সুবর্ণলতা – আশাপূর্ণা দেবীর একটি বিশেষ উপন্যাস। সুবর্ণলতা উপন্যাসের নারী চরিত্র আশাপূর্ণা দেবী যে ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা অতুলনীয়। আশাপূর্ণা দেবীর সুবর্ণলতা উপন্যাসটির সাথে তার লেখা প্রথম প্রতিশ্রুতি গ্রন্ঠের একটি যোগ সূত্র রেখেছেন। আশাপূর্ণা দেবী বলেন, সমাজবিজ্ঞানীরা লিখে রাখেন সমাজ বিতর্কের ইতিহাস, আমি একটি কাহিনীর মধ্যে সেই বিবর্তনের একটি রেখাঙ্কনের সামান্য চেষ্টা করেছি মাত্র।

সুবর্ণলতা বইয়ের বিবরণঃ

১.০১ একাল-সেকাল নিয়ে তর্ক

আপাতদৃষ্টিতে সুবৰ্ণলতা একটি জীবনকাহিনী, কিন্তু সেইটুকুই এই গ্রন্থের শেষ কথা নয়। সুবৰ্ণলতা একটি বিশেষ কালের আলেখ্য। যে কাল সদ্যবিগত, যে কাল হয়তো বা আজও সমাজের এখানে সেখানে তার ছায়া ফেলে রেখেছে। সুবৰ্ণলতা সেই বন্ধন-জর্জরিত কালের মুক্তিকামী আত্মাৱ ব্যাকুল যন্ত্রণার প্রতীক।

আর একটি কথা বলা আবশ্যক। আমার প্রথম প্রতিশ্রুতি গ্রন্থের সঙ্গে এর একটি যোগসূত্র আছে। সে যোগসূত্র কাহিনীর প্রয়োজনে নয়, একটি ভাবীকে পরবতী কালের ভাবধারার সঙ্গে যুক্ত করার প্রয়োজনে।

সমাজবিজ্ঞানীরা লিখে রাখেন সমাজ-বিবর্তনের ইতিহাস, আমি একটি কাহিনীর মধ্যে সেই বিবর্তনের একটি রেখাঙ্কনের সামান্য চেষ্টা করেছি মাত্ৰ।

–লেখিকা

 

প্রথম পর্ব

একাল-সেকাল নিয়ে তর্ক তো চিরকালের, কিন্তু কেমন করে চিহ্নিত করা যায়। সেই কালকে? একএকটা কালের আয়ু শেষ হলেই কি এক-একবার যবনিকা পড়ে? যেমন যবনিকা পড়ে নাট্যমঞ্চে?

না, যবনিকার অবকাশ কোথায়? অবিচ্ছিন্ন স্রোত। তবু একাল সেকাল, এযুগ সেযুগ বলে অভিহিতও করা হয়। সমাজ, মানুষের রীতিনীতি, চলন-বিলন, এরাই ধরে রাখে কালের এক-একটা টুকরোকে, ইতিহাস নাম দেয় অমুক যুগ, তমুক যুগ।

কিন্তু কালকে অতিক্রম করতেও থাকে বৈকি কেউ কেউ, নইলে কারা এগিয়ে দেবে সেই প্রবহমাণ ধারাকে? সে ধারা মাঝে মাঝেই স্তিমিত হয়ে যায়, নিস্তরঙ্গ হয়ে যায়। তবু এরা বর্তমানের পূজো কদাচিৎ পায়, এরা লাঞ্ছিত হয়, উপহসিত হয়, বিরক্ত-ভাজন হয়।

এদের জন্যে কাটার মুকুট।
এদের জন্যে জুতোর মালা।

 

০১.

তবু এরা আসে। হয়তো প্রকৃতির প্রয়োজনেই আসে। তবে কোথা থেকে যে আসবে তার নিশ্চয়তা নেই। আসে রাজরক্তের নীল আভিজাত্য থেকে, আসে বিদ্যা বৈভবের প্রতিষ্ঠিত স্তর থেকে। আসে নামগোত্রহীন মূক মানবগোষ্ঠীর মধ্য থেকে, আসে আরো ঘন অন্ধকার থেকে।

তাদের অভ্যুদয় হয়তো বা রাজপথের বিস্তৃতিতে, হয়তো বা অন্তঃপুরের সঙ্কীর্ণতায়।

কিন্তু সবাই কি সফল হয়?

সবাইয়েরই কি হাতিয়ার এক?

না।

প্রকৃতি কৃপণ, তাই কাউকে পাঠায় ধারালো তলওয়ার হাতে দিয়ে, কাউকে পাঠায় ভোঁতা বল্লম দিয়ে। তাই কেউ সফল সার্থক, কেউ অসফল ব্যৰ্থ। তবু প্ৰকৃতির রাজ্যে কোনো কিছুই হয়তো ব্যর্থ নয়। আপাত-ব্যর্থতার গ্লানি হয়তো পরবর্তীকালের জন্য সঞ্চিত করে রাখে শক্তিসাহস।

 

সুবৰ্ণলতা এসব কথা জানতো না। সুবৰ্ণলতা তার গৃহত্যাগিনী মার নিন্দার সম্বল নিয়ে সংসারে নেমেছিল!

তাই সে জেনেছিল সে কেবল তার অসাৰ্থক জীবনের গ্লানির বোঝা নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে। জেনেছিল তার জন্য কারো কিছু এসে যাবে না।

সুবৰ্ণলতার মৃত্যুতে যে সুবৰ্ণলতার সতেরো বছরের আইবুড়ো মেয়ে পায়ের তলার মাটি খুঁজে পায় নি, এ খবর জেনে যায় নি সুবৰ্ণলতা। জেনে যেতে পারে নি ওই মেয়েটার কাছে সুবৰ্ণলতার মৃত্যুদিনই জন্মদিন।

দক্ষিণের এই চওড়া বারান্দাটায়, যেখানে শুয়ে থাকতো সুবৰ্ণলতা সংসার থেকে চোখ ফিরিয়ে, সেখানটা থেকে মেয়েটা যেন আর নড়তে চায় না। সুবৰ্ণলতাকে নতুন চোখে দেখতে শিখল বুঝি সে জায়গাটা শূন্য হয়ে যাবার পর। দেখতে শিখল বলেই ভাবতে শুরু করল, জীবন শুরু করবার সময়ে যদি সুবৰ্ণলতা একখানা দক্ষিণের বারান্দা পেত, হয়তো জীবনের ইতিহাস অন্য হতো সুবৰ্ণলতার।

হয়তো ওই মেয়েটার চিন্তায় কিছু সত্য ছিল, হয়তো তাই হতো। কিন্তু তা হয় নি। দক্ষিণের বারান্দার দাক্ষিণ্য জোটে নি। সুবৰ্ণলতার কপালে।

অথচ জুটলে জুটতে পারতো।

সে বাড়িখানাও তো সুবৰ্ণলতার চোখের সামনেই তৈরি হয়েছিল। ওদের পুরনো এজমালি বাড়ির অংশের দরুন টাকাটা হাতে পেতেই সুবৰ্ণলতার বুদ্ধিমান ভাসুর, দেবর, স্বামী তাড়াতাড়ি বাড়িখানা ফেদে ফেলল। বলল, টাকার পাখা আছে। ওকে পুতে ফেলাই বুদ্ধির কাজ। গলির মধ্যে, তা হোক, বড় রাস্তার মুখেই, দুবার মোড় ঘুরতে হয় না।

সেই বাড়িতেই তো ত্ৰিশটা বছর কাটিয়ে গেছে সুবৰ্ণলতা, সেখান থেকেই বার আষ্টেক আঁতুড়ে গেছে, কেন্দেছে, হোসেছে, খেটেছে, বিশ্রাম করেছে, সংসারলীলার যাবতীয় লীলাতেই অংশগ্রহণ করেছে, তবু পিঞ্জরের যন্ত্রণাবোধে অহরহই ছটুফট করেছে।

সুবৰ্ণলতার স্বামী ক্ষুব্ধ গর্জনে বলতো, যেচে দুঃখ ডেকে আনা! সেধে কষ্ট ভোগ করা! শত সুখের মধ্যিখানে রাতদিন দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ছে মানুষের! আর কী চাই তোমার? আর কত চাই?

সুবৰ্ণলতা বলতো, আমি তো কিছু চাই না।

তা চাইবে কেন, না বলতে যখন সব কিছু হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছ। তোমার অন্য জায়েদের সঙ্গে অবস্থা মিলিয়ে দেখেছি কোনোদিন?

সুবৰ্ণলতা মৃদু হেসে বলতো, দেখেছি বৈকি!

তবু রাতদিন নিঃশ্বাস! যেমন মা তেমনি ছা হবে তো!

সুবৰ্ণলতা তীব্রস্বরে বলতো, আবার?

ওর বর তখন ভয় পেয়ে বলতো, আচ্ছা বাবা আচ্ছা, আর বলবো না।

ওই তীব্রতার পিছনে যে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার স্মৃতি। ভয় পাবে বৈকি।

কিন্তু এসব তো অনেক দিন পয়ের কথা। যখন সুবৰ্ণলতার রাগের কাছে রূপোলী তারের আভাস, যখন সুবৰ্ণলতার সেই দীর্ঘ উন্নত বাড়-বাড়ন্ত গড়নে ক্ষয় ধরেছে।

আগে যখন সুবৰ্ণলতা তার স্বামীত্যাগিনী মায়ের নিন্দনীয় ইতিহাসের সম্বল নিয়ে মাথা হেঁট করে শ্বশুর-ঘর করতে এসেছিল, যখন কোনো একটা উপলক্ষ পেলেই সুবৰ্ণলতার শাশুড়ী সুবৰ্ণলতাকে তার বিয়ের দরুন পাওয়া জরিতে জবড়াজঙ বেগুনী রঙা বেনারসী শাড়ী আর বড় বড় কলকাদার লাল মখমলের জ্যাকেট পরিয়ে সাজিয়ে ফেলত, আর বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলেই তার সামনে সাতখানা করে নিন্দে করতো বৌয়ের আর বৌয়ের বাপের বাড়ির-তখন?

তখন এত সাহস কোথা সুবৰ্ণর? নিজের বাড়িতেই তখন আড্ডা ছিল মুক্তকেশীর, যেতে হত না কোথাও। পাড়ার সবাই আসতো মুক্তকেশীর কাছে। অলিখিত আইনে পাড়ার মহিলাকুল সবাই ছিল মুক্তকেশীর প্রজা।

বাড়িটা তিনতলা, ঘরদালানের সংখ্যা কম নয়, দুদিকে দুটো রান্নাঘর, শানবাঁধানো উঠোন, গোটা তিন-চার কল-চৌবাচ্ছা, ধর কিছু নেই কোথাও। তবে ওই পর্যন্তই। বাড়িটা যেন সাদামাটার একটা প্রতীক, না আছে শ্ৰী না আছে ছাদ, বাড়ি না বাড়ি!

বাস করতে হলে কতটুকু কি আবশ্যক, শুধু এই চিন্তাটুকু ছাড়া বাড়ি বানাবার সময় আর কোনো চিন্তা যে এদের মাথায় এসেছিল এমন প্ৰমাণ পাওয়া যায় না।

মঠ নয়, মন্দির নয়, বড়মানুষের বাগানবাড়িও নয়, গোরস্ত লোকের বসবাসের বাড়ি। তার মধ্যে শোভা সৌন্দর্য শিল্প-রুচি এ সবের সম্পর্ক কি এদের বুদ্ধির বাইরে।

সুবৰ্ণলতাকে তাই এরা পাগল বলে। বলবে না কেন? সুবৰ্ণলতা যে ওই সব অদ্ভুত জিনিসগুলো খুঁজে বেড়ায়।

খুঁজে বেড়ায় বলেই বাড়ি বানানোর মধ্যপথে পুলকিত আনন্দে বরের কাছে রোজ ধর্ণা দিয়েছে তাকে একবার দেখিয়ে আনতে বাড়িটা। তারপর নতুন সংযোজনার প্ল্যান যোগাবে সুবৰ্ণলতা।

বর অবশ্য উড়িয়ে দিত আবদারটা। সুবর্ণ বলতো, বাঃ, তোমাদের আর কি? কতক্ষণই বা বাড়িতে থাকো? খাওয়া-নাওয়া আর ঘুম, এই তো! বাড়ি ভোগ করতে তো আমরা মেয়েমানুষরাই। আমাদের মত নিয়ে করলে—

করলে আর কি? লোকে বলবে স্ত্রৈণা! তবে যেতে চাও মাকে বল গে!

মাকে যে বলতেই হবে এ সত্য জানতো বৈকি সুবৰ্ণ, তবু বরের কাছে আবদার করায় আমোদ আছে, মিষ্টত্ব আছে, আশা আছে। হ্যাঁ, ছিল বৈকি আশা। বরের উপর না হোক, নিজের ক্ষমতার উপর অনেকখানি আস্থা আর আশা ছিল তখন সুবৰ্ণলতার। তখন সুবৰ্ণলতা কানে ইয়ারিং পরতো, তিনপেড়ে ড়ুরে শাড়ি পরতো, আর অনেক কসরৎ করে কাচপোকা ধরে তাকে কেটে কেটে টিপ করতো।

ইচ্ছেটাই তখন প্ৰবল তার, সব বিষয়ে।

অতএব মুক্তকেশীকেই গিয়ে ধরলো, বাড়িটা একবার দেখতে চলুন না মা, বেশি তো দূর নয়।

মুক্তকেশী অবশ্য সে আগ্রহে জল ঢাললেন, হাঁ-হাঁ করে উঠে বললেন, শোনো কথা, এখন যাবে কি? আদিনে অক্ষণে গেলেই হল? ভিটে বলে কথা। ঠাকুরমশাই শুভদিন দেখে দেবেন, বাস্তুপূজো করে তবে তো গৃহপ্ৰবেশ!

তার্কিক-স্বভাব সুবৰ্ণলতা অবিশ্যি সঙ্গে সঙ্গেই দুম করে বলে বসেছিল, আর এই যে আপনার ছেলেরা নিত্য-দিন যাচ্ছেন, তার বেলা দোষ হয় না?

মুক্তকেশী অভ্যস্ত বিরক্তির গলায় বলেছিলেন, তক্ক করা রোগটা ছাড়ো তো বাছা, এই রোগেই আমার হাড় পুড়িয়ে খেলে তুমি। বেটা ছেলের আবার কিছুতে দোষ আছে নাকি? মেয়েমানুষকেই সব কিছু মেনে-শুনে চলতে হয়।

অতএব বাড়ি তৈরি হতে হতে আর সে বাড়িকে দেখা ঘটে ওঠে নি। সুবৰ্ণলতার, কারণ সুবৰ্ণলতা যে মেয়েমানুষ এটা তো অস্বীকার করবার নয়।

অগত্যা আবার বরকেই ধরা, সামনের দিকে একটা বারান্দা রাখতে হবে কিন্তু, ঝুলবারান্দা। যাতে রাস্তা দেখা যায়।

সুবৰ্ণলতার বর চোখ কুঁচকে বলে উঠেছিল, কেন? রাস্তার দিকে ঝোলা বারান্দার হঠাৎ কি এত দরকার পড়ল? বিকেলবেলা বাহার দিয়ে দাঁড়াবার জন্যে?

সুবৰ্ণলতা তখনও ছেলেমানুষ, তখনও ওর সন্দেহবাই বরের কুটিল কথাগুলোর অন্তর্নিহিত কদৰ্য অর্থগুলো ধরতে পারত না, তাই বলে উঠেছিল, বা রে, বাহার দেওয়া আবার কি? রাস্তার দিকে বারান্দা থাকলে রাস্তাটা কেমন দেখা যায়! ঠাকুরভাসান, মহরম, বর-কনে যাওয়া, ঘটার মড়ার হরি সংকীর্তন, কত কি দৃশ্য রাস্তায়—

বর অবশ্য এবার হেসে ফেলেছিল। ওই এক কুটিল বান্তিকগ্ৰস্ত হলেও বয়সে সে-ও ছেলেমানুষই। হেসে বলেছিল, আর কিছু না হোক, শেষেরটা একটা দ্রষ্টব্য বটে। বিশেষণটা দিয়েছ ভাল, ঘটার মড়া।

সুবৰ্ণলতা অতঃপর মুখঝামটা দিতে কসুর করে নি। বলেছিল, ভুল কি বললাম, ঘটাপটা করে মড়া নিয়ে যায় না লোকে?

তা যায় বটে।

আমাকেও তাই নিয়ে যাবে তো? আবদেরে গলায় বলে ওঠে সুবৰ্ণলতা, আমি যখন মরে যাব, ঘটা করে সংকীর্তন করে নিয়ে যাবে?

বর মাথায় হাত দিয়ে বলে, সর্বনাশ! কে আগে মরে তার ঠিক আছে? আমি তোমার থেকে কত বড়, আমিই নিৰ্ঘাত আগে মরবো–

সুবৰ্ণলতা নিশ্চিন্ত গলায় বলে, ইস। মরলেই হল আর কি? সেদিন মার সেই কালীঘাটের দৈবজ্ঞি। আমার হাত দেখে কী ঘলে গেল মনে নেই?

না, মনে নেই তো—, বর অসহিষ্ণু গলায় বলে, কী বলেছিল? আমি অমর হবো?

যদিও বৌয়ের বয়েস মাত্র চোদ এবং তার বাইশ, তত্ৰাচ অসহিষ্ণুতায় খুব একটা ঘাটতি দেখা যাচ্ছে না। অন্তত বরপক্ষে তো নয়ই।

কিন্তু কথার ভটচায সুবৰ্ণলতাকে যে এই রাত্তিরেই যত কথায় পায়, তাই সে বলে ওঠে, আহা! কলিযুগে যেন অমর বর আছে! বলেছে আমি সধবা মরবো।

বাঃ, বেড়ো! তা এই সুখবরটি দিতে বোধ হয় বেশ কিছু বাগিয়ে নিয়ে গেছে তোমার কাছ থেকে?

আমার কাছ থেকে?

সুবৰ্ণলতা আকাশ থেকে পড়ে, আমি আবার কোথায় কী পাবো? মা সবাইয়ের হাত দেখালেন, চাল দিলেন, পয়সা দিলেন, নতুন গামছা দিলেন—

না, দিনের বেলায় নয়, দিনের বেলায় ছেলেমানুষ বৌ বরের সঙ্গে গল্প জুড়বে, এমন অনাচার আর যার সংসারে হয় হোক, মুক্তকেশীর সংসারে কদাপি ঘটতে পারে না।

এ নাটক রাত্রেরাই।

প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্য।

অবশ্যই বর এই মধুর ক্ষণটুকু এমন অকারণে অপব্যয় করতে রাজী নয়, তাই ওই তুচ্ছ কথায় যবনিকা টানতে বলে ওঠে, ভালই করেছেন। ওরা সব লোক সুবিধের নয়। ওদের সন্তুষ্ট রাখাই ভাল।

এ মন্তব্যের পরই বর একটু অনুচ্চ হাসির শব্দ শুনতে পায়।

সঙ্গে সঙ্গেই কঠোর গলায় বলে ওঠে, হাসলে যে?

এমনি।

এমনি মানে? এমনি কেউ হাসে?

পাগলে হাসে।

তা তুমি কি পাগল?

ছিলাম না, তোমাদের সংসারে এসে হয়েছি–চতুর্দশী সুবৰ্ণলতা প্ৰায় পাকা গিনীদের মতই ঝঙ্কার দেয়, দেখে-শুনেই পাগল। মার কোন কাজটাই বা তোমাদের কাছে ভুল? মা যদি ওকে কিছু না দিতেন, নিৰ্ঘাত বলতে, দেন নি বেশ করেছেন, যত সব ভণ্ড!

বলা বাহুল্য সুবৰ্ণ-পতি এতে খুব প্রীত হয় না, তীব্ৰস্বরে বলে, তবে কী করা উচিত? মাকে থো করে বৌয়ের পাদোদক খাওয়া?

সুবৰ্ণলতা দুৰ্গা দুৰ্গা করে উঠে বলে, যা নয়। তাই মুখে আনা! তার মানে আমায় রাগিয়ে দিয়ে কাজটি পণ্ড করার চেষ্টা। আমি কিন্তু রাগছি না, আমি হচ্ছি। ভবি। এই তোমার গা ছয়ে প্রতিজ্ঞা করছি সামনে বারান্দা না করলে তোমাদের সে বাড়িতে যাবই না। আমি।

বর তখনকার মত বলে, আচ্ছা আচ্ছা দেখা যাবে। এখন শোও তো এসে।

অন্ধকারের আবরণ তাই রক্ষে, নইলে বরের আদরের ডাকে তরুণী পত্মীর বিরক্তি-তিক্ত মুখভঙ্গীটুকু দেখতে পেলে বোধ করি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেত বর।

তবু গলাটায় মাধুর্যের ঘাটতি ধরতে পারলো বৈকি। সুবৰ্ণ যখন নীরস গলায় বলল, তোমার তো দেখা যাবে।! যা দেখবে তা জানাই আছে। একের নম্বরের মিথু্যক! বাড়ি করতে আর জমি পেল না— গলির মধ্যে! তখন সেও সমান নীরস গলায় বলে ওঠে, বাড়ি আমার একলার নয়। মাথার ওপর মা দাদা এদিকে ভাইয়েরা, আমি আবদার করিগে–ওগো আমার বৌ গড়ের মাঠের ওপর বাড়ি চায়। যত সব!

গড়ের মাঠ বলি নি আমি, শুধু বড় রাস্তাটা দেখতে চাই। মাথার ওপর ওপরওলা থাকলে একটা কথাও বলতে নেই বুঝি? আমি বলে রাখছি বারান্দা আমার চাই-ই চাই।

আমার চাই-ই, চাই!

বাঙালী গোরস্ত ঘরের বৌয়ের মুখের এই ভাষা! আসপদ্দা বটে একখানা! এত আসপদ্দা পেল কোথায় সুবৰ্ণলতা? এই কটা বছর শ্বশুরবাড়ির ভাত খেয়েই কি ওর মার ইতিহাস ভুলে গেছে? ভুলে গেছে তার লজ্জার গ্লানি? দিব্যি একখানি হয়ে উঠেছে।

আসপদ্দাটা তাহলে ওই জন্মসূত্রেই পাওয়া? তা ছাড়া আর কি? আরো তো বৌ রয়েছে

যখন-তখন তাই উদ্দেশে গালি পাড়েন মুক্তকেশী। কি করবো দুই বুড়ীই যে মরে হাতছাড়া হয়ে গেছে, নইলে আমার মাকে আর সইমাটিকে নিতাম এক হাত! নিজের নাতনীর গুণ জানতো না বুড়ী? জানতো, জেনে বুঝেই আমার গলায় এই অপরূপ মালাটি গছিয়ে দিয়েছিল। পূর্বজন্মের ঘোরতর শত্রুতা ছিল আর কি!

আবার এও বলেন কখনো কখনো, বুড়ীদের আর দোষ দিই কেন, মা-টির গুণই গাই। কেমন মা! আমড়া গাছে কি আর ল্যাংড়া ফলবে!

তবু সুবর্ণ তখনও চোটপাট উত্তর করতে শেখে নি। শাশুড়ী মায়ের প্রসঙ্গ তুললেই মরমে মরে যেত, আর শেষ অবধি যত আক্রোশ আর অভিযোগ গিয়ে পড়তো মায়ের উপরেই।

কেন, কেন তার মা আর সকলের মায়ের মত নয়? কেন তার মা স্বামীত্যাগ করে গৃহত্যাগ করে ছেলেমেয়ের মুখ হাসিয়ে গেছে?

সন্তানস্নেহ কিছুই নয় তা হলে? জেদটাই সব চেয়ে বড় তার কাছে? এমন কি একখানা চিঠি দিয়ে পর্যন্ত উদিশ করে না? সুবর্ণর যে অনেক বাধা সে কি মা বোঝে না? সুবর্ণ যদি তার মাকে একখানা চিঠি লিখতে বসে, বাড়িতে কোর্ট-কাছারি বসে যাবে না?

আইনজারি হবে না?

নিষেধাজ্ঞা?

একেই তো ওই অপরাধে কেউ তাকে দেখতে পারে না।

জবড়জং গাঢ় বেগুনী রঙা বেনারসী শাড়ি, আর জড়ির কলকাদার লাল মখমলের জ্যাকেট পড়া ন বছরের সুবৰ্ণলতা যখন ভাগ্যতাড়িতের মত এদের বৌ হয়ে এসে ঢুকলো, তখন তো একদিনেই তিন-তিনটে বছর বয়েস বেড়ে গেল তার। ঘরে পরে সবাই বলে উঠল, ন বছর? ওই ধাইপেয়ে দশাসই মেয়ের বয়স ন বছর? ন বছর ও তিন বছর আগে ছিল।

সেই বিরূপতার দৃষ্টি আজও ঘুচল না। সংসারের। বলতে গেলে পতিতের দৃষ্টিতেই দেখা হয়েছে তাকে। হতে পারে মা খারাপ হয়ে বেরিয়ে যান নি, তবু কুলত্যাগ, গৃহত্যাগ, স্বামীত্যাগ, এও কি সোজা অপরাধ নাকি?

তা অনেক দিন পর্যন্ত অপরাধিনী-অপরাধিনী হয়েই ছিল সুবর্ণ। তারপর দেখল। এরা শক্তের ভক্ত, নরমের যম! যত নীচু হও ততই মাথায় চড়ে এরা, অতএব শক্ত হতে শিখল।

কিন্তু শক্র হয়ে কি রাস্তার দিকের বাবান্দা আদায় করতে পেরেছিল সুবৰ্ণ?

না, পারে নি।

ওর স্বামী প্ৰবোধ বুঝি চুপি চুপি একবার মায়ের কাছে তুলেছিল কথাটা, মুক্তকেশী বলেছিলেন, না না, ওর গোড়ে গোড় দিয়ে মরিস নি তুই পোবা! ঘরের ভেতর খেমটা নাচছে বৌ, আবার বারান্দায় গলা ঝোলালে আরও কত বড় বাড়বে তা আন্দাজ করতে পারছিস? তোর ভ্যাড়াকান্ত শ্বশুরটা পরিবারকে আস্কারা দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলে শেষে পরিণামে কি ফল পেল দেখেছিস তো? চাই-ই চাই! মেয়েমানুষের মুখে এমন বাক্যি বাবার জন্মে শুনি নি।

এরপর আর কি বলবে প্ৰবোধ? তবে চালাকি একটু খেলে সে। প্রতিদিনই প্ৰবোধ দেয় সুবৰ্ণলতাকে, হচ্ছে গো, শুধু বারান্দা হচ্ছে।

পরিণামে যা হয় হোক, এখন তো বাড়তি কিছু সুখলাভ হয়ে যাচ্ছে, সুবৰ্ণলতার মুখে আহাদের আলো খেলছে, সুবৰ্ণলতা উৎসাহে অধীর হচ্ছে, সুবৰ্ণলতা আত্মসমর্পণে নমনীয় হচ্ছে।

হচ্ছে।

চৌদ্দ বছরের সুবৰ্ণলতার পক্ষে এ সন্দেহ করা শক্ত ছিল, এমন জলজ্যান্ত মিথ্যে ধাপ্পা দেওয়া যায়। বরের প্ৰেম প্ৰীতি ভালবাসার পরিচয়ে মুগ্ধ হচ্ছে তখনও। আর কল্পনায় স্বৰ্গ গড়ছে।

চৌদ্দ বছরের সুবৰ্ণলতার পক্ষে এ সন্দেহ করা শক্ত ছিল, এমন জলজ্যান্ত মিথ্যে ধাপ্পা দেওয়া যায়। বরের প্ৰেম প্ৰীতি ভালবাসার পরিচয়ে মুগ্ধ হচ্ছে তখনও। আর কল্পনায় স্বৰ্গ গড়ছে।

এই ভাঙা পচা বাড়িটা ছেড়ে নতুন বাড়িতে গিয়েছে সে, বারান্দার ধারে চমৎকার সুন্দর একখানি ঘর, বড় বড় জানলা, লাল টুকটুকে মেঝে, সেই ঘরটিকে নিজের মনের মত সাজাবে সুবৰ্ণ। দেয়ালে দেয়ালে ছবি, তাকের উপর ঠাকুর-দেবতার পুতুল, বাক্স-প্যাটরায় ফুলকটা ঘেরাটোপ, ঝালর দেওয়া বালিশ, ফর্সা বিছানা। সেই ঘরে বসে কাথায় ফুল তুলবে সুবৰ্ণ চুপি চুপি লুকিয়ে, ভবিষ্যতের জন্যে।

কাঁথার প্রয়োজনের সূচনা নাকি দেখা দিয়েছে সুবর্ণর দেহের অন্তঃপুরে। সুবৰ্ণ বোঝে না। অতশত, গিনীরাই বোঝেন। ভয়ও করছে, বেশ একটা মজা-মজাও লাগছে।

অনেক দোলায় দুলছে এখন সুবর্ণ। ন বছরে এসেছে। এদের বাড়ি, সেই থেকেই স্থিতি, মা নেই, কেই বা নিয়ে যায়? বাপ সাহসই করে নি। পিসি একটা আছে কাছে-পিঠে, নিয়ে যেতে চেয়েছিল। একবার, এরা পাঠায় নি। এরা বলেছে, সে-কুলের সঙ্গে আর সম্পর্ক রেখে কাজ নেই। বাপ দেখতে আসে মাঝে-মধ্যেই ওই ঢের! তাও তো এদের সামনে ঘোমটা দিয়ে একবার দেখা। বোধ হয় সেই দুঃখে বাপও এখন আর আসে না বেশি। অতএব এদের নিয়েই থাকতে হবে সুবৰ্ণকে, তাই এদের মানুষ করে তুলতে ইচ্ছে করে সুবর্ণর। ইচ্ছে করে এরা শৌখিন হোক, সভ্য হোক, রুচি-পছন্দর মানে বুকুক। এদের নিয়ে সুন্দর করে সংসার করবে। সুবর্ণ।

রেষারেষি, ঝগড়াঝগড়ি, স্বাৰ্থ নিয়ে মারামারি, এসব দুচক্ষের বিষ সুবর্ণর, দু চক্ষের বিষ সারাক্ষণ ওই রান্নাঘরে পড়ে থাকাও। উদার আবহাওয়ার স্বাদ জানে না। এরা। জানে না বই পড়তে, পদ্য মুখস্থ করতে।. ভাবতে ভাবতে মনটা হারিয়ে যায় সুবর্ণর, মনে পড়ে যায় তার আকস্মিক বিয়েটার কথা। বিয়েটা না হয়ে গেলে হয়তো এতদিন পাসের পড়া পড়তো সুবর্ণ।

মা তো বলতো তাকে, তোকে আমি তোর দাদাদের মতন পাসের পড়া পড়াবো।

সুবৰ্ণর ভাগ্যে ভগবান তেঁতুল গুললো।

যাক, এই জীবনের মধ্যেই মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে সুবৰ্ণকে। আর দাঁড়ানোর প্রথম সোপানই তো সুন্দর একটা বাড়ি। পরিবেশটা সুন্দর না হলে জীবনটা সুন্দর হবে কিসের উপর?

চোদ্দ বছরের সুবৰ্ণর কাছে জীবনসৌন্দর্যের মাপকাঠি তখন ওই রাস্তা দেখতে পাওয়া বারান্দা দেওয়া একখানি ঘর।

বারে-বারেই সে তাই বরকে জিজ্ঞেস করে, হ্যাগো, কতখানি চওড়া হচ্ছে?

বর ভুরু কুঁচকে বলে, তা অনেকখানি।

তা বেশ। কারণ হঠাৎ একটা বরকনে কি ঠাকুর গেল, সবাই মিলে দেখতে হবে তো বারান্দায় বুকে?

বীর তীক্ষ্ণ হয়।

বলে, সবাই তোমার মতন অমন বারান্দা-পাগল নয়।

তা সত্যি। সুবর্ণর চোখেমুখে আলো ঝলসে ওঠে, পাগলাই আছি আমি একটু! কী আহাদ যে হচ্ছে ভেবে! হ্যাগো, রেলিঙে সবুজ রঙ দেওয়া থাকবে তো?

তা সবুজ বল সবুজ, লাল বল লাল, তোমার ইচ্ছেতেই হচ্ছে যখন—

সুবৰ্ণ গলে পড়ে।

সুবৰ্ণ তার বরের মধ্যে সেই প্ৰেম দেখতে পায়, যা সে বইতে পড়েছে। বই অবশ্য লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তে হয়, শাশুড়ী ননদ দেখলে মেরে ফেলবে।

কিন্তু যোগান দেয় এদেরই একজন।

সুবৰ্ণর কাছে সে মানুষ দেবতা-সদৃশ। এদের সঙ্গে তুলনা করলে স্বর্গের দেবতাই মনে হয় তাকে সুবর্ণর। হায়, তার সঙ্গে যদি কথা কইতে পেত সুবর্ণ!

কইবার হুকুম নেই।

এদের রাশ বড় কড়া। বিশেষ করে প্রবোধ পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলা তো দূরের কথা, তাকানো পর্যন্ত পছন্দ করে না। সুযোগ পেলেই যে মেয়েমানুষগুলো খারাপ হয়ে যায়, এ তার বদ্ধমূল ধারণা। ওই বই দেওয়াটা টের পেলে কী যে ঘটতো কে জানে! কিন্তু সুবর্ণ সাবধানী।

তবু সুবর্ণর ইচ্ছে করে সেই দেবতুল্য মানুষটার সঙ্গে একটু কথা কয়। কথা কইতে পেলে সুবর্ণ তাকেই পাঠাতো বাড়িটা কেমন হচ্ছে দেখতে, প্রশ্ন করতো— বারান্দাটা কি রং হলে ভাল হয়!

কিন্তু সে হবার জো নেই যখন, তখন বরের মুখেই ঝাল খাওয়া! যে বর বলেছে, বারান্দাৱ কথা দুঃমি এখন কাউকে গল্প করতে বোলো না। শুধু তুমি জানািচ্ছ। আর আমি জানছি, আর জানছে মিস্ত্রীরা!

 

কিন্তু তার পর?

গৃহপ্ৰবেশের দিন-ক্ষণ দেখে মুক্তকেশী যখন দুখানা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে আর লক্ষ্মীর হাঁড়ি কোলে করে সপরিবারে এসে উঠলেন নতুন বাড়িতে?

