চন্দ্রবিন্দু – কাজী নজরুল ইসলাম-এর লেখা একটি কবিতার বই। চন্দ্রবিন্দু বইটি প্রথম ১৯৩১ সালে ডিএম লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত হয়। নন্দ্রবিন্দু কাব্যগ্রন্থটি বেশ কয়েকটি কবিতা নিয়ে রচিত হয়েছে। বইটি আমরা সংগ্রহ করে আপনাদের সুবিধার্থে এখানে সংরক্ষণ করেছি।
চন্দ্রবিন্দু বইয়ের বিবরণঃ
- বইয়ের নামঃ চন্দ্রবিন্দু
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আজি শৃঙ্খলে বাজিছে মাভৈঃ – বরাভয়
ইমন – কাওয়ালি
আজি শৃঙ্খলে বাজিছে মাভৈঃ – বরাভয়।
এ যে আনন্দ-বন্ধন, ক্রন্দন নয়॥
ওরে নাশিতে সবার এই বন্ধন-ত্রাস,
মোরা শৃঙ্খল ধরি তারে করি উপহাস,
সহি নিপীড়ন – পীড়নের আয়ু করি হ্রাস,
এ যে রুদ্র-আশীর্বাদ – লৌহবলয়॥
মোরা অগ্র-পথিক অনাগত দেবতার,
এই শৃঙ্খল বন্দিছে চরণ তাহার,
শোন শৃঙ্খলে তাঁর আগমনি-ঝংকার!
হবে দৈত্যকারায় নব অরুণ উদয়॥
আজি পূর্ণশশী কেন মেঘে ঢাকা
পিলু বারোয়াঁ – ঠুংরি
আজি পূর্ণশশী কেন মেঘে ঢাকা।
মোরে স্মরিয়া রাধিকাও হল কি বাঁকা॥
কেন অভিমান-শিশিরে মাখা কমল,
কাজল-উজল-চোখে কেন এত জল,
লহো মুরলী হরি লহো শিখী-পাখা॥
আদি পরম বাণী, ঊর বীণাপাণি
আদি পরম বাণী, ঊর বীণাপাণি।
আরতি করে তব কোটি কোবিদ জ্ঞানী।।
হিমেল শীত গত, ফাল্গুন মুঞ্জরে,
কানন-বীণা বাজে সমীর-মরমরে।
গাহিছে মুহু মুহু আগমনী কুহু,
প্রকৃতি বন্দিছে নব কুসুম আনি।।
মূক ধরণী করে বেদনা-আরতি,
বাণী-মুখর তারে করো মা ভারতী!
বক্ষে নব আশা, কণ্ঠে নব ভাষা
দাও মা, আশিস্ যাচে নিখিল প্রাণী।।
শুচি রুচির আলো-মরাল-বাহিনী
আনিলে আদি জ্যোতি, সৃজিলে কাহিনী।
কণ্ঠে নাহি গীতি, বক্ষে ত্রাস-ভীতি,
করো প্রবুদ্ধ মা, বর অভয় দানি।।
ব্রহ্মবাদিনী আদিম বেদ-মাতা!
এসো মা, কোটি-দল হৃদি-আসন পাতা।
অশ্রুমতী মা গো, নব-বাণীতে জাগো,
রুদ্ধ দ্বার খোলো সাজিয়া রুদ্রানী।।
আমার সকলই হরেছে হরি
আশাবরি – কাওয়ালি
আমার সকলই হরেছে হরি
এবার আমায় হরে নিয়ো।
যদি সব হরিলে নিখিল-হরণ
এবার ওই চরণে শরণ দিয়ো॥
আমায় ছিল যারা আড়াল করে,
হরি তুমি নিলে তাদের হরে,
ছিল প্রিয় যারা গেল তারা,
হরি এবার তুমিই হও হে প্রিয়॥
আমি তুরগ ভাবিয়া মোরগে চড়িনু
হিতে বিপরীত
কীর্তন
আমি তুরগ ভাবিয়া মোরগে চড়িনু
সে লইল মিয়াঁর ঘরে।
আমার কালি-মা ছাড়ায়ে কলেমা পড়ায়ে
বুঝি মুসলিম করে!
আঁখর : আমায় বুঝি মুসলিম করে গো!
শেষে আস্ত ধরিয়া গোস্ত খাওয়ায়ে –
মামদো করিবে গোরা গো!
আমার টিকি করি দূর রেখে দেবে নূর
জবাই করিবে পরে গো॥
আমি বাসব ভাবিয়া রাসভে পূজিনু
স্বর্গে যাইতে সোজা,
সে যে লয়ে এঁদো ঘাটে, ফেলে দিল পাটে
ভাবিয়া ধোবির বোঝা!
আঁখর : হল হিতে বিপরীত সবই গো!
আমি ভবানী ভাবিয়া করিতে প্রণাম
হেরি বাগদিনি ভবি গো
আমি শীতল হইতে চাহিনু, আনিল
শীতলা-বাহনে ধোবি গো॥
বাবা শিবের বাহন ভাবিয়া বৃষভ-
লাঙুল ঠেকানু ভালে,
হায় নিল না সে পূজা, শিং দিয়ে সোজা
গুঁতায়ে ফেলিল খালে!
আঁখর : আমার কপাল বেজায় ফুটো গো!
আমি জগন্নাথ হেরিতে হেরিনু
ধবল-কুষ্ঠী ঠুঁটো গো!
বাঁকা অঙ্গ হেরিয়া জড়ায়ে ধরিতে
হেরি ত্রিভঙ্গ খুঁটো গো॥
মোর মহিষী গৃহিণী খুশি হবে ভেবে
মহিষ কিনিয়া আনি!
বাবা মরি এবে ত্রাসে, শিং নেড়ে আসে
মহিষ, মহিষী রানি!
আঁখর : আমি কেমনে জীবন ধরি গো!
আমি ‘হরি বোল’বলে ডাকিতে হরি-রে!
হয়ে যায় ‘বলো হরি’গো॥
আমি দেখেছি তোর শ্যামে (প্রতিদ্বন্দ্বী)
প্রতিদ্বন্দ্বী
বাউল
আমি দেখেছি তোর শ্যামে
দেখেছি কদম-তলা,
আমি দেখেছি তোর অষ্টাবক্রের
আঁকাবাঁকা চলা
তার যত ছলাকলা।
দেখেছি কদম-তলা॥
তুই মোর গোয়ালের ছিঁড়ে দড়ি
রাত-বিরেতে বেড়াস চরি,
তুই রাখাল পেয়ে ভুলে গেছিস
আয়ান-ঘোষের রলা!
দেখেছি কদম-তলা॥
আমি ভাই খ্যাপা বাউল, আমার দেউল
বাউল
আমি ভাই খ্যাপা বাউল, আমার দেউল
আমারই এই আপন দেহ।
আমার এ প্রাণের ঠাকুর নহে সুদূর
অন্তরে মন্দির-গেহ।
সে থাকে সকল সুখে সকল দুখে
আমার বুকে অহরহ,
কভু তায় প্রণাম করি, বক্ষে ধরি,
কভু তারে বিলাই স্নেহ॥
ভুলাইনি আমারই কুল,
ভুলেছে নিজেও সে কুল,
ভুলে বৃন্ -দাবন গোকুল
(তার) মোর সাথে মিলন-বিরহ।
সে আমার ভিক্ষা-ঝুলি কাঁধে তুলি
চলে ধূলি- মলিন পথে,
নাচে গায় আমার সাথে একতারাতে,
কেউ বোঝে বোঝে না কেহ॥
এসো এসো তব যাত্রা-পথে
টোরি – কাওয়ালি
এসো এসো তব যাত্রা-পথে
শুভ বিজয়-রথে
ডাকে দূর সাথি।
মোরা তোমার লাগি হেথা রহিব জাগি
তব সাজায়ে বাসর জ্বালি আশায় বাতি॥
হেরো গো বিকীর্ণ শত শুভ চিহ্ণ
পথ-পাশে নগর-বাটে,
সবৎসা ধেনু গোখুর-রেণু
উড়ায়ে চলে দূর মাঠে।
দক্ষিণ-আবর্তবহ্ণি,
পূর্ণঘট-কাঁখে তন্বী।
দোলে পুষ্পমালা, ঝলে শুক্লা রাতি॥
হেরো পতাকা দোলে দূর তোরণ-তলে,
গজ তুরগ চলে।
শুক্লা ধানের হেরো মঞ্জরী ওই,
এসো কল্যাণী গো
আনো নব প্রভাতি॥
ওই পথে চেয়ে থাকি
খাম্বাজ-পিলু – কারফা
ওই পথে চেয়ে থাকি
আর কত বনমালি!
করে কানাকানি লোকে,
দেয় ঘরে-পরে গালি॥
মোর কুলের বাঁধন খুলে
হায় ভাসালে অকূলে
শেষে লুকালে গোকুলে
এ কী রীতি চতুরালি॥
ওহে রাখাল-রাজ
বাউল
ওহে রাখাল-রাজ!
কী সাজে সাজালে আমায় আজ।
আমার ঘরের ভূষণ কেড়ে নিয়ে
দিলে চির-পথিক সাজ॥
তোমার পায়ের নূপুর আমায় দিয়ে
ঘুরাও পথে ঘাটে নিয়ে,
বেড়াই বাউল একতারা বাজিয়ে হে,
তোমার ভুবন-নাটে নেচে বেড়াই
ভুলে শরম ভরম লাজ॥
তোমার নিত্য-খেলার নৃত্য-সাথি
আনন্দেরই গোঠে হে,
জীবন-মরণ আমার সহজ –
চরণতলে লোটে হে!
আমার হাতে দিলে সর্বনাশী
ঘর-ভুলানো তোমার বাঁশি,
কাজ ভুলাতে যখন তখন আসি হে,
আমার আপন ভবন কেড়ে – দিলে
ছেড়ে বিশ্বভুবন-মাঝ॥
কারা-পাষাণ ভেদি জাগো নারায়ণ
দরবারি কানাড়া – গীতাঙ্গী
কারা-পাষাণ ভেদি জাগো নারায়ণ।
কাঁদিছে বেদি-তলে আর্ত জনগণ,
বন্ধ-ছেদন জাগো নারায়ণ॥
হত্যা-যূপে আজি শিশুর বলিদান,
অমৃত-পুত্রেরা মৃত্যু-ম্রিয়মাণ!
