সুবর্ণলতা – আশাপূর্ণা দেবীর একটি বিশেষ উপন্যাস। সুবর্ণলতা উপন্যাসের নারী চরিত্র আশাপূর্ণা দেবী যে ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা অতুলনীয়। আশাপূর্ণা দেবীর সুবর্ণলতা উপন্যাসটির সাথে তার লেখা প্রথম প্রতিশ্রুতি গ্রন্ঠের একটি যোগ সূত্র রেখেছেন। আশাপূর্ণা দেবী বলেন, সমাজবিজ্ঞানীরা লিখে রাখেন সমাজ বিতর্কের ইতিহাস, আমি একটি কাহিনীর মধ্যে সেই বিবর্তনের একটি রেখাঙ্কনের সামান্য চেষ্টা করেছি মাত্র।
সুবর্ণলতা বইয়ের বিবরণঃ
- বইয়ের নামঃ সুবর্ণলতা
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
- প্রকাশনঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স
১.০১ একাল-সেকাল নিয়ে তর্ক
আপাতদৃষ্টিতে সুবৰ্ণলতা একটি জীবনকাহিনী, কিন্তু সেইটুকুই এই গ্রন্থের শেষ কথা নয়। সুবৰ্ণলতা একটি বিশেষ কালের আলেখ্য। যে কাল সদ্যবিগত, যে কাল হয়তো বা আজও সমাজের এখানে সেখানে তার ছায়া ফেলে রেখেছে। সুবৰ্ণলতা সেই বন্ধন-জর্জরিত কালের মুক্তিকামী আত্মাৱ ব্যাকুল যন্ত্রণার প্রতীক।
আর একটি কথা বলা আবশ্যক। আমার প্রথম প্রতিশ্রুতি গ্রন্থের সঙ্গে এর একটি যোগসূত্র আছে। সে যোগসূত্র কাহিনীর প্রয়োজনে নয়, একটি ভাবীকে পরবতী কালের ভাবধারার সঙ্গে যুক্ত করার প্রয়োজনে।
সমাজবিজ্ঞানীরা লিখে রাখেন সমাজ-বিবর্তনের ইতিহাস, আমি একটি কাহিনীর মধ্যে সেই বিবর্তনের একটি রেখাঙ্কনের সামান্য চেষ্টা করেছি মাত্ৰ।
–লেখিকা
প্রথম পর্ব
একাল-সেকাল নিয়ে তর্ক তো চিরকালের, কিন্তু কেমন করে চিহ্নিত করা যায়। সেই কালকে? একএকটা কালের আয়ু শেষ হলেই কি এক-একবার যবনিকা পড়ে? যেমন যবনিকা পড়ে নাট্যমঞ্চে?
না, যবনিকার অবকাশ কোথায়? অবিচ্ছিন্ন স্রোত। তবু একাল সেকাল, এযুগ সেযুগ বলে অভিহিতও করা হয়। সমাজ, মানুষের রীতিনীতি, চলন-বিলন, এরাই ধরে রাখে কালের এক-একটা টুকরোকে, ইতিহাস নাম দেয় অমুক যুগ, তমুক যুগ।
কিন্তু কালকে অতিক্রম করতেও থাকে বৈকি কেউ কেউ, নইলে কারা এগিয়ে দেবে সেই প্রবহমাণ ধারাকে? সে ধারা মাঝে মাঝেই স্তিমিত হয়ে যায়, নিস্তরঙ্গ হয়ে যায়। তবু এরা বর্তমানের পূজো কদাচিৎ পায়, এরা লাঞ্ছিত হয়, উপহসিত হয়, বিরক্ত-ভাজন হয়।
এদের জন্যে কাটার মুকুট।
এদের জন্যে জুতোর মালা।
০১.
তবু এরা আসে। হয়তো প্রকৃতির প্রয়োজনেই আসে। তবে কোথা থেকে যে আসবে তার নিশ্চয়তা নেই। আসে রাজরক্তের নীল আভিজাত্য থেকে, আসে বিদ্যা বৈভবের প্রতিষ্ঠিত স্তর থেকে। আসে নামগোত্রহীন মূক মানবগোষ্ঠীর মধ্য থেকে, আসে আরো ঘন অন্ধকার থেকে।
তাদের অভ্যুদয় হয়তো বা রাজপথের বিস্তৃতিতে, হয়তো বা অন্তঃপুরের সঙ্কীর্ণতায়।
কিন্তু সবাই কি সফল হয়?