১.০২ মুক্তকেশীর সংসার এমন কিছু বিপুল নয়

মুক্তকেশীর সংসার এমন কিছু বিপুল নয়, ছেলে মেয়ে বৌ নাতি নিজে সবাইকে নিয়ে সদস্য-সংখ্যা মাত্র দশ, গৃহপ্ৰবেশ উপলক্ষে বিবাহিতা দুই মেয়ে আর কুচি একটা নাতনী এসেছে এই যা। এই কটা লোককে একখানা সেকেণ্ড ক্লাস ঘোড়ার গাড়িতে ভরে ফেলা খুব একটা শক্ত ছিল না, পুরুষ দু-তিনজন গাড়ির ছাতে উঠে বসলেই স্থান-সন্ধুলান এবং ভাশুর-ভদ্রবৌ সমস্যা, দুটোরই সমাধান হত। তবু যে হিসেবী মুক্তকেশী দুটো গাড়ির আদেশ দিয়েছিলেন সে কেবল লক্ষ্মীর হাড়ির শুচিতা বাঁচাতে।

মেয়ে-বৌদের না হয় এক-একখানা চেলির শাড়ি পরিয়ে নেওয়া হল, কিন্তু ছেলেদের বেলায়? তাদের তো কোট-কামিজ-জুতো ছেড়ে একবস্ত্রে যেতে বলা যায় না? যতই পুরুষ পরশ-পাথর হোক, লক্ষ্মীর হাঁড়ি বলে কথা! যার মধ্যে সমগ্র সংসারটার ভাগ্য নিহিত।

কুতার্কিক মেজবেঁটা অবিশ্যি তুলেছিল তর্ক, বলেছিল, তবে যে আপনি বলেন, পুরুষ আড়াই পা বাড়ালেই শুদ্ধ-ৰ দাবড়ানি দিয়ে থামিয়েছেন তাকে।

তর্ক তুললেই মেজ বোঁ সুবৰ্ণও অবশ্য দুটো গাড়ির ব্যাপারে উৎসাহিতই। কারণ গাড়িভাড়ার ব্যাপারেও মুক্তকেশীর কার্পণ্যের অবধি নেই। যখনই যেখানে যাওয়া হয়— নেমন্তন্নবাড়ি, কি যোগে গঙ্গা নাইতে, চিড়িয়াখানায়, কি মরা যাদুঘরে, ওই গুড়ের নাগরী ঠাসা হয়ে। ননদরা যখন বাপের বাড়ি আসে তখনই এসব আমোদ-আহ্লাদ হয়, লোকসংখ্যাও তখন বাড়ে, বেড়াতে যাওয়ার সব সুখই যেন সুবর্ণর লুপ্ত হয়ে যায়। তাছাড়া জানলার একটি পাখি খোলবারও তো জো নেই, মুক্তকেশী তাহলে বৌকে বাবার বিয়ে খুড়োর নাচন দেখিয়ে ছাড়বেন।

দুই জা, দুই ননদ আর শাশুড়ী, মাত্র এই পাঁচজন পুরো একখানা গাড়িতে, ছোট দ্যাওর তো গাড়ির মাথায় আছে পথপ্রদর্শক হিসেবে। সুবৰ্ণ যেন হাত-পা মেলিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচে! আর সঙ্গে সঙ্গেই অপূর্ব একটা পুলক আবেগে মনটা উদ্বেল হয়ে ওঠে তার। হ্যাঁ তাই, এটাই হচ্ছে সেই আসন্ন ভাগ্যের সূচনা। খোলামেলা বারান্দার ধারের ঘর, অথবা ঘরের ধারে বারান্দা অপেক্ষা করছে সুবৰ্ণর জন্যে!..

যে বারান্দা থেকে গলা বাড়িয়ে সুবর্ণ বড় রাস্তা দেখতে পাবে। এখন মনে হয়। সুবর্ণর, একটু যে গলির মধ্যে, সেটাই বরং ভাল, অনেকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলেও কেউ কিছু বলবে না বোধ হয়। একেবারে বড় রাস্তার ধারে হলে হয় তো সে শাসনের ভয় ছিল।

 

চেলির শাড়িতে আগাগোড়া মোড়া, মাথায় ঘোমটা, শাশুড়ী ননদ বড় জায়ের দ্বারা পরিবেষ্টিত সুবৰ্ণ হেটমুণ্ডে নতুন বাড়ির দরজায় ঢুকে পড়ে, তবু মাথার উপরে অবস্থিত সবুজ রেলিং-ঘেরা বারান্দার অনুভূতি রোমাঞ্চিত করে তোলে তাকে, সমস্ত মন উদগ্র হয়ে থাকে সিঁড়ির দিকে।

কিন্তু সহজে সিঁড়ির দিকে যাওয়া হয় না, কারণ নীচের তলায় ঠাকুরঘরে বহুবিধ নিয়মকর্মের পালা চলতে থাকে, শান্তিজল না নিয়ে উঠে পড়বার প্রশ্নই নেই।

তবু একসময় সে পালা সাঙ্গ হয়।

শান্তিজল মাথায় নিয়েই টুক করে অন্যজনেদের মাঝখান থেকে সরে আসে সুবর্ণ, পা টিপে টিপে দোতলায় ওঠে।

ননাদরা বাড়ি ঢুকেই হুল্লোড় করে ওপরতলা দেখে গেছে। পুরুষরা দেখার প্রয়োজন অনুভব করে নি, কারণ তারা তো রোজই দেখেছে। তারা শান্তিজল মাথায় নিয়েই ছুটেছে বাজারে দোকানে। পুরো ওপরতলাটা আপাতত খাঁ খ্যা করছে।

খানচারেক ঘর, মাঝখানে টানা দালান, এদিকে ওদিক খোঁচা-খোঁচা একটু একটু ঘরের মত, এরই মাঝখানে দিশেহারা হয়ে ঘুরপাক খায় সুবর্ণ, এ দরজা ও দরজা পার হয়ে একই ঘরে বার বার আসে বিমূঢ়ের মত, বুঝতে পারে না কোন দরজাটা দিয়ে বেরোতে পারলে সেই গোপন রহস্যে ভরা পরম ঐশ্বর্যলোকে দরজাটি দেখতে পাবে!

ঘুরেফিরে তো শুধু দেয়াল।

রিক্ত শূন্য খা খ্যা করা সাদা দেয়াল, উগ্র নতুন চুনের গন্ধবাহী।

তবে কি বারান্দাটা তিনতলায়? আরো তাই নিশ্চয়! তাহলে তো আরোই ভাল।

ইস! এইটা খেয়াল করে নি এতক্ষণ হাঁদা-বোকা সুবর্ণ। একই ঘরে দালানে পাঁচবার ঘুরপাক খেয়ে মরছে! চেলির কাপড় সামলাতে সামলাতে তিনতলায় ছুটি দিল সুবর্ণ। কেউ তো নেই। এখানে, ছুটিতে বাধা কি! একেবারে ছাত পর্যন্তই তো ছুটি দেওয়া যায়।

না। ছাত পর্যন্ত ছুটি দেওয়া গেল না, ছাতের সিঁড়ি বানানো হয় নি। খরচে কুলোয় নি বলে আপাতত বাড়ির ওই অপ্রয়োজনীয় অংশটা বাকি রাখা হয়েছে।

কিন্তু বারান্দা?

যেটা নাকি সুবর্ণর ভালবাসার স্বামী সবাইকে লুকিয়ে শুধু মিস্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে গাঁথিয়েছে? কোথায় সেটা?

সুবৰ্ণ কি একটা গোলকধাঁধার মধ্যে এসে ঢুকে পড়েছে?

 

এর মানে? তুমি এই ওপর চূড়োয় এসে বসে আছ মানে?

নিরালার সুযোগে প্ৰবোধচন্দ্র এই প্রকাশ্য দিবালোকেই স্ত্রীর একেবারে কাছে এসে দাঁড়ায়। যদিও তার ভুরুতে কুঞ্চন-রেখা, কণ্ঠে বিরক্তির আভাস, মেজবৌ মেজবৌ করে হল্লা উঠে গোল নীচে, একা তুমি এখানে কী করছ?

সুবৰ্ণ সে কথার উত্তর দেয় না।

সুবৰ্ণ পাথরের চোখে তাকায়।

বারান্দা কই?

বারান্দা!

প্ৰবোধ একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে বিস্ময়ের গলায় বলে ওঠে, সে কী! খুঁজে পাও নি? আরে তাই তো! ভূতে উড়িয়ে নিয়ে গেল নাকি?

সুবৰ্ণর চোখ ফেটে জল আসে, তবু সে-জলকে নামতে দেয় না সে, কঠোর গলায় বলে, মিথ্যে কথা বললে কেন আমার সঙ্গে?

প্ৰবোধ তবু দামে না।

হেসে হেসে বলে, মিথ্যে কি গো, সত্যি সত্যি! ছিল, ভূতে কিম্বা ক্যাগে নিয়ে পালিয়েছে! এই তোমার গা ছয়ে বলছি—

বলেই এদিক-ওদিক তাকিয়ে খপ করে সেই দুঃসাহসিক কাজটা করে নেয়, গা-টা একবার ছুঁয়ে নেয়। একটু বেশি করেই নেয়।

এর পর আর চোখের জল বাধা মানে না। সুবর্ণ দু হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ে বলে, তুমি আমায় ঠকালে কেন? কেন ঠকালে আমায়? জানো বাবা মাকে ঠকিয়েছিল বলেই মা—

থাক থাক! এবার প্রবোধ বীরত্বে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে, তোমার মার বাহাদুরির কথা আর বড় মুখ করে বলতে হবে না। বেটা ছেলে পুরুষ-বাচ্ছা ভেড়ুয়ার মতন পরিবারের কথায় ওঠবোস করবে, কেমন? বারান্দা, বারান্দা! বারান্দার জন্যে এত বুক-ফাটাফাটি কেন শুনি! কই, বড়বৌ তো একবারও ওকথা মুখে আনে নি? তার মানে সে ভালঘরের মেয়ে, তোমার মতন এমন ছক্কাপাঞ্জা নয়! বারান্দায় গলা বুলিয়ে পরপুরুষের সঙ্গে চোখোচে্যুখির সাধ নেই তার! আর ইনি বারান্দার বিরহে তিনতলায় উঠে এসে পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসলেন! নীচের ওদিকে বড়বৌ কুটনো-বাটনা, রান্না, মাছ-কোটা নিয়ে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। যাও শীগগির নীচে নেমে যাও।

হ্যাঁ, নীচে সুবৰ্ণকে নেমে যেতে হয়েই ছিল। নীচের তলায় সেই বিভীষিকাময় দৃশ্যের ছবি কল্পনাচক্ষে দেখার পর আর বসে থাকার সাহস হয় নি তার, শুধু অপরিসীম একটা ধিক্কারে দীর্ণবিদীর্ণ হতে হতে সে মনে মনে বলেছে, ভগবান তুমি সাক্ষী, বারান্দা দেওয়া ভাল বাড়ি আমি করবো করবো করবো! আমার ছেলেরা বড় হলে, মানুষ হলে, এ অপমানের শোধ নেব!

প্ৰতিজ্ঞা!

কিন্তু সুবৰ্ণলতার সেই আগের প্রতিজ্ঞা? ও যে বলেছিল, বারান্দা না থাকলে সে বাড়িতেই আমি থাকবোই না! হায় রে বাঙালী-ঘরের বৌ, তার আবার প্রতিজ্ঞা! শুধু চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার মত বাড়ির মধ্যে সব থেকে ওঁচা ঘরটা নিজের জন্যে প্রার্থনা করেছিল বোকী অভিমানিনীটা।

বাড়ির পিছন দিকের উত্তর-পশ্চিম কোণের সেই ঘরটা কারুর প্রার্থনীয় হতে পারে এটা মুক্তকেশীর ধারণাতীত। ঘর বিলি করার ব্যাপ্তারে তিনি তখনো মনে মনে হিসেব করছিলেন। জ্যেষ্ঠর শ্রেষ্ঠ ভাগ এ নীতিতে বড় ছেলেকে পূর্ব-দক্ষিণের সেরা ঘরখানাই দিতে হয়, সেজ ছোট দুই ছেলেই তাঁর একটু শৌখিন। তা ছাড়া আজই না হয় তারা আইবুড়ো আছে, দুদিন বাদে তো বিয়ে হবে? তিনতলার ঘর থাকলে ভাল হয় তাদের। এদিকে আবার নিজেরও মাথা-গরমের বাতিক, ঘুপটি ঘরে ভয়, তাছাড়া তাঁর ঘরেই তো তার আইবুড়ো মেয়ের স্থিতি। খারাপট ঘরটা নিলে রেগে মরে যাবে না সে?

ওদিকে আবার মেয়ে-জামাই আসা আসি আছে। মেয়েদের আঁতুড় তোলা আছে। তাদের থাকা उभ0छ्।

খপ করে তাই কোনো কিছু ঘোষণা করে বসে নি মুক্তকেশী।

এহেন সময়, যখন খাওয়া-দাওয়ার পর সবাইকে নিয়ে দোতলায় উঠেছেন তিনি, তখনই এই প্রার্থনা জানায় সুবৰ্ণ।

মুক্তকেশী একটু অবাক না হয়ে পারেন না, তারপর মনে মনে হাসেন। এদিকে একটু তর্কবাগীশ হলেও স্বার্থের ব্যাপারে বোকা-হাবা আছে বেঁটা! তবু বিস্ময়টা প্ৰকাশ করেন না। শুধু প্রীতিকণ্ঠে বলেন, তা এটাই যদি তোমার পছন্দ তো তাই থাক। তবে হাওয়া কি তেমন খেলবে? পেবোর একটু গরম হবে না?

ছেলের গরমের প্রশ্নই করেন মুক্তকেশী, বৌয়ের অবশ্যই নয়।

সুবৰ্ণ মাথা নেড়ে বলে, গরম আর কি, হাতপাখা তো আছেই।

তবে তাই! তোমার বিছনা-তোরঙ্গগুলো এ ঘরে তুলে দিক তাহলে।

তুলে দেবার লোক আছে।

ঝি খুদু একটা জোয়ান পুরুষের শক্তি ধরে। সেও তো এসেছে ঘোড়ার গাড়ির মাথায় চড়ে। খুদুর বলেই বলীয়ান মুক্তকেশী।

তা বলে বিছানা পেতে সে দেবে না, দোতলায় তুলে দিয়েই খালাস। সুবৰ্ণই জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল, বিছানা পেতে নিল। নির্লিপ্ত নিরাসক্ত ভাবে।

কিন্তু প্ৰবোধের তো আর নিরাসক্তি আসে নি, তাই রাত্রে ঘরে ঢুকেই ফেটে পড়ে সে, শুনলাম মেজাগিনী শখ করে এই ওঁচা ঘরটা বেছে নিয়েছেন! মানেটা কি?

প্ৰবোধের বয়েস চব্বিশ, কিন্তু কথার বাঁধুনি শুনলে চল্লিশ ভাবতে বাধা হয় না। না হবে কেন, তিনপুরুষে খাস কলকাত্তাই ওরা—যে কলকাত্তাইরা ধান গাছের তক্তার প্রশ্নে উত্তর খুঁজে পায় না, চাষ করে শুধু কথার।

তা ছাড়া মুক্তকেশীর ছেলেমেয়েদের সকলেরই ধরন-ধারণ পাকা পাকা। তারুণ্যকে ওরা লজ্জার বস্তু মনে করে, সভ্যতাকে বলে ফ্যাশান!

রুচি পছন্দ সৌন্দর্যবোধ এসব হাস্যকর শব্দগুলো ওদের অভিধানে নেই। আর জগতের সারবস্তু যে পয়সা এ বিষয়েও কারো দ্বিমত নেই। তা বলে সবাই যে লোক খারাপ তা মোটেই নয়। সুবর্ণর ভাসুর সুবোধ তো দেবতুল্য, সাতে নেই, পাচে নেই, কারোর সঙ্গে মতান্তর নেই, স্নেহ মমতা সহৃদয়তা সব কিছু গুণই তার মধ্যে আছে।

সন্দেহ-বাতিকগ্রস্ত মেজ ভাইকে মাঝে মাঝেই বকে সে, কী যে বলিস পাগলের মতন! মানুষ কি খাঁচার পাখী যে রাতদিন বন্ধ থাকবে? সবাই চিড়িয়াখানায় যাবে, মেজবৌমা যাবে না? এমন বাতিকগ্রস্ত হলি কেন তুই বল দেখি!

সুবোধের এই ক্ষুব্ধ প্রশ্নের ফলেই সুবর্ণর তার জা-ননদদের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া ঘটে, নচেৎ তো হয়েই গিয়েছিল বারণ।

যাত্রার তোড়জোড় শুনলেই তো রায় দিয়ে বসেন তার পতি পরামগুরু যে যায় যাক, তোমার যাওয়া-ফাওয়া হবে না!

কিন্তু দাদা বললে না করতে পারে না। সেটা আবার সেকালের শিক্ষার গুণ। যত অপছন্দকার ব্যাপারই হোক, বাপ-দাদার আদেশ ঠেলবার কথা ভাবতেই পারত না কেউ।

সুবৰ্ণ এর জন্যে ভাসুরের উপর কৃতজ্ঞ ছিল।

কিন্তু এদিকে এত উদার হলেও পয়সার ব্যাপারে কার্পণ্যের কমতি ছিল না সুবোধের। মাসকাবারী বাজার এনে মুটেকে দুটোর জায়গায় তিনটে পয়সা দিতে আধা ঘণ্টা বধকাব্যকি করতে আলস্য ছিল না তার, মুক্তকেশীর গঙ্গাস্নানের পালকি-বেহারারা দুই আনার বেশী পয়সা চাইলে তাদের নাকের ওপর দরজা বন্ধ করে দিতে দ্বিধামাত্র করতে দেখা যেত না।

দ্বিধা অবশ্য আরো অনেক কিছুতেই করে না সে। যেমন, বাড়ির বাইরের রকে গামছা পরে বসে তেল মাখতে দ্বিধা করে না, উঠোনের চৌবাচ্চার ধারে দাঁড়িয়ে স্নান করতে দ্বিধা করে না।

দেখে সুবর্ণর মনটা যেন কী এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছটফট করে। এ যেন দেবদূতের গায়ে ছেঁড়া পোশাক, ফুলের গায়ে কাদা?

তবু ভাসুরকে সুবৰ্ণ ভক্তি করে।

ভক্তি করে বড় ননদকে।

সেই ছোট্ট বেলায় বেগুনী বেনারসী মোড়া সুবর্ণ যখন কাঁদতে কাঁদতে এদের বাড়িতে এসে দুধে-আলতার পাথরে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে হঠাৎ ড়ুকরে উঠে বলেছিল, আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও গো, তোমাদের পায়ে পড়ি, তখন চারদিক থেকে ছি-ছিক্কারের অগ্নিবাণে সুবৰ্ণ তো প্ৰায় ভস্ম হতে বসেছিল, মুক্তকেশী তো এই মারে কি সেই মারে, সেই দুঃসময়ে ওই বড় ননন্দই রক্ষা করেছিল তাকে। বলেছিল, তোমরা সব কী গো! দুধের বাছা একটা, আর ভেতরের ঘটনাও জেনেছ সবাই, ওর প্রাণীটার দিকে তাকাচ্ছ না?

বাড়ির বড় মেয়ে, জামাই দ্বিতীয় পক্ষের হলেও একটা কেষ্টবিষ্ট, কেউ তাই আর তাকে দাবড়াতে পারে নি, কিন্তু বৌকে কচি বাচ্ছা বলায় হেসেছিল সবাই। বলেছিল, আসছে জন্মে আবার ন বছরের হবে ও মেয়ে।

ননদ আবারও তাড়া দিয়েছিল, আচ্ছা আচ্ছা, বয়সের হিসেব পরে হবে, প্ৰবোর চাইতে তো আর বড় নয়? এখন বরণটা কর!

তদবধি বড় ননদকে দেবীজ্ঞান করে সুবর্ণ। সে যখন আসে, যেন হাতে চান্দ পায়। সে যে হিতৈষী, অন্য ননদদের মত ছুতো-ধরা নয়, সেটা বুঝতে দেরি হয় না। সুবর্ণর।

আজও তো সে ননদ সুবৰ্ণকে আড়ালে ডেকে চুপি চুপি বলেছিল, তুই আমন হাবা কেন রে মেজ বৌ? চেয়ে-চিন্তে অখাদ্য ঘরখানা নিলি!

মেজ বৌ অবলীলায় বলেছিল, তা একজনকে তো নিতেই হবে।

কিন্তু এখন ননদের ভাইয়ের তীব্র প্রশ্নের উত্তরে অবলীলায় যা বললো সেটা অন্য কথা। এখন বললো, কেন, ঘরটা খারাপ কিসে? ভালই তো! একটা জানলা খুললে পড়াশীর ভাঙা দেয়াল, আর একটা জানলা খুললে গেরস্তের কলপাইখানা, মিটে গেল ল্যাঠা। সব দিক দিয়ে নিৰ্ভয়! পরপুরুষের সঙ্গে চোখোচোখির বাসনা থাকলেও সে বাসনা মিটবে না।

ওঃ! প্ৰবোধ তীব্ৰ চাপা গলায় বলে, সেই বিষ মনে পুষে আক্রোশ মেটানো হল! আচ্ছা!

সুবৰ্ণ বালিশটা উল্টে-পাল্টে ঠিক করতে করতে বলে, কথাতেই আছে সৎসঙ্গে স্বৰ্গবাস! বিষ-পুঁটুলির সঙ্গগুণে জমছে বিষ!

প্ৰবোধও পাল্টা জবাব দেয়, আমার মনে বিষ? আর নিজের জিভখানি? সে তো একেবারে বিষের ছুরি!

সুবৰ্ণ শুয়ে পড়ে বলে, তা সেটা যখন বুঝেই ফেলেছি, ছুরি-ছোরার থেকে সাবধান থাকাই মঙ্গল।

বটে? আমি পুরুষবাচ্ছা, আমি শালা সাবধান হতে যাবো পরিবারের মুখ আছে বলে?

তা হলে হয়ো না! সুবর্ণ অবলীলায় বলে, ছোটলোকের মতন হাড়াই-ডোমাই করো রাতদিন!

তবু তুমি তোমার জিভ সামলাবে না?

হক কথায় সামলাবো না।

হঠাৎ একটা কাণ্ড ঘটে।

প্ৰবোধচন্দ্ৰ বীরপুরুষের ভঙ্গীতে উঠে বসে স্ত্রীর মাথার তালের মত খোঁপাটা ধরে সজোরে নেড়ে দিয়ে বলে, তোমার আসপদ্দার মাত্রা বাড়তে বাড়তে বড বেড়ে গেছে দেখছি! গলাধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বার করে দিতে পারি তা জানো?

তুমি আমার চুলের মুঠি ধরলে! সুবর্ণ উঠে বসে।

সুবৰ্ণর ফর্সা ধপধাপে গালের উপর বড় বড় কালো চোখ দুটো যেন জ্বলে ওঠে, ভয়ানক কিছু একটা বুঝি বলতে চায় সুবর্ণ, তারপর সহসাই গম্ভীর গলায় বলে, জানবো না কেন? খুব জানি। বাঙালীর মেয়ে হয়ে জন্মেছি, আর এটুকু জানবো না?

প্ৰবোধ বোঝে বেগতিক, গৃহপ্ৰবেশের সুখের দিনের রাতটাই মাটি। তাই সহসাই সুর বদলায়। নিতান্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে সরে এসে বলে, কেবল রাগ বাড়িয়ে দিয়ে মন্দ কথাগুলো শোনার সাধ। এই কটু কথাগুলো তুমিই মুখ দিয়ে বার করাও। আমি শালা এদিকে সারাদিন হাপু শুনছি কখন রাত আসবে, আর মহারাণী মেজাজ দেখিয়ে–নাঃ, তুমি বড্ড বেরসিক!

সুবৰ্ণর বয়েস চোদ্দ বছর।

অতএব প্ৰবোধের জয় হতে দেরি হয় না।

কিন্তু সে কি সত্যিই জয়?

জয় যদি তো অনেক রাত্রে পরিতৃপ্ত পুরুষটা, যখন নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে থাকে, ঘরের বাতাস উষ্ণ হয়ে ওঠে কেন একটা ভয়ঙ্কর আক্ষেপের দীর্ঘশ্বাসে?

যে দীর্ঘশ্বাসটা কথা হয়ে উঠলে এই রকম দাঁড়ায়, এরা এরকম কেন? সারাজীবন এদের নিয়ে কাটাতে হবে। আমায়া!

কিন্তু এটা সুবৰ্ণলতারই বাড়াবাড়ি বৈকি।

সাধারণ ঘরসংসারী মানুষ এ ছাড়া আর কি হয়? সবাই তো এই কথাই জানে, মানুষকে খেতে হয়, ঘুমুতে হয়, বংশবৃদ্ধি করতে হয় এবং সেই কাজগুলো নিশ্চিন্তে সমাধা করবার উপায় হিসাবে টাকা রোজগার করতে হয়।

আবার খেটেখুটে ক্লান্ত হলে তাস-পাশা খেলতে হয়, মাছ ধরতে হয়, রকে বসে রাজনীতি করতে হয়, ছেলে শাসন করতে হয়, মেয়ের বিয়ে দিতে হয়, আর বুড়ো হলে তীর্থ-ধর্ম গুরুগোবিন্দ করতে হয়।

এরা জানে মাকে ভক্তি করতে হয়, স্ত্রীকে শাসন করতে হয় এবং সর্ব বিষয়ে মেয়েমানুষ জাতটাকে তবে রাখতে হয়। শুধু মুক্তকেশীর ছেলেরাই এরকম, একথা বললে অন্যায় বলা হবে। অধিকাংশই এরকম। তারতম্য যা সে কেবল ব্যবহারবিধিতে।

সুবৰ্ণ বৃথাই দুষছে তার শ্বশুরবাড়িকে। অকারণেই ভাবছে— হায়, মন্ত্রবলে সমস্ত পৃথিবীটা ওলট-পালট হয়ে গিয়ে যদি মাঝখানের এই দিনগুলো মুছে যেত! যদি রাত পোহালেই দেখতে পেত সুবৰ্ণ, ন বছরের সুবর্ণ তাদের সেই মুক্তরামবাবু স্ত্রীটের বাড়ি থেকে স্কুলে যাচ্ছে বই-খাতা নিয়ে। সুবৰ্ণর মা হাসি-হাসি মুখে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।

একবার যদি এমন হয়, জীবনে আর কখনো সুবর্ণ তার ঠাকুমার ছায়া মাড়াবে না। ঠাকুমার কৃষ্ঠদেশের বাড়িতে একা না গেলে তো মাকে লুকিয়ে এমন হুট্‌ক্কারি বিয়ে দিয়ে বসতো না কেউ সুবর্ণর!

এতদিনে তা হলে হয়তো পাসের পড়া পড়তো সুবর্ণ।

না, মা কক্ষনো তার বিয়ে দিতো না তাড়াতাড়ি। বাবু বললেও না। ঠাকুমাই তার শনি। ঠাকুমা তাঁর সইয়ের মেয়েকে নাতনীর শাশুড়ী করে দিয়ে সইয়ের কাছে সুয়ো হলেন। সাধে কি আর ঠাকুমার কাছে যেতে ইচ্ছে করে না সুবর্ণর? মানুষটাকে যেন তার জীবনের শনি মনে হয়।

যেদিন বড় দুঃখ হয়, অপমান হয়, রাতদুপুরে এইসব চিন্তায় ছটুফট করে মরে সুবৰ্ণ, আর সমস্ত ছাপিয়ে মায়ের উপর একটা দুরন্ত অভিমানে দীর্ণ হতে থাকে।

মা তো দিব্যি চলে গেল!

সুবৰ্ণ মরলো কি বাঁচিলো একবার ভাবলও না। মা যদি কলকাতায় থাকতো, সুবৰ্ণকে এমন করে একদুয়োরী হয়ে পড়ে থাকতে হতো!

বিয়ে হলে এসে মায়ের জন্যে কি কম গঞ্জনা সইতে হয়েছে সুবৰ্ণকে? তখন মানে বুঝতো না সব কথার, এখন তো বোঝে! বোঝে তো কী কলঙ্কের ডালি মাথায় নিয়ে সুবর্ণর জীবন শুরু!

সুবৰ্ণর সামনেই তো গিন্নীরা বলাবলি করেছে, হ্যাঁগা ঘরণী গিন্নী, সংসারী বিয়ের যুগ্যি দুদুটো ব্যাটা, আমন শিবতুল্য স্বামী, আর মাগী কি না কুলে কালি দিয়ে চলে গেল!

বেয়ানের দোষ ঢাকতে যত না হোক, নিজের বংশের মান সামলাতেই তাড়াতাড়ি বলতেন, কুলে কালি অবিশ্যি নয়, তবে স্বামী-পুতুরের মুখে চুনকালি দিয়ে তো বটেই। মেয়েকে ইস্কুলে দিয়ে হাতী করবেন, এই বাসনায় ছাই পড়লো, শাশুড়ী বেগতিক দেখে নাতনীটাকে নিজের কাছে আনিয়ে নিয়ে ঝটপট বে দিয়ে ফেলল, এই রাগে গরগরিয়ে মানুষ ঠিকরে চলে গেলেন কাশীবাস করতে!

কাশীবাস! হুঁ! এই বয়সে কাশীবাস!

মহিলারা নাক সিটকোন। অর্থাৎ পুরোপুরি অগ্রাহ্যই করেন কথাটা। এতক্ষণ যে সুবর্ণর মার বিয়োসের ব্যাখ্যায় তৎপর হচ্ছিলেন, তা মনে রাখেন না।

মুক্তকেশী। আবার সামলান।

বলেন, কাশীতে যে বাপ বুড়ো আছেন গো মাগীর!

থাকুক। ঝঙ্কার দিয়েছেন তারা, বলি স্বামী-পরিত্যাগিনী তো বটে! সে মেয়েমানুষের আর রইল কি? তুমি ভাই মহৎ, তাই আবার ওই বৌকে ঘরে তুলেছি, কোন না হাতেও জল খাবে।

মুক্তকেশী সদৰ্পে ঘোষণা করেছেন, জলি? জল আমি কোনো বেটির হাতেই খাই না। আপন পেটের মেয়েদের হাতেই খাই নাকি? যেদিন থেকে হাত শুধু করেছি, একবেলা স্বপাক হবিষ্যি, আর একবেলা কাঁচা দুধ গঙ্গাজল, ব্যস!

গরবিনী মুক্তকেশী অতঃপর আপনি কৃন্ত্রসাধনের ব্যাখ্যা করতে বসতেন, সুবর্ণ হাঁ করে শুনতো। হ্যাঁ করেই, কারণ তখন তো জানতো না সুবৰ্ণ, আচমনী খাদ্য মানে কি, অম্বুবাচী কাকে বলে, নিরন্তু উপোসের দিন বছরে ক’টা?

 

দীর্ঘশ্বাস-মর্মরিত ঘর ক্রমশ স্থির হয়ে আসে, সারাদিনের পরিশ্রান্ত মেয়েটার চোখে ঘুম আসে নেমে, সঙ্কুচিত হয়ে ঘুমন্ত মানুষটার ছোঁওয়া বাঁচিয়ে শুয়ে পড়ে সে। লোকটার ওই পরিতৃপ্ত ঘুমন্ত দেহটার দিকে তাকিয়ে কেমন ঘৃণা আসে, অপবিত্র লাগে লোকটাকে।

এই কিছুক্ষণ আগেই যে ওর আদরের দাপটে হিমশিম খেতে হয়েছে, তা ভেবে বুকটা কেমন করে ওঠে।

কিন্তু কী করবে সুবৰ্ণ?

চারিদিকে কত লোক, বিদ্রোহ করে কি লোক-জানাজানি কেলেঙ্কারি করবে? তা ছাড়া সব দিনগুলোই তো আজকের মত নয়? সব দিনেই কিছু আর বিদ্রোহ আসে না। নিজের মধ্যেও কি নেই ভালবাসার আর ভালবাসা পাবার বাসনা?

কী করবে। তবে সে? ওকে ছাড়া আর কাকে? আর ওই মানুষটা ভালবাসার একটাই অর্থ জানে, আদর করবার একটাই পদ্ধতি।

নেব না বললে দাঁড়াবে কোথায় সুবৰ্ণ?

১.০৩ মুক্তকেশীর চার ছেলে

মুক্তকেশীর চার ছেলে।

সুবোধ, প্ৰবোধ, প্রভাস, প্রকাশ।

বড় সুবোধ বাপ থাকতেই মানুষ হয়ে গিয়েছিল, বাপাই নিজের অফিসে ঢুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন, কালক্রমে সেই মাৰ্চেণ্ট অফিসের বড়বাবুর পরবর্তী আসনটিতে এসে পৌচেছে সুবোধ, প্রকৃতপক্ষে তার টাকাতেই সংসার চলে।

মেজ প্ৰবোধ এনট্রান্স পাস করে অনেকদিন খেয়ে খেলিয়ে বেড়িয়ে এই কিছুদিন হল এক বন্ধুর সঙ্গে মিলে একটা লোহা-লক্কড়ের ব্যবসা ফেঁদেছে। টাকাটা বন্ধুর, খাটুনিটা প্ৰবোধের। সেজ প্রভাস হচ্ছে বাড়ির মধ্যে সেরা বিদ্বান ছেলে, এফ-এ পাস করে ফেলে সে ওকালতি পড়বে পড়বে করছে। আর প্রকাশ গোটা পাঁচ-ছয় ক্লাস পর্যন্ত পড়েই পাড়ার শখের থিয়েটারে স্ত্রীভূমিকা অভিনয় করছে আর চুলের কেয়ারি করছে। সুবর্ণর বিয়ের সময় সংসারের অবস্থা প্ৰায় এই ছিল।

অনেকদিন পর্যন্ত সুবর্ণ এদের সকলের পুরো নাম জানত না। সুবো, পেবো, পেভা, পেকা এই ছিল মুক্তকেশীর সম্বোধনের ভাষা। ছোট ননদ বিরাজকে ডেকে একদিন ধরে বসলো সুবর্ণ, তোমাদের সব নাম কি বল তো শুনি! মা তো তোমায় রাজু রাজু করেন, রাজবালা বুঝি?

শোনো কথা! রাজু অবাক হয়ে বলে, এতদিন বে হয়েছে, শ্বশুরবাড়ির লোকের নাম জানো না? মেজদা বলে নি?

সত্যি বলতে, রাজুর মেজদাকে কোনোদিন এ কথা জিজ্ঞেসও করে নি। সুবর্ণ। মনেও পড়ে নি জিজ্ঞেস করতে। এখনই হঠাৎ মনে পড়লো, জিজ্ঞেস করে বসলো। কিন্তু সেকথা না ভেঙে সুবর্ণ ঠোঁট উল্টে বলে, তোমার মেজদাকে জিজ্ঞেস করতে আমার দায় পড়েছে। তুমি রয়েছে হাতের কাছে, অন্যের খোশমোদ করতে যাবো কেন?

বয়সে তিন বছরের ছোট ননদিকেও এই তোয়াজটুকু করে নেয়। সুবৰ্ণ।

 

রাজু অবশ্য তাতে প্রীতিই হয়। আঙুল গুনে বলে, বড়দির নাম হচ্ছে সুশীলা, মেজদির নাম সুবলা, সেজদি হচ্ছে সুরাজ, আমি বিরাজ, আর দাদাদের নাম হচ্ছে–

মহোৎসাহেই গল্প হচ্ছিল ননদ-ভাজে। হঠাৎ সমস্ত পরিস্থিতিটাই গেল বদলে। বিরাজ রেগে ঠরঠরিয়ে উঠে গেল সেখান থেকে এবং তৎক্ষণাৎ মেজ বৌয়ের দুঃসাহসিক স্পর্ধার কথা সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ল।

ভাসুর-দেওরদের নাম নিয়ে তামাশা করেছে সুবর্ণ, ননদের নাম নিয়ে ভোঙিয়েছে!

করেছে। সত্যই করেছে সেটা সুবর্ণ।

কিন্তু সুবর্ণ কি জানতো একটু কৌতুকে এত দোষ ঘটবে? আর নামের মানে জিজ্ঞেস করলে অপমান করা হয়?

সুরাজ শুনে বলে উঠেছিল সে, ওমা, সুরাজ আবার কি রকম নাম? ও নামের মানে কি?

একে যদি ভেঙানো বলে তো ভেঙানো।

তবে হ্যাঁ, দেওরদের সম্পর্কে বলেছে বটে একটা কথা তামাশা করে। পর পর চারজনের নাম শুনে হি হি করে হেসে বলে উঠেছে, তা চার ভাইয়েরই মিল করে নাম রাখলে হতো!

বিরাজ ভুরু কুঁচকে বলেছিল, সুবোধ-প্ৰবোধের সঙ্গে আর মিল কই?

সুবৰ্ণ হেসে কুটি কুটি হয়েছিল, কেন, অবোধ-নির্বোধ!

সঙ্গে সঙ্গে ঠিকরে উঠেছিল বিরাজ, বয়সের থেকে অনেকখানি জোরালো ঝঙ্কার দিয়ে বলেছিল, এত আস্পদ তোমার মেজ বৌ? সেজদা ছোড়দাকে তুমি নির্বুদ্ধি বলতে সাহস পাও? রোসো, মাকে বলে দিয়ে আসছি!

