সুবল কীসের শব্দে জেগে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ওর হাত জেবের ভিতর, পাখিটা পোষা এবং ভালোবাসার পাখিটা কী করছে দেখতে থাকল। চারিদিকে কোলাহল। ট্রেন বড় একটা স্টেশনে থেমে আছে। কেবল ফুঁসছে ট্রেনটা, সে জানালাতে মুখ রাখতেই দেখল, দেহাতি মানুষগুলো সারা রাস্তায় ট্রেন আটকে জল শুষে নিয়েছে, সেই মানুষগুলো স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে। গোটা স্টেশনে একদল পুলিশ। দেখলে মনে হবে না ওদের এই মানুষগুলো সম্পর্কে কোনও কৌতূহল আছে। নির্বিকারভাবে যেন একদল বন্য মানুষকে ঘেরাও করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সবাই পালাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু হাতে বন্দুক, কিছু ফাঁকা আওয়াজ ওদের সন্ত্রস্ত করছিল।
সুবল এবার দ্রুত নেমে যাবার জন্য দরজা টানতেই দেখল দরজা খুলছে না। সে এবার কামরার ভিতরটা দেখল। এত কোলাহলের ভিতরও টুকুন এবং টুকুনের মা—বাবা অঘোরে ঘুমুচ্ছে। সে ভেবে পেল না এখন কী করবে! সে পুলিশের ভয়ে, নিশ্চয়ই ওরা এসে দরজা খুলে ওকে ধরে নিয়ে যাবে, সে কী করবে ভেবে পেল না! নিশ্চয়ই ওরা এসে ওর হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে নামাবে। ওর ভয়ে কান্না পাচ্ছিল প্রায়।
ঠিক তখন টুকুন জেগে গেছে। এই সব শব্দে, টুকুন জেগে দেখল, সুবল দরজা খুলতে পারছে না। টুকুন বাবাকে দেখেছিল দরজা লক করে দিতে। সুতরাং সুবল দরজা খুলতে পারছে না। সে সুবলকে কিছু বলার জন্য উঠে বসতেই জানালায় দেখতে পেল একজন পুলিশ ওদের কামরার দিকে ছুটে আসছে। প্ল্যাটফরমে হইচই। মানুষের ছোটাছুটি, এবং কান্না। যারা জল চুরি করেছিল অথবা লুট করেছিল তাদের এখন ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। টুকুন ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই ডাকল সুবল, সুবল। দরজা খুলবে না। দরজা খুললে ওরা ঢুকে পড়বে ঘরে।
সুবল বলল, আমাকে ওরা ধরে নিয়ে যাবে!
টুকুন বলল, তাড়াতাড়ি এদিকে এসো সুবল। বলে, সে বাংকের নীচে সুবলকে ঢুকিয়ে দিল। তারপর লম্বা চাদর দিয়ে পর্দার মতো একটা আড়াল সৃষ্টি করে সুবলকে অদৃশ্য করে দিল।
সুবল সব পোঁটলাগুলো শিয়রের দিকে রেখে দিল। জেবের ভিতর পাখিটা আছে, সুতরাং সুবল পাখিটাকে একটু আলগা করে রেখে দিল পাশে। পাখিটা এখন প্রায় জড় পদার্থের মতো যেন শীতে ভয়ানক কষ্ট পাচ্ছে অথবা পাখিটার ঘুম পাচ্ছিল বোধহয়—খুব জড়সড়ো হয়ে সুবলের শিয়রে বসে রয়েছে। টুকুন তার বিছানার চাদরটা নীচে ঝুলিয়ে দিয়েছে। টুকুন রুগণ এবং দুর্বল। টুকুন কোনওরকমে উঠে বসল এবং চাদর ঠিক মেঝের সঙ্গে মিলে আছে কিনা, সুবলের হাত পা এবং অন্য কোনও অংশ বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে কিনা দেখবার জন্য উঠে দাঁড়াল। টুকুন বড় দুর্বল, ক্ষীণকায়। সিল্কের দামি ফ্রক গায়ে ঢল ঢল করছে। শুধু সামান্য মুখে সতেজ সুন্দর চোখ কালো জলের মতো গভীর মনে হয়, বেদনার চিহ্ন এই চোখে। দরজায় ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে। টুকুন কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। মা এবং বাবা শেষ রাতের ঠান্ডা বাতাসটুকু পেয়ে অঘোরে ঘুমুচ্ছেন। সুতরাং টুকুন নিজে ধীরে ধীরে উঠে গেল এবং দরজা খুলে দিল—লম্বা এক পুলিশের মুখ, গোটা দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
টুকুন খুব আস্তে আস্তে বলল, কেউ নেই।
—কেউ তোমাদের কামরায় ঢুকে লুকিয়ে নেই তো?
