না না, গহনাগুলো যে পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত!
অদ্ভুত এক পরিস্থিতিতে পাওয়া গেল। মুক্তকেশীর সেই তেরঙ্গের মধ্যেই পড়ে গিয়েছিল কাপড়াচোপরের খাজে।
হয়তো গহনার বাক্সটায় চাবি দেওয়া হয় নি! হয়তো অসাবধানে কোনো সময় উপুড় হয়ে পড়ে গিয়েছিল বাক্সটা।
ঠিক ঠিক সবই পাওয়া গেল।
স্বাস্থ্যবতী সুবৰ্ণলতার দরুণ গায়ে বড় জরির কলকা বসানো মখমলের জামা আর বেগুনী ড়ুরে ভারী জরিদার বেনারসী পরে, সর্বাঙ্গে ঢলঢলে গহনা ঝলমলিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেল বিরাজ, চোখের জলে ভাসতে ভাসতে।
যাবার আগে গোপনে সুবৰ্ণলতার হাত ধরে কেঁদে বলেছিল, এতদিন তোমায় চিনতে পারি নি মেজবৌ, কত লাঞ্ছনার কারণ হয়েছি! তুমি দেবী।
সুবৰ্ণর চোখেও জল ছিল বৈকি। চোখে জল আর মুখ হাসি নিয়ে বলেছিল, যাক, একজন তবু চিনলে আমায়! তবু মনে জানবো ভূ-ভারতে এসে একটু সার্থক হলাম। তা মনে কি আর রাখবে মেজবৌকে? যা সোন্দর বর হল! পৃথিবীই ভুলে যাবে!
১.০৭ মুক্তকেশীর ছোট দুই ছেলে
মুক্তকেশীর ছোট দুই ছেলে যে রোজগারী হয়ে উঠেছে তা নয়, প্রভাস তো এখনো পড়ুয়া ছেলে, ল পড়ছে, আর প্রকাশ পাড়ার সখের থিয়েটারে হিরোইনের। পাকা পোস্টটা পেয়ে সুখে মহলা দিচ্ছে।
তবু মেয়ের বিয়ের পর ছেলেদের বিয়ের চিন্তায় আর বিলম্ব করলেন না মুক্তকেশী। মেয়ের বিয়ের জন্যই আটকে ছিলেন এযাবৎ। আর থাকেন? দুই ছেলের বিয়ের জন্যেই তোড়জোড় লাগান।
খবরটা শুনে উমাশশীর কাছে সেই কথাটা বলে বসলো সুবৰ্ণলতা। যে কথার জন্যে খণ্ডপ্ৰলয় ঘটে গেল।
তা সুবৰ্ণলতার জীবনটা নিরীক্ষণ করে দেখলে আগাগোড়াই তো শুধু ওই খণ্ডপ্রলয়। সুবৰ্ণলতা একটা কিছু বেফাঁস কথা বলে বসে, আর সংসারে। তুমুল কাণ্ড ঘটে।
মনে হয় এবার বুঝি একটা কিছু করে বসবে সুবৰ্ণলতা! কিন্তু নাঃ, আবার দেখা যায় সুবৰ্ণলতার তার দীর্ঘ সুন্দর দেহটা নিয়ে সংসারে চরে বেড়াচ্ছে, কাজ করছে, কর্তব্য করছে।
বোঝা যায় না। সুবৰ্ণলতা এই সেদিন গভীর রাতে বিনিদ্র চোখে মৃত্যুর যত রকম উপায় আছে তা নিয়ে ভেবেছে। বোঝা যায় না। সব সময় মরতে ইচ্ছে হয় ওর। কিন্তু কেন?
চিত্ৰগুপ্ত বুঝতে পারে নি, বুঝতে পারে নি। সুবৰ্ণলতার বিধাতাপুরুষ। হয়তো বা সুবৰ্ণলতা নিজেও পারে না।
বুঝতে পারে না নিজেই সে সোধে দুঃখু ডেকে আনে। নইলে কী দরকার ছিল সুবর্ণর বড় জায়ের কাছে শাশুড়ীর বুদ্ধির ব্যাখ্যা করবার? বলে বসবার দরকারটা কী ছিল, মার যেমন বুদ্ধি! ছোট ঠাকুরপোর আবার বিয়ে! গোপ কামিয়ে কামিয়ে মেয়ে সেজে সেজেই যার জীবন যাচ্ছে! দিতে হয় তো একটা বেটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া উচিত ওর!