শোণিত-লেখা জাগে – নাহি কি ভগবান?
মৃত্যুক্ষুধা জাগে শিয়রে লেলিহান!
শঙ্কানাশন জাগো নারায়ণ॥
কুসুম-সুকুমার শ্যামল-তনু
সিন্ধু-কাফি – কারফা
কুসুম-সুকুমার শ্যামল-তনু
হে বন-দেবতা, লহো প্রণাম।
বিটপী লতায় চিকন পাতায়
ছিটাও হাসি কিশোর শ্যাম॥
ঘনায় মায়া তোমার কায়া
কাজল-কালো ছায়া-শীতল,
পরিমল-সুরভিত কুন্তল
ময়ূর কুরঙ্গে হয়ে খেলো সঙ্গে,
চরণ-ভঙ্গে ফোটে শাখে ফুলদল।
কুহরে কোকিল পাগল গো
নয়নাভিরাম হে চির-সুন্দর,
রচিলে ধরায় অমর ধাম॥
কে যাবি পারে আয় ত্বরা করি
পিলু – কাহারবা
কে যাবি পারে আয় ত্বরা করি,
তোর খেয়া-ঘাটে এল পুণ্য-তরি॥
আবু-বকর, উমর, উসমান, আলি হাইদর,
দাঁড়ি এ সোনার তরণির, পাপী সব নাই নাই আর ডর,
এ তরির কান্ডারি আহমদ, পাকা সব মাঝি ও মাল্লা,
মাঝিদের মুখে সারিগান শোন ওই–লাশরীক্ আল্লাহ্!
মোরা নরক-আগুনে আর নাহি ডরি॥
শাফায়ত -পাল ওড়ে তরির অনুকূল হাওয়ার ভরে,
ফেরেশ্তা টানিছে তার গুন, ভিড়িবে বেহেশ্তি-চরে।
ইমানের পারানি কড়ি আছে যার আয় এ সোনার নায়,
যাবি চল পারের পথিক কলেমার জাহাজ-ঘাটায়।
ফিরদউস হতে ডাকে হুরি-পরি॥
কেঁদে যায় দখিন-হাওয়া ফিরে ফুল-বনের গলি
সিন্ধু-কাফি – ঠুংরি
কেঁদে যায় দখিন-হাওয়া ফিরে ফুল-বনের গলি,
‘ফিরে যাও চপল পথিক’, দুলে কয় কুসুম-কলি।
দুলে দুলে কয় কুসুম কলি॥
ফেলিছে সমীর দীরঘশ্বাস – আসিবে না আর এ মধুমাস,
কহে ফুল, ‘জনম জনম এমনই গিয়াছ ছলি।
জনম জনম গিয়াছ ছলি’॥
কহে বায়, ‘রজনি-ভোরে বাসি ফুল পড়িবে ঝরে’,
কহে ফুল, ‘এমনই করে আমি ফুল-চোরেরে দলি,
এমনই কুসুম-চোরেরে দলি॥’
কাঁদে বায়, ‘নিদাঘ আসে আমি যাই সুদূর বাসে’,
ফোটে ফুল হাসিয়া ভাষে, ‘প্রিয়তম, যেয়ো না চলি।
ওগো প্রিয়তম, যেয়ো না চলি’॥
কেন আসে কেন তারা চলে যায়
খাম্বাজ – মধ্যমান
কেন আসে কেন তারা চলে যায় –
ক্ষণেক তরে॥
কুসুম না ফুটিতে কেন ফুল-মালী
ছিঁড়িয়া সাজি ভরে কানন করে খালি,
কাঁটার স্মৃতি বেঁধে লতার বুকে হায়,
ব্যথা-ভরে॥
ছাড়িয়া স্নেহ-নীড় সুদূর বন-ছায়
বিহগশিশু কেন সহসা উড়ে যায়,
কাঁদে জননি তার ঝরা পালকখানি
বুকে ধরে॥
কেন করুণ সুরে হৃদয়-পুরে
দেশ-সুরাট – একতালা
কেন করুণ সুরে হৃদয়-পুরে
বাজিছে বাঁশরি।
ঘনায় গহন নীরদ সঘন
নয়ন মন ভরি॥
বিজলি চমকে পবন দমকে
পরাণ কাঁপে রে,
বুকের বঁধুরে বুকে বেঁধে ঝুরে
বিধুরা কিশোরী॥
ঘোর ঘনঘটা ছাইল গগন
কাজরি –হোরি-ঠেকা
ঘোর ঘনঘটা ছাইল গগন।
ভুবন গভীর বিষাদ-মগন॥
বারিধারে কাঁদে চারিধার আজি,
শ্বসিয়া শ্বসিয়া ঝুরিছে পবন॥
নাহি রবি-শশী নাহি গ্রহ-তারা,
নিখিল নয়নে শ্রাবণের ধারা,
বিশ্ব ডুবাল গো শোকের প্লাবন॥
চলো মন আনন্দধাম
ভৈরবী ভজন – দাদরা
চলো মন আনন্দধাম!
চলো মন আনন্দধাম রে
চলো আনন্দধাম॥
লীলাবিহার প্রেমলোক
নাই রে সেথা দুঃখ-শোক,
সেথা বিহারে চির-ব্রজবালক
বনশিওয়ালা শ্যাম রে
চলো আনন্দধাম॥
আবাঙ্মনস-গোচরম্ –
নাহি চরাচর নাহি রে ব্যোম,
লীলা-সাথি গ্রহ রবি ও সোম
সংগীত – ওম্ নাম রে
চলো আনন্দধাম॥
ছুঁচোর কীর্তন
ছুঁচোর কীর্তন
কীর্তন গায় ছুচুন্দর,
হুতুম প্যাঁচা বাজায় খোল।
ছাতার পাখি দোহার গায়
গোলেমালে হরিবোল॥
কিচির-মিচির কিচির-কিচ
ইঁদুর বাজায় মন্দিরা,
তানপুরা ওই বাজায় ব্যাং
ওস্তাদের সম্বন্ধীরা।
শালিক বায়স ভক্তদল
হরিবোলের লাগায় গোল॥
হুলো বেড়াল মিয়াঁও ম্যাঁও
করছে শুরু খেয়াল-গান,
ব্যা-এ্যা-এ্যা-এ্যা পুং অজ
মারছে জলদ হলক-তান।
রাসভ গলা ভাঙল তার
ধ্রুপদ গেয়ে খেয়ে ঘোল॥
টপ্পা-গানের ঝাড়ছে তান
চিঁহিঁহিঁচিঁহিঁহিঁ অশ্বরাজ,
ঠুংরি-গানের ঝটকা-তান
মারছে ফড়িং ঝোপের মাঝ।
খাণ্ডারবাণী ধ্রুপদ গায়
বলদ গিয়ে পিঁজরাপোল॥
লেড়ি কুকুর বাউল গায়
পুচ্ছ তুলি উচ্চ মুখ,
ভাটিয়ালি গান শেয়াল গায়
ভীষণ শীতের ভুলতে দুখ।
গাব-গুবাগুব ‘কুক’পাখি
বাজায়, ভুতুম বাজায় ঢোল॥
ধরা গলায় মহিষ গায়
যেন বুড়ো খাঁ সায়েব,
কাবলিওয়ালা বেহাগ গায়
‘মোর মগায়া’খেয়ে শেব।
ভেড়া বলে, ‘কণ্ঠ মোর
গেছে ধরে খেয়ে ওল!’
জন্তুর মাঝে ভাই উট – খিচুড়ি
খিচুড়ি জন্তু
মালবশ্রী – কাওয়ালি
জন্তুর মাঝে ভাই উট – খিচুড়ি!
মদ খেয়ে সৃজিয়াছে স্রষ্টা-শুঁড়ি॥
দো-তালার উঁচু আর তে-তালার ফাঁক –
ঢিমে তে-তলার ফাঁক,
অষ্টাবক্রীয় দশটা বাঁক,
হামা দিয়ে চলে যেন তাড়কা খুড়ি॥
জিরাফের গলা তার ঘোটকিনী মুখ,
আগাগোড়া গোঁজামিল বাঁদুরে ভালুক,
গাড়িকে এ গাড়ি বাবা জুড়িকে জুড়ি॥
লাগিয়াছে দেহে গজ-কচ্ছপ রণ,
কচ্ছপি পিঠ আর গজ-নি চরণ,
আরবের হাজি মিয়াঁ – বাপ রে থুড়ি॥
জবাকুসুমসঙ্কাশ ওই উদার অরুণোদয়
ভজন – একতালা
জবাকুসুমসঙ্কাশ ওই
উদার অরুণোদয় ।
অপগত তমোভয়।
জয় হে জ্যোতির্ময়॥
জননির সম স্নেহসজল
নীল গাঢ় গগনতল,
সুপেয় বারি প্রসূন-ফল
তব দান অক্ষয়।
অপহত সংশয়।
জয় হে জ্যোতির্ময়॥
জাগো জাগো শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম-ধারী
বাগেশ্রী – চৌতাল
জাগো জাগো শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম-ধারী!
কাঁদে ধরিত্রী নিপীড়িতা, কাঁদে ভয়ার্ত নরনারী॥
আনো আরবার ন্যায়ের দণ্ড
দৈত্য-ত্রাসন ভীম প্রচণ্ড,
অসুর-বিনাশী উদ্যত অসি, ধরো ধরো দানবারি॥
ওই বাজে তব আরতি বোধন
কোটি অসহায় কণ্ঠে রোদন!
ব্যথিত হৃদয়ে ফেলিয়া চরণ
বেদনা-বিহারী এসো নারায়ণ!