মাকে বলে দেওয়ার নামে অবশ্য সুবর্ণর মুখটা শুকিয়ে গিয়েছিল। ব্যস্ত হয়ে ওর হাত চেপে বলেছিল, ওমা, তুমি রাগ করছ, কেন, ভাই? আমি তো ঠাট্টা করেছি—

কিন্তু বিরাজ হাত ধরার মান রাখে নি, হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল।

সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য মুক্তকেশীর আবির্ভাব।

চেঁচানো না, ধমকানো না, থমথমে গলায় বললেন, কোন লক্ষ্মীছাড়া ঘরে মানুষ হয়েছিলে মেজবৌমা, শিক্ষা-সহবৎ নেই? এদিকে পাকা পাকা কথার জাহাজ? বলি পোবা-পেকার নাম নিয়ে ধিক হয়েছে কেন শুনি?

সুবৰ্ণ এবার সাহস সঞ্চয় করে বলে ফেলে, আমি তো ঠাট্টা করেছি।

ঠাট্টা? ঠাট্টা করেছ? বলি মেজবৌমা, ঠাট্টাটা কাকে করেছ? এই শাশুড়ীমাংগীকে, আর সেই মরা শ্বশুরকে তো? নামকরণ তো। ওরা নিজেরাই করতে যায় নি, এই আমরাই করেছি। সাতজন্মে এমন কথা শুনি নি যে, পুটকে একটা বৌ এসে ঠিকুজি-কুলুজি চাইতে বসে, নাম নিয়ে ব্যাখ্যানা করে। এ্যা, পোবা-পেকা শুনলে কী বলবে গো!

সুবৰ্ণতা বলে ফেলে, সবাইকে যদি শুনিয়ে বেড়ান, তবে আর কি করবো? আমি তো কাউকে শোনাতে যাই নি। ঠাট্টা করে বলেছিলাম, ছোট-ঠাকুরঝি লাগিয়ে দিতে গেল কেন?

বৌয়ের মুখ থেকে এমন স্পষ্ট পরিষ্কার ভাষা শোনার অভ্যাস মুক্তকেশীর নেই। বড় বৌ উমাশশীর মুখ দিয়ে সাত চড়ে রা বেরোয় না। বোনপো-বৌ ভাগ্নে-বৌ তা-ও অনেক দেখেছেন, পেটে পেটে বজাতি, হাড়-হারামজাদা হলেও মুখে এমন খই ফোঁটায় না কেউ।

আরো থমথমে গলায় বলেন, আমার গর্ভের মেয়ের আমন লাগানো-ভাঙানো স্বভাব নয় মেজবৌমা। ভাইদের ঘেন্না দেওয়া দেখে প্ৰাণে বড় লেগেছে। তাই বলে ফেলেছে। তোমার চরণেই কোটি কোটি নমস্কার মা। নামের আবার মানে চাই! বাপের কালে শুনি নি এমন কথা। জানতাম না। তো ঘরে আমার এমন বিদ্যোবতী বৌ আসবে, তা হলে মানে খুঁজে খুঁজে নাম রাখতাম। আচ্ছা! আসুক আজ পেভা, সে তো দুটো পাস করে তিনটে পাসের পড়া ধরছে, শুনছি। নাকি ওকালতি পড়বে। তাকেই জিজ্ঞেস করবো কোন নামের কি মানে? আর বলবো, এত বিদ্যে করেও তোদের

সুবৰ্ণ অভিমানী, কিন্তু সুবৰ্ণ কথায় খই ফোঁটায়, আত্মস্থ থাকতে পারে না। রাগ হলে চাপাবার ক্ষমতা নেই সুবর্ণর। তাই সুবৰ্ণ ফের শাশুড়ীর মুখের উপর বলে বসে, আপনারা বড্ড তিলকে তাল করেন, তুচ্ছ কথা নিয়ে এত হৈ-চৈ করতে ভাল লাগে।

মুক্তকেশী বসে পড়েন।

মুক্তকেশী বলেন, রাজু, এক ঘটি জল আন, মাথায় থাবড়াই। সই-মা আমার কত জন্মের শক্ৰ ছিল গো, এই মেয়ে গছিয়েছে আমায়া!

বিরাজ ছুটে জলের ঘটি নিয়ে আসে, মুক্তকেশী খাবলে খাবলে খানিক মাথায় থাবড়ে বলেন, এ বৌ নিয়ে ঘর করা হবে না। আমার, দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। সেই ভবিষ্যৎ। রাজু দোরটা দে, আমি একবার বাদুড়বাগান ঘুরে আসি। মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠল।

মাথার মধ্যে আগুন যখন-তখনই জ্বলে ওঠে মুক্তকেশীর। একটা মাত্র ছেলেকে স্বামী দাঁড় করিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, আর তিনটি মেয়ের বিয়ে দিয়ে গিয়েছেন এই পর্যন্ত। বাকী তিন-তিনটে ছেলেকে টেনে তুলতে হয়েছে, শেষ মেয়েটা বিয়ের যুগ্যি হয়ে উঠল।

এখন তবু দুই ছেলে রোজগার করছে, বড়র মাইনেও বেড়েছে। তখন যে টানাটানিতে চলেছে, ঈশ্বর জানেন আর মুক্তকেশী জানেন। সেই সব কষ্টই আগুনের উপাদান হয়ে মজুত আছে ভিতরে। একটু-ওদিকেই জ্বলে ওঠে সেই আগুন।

কিন্তু ঘরসংসারে তো এতদিন এদিক-ওদিক ছিল না। যা কিছু বাইরে। ঘরে ছেলেরা জোড়হস্ত, বড় বৌ তো মাটির ঘট, মেজ বৌ এসে ঢোকা পর্যন্ত থেকে থেকেই আগুন জ্বলে। আর উঠতে বসতে সেই পরলোকগতা। সইমার উদ্দেশ্যে অভিযোগবাণী বর্ষণ করেন।

তাও কি পার আছে?

মুখরা মেজ বৌ। কিনা বলে বসে, মরা মানুষটাকে আর কত গাল দেবেন? সেখানে বসে জিভ কামড়ে কামড়ে নতুন করে মরবো যে! একে তো আমি পৌত্রী হয়ে রাতদিন শাপ দিচ্ছি—

তুমি শাপ দিচ্ছ! মুক্তকেশী হঠাৎ থতিয়ে গিয়েছিলেন, ভুরু কুঁচকে বলেছিলেন, তুমি শাপ দিচ্ছ কোন দুঃখে?।,

যে দুঃখে আপনি দিচ্ছেন সেই দুঃখে, সুবৰ্ণ আকাশপানে তাকিয়ে উদাস গলায় বলেছিল, আর এখন দোষ দিই না, অদেষ্ট বলে মেনে নিয়েছি।

সুবৰ্ণর এই সব কথা শুধু মেয়েদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, পুরুষদের কানেও ওঠে। মুক্তকেশীই ওঠান, রোজ একবার করে হাতজোড় করে সংসার থেকে ছুটি চান।

শুনে মুক্তকেশীর বড় ছেলে মাঝে মাঝেই বলে, তোমরাই বা মেজ বৌমাকে অত ঘাটাও কেন বুঝি না। বুঝতেই তো পারো, একটু তেজী প্রকৃতির আছেন উনি—

কিন্তু মেজ-সেজ ছোট এই মারে তো এই কাটে করে ওঠে। বয়সে বড় দেবীরদের সঙ্গে মুখোমুখি কথা কওয়া চলে না, তাই দেবীররা একতরফা গর্জন করে, মাকে অপমান? ভেবেছেন কি মেজ বৌ? মেজদার যাই রাজা দশরথের অবস্থা তাই পার হয়ে যাচ্ছেন, আর কেউ হলে আমন পরিবারের মুখ জুতিয়ে ছিঁড়ে দিত। তেজী প্রকৃতি আছেন উনি বলে তো দাদা তুমি দিব্যি আস্কারা দিলে, বলি মার অপমানটা গায়ে বাজল না তোমার!

সুবোধ সহাস্যে বলে, আহা, এক ফোঁটা মেয়ের কথায় মার আবার অপমান কিসের? গ্ৰাহ্য করেন কেন?

কিন্তু প্ৰবোধ থাকলে দাদার বদলে ছোট ভাইদের সমর্থন করে। বলে, দিয়ে আসতে হবে একদিন বিদেয় করে।

বলে, তবে গলাটা একটু নামিয়ে বলে। বৌকে নেহাৎ চটিয়ে রাখলে অসুবিধে আছে। বৌ বিগড়োলে নিজের স্বভাব-চরিত্র ভাল রাখতে পারা যাবে কি বিগড়ে বসবে কে বলতে পারে? পুরুষমানুষ তো?

বাদুড়বাগানে মুক্তকেশীর সমবয়সী মাসতুতো বোন হেমাঙ্গিনীর বাড়ি। মাথা গরম হয়ে উঠলেই এখানে চলে আসেন মুক্তকেশী। কারণ হেমার কথাবার্তা প্ৰাণ-জুড়োনো, হেমার কাছে জল উঁচু  তো জল উঁচু , জল নীচু তো জল নীচু।

মুক্তকেশী যদি বলেন, আমার বড় বেঁটার মত ভালোমানুষ আর হয় না—

হেমা বলেন, আহা তা আর বলতে! বৌ দেখলে চোখ জুড়োয়।

মুক্তকেশী যদি বলেন, আমার বড় বেঁটার মতন বোকা আর ত্ৰিভুবনে নেই-

হেমা বলেন, তা যা বলেছ, দেখছি তো সব! তুই যাই তাই-ওই বোকাকে নিয়ে ঘর করছিস!

তবে মুক্তকেশীর মেজ বৌ সম্পর্কে সুরফের্তা করতে হয় না কখনো হেমাকে। সব সময়েই বলা চলে, সত্যি মুক্ত, কী করে যে তুই বৌ নিয়ে ঘর করছিস!

মুক্তকেশী কপালে করাঘাত করে বলেন, উপায়? পেবোর তো শুধু মুখে হুমকি, ভেতরে ভেতরে রূপুসী বৌয়ের ছিচরণের গোলাম! আমার অবস্থাটি কেমন? সেই যে বলে না—

মেয়ে বিয়োলাম, জামাইকে দিলাম
বেটা বিয়োলাম, বৌকে দিলাম,
আপনি হলাম বাঁদী,
ইচ্ছে হয় যে, দুয়োরে বসে
ঠ্যাং ছড়িয়ে কাঁদি!

সেই তাই, চোর হয়ে আছি।

সমবয়সী হলেও মুক্ত নাকি দু-চার মাসের ছোট, তাই হেমাঙ্গিনীর বর কাশীনাথ তাঁর সঙ্গে ছোট শালীজনোচিত কৌতুক-পরিহাস করে থাকেন, এবং দুই বোনে একত্র হলেই ঠিক এসে জোটেন। ভাল চাকরি করতেন, দিল্লী-সিমলেয় কাজ ছিল, সম্প্রতি রিটায়ার করে সাবেকী বাড়িতে এসে বসবাস করছেন। হেমাঙ্গিনী অবশ্য কখনো স্বামীর সঙ্গে সেই দিল্লী-সিমলের সুখাস্বাদন করতে যান নি। বরের সঙ্গে বাসায় যাওয়ার নিন্দের ভয়েই শুধু নয়, নিজের দিকেও জাত-যাওয়ার ভয় ছিল প্ৰবল। ওসব দেশে গেলে যে জাত-যাওয়া অনিবাৰ্য এ কথা হেমাঙ্গিনীর ছেলেবেলা থেকে শোনা। কাশীনাথের গৃহসুখ ছিল শুধু ছুটি-ছাটায়।–

কাশীনাথ হেসে হেসে বলতেন, জাতটা আর বাঁচলো কই? এই জাত-যাওয়া লোকটার ঘরে এসে তো শুচছ!

হেমাঙ্গিনী ভ্ৰাভঙ্গী করত, যত সব বিটকেল কথা!

আমি চলে গেলে গঙ্গাস্নান করা? না শুধু লুকিয়ে একটু গোবর খেয়ে ফেল?

হেমাঙ্গিনী আরো ভুরু কোঁচকাতো।

বেশি কথা বলতে জানতো না কখনো, এখনো না। সব কথাই মুক্তকেশীর। মাঝে-সাঝে কাশীনাথ এসে জোটেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মত।

তুমি চোর হয়ে আছ? বল কি মুক্ত? তা হলে ডাকাত আবার কেমন দেখতে?

হেমাঙ্গিনী বলে ওঠেন, আবার তুমি মস্করা করতে এলে? ও মরছে নিজের জ্বালায়—

কাশীনাথ হুঁকো খেতে খেতে মিটিমিটি হেসে বলেন, লঙ্কাও মরে নিজের জ্বালায়। তার জুলুনি ঘোচাবে, এমন সাধ্যি মা গঙ্গারও নেই! বলি, হচ্ছে তো? পরের মেয়েদের কুচ্ছে হচ্ছে তো? আশ্চয্যি, বুড়ো বুড়ো দুটো গিন্নী তোমরা, আপনি আপন দোষ দেখতে পাও না, ওই দুধের মেয়েগুলোও মধ্যে এত দোষও দেখো!

মুক্তকেশীর মুখ লাল হয়ে ওঠে, তবু বলেন, বুড়ো মাগীদের দোষ দেখতে তো জগৎ আছে জামাইবাবু! এই তুমিই তো কত দোষ দেখছা! তবে ওদেরও শিক্ষেদীক্ষের দরকার। কুচ্ছে। আমরা করি না, হক কথা বলি। এই যেমন তোমাদের ঘরের ছোটটি, তেমনি আমার ঘরের মেজটি, তুল্যমূল্য। ওরা আমাদের দেশত্যাগী করতে পারবে।

তা বললে কী হবে? হেমাঙ্গিনী অসন্তোয্যের গলায় বলেন, বুড়ো বয়সে উনি এখন ক্ষুদে ক্ষুদে বৌদের মানরাখা কথা বলতে আরম্ভ করেছেন! মনে করেছেন তাতে রাখি! আমি মরে গেলে বৌরা যত্ন-আত্তি করবে! মনেও করো না তা, বুঝলে? বাঘিনীর চোখের সামনে আছে, তাই এখন এত ঠাকুরসেবা। মারি একবার, তখন দেখো। বলবে ভাল আপদ হয়েছে, ঘাড়ে একটা বুড়ো শ্বশুর!

কাশীনাথ হেসে ওঠেন, বালাই বালাই, তুমি মরবে। আর আমি জিন্দা থেকে সেই দৃশ্য দেখবো? ছিঃ! তুমি দু-দশ দিন মুক্তর মতন মাথা মুড়িয়ে হাত নেড়া করে স্বাধীনতার সুখটা ভোগ করে নাও। বৈধব্যকালটাই তো মেয়েমানুষের আসল সুখের কাল গো! তাতে আবার যদি বয়েসকলটা একটু ভাটিয়ে আসে! কার সাধ্যি হক কথা বলে!

জামাইবাবুর। যেমন কথা!

মুক্তকেশী কোপ প্ৰকাশ করেন।

কাশীনাথ দামেন না। বলেন, হক্‌ কথা কও ভাই মুক্ত, ভায়রাভাই যখন বেঁচে ছিল এত পা ছিল তোমার? এত স্বাধীনতা?

এইরকম হাড়জুলানো কথাবার্তা কাশীনাথের। কিন্তু শুনতেই হয়, উপায় কি? হেমা যে তার প্ৰাণের সখী, হেমার সঙ্গেই যত শলা-পরামর্শ। শিষ্যাও বটে।

বৌদের কিসে জব্দ রাখতে হয়, আর ছেলেদের কি করে বশে রাখতে হয়, সে বিদ্যাকৌশল মুক্তকেশী শেখান হেমাঙ্গিনীকে।

আজ কিন্তু মুক্তকেশীই পরামর্শ চান, ওই বেহেড বৌকে কি করে দাবে আনি বল দিকি হেমা?

হেমাঙ্গিনীরও বোধ করি। হঠাৎ গুরুর পোস্ট পেয়ে বুদ্ধি খুলে যায়। গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলেন, দাবে আনা যায় ভাতে মারলে! বরের সোহাগেই তো ধরাখানা সরাখানা। তুমি একটা কোনো কৌশল করে ছেলেকে নিজের কাছে নিয়ে শোবে, দেখো দুদিনে টিট হয়ে যাবে।

মুক্তকেশীর কৌশলটা মনঃপুত হয়, কিন্তু সম্ভব মনে হয় না। বলেন, ছোঁড়া যে তা হলে বুক ফেটে মরবো!

বরং উল্টো রে মুক্ত, ডাকিনীদের খপ্পর থেকে দুদিন সরিয়ে নিয়ে বাঁচবে। তুই একটা বানানো কথা বল। বল যে স্বপ্ন দেখলাম, তোর সময় খারাপ আসছে। মাতৃমন্তর জপিলে আর মায়ের আওতায় থাকলে তবেই রক্ষে।

 

তবেই রক্ষে বুঝলে বড় বৌমা–, মুক্তকেশী বড় বৌমার কাছে ফিসফিস করেন, এই বাক্যিটি ভালমত করে বুঝিও তো তোমার মেজ জা-টিকে। আমি বলতে গেলে মন্দ হবো। তবে আমাকে তো ছেলের কল্যেণ-অকল্যেণ দেখতে হবে।

না, তখনো সুবৰ্ণলতার চোদ্দ বছর বয়েস হয় নি, তখনো তার অন্তরালে একটি প্ৰাণকণা আশ্রয়লাভ করে নি। তখনো সুবৰ্ণরা সেই তাদের পুরনো বাড়িতে ছিল, যে বাড়ির উঠোনে দেয়াল তুলে তুলে তার জেঠশ্বশুর-খুড়শ্বশুররা নিজ নিজ সীমারেখা নির্দিষ্ট করে নিয়ে বসবাস করতেন এবং শাশুড়ীকুল খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকলেই এ বাড়িতে বেড়াতে এসে সংসারের সর্বত্র শ্যেনদৃষ্টি ফেলতেন।

কিন্তু সকলেই এক দলে নয়।

ছোট খুড়শাশুড়ীর শ্যেনদৃষ্টি এই নতুন ব্যবস্থার ওপর পড়তেই তিনি মুক্তকেশীকে এসে চেপে ধরলেন, হ্যাগো নাদি, এ আবার কি আদিখ্যেতা তোমার? ঘরে ডবকা বৌ, প্ৰবোধ কেন তোমার আঁচলতলায় শুতে আসে?

মুক্তকেশী যদিও দজাল, তবু জা-ননদকে কিছুটা মেনে চলেই আসছেন। তাই বেশ করেছি তোমার তাতে কি-না বলে সংক্ষেপেই বলেন, স্বপন পেয়েছি।

স্বপন পেয়েছ? ওমা! স্বপন পাবার বস্তু-বিষয় পেলে না তুমি? কী স্বপন পেয়েছ শুনি?

মুক্তকেশী আরো সংক্ষেপে বলেন, স্বপন বলা নিষেধ।

ছোট বৌ ব্যঙ্গের সুরে বলে, জেগে স্বপন দেখলে বলতে নিষেধ হবে বৈকি। তবে এও বলে রাখছি। নদি, বজ্রআঁটুনি করলেই গেরো ফসকায়। এখন তোমার বৌ মনের খেদ মনে চেপে তোমার অন্যায় বিধেন মেনে চলছে, ভবিষ্যতে এর শোধ নেবে তা জেনো। বুড়ো তো হতে হবে, ওদের হাতে তো পড়তে হবে।

মুক্তকেশী সদৰ্পে বলেন, কেন? মানুষের হাতে পড়তে যাবো কেন? মা গঙ্গা নেই? যতক্ষণ চক্ষুছরদ থাকবে, ততক্ষণ দাপট করে সংসারে থাকবো। ক্ষ্যামতা গেলে গঙ্গা-গৰ্ভে ঠাঁই নেব। তবে এ কথাটি বলে রাখি ছোট বৌ, যার দুঃখে চোখে নোনাপানি ঝরিছে তোমার, সেটি সোজা নয়। খেদা! খেদে তো মরে যাচ্ছে! বড়বৌমার কাছে কী বলেছে জানো? আঃ, শুনে বাঁচলাম, হাড়ে বাতাস লাগলো। কিছুদিন তবু ঘুমিয়ে বাঁচবো। মা-দুগ্‌গার কাছে বর চাইবো সময় ওর যেন বরাবর খারাপ থাকে। শুনলে? এর পরও করবে। খেদ?

ওটা তেজ করে বলেছে, ছোটগিনী হেসে ফেলে বলেন, দুঃখু জানিয়ে খেলো হবে না। এই আর কী! তা তোমার ছেলের অবস্থা কি?

মুক্তকেশীও তেজী।

মুক্তকেশী খেলো হবার ভয়ে মটমটিয়ে কথা বলেন। তবু আচমকা মুক্তকেশী একটু অসতর্ক হয়ে যান। বলে ফেলেন, ছেলের কথা আর বলিসনে, কামরূপ কামিখ্যের জন্তু। ছটুফটিয়ে মরছেন, সারারাত্রি ঘুম নেই। এই উঠছে, এই জল খাচ্ছে, আমি তেমন মড়া হয়ে ঘুমোলে পারলে পালায়। আমিও বাবা তেমনি ঘুঘু, যেই উসখুসি করে সাড়া করি, জল খাবি? মশা কামড়াচ্ছে? গরম হচ্ছে?

ছোট গিন্নী হেসে ফেলে বলেন, তা মা হয়ে তো কম শাস্তি করছ না তুমি ছেলের?

সেই তো! সেই তো হয়েছে জ্বালা, কুলাঙ্গার হয়েছে একটা। আমার সুবো। অমন নয়। এই হতভাগার জন্যেই আবার মান খুইয়ে ঘরে পাঠাতে হবে। মানিনী তো গরবে আছেন। শুনলে অবাক হবে, রাজুকে কাছে শুতে বলেছিলাম, নিল না ঘরে! বলে একলা খিল দিয়ে বেশ শোবো!

হ্যাঁ বলেছিল সুবর্ণ।

তেরো বছরের সুবর্ণ।

আমার আমন ভূতের ভয় নেই। একলা বেশ শোবো। বরং সুখে ঘুমুবো, সারারাত একজনকে বাতাস করে মরতে হবে না।

কিন্তু মুক্তকেশীর গর্ভের কুলাঙ্গার এই অপমানের পরও মান খোয়ায়। আড়ালে আবডালে হাত ধরতে আসে। বলে, তোমার প্রাণে কী একফোঁটা মায়া-মমতা নেই মেজ বৌ? ফাঁদে-ফন্দীতে একবার দেখা করতেও ইচ্ছে হয় না?

সুবৰ্ণ হাত ধরতে না দিয়ে বলে, কেন, দেখছি না নাকি? সর্বদাই তো দেখতে পাচ্ছি।

আহা সে দেখা আবার দেখা! রাতেই না হয়। ঘরে আসা বারণ, অন্য সময় একটু দেখা করতে দোষ কী?

আমার অতি সাধ নেই।

ভারি নির্মায়িক তুমি।

তোমাদের সবাই তো খুব মায়াবান!

আহা, মায়ের একটা কারণ ঘটেছে তাই—

আমিও তো তাই বলছি। তুমিই হাঁপাচ্ছ।

হাঁপাচ্ছি সাধে মেজ বৌ? মানুষের কলজে আছে তাই হাঁপাচ্ছি।

আমার তবে নেই সে কলজে! হল তো?

দোহাই তোমার, কাল দুপুরে একটিবার যেন চিলেকোঠার ঘরে দেখা পাই।

দুপুরে? আপিস নেই?

আপিস পালিয়ে চলে আসতে হবে, উপায় কি?

তোমার মাথা খারাপ বলে তো আর আমার খারাপ হয় নি?

ওঃ, আচ্ছা! তার মানে স্বামীর প্রতি মন নেই। তার মানে মনে অন্য চিন্তা আছে। বেশ আমিও পুরুষমানুষ।

শুনে বাঁচলাম। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় কিনা।

প্রবোধ ক্রুদ্ধস্বরে বলে, এইটুকু বয়সে এত কথা শিখলে কি করে বল তো?

কি জা—নি!

হঠাৎ দালানে কার ছায়া পড়ে। প্ৰবোধ তাড়াতাড়ি চলে যেতে যেতে বলে, আচ্ছা আচ্ছা, ঝগড়া থাক। দোহাই তোমার, মনে থাকে কাল দুপুরে, চিলেকোঠার ঘরে! আপিস পালিয়ে এসে যেন হতাশ না হই!

 

কিন্তু আশা কি পূর্ণ হয়েছিল প্ৰবোধের? চিলেকোঠার ঘরে এসেছিল সুবৰ্ণ?

১.০৪ এসেছিল সুবৰ্ণ সেই চিলেকোঠার ঘরে

হ্যাঁ, এসেছিল সুবৰ্ণ সেই চিলেকোঠার ঘরে। যখন সংসারের সব পাট চুকিয়ে মুক্তকেশী নিত্যনিয়মে দ্বিপ্রাহরিক পাড়া বেড়ানোয় বেরিয়েছেন, উমাশশী গেছে ছেলে ঘুম পাড়ানোর ছুতোয় একটু গা গড়িয়ে নিতে, খুদু আঁশ-নিরামিষ দু প্রস্থের বাসনের পাহাড় নিয়ে উঠোনে বসেছে গুছিয়ে, তখন এই নিরিবিলির অবসরে পা টিপে টিপে সিঁড়িতে এল সুবর্ণ, আরো পা টিপে টিপে সিঁড়ি উঠতে লাগল অভিসারের ভঙ্গিতে পায়ের মল খুলে রেখে।

কিন্তু পায়ের মল কি এক সুবৰ্ণই খুলেছিল? তা যেই খুলুক প্ৰবোধের সেটা জানার কথা নয়, প্ৰবোধ তাই প্রতি মুহূর্তে একটি মলের রুনুকুনুর অপেক্ষায় উৎকৰ্ণ হয়ে হয়ে ক্রমশ হতাশ হচ্ছে, ক্রুদ্ধ হচ্ছে, ক্ষিপ্ত হচ্ছে।

গরমে গলাগলিয়ে ঘাম ঝরছে, মশার কামড়ে আরো গা ফুলে উঠেছে, নিজের হাতের চড় খেয়ে খেয়ে গায়ে ব্যথা হবার যোগাড়! তবু বেরিয়ে পড়বার উপায় নেই। কারণ আশা ছলনাময়ী। তা ছাড়া বেরোবেই বা কোন লজ্জায়? ও যে আজ অফিস পালিয়েছে সেটা তো আর ঢাক পিটিয়ে লোক-জানাজানি করবার কথা নয়।

অফিস পালানো বলে পালানো, প্রায় ছেলেবেলায় স্কুল পালানোর মতই কাণ্ড করে বসেছে। দাদার সঙ্গে পাশাপাশি বসে ভাত খেয়ে, দাদার সঙ্গে একসঙ্গে বেরিয়ে, দাদার চোখে ধুলো দিয়ে ফিরে এসেছে। ধুলো দেওয়ার সুবিধেও আছে, প্ৰবোধ যায় ট্রামে, সুবোধ যায় শেয়ারের ঘোড়ার গাড়িতে। মোড়ের মাথায় ছাড়াছাড়ি হয়ই।

দাদাকে দেখিয়ে ট্রামে উঠে, একটু পরে টুপ করে নেমে আসে গুটি গুটি বাড়িপানে। এ সময় কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার ভয় কম, কারণ পাড়া ঝেটিয়েই তো সব পুরুষ জাতীয়েরা অফিস ইস্কুলে চলে গেছে। মেয়েমানুষরা তো আর রাস্তায় বেরোচ্ছে না যে দেখে ফেলবে?

তবু যদি কারো বাড়ির ঝি-চাকর কি স্বয়ং খুদুর সঙ্গেই দেখা হয়ে যায়, কোন কথাটা বলে মান রক্ষা করবে, সেটা তৈরি করেই রেখেছে! বলবে, ওরে বাবারে, পেটের মধ্যেটা এমন মোচড় দিয়ে উঠল, মাঝপথে ফিরে আসতে হল।

না, এর থেকে সভ্য কোনো মিথ্যে কথা বানাতে পারে নি। সুবৰ্ণলতার স্বামী। কিন্তু বিধি তখনও পর্যন্ত তার প্রতি সদয়। তাই কোনো চেনা মুখের সঙ্গে মুখোমুখি হতে হল না প্ৰবোধচন্দ্ৰকে। অবশ্যি সদর দোর দিয়েও ঢোকে নি সে। কি জানি দৈবদুর্বিপাকে যদি আজই মুক্তকেশী। এত বেলায়?ष्ठाङ्क्षाgনা याনা!

হ্যাঁ, নিত্য গঙ্গাস্নানের পুণ্য অর্জন করে চলেছেন মুক্তকেশী বিধবা হয়ে পর্যন্ত। বিরাজ তখনো নিতান্ত শিশু, তত্ৰাচ মুক্তকেশী বৈধব্য ঘটবার সঙ্গে সঙ্গেই বৈধব্যের সর্ববিধ শুচিতা এবং কঠোরতা পালন করে আসছেন। চুল কেটেছেন, হাত শুধু করেছেন, পান ছেড়েছেন রাত্রে আচমনী খাদ্য ছেড়েছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

ছেলেদের অফিস পাঠিয়ে মুক্তকেশী ঘটি-গামছা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। সে আন্দাজে বেরিয়ে গেছেন, কিন্তু কে বলতে পারে প্রবোধের ভাগ্যেই আজ–

পাশের ওই মেথর আসার গলি দিয়ে ঢুকে পড়লে আর কোনো ভয় নাই। মুক্তকেশী এর ধারেকাছেও উঁকি দেন না কোনোদিন। প্ৰবোধ? সে তো আড়াই পা বাড়ালেই শুদ্ধ। আড়াই পায়ের কসরৎ ছেলেবেলা থেকেই অভ্যাস করা আছে মুক্তকেশীর ছেলেদের।

অতএব প্ৰবোধ নিষ্কন্টকে বাড়ি ঢুকে এদিকে ওদিক তাকিয়ে ঝাঁপ করে ছাতের সিঁড়ি ধরেছে। ধরেছে মানেই মরেছে। সেই বোলা এগারটা থেকে এই বেলা আড়াইটে! চিলেকোঠার এই ঘরটাতেই কি জমাতে হয়। ছাই সংসারের যাবতীয় ওঁচা মাল?

পায়াভাঙা চৌকী, কলাভাঙা তোরঙ্গ, ড্রালাভাঙা হাতবাক্স, এসব ছাড়াও ছেঁড়া মশারি, পুরানো কাঁথা, বাতিল তোশক, ফুটো ঘড়া, কাচফাটা ছবির ফ্ৰেম-কী আছে আর কী নেই! ফেলবার নয়, ফেলবার নয়, এই সব বস্তুর আর গতিই বা কি?

অবশ্য ভবিষ্যতে ওদের আবার টেনেন্টুনে কাজে লাগাবার আশা আছেও কিছু কিছু। যেমন, সময় সুবিধে করে ধুনুরি ডেকে ছেঁড়া তোশক ধুনিয়ে, নতুন একটু খেরো কিনে তোশক বানিয়ে নেওয়া, কাঁথাগুলোর উপর আবার একপ্রস্থ করে কাপড় বসিয়ে গোটাকতক ফোঁড় চালিয়ে নিয়ে কাজ চালানো, বাসনওলা এলে ঘাড়াগুলো বদল দেওয়া, আর বাসনওয়ালী এলে ছেঁড়া মশারি বদলে দুএকখানা পাথরের খোরা, কি কাসার বাটি, নয়তো একটা পেতলের গামলা কি মোটা চিরুনি আর হাত-আয়না কিনে ফেলা!

ফাটা ছবির ফ্রেমেরও সদৃগতি হয় বৈকি! ভাঙা কাঁচেরও খদের আছে। ভরদুপুরে বেরোয় তারা কাচ ভাঙা-কাচ ভাঙা হাঁক পেড়ে। চোর সামলাতে পাঁচিলের মাথায় ভাঙা কাচ পুততে কেনা হয় ওগুলো।

মোটা কথা, গোরস্ত বাড়িতে চাটু করে কিছু ফেলে দেওয়ার কথা ওঠে না। ফেলাছড়ায় মা-লক্ষ্মী বিমুখ হন এ আর কোন গোরস্তর গিন্নী না জানে? অথচ ওই সব কুদর্শন বস্তুগুলো, সময়সাপেক্ষে যাদের সদগতি হবে, তাদের কিছু আর সর্বদা চোখের সামনে বিছিয়ে রাখা যায় না! তাদের জন্যেই চোরকুঠুরি, চিলেকোটা, চালি, সাঙ্গা!

মুক্তকেশী ও গোরস্তর পিানীর পদ্ধতিতেই চিলেকোঠাটাকে বোঝাই করে রেখেছেন। কোনো একদিনও এ ঘরে আর আদরে পুত্ররত্ব পেবো এসে বসে বসে মশার কামড় খাবে আর নিজের গাল নিজে চড়াবে, এ কথা মুক্তকেশীর স্বপ্নের অগোচর।

অথচ সেটাই ঘটছে।

পেবো মশার ছুতোয় নিজের গালে নিজে চড়াচ্ছে, নিজের কান নিজে মুলছে, এবং নেহাৎ মাটিতে শতবর্ষের ধুলো বলে নাক ঘষটে নাকে খৎ দিতে না পারায় মনে মনে সেটা দিচ্ছে শতবার!

ভরসা বলতে, আশ্রয় বলতে ভাঙা এই তক্তপোশটা। সেটাকে প্ৰবোধ ফুঁ দিয়ে দিয়ে আলতো করে কোঁচার আগার ঝাঁপটা মেরে বসবার যোগ্য করে নিয়েছে। সুবৰ্ণলতাকে নিয়ে যদি দুদণ্ড বসতে হয় এখানে বিরহজ্বালা মেটাতে, চৌকির ক্যাচার্ক্যোচ শব্দটা নিয়ে না মুশকিলে পড়তে হয়, এই ভাবনাতেই কাতর ছিল প্রথম দিকে, ক্রমশ সেটা চলে গেছে, এখন শুধু ভাবনা সুবর্ণ এলে কী কী কটু কথায় মনের ঝাল মেটাবে।

কী ভেবেছে সে নিজেকে?

মহারাণী?

তাই তীর্থের কাকের মতন, রাস্তার হ্যাংলা কুকুরের মতন হা-পিত্যেশ করে বসে আছে প্ৰবোধ, যে নাকি সুবর্ণর স্বামী! জগতের সেরা গুরুজন! জাপান থেকে চিরুনি আসে, তাতে পর্যন্ত লেখা থাকে পতি পরম গুরু। তার মানে তাদের দশের মেয়েরাও এ উপদেশ শিরোধাৰ্য করে। আর সুবর্ণ হিন্দুর মেয়ে হয়ে, বাঙালীর মেয়ে হয়ে এই কষ্টটা দিচ্ছে স্বামীকে?

প্ৰবোধ পারে না। অমন পরিবারকে ত্যাগ করে দিতে? একবার যদি মায়ের কাছে মুখের কথাটি খসায় প্ৰবোধ, যদি বলে, তোমার মেজবৌ তোমারই থাক মা, আমার দরকার নেই, আমার জন্যে চিমটে আছে, লোটা আছে, গেরিমাটি আছে— মা দূর দূর করে বিদেয় করে দেবে না। অমন অলক্ষ্মী বৌকে? আর ছেলেকে ঘরবাসী করতে নতুন করে মেয়ে দেখে বিয়ে দেবে না?

ভেবে দেখে না। এসব গরবিনী দেমাকী!

নাকি ভাবে প্ৰবোধের আর বৌ জুটবে না?

পুরুষ বেটা ছেলে, আস্ত চারখানা হাত-পা আছে, তার আবার বৌয়ের অভাব? ত্যাগ দিতেই বা ছুতোর অভাব কি? মস্ত ছুতো তো রয়েইছে।

মা!