বলা বাহুল্য, কথাটা চাউর হতে দেরি হল না। তিন বছরে টেপু। মহোৎসাহে বলে বেড়াতে লাগল, মেজ খুড়িমা বলেছে, ছোট কাকা তো মেয়েমানুষ, বেটাছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে ছোটকাকার!
বলা বাহুল্য, প্ৰলয় ঘটতেও দেরি হয় নি।
গোঁফ-কামানো মেয়েলী-গলা প্ৰকাশচন্দ্ৰ বীর্য-বিক্রমে লাফাইঝাঁপাই করতে থাকে মেয়েমানুষের আস্পর্ধার বিরুদ্ধে। বিদ্বান বিচক্ষণ প্রভাস চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে থাকে, উদ্দেশ্য আলাদা। আরও বৌ আসে বাড়িতে এটা ইচ্ছে নয়। নিজের যথেচ্ছাচারটা চলবে না ভেবে বাধ দিচ্ছেন। মনে হয়, মেজদার উচিত ওঁকে নিয়ে আলাদা বাস করা। নচেৎ ওঁর দৃষ্টান্তে নতুন যে বৌরা আসবে, তাদেরও মাথা বেঠিক হয়ে যাবে।
শুধু সুবোধই কথাটা শুনে হা হা করে হেসে উঠেছিল, বাড়ির মধ্যে মেজবৌমারই দেখছি একটু বুদ্ধিসুদ্ধি আছে। মা যে পেকার জন্যেও এক্ষুণি কনে খুঁজছেন, আমি তো ভাবতেই পারি নি!
তা সুবোধের অবশ্য সাতখুন মাপ। কারণ প্ৰবোধ আজকাল প্রচুর কাঁচা পয়সা রোজগার করলেও, এখনো গৃহকর্তা হিসেবে সমগ্র সংসারের ভাত-কাপড়ের দায়টা সুবোধই টেনে চলেছে। নিজের সারি সারি ছেলেমেয়েতে ঘর ভরে উঠলেও এদিকে কার্পণ্য করে না সে।
ভগবানও মুখ তুলেছেন, বড়বাবু হয়েছে সে।
তবে বাড়িতে মুক্তকেশীই বড়বাবুর বড়সাহেব সব। সুবোধের কথা ধর্তব্য করলেন না, ছেলেদের বিয়ে তিনি দিলেন। নগদ নিলেন, তত্ত্ব ঘরে তুললেন, এক কুটুমের নিন্দেয় শতমুখ এবং আর এক কুটুমের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন।
ওটাই মুক্তকেশীর রাজনীতি।
প্রথম থেকেই বিভেদ সৃষ্টি করে রাখা ভাল। নইলে জায়ে জায়ে একদল হলে পৃষ্ঠবল বাড়বে না! শাশুড়ীকে কি তাহলে গ্রাহ্য করবে?
তা মুক্তকেশীর নীতি কার্যকরী হয় বৈকি। নতুন বৌয়েরা আসার পর থেকেই সংসারের বায়ূমণ্ডলে উত্তাপের সঞ্চার হতে দেখা যায়। মুক্তকেশী সেই উত্তাপের সুযোগে একজনকে সুয়ো করে নেবার চেষ্টা করেন।
উকিল ছেলের বৌ-ই। ইদানীং সুয়ো হয়েছে। তাকে তোয়াজ করে চলেছেন মুক্তকেশী প্ৰায় নির্লজের মত।
কারণ?
কারণ পায়ের তলায় একটু শক্ত মাটির আশ্রয় খুঁজছেন মুক্তকেশী, যে মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়তে পারেন।
প্ৰতিপক্ষ?
আর কে?
দুৰ্দান্ত দুবিনীত মেজবৌ।
তার চোখের কোণে যেন চাপা আগুনের গানগনানি, তার ঠোঁটের কোণায় যেন ঔদ্ধত্যের ঝিলিক।
মুক্তকেশীর কাজে প্রতিবাদ করে বসে সে যখন-তখন।
তার উপর আবার বরটা তার উপায়ী হয়ে উঠেছে উত্তরোত্তর।
ওকে দাবাতে হলে শক্ত মাটিতে পা রাখতে হয়। অলিখিত আইনে সব ভাইরাই উকিল ভাইকে নিজেদের থেকে উচ্চাসনে বসিয়ে সমীহর চোখে দেখে আসছে, কাজেই সেই খুঁটিটাই ধরা ভাল।