রুদ্ধ কারার অন্ধ প্রাকার-বন্ধন অপসারি॥
জাগো বধূ জাগো নব বাসরে
ভৈরবী – আদ্ধা-কাওয়ালি
জাগো –
জাগো বধূ জাগো নব বাসরে।
গৃহ-দীপ জ্বালো কল্যাণ-করে॥
ভুবনের ছিলে, এলে ভবনে,
স্বপন হতে এলে জাগরণে,
শ্রী-মতী আসিলে শ্রী-হীন ঘরে॥
স্বপন-বিহারিণী অকুণ্ঠিতা,
পরিলে গুণ্ঠন সলাজ ভীতা,
কমলা আসিলে কাঁকন পরে॥
জাগো হে রুদ্র, জাগো রুদ্রাণী
যোগিয়া -– একতালা
জাগো হে রুদ্র, জাগো রুদ্রাণী,
কাঁদে ধরা দুখ-জরজর!
জাগো গৌরী, জাগো হর॥
আজি শস্য-শ্যামা তোদের কন্যা
অন্নবস্ত্রহীনা অরণ্যা,
সপ্তসাগর-অশ্রু-বন্যা
কাঁপিছে বুকে থরথর॥
আর সহিতে পারি না অত্যাচার,
লহো এ অসহ ধরার ভার।
গ্রাসিল বিশ্ব লোভদানব,
হা হা স্বরে কাঁদিছে মানব,
জাগো ভৈরবী জাগো ভৈরব
ত্রিশূল খড়্গ ধরো ধরো॥
জয় বাণী বিদ্যাদায়িনী
খাম্বাজ – একতালা
জয় বাণী বিদ্যাদায়িনী।
জয় বিশ্বলোক-বিহারিণী॥
সৃজন-আদিম-তমো অপসারি
সহস্রদল কিরণ বিথারি
আসিলে মা তুমি গগন বিদারি
আলোক-মরাল-বাহিনী॥
ভারতে ভারতী মূক তুমি আজি,
বীণাতে উঠিছে ক্রন্দন বাজি,
ছিন্ন চরণ-শতদলরাজি
কহিছে পীড়ন-কাহিনি॥
ঊর মা আবার কমলাসীনা,
করে ধরো পুন সে রুদ্রবীণা,
নব সুর তানে বাণী পরাধীনা
জাগাও অমৃত-ভাষিণী॥
জয় মর্ত্যে অমৃতবাদিনী চির-আয়ুষ্মতী
ইমন – কাওয়ালি
জয় মর্ত্যে অমৃতবাদিনী চির-আয়ুষ্মতী
জয় নারী-রূপা দেবী পুণ্যশ্লোকা সতী॥
জয় অগ্নিহোত্রী অয়ি দীপ্তা উগ্রতপা জ্যোতির্ময়ী।
জয় সুরলোক-বাঞ্ছিতা, সতী মহিমার গীতা, মৃত্যুজয়ী।
জয় সীমন্তে নবারুণ, ধরণির অরুন্ধতী॥
চির-শুদ্ধাচারিণী চির-পবিত্রা সুমঙ্গলা!
চির-অবৈধব্য-যুতা তুমি চিরপূজ্যা মা, নহ অবলা।
মা গো যুগে যুগে চির-ভাস্বর তুমি উদীচী জ্যোতি॥
তব সীমান্ত-সিন্দূর মাগে, মা গো, বিশ্ব-বধূ;
মা গো মৃত্যুঞ্জয়ী তব তপস্যা দাও, দাও আশিস-মধু!
সব কন্যা জায়া যাচে তব বর, করে প্রণতি॥
ডুবল ফুটো ধর্ম-তরি (সর্দা-বিল)
সর্দা-বিল
ডুবল ফুটো ধর্ম-তরি
ফাটল মাইন সর্দার।
উঠল মাতম ‘সামাল সামাল
ব-মাল মেয়ে-মর্দার॥
১
এ কোন এল বালাই, এবে
পালাই বল কোন দেশ।
গাছের তলায় ঘড়েল শেয়াল,
কাকের মুখে সন্দেশ!
কন্যা-ডোবা বন্যা এল,
ডুবল বুঝি ঘর-দ্বার॥
২
আয়েশ করে বিয়ের মেয়ের
বাড়বে বয়সে চৌদ্দ,
বাপের বুকের তপ্ত খোলায়,
দিব্যি গেয়ান-বোধ তো!
হদ্দ হলেন বউদি ভেবে,
ছাড়ল নাড়ি বড়দার॥
৩
শূন্য স্বর্গ-মার্গে যেত
গৌরীদানের মারফত
যমের যমজ জামাতৃকে
লিখে দিয়ে ফারখত
নৈকষ্য কস্য এখন,
জাত গেল ‘মেল খড়দা’র॥
৪
দেব্তা বুড়ো শিব যে মাগেন
আট-বছরি নাতনি,
চতুর্দশী মুক্ত-কেশী–
কনে নয়, সে হাথনী!
পুঁটুলি নয়, এঁটুলি সে,
কিংবা পুলিশ-সর্দার॥
৫
সিংগি চড়া ধিঙ্গি মেয়ে
বউ হবে কি, বাপ রে!
প্রথম প্রণয়-সম্ভাষণেই
হয়তো দেবে থাপড়ে।
লাফ দিয়ে সে বাইরে যাবে
ঝাঁপ খুলে ওই পর্দার॥
৬
সম্বন্ধ ভুলে শেষে
যা তা বলে ডাকব?
বধূ তো নয়–যদুর পিসি!
কোথায় তারে রাখব!
ধর্মিনী নয়, জার্মানি-শেল!
গো-স্বামী! খবরদার!
৭
ঠাকুর ভাশুর মানবে নাকো,
রাখবে না মান দুর্গার
হয়তো কবে বলবে—‘পিয়ো,
ঝোল রেঁধেছি মুরগার’!
আনবে কে বাপ গুর্খা-সিপাই
দন্ত-নখর-বর্দার॥
৮
টাকাতে নয় ভাবনাতে শেষ
মাথাতে টাক পড়বে!
যোদ্ধা বামা গুটিয়ে জামা
কথায় কথায় লড়বে!
যেই পাবে না শেমিজ বডিস
কৌটো পানের জর্দার॥
৯
জাত মেরেছিস, ভেবেছিনু,
জাতিটা নয় যাক গে,
গৃহিনী-রূপ গ্রহণীরোগ
তাও ছিল শেষ ভাগ্যে!
দোক্তা ফেলে গিন্নি কাঁদেন,
কর্তা চলেন হরদ্বার॥
তিমির-বিদারী অলখ-বিহারী
ভৈরবী – আদ্ধা কাওয়ালি
তিমির-বিদারী অলখ-বিহারী
কৃষ্ণ মুরারি আগত ওই।
টুটিল আগল, নিখিল পাগল,
সর্বসহা আজি সর্বজয়ী॥
বহিছে উজান অশ্রুযমুনায়,
হৃদি-বৃন্দাবনে আনন্দ ডাকে, আয়,
বসুধা-যশোদার স্নেহধার উথলায়,
কাল-রাখাল নাচে থই তাথই॥
বিশ্ব ভরি ওঠে স্তব নমো নমঃ,
অরির পুরী-মাঝে এল অরিন্দম!
ঘিরিয়া দ্বার বৃথা জাগে প্রহরীজন,
কারার মাঝে এল বন্ধ-বিমোচন,
জাগিয়া ব্যথাহত ডাকে মাভৈঃ॥
তুই লুকাবি কোথায় মা কালী
রামপ্রসাদি
তুই লুকাবি কোথায় মা কালী!
আমার বিশ্বভুবন আঁধার করে
তোর রূপে মা সব ডুবালি॥
আমার সুখের গৃহ শ্মশান করে
বেড়াস মা তায় আগুন জ্বালি,
আমার দুঃখ দেওয়ার ছলে মা তোর
ভুবন-ভরা রূপ দেখালি॥
আমি পূজা করে পাইনি তোরে
এবার চোখের জলে এলি,
আমার বুকের ব্যথার আসন পাতা
বস মা সেথা দুখ-দুলালি॥
তুমি দুখের বেশে এলে বলে ভয় করি কি, হরি
বাউল
তুমি দুখের বেশে এলে বলে ভয় করি কি, হরি!
দাও ব্যথা যতই তোমায় ততই নিবিড় করে ধরি।
আমি ভয় করি কি হরি॥
আমি শূন্য করে তোমার ঝুলি
দুঃখ নেব বক্ষে তুলি,
আমার ব্যথা শোকের শতদলে তোমায় নেব বরি।
আমি ভয় করি কি হরি॥
তুমি আড়াল ভেঙে দাঁড়ালে মোর সকল শূন্য ভরি।
আমি ভয় করি কি হরি॥
তুষার-মৌলি জাগো জাগো গিরি-রাজ
সাজগিরি – ত্রিতালি
তুষার-মৌলি জাগো জাগো গিরি-রাজ!
পঙ্গু তোমারে আজি হানিতেছে লাজ॥
রুদ্র ও রুদ্রাণী অঙ্কে যাহার,
দৈত্য হরিছে আজ সম্মান তার।
হে মহা-মৌনী জাগো, পরো নব সাজ॥
স্বর্গ তোমার শিরে, পদতলে হায়,
আর্যাবর্ত কাঁদে চির-অসহায়!
মেঘ-লোক হতে হনো দৈত্যারি বাজ॥
তোর বিদায়-বেলার বন্ধুরে
জয়জয়ন্তী – একতালা
তোর বিদায়-বেলার বন্ধুরে
দেখে নে নয়ন পুরে।
সে যায় মিশে ওই কোন দূরে
বেলাশেষের শেষ সুরে॥
ঘুমের মাঝে বন্ধু তোর,
ছিঁড়বে বাহুর বাঁধন-ডোর!
যাবে নয়ন, রবে নয়ন-লোর,
যায় রে বিহগ যায় উড়ে॥
তুই বহাবি নদী কেঁদে, –
পাষাণে হৃদয় বেঁধে
তবু যেতে হবে তায়
অসহায় – অচিন পুরে॥
থাকিতে চরণ মরণে কী ভয়
কমিক গান
শ্রীচরণ ভরসা
সোহিনী – একতালা
কোরাস :
থাকিতে চরণ মরণে কী ভয়,
নিমেষে যোজন ফরসা।
মরণ-হরণ নিখিল-শরণ
জয় শ্রীচরণ ভরসা॥
গর্বের শির খর্ব মোদের?