সবাইয়েরই কি হাতিয়ার এক?
না।
প্রকৃতি কৃপণ, তাই কাউকে পাঠায় ধারালো তলওয়ার হাতে দিয়ে, কাউকে পাঠায় ভোঁতা বল্লম দিয়ে। তাই কেউ সফল সার্থক, কেউ অসফল ব্যৰ্থ। তবু প্ৰকৃতির রাজ্যে কোনো কিছুই হয়তো ব্যর্থ নয়। আপাত-ব্যর্থতার গ্লানি হয়তো পরবর্তীকালের জন্য সঞ্চিত করে রাখে শক্তিসাহস।
সুবৰ্ণলতা এসব কথা জানতো না। সুবৰ্ণলতা তার গৃহত্যাগিনী মার নিন্দার সম্বল নিয়ে সংসারে নেমেছিল!
তাই সে জেনেছিল সে কেবল তার অসাৰ্থক জীবনের গ্লানির বোঝা নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে। জেনেছিল তার জন্য কারো কিছু এসে যাবে না।
সুবৰ্ণলতার মৃত্যুতে যে সুবৰ্ণলতার সতেরো বছরের আইবুড়ো মেয়ে পায়ের তলার মাটি খুঁজে পায় নি, এ খবর জেনে যায় নি সুবৰ্ণলতা। জেনে যেতে পারে নি ওই মেয়েটার কাছে সুবৰ্ণলতার মৃত্যুদিনই জন্মদিন।
দক্ষিণের এই চওড়া বারান্দাটায়, যেখানে শুয়ে থাকতো সুবৰ্ণলতা সংসার থেকে চোখ ফিরিয়ে, সেখানটা থেকে মেয়েটা যেন আর নড়তে চায় না। সুবৰ্ণলতাকে নতুন চোখে দেখতে শিখল বুঝি সে জায়গাটা শূন্য হয়ে যাবার পর। দেখতে শিখল বলেই ভাবতে শুরু করল, জীবন শুরু করবার সময়ে যদি সুবৰ্ণলতা একখানা দক্ষিণের বারান্দা পেত, হয়তো জীবনের ইতিহাস অন্য হতো সুবৰ্ণলতার।
হয়তো ওই মেয়েটার চিন্তায় কিছু সত্য ছিল, হয়তো তাই হতো। কিন্তু তা হয় নি। দক্ষিণের বারান্দার দাক্ষিণ্য জোটে নি। সুবৰ্ণলতার কপালে।
অথচ জুটলে জুটতে পারতো।
সে বাড়িখানাও তো সুবৰ্ণলতার চোখের সামনেই তৈরি হয়েছিল। ওদের পুরনো এজমালি বাড়ির অংশের দরুন টাকাটা হাতে পেতেই সুবৰ্ণলতার বুদ্ধিমান ভাসুর, দেবর, স্বামী তাড়াতাড়ি বাড়িখানা ফেদে ফেলল। বলল, টাকার পাখা আছে। ওকে পুতে ফেলাই বুদ্ধির কাজ। গলির মধ্যে, তা হোক, বড় রাস্তার মুখেই, দুবার মোড় ঘুরতে হয় না।
সেই বাড়িতেই তো ত্ৰিশটা বছর কাটিয়ে গেছে সুবৰ্ণলতা, সেখান থেকেই বার আষ্টেক আঁতুড়ে গেছে, কেন্দেছে, হোসেছে, খেটেছে, বিশ্রাম করেছে, সংসারলীলার যাবতীয় লীলাতেই অংশগ্রহণ করেছে, তবু পিঞ্জরের যন্ত্রণাবোধে অহরহই ছটুফট করেছে।
সুবৰ্ণলতার স্বামী ক্ষুব্ধ গর্জনে বলতো, যেচে দুঃখ ডেকে আনা! সেধে কষ্ট ভোগ করা! শত সুখের মধ্যিখানে রাতদিন দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ছে মানুষের! আর কী চাই তোমার? আর কত চাই?
সুবৰ্ণলতা বলতো, আমি তো কিছু চাই না।
তা চাইবে কেন, না বলতে যখন সব কিছু হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছ। তোমার অন্য জায়েদের সঙ্গে অবস্থা মিলিয়ে দেখেছি কোনোদিন?