মার নামে বদনাম তুললেই তো চুকে গেল।

এতদিন ত্যাগ করা হয় নি কেন? জানতাম না!

ভেতরের কথা জানতাম না। ব্যস!

অদৃশ্য সেই অপরাধিনীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তাকে যথেষ্ট লাঞ্ছনা করতে থাকে প্ৰবোধ, যথেচ্ছ কটুকাটিব্য! করবে না কি করবে, মশার কামড়ে চাকা চাকা হয়ে গেল না। সর্বাঙ্গ? ঘামতে ঘামতে লোনা হয়ে গেল না দেহটা? এত জিনিস আছে। ঘরে, এত জঞ্জাল, একখানা ভাঙা হাতপাখা নেই! যেটা থাকলে নাকি প্ৰাণটা এমন ঠোঁটের আগায় আসত না, আর হয়তো মেজাজ এত সপ্তমে উঠিত না!

কিন্তু নেই।

একখানা ফাটা ছবির কাচ নিয়ে নেড়ে নেড়ে বাতাস খেতে গেল। হতভাগ্য বেচারা, ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়ল সেটা! লাভের মধ্যে কাচের টুকরোর বিভীষিকা ছড়িয়ে রইল চৌকির উপর।

লক্ষ্মীছাড়া মেয়েমানুষটা আসুক একবার, আগে এই কাচগুলোর ব্যবস্থা করিয়ে তবে অন্য কাজ।

রাগতে রাগতে হঠাৎ একসময় চোখে জলই এসে যায় প্ৰবোধের। শুধু কী ওই পাজী মেয়েমানুষটা?

নিজের মা তার শত্রু নয়?

গৰ্ভধারিণী মা!

আরো তিনটে ছেলেও তো রয়েছে তার? আর কাউকে কেন্দ্র করে স্বপ্ন দেখতে পারলেন না? এই হতভাগ্য পেবোই তার স্বপ্নে ঠাঁই পেতে গেল!

কেন?

কোন অপরাধে?

মা যদি ওই কিন্তুতকিমাকার স্বপ্নটি দেখে না বসতেন, আজ কি এই দুৰ্গতি ঘটতো প্ৰবোধের? পনের বিশ দিন উপোসী রাত কাটাতে কাটাতে তবেই না এমন মরীয়া হয়ে উঠেছে প্ৰবোধ? বিনিদ্র রজনীতে মা আসেন গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে, পাখার বাতাস করতে! কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে! সেই নুনের ছিটের জ্বালায় মার পায়ে মাথা খুঁড়ে বলতে ইচ্ছে হয়, মা, তোমার স্নেহ সংবরণ কর মা। মারার ওপর খাঁড়ার ঘা বসিও না।

তা সত্যিই তো বলা যায় না, তাই সব আক্রোশ জমা হয় গিয়ে সেই ঘোমটাধারিণীর ওপর। এদিকে তো ঘোমটার ভেতর খেমটা নাচ, শুধু স্বামীর বেলাতেই যত লজ্জা!

সুবৰ্ণ যদি চালাকি চাতুরী খেলিয়ে একটু অগ্রণী হতো, এক আধবার কি সুযোগ জুটতো না? তা নয়, মহারাণী যেই ঘরে ঢুকলেন, শব্দ করে খিল ঠুকলেন, ব্যস! হয়ে গেল রাত কাবার!

প্রথম যখন শোনা গেল সুবর্ণ একলা শুতে চেয়েছে, বলেছে তার অত ভয় নেই, প্ৰবোধ আশায় কম্পিত হয়েছিল, আহ্লাদে পুলকিত হয়েছিল।

বোঝা গেছে!

মানে বোঝা গেছে!

চালাকের দাড়ি তো!

খেয়াল হয়েছে। ঘরে রাজু-ফাজু থাকলে অসুবিধে, ধরা পড়ে যাবে চোরা অভিসার, তাই!

হায় কপাল, সে আশা মরীচিকা মাত্ৰ!

বসে বসে মজা দেখছে, স্বামীর ছটফটানি যন্ত্রণা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে! নরকেও ঠাঁই হবে এই পাপিষ্ঠার?

হবে না! নরকেও ঠাঁই জুটবে না। ওর!

রাগ বেড়েই চলে। কারণ তদুপরি পেটের মধ্যে অগ্নিদাহ। কোনকালে অফিসের ভাত খেয়ে বেরিয়েছে, কখন সে ভাত হজম হয়ে গেছে, তেষ্টায় ছাতি ফাটছে, এক ফোঁটা জলও পেটে পড়ে নি!

অফিসে থাকলে এতক্ষণে চার-ছখানা হিঙ্গের কচুরী, গোটা আষ্টেক আলুর দম, আধ-পোটাক বোঁদে সেঁটে, গেলাস দুই জল খেয়ে নেওয়া হয়ে যেত, সে জায়গায় এই! পেটের কলকজাগুলো পর্যন্ত বাপান্ত করছে!

আসবে না!

আসবে না পাপীয়সী!

বেরিয়েই পড়তে হবে এবার!

সত্যিই তো আর গুমখুন হতে পারে না প্ৰবোধ?

 

অবস্থা যখন এমনি চরমে, তখন হঠাৎ মৃদুমন্দ হাসির আওয়াজ যেন দরজার ওদিকে চিকমিকিয়ে ওঠে!

খি খি খি খি কৌতুকের হাসি!

তার মানে প্ৰবোধের অবস্থা অনুমান করে আমুদে হাসি হাসছে।

প্ৰবোধ কি দরজা খুলেই ওর গলাটা টিপে ধরবে? নাকি নিষ্ঠুর পাষাণী বলে দু হাতে সাপটে ধরে–

দরজায় টোকা পড়ল।

যেটা আগে থেকে ঠিক ছিল।

প্ৰবোধ খিল বন্ধ করে বসে থাকবে, সুবর্ণ এসে তিনটি টোকা দেবে। কারণ দৈবাৎ যদি অন্য কেউ এসে দোর ঠেলে! তার থেকে সাঙ্কেতিক ব্যবস্থা করে রাখাই ভাল!

টোকা পড়ল।

একবার, দুবার, তিনবার।

কোঁচার কাপড় তুলে মুখ মুছতে মুছতে দরজার খিলটা খুলে দিল প্ৰবোধ, আর সঙ্গে সঙ্গে চমকে ঠিকরে ফের চৌকির ওপর গিয়ে পড়ল ভয়ঙ্কর একটা আ-আ শব্দে!

শব্দটা একবার ড়ুকরে উঠেই একেবারে পাক খেয়ে দুদ্দাড়িয়ে নিচে নেমে গেল সিঁড়িতে আর্য আ রেশ ছড়িয়ে!

বিরাজ!

বিরাজের ওই রোগ।

ভয় পেলেই আঁ আঁ করে চোখ কপালে তুলে কীর্তিকাণ্ড করে বসে! আর ভয় পায় ও ফি হাত! বিরাজকে ভয় দেখানো এ বাড়ির সকলের একটা পরিচিত খেলা!

প্ৰাণ গেলেও বিরাজ অন্ধকারে দোতলায় সিঁড়িটায় ওঠানামা করে না। ফস করে কারুর ঘরের পিলসুজ থেকে পিদিপটা তুলে নিয়ে এসে সিঁড়ি ওঠে নামে। এমন কি দিনদুপুরেও ভূতের ভয় বিরাজের।

তা বিরাজকে নিয়ে বাড়ির সেই পরিচিত খেলাটাই কি খেলতে বসেছিল সুবর্ণ? বিরাজকে ভয় দেখিয়ে কৌতুক পেতেই তাকে ভুলিয়েভালিয়ে ছাতে তুলেছিল?

নাকি রহস্য-কৌতুকের লক্ষ্যস্থল অন্য?

খেলার উল্লাস আর একজনকে নিয়ে?

তা কৌতুকপ্রিয় সুবর্ণর ভাবভঙ্গীতে কিছু বোঝা যায় নি। খুব নিরীহ গলায় চুপিচুপি বিরাজকে বলে রেখেছিল সে, মা বেরিয়ে গেলে চিলেকোঠায় গিয়ে বাঘবন্ধী খেলবে ছোটঠাকুরঝি?

বাঘবন্দী খেলাটা বিরাজেরই পরম প্রিয়, কারণ অক্ষর পরিচয়ের বালাই তার নেই, দুপুরের অবকাশকে সহনীয় করবার জন্য উপায় জানা নেই। উমাশশীর মত ঘুম মারতেও ওস্তাদ নয় সে।

তাই সুবৰ্ণ যখন দুপুরবেলা চুপিচুপি একখানি বই নিয়ে বসে, বিরাজ বাঘবন্দীর জন্যে পীড়াপীড়ি করে। না খেললে বই পড়ার কথা মাকে বলে দেব বলে শাসায়। সুবৰ্ণকে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও যুঁটি কড়ি নিয়ে বসতে হয়। সে অনিচ্ছা বিরাজের চোখে ধরা পড়ে বৈকি!

কাজেই প্ৰস্তাবটা বিরাজের কাছে প্ৰায় অলৌকিকই লেগেছিল।

তাছাড়া চিলেকোঠার ঘরে।

যেখানে ভরদুপুরে গেলে গা ছমছম করে।

মা চলে গেলে আর চিলেকোঠায় কেন? বিরাজ অবাক হয়, দোতলার ঘরেই তো-

না, মুক্তকেশীর সামনে বৌ মানুষের আমন সময় অপচো করা খেলা চলে না! বৌ অবসর সময়ে সলতে পাকাবে, সুপুরি কাটবে, চালডালের কাঁকর বাছরে, নিদেনপক্ষে কাঁথা সেলাই করবে, এটাই বিধি। কচি ছেলের মা-দের যদি বা ঘুমের কিছুটা ছাড়পত্র থাকে, অন্যদের তো আদৌ না।

ওই সব কাজ না করে বৌ কড়ি ঘুটি চেলে খেলতে বসবে? মা-লক্ষ্মী টিকবেন তাহলে? চার হাত তুলে ধেই ধেই করে বেড়িয়ে যাবেন না?

মুক্তকেশীর অবশ্য গ্রাবুর আসরে বাঁধা বরাদ্দ আছে। শীত গ্ৰীষ্ম বর্ষা, রোদ বৃষ্টি বাজপাত, সব কিছু তুচ্ছ করে দ্বিপ্রাহরিক সেই তাসের আড্ডায় গিয়ে হাজির হন মুক্তকেশী! আবার সেখানে এক স্যাকরা-গিনীর সঙ্গে ছোঁয়াছুয়ি হয়ে যায় বলে এসে স্নানও করেন। কিন্তু মুক্তকেশীর সঙ্গে কার তুলনা?

বাঘের সঙ্গে হরিণের তুলনা সাজে?

সিংহের সঙ্গে খরগোসের?

মুক্তকেশীর সামনে তাই খেলা চলে না। মেয়ের জন্যে মনটা যদি বা একটু দোলে, তবু বৌ নষ্ট তো আর করতে পারেন না মেয়ের মায়ায় পড়ে?

মেয়েকে অনেক খোশামোদ করেন নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে কিন্তু যেতে চায় না বিরাজ। বলে, গিন্নীদের কাছে তো সেই মুখে তালাচাবি দিয়ে বসে থাকা। কথা কইলেই বকবে!

বকবো না তো কি? পরের ঘরে যেতে হবে না? বলে চলে যান মুক্তকেশী পেট-কাপড়ে তাসজোড়াটি বেঁধে নিয়ে। চুখিচুপি শিখিয়ে দিয়ে যান, দুপুরভোর যেন গাল-গল্প করে মেজবৌমার কাজ কামাই করিয়ে দিসনে।

খেলার আকর্ষণ তাই পুরোদমেই আছে। কিন্তু মুক্তকেশীর অসাক্ষাতে চিলেকোঠায় কেন?

সুবৰ্ণ বলে, আছে। মজা! গেলেই দেখতে পাবে।

বলই না ছাই! কুলের আচার সরিয়ে জমা করে রেখে এসেছ বুঝি?

উঁহুঁ!

তবে?

বলবো কেন? বলছি তো গেলেই দেখতে পাবে।

বলই না বাবা!

বললে মজা থাকবে না।

বুঝেছি ঝালমুড়ি মেখে রেখে এসেছি।

সুবৰ্ণ কৌতুকে ফেটে বলে, ধরে নাও তাই।

সুবৰ্ণর ওই কৌতুকে ফাটা মুখ দেখে ৰিরাজও স্পন্দিত হয়।

না জানি কি!

অবশ্য সেই থেকে আরো অনেকবার প্রশ্ন করে করে অস্থির করেছে বিরাজ, কিন্তু একা একবার ছুটে গিয়ে দেখে আসবে, সে সাহস হয় নি।

অথচ শত সাধ্যসাধনাতেও সুবর্ণ মজা ফাঁস করে নি।

নিচের সংসারের পাঠ যখন শেষ হল, সুবর্ণ বলে, চল এইবার! মল জোড়াটা খুলে পা টিপে টিপে চল।

ওমা কেন?

বিরাজ ভয়ে আতকে ওঠে, মল খুলবো কেন?

আছে। মজা! আমিও খুলছি।

আমার বাপু বড্ড ভয়-ভয় করছে!

ভয় আবার কি? বল না, ভূত আমার পুত শাঁকচুন্নি আমার ঝি, রামলক্ষ্মণ বুকে আছেন ভয়টা আমার কি?

অদ্ভুত কিছু একটা কৌতুকের আশায় অগত্যাই ওই মন্ত্রটা জপ করতে করতে সুবর্ণর সঙ্গে সঙ্গে ছাতে ওঠে বিরাজ।

তারপর?

তারপর সুবর্ণ বলে, আস্তে দরজায় তিনটে টোকা দে!

ও বাবা কেন?

দে না! দেখবি স্বপ্নে যা ভাবিস নি। তাই দেখতে পাবি!

তুমি আমায় ভূতে খাওয়াতে চাও নাকি, বল তো?

সুবৰ্ণ এবার উদার হয়, বেশ, সে সন্দ যদি হয়ে থাকে তোমার তো দিও না টোকা! এতদিন আমাকে দেখেশুনে এত অবিশ্বাস আমার ওপর?

বিরাজ লজ্জিত হয়।

স্বভাবদোষে আর শিক্ষার দোষে সব কথা মার কাছে লাগিয়ে দেওয়ার অভ্যাস থাকলেও মেজবৌদি তার কাছে আকর্ষণীয়। মেজবৌদির কাছে চুল বাধতে সুখ, মেজবৌদির কাছে সাজতে সুখ, মেজবৌদির সঙ্গে খেলতে, গল্প করতে সুখ। মেজবৌদির অভিমানে তাই নরম হয় সে।

বলে, বেশ বাবা বেশ, দিচ্ছি টোকা, বাঁচি বাঁচবো মারি মরবো!

সুবৰ্ণ হেসে ওঠে খি খি করে।

তারপর টোকা!

তারপর খিল খোলার শব্দ!

সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নের অতীত সেই দৃশ্য!

যে মেজদা ভাত খেয়ে অফিস চলে গেছে, সেই মেজদা খিল খুলে দিল ছাতের দরজার।

কিন্তু সত্যিই কি মেজদা?

ওই কি মেজদার মুখ?

অমনি ভয়ঙ্কর?

আমন বীভৎস?

হ্যাঁ, প্রায় অজ্ঞান হয়েই পড়েছিল বিরাজ, আর এই কৌতুকের জন্যে তাই অনেক খেসারৎ দিতে হয়েছিল সুবৰ্ণকে।

মুক্তকেশীর মেয়েকে অজ্ঞান করার অপরাধে, মুক্তকেশীর ছেলেকে লাঞ্ছনা করার অপরাধে! আবার শুধু মৌখিক তিরস্কারই নয়, দৈহিক শাস্তিও পেতে হয়েছিল। লাঞ্ছিত অপমানিত স্বামীর কাছ হতে!

সুবৰ্ণর কৌতুকম্পৃহার অধ্যায়ে একটা বড় ছেদ পড়েছিল সেদিন থেকে।

তবু স্বভাব যায় না মলে! আবার একদিন ননদাইকে নিয়ে রঙ্গ করতে গিয়ে-তা সে তো পরে।

সুবৰ্ণদের দর্জিপাড়ার নিজেদের বাড়িতে।

যে বাড়িতে সিঁড়ির অভাবে ছাতে ওঠা যায় না। টাকার অভাবে সারা জীবন সিঁড়ি হল না। যার।

কিন্তু শুধু কি টাকার অভাবে?

প্ৰয়োজন বোধের অভাবেও কি নয়?

সুবৰ্ণ ছাড়া আর কেউ ছাতে উঠতে না পাওয়াটা মস্ত একটা লোকসান ভাবে নি। সে বাড়িতে।

১.০৫ সুবৰ্ণলতার শ্বশুরবাড়ির আর কেউ

না, সুবৰ্ণলতার শ্বশুরবাড়ির আর কেউ ছাতে ওঠবার সিঁড়িটার প্রয়োজন অনুভব করে নি। রান্নাঘরের নীচু ছাতটা তো রয়েছে দোতলায়, তা ছাড়া উঠোনটাও রয়েছে অত বড়, এতে আর গোরস্তর কাপড় শুকোতে দেওয়া, বিছানা রোদে দেওয়া, কি বড়ি আচার আমসত্ত্ব জারকলেবুর চাহিদা মিটবে না?

মিটছে, অনায়াসেই মিটছে। সিঁড়ি থাকলেই বা কে ওই তিনতলার fi। মাথায় উঠতে যেতো। ওই সব বোঝা বয়ে?

সুবৰ্ণলতার সবই ক্ষ্যাপামি।

বলে কি না—আমি বইব। তোমরা সিঁড়ি কর, দেখো, সারা সংসারের সমস্ত ভিজে কাপড় কথা বিছানার বোঝা বয়ে নিয়ে যাব আমি। আচার, আমসত্ত্ব, বড়ি? তাও তসর মটকা পরে দিয়ে আসব, নামিয়ে আনব। কাউকে সিঁড়ি ভাঙতে হবে না।

কিন্তু ওর এই ক্লেশ স্বীকারের প্রতিশ্রুতিতেও উৎসাহিত হয় নি কেউ। খাওয়া নয়, পরা নয়, কিনা ছাতে ওঠা! এর জন্য মানুষের খিদেতেষ্টার মত ছটফটানি ধরেছে এটা ন্যাকামির মতই লেগেছে ওদের কাছে। ন্যাকামি ছাড়া আবার কি?

একটুকরো বারান্দা, ছাতে ওঠবার একটা সিঁড়ি, এ যে আবার মানুষের পরম চাওয়ার বস্তু হতে পারে, এ ওদের বুদ্ধির অগম্য।

বরং সুবৰ্ণলতার স্বামীর তীক্ষ্ণবুদ্ধির কাছে আসল তথ্যটা ধরা পড়েছিল। সুবৰ্ণলতার এই আকুলতার পিছনে যে কোন মনোভাব কাজ করছে তা আর বুঝতে বাকী থাকে নি প্ৰবোধের।

ছাদে উঠে পাঁচবাড়ির জানালায় বারান্দায় উঁকিঝকি দেওয়ার সুবিধে, নিজেকে আর দশজোড়া উঁকিঝকি মারা চোখের সামনে বিকশিত করার সুবিধে, আর বিশ্বাস কি যে চিল বেঁধে চিঠি চালাচালির সুবিধেটাও নয়?

প্ৰবোধের তাই সিঁড়িতে প্ৰবল আপত্তি।

সুবোধ বরং কখনো কখনো বলেছে, বোনাসের টাকাটা বেড়েছে, লাগিয়ে দিলে হয় সিঁড়িটা! প্ৰবোধের প্রতিবন্ধকতাতেই সে ইচ্ছে থেকে নিবৃত্ত হয়েছে সুবোধ।

বুদ্ধিমান ভাই যদি বলে, মাথা খারাপ? ওই টাকাটা সংসারের সত্যিকারের দরকারী কাজে লাগানো যাবে। নিবিরোধী দাদা কি সে কথার প্রতিবাদ করে? না, করতে পারে?

আর সত্যি, গোরস্তর সংসারে তো দরকারের অন্ত নেই। বিছানা বালিশ, জুতো জামা, র‍্যাপার চাদর, এ সবে তো ঘাটতি আছেই সব সময়। মুক্তকেশীর তীর্থখরচ বাবদও কিছু রাখা যায়। পাড়ার গিন্নীরা যখন দল বেঁধে তীর্থধর্ম করতে যান, মুক্তকেশী তাদের সঙ্গ না নিয়ে ছাড়েন না। তখন ছুটোছুটি করে টাকাটা যোগাড় করতে হিমসিম খেতে হয় ছেলেদের। হাতে থাকলে—

এইসব দরকারী কাজ থাকতে, টাকা ঢালতে হবে ইটের পাঁজায়?

অতএব সুবৰ্ণলতার কম্পিত আশার কুড়ির উপর পাথর চাপা পড়ে।

কিন্তু সুবৰ্ণলতার চাওয়ার সীমানা কি ওইটুকু মাত্র? একটুকরো বারান্দা, ছাদে ওঠবার একটা সিঁড়ি? ব্যস? আর কিছু নয়? জীবনভোর শুধু ওইটুকুই চেয়েছে সুবৰ্ণলতা?

না, তা নয়।

বেহায়া সুবৰ্ণ আরো অনেক কিছু চেয়েছে। পায় নি, তবু চেয়েছে। চাওয়ার জন্যে লাঞ্ছিত হয়েছে, উৎপীড়িত হয়েছে, হাস্যাম্পদ হয়েছে, তবু তার চাওয়ার পরিধি বেড়েই উঠেছে।

সুবৰ্ণলতা ভব্যতা চেয়েছে, সভ্যতা চেয়েছে, মানুষের মত হয়ে বাঁচতে চেয়েছে। সুবৰ্ণলতা বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে নাড়ীর যোগ রাখতে চেয়েছে, দেশের কথা ভাবতে চেয়েছে, দেশের পরাধীনতার অবসান চেয়েছে।

সুবৰ্ণলতাকে তবে পাগল বলবে না কেন তার স্বামী, শাশুড়ী, ভাসুর, দ্যাওর?

ওরা বলেছে, বাবার জন্মে শুনি নি এমন কথা! বলেছে, সেই যে বলে সুখে থাকতে ভূতের কিল খাওয়া, মেজবৌয়ের হচ্ছে তাই! রাতদিন অকারণ অসন্তোষ, রাতদিন অকারণ আক্ষেপ!

ওরা সুবৰ্ণলতার ওই চাহিদাটাকে অকারণ অসন্তোষ ছাড়া আর কোনো অ্যাখ্যা দেয় নি। ওদের বোধের জগৎটা ওদের তৈরী বাড়ির ঘরের মত। কোথাও•এমন একটা ভেন্টিলেটার নেই যেখান দিয়ে চলমান বাতাসের এক কণা ঢুকে পূড়তে পারে।

দর্জিপাড়ার এই গলিটার বাইরে আর কোনো জগৎ আছে, এ ওরা শুধু জানে না তা নয় মানতেও রাজী নয়।

ঘর বানবার সময় আওয়াজী (ভেন্টিলেটার) না রাখার যুক্তিটাই ওদের মনোভাব।

কোনো দরকার নেই। অনর্থক দেয়ালটায় ফুটো রাখা। পাখীতে বাসা বানাবে, আর জঞ্জাল জড়ো হবে, এই তো লাভ?

অনর্থক পাখীর বাসায় জঞ্জাল জড়ো করতে চায় নি। ওরা। তাতে শুধু লোকসানই দেখেছে।

ওদের বোধের ঘরেও ভেন্টিলেটারের অভাব।

কিন্তু সুবৰ্ণলতা কেন বহির্জগতে বহমান বাতাসের স্পর্শ চায়? এ বাড়ির বৌ হয়েও তার সমস্ত সত্তা কেন মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় ছট্‌ফট করে? তার পরিবেশ কেন অহরহ তাকে পীড়া দেয়, আঘাত হানে?

তা এ প্রশ্নের উত্তর একদা সুবৰ্ণলতার বিধাতাও চেয়ে পান নি।

যেদিন আসন্ন সন্ধ্যার মুখে সুবৰ্ণলতার শেষ চিহ্নটুকু পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে গেল, চিতার আগুনের লাল আভায় আকাশের লাল আভায় মিশলো, ধোঁয়া আর আগুনের লুকোচুরির মাঝখান থেকে সুবৰ্ণলতা পরলোকে পৌঁছে গেলেন, সেদিন যখন চিত্রগুপ্তের অফিসে নতুন কেউ এসে পড়ায় ঘন্টিটা বেজে উঠল, বিধাতা-পুরুষ গলাঝাড়া দিয়ে বললেন, কে এল হে চিত্ৰগুপ্ত?

চিত্ৰগুপ্ত গলাঝাড়া দিয়ে বলে উঠলেন, আজ্ঞে হুজুর, সুবৰ্ণলতা।

সুবৰ্ণলতা? কোন সুবৰ্ণলতা? কাদের ঘরের?

আজ্ঞে হুজুর বামুনদের। যে মেয়েটা সেই পনেরো বছর বয়ে থেকে মরণকামনা করতে করতে এই পঞ্চাশ বছরে সত্যি মালো!

বিধাতাপুরুষ বললেন, তাই নাকি? তা জীবনভোর মরণকামনা কেন? খুব দুঃখী ছিল বুঝি?

চিত্ৰগুপ্ত এ প্রশ্নে পকেট থেকে দূরবীক্ষণ যন্ত্র বার করে চোখে লাগিয়ে কিছুক্ষণ মর্ত্যধামের দিকে সন্ধানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দ্বিধাযুক্ত স্বরে উত্তর দিলেন, তা তো ঠিক মনে হচ্ছে না। বরং ষোলো আনা সুখের অবস্থাই তো দেখছি।

তবে?

চিত্ৰগুপ্ত মাথা চুলকে বললেন, আজ্ঞে সে হিসেব দেখতে হলে তো সময় লাগবে। এসব গোলমেলে লোকেদের ডিপার্টমেন্ট আলাদা।

বিধাতাপুরুষের কেরানী কবে আবিষ্কার করতে পেরেছিল সুবৰ্ণলতার উল্টোপাল্টা প্রকৃতির কারণ রহস্য, কবে সে বিবরণ পেশ করেছিল মনিবের দরবারে, কে জানে সে কথা!

হয়তো করেই নি।

হয়তো বিধাতা পুরুষও আর সে নিয়ে মাথা ঘামান নি। মুহূর্তে মুহূর্তে কত কোটি কোটি বার ঘণ্টি পড়ছে, কত হাজার কোটি লোক আসছে, বামুনদের সুবৰ্ণলতাকে কে মনে করে বসে থেকেছে?

প্রশ্নটা তাই নিরুত্তর থেকে গেছে।

শুধু সুবৰ্ণলতা যতদিন বেঁচে থেকেছে, অহরহ তাকে ঘিরে এ প্রশ্ন আছড়ে আছড়ে পড়েছে।

সংসারসুদ্ধ সবাই খাচ্ছে ঘুমোচ্ছে হাসছে খেলছে ছেলে ঠেঙাচ্ছে ছেলে আদর করছে গুরুজনকে মান্য করছে গুরুজন রাগ করলে চোর হয়ে থাকছে, নিয়মের ব্যতিক্রম নেই, শুধু মেজবৌই রাতদিন হয় ঠিকরে বেড়াচ্ছে, নয় দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছে। নয়তো এমন একটা কিছু কাণ্ড করে বসছে যা দেখৈ স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছে লোকে। কী করবে। লোকে এ বৌকে নিয়ে?

গুরুলঘু জ্ঞানের বালাই নেই, কিছুতে সন্তোষ নেই।

কেন?

কেন?

কী তুমি এমন রাজকন্যে যে কিছুতে মন ওঠে না? আর কথাই বা এত কটকটে কেন শুনি?

প্রথম ছেলে।পুলে হচ্ছে, লজ্জায় মাথা হেঁট করে বসে থাকবি, তা নয়, আঁতুড়ঘরে ঢোকার মুখে বলে কিনা, এত সব ময়লা ময়লা কাপড় বিছানা দিচ্ছেন? ও থেকে অসুখ করে না বুঝি? উমাশশী সেই ছেঁড়া কথা কাপড়গুলো নামিয়ে এনে ধপ করে ফেলেই নাকটায় আঁচল দিয়েছিল, ওর থেকে লাফিয়ে ওঠা ধুলোর থেকে আত্মরক্ষা করতে।

জায়ের কথা শুনে চমকে আঁচল ছেড়ে শঙ্কিত দৃষ্টি মেলে শাশুড়ীর দিকে তাকালো। হে ভগবান, যেন শুনতে না পেয়ে থাকেন!

কিন্তু ভগবান উমাশশীর প্রার্থনা কানে নেবার আগেই মুক্তকেশীর কানে পৌঁছে গেছে তাঁর বধুমাতার বাণী।

মুক্তকেশী। তখন ছেলের নাড়ী কাটবার জন্যে চ্যাঁচাড়ি গুছিয়ে রাখছিলেন। প্রসববেদনার বাড়াবাড়িটা হবার আগেই সব কিছু গুছিয়ে রাখেন সুগৃহিণী মুক্তকেশী। অবিশ্যি ইতিপূর্বে বৌয়ের আঁতুড় তুলতে তাঁকে হয় নি। বড়বৌমার মা গরীব দুঃখী বিধবা মানুষ হলেও প্রথম দ্বিতীয় দুবারই মেয়েকে কাছে নিয়ে গেছেন। মুক্তকেশী যা করেছেন নিজের মেয়েদের। তবে আসলে পোক্ত হয়েছেন জা ননদ ভাসুরঝি দ্যাওরঝিদের ওপর হাত পাকিয়ে। একান্নবতী সংসার ছিল তো আগে।

তা ছাড়া হাঁড়ি ভেন্ন হলেও আপদে বিপদে সবাই সবাইয়ের করেছে। মুক্তকেশী বেশি করিৎকর্ম বলে বেশি করেছেন।

কিন্তু মুক্তকেশী কি এতখানি বয়সে—এমন দুঃসাহসিক স্পর্ধার কথা শুনেছেন কখনো?

না, জীবনে শোনেন নি।

প্রসব-বেদনায় ছট্‌ফট করতে করতে যে কোনো ঝি-বৌ এতটা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে পারে, এ মুক্তকেশীর ধারণার বাইরে, জ্ঞানের বাইরে, স্বপ্নের বাইরে।

হাতের চ্যাঁচাড়ির সুয়ো হাতে ফুটিয়ে থ হয়ে গিয়ে বলে ওঠেন মুক্তকেশী, কি বললে মেজবৌমা?

মেজবৌমা প্ৰায় গোল হয়ে শুয়ে উঃ আঃ করছিল, তবু ওর মধ্যেই বলে উঠল, শুনতে তো পেলেন। ওই ধুলো-ভর্তি ময়লা পুরনো বিছানা কাঁথায় অসুখ করবে, সেই কথা বলছি।

মুক্তকেশী রান্নাঘরের বড় উনুনটার মতন গনগনিয়ে বলে ওঠেন, আমার এই কপালটা দেয়ালে ঠকে ফাটাতে ইচ্ছে করছে মেজবৌমা, নইলে কোনদিন নিজের আগুনে নিজেই ফেটে পড়বো! অ্যাঁ! বললে কী তুমি? বললে কী, পুরনো বিছানায় রোগ জন্মাবে তোমার? আঁতুড়ঘরে যে কথা কেউ না শুনেছে, সেই সব কথা আমায় শুনতে হচ্ছে পদে পদে? … তবে? কী করতে হবে তাহলে? নবাব-নন্দিনীর জন্যে সাটিনের বিছানার বায়না পাঠাতে হবে? তবে একটু ধৈর্য ধরে থাকো বাছা, এক্ষুণি ঘরের ডাক বাইরে আর বাইরের ডাক ঘরে করে বাড়ি তোলপাড় করো না। পেটের পো পেটে রেখে বসে থাকো, আমার ত্যাড়াকান্ত ছেলে আসুক আপিস থেকে, বলি তাকে বিছানার কাহিনী!

সুবৰ্ণর তখন ছটফটানি শুরু হয়ে গেছে, তবু সুবৰ্ণ জবাব দিতে ছাড়ে না। মূর্খ সুবর্ণ, অবোধ সুবৰ্ণ, সংসার-জ্ঞানহীনা সুবৰ্ণ!

বলে, যাক গে বাবা থাক! আমার তো মরণ হলেই মঙ্গল!

মুক্তকেশী সহসা নিজের গালে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় বসিয়ে বলে ওঠেন, তোমার মরণ হলেই মঙ্গল? অ্যাঁ! ও রাজু, মাথায় জল দে!

রাজু অবশ্য জল আনল না, মুক্তকেশী বিনা জলেই চাঙ্গা হয়ে আবার বলেন, তাহলে এও বলি মেজবৌমা, এমন চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলতে তোমার মায়া হয় না? এ কী আমার করবার কথা? প্রেথম পোয়াতী শ্বশুরঘরে আঁতুড় পেতেছে শুনেছ। কখনো? না দেখেছি কখনো? বলি মা-ই না হয় তোমার কুলের ধ্বজা বাপ মিনসে তো আছে? বাপ আছে, ভাইভাজ আছে, কাছের গোড়ায় একটা পিসি রয়েছে, নিয়ে যেতে পারল না? নতুন সাটিন মখমলের বিছানায় শুইয়ে আঁতুড় তুলতো বাপ!

আর উত্তর-প্রত্যুত্তরের ক্ষমতা ছিল না। সুবৰ্ণলতার, তবু শেষ একটা কথা বলে নেয়, বাবা যখন নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তখন তো কই পাঠান নি, এখন দোষ দিচ্ছেন কেন?

সুবৰ্ণ যন্ত্রণায় ছটফট করছে, মুক্তকেশীও হাড়ি ধাই গঙ্গামণির আগমন আশায় ছটুফট করছেন, ৩ত্ৰাচ এই বাকযুদ্ধ।

মুক্তকেশী অবাক গলায় যেন আর্তনাদ করে ওঠেন, বাবা নিয়ে যেতে চেয়েছিল? বলি কখন আবার নিয়ে যেতে চেয়েছিল মেজবোমা? স্বপ্ন দেখছ, না। স্বপ্ন দেখোচ্ছ?

স্বপ্ন দেখব কেন মা? ইচ্ছে করলেই মনে পড়াতে পারবেন। বিয়ের পর নিয়ে যাবার কথা বলেন নি। বাবা? আপনারাই বলেছিলেন, কুসঙ্গে পাঠাব না–

বলেছি, বলবই তো, একশোবার বলবো। মুক্তকেশী বলেন, নিত্যি যদি ওই হতচ্ছাড়া বাপের ঘরে যাওয়া-আসা করতে, তুমি কি আর এতদিন ঘরে থাকতে মা? কবে জুতো-মোজা পায়ে দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে! খবরের কাগজ পড়া মেয়েমানুষ তুমি, সোজা কথা?

বাবা রে গেলাম গো–সুবর্ণ কাতরে উঠে বলে, মায়া মমতা কী আপনাদের প্রাণে একেবারে দেন নি। ভগবান? মরে যাচ্ছে মানুষটা, তবু বাক্যযন্ত্রণা—

প্রস্তর-প্রতিমা উমাশশী হাঁ করে চেয়েছিল তার ছোটজায়ের দিকে।

কী ও?

মেয়ে না ডাকাত?

এত বড় দুঃসাহস কোথায় পেল ও? উমাশশীর যে দেখে শুনেই বুক কাপে, পেটের ভিতর হাত-পা সেঁধিয়ে যায়। সুবর্ণর শেষ কথায় হঠাৎ উমাশশীর সমস্ত স্নায়ূগুলো যেন একযোগে ছুটি চেয়ে বসলো।

উমাশশী মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হু-হু করে কেঁদে উঠল। কেন, তা সে নিজেই জানে না।

এই আদিখ্যেতায় মুক্তকেশী কি বলতেন কে জানে, কিন্তু বিপদমুক্ত করলো একটি শানানো ধারালো গলা।

এ গলা হাড়ি-বৌ গঙ্গামণির।

সুবৰ্ণর যন্ত্রণা শুরু হতেই খুদু গিয়েছিল তাকে ডাকতে।

বড়বৌয়ের কান্না শুনতে পেয়ে দালান থেকেই চিৎকার করে উঠেছে গঙ্গা, বলি হয়ে গেল নাকি? কান্নাকাটি পড়ে গেল যে?