চরণ তেমনই লম্বা!
শৈশব হতে আ-মরণ চলি
সবারে দেখায়ে রম্ভা।
সার্জেন্ট যবে আর্জেন্ট-মার
হাতে করে আসে তাড়ায়ে,
না হয়ে ক্রুব্ধ পদ প্রবুদ্ধ
সম্মুখে দিই বাড়ায়ে॥
কোরাস :
থাকিতে চরণ মরণ কী ভয়,
নিমেষে যোজন ফরসা।
মরণ-হরণ নিখিল-শরণ
জয় শ্রীচরণ ভরসা॥
বপু কোলা ব্যাং, রবারের ঠ্যাং,
প্রয়োজন মতো বাড়ে গো,
সমানে আঁদাড়ে বনে ও বাদাড়ে
পগারে পুকুরপাড়ে গো।
লখিতে চকিতে লঙ্ঘিয়া যায়
গিরি দরি বন সিন্ধু,
এই এক পথে মিলিয়াছি মোরা,
সম মুসলিম হিন্দু॥
কোরাস :
থাকিতে চরণ মরণে কী ভয়,
নিমেষে যোজন ফরসা!
মরণ-হরণ নিখিল-শরণ
জয় শ্রীচরণ ভরসা॥
কহিতেছে নাকি বিশ্ব, আমরা
রণে পশ্চাতে হেঁটে যাই?
পশ্চাৎ দিয়া ছুটে কেউ? হেসে
মরিব কি দম ফেটে, ছাই!
ছুটি যবে মোরা – সুমুখেই ছুটি,
পশ্চাতে পাশে হেরি না!
সামনে ছোটারে পিছু হাঁটা বল?
রাঁচি যাও, আর দেরি না॥
কোরাস :
থাকিতে চরণ মরণে কী ভয়,
নিমেষে যোজন ফরসা।
মরণ-হরণ নিখিল-শরণ
জয় শ্রীচরণ ভরসা॥
আমাদের পিছে ছুটিতে ছুটিতে
মৃত্যু পড়িবে হাঁপায়ে,
জিভ বার হয়ে পড়িবে যমের,
জীবন তখন বাঁ পায়ে!
মোরা দেব-জাতি ছিনু যে একদা,
আজ তার স্মৃতি চরণে,
ছুটি না তো, যেন উড়ে চলি নভে,
থাকে নাকো ধুতি পরনে॥
কোরাস :
থাকিতে চরণ মরণ কী ভয়,
নিমেষে যোজন ফরসা।
মরণ-হরণ নিখিল-শরণ
জয় শ্রীচরণ ভরসা॥
বাপ-পিতামোর প্রদর্শিত এ
পথ মহাজন-পিষ্ট,
গোস্বামী মতে পরাহেও বাবা
এ পথে মিলিবে ইষ্ট!
মরে যদি যাও তাহলে তো তুমি
একদম গেলে মরিয়াই!
চরণের জোরে মরণ এড়াও,
বাঁচিবে চরণ ধরিয়াই॥
কোরাস :
থাকিতে চরণ মরণ কী ভয়,
নিমেষে যোজন ফরসা।
মরণ-হরণ নিখিল-শরণ
জয় শ্রীচরণ ভরসা॥
দে গোরুর গা ধুইয়ে
দে গোরুর গা ধুইয়ে’
কোরাস : দে গোরুর গা ধুইয়ে॥
উলটে গেল বিধির বিধি
আচার বিচার ধর্ম জাতি,
মেয়েরা সব লড়ুই করে,
মদ্দ করেন চড়ুই-ভাতি!
পলান পিতা টিকেট করে–
খুকি তাঁহার পিকেট করে!
গিন্নি কাটেন চরকা, –কাটান
কর্তা সময় গাই দুইয়ে!
কোরাস : দে গোরুর গা ধুইয়ে ॥
চর্মকার আর মেথর চাঁড়াল
ধর্মঘটের কর্মগুরু!
পুলিশ শুধু করছে পরখ
কার কতটা চর্ম পুরু!
চাটুজ্যেরা রাখছে দাড়ি,
মিয়াঁরা যান নাপিত-বাড়ি!
বোঁটকা-গন্ধী ভোজপুরি কয়
বাঙালিকে –‘মৎ ছুঁইয়ে!’
কোরাস : দে গোরুর গা ধুইয়ে ॥
মাজায় বেঁধে পইতে বামুন
রান্না করে কার না বাড়ি,
গা ছুঁলে তার লোম ফেলে না,
ঘর ছুঁলে তার ফেলে হাঁড়ি!
মেয়েরা যান মিটিং হেদোর,
পুরুষ বলে, ‘বাপরে দে দোর!’
ছেলেরা খায় লাপসি হুড়ো,
বুড়োর পড়ে ঘাম চুঁইয়ে!
কোরাস : দে গোরুর গা ধুইয়ে ॥
ভয়ে মিয়াঁ ছাড়ল টুপি,
আঁটল কষে গোপাল-কাছা,
হিন্দু সাজে গান্ধি-ক্যাপে,
লুঙ্গি পরে ফুঙ্গি চাচা!
দেখলে পুলিশ গুঁতোয় ষাঁড়ে,
পুরুষ লুকায় বাঁশের ঝাড়ে!
খ্যাঁদা বাদুড় রায়-বাহাদুর,
খান-বাহাদুর কান খুইয়ে॥
কোরাস : দে গোরুর গা ধুইয়ে ॥
খঞ্জ নেতা গঞ্জনা দেয়,
চলতে নারে দেশ যে সাথে!
টেকো বলে, ‘টাক ভালো হয়
আমার তেলে, লাগাও মাথে!’
‘কী গানই গায়’– বলছে কালা;
কানা কয়, কী নাচছে বালা!’
কুঁজো বলে, ‘সোজা হয়ে
শুতে যে সাধ, দে শুইয়ে!’
কোরাস : দে গোরুর গা ধুইয়ে ॥
সস্তা দরে দস্তা-মোড়া
আসছে স্বরাজ বস্তা-পচা,
কেউ বলে না, ‘এই যে লেহি’
আসলে ‘যুদ্ধ দেহি’র খোঁচা।
গুণীরা খায় বেগুন-পোড়া,
বেগুন চড়ে গাড়ি-ঘোড়া!
ল্যাংড়া হাসে ভেংড়ো দেখে
ব্যাঙের পিঠে ঠ্যাং থুইয়ে!
কোরাস : দে গোরুর গা ধুইয়ে ॥
দ্যাখো হিন্দুস্থান সায়েব মেমের
কমিক গান
তৌবা
বেহাগ-খাম্বাজ – দাদরা
দ্যাখো হিন্দুস্থান সায়েব মেমের,
রাজা আংরেজ হারাম-খোর।
ওদের পোশাকের চেয়ে অঙ্গই বেশি,
হাঁটু দেখা যায় হাঁটিলে জোর!
আর মেয়েরা ওদের মদ্দের সাধে
রাজপথে করে গলাগলি,
আরে শুধু তাই নয়, নাচে গলা ধরে
ব্যান্ড বাজায়ে ধলা-ধলি॥
কোরাস :
আরে তৌবা! আরে তৌবা!!
আরে যাবে কোথা মিয়াঁ? চৌদিক ঘিরে
টিকি বেঁধে শিরে কাফের হায়,
খাই আমরা হারাম সুদ? আরে যাও,
ওরা যে তেমনি ক্যাঁকড়া খায়!
দ্যাখো ষাড়-পোড়া খেলে হাড় মোটা হয়,
সোজা কথাটা কি বুঝিলে ছাই!
আর খাসি নাহি করে বোদা পাঁঠা ধরে
কেটে খায়, করে নাকো জবাই॥
কোরাস :
আরে তৌবা! আরে তৌবা!!
দ্যাখো মেয়েরা ওদের বোরকা না দিয়ে
রেল ও জাহাজে চড়িয়া যায়,
মোদের বোরকা দেখিলে ছেলেরা ওদের
জুজুবুড়ি বলে ভিরমি খায়।
আরে ইজ্জত তবু থাকে তো মোদের
যক্ষ্মায় নয় মরে শতক,
ওরে উহাদের মতো বেরুলে বিবিরা
যদি কেউ দেখে হয় ‘আশক’॥
কোরাস :
আরে তৌবা! আরে তৌবা!!
আরে আমাদের মতো দাড়ি কই ওদের?
লাগিলে যুদ্ধ নাড়িবে কী?
আর উহাদের মতো কাছা কোঁচা নাই,
ধরিলে মোদের ফাড়িবে কী?
ছার অস্ত্র লইয়া কী হবে, আমরা
বস্ত্র যা পরি থান খানিক,
তাতে তৌবা তৌবা করি যদি, যাবে
কামানের গোলা আটকে ঠিক
কোরাস :
সোবহান আল্লা! সোবহান আল্লা!!
দ্যাখো তুর্কিরা বটে ছাঁটিয়া ফেলেছে
তুর্কি নূর ও মাথার ফেজ,
আর ‘দীন-ই-ইসলাম’ছেড়ে দিয়ে শুধু
তলোয়ারে তারা দিতেছে তেজ!
আরে বাপ-দাদা করে গিয়েছে লড়াই,
আমরা খামখা কেন লড়ি!
দেহে ইসলামি জোশ আনাগোনা করে
‘ছহি জঙনামা’ যবে পড়ি॥
কোরাস : সোবহান আল্লা! সোবহান আল্লা!!
মোরা মসজিদে বসি নামাজ পড়ি যে,
রক্ষা কি আছে বিধর্মীর?
ওরা ‘কাফুরের’ মতো যাইবে ফুরায়ে’
অভিশাপ যদি হানেন পির!