—না।
—বড় জালাতন করছে এইসব দেহাতি মানুষগুলো।
টুকুন কোনও জবাব দিল না। কারণ বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তার শরীর এত দুর্বল যে, মনে হচ্ছিল মাথা ঘুরে নীচে পড়ে যাবে। সে পুলিশের কথা প্রায় শুনতে পাচ্ছিল না। এটা প্রথম শ্রেণী, ওরা প্রথম শ্রেণীর যাত্রী। পুলিশের গার্ড এসেছিল, স্টেশনমাস্টার এসেছিল, ওদের কামরাতে এইসব দেহাতি মানুষগুলো উপদ্রব করে গেছে কিনা, অথবা কোনও দুর্ঘটনার জন্য এই দেহাতি মানুষগুলো দায়ী কিনা অনুসন্ধানের চেষ্টায় আছে।
টুকুন এবার শক্ত গলায় বলল, এ ঘরে কেউ আসেনি গার্ডসাহেব। বলে, সে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর বাংকে কোনোক্রমে ছুটে গিয়ে শুয়ে পড়ল। আর অবাক টুকুন, কী বিস্ময় টুকুনের, আজ প্রথম কতদিন পর সে নিজে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তে পেরেছে। সে কতদিন পর নিজের পায়ের উপর ভর করে দাঁড়াতে পেরেছে। সে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। মা—বাবা ঘুমুচ্ছেন। মা—বাবা দেখতে পেলেন না টুকুন নিজে উঠে বসেছে এবং নিজে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছে। দরজা বন্ধ করেছে।
সে মা—বাবাকে ডাকেনি, কারণ মা—বাবা হয়তো ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দিয়ে সব বলে দিতেন। হ্যাঁ, এসেছিল, সুবল এক পাখিয়ালা, সে পাখিয়ালা এসেছিল দলবল নিয়ে, সে তার দলবল নিয়ে এই ঘরের শেষ জলটুকু নিঃশেষ করে গেছে। মাকে হয়তো বোঝাতেই পারত না, সুবল এক পাখিয়ালা এসে টুকুন নামে এক রুগণ স্থবির বালিকার পায়ে শক্তি সঞ্চার করতে সাহায্য করেছে। টুকুন মাকে বাবাকে তার এই বিস্ময় দেখানোর জন্য ডাকল, মা, মা!
সে ডাকল, বাবা, বাবা!
ট্রেন চলছে। ভোর হয়ে আসছে। জানালা দিয়ে আবার বড় মাঠ দেখা যাচ্ছে। ট্রেনের তার দেখা যাচ্ছে। পাখিরা ভোরের আলোতে উড়ে যাচ্ছিল। এই মাঠ দেখলে এখন আর কোনও জলকষ্টের কথা মনে পড়ছে না। কিছুটা সবুজ আভা এখন দেখা যাচ্ছে। গ্রামে মানুষের চালাঘর, গোরুবাছুর এবং মাঠে সামান্য শস্য দেখা যাচ্ছিল। টুকুন খুব ধীরে ধীরে তখনও ডাকছে, মা, বাবা, দেখো দেখো। মা, বাবা, ওঠো ওঠো। দেখো তোমরা, তোমরা দেখো, টুকুন শুয়ে নিজের মায়ের ওপর কোমল হাত রাখল।