বেয়াড়া আস্‌পদ্দাবাজ বেঁটাকে যতই গালমন্দ করুন, তার জন্যে উদ্বিগ্ন হচ্ছিলেন বৈকি মুক্তকেশী, বিপদকাল বলে কথা! গঙ্গামণির গলার আওয়াজে মুক্তকেশী যেন হাতে চাঁদ পান!

আর মুহূর্তে ভোল বদলে যায়। তাঁর। অভিমানের গলায় বলে ওঠেন, এতক্ষণে এলি গঙ্গা? বৌ এদিকে এখন তখন!

গঙ্গা খরখারিয়ে ওঠে, তা কী করবো বাবু, তোমার নাতি হচ্ছে বলে তো আর এই গঙ্গামণি মরতে পারে না? পান সাজবো, দোক্তাপাতা গুঁড়োবো, পানদোক্তা গুলের কোটো আঁচলে বাধবো, দুয়োরে তালাচাবি নাগাবো, তবে তো আসবো!

মুক্তকেশী আরও অভিমানী গলায় বলেন, এখানে কী তুই পানদোক্তা। পেতিস না গঙ্গা?

হ্যাঁ, এদের কাছে মুক্তকেশী নোম নত। কারণ এদের নইলে আঁচল। এ বিপদের দিন তো আসবেই সংসারে। বছর বছরই আসবে।

গঙ্গার হাতিযশের নামডাক আছে, তাই গঙ্গার দস্তরমিত অহঙ্কারও আছে। রীতিমত অহঙ্কার আছে। এতটুকু এদিকও-ওদিক হলেই খরখর করে। পাঁচকথা শুনিয়ে দেবে, তেমন রাগ হলে প্ৰসূতিকে ফেলে চলে যাবে। নয়তো ইচ্ছে করে অবস্থা খারাপ করে দেবে।

তাই তোয়াজ করতেই হয়।

তাই গদগদ গলায় বলতে হয়, ক-কুড়ি পান খাবি খ্যা না!

খাব, পাঁচকুড়ি পান খাব। আগে তোমার নাতিকে পৃথিবীর মাটি দেখাই। কই গো বড়বৌমা, এক খুরি গরম জল দাও দিকি! হ্যাগা, তুমি কাঁদছ কেন? শাউড়ীর গাল খেয়েছ বুঝি? তা খেতে পারো, যা দজাল শাউড়ী! নাতি হলে ঘড়া বার করতে হবে, বুঝলে গিন্নী, ওর কমে ছাড়ব না!

গঙ্গামণির একটি চোটপাট কথা মুক্তকেশীল গা-সহা। তাই মুক্তকেশী চটে ওঠেন না। চেষ্টা করে হেসে বলেন, আচ্ছা, আন তো আগে। হবে তো একটা মেয়ের টিপি, বুঝতেই পারছি।

মেয়ে হলেও গামলা! মেজখোকার এই প্ৰেথম, তা মনে রেখো। গঙ্গামণি অতঃপর তার নিকষ-কৃষ্ণ বিপুল দেহখানি নিয়ে আসরে ওঠে।

গরম দুধ দাও দিকি, একটু গরম দুধ দাও, জোর আসবে দেহে। ন্যাকড়াকানির পোটলা কই গো? বালিশ আছে? চ্যাঁচাড়ি? মজুত রাখো হাতের কাছে।… বলি মেজবৌমা, অমন হাত-পা ছেড়ে দিয়ে নীলবনু হয়ে আছ যে! বুকে বল আনো, পেরাণে সাহস আনো, কষ্ট নইলে কি আর কেষ্ট মেলে?

কষ্ট নইলে কেষ্ট মেলে না!

অতএব কেষ্ট চাইতে হলে কষ্ট করতেই হবে।

কিন্তু শুধু যদি কষ্টই ওঠে ভাগ্যে, কেষ্টটি না মেলে?

মুখপাত প্রথম সন্তান হলো কি না মাটির ঢিপি এক মেয়ে? ছিছি!

মুক্তকেশী ক্রুদ্ধ গলায় বলে ওঠেন, জানতুম! গামলা পাবি না কচু পাবি!

চলেছিল যমে-মানুষে টানাটানির পালা। দীর্ঘসময় এই কষ্ট হয়রানি উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, তার ফলাফল কি না একটা মেয়ে! শাঁখ বাজবে না জেনেই বোধ করি চিলের মত চেচনির সাহায্যে পৃথিবীতে নিজের আগমনবার্তা নিজেই ঘোষণা করছে।

গঙ্গামণিও যেন অপ্ৰতিভ হয়।

নাতির ছলনা দেখিয়ে অনেক কথা বলে নিয়েছে! সত্যিই নাতিটি হলে মুখ থাকত!

এই তো মুক্তকেশী বলে উঠলেন, তুমি আর সঙের মতন শাঁখ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে না। বড়বৌমা, তুলে রেখে দাও গে! চোঁচানির শব্দ শুনেই বুঝেছি আসছেন একখানি নিধি!

সুবৰ্ণ এত কথা শুনতে পায় না, সুবর্ণ যেন চৈতন্য আর অচৈতন্যের মধ্যবতীর্ণ একটা অবস্থায় নিমজ্জিত। সুবৰ্ণ যেন দেখতে পাচ্ছে সুবর্ণর মা এসেছে মাথার কাছে, বলছে, ছেলে-মেয়ে দুই-ই সমান সুবর্ণ, হেলা করিস না।

সুবৰ্ণ হাত বাড়িয়ে মাকে ধরতে যায়, পারে না। হাত তুলতে পারল না বলে, না মা হারিয়ে গেল বলে?

হারিয়ে গেল।

সুবৰ্ণ আর তার মায়ের সেই দীর্ঘ ছাদের উজ্জ্বল মূর্তিটা দেখতে পেল না। শুধু সুবর্ণর সমস্ত প্ৰাণটা হাহাকার করতে থাকে।

সুবৰ্ণ কি স্বপ্ন দেখছিল?

কিন্তু মাকে কি সুবর্ণ এত বেশি মনে করে? মার উপর একটা রুদ্ধ অভিমান যেন সেই স্মৃতির দরজা বন্ধ করে রেখেছে। সুবর্ণর যে এদের সংসার ছাড়াও একটা অতীত ছিল, ভুলে থাকতে চেয়েছে সে কথা।

হঠাৎ সেই অচৈতন্যলোক থেকে যেন জেগে উঠল সুবর্ণ।

আর ঠিক সেই মুহূর্তেই যেন ধাক্কা খেলো।

আবার?

আবার সেই কাহিনী?

সেই কথা আবার গঙ্গামণিকে বিশদ করে বলতে ইচ্ছে করছে মুক্তকেশীর—।

হ্যাঁ, মুক্তকেশীরই গলা!

শ্ৰোতা গঙ্গামণি।

অ আমার পোড়াকপাল, জানিস না তুই? ওলো শোন তবে, মেজবৌ হচ্ছে আমার সাইমার নাতনী; সেই যে সেবার জিজ্ঞেস করলি, বারুইপুরে যোচ্ছ কেন গা? বললাম, সাইমার বাড়ি। তা সেই রকম গিয়েছি, দেখি এই ধিঙ্গী অবতার মেয়ে ঠাকমার কাছে বসে সোহাগ খাচ্ছে। রূপখানা মন্দ নয়, বাড়ন্ত গড়ন-মিথ্যে বলব না, চোখে লাগল, মনে ধরে গেল। ভাবলাম পেবোর সঙ্গে দিব্যি মানায়। তা সেই কথা বলতে সাইমা কপালে হাত চাপড়ালো। বললো, বিয়ে? বিয়ে কে দিচ্ছে ওকে? ওর বিদ্যুবৃত্তীৰ্ষক বিদ্যে শেখাতে ইস্কুলে পড়াচ্ছে। আরও পড়াবে, পাশের পড়া পড়বে মেয়ে।

শুনে আমি হাঁ।

বলি, হ্যাগো তুমি শাউড়ী থাকতে—বেটার বৌয়ের কথাই জয়ী হবে?

সইমা বললো, না হয়ে উপায়! দেখিসনি তো আমার বৌটিকে! শুনে বুঝলি ঘেন্নায় যেন প্ৰাণ শতখান হল। খুব ধিক্কার দিলাম সইমাকে। তারপর পরামর্শ দিলাম, বৌকে না জানিয়ে নাতনীর বিয়ে দিয়ে ফেল। হয়ে গেল। তো আর ট্যা-ফোটি করতে পারবে না!

গঙ্গামণির কণ্ঠকাসর বেজে ওঠে, মা কোথায় ছিল?

ছিল? ছিল এই কলকাতায়। মেয়ে গরমের ছুটিতে আম খেতে গিয়েছিল বাপের সঙ্গে। আমি বলি, এই সুযোগ সইম! মেয়ের মাকে খবর দাও, হঠাৎ একটা সুপাত্তরের সন্ধান পাওয়া গেছে, হাতছাড়া করতে পারছি না, চলে এসো—মেয়ের বিয়ে আরম্ভ হচ্ছে। এই তো ব্যাপার, সরল সাদা ব্যবস্থা। আচ্ছা তুই বল গঙ্গা, কী এমন অনেয্য কাজটা হয়েছে?

কে বলছে অনেয্য?

কে? তা মিথ্যে বলব না, কেউ বলে নি। দশেধর্মে সবাই বললো ভাগ্যি বটে মেয়ের। যাচা পাত্তর এসে মেয়ে নিচ্ছে! অনেয্য বললেন আমার বেয়ানঠাকরুণ। তিনি কলকেতা থেকে এসেই যেন আকাশে পা তুললেন। এ বিয়ে আমি মানি না, এ বিয়ে ভেঙে দেব।

অ্যাঁ! গঙ্গামণি শিউরে ওঠে, বে ভেঙে দেব বললে?

বলল তো! মেয়ে-জামাইয়ের মুখ দেখল না, একটু আশীৰ্বাদ করল না, ভিটেয় পা দিল না, শুড়ীর সঙ্গে কথা কইল না, সোয়ামীকে ডেকে বলল, ভালো চাও তো মেয়ের বিয়ে ভাঙো, নইলে এই চললাম!

বেয়াই আমার খুব দৈ-দস্তর কলাল, শুনলাম হাতজোড়া পর্যন্ত করল, মাগী একেবারে বজ্জর! শুনল না কথা, ঠকঠক করে গিয়ে গাড়িতে চড়ে বসে বলে গেল, তুমি যেমন আমায় ঠকিয়েছ, আমিও তার শোধ নিচ্ছি। তোমার সংসারে আর নয়। ব্যস, সেই উপলক্ষ। ঘর-সংসার ত্যাগ দিয়ে তেজ করে চলে গেল কাশীতে বাপের কাছে। ব্যস, আর এল না।

এল না।

গঙ্গামণি যেন শুনে পাথর।

এল না কিগো সুবোধের মা, পাগল-ছাগল নয় তো?

পাগল! হুঁ, পাগল করতে পারে মানুষকে! ওই বৌ নিয়ে তো আজন্ম সাইমা জ্বলে পুড়ে মরেছে। কী তেজ আস্‌পদ্দা! তা যেমনি মা, তেমনি ছা। আমার এই ধনীও তো তেজ-আস্‌পদ্দায় কম যান না!

হ্যাঁগো, তা বাপের বাড়িতে আছে কে এখন?

আছে সবাই। বাপ ভাই ভাঁজ, কাছেপিঠে পিসিও আছে একটা। কিন্তু আমার আর কী ইষ্টলাভ হল! এই তো প্রেথমবার, কোথায় মা-বাপ কাছ নিয়ে যাবে, সাধ-নেমন্তন্ন দেবে, তা নয়। আমার বুকে বাশ ডলছে!

গঙ্গা বলে ওঠে, হ্যাগো, তা মা আর আসবে না?

কি জানি ভাই! তেজ কখনো করলাম না, তেজের আস্বাদ জানলামও না। এল না তো এই এত বচছরে!

মুক্তকেশী বলেন, ভগবান জানে, যার ধর্ম তার কাছে। তবে মনে হয় সেদিকে কিছু নয়, শুধু তেজ-আসূপদা। আমাকে না বলে আমার অনুমতি না নিয়ে আমার মেয়ের বিয়ে দিয়ে ফেলেছে, নেহি করেঙ্গা অমন সোয়ামীর ঘর। এই আর কি।

তাজ্জব! তা বাপু বৌদিদি, বেয়ান যখন তোমার সাইমার পুতবৌ, তখন জানতে তো তার ধাতধরন। স্বেচ্ছাসুখে তার মেয়ে আনলে কি বলে?

মুক্তকেশী কপালে হাত দিয়ে বলেন, অদেষ্ট!

অদেষ্ট!

সমস্ত নিরুপায়তার শেষ কথা!

আদি অন্তকাল সেই অদৃষ্ট নামক অ-দৃষ্ট ব্যক্তিটিকেই আসামী খাঁড়া করছে লোকে, সমস্ত কিছুর চরমকালে।

মুক্তকেশীও করলেন।

 ১.০৬ তিনটে বছর গায়েব করেও

তিনটে বছর গায়েব করেও বিরাজকে আর বারোর কোঠায় রাখা যাচ্ছিল না। দেখতে ছোটখাটো, বয়সের বাড়বাড়ন্ত নেই বলেই যে পাড়াপাড়শীর চোখে ধুলো দিয়ে চালানো যাবে, এ আশা একটু বেশি আশা।

সেদিন তো এক প্ৰিয়সঙ্গিনীর সঙ্গে বন্ধু-বিচ্ছেদই ঘটে গেল। মুক্তকেশী তার কাছে আক্ষেপ জানাচ্ছিলেন, ছেলেরা তো আপিস আর তাসপাশা নিয়েই মগ্ন, বোনটার বিয়ের কথা মনেও আনে না, আমারই হয়েছে জ্বালা। একটা পাত্তর-টাত্তরের সন্ধান দাও না ভাই, গলা দিয়ে ভাত নামছে না যে। বারো বছর পার হয় হয় মেয়ে-

হয়ে গেল উল্টো উৎপত্তি। বান্ধবী বলে বসলেন, এখনো বারো পার হয় হয়? মেয়ে কি তোমার উল্টো দিকে হাঁটছে সুবোধের মা? পাঁচ বছর আগে তো শুনেছি। রাজু দশে পা দিয়েছে—!

মুক্তকেশী প্রথমটা পাথর হয়ে গিয়েছিলেন, তারপরই অবশ্য নিজমূর্তি ধরলেন। বান্ধবীকে বাবার বিয়ে-খুড়োর নাচন দেখিয়ে দিয়ে বন্ধুত্বের মূলে কুঠারাঘাত করে চলে এলেন। কিন্তু মনের মধ্যে তো আগুনের দাহ।

আবার একদিন মুক্তকেশীর এক জ্ঞাতি ননদ বেড়াতে এসে বলে বসলেন, কোলের মেয়ে বলে বুঝি কাছছাড়া করবি না। নবৌ, মেয়েকে বীজ রাখবি? বলি রাজি যে পাড় হয়ে উঠল!

রসনার ধার সম্পর্কে মহিলাটির খ্যাতি আছে। মুক্তকেশীকে তিনি হেলায় জয় করতে পারবেন এ কথা মুক্তকেশীর অজানা নয়। তাই এক্ষেত্রে মুক্তকেশী অন্য পথ ধরলেন। অভিমানের গলায় বললেন, তা তোমরা পিসিরা থাকতে যদি মেয়ের বিয়ে না হয়, আমি আর কি করবো ঠাকুরঝি? চোদ্দপুরুষ নরকস্থ হলে তোমার গিয়ে বাপ-ঠাকুর্দার বংশই হবে, আমার নয়। তোমরাই বোঝ।

অতএব কলহ এগোল না, ননদ মুক্তকেশীর ছেলেদের নিন্দাবাদ করে বিদায় নিলেন।

কিন্তু তারপর ঝড় উঠল। অবিচ্ছিন্ন ঝড়।

মুক্তকেশীর সংসারে সেই ঝড়ের ধাক্কায় তোলপাড় হতে থাকলো। বিরাজ তো মার সামনে বেরোনোই ছেড়ে দিল, কারণ তাকে মাঝে রেখেই তো মার যত বাক্যি-বুলি!

প্ৰবোধ-সুবোধও মার সর্ববিধ কটুক্তি নীরবে গলাধঃকরণ করে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাচ্ছে, উমাশশী সর্বদাই তটস্থ, এমন কি মুখরা সুবৰ্ণও মার মনপ্ৰাণ ভাল নেই ভেবে চুপচাপ আছে।

এহেন পরিস্থিতিতে সহসা আগুনে জল পড়ল। বড় মেয়ে সুশীলা এসে হাজির এক সম্বন্ধ নিয়ে। বিদ্বান ছেলে, রূপে কাৰ্তিক, অবস্থা ভাল, তারা এই সালেই বিয়ে দিতে চায়, কারণ সামনে অকাল পড়ছে। তবে হ্যাঁ, একটু খাই আছে। ফুলশয্যার তত্ত্ব, দানসামগ্ৰী, বরাভরণ, নমস্কারী, ননদঝাঁপি, কনের গা-সাজানো গহনা ইত্যাদি সর্ববিধ সৌষ্ঠবের ওপর আবার তিনশো টাকা নগদ।

নগদের সংখ্যাটা শুনেই আঁতকে উঠলেন মুক্তকেশী।

তিন-তিনশো টাকা নগদ বার করা কি সোজা?

ঘরখরচা, বরযাত্রী-কনেযাত্রী খাওয়ানো, এসবও তো আছে?

মেয়ের ওপর বিরূপ হলেন মুক্তকেশী। বেজায় গলায় বললেন, খুব যা হোক সম্বন্ধ আনলি! তোর ভাইদের বুঝি রাজা-রাজড়া ভেবেছিস? এখনো বলে বাড়ির দেনাই শোধ হয় নি!

সুশীলা এর জন্য প্ৰস্তৃত ছিল।

সুশীলার ভাঁড়ারে তাই যুক্তি মজুত ছিল।

ধার-দেনা আবার কোন গোরস্তটাকে করতে না হয়? কন্যেদায় উদ্ধার করতে ধার-দেনা করা তো চিরাচরিত বিধি। এমন সোনার পাত্ৰ হাতছাড়া করলে, এরপর মাটির পাত্রে মেয়ে সপতে হবে। আর তার মানেই চিরটাকাল মেয়েকে টানা।

এই যে তিন তিনটে মেয়েকে পার করেছেন মুক্তকেশী, ভাল ঘরে বরে দিয়েছেন বলেই না। নিশ্চিন্দি আছেন—ইত্যাদি ইত্যাদি বহুবিধ যুক্তির জালে বন্দী করতে চায় সুশীলা মাকে।

তা মুক্তকেশীরই কি আর মন ঝোঁকে না সোনার পাত্রের দিকে? তবু আরও বোজার গলায় বলেন, বুলে দেখে ড়োমার ভাইদের। আমার কোঁচড়ে তো আর টাকার কঁড়ি জুমানো নেই, যে বুকের পাটা করে হ্যা করবো? মেয়ে তো তালগাছ হয়ে উঠছে, দেখি আর ক্যাপি!

তা ভাইদের বলে দেখে সুশীলা।

বুদ্ধিমতী মেয়ে বেশ মোক্ষম সময়েই কথাটা পাড়ে। চার ভাই যখন সারি দিয়ে খেতে বসেছ বড় বড় কাঠালিকাঠের পিঁড়ি পেতে, সামনে মা বসেছেন। পাখা হাতে করে, বৌমা ধারে কাছে ঘুরছে। নুনটুকু লাগবে কি না জানতে, তখন মায়ের হাত থেকে পাখ্যাখানা নিয়ে নাড়তে নাড়তে সুশীলা বলে ওঠে, হ্যাঁ রে, তা রাজুর বিয়ের কী করছিস তোরা?

যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। সে প্রসঙ্গের ধুয়ো তুলে ঢালে খাঁড়ায় হয়ে আছেন মুক্তকেশী, দিদির মুখেও কি না সেই প্রসঙ্গ!

সন্দেহ কি যে মারই শিক্ষা!

কিন্তু সে সন্দেহ তো ব্যক্ত করা যায় না। সুবোধ থালায় আঁক কাটতে কাটতে বলে, খুঁজছি। তো। তেমন মনের মতন পাচ্ছি। কাই! যা তা ধরে তো আর-

আহা-হা, তাই বা দিবি কেন? ভাল পাত্তর আমার হাতে আছে। তবে খাই একটু বেশি।

হ্যাঁ, একঝোঁকে বলে ফেলাই ভাল। বিরুক্তি বা বাদ প্রতিবাদের পথ থাকে না।

শব্দটা কী ভয়াবহ!

যেন হাঁ করে খেতে আসছে।

সুবোধের মুখ শুকিয়ে যায়, খাঁই মানে? কত খাঁই?

কত সেকথা শুনে সুবোধের মুখ আরো শুকোয়। গলা ঝাড়া বলে, অত খাঁই হলে— মানে, আমাদের তো এখন হাতে কিছু নেই—

বোনের বিয়ে তাহলে শিকেয় তোলা থাক—, মুক্তকেশী ঠাণ্ডা পাথুরে গলায় বলেন, হাতে যখন টাকা নেই তোমাদের, বলবার কিছু নেই। তবে শাস্তরে ভগ্নীদায় আর কন্যাদায়কে সমানই বলেছে।

কোন শাস্তরে বলেছে। এ কথা, সে প্রশ্ন তোলে না মুক্তকেশীর ছেলেরা। এ কথাও তোলে না, না বুঝে সুঝে বুড়ো বয়স অবধি সংসার বাড়াতে তোমায় বলেছিল কে বাপু? তোমার নির্বুদ্ধিতার দায় আমাদের পোহাতে হবে এমন কি বাধ্যবাধকতা?

না, তোলে না। এসব কথা, শুধু অক্ষুটে বলে, না, মানে গহনাটাও গা সাজানো চাইছে কিনা। এদিককারও সব আছে, তার ওপরে নগদ-

হঠাৎ রান্নাঘরে শেকলটা নড়ে ওঠে।

সাঙ্কেতিক ঘণ্টা!

সুশীলাই পাখ্যাখানা নামিয়ে উঠে যায়, আর পরীক্ষণেই হাস্যবিদনে এসে বলে, ওই শোনো, হয়ে গেল সমিস্যের সমাধান! মেজ বৌ বলছে, গহনার জন্যে ভাবতে হবে না তোমাদের!

ভাবতে হবে না!

চার ভাই-ই একটু সচকিত হয়। যেন ঠিক অনুধাবন করতে পারে না। কিন্তু মুক্তকেশী পারেন, সঙ্গে সঙ্গে একগাল হেসে বলে ওঠেন, বুঝেছি। নির্বুদ্ধির ঢেঁকি নিজের গয়নাগুলো খয়রাৎ করবে। বোকা হবো হলে কি হয়, মনটা ওর বরাবরই উঁচু।

এই সেদিনই ভিখিরিকে একখানা পুরনো কাপড় দিয়ে ফেলার অপরাধে যে ওই বৌয়ের দরাজ মেজাজের খোঁটা তুলে, নাকের জলে চোখের জলে করেছিলেন তাকে, তা অবশ্য মনে পড়ে না।

মেজ বৌয়ের উঁচু মনের পরিচয়ে ছোট দুই ভাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাতের চুড়োয় গর্ত করে ডাল ঢেলে সাপটিাতে থাকে, বড় ভাই মাথাটা নিচু করে ভাতটা নাড়াচাড়া করতে থাকে এবং মেজ ভাই প্ৰচণ্ড রাগকে সংহত করতে বড় বড় গ্রাস তুলতে থাকে মুখের মধ্যে তার ওপর।

অসহ্য!

অসহ্য এই সর্দারী!

স্বামীর অনুমতি নেওয়া দূরে থাক, স্বামীর সঙ্গে একবার পরামর্শ করে নেবারও দরকার বোধ করল না! ভেবেছে কি ও?

প্ৰশংসা কুড়োবেন?

প্ৰশংসা কুড়িয়ে পেট ভরবে?

ঐদিকে তো আচার-আচরণের দোষে নিন্দেয় গগন ফাটিছে! কই তার বেলায় তো ইচ্ছে হয় না, বড় বৌয়ের মতন শান্তশিষ্ট হয়ে সুখ্যাতি কিনি!

ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবেন!

চাদির ছুঁচ দিয়ে লোকের মুখ সেলাই করে দেবেন!

রাগে হাত-পা কাঁপতে থাকে প্ৰবোধের। সুশীলার অবশ্য এ ভাবান্তর চোখ এড়ায় না, তবে সুশীলা সে কথা তুলে আর ব্যাপারটাকে উদঘাটন করতে চায় না। তাড়াতাড়ি ভাইদের পাতের কাছে দুধের বাটিগুলো এগিয়ে দিয়ে গুড়ের বাটিটা নিয়ে আসে।

প্ৰবোধ একটা সুযোগ পায়, প্ৰবোধ এই ছুতোয় মনের উত্তাপ প্রকাশ করে বসে। দুধের বাটিটা বঁ হাতে ঠেলে দিয়ে বলে, লাগবে না, সরিয়ে নাও।

ওমা সে কী, কেন? পেট ভাল নেই?

পেট খারাপ শত্রুর হোক- প্ৰবোধ থমথমে গলায় বলে, এসব বাবুয়ানা ছাড়তে হবে এবার!

সুশীলা বুঝেও না বোঝার ভান করে, ফিকে গলায় বলে, হঠাৎ বাবুয়ানা কি দোষ করল!

প্ৰবোধ গুজগুঁজে গলায় বলে, যাদের এক পয়সার সংস্থান নেই, এক কথায় মেয়েদের গায়ের গহনায় হাত পড়ে, তাদের এমন দুধ ক্ষীর খাওয়া মানায় না।

বলে ফেলেই অবশ্য ঘাড়টা গুঁজে যায় প্ৰবোধের, কারণ ঠিক এমন স্পষ্টাস্পষ্টি কিছু বলে ফেলার ইচ্ছে তার ছিল না, চোরা গোপ্তা একটু ইশারা দিতে চেয়েছিল, হল না।

মায়ের পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় বুকটা হিম হয়ে গেল তার। এরপর আর কি ও গহনা ছোঁবেন মুক্তকেশী?

কিন্তু মুক্তকেশী কি সুবৰ্ণলতা?

তাই অভিমানভারে সুবিধে-সুযোগ পণ্ড করবেন? না, সুবৰ্ণলতার মত বোকা নয় মুক্তকেশী। মুক্তকেশী। তাই তেতো গলায় বলে ওঠেন, তা ওই দুধ টুকু সরালেই সব সমিস্যের মীমাংসা হবে? না ওই বাঁচানো দুধ টুকু পুনরায় গরুর বাঁটে উঠে গিয়ে আবার পয়সা ফিরিয়ে আনবে? বাড়িতে কন্যেদায় উপস্থিত হলে, ঝি-বৌয়ের গহনায় হাত পড়ে না। এমন রাজার সংসার কাটা দেখেছিস তুই? মেজ বৌমা নিজে মুখ ফুটে বলেছে, সেইটুকুই আহ্লাদের, নইলে দরকারের সময় ছলে বলে কৌশলে নিতেই তো হতো! দিতে চেয়ে খুব একটা মহত্তর কিছু করে নি মেজ বৌমা। বড় বৌমারও থাকলে দিত।

অর্থাৎ প্ৰবোধের ঠেস দেওয়া কথার ফল হলো এই। সুবৰ্ণলতার মহত্ত্ব, উদারতা সব কিছুই এখন তৃতীয় বিভাগে পড়ে গেল, সুবৰ্ণলতার উঁচু  মনের পরিচয়টা ধামাচাপা পড়ে গেল, সুবৰ্ণলতার সুখ্যাতিটা মাঠে মারা গেল।

মুক্তকেশী অতঃপর বসে বসে ফিরিস্তি দিতে লাগলেন এহেন ঘটনা আর কবে কোথায় দেখেছেন এবং কী রকম সোনাহেন মুখ করে সেই সব বৌরা গা থেকে গহনা খুলে দিয়েছে ননদের বিয়েতে, ভাশুরবির বিয়েতে।

তবে?

সবৰ্ণলতা কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করে নি সুবৰ্ণলতা এত কিছু বাহাদুরি দেখায় নি। সুবৰ্ণলতার মনটাকে যে উঁচু  মন বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন মুক্তকেশী, সে কেবল মুক্তকেশীর নিজের মন উঁচু  বলে।

কিন্তু সুবৰ্ণলতার সেই মনের স্বীকৃতি কি রইল? বিরাজের গায়ে-হলুদের দিন যখন মুক্তকেশী মেজ বৌমার গহনার বাক্সটি তোরঙ্গ থেকে বার করলেন মেয়েকে সালঙ্কারা করবার জন্যে, তখন কি দর্জিপাড়ার ওই বাড়িটায় একটা বজ্রাপাত ঘটে গেল না?

দোয়াত আছে, কালি নেই।

বাক্স আছে, গহনা নেই।

মুক্তকেশীর ঘরে তোরঙ্গ, মুক্তকেশীর কোমরের ঘুনসীতে চাবি, অথচ মুক্তকেশীর অজানতে সে গহনা হাওয়া!

এ হেন ঘটনায় বিয়েবাড়িতে যতদূর হুলস্থূল হবার তো হয়েছিল বৈকি। বেশি বৈ কম হয় নি, কারণ বিয়েতে মুক্তকেশীর তিন বিবাহিতা মেয়ে এসেছে সপরিবারে, এসেছেন মুক্তকেশীর ভাজ, বোন, মাসতুতো বোন হেমাঙ্গিনী।

সকলে গালে হাত দিয়ে থ!

ভূত না চোর!

চোর যদি তো বাক্সটাসুদ্ধই নেবে, বাক্স খুলে আংটি মাকড়ি মল ইত্যাদি কুচকানো গহনা রেখে দিয়ে, বালা বাজুবন্ধ, চিক, সীতাহার, শাঁখা অনন্ত, পালিশ পাতের চুড়ি ইত্যাদি করে বড় বড় গহনাগুলি বেছে নিয়ে যাবে? এত সময় হবে চোরের?

তা হলে! হুঁ!

রাত-বিরেতে সিঁড়ির ছায়ায় কি উঠোনের ছাঁচতলায় ভূতের দেখা মেলে বলেই যে লোকে গহনা-চোর ভূতে বিশ্বাসী হবে এমন হয় না।

শেষ অবধি। তবে ঘরের মানুষ!

কে সেই মানুষটি?

কোন ঘরের?

মুখ মুখে কথা ফেরে, কথা কানে ইটে। অনেক কান ঘুরে সুবৰ্ণলতার কানে এসে পৌঁছয় উত্তরটা।

আর কে?

যার জিনিস সে।

হ্যাঁ, সে নিজেই। তা ছাড়া আর কি! সুখ্যাতি কিনতে লোক দেখিয়ে দানপত্তরে সই করে বসে হাত-পা কামড়ে মরছিল, অতএব তলে তলে পাচার। বাপের বাড়ি যাওয়া-আসা নেই! তাতে কি, এ বাড়িরই আনাচেকানাচে কোথাও সরিয়ে রেখেছে, পরে তাক বুঝে ব্যবস্থা করবে। দিয়ে ফেললে তো হাতছাড়া গোত্তরছাড়া!

সরিয়েছে কখন?

মৃত্যুর আবার ভাবনা কি, গঙ্গায়ানে যান না মুক্তকেশী। তাসের আড্ডায়?

চাবি?

সে অমন পাঁচটা চাবি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুলে ফেলা যায়। ভাঁড়ারের বাসনের সিন্দুকের মরচেধরা তালাটা খুলে দেয় নি সেদিন সুবৰ্ণলতা?

খুলে দিয়ে বাহাদুরী নেয় নি?

পান সাজিছিল সুবৰ্ণলতা, কাছে এসে কানে ঢেলে দিল। একজন কথাটা।

সুবৰ্ণলতা দাঁড়িয়ে উঠল।

বলল, কি বললে?

ও বাবা, এ যে নাগিনীর মত ফোঁস কর ওঠে গো! আমি বলি নি বাবা, বলেছে তোমারই শাশুড়ী।

কোথায় তিনি?

আরক্ত মুখ আগুনের মত গানগনিয়ে ওঠে, সামনে এসে মুখোমুখি বলবার সাহস হল না বুঝি?

জানি না। বাবা, তোমাদের কথা তোমরা জানো বলে জ্ঞাতি ননন্দ পালায়। ভেবেছিল কথাটা নিয়ে জ্ঞাতি জেঠির একটু নিন্দেবাদ করবে, ব্যাপার দেখে থেমে গেল, সরে পড়ল।

কিন্তু সুবৰ্ণলতা কি থেমে থাকবে?

সুবৰ্ণলতা কি তার মা সত্যবতীর রক্তে-মাংসে তৈরি নয়? যে সত্যবতী কখনো মিথ্যার সঙ্গে আপোস করে চলতে পারে নি, কখনো অন্যায় দেখে চুপ করে থাকে নি?

সুবৰ্ণলতা সেই একবাড়ি লোকের সামনে মুক্তকেশীর মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। বলল, গহনা হারানোর কথায় কী বলেছেন??

মুক্তকেশী তাঁর মেজবৌমার অনেক মূর্তি দেখেছেন, কিন্তু ঠিক এ মূর্তিটি বোধ হয় দেখেন নি, তাই ফিসে গলায় বলেন, কী আবার বলবো?

বলেন নি, আমি সরিয়ে ফেলেছি?

মুক্তকেশী গালে হাত দেন, ওমা শোনো কথা! তোমার জিনিস, তুমি বলে কত আহ্লাদ করে ছোট ননদকে দেবে বললে, তোমায় ও কথা বলতে যাব কেন? ছিছি, আমি পাগল না। ভূত!

নিজের অভিনয়-ক্ষমতায় নিজেই প্রীত হন মুক্তকেশী।

সুবৰ্ণলতা এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলে, তবে যে রঞ্জা ঠাকুরঝি বলল?

মুক্তকেশী কথাটা লুফে নেন।

উদাস গলায় বলেন, তা তো বলবেই, জ্ঞাতি শতুর যে! জ্ঞাতির মুখেই এমন কথা শোভা পায়!

তবে আপনি কাকে সন্দেহ কর্চ্ছেন?

সন্দেহ আর কাকে করবো বাছা, করি আমার আদেষ্টকে! গহনার জন্যে এখন শ্বশুরবাড়িতে কত খোয়ার হয় দেখা মেয়েটার!

হবে বললেই তো হয় না— সুবৰ্ণলতা তীব্ৰস্বরে বলে, বার করতে হবে গহনা!

ওমা, বার করবো কোথা থেকে? হদিস জানি?

মুক্তকেশী হদিস জানেন না, কিন্তু মুক্তকেশীর বৌ সে হদিস বার করে ছাড়বে! মুক্তকেশীর ঘোমটা দেওয়া বৌ ঘোমটা মুখে সকলের সামনে মুখ তুলে চেঁচিয়ে ওঠে, আপনার ছেলে কই, মেজ ছেলে?

ওমা কী সর্বনেশে কথা, তাকে কী দরকার?

আছে দরকার।

তা এই একবাড়ি লোকের সামনে ডেকে কথা কইবে নাকি তুমি তার সঙ্গে?

কইব। কইতেই হবে। খুদু ডেকে আনো তো তোমাদের মেজদাদাবাবুকে।

চটি জুতোর শব্দ করতে করতে বাইরের ঘর থেকে ভিতরে এল প্ৰবোধ। অলস আদুরে গলায় শুধোলো, মা, ডেকেছ কেন গো?