দ্যাখো পায়জামা চেপে রেখেছি আজিও
আমাদের এই পায়ের জোর,
আরে অক্কাই যদি পেতে হয় – দিব
মক্কার পানে সরল দৌড়॥
কোরাস :
মাশাআল্লা ! ইন্শাআল্লা !!
জানো, দুনিয়ায় মোরা যত পাব দুখ,
বেহেশতে পাব ততই সুখ,
আর মেরে যদি হাত-চুলকুনি মেটে,
নে বাবা, তোদেরই আশ মিটুক!
সবে পশ্চাৎ দিয়ে করিব জবাই,
আসুন ‘মেহেদি’ ,থাম দুদিন!
বাবা মুষল লইয়া কুশল পুছিতে
আসিছে কাবুলি মুসলেমিন॥
কোরাস :
আল্লাহু আকবর ! আল্লাহু আকবর !!
নমো নমো নমো নমঃ হে নটনাথ
দুর্গা – গীতাঙ্গী
নমো নমো নমো নমঃ হে নটনাথ!
নব ভবনে করো শুভ চরণ-পাত।
নৃত্য-ভঙ্গিতে সৃজন-সংগীতে
বিশ্বজন-চিতে আনো নব-প্রভাত॥
তোমার জটাজূটে বহে যে জাহ্নবী
তাহারই সুরে প্রাণ জাগাও, আদি কবি!
শুচি ললাটতলে
যে শিশু শশী ঝলে,
তারই আলোকে হরো দুখ-তিমির-রাত॥
হে চির-সুন্দর, দেহো আশীর্বাদ –
হউক দূর সব অতীত অবসাদ।
লঙ্ঘি সব বাধা
তব পতাকা বহি,
ফুল্লমুখে সহি সকল সংঘাত॥
নব জীবনে লয়ে আশা অভিনব
ভুলি সকল লাজ গ্লানি পরাভব,
এ নাট-নিকেতনে আরতি করি তব
হে শিব, করো নব-জীবন সঞ্জাত॥
নাচে মাড়োয়ার লালা
তাকিয়া নৃত্য
হিন্দোল – কাওয়ালি
নাচে মাড়োয়ার লালা
নাচে তাকিয়া।
(নাচে) ভোঁদড় হিন্দোলে
ঝোপে থাকিয়া॥
পায়জামা পরে যেন
নাচে গান্ডার,
নাচে সাড়ে পাঁচ মনি
ভুঁড়ি পাণ্ডার!
গঙ্গার ঢেউ নাচে,
বয়া ঝাঁকিয়া।
গামা নাচে, ধামা নাচে,
মুটকি নাচে,
জামা পরে ভল্লুক
নাচিছে গাছে!
ঝগড়েটে বামা নাচে
থিয়া তাথিয়া॥
ছোটো মিয়াঁ’‘বড়ো মিয়াঁ’
বলি কোলা ব্যাং
বৃষ্টিতে নাচে, নাড়ি
নড়বড় ঠ্যাং!
(নাচে) গুজরাতি হাতি
কর্দম মাখিয়া॥
নাহি ভয় নাহি ভয়
টোড়ি – একতালা
নাহি ভয় নাহি ভয় ।
মৃত্যুসাগর মন্থন শেষ,
আসে মৃত্যুঞ্জয়॥
হত্যায় আসে হত্যানাশন,
শৃঙ্খলে তার মুক্তিভাষণ,
অন্ধ কারায় তমোবিদারণ
জাগিছে জ্যোতির্ময়॥
ব্যথিত হৃদয়-শতদল তাঁর
আঁখি-জল-ঘেরা আসন বিথার।
ব্যাথা-বিহারীরে দেখিবি কে আয়,
ধ্বংসের বুকে শঙ্খ বাজায়!
নিখিলের হৃদিরক্ত-আভায়।
নবীন অভ্যুদয়॥
নিশুতি রাতের শশী গো
খাম্বাজ-পিলু – ঠুংরি
নিশুতি রাতের শশী গো।
ঘুমায়ে সকলে নিশীথ নিঝুম,
হরিল কে তব নয়নের ঘুম,
কার অভিসারে জাগো গগন-পারে
চাঁদ-ভোলানো সে কোন রূপসি॥
লুকায়ে হেরি আমি অভিসার তব,
তারকারা হেরে লুকায়ে নীরব,
কপট ঘুম ভাঙি হেরো হাসিছে সব
দূর অলকার বাতায়নে বসি॥
নীরন্ধ্র মেঘে মেঘে অন্ধ গগন
মল্লার – কাওয়ালি
নীরন্ধ্র মেঘে মেঘে অন্ধ গগন।
অশান্ত-ধারে জল ঝর ঝরে অবিরল,
ধরণি ভীতি-মগন॥
ঝঞ্ঝার ঝল্লরি বাজে ঝননননন,
দীর্ঘশ্বসি কাঁদে অরণ্য শনশন,
প্রলয়-বিষাণ বাজে বজ্রে ঘনঘন,
মূর্ছিত মহাকাল-চরণে মরণ॥
শুধিবে না কেহ কি গো এই পীড়নের ঋণ,
দুঃখ-নিশি-শেষে আসিবে না শুভ দিন?
দুষ্কৃতি বিনাশায় যুগ-যুগ-সম্ভব,
অধর্মনিধনে এসো অবতার নব!
‘আবিরাবির্ম এধি’ওই ওঠে রব,
জাগৃহি ভগবন, জাগৃহি ভগবন॥
নয়নে ঘনাও মেঘ, মালবিকা
মালবশ্রী – কাওয়ালি
নয়নে ঘনাও মেঘ, মালবিকা!
গগনে জাগাও তব নীরদ-লিখা॥
বিদ্যুৎ হানে যদি গরজায় বাজ,
সুন্দর মৃত্যুরে নাহি ভয় আজ,
আমার এ বনে এসো মনোবালিকা॥
ঝরুক এ শিরে মোর ঘন বরষা,
ফুটিবে কাননে ফুল, আছে ভরসা।
এসো জল-ছলছল পথে অভিসারিকা॥
পূজা-দেউলে মুরারি
তিলং–সাদ্রা
পূজা-দেউলে মুরারি,
শঙ্খ নাহি বাজে,
বন্ধ দ্বার, নির্বাপিত দীপ লাজে॥
ভগ্ন ঘট, শূন্য থালা,
পুণ্য-লোক রক্তে ঢালা
দৈত্য সেথা নৃত্য করে মৃত্যু-সাজে,
দাও শরণ তব চরণ মরণ-মাঝে॥
প্রণমি তোমায় বন-দেবতা
দুর্গা – দাদরা
প্রণমি তোমায় বন-দেবতা।
শাখে শাখে শুনি তব ফুল-বারতা–
দেবতা॥
তোমার ময়ূর তোমার হরিণ
লীলা-সাথি রয় নিশিদিন,
বিলায় ছায়া বাণীবিহীন
তরু ও লতা–
দেবতা॥
প্রাথমিক শিক্ষা বিল
প্রাথমিক শিক্ষা বিল
(নেপথ্যে কোরাস) এই বেলা নে ঘর ছেয়ে॥
এই দেশটা ভীষণ মূর্খ,
এবার ঘুচাব দেশের দুঃখ।
হবে চাষারা উচ্চ-প্রাইমার,
ওরে আর এদেশের নাই মার!
ছুটে আয় আয় সব ছেলেমেয়ে!
(নেপথ্যে) এই বেলা নে ঘর ছেয়ে॥
বহু দিন ধরি করি আঁক-পাঁক
এবে মিলিয়াছে মনোমতো ফাঁক।
তোরা
মাথা পিছু সব টাকা গোন
দিব
পণ্ডিত করে বাছাধন!
হবি বাবু সার রে অলপ্পেয়ে !
(নেপথ্যে) এই বেলা নে ঘর ছেয়ে॥
তোরা পাসনে কো খেতে মাড় ভাত,
নাই পরনে বসন আধ-হাত।
পাবি অন্ন-বস্ত্র এইবার
এই আইন হইবে যেই বার!
টাকা তোল তোরা আদা-জল খেয়ে।
(নেপথ্যে) এই বেলা নে ঘর ছেয়ে॥
তোরা করছিস কি অবিশ্বাস?
কেন ছাড়িস দীর্ঘ নিশ্বাস?
মোর টাকার কি আর ভাবনা,
ওই টাকা বিনে খেতে পাব না?
চলে রাজ্য কি তোর মুখ চেয়ে?
(নেপথ্যে) এই বেলা নে ঘর ছেয়ে॥
এই শিক্ষার লাগি হরদম
বলি খরচটা কিছু করি কম?
আজও গ্রাম-পিছু প্রতি বৎসর
আট আনা করে দিই, মনে কর!
তবু আছে অজ্ঞান-ভূতে পেয়ে।
(কোরাস) এই বেলা নে ঘর ছেয়ে॥
দিয়ে তোদেরই শিল ও নোড়া রে
ভাঙিব তোদেরই দাঁতের গোড়া রে!
‘বাই জোভ!’আরে ছি, ছি, তা নয়,
তোরা ভাবিস তাহাই যা নয়!
ধিনি কেষ্ট রে, নেচে আয় ধেয়ে।
(নেপথ্যে) এই বেলা নে ঘর ছেয়ে॥
বলি, চারটে করো তো পয়সা,
তাতেই চেঁচিয়ে ধরালি বয়সা!
তাও পাঁচটা কোটি তো লোক ছাই,
হয় ক-টাকা সে – তুই বল ভাই!
তবু ফ্যালফ্যাল করে রস চেয়ে?
(নেপথ্যে) এই বেলা নে ঘর ছেয়ে॥
তোরা কতই রকম দিস ‘সেস’
হলি ‘সে’স’দিয়ে দিয়ে নিঃশেষ,
ওরে জ্ঞান-এরণ্ডের এ যে ফল!
এ-ও না খেলে আর কী খাবি বল!
জ্ঞান- কান্ডারি এল তরি বেয়ে!
(নেপথ্যে) এই বেলা নে ঘর ছেয়ে॥
হবি এবার বিদ্যে-দিগ্গজ,
পোকা করিবে মগজে বজবজ!