মা নয়, আমি!

দর্জিপাড়ার গলির ওই বাড়িটায়। আর একটা বাজ পড়ল।

বুঝিবা এ কাজটা আরো ভয়ঙ্কর, আরো সাংঘাতিক।

মুক্তকেশীর পাশ কাটিয়ে, মুক্তকেশীর সামনে, একবাড়ি লোকের সামনে মুখের ঘোমটা কমিয়ে বরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বৌ তীব্ৰ গলায় উচ্চারণ করল, মা নয়, আমি!

প্ৰবোধের মুখটা হঠাৎ অমন পাংশু হয়ে গেল কেন? প্ৰবোধ হুঙ্কার দিয়ে বৌকে থামিয়ে দিতে পারল না কেন? আমন বোকার মত শিথিল গলায় প্রশ্ন করল কেন, তার মানে?

সুবৰ্ণলতা কি সত্যই পাগল হয়ে গেছে? সুবৰ্ণলতা কি ভুলে গেছে সে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, কাদের সামনে? তা নইলে কি করে সুবৰ্ণলতা তেমনি স্বরেই বলতে পারে, মানে বুঝতে খুব কষ্ট হচ্ছে? গহনাগুলো কোথায় সরিয়েছ?

গহনা? আমি? কিসের গহনা? মানে—ইয়ে সেই গহনা? আমি কি জানি? বাঃ!

প্ৰবোধের জিভ তোৎলার অভিনয় শুরু করে।

কিন্তু মুক্তকেশী কি দাঁড়িয়ে ছেলের এই অপমান সহ্য করবেন?

তা তো আর হয় না।

মুক্তকেশী কনুইয়ের ধাক্কায় বৌকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলেন, বাড়তে বাড়তে একেবারে যে আকাশে পা তুলছে মেজবৌমা। কাকে কি বলছো জ্ঞান নেই?

আছে। জ্ঞান ঠিকই আছে।–ধাক্কা খেয়েও নিবৃত্ত হয় না সুবৰ্ণলতা। বলে, খুব তো মাতৃভক্ত ছেলে আপনার, মায়ের পা ছুঁয়ে দিব্যি গালুক না, ও জানে কি না গহনা কোথায় আছে!

বেশ তাই করছি—, প্ৰবোধ মায়ের পা থেকে হাত চারের দূরে দাঁড়িয়ে হাত-পা ছেড়ে, পা ছয়েই দিব্যি গালছি। ডরাই নাকি? ঐ্যা, এত বড় আস্পর্ধার কথা! আমি চোর, আমি গহনা চুরি করেছি!

চুরি করবে। কেন, সাবধান করেছ-, সুবৰ্ণলতা আরো তীক্ষ্ণ গলায় বলে, পাছে পরের ঘরে দামী জিনিসগুলো চলে যায়। তাই বাধা দিয়েছ। তোমায় চিনি না। আমি? দেব বলেছি বলে যাচ্ছেতাই কর নি তুমি আমায়? ধরে ঠেঙাও নি?

হ্যাঁ, এই চরমতম অপমানের কথা ব্যক্ত করে বসলো সুবৰ্ণলতা। পাছে লোক-জানাজানি হয়ে যায় বলে মার খেয়ে যে টু শব্দটি করে না, তার এই বলে বসাটা আশ্চর্য বৈকি!

এমনই ধৈৰ্যচ্যুতি ঘটলো সুবৰ্ণলতার যে, তার জীবনের এই লজ্জাকর গোপনীয় খবরটা এমন করে উদঘাটিত করে বসলো!

 

তা সুবৰ্ণলতার চরিত্রে হয়তো ওইটাই ছিল পরমতম ত্রুটি। সুবৰ্ণলতা যখন-তখনই ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করে বসতো। সেই অতিক্রম করে বসায় যে নিজেই সে হাস্যাম্পদ হতো, হেয় হতো, সমালোচনার বিষয়বস্তু হতো, তা মনে রাখতে পারত না! সুবৰ্ণলতা যে তার ননদের গায়ে-হলুদের দিন গলায় আঁচল পাকিয়ে মরতে গিয়ে একটা কীর্তি করে বসেছিল, এতে কেউ সুবৰ্ণলতাকে মমতা করেছিল? না কি প্ৰবোধকে নিন্দে দিয়ে সত্যপথে স্থির তার বৌকে বাহবা দিয়েছিল?

মোটেই না। সুবৰ্ণলতাকে শুধু ছি-ছিক্কার করেছে। সবাই। কারণ সুবৰ্ণলতার জন্যে ডাক্তার ডাকতে হয়েছিল সেদিন।

কী লজা! কী লজা!

মুক্তকেশীই কেন গলায় দড়ি দেন নি সেদিন, এই আশ্চর্য!

আচ্ছা বিরাজের বিয়েটা কি তবে বন্ধ হয়ে গেল?

ইস! পাগল নাকি?

মেয়ের বিয়ে বন্ধ হয়?

মা মরলে তাকে ঘরে শেকল তুলে রেখে দিয়ে লোকে কন্যাসম্প্রদানটা করে নেয়! এ তো তুচ্ছ একটা বৌ বাড়ির!

তা ছাড়া মরেও নি তো!

শুধু কেলেঙ্কারী করেছিল!

একবেলা শুয়ে পড়ে থেকেই তো সেরে গেল তার দুর্বলতা। আবার তো পরদিন উঠে কাজ-কর্ম করতে লাগলো বিয়েবাড়িতে। সবাইয়ের সঙ্গে খেতে বসতেও দেখা গেল মাছ লুচি নিয়ে। শুধু একটু বেশী শান্ত, একটু বেশী স্তব্ধ।

কিন্তু লজ্জিত কি?

আশ্চর্য, লজ্জিত হতে দেখা যায় নি কখনো সুবৰ্ণলতাকে! অথচ জীবনে কম কেলেঙ্কারী তো করে নি। সে! বারে বারে করেছে, যখন—তখন।

বিরাজের বিয়ে হয়ে গেল তা হলে? তবে বুঝি নিরলঙ্কার দেহে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে দাঁড়াতে অনেক গঞ্জনা খেতে হয়েছিল বেচারাকে?

না না, গহনাগুলো যে পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত!

অদ্ভুত এক পরিস্থিতিতে পাওয়া গেল। মুক্তকেশীর সেই তেরঙ্গের মধ্যেই পড়ে গিয়েছিল কাপড়াচোপরের খাজে।

হয়তো গহনার বাক্সটায় চাবি দেওয়া হয় নি! হয়তো অসাবধানে কোনো সময় উপুড় হয়ে পড়ে গিয়েছিল বাক্সটা।

ঠিক ঠিক সবই পাওয়া গেল।

স্বাস্থ্যবতী সুবৰ্ণলতার দরুণ গায়ে বড় জরির কলকা বসানো মখমলের জামা আর বেগুনী ড়ুরে ভারী জরিদার বেনারসী পরে, সর্বাঙ্গে ঢলঢলে গহনা ঝলমলিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেল বিরাজ, চোখের জলে ভাসতে ভাসতে।

যাবার আগে গোপনে সুবৰ্ণলতার হাত ধরে কেঁদে বলেছিল, এতদিন তোমায় চিনতে পারি নি মেজবৌ, কত লাঞ্ছনার কারণ হয়েছি! তুমি দেবী।

সুবৰ্ণর চোখেও জল ছিল বৈকি। চোখে জল আর মুখ হাসি নিয়ে বলেছিল, যাক, একজন তবু চিনলে আমায়! তবু মনে জানবো ভূ-ভারতে এসে একটু সার্থক হলাম। তা মনে কি আর রাখবে মেজবৌকে? যা সোন্দর বর হল! পৃথিবীই ভুলে যাবে!

১.০৭ মুক্তকেশীর ছোট দুই ছেলে

মুক্তকেশীর ছোট দুই ছেলে যে রোজগারী হয়ে উঠেছে তা নয়, প্রভাস তো এখনো পড়ুয়া ছেলে, ল পড়ছে, আর প্রকাশ পাড়ার সখের থিয়েটারে হিরোইনের। পাকা পোস্টটা পেয়ে সুখে মহলা দিচ্ছে।

তবু মেয়ের বিয়ের পর ছেলেদের বিয়ের চিন্তায় আর বিলম্ব করলেন না মুক্তকেশী। মেয়ের বিয়ের জন্যই আটকে ছিলেন এযাবৎ। আর থাকেন? দুই ছেলের বিয়ের জন্যেই তোড়জোড় লাগান।

খবরটা শুনে উমাশশীর কাছে সেই কথাটা বলে বসলো সুবৰ্ণলতা। যে কথার জন্যে খণ্ডপ্ৰলয় ঘটে গেল।

তা সুবৰ্ণলতার জীবনটা নিরীক্ষণ করে দেখলে আগাগোড়াই তো শুধু ওই খণ্ডপ্রলয়। সুবৰ্ণলতা একটা কিছু বেফাঁস কথা বলে বসে, আর সংসারে। তুমুল কাণ্ড ঘটে।

মনে হয় এবার বুঝি একটা কিছু করে বসবে সুবৰ্ণলতা! কিন্তু নাঃ, আবার দেখা যায় সুবৰ্ণলতার তার দীর্ঘ সুন্দর দেহটা নিয়ে সংসারে চরে বেড়াচ্ছে, কাজ করছে, কর্তব্য করছে।

বোঝা যায় না। সুবৰ্ণলতা এই সেদিন গভীর রাতে বিনিদ্র চোখে মৃত্যুর যত রকম উপায় আছে তা নিয়ে ভেবেছে। বোঝা যায় না। সব সময় মরতে ইচ্ছে হয় ওর। কিন্তু কেন?

চিত্ৰগুপ্ত বুঝতে পারে নি, বুঝতে পারে নি। সুবৰ্ণলতার বিধাতাপুরুষ। হয়তো বা সুবৰ্ণলতা নিজেও পারে না।

বুঝতে পারে না নিজেই সে সোধে দুঃখু ডেকে আনে। নইলে কী দরকার ছিল সুবর্ণর বড় জায়ের কাছে শাশুড়ীর বুদ্ধির ব্যাখ্যা করবার? বলে বসবার দরকারটা কী ছিল, মার যেমন বুদ্ধি! ছোট ঠাকুরপোর আবার বিয়ে! গোপ কামিয়ে কামিয়ে মেয়ে সেজে সেজেই যার জীবন যাচ্ছে! দিতে হয় তো একটা বেটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া উচিত ওর!

বলা বাহুল্য, কথাটা চাউর হতে দেরি হল না। তিন বছরে টেপু। মহোৎসাহে বলে বেড়াতে লাগল, মেজ খুড়িমা বলেছে, ছোট কাকা তো মেয়েমানুষ, বেটাছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে ছোটকাকার!

বলা বাহুল্য, প্ৰলয় ঘটতেও দেরি হয় নি।

গোঁফ-কামানো মেয়েলী-গলা প্ৰকাশচন্দ্ৰ বীর্য-বিক্রমে লাফাইঝাঁপাই করতে থাকে মেয়েমানুষের আস্পর্ধার বিরুদ্ধে। বিদ্বান বিচক্ষণ প্রভাস চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে থাকে, উদ্দেশ্য আলাদা। আরও বৌ আসে বাড়িতে এটা ইচ্ছে নয়। নিজের যথেচ্ছাচারটা চলবে না ভেবে বাধ দিচ্ছেন। মনে হয়, মেজদার উচিত ওঁকে নিয়ে আলাদা বাস করা। নচেৎ ওঁর দৃষ্টান্তে নতুন যে বৌরা আসবে, তাদেরও মাথা বেঠিক হয়ে যাবে।

শুধু সুবোধই কথাটা শুনে হা হা করে হেসে উঠেছিল, বাড়ির মধ্যে মেজবৌমারই দেখছি একটু বুদ্ধিসুদ্ধি আছে। মা যে পেকার জন্যেও এক্ষুণি কনে খুঁজছেন, আমি তো ভাবতেই পারি নি!

তা সুবোধের অবশ্য সাতখুন মাপ। কারণ প্ৰবোধ আজকাল প্রচুর কাঁচা পয়সা রোজগার করলেও, এখনো গৃহকর্তা হিসেবে সমগ্র সংসারের ভাত-কাপড়ের দায়টা সুবোধই টেনে চলেছে। নিজের সারি সারি ছেলেমেয়েতে ঘর ভরে উঠলেও এদিকে কার্পণ্য করে না সে।

ভগবানও মুখ তুলেছেন, বড়বাবু হয়েছে সে।

তবে বাড়িতে মুক্তকেশীই বড়বাবুর বড়সাহেব সব। সুবোধের কথা ধর্তব্য করলেন না, ছেলেদের বিয়ে তিনি দিলেন। নগদ নিলেন, তত্ত্ব ঘরে তুললেন, এক কুটুমের নিন্দেয় শতমুখ এবং আর এক কুটুমের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন।

ওটাই মুক্তকেশীর রাজনীতি।

প্রথম থেকেই বিভেদ সৃষ্টি করে রাখা ভাল। নইলে জায়ে জায়ে একদল হলে পৃষ্ঠবল বাড়বে না! শাশুড়ীকে কি তাহলে গ্রাহ্য করবে?

তা মুক্তকেশীর নীতি কার্যকরী হয় বৈকি। নতুন বৌয়েরা আসার পর থেকেই সংসারের বায়ূমণ্ডলে উত্তাপের সঞ্চার হতে দেখা যায়। মুক্তকেশী সেই উত্তাপের সুযোগে একজনকে সুয়ো করে নেবার চেষ্টা করেন।

উকিল ছেলের বৌ-ই। ইদানীং সুয়ো হয়েছে। তাকে তোয়াজ করে চলেছেন মুক্তকেশী প্ৰায় নির্লজের মত।

কারণ?

কারণ পায়ের তলায় একটু শক্ত মাটির আশ্রয় খুঁজছেন মুক্তকেশী, যে মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়তে পারেন।

প্ৰতিপক্ষ?

আর কে?

দুৰ্দান্ত দুবিনীত মেজবৌ।

তার চোখের কোণে যেন চাপা আগুনের গানগনানি, তার ঠোঁটের কোণায় যেন ঔদ্ধত্যের ঝিলিক।

মুক্তকেশীর কাজে প্রতিবাদ করে বসে সে যখন-তখন।

তার উপর আবার বরটা তার উপায়ী হয়ে উঠেছে উত্তরোত্তর।

ওকে দাবাতে হলে শক্ত মাটিতে পা রাখতে হয়। অলিখিত আইনে সব ভাইরাই উকিল ভাইকে নিজেদের থেকে উচ্চাসনে বসিয়ে সমীহর চোখে দেখে আসছে, কাজেই সেই খুঁটিটাই ধরা ভাল।

মুক্তকেশী। তাই রাতদিন সেজবৌ গিরিবালার শরীর কাহিল দেখেন, আর খেটে খেটে আধমরা হতে দেখেন তাকে। আর তার গুণের তুলনা দেখতে পান না। সে যে বড়মানুষের মেয়ে হয়েও দেমাকী নয়, এটাই কি সোজা পাওয়া নাকি?

প্রকাশের বৌ বিন্দু বড়মানুযের মেয়ে নয়, নিতান্তই নিরুপায়ের ঘরের মেয়ে। মুক্তকেশী রাতদিন তাকে তার সেজ জার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে বলেন।

মুক্তকেশীর এই রাজনীতির লীলার উপর দিয়ে বয়ে চলেছে দিন, বিয়ে চলেছে প্রকৃতির লীলা। মেয়েতে বৌতে মিলে কোন না বছরের বারতিনেক আঁতুড়ের ঘটনা ঘটাচ্ছে!

সুবৰ্ণলতা?

তা সুবৰ্ণলতাও সে দলে আছে বৈকি। প্রকৃতি তো ছেড়ে কথা কইবার মেয়ে নয়। আর প্ৰবোধচন্দ্রও কিছু আর ছেড়ে কথা কইবার ছেলে নয়।

যে স্ত্রীলোক অতুিড়ে যেতে ভয় পায়, সে স্ত্রীলোককে অসতী ছাড়া আর কিছু বলতে রাজী নয় প্ৰবোধ। মা হতে অরাজী? তার মানে রূপ-যৌবন ঝরে যাবার ভয়? তার মানে পরপুরুষ আর ফিরে চাইবে না। এই আশঙ্কা, এই তো? বুঝি সব। ওসব বিবিয়ানা রাখা!

বিবিয়ানা রাখতে হয়। অতএব।

কত আর বুঝবে সুবৰ্ণলতা?

কত খণ্ড প্ৰলয় ঘটবে?

কত কেলেঙ্কারী করবে?

বাড়িতে তো আর এখন শুধু গুরুজনই নেই, লঘুজনও রয়েছে যে। লজ্জা তো তাদের সামনেই। তা ছাড়া সমপৰ্যায়রা?

তারা যদি টের পায় সম্পূর্ণ ইচ্ছার বিরুদ্ধে আতুড়ে ঢুকতে হচ্ছে সুবৰ্ণলতাকে, আর কি মানবে তাকে? হয়তো আহা! ই করে বসবে।

ওই আহার চাইতে অনেক ভাল ঈর্ষা।

তা ঈর্ষা তারা করে বৈকি।

এতকাল বিয়ে হয়েছে সুবৰ্ণলতার, তবু তার বর তাকে চক্ষে হারা হয়, তবু একদণ্ড ঘরে না দেখলেই রসাতল করে, রান্নাঘরে গেলেই বার বার ছেলেপুলেকে জিজ্ঞেস করে, এই, তোদের মা কই?

এর চাইতে ঈর্ষার বস্তু আর কি আছে?

আজীবন সবাই সুবৰ্ণকে ঈর্ষাই করেছে।

আর বাইরের লোক বলেছে, এমন মানুষ হয় না।

এ কথা মুক্তকেশীর সংসারের বাইরের সবাই চিরকাল বলেছে।

আর র সংসার বলেছে, এমনটি আর দেখলাম না! কোটি কোটি নমস্কার!

সেই দূর অতীতে সুবর্ণলতার যেদিন গলায় আঁচল পাকিয়ে মরতে বসে হারানো গহনার হদিস করে দিয়েছিল, সেইদিনই বোধ করি গলা খুলে বলার শুরু।

মুক্তকেশী মেয়ের গায়ে গহনা পরিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন বৈকি? তবু বলেছিলেন, কোটি কোটি নমস্কার মা, কোটি কোটি নমস্কার!

উমাশশীও বলেছিল, নমস্কার করছি বাবা!

সুবৰ্ণলতার দেওররা বলেছিল, নমস্কার! কোটি কোটি নমস্কার!

শুধু সুশীলা বলেছিল, কেলেঙ্কারিটা তোরাই করলি! যতদূর নয় ততদূর লোক হাসালো তো পেবোটা, অথচ কেলেঙ্কারী ছড়ালো বৌয়ের!

আর সুশীলার বর কেদারনাথ বলেছিলেন–। তা তাদের কথার মূল্য কি? তারা তো মুক্তকেশীর সংসারের বাইরের লোকই। যাদের শুনিয়ে শুনিয়ে মুক্তকেশী বলতেন।–

যার সঙ্গে ঘর করি নি,
সে-ই বড় ঘরাণী,
যার হাতে খাইনি,
সে-ই বড় রাধুনী।

তা সেই কেদারনাথ শুধু সেদিনই নয়, অনেক সময় অনেক দিনই বলতেন, মানুষটাকে তোমরা চিনলে না! বলতেন, এমন মেয়ে সচরাচর হয় না গো! তবে আমার শাশুড়ী ঠাকরুণ আর তাঁর সুযোগ্য পুত্র শিব গড়ার মাটিতে বাঁেদর গড়বার পণ করে বসেছেন এই দুঃখ!

কেদারনাথের সঙ্গে কথা কইবার অনুমতি ছিল সুবৰ্ণলতার। অর্থাৎ সুবৰ্ণলতাই ওটা চালু করে নিয়েছিল। উমাশশী কখনো ননদাইয়ের সঙ্গে কথা বলবার প্রয়োজন অনুভব করে নি। ঘোমটা দিয়ে ভাত জল এগিয়ে দিয়েছে এই পর্যন্ত।

সুবৰ্ণলতাই প্রথম বলেছিল, বড় ঠাকুরজামাইয়ের সঙ্গে কথা কইলে দোষ কি মা? আমি তো ওঁর মেয়ের বয়েসী!

কথাটা মিথ্যা নয়।

কেদারনাথের বয়েস হয়েছে।

সুশীলা তার দ্বিতীয় পক্ষ।

আগের পক্ষের যে মেয়েটি আছে, বয়সে সে সুবৰ্ণলতার চাইতে বড় বৈ ছোট হবে না। সুশীলা যখন বেশি দিনের জন্যে বাপের বাড়ি আসতো, সতীনঝিকে নিয়ে আসতো।

এখন আর আসে না। শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে মেয়ে।

সে যাক, সুবৰ্ণলতা যে কেদারনাথের মেয়ের বয়সী তাতে ভুল নেই।

তাই এত সাহস সুবৰ্ণলতার।

তবু মুক্তকেশী প্ৰস্তাবটা প্ৰসন্ন-চিত্তে গ্ৰহণ করবেন। এমন আশা করা যায় না। বললেন। হঠাৎ কথা কইবার দরকারই বা কি এত পড়লো?

উনি সর্বদা ডাক দেন, কই গো বড় গিনি, কই গো মেজ গিন্নী বলে, পান-তামাক চান, বোবার মত শুধু এগিয়ে দিই, লজ্জা করে!

মুক্তকেশী বোজার মুখে বলেন, কি জানি মা, তোমাদের যুগের লজ্জার রীতি-নীতি কি! যাতে লজ্জা, তাতে তোমাদের লজ্জা নেই, যেটা সভ্যতা-ভাব্যতা তাতেই হল লজ্জা! গুরুজনের সঙ্গে কথা কি কইলেই হয়? মান রাখতে না পারলে?

সুবৰ্ণ হেসে ফেলে বলে, মানই বা রাখতে না পারবো কেন মা? মান্যের মানুষ—

মুক্তকেশী একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেন, সে শাস্তর যে তোমার পাঠশালায় আছে, তা তো জানি না মা! গুরুজনকে হেঁট করাই তো তোমার প্রিকিতি!

সুবৰ্ণলতা বলেছিল, বড় ঠাকুরজামাইকে হেঁট করতে চাইবে, এমন খারাপ কেউ আছে নাকি জগতে?

সেই বড় ঠাকুরজামাইটি মুক্তকেশীর নিজের জামাই, তাকে প্রাধান্য না দিলে চলে না। তাই অনেক তর্কাতর্কির পর নিমরাজী হয়েছিলেন মুক্তকেশী।

নিজেও তো তিনি কতকাল জামাইয়ের সঙ্গে কথা কইতেন না, ঘোমটা দিতেন। কিন্তু জামাইয়ের প্রাণ-জুড়ানো ব্যবহারে ধীরে ধীরে সেটা ত্যাগ করেছেন।

তাই বলে বৌ?

আর ওই দজাল বৌ?

এমনিতেই যে স্বামীর মাথায় পা দিয়ে হাঁটে! এর ওপর আবার পরপুরুষের সঙ্গে মুখ তুলে কথা

সেই কথাই বলেছিলেন, ঠাকুরজামাইয়ের সঙ্গে কথা কয়ে কি চতুর্বর্গ লাভ হবে তুমি জানো মা। তবে এও বলি, জানো তো পেবো এসব পছন্দ করে না!

সুবৰ্ণ আরক্ত মুখে বলে, কেউ যদি পাগল হয়, তার তালেই চলতে হবে?

পাগল যে কে, সে হিসেবেই বা করছে কে বাছা! মুক্তকেশী বোজার গলায় বলেন, কথা কইবে কও, হ্যাঁ হ্যাঁ করো না গুচ্ছির। তোমার তো মাত্ৰাজ্ঞান নেই! এই যে পেকার সঙ্গে হিট হট করে কথা কইচ, মান কি রাখছো তার?

মান!

প্ৰকাশের!

শখের থিয়েটারে মেয়ে সাজা সেই ছেলেটারও মানহানির প্রশ্ন!! সুবৰ্ণলতার মুখেচোখে একটা হাসির আভাস খেলে গিয়েছিল। তবু কৌতুকের গলা সম্বরণ করে বলেছিল, মানের হানি কি করেছি মা, বিয়ের কথায় একটু হন্তারক হয়েছিলাম, তা সে আক্ষেপ তো তার মিটেছে বাপু!

মুক্তকেশী সগর্বে বলেন, মিটবে না তো কি তোমাদের হাততোলায় রেখে দেব ওকে?

তা সেই গর্বের মুহূর্তে সুবৰ্ণলতা বলে উঠেছিল, সে যাক, তাহলে বাপু কথা কইব বড় ঠাকুরজামাইয়ের সঙ্গে—

তাতে যদি তোমার চারখানা হাত-পা বেরোয় তা কোরো!

এই অসতর্ক উক্তিটুকুই অনুমতি বলে ধরে নিয়েছিল সুবৰ্ণলতা।

কিন্তু সত্যিই তো, কী চারখানা হাত বেরুবে সুবর্ণের বুড়ো ভদ্রলোকটার সঙ্গে কথা কয়ে?

কে জানে সে কথা!

তবে এইটি হলো, বাড়ির পরবর্তী আরও দুটো বৌ এ সুযোগটার সদ্ব্যবহার করলো। মুক্তকেশী বললেন, হবেই তো! কথাতেই আছে, আগ ন্যাংলা যেদিকে যায়, পাছ ন্যাংলা সেদিকে ধায়া! মেজবৌ একেলে হাওয়া ঢোকালো বাড়িতে!

মেজবৌয়ের এ বদনাম উঠতে বসতে। মেজবৌ বাড়িতে খবরের কাগজ আসার পত্তন করেছে, মেজবৌ বাড়িতেও গায়ে সেমিজ দেওয়ার পত্তন করেছে, মেজবৌ আঁতুড়ঘরে ফর্সা বিছানা-কাপড়ের প্রথা প্রবর্তন করেছে। মেজবৌ মেয়েঞ্জলোকে সুদ্ধ ধরে ধরে পড়তে বসার শাসননীতি প্রয়োগ করেছে। এমন আরো অনেক কিছুই করেছে মেজবৌ।

ধিকৃত হয়েছে, লাঞ্ছিত হয়েছে, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে জর্জরিত হয়েছে, তবু জেদ ছাড়ে নি। শেষ পর্যন্ত করে ছেড়েছে।

 ১.০৮ কিন্তু জেদী মেয়ে সুবৰ্ণলতা

কিন্তু জেদী মেয়ে সুবৰ্ণলতা সব কিছুই কি করে উঠতে পেরেছে?

সমুদ্র দেখবার যে বড় বাসনা ছিল তার, দেখেছিল কি সারা জীবনে? অথচ ইচ্ছেটা তাকে কম্পিত করেছিল। সেই কোন অতীতকালে!

কত বয়েস তখন সুবৰ্ণলতার যখন মুক্তকেশী পাড়ার দলের সঙ্গে শ্ৰীক্ষেত্ৰ গিয়েছিলেন?

আকস্মিক কথাটা উঠেছে, চাটুপট সব যোগাড় করে ফেলতে হবে। মুক্তকেশী দুজোড়া থান ধুতি সাজো কাচিয়ে নেন ধোবার বাড়ি থেকে। গায়ের চাদর খুন্দুকে দিয়ে কাচিয়ে নেন সাজিমাটি দিয়ে। এ ছাড়া যোগাড় কি কম? কম্বল, বালিশ, মধু, আখের গুড়, ইসবগুল, আতপ চাল, সাবু, মিশ্ৰী, খুঁটিনাটির কি অন্ত আছে? একেই তো বিদেশে বেঘোরে প্রাণটা হাতে করে যাওয়া!

মা তীৰ্থ করতে যাবেন শুনে মেয়েরা দেখা করতে আসে এক-একদিন। সুশীলা তো থেকেই গেল। কদিন। মেজ সুবালাও এল, পরদিন চলে গেল। বড় ননদকে সুবৰ্ণ বড় প্রীতির চোখে দেখে। মানুষটার মহৎ গুণ, বড় নির্বিবোধী আর শান্তিপ্রিয়। যেটা নাকি মুক্তকেশীর গর্ভজাতদের মধ্যে দুর্লভ।

এরা সকলেই অশান্তিপ্ৰিয়।

অকারণ একটা কথা কাটাকাটি, অকারণ একটা চোঁচামেচি, অকারণ একটা জটিলতার সৃষ্টি করা-এটাই যেন এদের ব্যসন! বিশেষ করে সুবৰ্ণলতার উকিল সেজ দেওরের আর সুবৰ্ণলতার প পরম গুরুর। এরা দুজন যেন এদের উপস্থিতিতে সমস্ত পরিবেশটাকে সচকিত করে রাখতে চায়, অহরহ সরবে ঘোষণা করতে চায়। আমি আছি। এই ওদের বিলাস, ওই ওদের বিকাশ।

হয়তো এমনই হয়।

যাদের মধ্যে নিজেকে বিকশিত করবার উপর্যুক্ত কোনো বিশেষ গুণ নেই, অথচ নিজেকে বিশিষ্ট দেখার ইচ্ছেটা থাকে ষোল আনা, তাদের মধ্যেই জন্ম নেয়। এই বিকৃতি। তারাই নিজের চারিদিকে একটা সোরগোলের আবর্ত তুলে বিশিষ্ট হলাম ভেবে আত্ম তৃপ্তি পায়।

প্ৰবোধ একটা মুটের সঙ্গে অথবা একটা পালকি-বোহারার সঙ্গে একটা দেড়টা পয়সা নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এমন শব্দময় দৃশ্যের অবতারণা করতে পারে যে, পাড়াসুদ্ধ লোক সচকিত হয়ে ছুটে আসে, জানলায় জানলায় খড়খাঁড়ির ফাঁকে কৌতূহলী চোখের ভিড় বসে যায়।

প্রভাসের মহিমাটা আবার বাড়িতেই বেশি প্রকট।

প্রভাস প্ৰতি কথায় পা ঠুকে বলে, আমি শুনতে চাই কে এ কথা বলেছে! শুনতে চাই কে এ কাজ করেছে!

তারপর?

তারপর অপরাধীর জন্য তো আছেই হাতে মাথা কাটার ব্যবস্থা!

ঘোরতর মাতৃভক্ত প্রভাসচন্দ্র প্রতি পদে সংসারে তার মাতৃসম্মান ক্ষুন্ন হতে দেখে, এবং সেই কল্পিত অসম্মানকে উপলক্ষ করে ঘূর্ণিঝড় তোলে! প্রধান লক্ষ্যবিন্দু অবশ্য সুবৰ্ণলতা!

কারণ সুবৰ্ণলতাই গুরুজনদের মান-সন্মান রক্ষার নীতি, নিয়ম, ধারা, অনুচ্ছেদ ইত্যাদি মেনে চলতে তেমন উৎসাহী নয়। সুবৰ্ণলতা জানে না অকারণ গাল খেয়ে চুপ করে থাকতে হয়, সুবৰ্ণলতা জানে না। অহেতুকি খোশামোদ আর তোয়াজ করতে।

তাই সুবৰ্ণলতার নাম না করেও শব্দভেদী বাণ নিক্ষেপ করে, মাকে মান্য করে চলতে যে না পারবে, সে যেন পথ দেখে। এ ভিটেয় মাকে অপমান করে বাস করা চলবে না।

হ্যাঁ, বহু সহস্রবার পথ দেখার হুকুম পেয়ে পেয়ে তবে পথ দেখেছিল সুবৰ্ণলতা। তবু নিন্দেয় টি টি পড়েছিল সুবৰ্ণলতার-আলাদা হয়ে গিয়েছিল বলে।

হাঁড়ি ভেন্ন করা সে কথা স্বতন্ত্র, যেমন করেছে ছোটবৌ বিন্দু, তা বলে বাড়ি ভিন্ন!

কিন্তু এসব তো অনেক পরের কথা।

সুবৰ্ণলতা যখন সমুদ্রের স্বপ্ন দেখতো, তখন আলাদা হওয়ার স্বপ্ন দেখে নি।

মুক্তকেশী শ্ৰীক্ষেত্রে যাচ্ছেন।

যেখানে নাকি সমুদ্র আছে।

মুক্তকেশীর সাজিমাটিতে কাঁচা চাদর বালিশের ওয়াড় তুলে আনতে রান্নাঘরের ছাদে এল সুবর্ণ। এটাই মুক্তকেশীর বিশুদ্ধ এলাকা। এখানে তার কাঁচা কাপড় শুকোয় শুকোয় বড়ি আচার।

রোদ পড়লে এগুলি ঘরে তোলার ভার সুবর্ণর। সেচ্ছায় সে এ ভার নিয়েছে। কাপড়ে সন্ধ্যা পাবার আগেই তসর শাড়ি একখানা জড়িয়ে পাশের দিকের এই নিচু ছাদটায় নেমে আসে সুবৰ্ণ। গলির মধ্যে বাড়ি, ছাদে তার বুকচাপা হাওয়া। তাছাড়া হবেই বা কি? যে ছাদে উঠতে হয় না, নামতে হয়, সে ছাদে কোথা থেকে আসবে উত্তাল হাওয়ার স্বাদ?

তবু ভালো লাগে।

তবুও সামান্যতম মুক্তি।

উপরে বাতাস না থাক, পায়ের তলায় ঘুটে আর কয়লার গুঁড়োর তৈরি গুলোর ছড়াছড়ি থাক, তবু তো মাথার ওপর আকাশ আছে।

কাপড় শুকোতে দেওয়া দড়িতে হাত দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সুবর্ণ এই একটুকরো আকাশের দিকে তাকিয়ে।

সমুদ্র কী ওই আকাশের মত?

না, তাতে নাকি ঢেউ আছে, তরঙ্গ আছে, গর্জন আছে। কী অপূর্ব সেই মহিমা!

সুবৰ্ণলতার শাশুড়ী মুক্তকেশী সেই মহিমুর দৃশ্য দেখবেন গিয়ে। কিন্তু মুক্তকেশীর মনের কাছে কি সেই সমুদ্রে মূল্য ধরা পড়বে? মুক্তকেশী তো কই একবারও বলছেন না। সমুদ্রদর্শনে যাচ্ছি। বলছেন জগন্নাথ-দর্শনে যাচ্ছি! বলছেন জগন্নাথ টেনেছেন!

সুবৰ্ণলতাকে তো কই সমুদ্র টান দিচ্ছে না?

সুবৰ্ণলতার আকুলতার চাইতে কি মুক্তকেশীর চিত্তের আকুলতা বেশি?

নইলে চারধাম করে নিতে পেরেছেন তিনি। আবার দ্বিতীয়বার পুরী যাচ্ছেন। রথযাত্রাকে উপলক্ষ করে। কেদারবন্দরী, দ্বারকা, মথুরা, বৃন্দাবন কত কত জায়গায় গিয়েছেন মুক্তকেশী সুবর্ণর বিয়ের আগে, পরে।

পাড়ার মহিলাদের সঙ্গে ব্যবস্থা পাকা করে ফেলে এসে ছেলেদের একত্রে ডেকে বলেন, তোমরা চার ভাই কে কি দেবে বল?

ছেলেদের মুখ শুকোলেও মুখে হারে না। বলে, তোমার যা লাগে বল মা!