ফুলে ফুলে বন ফুলেলা
কামোদ – একতালা
ফুলে ফুলে বন ফুলেলা।
ফুলের দোলা, ফুলের মেলা,
ফুল-তরঙ্গে ফুলের ভেলা॥
ফুলের ভাষা ভ্রমর গুঞ্জে
দোলনচাঁপার ঝুলনকুঞ্জে,
মুহু মুহু কুহরে কুহু
সহিতে না পারি ফুল-ঝামেলা॥
বক্ষে আমার কাবার ছবি
বাগেশ্রী-সিন্ধু – কাহারবা
বক্ষে আমার কাবার ছবি,
চক্ষে মোহাম্মদ রসুল।
শিরোপরি মোর খোদার আরশ্,
গাই তারই গান পথ-বেভুল॥
লায়লির প্রেমে মজনুঁ পাগল,
আমি পাগল ‘লা-ইলা’র,
বোঝে আমায় প্রেমিক দরবেশ,
অ-রসিকে কয় বাতুল॥
হৃদয়ে মোর খুশির বাগান,
বুলবুলি তায় গায় সদাই –
ওরা খোদার দয়া যাচে,
আমি খোদার ইশ্ক চাই॥
আমার মনের মসজিদে দেয়
আজান প্রেমের ‘মুয়াজ্জিন’,
প্রাণের পরে কোরান লেখা
‘রুহ’ পড়ে তা রাত্রিদিন।
খাতুনে-জিন্নাত আমার মা,
হাসান হোসেন চোখের জল,
ভয় করি না ‘রোজ-কিয়ামত’
পুলসিরাতের কঠিন পুল॥
বগল বাজা দুলিয়ে মাজা (ডোমিনিয়ন স্টেটাস)
ডোমিনিয়ন স্টেটাস
কোরাস : বগল বাজা দুলিয়ে মাজা,
বসে কেন অমনি রে!
ছেঁড়ে ঢোলে লাগাও চাঁটি,
মা হবেন আজ ডোমনি রে॥
রাজা শুধু রাজাই রবেন
পগার-পারে নির্বাসন,
রাজ্য নেব দু ভাই মিলে
দুর্যোধন আর দুঃশাসন!
অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র রবে
সিংহাসনে মাত্র নাম!
কোঁতকা যাবে, রইবে শুধু
বোঁটকা খানিক গাত্রঘাম॥
অনেক-কিছু সয়ে গেছে,
গন্ধটা আর সইবে না?
কী কস? গলা-বন্ধটা? এও
দুদিন বাদে রইবে না!
কলসি-কানার প্রহার খেয়েও
প্রভু কেয়সা প্রেম বিলায়।
গউর বলে, ‘প্রেমসে’নাচে
জগাই মাধাই – দেখবি আয়॥
রইত তো কেউ রাজা হেথাও,
না হয় সেথাই রইল কেউ।
আচ্ছা ফ্যাসাদ যা হোক! তবু
বাঘের পিছে লাগবি ফেউ?
ঠুঁটো হলেও হাত পেলি তো!
ছিলি যে একদম বে-হাত!
একেবারেই ঠ্যাং ছিল না,
পেলি তো এক ঠ্যাং নেহাত!
ভিক্ষের চাল কাঁড়াই হোক–আর
আকাঁড়া – তাই ঝোলায় ভর।
ওই চিবিয়ে জল খেয়ে থাক!
ফেনও পাবি অতঃপর॥
ধৈর্য ধরে থাকে বেড়াল
তাই তো শেষে পায় কাঁটা,
পাত হতে সে মাছ তুলে নেয়?
তেমনি সে যে খায় ঝাঁটা॥
ভারত একার নয় তো কারুর –
বিশ্ব-আড়ত, পীঠস্থান!
পারত-পক্ষে মারতে কসুর
করেনি কেউ হুন পাঠান!
চিরটা কাল বনের মোরা
লোমশ-মুনিই ছিলুম দেখ!
আহার ছিল শাক পাতা আর
ভাবের গাঁজা ছিলিম টেক!!
আজ তবু কেক বিস্কুট খাস,
হয়েও গেলি প্রায় রাজাই!
গাল বাজাই আয় কানাডা আর
অস্ট্রেলিয়ার ভায়রা-ভাই!
ধুচনি মাথায় হাতে ধামা
দেখে মোদের রসিক-রাজ –
ডোমের জাতি ভেবে–দিলেন
ডোমনি করে মাতায় আজ॥
বন্দিনি মা ছিলেন আহা,
আজ দিয়েছে মুক্তি রে!
বাজাও ধামা মামার নামে,
রক্ত ঢালো বুক চিরে!
এবার থেকে ধামাধারী
বলদ-দল, ভাবনা কি?
দিব্যি খাবে ডুবিয়ে নুলো
পাতনা নাদায় জাব মাখি॥
হাতির পিছে নেংচে চলে
ব্যাংছা এবং খলসে রে!
দোহাই দাদা, চলিসনে আর,
চোখ যে গেল ঝলসে রে!
‘মাভৈঃ! এবার স্বাধীন হনু!’
যাই বলেছি, পৃষ্ঠে ঠাস!
পড়ল মনে, পীঠস্থান এ,
ডোমিনিয়ন স্টেটাস!
বন-বিহারিণী চপল হরিণী
সিন্ধু – কাওয়ালি
বন-বিহারিণী চপল হরিণী
চিনি আঁখিতে চিনি কানন-নটিনীরে।
ছুটে চলে যেন বাঁধভাঙা তটিনী রে॥
নেচে নেচে চলে ঝরনার তীরে তীরে।
ছায়াবীথিতলে কভু ধীরে চলে,
চকিতে পলায় নিজ ছায়া হেরি
গিরি শিরে॥
বনে বনে জাগে কী আকুল হরষন
ভৈরবী – সেতারখানি
বনে বনে জাগে কী আকুল হরষন।
ফুল-দেবতা এল দিতে ফুল-পরশন॥
হরিততর আজি পল্লব বনবাস,
মুকুল-জাগানিয়া সমীরণ ফেলে শ্বাস,
বেপথু লতা যাচে মধুপের দরশন॥
কিশোর-হিয়া-মাঝে যৌবন-দেবতা
গোপনে আনে নব জাগরণ-বারতা,
বধূর সাথে খোঁজে বঁধু বন নিরজন॥
বন্দির মন্দিরে জাগো দেবতা
হাম্বীর – কাওয়ালি
বন্দির মন্দিরে জাগো দেবতা!
আনো অভয়ংকর শুভ বারতা।
জাগো দেবতা, জাগো দেবতা॥
শৃঙ্খলে বাজে তব সম্বোধনী,
কারায় কারায় জাগে তব শরণি,
বিশ্ব মূক ভীত, কহো গো কথা!
জাগো দেবতা, জাগো দেবতা॥
নিশিদিন শোন নিপীড়িতা ধরণি
অশ্রুতে অ-শ্রুত শঙ্খধ্বনি!
পঙ্গু রুগ্ণ নর অত্যাচারে,
ধর্ষিতা নারী কাঁদে দৈত্যাগারে,
জাগো পাষাণ, ভাঙো নীরবতা।
জাগো দেবতা, জাগো দেবতা॥
মৃদুল মন্দে মঞ্জুল ছন্দে
পিলু খাম্বাজ– ঠুংরি
মৃদুল মন্দে মঞ্জুল ছন্দে
মরাল মদালস নাচে আনন্দে॥
তরঙ্গ-হিল্লোলে শতদল দোলে,
শিশু অরুণে জাগায় অমা-যামিনীর কোলে,
শুষ্ক কানন ভরে বকুল-গন্ধে॥
নন্দন-উপহার ধরণির করে,
শুভ্র পাখায় শুভ আশিস ঝরে।
মিলন-বসন্তের দূত আগমনি,
কণ্ঠে সুমঙ্গল শঙ্খের ধ্বনি,
কুহু-কেকা গাহে মধুর দ্বন্দ্বে॥
যদি শালের বন হত শালার বোন
যদি
কীর্তন
যদি শালের বন হত শালার বোন
আর কনে বউ হত ওই গৃহেরই কোণ।
ছেড়ে যেতাম না গো,
আমি থাকিতাম পড়ে শুধু, খেতাম না গো!
যদি শালের বন হত শালার বোন –
আমি ওই বনে যে হারিয়ে যেতাম!
ওই বৃন্দাবনে চারিয়ে যেতাম!
ওই মাকুন্দ হত যদি কুন্দ-বালা
হত দাড়িম্ব-সুন্দরী দাড়িওয়ালা!
আমি ঝুলে যে পড়িতাম
তার দাড়ি ধরে –
ওগো দুর্গা বলে –
আমি ঝুলে যে পাড়িতাম!
হত চিমটি শালির যদি বাবলা কাঁটা,
আর শর-বন হত তার খ্যাংরা ঝাঁটা!
দোয়ার্কি :
বিষ ঝেড়ে যে দিত তোর খ্যাংরা মেরে
বিষ ঝেড়ে যে দিত তোর!
যদি একই শালি
দিলে গো মা কালী,
সে যে শালি নয় বিশালী (মা গো)
মাগো বিশাল বপু তার
বিশালী সে – শালি নয়, শালি নয়!
রাউন্ড-টেবিল-কনফারেন্স
রাউন্ড-টেবিল-কনফারেন্স
কোরাস : দড়াদড়ির লাগবে গিঁঠ
গোল-টেবিলের বৈঠকে!
ঠোকর মারে লোহায় ইঁট
এ ঠকে কী ওই ঠকে॥
ব্যান্ড বাজে, ইং-ল্যান্ডে ওই
চলল লিডার্স এ্যান্ড কোং,
শকুন মাতুল কালনেমি, –
কণ্ঠে লাউড-স্পিকার চোং!