এবারেও বলেছে।

তা এবারে টাকা একটু বেশি লাগবে।

রথে যাওয়া আটকে বাঁধতে হবে, পাণ্ডাপূজো করতে হবে, গুণ্ডিচাবাড়ি ভোগ দিতে হবে।

মুক্তকেশী জানতেন, টাকা দিলে প্ৰবোধই দেবে। সুবোধের নেই বলে দিতে পারবে না, আর সেজ ছোট কিপটেমির জন্যে দিতে পারবে না।

তা প্ৰবোধও কিছু কম কিপটে ছিল না, শুধু সুবর্ণর দাপটেই মুক্তহস্ত হতে হয়েছে তাকে।

প্ৰবোধের আজকাল উপার্জন বেশি, জাহাজঘাটায় মাল লেন-দেনের কাজ, কাঁচা পয়সা, তাই দায়ে-দৈবে, জামাইবাড়ির তত্ত্ব-তল্লাসের ব্যাপারে। প্ৰবোধই মার ভরসা এখন।

এই একটি কারণেই হয়তো এখনো পর্যন্ত সুবৰ্ণলতাকে মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে বাড়ির বাইরে দূর করে দেন নি মুক্তকেশী! টাকাকড়ির ব্যাপারে বেঁটা একেবারে উদোমাদা। আমার স্বামীর বেশি গেলো বলে হাপসানো তো দূরের কথা, তোমার বেশি আছে তুমিই দাও বলে স্বামীকে উৎপীড়ন করে মারে।

আর বৌ তিনটে এক পয়সার মরে বাঁচে!

উমাশশী যে অত ভালো, পয়সার ব্যাপারে কঞ্জুষের রাজা!

এই যে নিত্য গঙ্গাস্নান করেন মুক্তকেশী, খরচ কি নেই তাতে? গাড়িপালকি না চড়ুন, ঠাকুরদোরে তো দু-চারটে পয়সা দিতে হয়! ভিখিরি ফকিরকেও এক-আধটা না দিলে চলে না। তাছাড়া গঙ্গার ঘাটের বাজার থেকে হলো বা দুটো ফলপাকড়, হলো বা দুটো মাটির পুতুল কেনা, এ তো আছেই। এ খরচ সুবৰ্ণলতাই হাতে গুঁজে দেয়। নিজে থেকেই দেয়।

এবারেও যে প্ৰবোধ উদার গলায় বলেছিল, সবাইকে আর এই সামান্যর জন্যে বলার কি আছে মা? তোমার আশীর্বাদে শ দুই টাকা আমিই তোমাকে দিতে পারবো –সে। ওই বৌয়ের অন্তরটিপুনিতে ছাড়া আর কিছু নয়। তবে মুক্তকেশী মর্যাদা খোয়ান নি।

মুক্তকেশী উদাসভাবে বলেছিলেন, সে তোমাদের যার যেমন ক্ষ্যামিতা, ভাইয়ে ভাইয়ে মোকাবিলা কর! আমি সবাইয়ের কাছে বলে খালাস!

বৌয়ের বদান্যতায় বিচলিত হবেন মুক্তকেশী এমন নয়।

সুবৰ্ণলতা কাঁচা কাপড় তুলে নেমে আসছিল, সহসা বড় বৌয়ের সেজ ছেলে গাবু এসে হাঁক পাড়ে, মেজ খুড়ী, দিব্বি যে ছাদে এসে হাওয়া খাওয়া হচ্ছে! ওদিকে দেখ গে যাও, ঠাকুমা তোমার পিণ্ডি চটকাচ্ছে!

হ্যাঁ, এই ভাষাতেই কথা বলতে অভ্যস্ত ওরা।

এই ভাষাই তো শুনছে অহরহ।

সুবৰ্ণ সুরু কুঁচকে বলে, কেন হলোটা কি?

হলো? হুঁ! সাতশোবার ডাকছেন, শোনো গে কেন?

ওঃ!

সাতশোবার ডেকে সাড়া না পাওয়াটাই তা হলে অপরাধ! অতএব মারাত্মক কিছু না। সুবর্ণ তাড়াতাড়ি কাঁচা কাপড় যথাস্থানে রেখে এসে বলে, মা ডাকছিলেন?

মুক্তকেশী গম্ভীর আর কঠোর কণ্ঠে বলেন, বোসো।

ঈষৎ ভয় পেয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখে সুবর্ণ।

কেদারনাথ ঈষৎ গাম্ভীর্যে বলেন, তা বললে কি চলে মেজ গিন্নী? মিলিয়ে নিতে হয়!

যা হয় না তা কিভাবে হবে বলুন! সুবর্ণ একেবারে সম্ভাবনার মূলেই কোপ দিয়ে বলে, ও কথা ছেড়ে দিন। আপনি আমার একটা উপকার করুন ঠাকুরজামাই, কেনা হয়ে থাকবো আপনার। মাকে বলুন আমাকে নিয়ে যেতে!

কৌতুকপ্ৰিয় কেদারনাথ ওই কেনা হয়ে থাকার প্রসঙ্গে কিছু কৌতুক কথা আমদানি করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সুবর্ণর আবেগে থারথার মুখ দেখে সামলে নিলেন।

অবাক হয়ে বললেন, নিয়ে যেতো! কোথায় নিয়ে যেতে!

পুরীতে।

পুরীতে? তোমায় পুরী নিয়ে যাবেন আমার পূজনীয় শাশুড়ী ঠাকরুণ? তা হলেই হয়েছে!

শাশুড়ীর সম্বন্ধে সমবয়সী জামাই কেদারনাথ এ ধরনের হাস্য-পরিহাস করেই থাকেন।

সুবৰ্ণ বলে, সে আমি জানি। তাই তো আপনাকে ধরছি। আপনার দুটি পায়ে পড়ি ঠাকুরজামাই, বলুন। একবার। আপনার কথায়, না করতে পারবেন না।

আহা, বুঝছে না ভাই! বলাটাই যে নিন্দের হবে! সব বৌয়ের কথা বলতাম। সে আলাদা কথা!

সব বৌ? সুবৰ্ণ তীব্ৰ গলায় বলে, ওরা কি সমুদ্র দেখতে চায়? ওদের খালি গাদা গাদা রানা আর গাদা গাদা খাওয়ায় আহ্লাদ। আপনি একবারটি আমার কথা বলুন ঠাকুরজামাই! বলবেন, পগল-ছাগল, বড্ড ইচ্ছে হয়েছে–

কেদারনাথ হয়তো বুঝতে পারেন পাগল-ছাগলের মতই কথা বলছে মানুষটা। তবু মুখে উপর তার সব আশা ধূলিসাৎ করে দিতে পারেন না। স্নেহের গলায় বলেন, আচ্ছা বলে দেখবো।

সুবৰ্ণলতার চোখের সামনে আশার দীপ জ্বলে ওঠে।

সুবৰ্ণলতা আনন্দে ছল ছল করতে করতে বলে, বলে দেখবো নয়, এ আপনাকে করে দিতেই হবে ঠাকুরজামাই। সমুদ্র দেখতে বড় ইচ্ছে আমার। মনে হয় একবার সমুদ্র দেখতে পেলে বুঝি মরতেও দুঃখ নেই।

এই দেখ পাগল! আচ্ছা, আচ্ছা, বলে দেখবো।

অবোধ সুবৰ্ণলতা এই আশ্বাসের তেলাটুকু দিয়ে আশার দ্বীপ জেলে রাখে। সুবর্ণ মনে করে পুরীর টিকিট বুঝি কেনা হয়ে গেছে তার!

সেই থেকে এই চব্বিশ ঘণ্টা সময় সমুদ্রের স্বপ্লে ড়ুবে আছে সুবর্ণ।

হঠাৎ যেন কে ওকে সেখানে থেকে টেনে তুলে এনে পাথরে আছড়ে মারলো।

মুক্তকেশীর দরবারে বিচার বসলো। জেরা শুরু হলো, কী বলেছে তুমি কেদারকে?

সুবৰ্ণ শঙ্কিত গলায় বলে, বলেছিলাম যেতে ইচ্ছে করে—

শুধু ওই কথা বলেছ? বলনি বড়বৌ, সেজবৌ, ছোটবৌ গাদা গাদা খায়!

সুবৰ্ণ অবাক হয়ে বলে, ও কথা আবার কখন বললাম?

কেন, যখন ঠাকুরজামাইয়ের কোলের কাছে বসে আদর কাড়ানো হচ্ছিল! সাধে কি আর মেয়েমানুষকে ঘোমটা দিয়ে অন্দরে রাখার রেওয়াজ মেজ বৌমা? এই তোমার মতন লক্ষ্মীছাড়া মেয়েমানুষদের জন্যই। আরো দুটো বৌও তো কথা কয়, কই তোমার মতন কোলের কাছে বসতে চায় না তো তারা? পেবো যাই দেখে নি। তাই রক্ষে, দেখলে গুরুলঘু মানতো? ঠাকুরজামাইয়ের কাছে বসে আদর কাড়ানো হচ্ছিল! জগন্নাথে নিয়ে যাবার বাসনা জানানো হচ্ছিল! ওরা গাদা গাদা খায়, ওদের যাবার দরকার নেই, আমি সোহাগী, আমায় নিয়ে যেতে বল! বলি কেন? কেন? এত আসপদ্দা তোমার কিসের? ওরা তোমার বাবার খায়?

সুবৰ্ণর এবার প্রসঙ্গটা মনে পড়ে। অতএব বিস্ময়টা কাটে।

প্রতিবাদের সুরে বলে ওঠে, ও ভেবে ও কথা বলি নি আমি—

হঠাৎ বড়বৌয়ের বড় মেয়ে মল্লিকা খরখর করে বলে ওঠে, না বল নি বৈকি! আমি যেন শুনি নি! টোপিও শুনেছে। বল নি তুমি বড় পিসেমশাইকে, ওরা গাদা গাদা রাধে, গাদা গাদা খায়–এখন আবার মিছে কথা বলা হচ্ছে!

না, মল্লিকার দোষ নেই।

এ বাড়ির শিশুরা জ্ঞানচক্ষু উনীলনের সঙ্গে সঙ্গেই দেখে আসছে, সবাই সুবৰ্ণলতার বিপক্ষ। সুবৰ্ণলতা সকলের সমালোচনার পাত্রী। সুবৰ্ণলতাকে এক হাত নিতে পারবার চেষ্টায় সবাই তৎপর। তবে আর তাদেরও তেমন মনোভাব গড়ে উঠবে না কেন! সুবৰ্ণলতার নিজের মেয়ে পারুলও কি ওদের দলে নয়!

ছেলে দুটি অবিশ্যি মার নেওটা, কিন্তু মেয়েটা মল্লিকারই জুড়ি।

কিন্তু আজ মল্লিকার কপালে দুঃখ ছিল।

অভ্যস্ত পাকা কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গেই বড়-সড় একটা চড় খেল সে।

হঠাৎ যেন সুবর্ণর মাথায় আগুন জ্বলে উঠল ওর কথায়। তাই বলেছি বেশ করেছি, এক ফোঁটা মেয়ে তোর এত সর্দারী কিসের রে? বলে ঠাস করে একটা চড় তার গালে বসিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। খেয়াল করল না, তার বিচারসভা অসমাপ্ত কাৰ্যভাব নিয়ে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল সেই গমনপথের দিকে।

কিন্তু বিচারসভা কি তার কার্যভার শেষ না করে নিশ্চিন্ত হয়? মুলতুবি সভা আবার বসে না নতুন উদ্যমে।

বিচার হয়। সুবর্ণর।

সেই বিচারের সূত্রে সমুদ্রের আভাস কিছু মেলে বৈকি।

ঢেউ, তরঙ্গ, গর্জন।

লবণাক্ত স্বাদ?

তারই বা অভাব কি?

সেও তো মজুত আছে অগাধ অফুরন্ত। শুধু একবার বালুবেলায় আছড়ে পড়ার অপেক্ষা।

আচ্ছা কেদারনাথ আর সুশীলা?

তারা?

তারা তো আগেই চলে গিয়েছিল। কেদারনাথ চেষ্টা দেখবার চেষ্টায় আজও এসেছিলেন। কথা তোলার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে পড়লো। গত কালকের ইতিহাস। তারপরই উঠলো ঝড়। পরিস্থিতির আভাস দেখেই সুশীলা বলেছিল, আমি তোমার সঙ্গে পালাই চল। চোখের ওপর বেঁটার খোয়ার দেখতে পারব না।

খোয়ার থেকে রক্ষা করবার চেষ্টা করলে বিপদ আরো বাড়ানোই হবে বেঁটার সে কথাও তো অবিদিত নেই। তবু রক্ষা হলো না।

দু-তিন ছেলের মা হবার পর মারটা ছেড়েছিল প্ৰবোধ, কিন্তু পরপুরুষের গা ঘেষে বসে আদর কাড়ানোর খবরে আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারল না। হিংস্র জানোয়ারের মত প্ৰায় ঝাঁপিয়ে পড়ে দেয়ালে মাথা ঠুকে দিতে উচ্চারণ করলো, বল আর বুড়োর সঙ্গে কথা কইবি না! প্ৰতিজ্ঞা কর!

সুবৰ্ণ আচাড়ে-কামড়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, করব না প্ৰতিজ্ঞা।

তাহলে তোর ওই পেয়ারের বুড়োকেই খুন করে ফেলবো দেখিস!

কোরো। সংসারে দুটো বিধবা সৃষ্টি হবে এই যা। খুন করে রেহাই পাবে না, ফাঁসি যেতে হবে।

প্ৰবোধ এই দুঃসহ স্পর্ধার সামনে সহসা স্তব্ধ হয়ে যায়। হ্যাঁ, এই স্বভাব প্ৰবোধের। হয়তো দুর্বলচরিত্র মাত্রেরই এমনি স্বভাব হয়। কেঁচোকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেখলেও তারা হঠাৎ ভয় খায়, নিজেকে সম্বরণ করে নেয়।

সুবৰ্ণলতা যদি উমাশশীর মত হতো, কবেই হয়তো প্ৰবোধ তাকে অবহেলায় ঘরে ফেলে রেখে কাঁচা পয়সার সদ্ব্যবহার করবার পথ খুঁজতে যেত। কিন্তু সুবর্ণলতার এই দুঃসহ স্পর্ধাই একটা তীব্র আকর্ষণ!

তাই প্ৰবোধ একবার হয়ে মারে, পরীক্ষণেই জ্ঞানশূন্য হয়ে পায়ে ধরতে যায়।

সেদিনও প্রথমটা স্তব্ধ হয়ে গিয়েই সহসা সুর বদলায় প্ৰবোধ। সুবৰ্ণলতার নখের আঁচড়ে বিক্ষত হাতটায় ফুঁ দিতে দিতে বলে, উঃ, নখে দাঁতে বাঘের বিষ! ফাঁসিতে লটকাতে প্ৰধান সাক্ষী বোধ হয় তুমিই হবে?

একশোবার!

প্ৰবোধের গলায় অভিমানের সুর বাজে, তা জানি। এ আপদ মরলেই যে তুমি বঁচো তা আর আমার জানতে বাকি নেই। নিজের মাছ খাওয়াটাও যে ঘুচিবে সেই সঙ্গে, সে খেয়াল আছে?

সুবৰ্ণলতা বিধ্বস্ত খোঁপাটা জড়িয়ে নিয়ে নিজের বালিশটা মাটিতে ফেলে শুয়ে পড়ে বলে, তোমাদের মতন খাওয়াটাই আমার কাছে চতুর্বর্গ নয়!

তার মানে বিধবা হতেই চাও?

চাই, তাই চাই। শুনলে তো? এখন কি করবে? আমার প্রার্থনা পূরণ করতে বিষ খাবে? না। গলায় দড়ি দেবে?

এই বৌকে কোন উপায়ে জব্দ করবেো প্ৰবোধ?

মেরে ফেলা ছাড়া করা যাবে আর কিছু?

 

অথচ আবার নিজে সে প্রকৃতির একটা নিষ্ঠুর কৌতুকের প্যাঁচে নিতান্তই জব্দ!

এত কাণ্ডের পরও ওই ত পড়ে থাকা দীর্ঘ, বলিষ্ঠ, স্বাস্থ্যে ভরপুর দেহটা যেন তাকে লক্ষ বাহু দিয়ে আকর্ষণ করতে থাকে!

তিন ছেলের মা হয়েও তো স্বাস্থ্যে এতটুকু শিথিলতা এল না!

অতএব এবার খোশামোদের পথ ধরতে হয়।

তবে সেটা কিছু বিচিত্র।

লুব্ধ পুরুষের গভীর রাত্রির সেই বিচিত্র তোয়াজের ইতিহাস অনুদ্‌ঘাটিতই থাক।

সুবৰ্ণরই বা কী উপায় আছে। এর থেকে নিস্কৃতি পাবার, মরে হাড় জুড়নো ছাড়া?

রাত্রে দরজা খুলে বেরিয়ে আসার ছেলেমানুষি আর করা চলে না এখন। চারিদিকে চল্লিশটা চোখ! ছোটগুলোর কথা মনে করলেই সেই তীব্র বাসনাও স্তিমিত হয়ে আসে।

অথচ মরবার উপকরণও তো দুর্লভ!

শাশুড়ীর একটা রাতের মালিশের ওষুধ চুরি করে লুকনো আছে বটে, কিন্তু খুব একটা আস্থা আসে না তার উপর।

আবার একবার কি লোক হাসাবে সুবৰ্ণ?

মরতে গিয়ে না মরে কেলেঙ্কারী করবে?

তার থেকে এই কথা বিশ্বাস করাই ভাল, সুবৰ্ণ কারো দিকে তাকালেই মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে ওঠে প্ৰবোধের, হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। তাই এমন কাণ্ড করে বসে।

কারণ?

কারণ তো পড়েই আছে।

ভালবাসার আধিক্য! পায়ে মাথা খুঁড়ে সেই কথাই বোঝাতে চায় প্ৰবোধ।

মেয়েটা ঠাকুমার কাছে শোয়, কিন্তু ছেলে দুটোও তো ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে, তাদের ঘুমের গভীরতায় বিশ্বাস নেই, শেষ পর্যন্ত ওই আধিক্যটা বোঝা ছাড়া উপায়ই বা কি?

১.০৯ তীৰ্থ থেকে ফিরলেন মুক্তকেশী

তীৰ্থ থেকে ফিরলেন মুক্তকেশী, সঙ্গে নিয়ে এলেন সেজমেয়ে সুরাজকে।

না, তীর্থপথে কুড়িয়ে পান নি তাকে, সম্প্রতি তার ব্যর কটকে বদলি হয়েছে, তাই সেখানেই দু-একদিন থেকে একেবারে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন। বললেন, এত বড় খবরটা চেপে বসে আছিস সুরি? ধন্যি বটে! এই সময় কখনো একা থাকে?

সুরাজের বরের বদলির কাজ, সুরাজ মেমসাহেবের মত স্বামীর সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। চাকর, ঠাকুর, আর্দলী, বেহারা সকলের সঙ্গে কথা বলে, বর এতটুকু এদিক-ওদিক করলে পলকে প্ৰলয় করে।

অবশ্যই সে প্ৰলয় মুক্তকেশীর মত নয়, প্ৰণয়েরই পরিচয় ঘোষণা মাত্ৰ। ভঙ্গীটা অতএব সভ্য মার্জিত।

সুরাজকে দেখলে বোঝাবার জো নেই একদা সে এ সংসারের মেয়ে ছিল।

সুরাজ সর্বদা টাইট জ্যাকেটবডি পরে থাকে। সুরাজ এক-গা গহনা পর্যাকে সেকেলে বলে হাসে, সুরাজ মাথায় সোনার চিরুনি বসিয়ে খোঁপা বঁধতে নারাজ, সুরাজ নাকি স্বামীর কর্মস্থলে জুতো পায়ে দেয়।

সুরাজ কদাচুই আসে।

শেষ এসেছিল বিরাজের বিয়ের সময়, গোলমাল দেখে বরকে চিঠি লিখে মেয়াদের আগেই সরে পড়েছিল

এবার যে এল সেটা ইচ্ছেয় নয়, নিতান্তই মায়ের নির্বন্ধতিশয্যে! বরও বলল, সত্যিই বটে, এতদিন পরে যখন আবার ইচ্ছে মার কাছে থাকলেই হয়তো ভাল। কলকাতা শহর।–

একটি ছেলে সুরাজের, দশ বছর পরে আবার এই ঘটনা।

মুক্তকেশীর কি শুধুই মাতৃস্নেহ?

তার উপর বাড়তি আরও কিছু ছিল না?

তাঁর এই ষোল আনা স্বাধীন মেমসাহেব মেয়েটিকে আত্মজনের সামনে দেখাবার বাসনাও ছিল না কি?

এর আগে যখন এসেছে, তখন এত সুখ-স্বাধীনতা ছিল না, শাশুড়ীমাপী ছিল বেঁচে, এখন সে বালাইও গেছে। মেয়েকে তাই বুকে করে নিয়ে এলেন মুক্তকেশী। আর জনে জনে ধরে ধরে শোনাতে লাগলেন, এত বড় ঘটনা, আমি মা, আমাকে জানায় নি!

সুরাজ লজ্জা পেয়ে বলে, কী একেবার ঘটনা! মা যেন কী! আর দেখছি না বুঝি এ ঘটনা?

মুক্তকেশী বলে ওঠেন, দেখব না কেন? নিয়তই দেখছি। হাঁস-মুরগীর মত রাতদিন প্যাঁক প্যাঁক করে বংশ বৃদ্ধি হচ্ছে, দেখছি না? তার সঙ্গে আর তোর তুলনা করিস না মা!

সুরাজ লজ্জা পেয়ে চুপ করে।

কিন্তু সুরাজ এ সংসারে হাঁপিয়ে ওঠে। একদা যে এইখানেই থেকেছে সে, সে কথা যেন তার নিজেরও বিশ্বাস হয় না।

সুরাজের দাদারা কী স্কুল, কী অমার্জিত, কী সেকেলে! সুরাজের বৌদিরা যেন ঝি-চাকরানীর পর্যন্নুর রাজের ভাইপো-ভাইঝিগুলো যেন গোয়ালের গরু-ছাগল!

আশ্চর্য!

ভালভাবে থাকতে ইচ্ছে হয় না। এদের?

সেই কথাই জিজ্ঞেস করে সে।

বলে, সংসারে খরচ তো কম হতে দেখি না, অথচ সৌষ্ঠবের বালাই নেই কেন বল তো তোমাদের?

খরচ অবশ্য বড়লোক সুরাজের খাতিরে একটু অতিরিক্তই করা হচ্ছিল। বিরাজ এক ধরনের বড়লোক, এ আর এক ধরনের। বিরাজের কাছে চক্ষুলজ্জা নেই, এর কাছে সেটা আছে।

তবু লজ্জা কি বাঁচানো যাচ্ছে?

লজ্জা যে চতুর্দিকে ছড়ানো!

সুরাজ বলে, স্বামী ধমক দেবে। আর তাই সইতে হবে? কেন দড়ি কি নেই জগতে?

সুরাজ বলে, পড়ে মার খাও বলেই এত অত্যাচার তোমাদের ওপর। নিজের মানটি নিজে রাখতে হবে বাবা! সেজদাই বা হঠাৎ সংসারের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হল কেন তাও বুঝি না! আর মেজদার ওই সন্দেহবাতিক সহ্য কর কি করে মেজ বৌদি ভেবে পাই না। ধোবার সামনে বেরিয়েছিলে বলে। তোমায় যাচ্ছেতাই করলে মেজদা। আমি তো দেখে হ্যাঁ। আমি হলে কি করতাম জানো? ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে রাস্তার লোকের সঙ্গে গল্প করতাম।

সুবৰ্ণ এ ধরনের কথায় চুপ করেই থাকে। সুবর্ণ এই সহানুভূতির মধ্যে প্রচ্ছন্ন একটা অপমানের জ্বালা অনুভব করে। তা গিরিবালাও দণ্ডমুণ্ডের কর্ত প্রসঙ্গে জ্বালা অনুভব করছিল। তাই বলে ওঠে, ই, তা তো করতে! তার পর ঠেঙানিটা খেলে?

সুরাজ ভুরু কুঁচকে বলে, ঠেঙানি!

তবে না তো কি! ইহঁ, মেজ বড়ঠাকুরের তো সে গুণে ঘাট নেই! নিজে পড়েছ শিবতুল্য মানুষের হাতে–

সুরাজ সুবর্ণর মুখের দিকে তাকায়।

সুরাজ ভয় পায়।

তাই তাড়াতাড়ি বলে, আসল কথা কি জানো সেজবৌ, মাতৃনিন্দা মহাপাপ হলেও না বলে পারছি না, মার পৃষ্ঠবলেই এতটা হতে পেরেছে। মা টি তো আমার সোজা নয়! পুরুষ একলা পড়লেই পরিবারের কাছে জব্দ। মা দাদা ভাজ চারিদিকের পৃষ্ঠবলে এত বাড় বাড়ে তাদের। তোমাদের নন্দাইটি যে একলা পড়েছে কিনা তাই শিবতুল্য।

তখনকার মত রক্ষা হয়।

কিন্তু মুক্তকেশীই আবার আগুন জ্বলেন।

হেমাঙ্গিনী এসেছেন সুরাজকে দেখতে, মুক্তকেশী হেসে হেসে গলা খুলে মেয়ের বাসার সুখসমৃদ্ধির গল্প করেন, গল্প করেন বশংবদ জামাইয়ের আনুগত্যের কাহিনী।

সে কী বাড়ি! একেবারে সাহেব বাড়ি, বুঝলি হেমা? কোচ কেদারা, টেবিল আর্শি। কত কেতা! সুরিও আমার বেড়ায় যেন মেম! পায়ে জুতো-মোজা, বিলিতি ঢং করে কাপড় পরা। আর জামাইয়ের আমার… হি হি হি কী বলবো-অবস্থা যা! অত বড় একটা হোমরা চোমরা চাকুরে, সুরির কাছে যেন চোরটি! সুরির কথায় উঠছে বসছে, সুরি চোখ রাঙালে চোখে অন্ধকার দেখছে। দূরে থেকে শুনি, চোখে তো দেখা হয় নি, দেখে বলবো কি চোখ যেন জুড়োলো!

হঠাৎ এই জমাটি সভায় ছন্দপতন ঘটে।

হঠাৎ সুবৰ্ণলতা কোন দিকে থেকে যেন এসে প্রশ্ন করে, এসব দেখলে আপনার চোখ জুড়োয় মা?

মুক্তকেশী প্রথমটায় থতামত খান। তার পর কপাল কুঁচকে বলেন, কোন সব?

এই যে—পুরুষমানুষ স্ত্রীর কথায় উঠছে বসছে, স্ত্রী চোখ রাঙালে চোখে অন্ধকার দেখছে! তাছাড়া কোচ কেদারা টেবিল আর্শি-

মুক্তকেশী ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, কেন, শুনে বুঝি তোমার গা-জ্বালা করে উঠল মেজবৌমা? তা করবেই তো, হিংসের রীষে ভরা যে! বলি তোমরাই বা সোয়ামীকে কী ভ্যাড়াকান্ত করতে বাকী রেখেছ? সাধ যায় তো পরো জুতো-মেজো, খানা খাওগে টেবিলে বসে! ধন্যি বটে! আহ্লাদ করে দুটো গপূপো করতে এলাম, গায়ে যেন ছুঁচ ফুটলো মানুষের!

ছুঁচ কেন ফুটবে মা! সুবর্ণ উঠে পড়ে বলে, আহ্লাদের কথায় আহ্লাদই হয়। মনে হয় তবু বাংলা দেশের একটা মেয়েমানুষও মানুষের মত বাঁচিছে। তবে আপনাদের চোখে এসব মেমসাহেবী ভাল ঠেকে, এটা দেখেই আশ্চয্যি হচ্ছি!

মুক্তকেশী আর উচিত উত্তর খুঁজে পান না। সুবৰ্ণ চলে গেলে বলে ওঠেন, দেখলি তো হেমা, এই আগুনের খাপরা নিয়ে ঘর করছি আমি।

সর্বদা এই কথাই বলেন মুক্তকেশী।

সবাই তাই বলে।

আগুনের খাপরা।

কিন্তু সেই আগুন কানে জ্বালাতে পারলো সুবৰ্ণ? কী বা জ্বালালো? শুধু তো নিজেই জ্বলে জ্বলে ভস্ম হলো!

 

সুরাজের বরের চিঠি এল।

রঙিন খাম, আতরের গন্ধ, খামের কোণে বেগুনীরঙা একটি ছোট গোলাপ ফুল!

কত বছর বিয়ে হয়েছে সুরাজের?

সুবৰ্ণর থেকে বড় না সুরাজ?

সুরাজের নামের মানে নিয়ে যখন কৌতুকের হাসি হেসেছিল সুবর্ণ, তখন তো সুরাজের বিয়ে হয়ে গেছে।

সুরাজ লজ্জায় আনন্দে গৌরবে হেসে ফাটে। বলে, বুড়ো বয়সে ঢং দেখেছ? আসল কথা বিয়ে হয়ে ইস্তক তো ইস্তিরী গলায় ঝুলছে, এদিকে সখের প্রাণ গড়ের মাঠ! তাই নতুন বরের মত—

চিঠিখানা নিয়ে সরে পড়ে সুরাজ আতর আর আদরের সৌরভ ছড়িয়ে!

গিরিবালা বলে, পয়সা থাকলেই আদিখ্যেতা শোভা পায়।

বিন্দু বলে, শোভা পায় আর বোলো না। সেজদি, হাসি পায় তাই বল!

উমাশশী বলে, সেজ ঠাকুরজামাই তোমাদের ভাসুরের চাইতে মাত্তর দু বছরের ছোট।

হয়তো ওইতেই অনেক কিছু বলা হয়।

শুধু সুবর্ণ কিছু বলে না।

সুবৰ্ণকে কে যেন আচমকা এক ঘা চাবুক মেরে গেছে।

সত্যিই কি তবে হিংসুটে হয়ে যাচ্ছে সুবৰ্ণ?

সৌভাগ্যের অনেক লীলা দেখিয়ে বিদায় নিল সুরাজ। শেষের দুদিন যে আবার বরও এসেছিল নিয়ে যেতে।

বড়লোক বোনাইকে তোয়াজ করতে অনেক ব্যয় করে ফেললে মুক্তকেশীর ছেলেরা। কারণ সুরাজের বর ভাবেন সাহেবের আগমন উপলক্ষে আরও তিন মেয়ে-জামাইকে নেমন্তন্ন করে আনলেন। মুক্তকেশী। সুবালা তো পড়ে থাকে চাপতীয়, সাতজন্মে আনবার কথা মুখেও আনেন না, কারণ তার একপাল এণ্ডি গেণ্ডি। আবার আনলেন।

মুক্তকেশী সবাইকে ডেকে ডেকে বলেন, লক্ষ্মীর ঘরে যষ্ঠীর কৃপা কম, এ হচ্ছে ডাকের বচন। দেখ তার সাক্ষী সর। বললাম। এ দুটো মাস থাক আমার কাছে, একেবারে খালাস হয়ে তবে যাস! জামাইও রাজী হয়েছিলেন, বরসোহাগী মেয়েই আমার থাকতে পারলেন না-বর ছেড়ে!

সুরাজ চুপিচুপি সুবৰ্ণকে বলে, মোটেই তা নয় বাবা, মায়ের এই দাপটের বহরে থাকবার বাসনা মিটে গেছে আমার। অন্যকে নিচু করে আমায় বড় করা, এ বাপু অসহ্য!

তা সেই অসহ্যটুকু শেষ পর্যন্তই করতে হল সুরাজকে। ভবেনকে নিয়ে আদিখ্যেতার বাড়াবাড়ি করলেন মুক্তকেশী। যাত্রাকালে শুধু মেয়েকেই ভাল ফরাসডাঙার শাড়ি দিলেন তা নয়, জামাইকে কাঁচির ধুতি-চাদর দিলেন।

দিলেন সুবালা আর সুবালার বরকেও, দিলেন মিলের ধুতি-শাড়ি।

তবু খরচপত্র হয়ে গেল বিস্তর।

দিলেন সঙ্গে।

আর শেষ অবধি হয়তো হাফ ছেড়েই বাঁচলেন।

সুবালার ইচ্ছে ছিল কটা দিন থাকে।

কিন্তু পাঁজি-পুথি না দেখে আদিনে এসেছে এই ছুতোয় তাকে ভাগালেন মুক্তকেশী।

তারপর–

হ্যাঁ, তার পরদিনই সন্ধ্যাবেলা ছেলেদের ডেকে সংকল্পটা ঘোষণা করলেন মুক্তকেশী।

বললেন, আমার তীর্থখরচ তো ডবল লাগল-শশধরের মার কাছে একশোখানি টাকা হাওলাৎ নিয়ে তবে পাণ্ডার কাছে মুখর ক্ষে। সে কার্জ শোধ করতে হবে। তারপর তোমাদের এই বোনভগ্নীপোত আনাআনি। খরচের খরচান্ত! বৌ-ছেলেদের মাস দুচ্চারের মতন বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দে। দিকি। দেনাপত্তর শোধ করে, একটু গুছিয়ে নিয়ে তাপর আনিস!

শুনে ভাইয়েরা মুখ-চাওয়াচাওয়ি করল।

সুবোধের তো শ্বশুরবাড়ি বলতে অষ্টরস্তা। শাশুড়ীই কখনো ভাইয়ের বাড়ি, কখনো দ্যাওরের বাড়ি, কখনো বোনঝির বাড়ি!

আর প্রবোধ?

তার যে একটা শ্বশুরবাড়ি আছে, সে কথা কে কবে মনে রেখেছে?

প্রভাসের অবশ্য ভাল শ্বশুরবাড়িই আছে, প্রকাশেরও আছে একটা যেমন তেমন কিন্তু প্ৰস্তাবটা কারো কাছেই প্ৰীতিকর ঠেকে না। তবু মায়ের কথার প্রতিবাদ চলে এ তারা ভাবতেই পারে না।

স্বৰ্গাদপি গরীয়সী বলে কথা!

ন্যায় বলুন, অন্যায় বলুন, মাথা পেতে নিতে হবে আদেশ।

কে জানে বৌয়েরা এ প্রস্তাব কোন আলোয় নেবে! ইদানীং তো বৌগুলো যখন-তখনই বলতে শুরু করেছে, এতই যদি মাতৃভক্তি, মায়ের আঁচলতলায় খোকা হয়ে থাকলেই পারতে! বিয়ে করে সংসার পাতবার সাধ হয়েছিল কেন?

যখন-তখনই বলে।

ধমকে ঠাণ্ডা করা যায় না।

এ এক বিড়ম্বনা।

মাতৃভক্তি আর বিয়ে, এই দুটোর মধ্যে যে কখনো বিরোধ ঘটতে পারে, এটা কে কবে ভেবেছিল?

সে যাক, নেপথ্যের চিন্তা পরে, আপাতত সামনে মা। ছেলেরা তাই নিতান্ত বাধ্য ভাবে বলে, তুমি যা ভাল বুঝবে।

আমি তো ভাল বুঝেই বলছি। তবে তোমরা এখন সব বিজ্ঞ হয়েছ

হঠাৎ প্ৰবোধচন্দ্ৰ ইতস্ততঃ করে বলে ওঠে, আমার আর শ্বশুরবাড়ি!

মুক্তকেশী বলেন, তা জানি। থেকেও নেই। অথচ শ্বশুর মিনসে নাকি এখনও চাকরি করছে, দুই শালা মান্যিমান হয়েছে। ছোটটা তো আবার বিয়েও করে নি, বিদেশে থাকে, টাকা পাঠায়। সেই যে বলে না, আছে। গরু না বয় হাল, তার দুঃখু চিরকাল এ হয়েছে তাই।

প্ৰবোধ এসব তথ্যে অবাক হয়।

শ্বশুরবাড়ি নামক এক জায়গা যে তার আছে, এ প্রমাণ পাবার সুযোগ পায় নি সে। শাশুড়ীর কলঙ্ক-কথা সহজ ধারার মুখে পাথর চাপিয়ে দিয়েছিল। প্রথমে সেই একবার শ্বশুর নিতে এসেছিল, মুক্তকেশী যাচ্ছেতাই করে বিদায় করেছিলেন। তার পর আরও কি উপলক্ষে যেন নেমন্তন্ন করতে এসেছিল। পাঠানো হয় নি। আগে আসতো এক-আধা দিন, আর আসে না।

তদবধি সব সম্পর্ক শেষ।

জীবনে কোনোদিন উচ্চারণ করে নি সুবর্ণ–বাবার জন্যে মন কেমন করছে অথবা একবার তাদের না দেখে থাকতে পারছি না।

এখন হঠাৎ মুক্তকেশীর মুখে তাদের তত্ত্ব-বার্তা!