তাদের ছাড়া কুম্ভীরে
মাছের দুঃখ কইত কে॥
চলছে নরম গরম চাঁই
হোমরা চোমরা ওমরা যায়,
ধুনতে তুলো ধপড় ধাঁই
ডোমিনিয়ন-ডোমরা যায়।
বলছে ডেকে, ‘দেখ রে দেখ
প্রতাপ চলে চৈতকে॥’
ডিম-গোলাকার গোল-টেবিল
করবে সার্ভ অশ্ব-ডিম,
তা দিবে তায় ধাড়ির দল,
তা নয় দিলে ততঃ কিম?
আনবে স্বরাজ ব্রিটিশ-বর্ন,
অস্ট্রেলিয়ার ভাইপোকে॥
স্বর্গ ভেবে ধাপার মাঠ
ধাপা-মেলের ময়লা যায়,
কুটুম ভেবে কেষ্টরে
বৈকুন্ঠে গয়লা যায়
স্বরাজ-মাখম উঠবে যে–
নইলে এ ঘোল মইত কে॥
বেছে বেছে পিঁজরাপোল
নড়বড় বড়োর দল
আনল বুড়ো হাবড়াদের,
যাত্রা-কমিক দেখবি চল!
ঘাঁটা-পড়া ঘাড় ওদের,
নয় এ বোঝা বইত কে॥
বাঘ নেবে পাঠ বেদান্তের,
বি-দন্ত সব পুরুত যায়,
করবে শান্তি মন্ত্রপাঠ
ব্যাঘ্র! ব্যগ্র বক্ষে আয়!
শিখাবে অদ্বৈতবাদ
দ্বিধা-ভক্ত দ্বৈতকে॥
বাধাস নে আর লটঘটি
দোহাই বাবা চ্যাংড়া থাম!
এমন ফলার কাঁচকলার,
তোরাও পাবি ল্যাংড়া আম!
সাগর মথি আনবে সব
হয় সুধা নয় দই টকে॥
লিগ-অব-নেশন
লিগ-অব-নেশন
[সিংহ-ইংরাজ॥ হস্তী-ভারতবর্ষ॥ বাঘ-ফ্রান্স॥ ভল্লুক-রুশিয়া॥
হাঙর-ইটালি॥ নেকড়ে-অস্ট্রিয়া॥ শিব-গ্রিস॥
হায়েনা-আমেরিকা॥ ঈগল-জার্মানি॥]
কোরাস :
বসেছে শান্তি-বৈঠকে বাঘ,
সিংহ, হাঙর, নেকড়ে!
বৈষ্ণব গোরু, ছাগ, মেষ এসে
হরিবোল বলে দেখ রে॥
শিবা, সারমেয়, খটাস, শকুনি–
দু-নয়ন লবণাক্ত
কেঁদে কয়, ‘দাদা, নামাবলি নেব
আর রব নাকো শাক্ত!
কেন রেষারেষি দ্বেষাদ্বেষি বৃথা,
দিব ফেলে নখ দন্ত,
তপস্বী হয়ে বনে যাব সবে,
পশুর হউক অন্ত।
ছাগ মেষ সব কে কোথা আছিস,
নিয়ে আয় সব ঢাক-ঢোল,
এসেছেন গোরা প্রেম-আনন্দে
ন্যাজ তুলে সবে হরিবোল!
শিশু-হাসি হেসে নব জিশু-বেশে
এসেছেন আহা বনমাঝ,
অজিন-আসন এনে দে হরিণ,
বসিবেন গোরা, পশুরাজ॥’”
পশুরাজ কন, ‘পশুদল, শোনো,
শোনো মোর বাণী স্বস্তির।’
বাঘা কয়, ‘প্রভু! দন্ত বেজায়
বাড়িয়া উঠিছে হস্তীর।’
প্রভু কন, ‘বাবা শান্তির এই
বৈঠক তারই জন্যে!’
নেকড়ে অমনি কহে, ‘চুপ! চুপ!
শুনিয়া ফেলিবে অন্যে!’
হাবাতে হাঙর খেজুর-গুঁড়ির
লেজুর করিয়া উচ্চ,
বলে, ‘প্রভু তুমি ধূমকেতু-তারা,
এ ভক্ত তার পুচ্ছ!’
প্রভু কন, ‘আহা, এতদিন পরে
মিলিল ভক্ত হনুমান!’
হাঙরের চোখে সাঁতার-সলিল,
বলে, ‘প্রভুর কী অনুমান!’
খেঁকড়ে-কণ্ঠ নেকড়ে কহিল,
‘হায়েনা তো প্রভু আয়েনা!
আমরা করিব হরিনাম, আর
সে নেবে আফ্রিকা চায়েনা!’
ব্যাঘ্র কহিল, ‘সে স্যাঙাত যে রে
আছে রগ ঘেঁসে আমারই!’
প্রভু কন, ‘ওই নোড়া দিয়ে দাঁত
ভাঙিব ভালুক মামারই॥’
হাঙর কহিল, ‘ভালুক মামা যে
ক্রমেই আসিছে রুষিয়া!’
প্রভু কন, ‘আর কটা দিন ব্যাটা
বাঁচিবে আমড়া চুষিয়া?’
লড়ালড়ি করে হায়েনা ভালুক
দুটোরই ধরিবে হাঁপানি,
ছিনেজোঁক রবে লাগিয়া পিছনে,
পাশে চিতে বাঘ জাপানি!
হাড়গোড়-ভাঙা ঈগল পক্ষী
কহিল পক্ষ ঝাপটি,
‘প্রভু তব পিছে চাপকান-ঢাকা
আফগান মারে ঘাপটি!’
প্রভু কন, ‘ওরই ভাবনায় বাবা
ধরেছে রক্ত-আমেশা!
গোস্ত খাওয়ায়ে দোস্ত করিতে
তাই তো চেষ্টা হামেশা!’
শিবা কয়, ‘প্রভু, সুরকি-রাঙানো
টুপি ছাড়িয়াছে তুর্কি!’
প্রভু কন, ‘মজি সংসার-মোহে
ছাড়িল খোদার নূর কি?
কপাল মন্দ! কী করিবে বলো!
অদৃষ্টে নাই ভেস্ত!’
শিবা কয়, ‘যাব আমিই ভেস্তে
তাহলে, বিচার বেশ তো!’
সাত হাত দাঁত বের করে এল
এমন সময় হস্তী,
শুণ্ড বুলায়ে মুণ্ডে কহিল,
‘করো মোরও সাথে দোস্তি!’
‘রে গজমূর্খ!’বলি প্রভুপাদ
পশুরাজ ওঠে গর্জি –
‘কার মর্জিতে তুই এলি হেথা
চিড়িয়াখানারে বর্জি!’
‘গজরাজ আমি, অজ নই’কহে,
অঙ্গ দুলায়ে হস্তী,
‘চিড়িয়াখানার পিঞ্জর ভেঙে
এসেছি বনের বস্তি!’
শকুনি, খটাস, শিবা, সারমেয়
তুলিল ভীষণ কলরোল;
তক্ত প্রভুর তুলি পশুদল
বল ‘বলো হরি হরিবোল!’
শুক্লা জ্যোৎস্নাতিথি, ফুল্ল পুষ্পবীথি
গৌড়-সারং – কাওয়ালি
শুক্লা জ্যোৎস্নাতিথি, ফুল্ল পুষ্পবীথি,
গন্ধ-বর্ণ-গীতি-আকুল উপবন
চিত্ত স্বপ্নাতুর, অঙ্গ চুরচুর,
মাগে হৃদিপুর সুন্দর-পরশন॥
চন্দন-গন্ধিত মন্দ দখিনাবায়
নন্দন-বাণী ফুলে ফুলে কয়ে যায়,
তনু-মন জাগে রাঙা অনুরাগে,
আজি মাধবী-বাসর জাগরণ॥
সন্ধ্যা-আঁধারে ফোটাও, দেবতা
বেলাওল – একতালা
সন্ধ্যা-আঁধারে ফোটাও, দেবতা,
শুভ্র রজনিগন্ধা!
নিরাশা-শুষ্ক পরানে বহাও
প্রেমের অলকানন্দা॥
অশ্রুজলের অকূল সায়রে
ফুটুক কমল তব শুভ বরে,
বেদনা-আহত কবির চিত্তে
বাণী দাও মধুছন্দা॥
দুঃখ আসিলে সে দুখ ভুলিতে
দাও আনন্দ দুঃখীর চিতে,
আঁধার-গহন নিবিড় নিশীথে
ভাঙিয়ো না সুখ-তন্দ্রা॥
সাইমন-কমিশনের রিপোর্ট
(প্রথম ভাগ)
ভারতের যাহা দেখিলেন
কোরাস : ‘কী দেখিতে এসে কী দেখিনু শেষে,’
রিপোর্টে লেখেন সাইমন –
হুটোপুটি করে ছুটোছুটি করে
বুড়োবুড়ি, কাজে নাই মন!
‘ম্যাদা’দল আর ‘উদো’দল পায়ে
হস্ত বুলায় হর্দম,
পুঁচকে দলের ফচকে ছোঁড়ারা
ছিটাইছে বটে কর্দম!
ত্যক্তের চেয়ে ভক্তই বেশি,
আহাহা ভক্ত বেঁচে থাক!
ছোলা ভেজা দেব, কাঁচকলা দেব,
নিশ্চয়ই মনে এঁচে রাখ॥
আসিতে ভারতে সানকি লইয়া
আসিলে ফকির ফোকরা,
পিছন হইতে ঠোকরায় টাকে
ডেঁপো গোটা কয় ছোকরা।
ছেলে যা দেখিনু, ছেলের চাইতে
পিলে বড়ো, অধিকন্তু –
বৃহত্তম ‘জু’দেখিনু জীবনে –
প্রথম দুপেয়ে জন্তু॥
মাথা নাই হেথা, নাইকো হৃদয়,
শুধু পেট আর পিঠ সার,
এত ‘পিঠে’খেয়ে কেমনে হজম
করে, করে নাকো চিৎকার!
ঠুঁটো হাত শুধু চিত করে রাখে
শূন্যের পানে তুলিয়া,
বিপদে শ্রীপদ ভরসা, তাহাও
শ্লীপদে গিয়াছে ফুলিয়া॥
মাড়োয়ারি আর ‘মালোয়ারি’জ্বর
এদের পরম মিত্র,
মরমরদেরে একেবারে মেরে
রাখিছে দেশ পবিত্র!
ইহাদের হরি বন্ধু মোদেরই
‘গুড ওল্ড জেন্টলম্যান’,
কচুরি-পানায় ডোবা ও খানায়
এঁর কৃপা করে ‘ভ্যানভ্যান’॥
এদেশের নারী বেজায় আনাড়ি,
পুরুষের হাতে তবলা,
তবলাতে চাঁটি মারিলে সে কাঁদে,
ইহারা কাঁদে না, অবলা!
জরিশাড়ি-মোড়া চকলেট ওরা
বন্দী হেরেম-বাক্সে,
বাহির করিলে খেয়ে নেবে কেউ,
কাজেই বাক্সে থাক সে॥
ইসকুলে, প্রেমে, জ্বরে পড়ে পড়ে
জীবন কাটায় ছেলেরা ;
মাঝে মাঝে করে ভ্রান্ত শিষ্ট –
শান্তে লেনিন ভেলেরা।
চোখের চাইতে চশমাই বেশি,
ভাগ্যিস ওরা অন্ধ,
নইলে কখন টানিয়া ধরিত
আমাদের গলাবন্ধ॥
আমাদের দেখাদেখি কেহ কেহ
করিছে ক্লাবের মেম্বার,
স্কার্ট পরে চাষারা, বাবুরা
বিবি লয়ে যায় চেমবার!
বিলিতি দাওয়াই ধরিতেছে ক্রমে,
আর বাকি নাই বেশি দিন,
গুডবয় হয়ে গিলিছে আফিম,
হুইস্কি, ব্রাণ্ডি, কুইনিন॥
কাফ্রি চেহারা, ইংরিজি দাঁত,
টাই বাঁধে পিছে কাছাতে;
ভীষণ বম্বু চাষ করে ওরা
অস্ত্র-আইন বাঁচাতে!
চাচা-ভাইপোতে মিল নাই সেথা
আড়াআড়ি টিকি দাড়িতে,
যুদ্ধ বাধাই উহাদেরই দিয়ে,
ধরিয়া আনাই ফাঁড়িতে॥
উহাদের মতো কেলে রং সব
গাছপালা জল আকাশের,
উহাদের গাই মোদেরই গাই-এর
মতো সাদা দুধ দেয় ফের।
কালো চামড়ার ভিতরে ওদের
আমাদেরই মতো রক্ত,
এ যদি না হত – শাশ্বত হত
ও-দেশে মোদের তক্ত!
(দ্বিতীয় ভাগ)
ভারতকে যাহা দেখাইলেন
কোরাস : জিশুখ্রিস্টের নাই সে ইচ্ছা,
কী করিব বলো আমরা!
চাওয়ার অধিক দিয়া ফেলিয়াছি
ভারতে বিলিতি আমড়া॥
চামড়া ওদের আমাদের মতো
কিছুতেই নহে হইবার!
হোয়াইটওয়াশ যা করিয়াছি–তাই
দেখিতেছি নহে রইবার!
আমাদের মতো যারা নয় তারা
অমনই রবে, কী করে বল!
সাদাদের মতো কালা অসভ্য
হইবে স্বাধীন? হরিব্ল!
আঁঠি ও চামড়া বিলিতি আমড়া
মন্টেগু দিল চুষিতে;
শাঁস নাই বলে কাঁদিল, দিলাম
বিলিতি কুমড়ো তুষিতে।
তাহাতেও যারা খুশি নয়, এতো
ভুসি খেয়ে ভরে নাকো পেট,
ঘুসি বরাদ্দ তাহাদের তরে,
ঝুঁটি ধরে করো মাথা হেঁট॥
পুলিশের লাঠি আরও বড়ো হোক,
আরও যেন তাতে থাকে গিঁঠ,
হস্তেরে ফেলো অস্ত্র-আইনে,
ঘর হতে তোলা হোক ইঁট!
কাগজের শুধু হইয়াছে নোট,
কাগজের হোক রুটিও,
মাথা কেটে দাও, কেটে দাও হাত
থাকে নাকো যেন টুঁটিও॥
যতটুকু দড়ি ছাড়িয়াছ, তাহা
গুটাইয়া লও পুনরায়,
একবার যদি বেড়া ভাঙে, তবে
আরবার ধরা হবে দায়!
আরও প্রশস্ত করে দাও পিঠ
ধুর্মুস-পেটা করিয়া,
টিকি ও দাড়ির চাষ করো, লহো
নখর দন্ত হরিয়া॥
ও-দেশের জলে ম্যালেরিয়া-বিষ,
উহারা বিলিতি-জল খাক।
গুলি খেতে দাও তাদেরে, ওদের
চ্যাঁচায় যে এক দল কাক!
পা কেটে ওদের ঠেকো করে দাও,
উহাদের সাথে ছুটিতে
হার মেনে যায় এরোপ্লেন, পায়ে
গুলি পারে নাকো ফুটিতে॥
সিরিঞ্জ লইয়া আরও ফাঁপাইয়া
দাও প্লীহা আর যকৃৎ!
ঢাক কিনে দাও হিঁদুরে, মুসল –
মানে বলো, করো বকরিদ।
ভাতে নাই কিছু ভিটামিন, ওতে
মদ হোক, ওরা খাক ফেন,
এ স্বাস্থ্যে ভাত বড়ো ক্ষতিকর,
খুব জোর দুটো শাক দেন॥
অতিশয় বেশি কথা কয়ে কয়ে
বাড়াতেছে প্যালপিটেশন,
গ্যাগ পরাইতে করো সশস্ত্র
ডাক্তারে ইনভিটেশন।
মা ভগবতীর সার উহাদের
ব্রেনে আরও দাও পুরিয়া,
যদি থাকে মেরুদণ্ড কারুর
দাও তা ভাঙিয়া চুরিয়া॥
বোমা মেরে মেরে পায় নাকো খুঁজে
আজও উদরে ‘ক’অক্ষর,
এ মেষ কেমনে সভ্য ষাঁড়ের
সহিত হানিবে টক্কর?
পায়ে ও গলায় ছাড়া ইহাদের
কোনো সে অঙ্গে বল নাই॥
ব্যারাম মাফিক ওষুধ দিলাম,
দিলাম কিন্তু ফল নাই॥
সাহেব ও মোসাহেব
সাহেব ও মোসাহেব
সাহেব কহেন, ‘চমৎকার! সে চমৎকার!’
মোসাহেব বলে ‘চমৎকার সে হতেই হবে যে!
হুজুরের মতে অমত কার?’
সাহেব কহেন, ‘কী চমৎকার,
বলতেই দাও, আহা হা!’
মোসাহেব বলে, ‘হুজুরের কথা
শুনেই বুঝেছি, বাহাহা বাহাহা বাহাহা!’
সাহেব কহেন, ‘কথাটা কী জান? সেদিন–’
মোসাহেব বলে, ‘জানি না আবার?
ওই যে, কী বলে, যেদিন–’
সাহেব কহেন, ‘সেদিন বিকেলে
বৃষ্টিটা ছিল স্বল্প!’
মোসাহেব বলে, ‘আহা হা, শুনেছ?
কীবে অপরূপ গল্প!’
সাহেব কহেন, ‘আরে মলো! আগে
বলতেই দাও গোড়াটা!’
মোসাহেব বলে, ‘আহা-হা গোড়াটা!
হুজুরের গোড়া! এই চুপ, চুপ ছোঁড়াটা!’
সাহেব কহেন, ‘কী বলছিলাম,
গোলমালে গেল গুলায়ে!’
মোসাহেব বলে, ‘হুজুরের মাথা! গুলাতেই হবে!
দিব কি হস্ত বুলায়ে!’
সাহেব কহেন, “শোনো না! সেদিন
সূর্য উঠেছে সকালে!’
মোসাহেব বলে, ‘সকালে সূর্য?
আমরা কিন্তু দেখি না কাঁদিলে কোঁকালে!’
সাহেব কহেন, ‘ভাবিলাম, যাই,
আসি খানিকটা বেড়ায়ে,’
মোসাহেব বলে, ‘অমন সকাল! যাবে কোথা বাবা,
হুজুরের চোখ এড়ায়ে!’
সাহেব কহেন, ‘হল না বেড়ানো,
ঘরেই রহিনু বসিয়া!’
মোসাহেব বলে, ‘আগেই বলেছি! হুজুর কি চাষা,
বেড়াবেন হাল চষিয়া?’
সাহেব কহেন, ‘বসিয়া বসিয়া
পড়েছি কখন ঝিমায়ে!’
মোসাহেব বলে, ‘এই চুপ সব!
হুজুর ঝিমান! পাখা কর, ডাক নিমাইএ!’
সাহেব কহেন, ‘ঝিমাইনি, কই
এই তো জেগেই রয়েছি!’
মোসাহেব বলে, ‘হুজুর জেগেই রয়েছেন, তা
আগেই সবারে কয়েছি!’
সাহেব কহেন, ‘জাগিয়া দেখিনু, জুটিয়াছে যত
হনুমান আর অপদেব!’
‘হুজুরের চোখ, যাবে কোথা বাবা?’
প্রণমিয়া কয় মোসাহেব॥
সুন্দর হে, দাও দাও সুন্দর জীবন
সরফরদা – একতালা
সুন্দর হে, দাও দাও সুন্দর জীবন।
হউক দূর অকল্যাণ সকল অশোভন।
এ প্রাণ প্রভাতি-তারার প্রায়
ফুটুক উদয়-গগন-গায়,
দুঃখ-নিশায় আনো পূর্ণ চাঁদের স্বপন॥
সকল বিরস হৃদয় মন সরস করো হে,
আশায় সূর্যে মৃত্যু-গহন বিষাদ হরো হে!
কাঁটার ঊর্ধ্বে ফোটাও ফুল,
ভোলাও পথের দুঃখ ভুল,
এ বিশ্ব হোক পূজা-দেউল
পবিত্র-মোহন॥