প্ৰবোধ বোধ করি ক্ষীণকণ্ঠে একবার বলে, কে বললো তোমায়?

মুক্তকেশী গম্ভীরভাবে বলেন, তোদের মাকে কারুর কিছু বলে যেতে হয় না, হাওয়ায় খবর পায়। মেজ বৌমার সেই পিসি বুড়ীর একটা সতীন-ঝি যে আমাদের হেমার ছেলের শালীর শাশুড়ী। সেই সূত্রেই খবর!

পিসি, সতীন-বি, শালী, শাশুড়ী! এই সম্পর্কের জটিলতার জাল-মুক্ত হবার চেষ্টা করে না। প্ৰবোধ। শুধু সাহসে ভর করে বলে ফেলে, তা ওরা তো সাতজন্মে নিয়ে যাবার কথা বলে না—

বলবে কে? মা আছে? তোমরা গরুড়ধ্বজা শাশুড়ীর গুণে উভয় কুল মজিলো! যাক গে, নিয়ে যাবার কথা বলার অভ্যোস ওদের নেই, তাই বলে না। তুই যাবি, বৌকে রেখে আসবি!

এবার প্রবোধের হয়ে সুবোধ হাল ধরে, কিন্তু মা, ওরা যখন বলে নি, তখন—

কথা শেষ করতে দেননি। মুক্তকেশী। বলে ওঠেন, তা ওরা কেমন করে জানবে যে তোমাদের দেনা-কর্জ হয়ে গেছে, বেপোটে পড়েছ? তোমাদের শালা শ্বশুরেরা খড়ি পাততে পারে, এ খবর পেয়েছ। কোনোদিন?

তা-নয়, মানে—, প্ৰবোধ প্ৰায় মরীয়া হয়েই বলে ফেলে, সাতজনে বলে না, হঠাৎ এরকম উপযাচক হয়ে—

মুক্তকেশী ছেলের বক্তব্যকে সম্পূর্ণতার রূপ দিতে দিলেন না, বলে উঠলেন, উপযাচক হয়ে পাঠিয়ে দিলে তাড়িয়ে দেবে, এ ভয় যদি থাকে তোমার তা হলে অবিশ্যি পাঠাবার কথা ওঠে না। তবে চিরকাল জানি বিয়েওলা মেয়ে আরাধনার সামগ্ৰী, বাপের বাড়ি গেলে বাপ-ভাই মাথায় করে রাখে।

তবে তাই হবে–

বলে ছেলেরা তখনকার মত রণে ভঙ্গ দেয়। কারণ অনুভব তো করছে, নেপথ্যে জোড়া তিনেক কান উৎকৰ্ণ হয়ে আছে। তাদের মুখ বন্ধ করে রাখবার কার্যকরী পদ্ধতিটা যেন আজকাল আর তেমন কাজে লাগছে না।

এই বিদ্রোহাত্মক মনোভাবের আমদানিকারিণী যে সুবৰ্ণলতা, তাতে অবশ্য সন্দেহ নেই। সেজ ছোট ভাই তাই প্রতিনিয়ত সুবৰ্ণলতাকে শাপশাপান্ত করছে মনে মনে।

কিন্তু তাতে তো শুধু গায়ের ঝাল মেটানো। সংক্রামক ব্যাধি আপনি কাজ করেই যাবে।

কর্তারা অদৃশ্য হতেই নেপথ্যাচারিণীরা রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলেন।

বৌরা যে কাছে-পিঠে কোথাও আছে, এটা মুক্তকেশী আন্দাজ করেছিলেন। ভেবেছিলেন, ভালই, জানা হয়ে থাক। সামনে এসে তো আর প্রতিবাদ করতে পারেন না!

আর প্রতিবাদই বা করবে। কি!

বাপের বাড়ি যাবার সুযোগ পেলে তো বর্তেই যাবে। অবশ্য বড়বৌকে তিনি সবাইয়ের সঙ্গে ধরে সমাদৃষ্টির পরাকাষ্টা দেখালেও, মনে মনে তাকে ধর্তব্য করেন নি। তাকে পাঠাবেন না। কাৰ্যকালে কোনো ছুতো করবেন।

একযোগে সবাই চলে গেলে চলবে কেন?

মুক্তকেশী কি গুরুগঙ্গা ছেড়ে এখন ছেলেদের অফিসের ভাত রাঁধতে বসবেন? বড়বৌ গেলে অচল। যেদিকে জল পড়ে সেদিকে ছাতি ধরে সে। অথচ আত্মভোলা উদোমাদা। বাড়ির পিপড়েটাকে পর্যন্ত ভয় করে চলে। ও থাকবে।

মেজ সেজ ছোটকেই পাঠাতে হবে।

আহ্লাদে নাচবে। সেজ ছোট নাচবেই। তবে—

ওই মেজটার ব্যাপার সন্দেহজনক।

ওর মাতিবুদ্ধি কোনোদিনই স্বাভাবিক খাতে বয় না। হয়তো বা দুম করে বলে বসবে—আমি যাব না।

বৌদের এদিকে আসতে দেখেই মুক্তকেশী গম্ভীর চালে সলতে পাকাতে বসলেন। সলতে তো সংসারে কম লাগে না। ঘরে ঘরে হিসেব করলে, কোন না। দশ-বারোটা পিদিম জ্বলে! কেরোসিনের চলন অন্য কোথাও যদি হয়েও থাকে, মুক্তকেশীর অন্দরে তার প্রবেশ নিষেধ। নতুন আলোর পক্ষপাতী নন। মুক্তকেশী।

গিরিবালা এসেই সুয়োর গলায় বলে, ওসব রাখুন। না মা। আপনি কেন কষ্ট করছেন? সালতে পাকাতে কেউ না সময় পায়, আমি পাকিয়ে রাখবো।

মুক্তকেশী একটু উদাস হাসি হেসে বলেন, তোমরা কচিকাঁচার মা, বললে করবো, হয়তো সময় পেলে না! অসময়ে অসুবিধেয় পড়া তো।

ফস করে গিরিবালার হয়ে কথার উত্তর দেয় সুবৰ্ণলতা, কেন, আমরা কি কিছু করি না?

মুক্তকেশী বহুবার ওর দুঃসাহস দেখেছেন, তবুও কেন যে চমকান? চমকে উঠেই পরীক্ষণে ঠোটের আগায় একচিলতে ধনিলঙ্কার ঝালমাখানো হাসি এনে বলেন, করো না কে বলছে গো! তোমরাই তো সংসার মাথায় করে রেখেছি। তবে আমিই বা বসে থাকি কেন? দুটো সলতে পাকিয়েও যদি উপকার না করবো তো ছেলেদের ভাতগুলো খাবো কোন লজ্জায়?

সুবৰ্ণলতা এতখানি রাগ প্রকাশের পরও বলে, এ আপনার রাগের কথা। সে যাক আমাদের বাপের বাড়ি পাঠাবার কি যেন কথা হচ্ছিল!

মুক্তকেশীর হাতের পীড়নে ছেঁড়া ন্যাকড়ার টুকরোগুলো কাঠির মত কঠিন হয়ে উঠেছে, আরো কঠিন হয়ে উঠছে তার চোয়ালের মাংসপেশী। সেই মুখের উপর্যুক্ত নীরস স্বরেই বলেন তিনি, যাদের কাছে বলবার বলা হয়ে গেছে বাছা, এক কথা পাঁচবার বলার সামর্থ্য আমার নেই।

এতো কঠিন হবার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু তবুও প্রয়োজন আছে। ওটাই তো আশ্রয়। ওটাই পা রাখবার জায়গা। নইলে কি আর সংসার-পর্বতের চূড়োর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা যায়? ভয় দেখিয়েই সবাইকে পদানত করে রাখা। ভয় ভাঙা হলে চুড়ো থেকে গড়িয়ে পড়ে যেতে হবে কি না। কে জানে!

ভক্তির প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামান না মুক্তকেশী, ভালবাসার তো নয়ই। তাঁর মতে এই-ই ভাল। শনি দেবতার পূজোয় উপচারের ক্রটি করবার সাহস কারো হবে না।

কঠিন মুখে সলতেই পাকাতে থাকেন মুক্তকেশী। জলজ্যান্ত মানুষগুলো যে দাঁড়িয়ে আছে সে সম্পর্কে যেন চেতনাই নেই।

জানেন এ মুখের সামনে সুবৰ্ণলতারও কথা বলবার সাহস হবে না। সাহস হবে না। অবশ্য বকুনির ভয়ে নয়, মানহানির ভয়ে। কথা বললে যদি সে কথার উত্তর না দেন মুক্তকেশী?

সে অপমান যে সুবৰ্ণলতার মরণাতুল্য, সে কথা জানেন মুক্তকেশী। সে মরণ দিতে চানও মাঝে মাঝে। কিন্তু তাঁর নিজের বাকযন্ত্রই বিশ্বাসঘাতকতা করে। করে না বলে থাকতে পারেন না। তিনি।

বিন্দু আর গিরিবালা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল বাপের বাড়ি যাবার প্রস্তাবটা পাকা করার জন্যে। কে বলতে পারে আবার মেজাজ ঘুরে যায়। কিনা গিন্নীর!

নিজেই তো মুক্তকেশী সব সময় বৌদের বাপের বাড়ি যাওয়ার প্রতিবন্ধকতা করেন।

এবারই বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে। এবারই মুক্তকেশী সুর বদলেছেন।

এমন সুযোগ আবার না ফসকে যায়!

ওরা, তাই অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল কথা পাকা করতে। কিন্তু আপাতত সুবিধে হল না। চলে গেল আস্তে আস্তে।

চলে গেল সুবৰ্ণলতাও।

কিন্তু সে কি আস্তে আস্তে?

সে কি আশায় আশায়?

 

কিন্তু উল্টোপাল্টা সুবৰ্ণলতা সম্পর্কে যা ভেবেছিলেন মুক্তকেশী, তাই-ই হল। সুবর্ণ ঠিকরে এসে বলল, আমি যাব না।

প্ৰবোধও অবশ্য এ আশঙ্কা করেছিল, এবং মনে মনে কণ্টকিতও হচ্ছিল, তবু মুখে অবহেলা দেখিয়ে বললো, কেন? যাবে না কেন?

যাবো কেন, সেটাই শুনতে চাই!

প্ৰবোধ কড়া হবার চেষ্টা করে বলে, ঘটা করে শোনবার কী আছে? একদা একটা কিছু ঘটেছে বলে চিরদিনের জন্যে কুটুম্বুর সঙ্গে বিরোধ রাখাই বুঝি মহত্ত্ব?

মহত্ত্ব করতে তো চাইছে না কেউ!

প্ৰবোধ তীব্ৰস্বরে বলে, মা চাইছেন। মা মহত্ত্বের বশে সেটা মিটোতে চাইছেন।

আমি চাই না।

তোমার বাপ-ভাইয়ের সঙ্গে ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগা চাইছ না। তুমি?

না।

নমস্কার! ক্ষুরে ক্ষুরে নমস্কার তোমার!

সুবৰ্ণ অন্যদিকে চেয়ে বলে, সে তো করছেই। রাতদিনই করছে। নতুন নয়। প্ৰবোধ গলাটা নরম করে কাৰ্যোদ্ধার করবার চেষ্টা করে। মার কানে এই কথা কাটাকাটির আভাস গেলে তো আর রক্ষা নেই।

অবশ্য মায়ের এই আকস্মিক খেয়ালটার কারণ সে বুঝতে পারছে না, এবং সে খেয়ালে বিপন্ন হচ্ছে। ধারণা করতে পারছে না—এ হচ্ছে নির্বুদ্ধির টেকি নামধারিণী হেমাঙ্গিনীর।

হ্যাঁ, হেমাঙ্গিনীই বলেছে, ওই দজাল পরিবারকে তো তোর পেবো মাথায় করে নাচে, বলি সদা-সর্বদা অতি দাপট সয়ে থাকিস কি করে? বৌ তো একন্দোরী!

মুক্তকেশী বলেছিলেন, কী করবো বল? অসহ্য হলে বেটার বৌকে লোকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়, আমার তো ওর বেলায় সুখ হবার জো নেই। সদা-সর্বদাই বুকের ওপর আগুনের মালসা নিয়ে বসে আছি।

হেমাঙ্গিনীই তখন এই পরামর্শ দিয়েছিলো, বিরোধ মিটিয়ে ফেল! জিদ নিয়ে কি ধুয়ে জল খাবি? আর সত্যি তো তোর বেয়ানমাগী কুচরিত্তির নয়! কাশীতে আছে, শুনি নাকি ডাটের ওপর আছে। বাপের পয়সা খায় না, খোট্টাদের ছেলেমেয়েকে বাংলা, ইংরিজি পড়িয়ে মাইনে নেয়, সেই পয়সার চালায়। তুই বাপু তোর মেজবৌয়ের বাপের বাড়িটাকে এবার জাতে তোলা। তুইও দুদিন হাফ ফেলে বাচ, মহারাণীও দুদিন বাপ-ভাইয়ের ওপর দাপট করে আসুক!

অতএব এই জাতে তোলার প্রয়াস!

কিন্তু সে প্রয়াসে যার বর্তে যাবার কথা, সে-ই বাদী হচ্ছে! বলছে, আমি চাই না। তার মানে মেয়েমানুষ নয়, পাষাণী!

প্ৰবোধকে অতএব অবাক হয়ে বলতে হয়, আশ্চর্য!

সুবৰ্ণ তীক্ষ্ণ গলায় বলে, ওঃ, এইটুকুতেই আশ্চর্য হচ্ছে তুমি? তা হতে পার, তোমাদের অসাধ্য কাজ নেই। তবে ভাবছি—এত বছর বিয়ে হয়েছে, বাপ-ভাইয়ের চেহারা কেমন তা ভুলে গেছি, এখন উপযাচক হয়ে বৌ পৌঁছে দিয়ে আসতে মাথা কাটা যাবে না তোমাদের?

মাথা যে একেবারেই কাটা যাচ্ছিল না তা নয়। তবু আর একজন যে প্রত্যক্ষ হাতে মাথা কাটবার জন্যে খাঁড়া শানিয়ে বসে। সে ভয়ের তুল্য ভয় আছে?

তাই প্ৰবোধকে উদার সাজতে হয়। বলতে হয়, মায়ের মাতিবুদ্ধিতে এতদিন তো কষ্ট পেলে, এখন বাপ বুড়ো হয়েছেন, কবে আছেন। কবে নেই, যাওয়া-আসাটা বজায় করাই তো ভাল।

তোমাদের ভালর সঙ্গে আমার ভাল মেলে না—, সুবর্ণ উদ্ধতভাবে বলে, মোট কথা আমি যাব না।

প্ৰবোধ হাসির চেষ্টা করে বলে, যাবো না বললে আর চলছে কোথা? হাইকোর্টের হুকুম যে বেরিয়ে গেছে!

সুবৰ্ণলতা এক মুহূর্ত স্তব্ধ থেকে বলে, আমি যদি সে হুকুম না মানি?

যদি না মানি! মার হুকুম তুমি মানবে না!

ন্যায্য হুকুম হলে অবশ্যই মানবো, অন্যায্য হুকুম হলে নয়।

প্ৰবোধ রূঢ় গলায় বলে, মার ন্যায্য-অন্যায্যের বিচার করবে তুমি?

করবো না কেন? মানুষ হয়ে যখন জন্মেছি, ভগবান যখন চোখ কান, মন বুদ্ধি দিয়েছে—

এ কথায় প্ৰবোধ রীতিমতো ক্রুদ্ধ হয়। বলে, মানুষ হয়ে জন্মেছ, তাই প্রতি পদে গুরুজনদের ব্যাখ্যানা করবে, কেমন? পায়ে মাথায় এক হয় না, বুঝলে?

তোমার সঙ্গে তর্ক করবার বাসনা আমার নেই। তবে তোমার মাকে বলে দাও গে, এতকাল পরে হঠাৎ বাপের বাড়ি আমি যাব না।

প্ৰবোধ আরো ক্রুদ্ধ। গলায় বলে, ইচ্ছে হয় নিজে গিয়ে বল গে, আমি বলতে পারবো না। আশ্চর্য, এমন বেহায়া মেয়েমানুষ কখনো দেখি নি! কত ভাগ্যে যদি মার মত হল—

দোহাই তোমার, ভাগ্যের কথাটা থামাও। বেশ, অত ভাগ্যের ভার বইবার ক্ষমতা আমার নেই, তাই ধরে নাও! মনে পড়ে পিসি একবার চিঠি লিখেছিল, বাবার শক্ত অসুখ, সে চিঠি তোমরা ছিঁড়ে ফেলেছিলে? মনে পড়ে ছোড়দা একবার দাদার মেয়ের অন্নপ্রাশনে নেমন্তন করতে এসেছিল, তোমরা তাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে দাও নি, দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলে?

প্ৰবোধ সদৰ্পে বলে, তা রাগের ক্ষেত্রে মানুষ অমন করেই থাকে!

রাগের ক্ষেত্রটা হঠাৎ শ্ৰীক্ষেত্র হয়ে যাচ্ছে কি জন্যেই সেটাই জানতে চাইছি।

প্ৰবোধ হঠাৎ একটা অসতর্ক উক্তি করে বসে। বলে ফেলে, আমি বলি নি বাবা, আমার ইচ্ছেও ছিল না। মার হুকুম, কী করবো!

সুবৰ্ণলতা একবার স্বামীর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলে, ঠিক আছে। আমিই হুকুম রদ করিয়ে আনছি।

খবরদার মেজবৌ—, প্ৰবোধ হাঁ-হাঁ করে ওঠে, ইচ্ছে করে আগুন খেতে যেও না। জেনে—শুনে সাপের গর্তে হাত দিও না।

সাপের বিষেই তো জরজর হয়ে আছি, এর থেকে আর বেশি কি হবে! বলে সুবৰ্ণলতা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

নিরুৎপায় প্ৰবোধচন্দ্র ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে থাকে। সাহস হয় না। দালানে বার হতে। কি জানি কি সর্বনাশ ঘটাতে গেল সুবৰ্ণলতা!

হ্যাঁ, তখনো এ ভয় ছিল।

তখনো বহুবিধ সর্বনাশ ঘটিয়ে ঘটিয়ে ঘাটা পড়ায় নি। সুবর্ণ। তাই তখনও প্ৰবোধ ভাবতে পারতো, মেয়েমানুষ হয়ে কী ভয়ানক বুকের পাটা মেজবৌয়ের!

মুক্তকেশীও যে মেয়েমানুষই, এ তথ্যটা আবিষ্কার করে ফেলার মতো দুঃসাহস ওদের নেই।

জননী জন্মভূমিশ্চ স্বৰ্গাদপি গরীয়সী!

জন্মভূমির বার্তা প্ৰবোধচন্দ্রদের সংস্কৃতিতে কখনো প্রবেশ করে নি, ওরা শুধু একজনকেই জানে। জানে তার ইচ্ছে আইন, তার আদেশই অলঙ্ঘ্য। হবে না!

লঙ্ঘন করার চিন্তার ধারে-কাছে কারো ছায়া দেখলেই যে মুক্তকেশী বলে বসেন, থাকবো না, চলে যাবো! বার্ধক্যে বারাণসী এ কথা ভুলে বসে আছি বলেই এত হেনস্থা আমার!

ওদিকে স্ত্রীও ছেড়ে কথা কয় না।

উঃ, পুরুষমানুষ হয়ে জন্মানোর কত জ্বালা!

কতক্ষণ পরে যেন চমক ভাঙলো ভাইঝি মল্লিকার ডাকে।

মল্লিকা উচ্চ চিৎকার হাঁক দিয়েছে, মেজকাকা, জলদি! ঠাকুমা ডাকে—

আমাকে? আমাকে কেন?

মল্লিকা খরখর করে বলে, তা জানি না! মেজকাকী গিয়ে ঠাকুমাকে সাতকথা শুনিয়ে দিয়েছে, তাই বোধ হয়!

প্ৰবোধ কাতর গলায় বলে, মল্লিকা, লক্ষ্মী মা আমার, বল গে। মেজকাকা বাড়ি নেই।

বাঃ, বললেই অমনি হলো? এইমাত্তর আরু তোমায় দেখে গেল না?

তবে যা, বল গে এইমাত্তর—ইয়ে কলঘরে ঢুকেছে।

আমি বাবা মিথ্যে-টিথ্যে বলতে পারবো না, ইচ্ছে হয় যাবে, না ইচ্ছে হয় না যাবে! বলে ধৰ্মপুত্রের মহিলা সংস্করণ মল্লিকা ধর্মের মহিমা বিকীর্ণ করে চলে যায়। মনে হয় একটা গিন্নী!

অগত্যাই যেতে হয় প্ৰবোধকে বলির পাঁঠার গতিভঙ্গী নিয়ে।

মুক্তকেশী ছেলেকে দেখে জলদগম্ভীরে বলেন, বাবা প্ৰবোধ! মুখ্যু মেয়েমানুষ, একটা অসঙ্গত কথা না হয় বলেই ফেলেছি, ঘাট মানছি তার জন্যে। কিন্তু অপরাধের শাস্তি দিতে নিজে তুমি ধরে সাত ঘা জুতো মারলে না কেন আমায়? বৌকে দিয়ে এই অপমানটা করানোর চাইতে সে অনেক ভাল ছিল!

মা! প্ৰবোধচন্দ্ৰ প্ৰায় আছড়ে মায়ের পায়ের কাছে পড়ে বলে মা, তোমাকে অপমান করার সাহস যার হয়েছে জুতো তারই খাওয়া উচিত! কোথায় সে! এখনি একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক।

মুক্তকেশী অবশ্যই একটু প্রীত হন।

নচেৎ তুমি ছেড়ে তুই ধরতেন না।

বলেন, থাম পেবো! বীরত্বের বড়াই আর করিস নে। এদিকে তো বৌয়ের ভয়ে কেঁচো হয়ে গুটিয়ে যাস! পুরুষের হিম্মত যদি থাকতো তোর, তোর বৌ এমন দুঃশাসন হয়ে উঠত না!

প্ৰবোধচন্দ্ৰ জননীর এই ধিক্কারবাক্যে সহসা দুঃশাসন-শাসক ভীমমূর্তি ধারণ করে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, মল্লিকা, ডেকে আন তোর মেজকাকীকে! সোজায় না আসে চুলে ধরে নিয়ে আয়!

মুক্তকেশীর কুলিশকঠোর ওষ্ঠ্যাধরের ফাঁকে বোধ হয় ক্ষীণ একটু হাসির আভাস দেখা যায়। কিন্তু সেটুকু দমন করে ফেলে বলেন, থাক বাছা, কেলেঙ্কারিতে আর কোজ নেই। যে যেমন আছে থাক। আমাকে তোমরা আজই কাশী পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা কর। বেটার বোয়ের লাথি খেয়ে সংসার কামড়ে পড়ে থাকবার প্রবৃত্তি আমার নেই।

কিন্তু মুক্তকেশীর কথা শেষ হতে না হতেই ঘরের মধ্যেই কি কেউ দাগলো? না হলে সবাই আমন চমকে উঠল। কেন?

বোমা না হলেও বোমার মতনই শক্তিশালী! মৃদু অথচ তীক্ষ্ম একটি প্রতিবাদ!

অপমান আমি কাউকে করি নি। কথার জোরে, নয়কে হয় করলে কী করবো!

বললো।

বললো এই কথা সুবৰ্ণলতা।

বরের সামনে, বড় বড় দ্যাওরদের সামনে, স্পষ্ট গলায় শাশুড়ীর কথার প্রতিবাদ করলো।

বজ্রাহত ভাবটা কাটলে মুক্তকেশী একটু তিক্ত হাসি হেসে বলেন, এর পরও আর তোমরা আমায় এ সংসারে থাকতে বল বাবা? না হয়। আমি তোমাদের শাখা-চুড়ি পরা মা নয়, তবু মা তো—

বড়বৌ!

হঠাৎ যেন ঘুমন্ত বাঘ গর্জন করে উঠল, বড়বৌ! বড়বৌ! চিৎকারে বাড়ি থরথরিয়ে ওঠে।

দোষ করেছে মেজবৌ, ডাক কেন বড়বৌকে?

কেউ বুঝতে পারে না।

সবাই থারথার করে।

বড়বৌ তো মেজ দ্যাওরের সঙ্গে কথাও কয় না। তথাপি এই ডাকের পর বসেও থাকতে পারে না। রণস্থলে হাজির হয়ে ঘোমটা দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে।

প্ৰবোধচন্দ্ৰ উত্তেজিতভাবে বলে, বড়বৌ, তোমাদের মেজবৌকে বল মার পায়ে ধরে ক্ষমা চাক!

ওঃ, তাই!

তাই বড়বৌ!

মায়ের সামনে সরাসরি স্ত্রীকে সম্বোধন করে চলে না, তাই বড়বৌকে মাধ্যম করা!

অবশ্য আশা ছিল বড়বৌকে আর কষ্ট স্বীকার করতে হবে না, এই হুমকিই যথেষ্ট। কিন্তু আশ্চর্য কাণ্ড! এত বড় তর্জনের পরও কাঠের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে রইল সুবৰ্ণলতা।

বড়বৌ, ওকে ঘাড় ধরে ক্ষমা চাওয়াও।

উমাশশী কাছে এসে মৃদুস্বরে বলে, সঙ্গের মতন দাঁড়িয়ে রাইলি কেন মেজবৌ? যা, মাপ চা!

সুবৰ্ণলতা মুখ তুলে উমাশশীর দিকে তাকালো। আর সে দৃষ্টিতে উমাশশী যেন হিম হয়ে গেল। শাশুড়ী ফ্রাধের অনেক ভয়াবহ দৃষ্টি দেখার অভ্যাস আছে তার, এমন চাউনি কখনো দেখে নি।

এ কী!

সুবৰ্ণলতা কি পাগল হয়ে গেল?

এ যে স্পষ্ট পাগলের চোখ!

সেই চোখ তুলে সুবৰ্ণলতা তীব্ৰস্বরে বলে, কেন?

মাপ চাইব কেন? উমাশশী বলে, চাইলেই তো সব গোল মিটে যায় ভাই। বল্‌—বল লক্ষ্মীটি, মা, যা বলেছি, না বুঝে বলেছি।

কিন্তু উমাশশীদের হিসেবমত গোল মিটোতে পারলে তো পৃথিবীটাই সমতল হয়ে যেত। তা হয় না।

সুবৰ্ণলতার মুখ দিয়ে সে কথা বার করানো যায় না। সুবৰ্ণলতা বলে, না। বুঝে তো বলি নি, বুঝেই বলেছি।

হ্যাঁ, বুঝেই বলেছে সুবৰ্ণ শাশুড়ীকে, বাবার সঙ্গে সম্পর্ক তুলে দিয়ে রাখা হয়েছে, বাবা যখন উদ্দিশ করেছেন, তখন দূর-দূর করে খেঁদিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর এখন নিজের সংসারে ভাতের আকাল হয়েছে বলে ঠেলে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে! খুব তো মানের বড়াই, কাকে মান বলে, কাকে অপমান বলে, সে জ্ঞান নেই!

বলেছিল।

আবার এখন বলছে, না বুঝে বলি নি!

অবাক হয়ে গিয়েছিল বাড়ির প্রতিটি সদস্য। এমন কি সুবোধও। বিরক্ত হয়ে বলেছিল, পেবোটা শিক্ষা-সহবৎ দিতে জানে না।

আর মুক্তকেশী?

মুক্তকেশী শুধু স্তম্ভিতই হন নি, যেন একটু ভয়ও পেয়েছিলেন। একটা ভয়াবহ ভবিষ্যৎ যেন দাঁত খিঁচিয়ে উঁকি মারছে তাঁর জীবনের সীমানা-প্রাচীরের ওধার থেকে। পড়বে বুঝি লাফিয়ে!

যাক তবু এখুনি সে ভয়কে আমল দেবার দরকার নেই। ঘরের খিল-হুড়কো আছে মজবুত। ছেলেরা আজও মায়ের পদানত। আজও একটা বৌকে দূর করে দিয়ে ছেলের আর একটা বিয়ে দিতে পারেন মুক্তকেশী!চ

প্রভাস বলেছে, ওকালতি করছি, কোর্ট-কাছারি দেখছি, ভদ্রঘরের মেয়ে যে এমন বে-সহবৎ হয়, এ ধারণা ছিল না। এ সমস্তই মেজদার বুদ্ধিহীনতার ফল! মেয়েমানুষকে কখনো আস্কারা দিতে আছে? সর্বদা চোখরাঙানির নিচে রাখলে তবে শায়েস্তা থাকে।

প্রকাশ বলেছে, পয়সা দিয়ে আর এস্টারে গিয়ে থিয়েটার দেখতে হবে আমাদের, বাড়ি বসেই অনেক থিয়েটার দেখতে পাওয়া যাবে। বিয়েটা জব্বর করেছিল মেজদা!

 

ক্ষিপ্ত মেজদা অতএব বৌ শায়েস্তা করবার ভার নেয়। থার্ড ক্লাস ঘোড়ার গাড়ি একখানা ডেকে আনে।

যে গাড়িতে চাপিয়ে এ বাড়ির মেজবৌকে নির্বাসন দেওয়া হবে। মেজবৌ যাবে একা, একবস্ত্ৰে। মেয়েটা আর ছেলে দুটো থাকবে এ বাড়িতে। তারা এ বংশের। সুবৰ্ণলতার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখা হবে না।

যদি কোনোদিন পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে চিঠি লেখে, তবেই হয়তো আবার ওদের মুখ দেখাতে পারবে সুবর্ণ। নচেৎ এ বাড়ির অন্নজলের বরাত উঠল। ওর। বরাত উঠল স্বামী-সন্তানের সঙ্গর।

আড়ালে-আবডালে সবাই প্ৰবোধকে স্ত্রৈণ বলে। দেখুক আজ তারা।

নিজেই বনবাস দিয়ে আসবে সীতাকে।

মুক্তকেশী। কিন্তু এ ভূমিকায় নেই।

মুক্তকেশী সেই যে জপের মালা নিয়ে বসেছেন, নড়ন-চড়ন নেই তার থেকে।

সুবৰ্ণর বড় মেয়ে চাঁপা মায়ের এই দুৰ্গতিতে কাঠ হয়ে বসে থেকে একসময় ঘরে গিয়ে কাঁদতে বসেছে, ভানু কানু দুই ছেলে মার সঙ্গে যাবো—করে পরিত্ৰাহি চেঁচিয়ে অবশেষে জেঠির কাছ থেকে খেলনা পুতুল খাবার পেয়ে চুপ করেছে, কর্তারা কে কোন দিকে গেছেন, গিন্নীরা আরদ্ধ কাজের ভার আবার হাতে তুলে নিয়েছে, মুক্তকেশী নির্বিকার।

প্ৰবোধের কাজটা তার সমর্থন পেলো কি পেলো না, তাও বুঝতে পারে না প্ৰবোধ।

এর চাইতে যদি মুক্তকেশী গলা খুলে বলতেন, বেশ করেছে প্ৰবোধ, এত বড় জাঁহাবাজ মেয়ে তিনি ভূভারতে দেখেন নি, অনেক আহ্লাদের ব্যাপার হতো!

এটা কী হলো?

লাঠিটা ভাঙলো, সাপটা মরলো না!

বৌ বিতাড়িত হল, মা প্ৰসন্ন হলেন না!

১.১০ মুক্তকেশীর সংসারের অন্নজল

কিন্তু মুক্তকেশীর সংসারের অন্নজল কতদিনের জন্যে উঠেছিল সুবৰ্ণলতার?

সে ইতিহাস জানতে হলে টাইট-বঁধুনি তো দূরের কথা, একেবারে অবাঁধা। বুরো ঝুরো পাতাগুলো তার এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে, উড়ে বেড়িয়েছে।

তবু সেই বিদেয় করে দেওয়ার অধ্যায়টা খুঁজে পেতে দেখে এইটুকু দেখা যায়, বাড়ির দরজায় ঘোড়ার গাড়ির শব্দ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন সুবৰ্ণলতার বাবা নবকুমার বাঁড়িয্যে। ফর্সা ধবধবে রঙ, নিটোল গড়ন, চুল কাঁচা-পাকা। হয়তো বা কাঁচার থেকে পাকার সংখ্যাই বেশি।

পরনে ফতুয়া, পায়ে বিদ্যাসাগর চটি। একদা সরকারী কোনো এক অফিসের বড়বাবু ছিলেন, রিটায়ার্ড। ঘরকুনো মানুষ, বাইরে বেরোন কমই। সারাদিন বাড়ি বসে ছেলের বেঁকে টিকটিক করেন। আর নাতি নিয়ে সোহাগ করেন।

বেরোনোর মধ্যে সৌদামিনী দেবীর বাড়িতে একটু বেড়াতে যাওয়া। বৃদ্ধা বিধবা, নবকুমারের দূর সম্পর্কের দিদি। বহু দুঃখ-কষ্ট পার হয়ে আর বহু কৰ্মক্ষয় করে শেষ জীবনে পেয়েছিলেন কিঞ্চিৎ সুখের স্বাদ, কিন্তু সাইল না।

বুড়োটি গত হলেন।

অবিশ্যি সৌদামিনীর যা বয়েস তাতে বৈধব্যটাই স্বাভাবিক, তবে বহু কষ্ট পেয়ে সবেই তো স্বামী পেয়েছিলেন। তার সতীনই সর্বস্ত দখল করে রেখেছিল।

স্বামী গেছেন, সতীন গেছে, এখন একা সতীনের ছেলে।পুলে বৌ জামাই সব নিয়ে সংসার করছেন।

এই সংসারটাই দেখে পরিতৃপ্ত হন নবকুমার। তাই ছুটে ছুটে আসেন। এ সংসারে পুরনোর ছাপ বিদ্যমান, কারণ সৌদামিনীর হাতেই তো গড়া। যে সৌদামিনী নবকুমারের দিদি।

নবকুমারের মনের সঙ্গে খাপ খায় না। সে পছন্দ, সে রুচি!

কিন্তু বৌয়ের বা দোষ কি? শ্বশুর মনের মত রুচি-পছন্দ সে পাবে কোথায়? শাশুড়ীকে কি চক্ষে দেখেছে?

বিয়ের কনের থেকেই গিন্নী হতে হয়েছে তাকে। সংসারত্যাগিনী শাশুড়ীর পরিত্যক্ত সংসারটাকে কুড়িয়ে তুলে নিতে হয়েছে ছোট দুটি হাতে।

সংসারও অবিশ্যি ছোট, শ্বশুর দ্যাওর স্বামী। কিন্তু ছোট বলেই যে হাল্কা তা তো নয়। পাষাণবার। মৃত্যুর মধ্য দিয়েই যে উত্তরাধিকার সেটা সহজ, সেটা কোমল, কিন্তু এ তো তা নয়।

স্বেচ্ছায় সংসারটাকে ত্যাগ করে চলে গেছে সংসারের গিন্নীটা! ছেলের বিয়ে সব ঠিকঠাক, তখনই অকস্মাৎ মেয়ের বিয়েকে কেন্দ্র করে এই কাণ্ড।

যথানির্দিষ্ট দিনে ছেলেটার বিয়ে হয় নি বটে, তবু বিয়েটা হলো। কারণ শাশুড়ী সত্যবতী নাকি এ সম্বন্ধ স্থির করে গিয়েছিলেন।

শ্বশুর সেই ইচ্ছেকে প্ৰাধান্য দিয়েছিলেন।

বৌ সুধীরবালা।

মানুষ খারাপ নয়, তবু নবকুমার যেন তাকে তেমন মেহের চোখে দেখেন না, পয়-অপয় কথাটা বিশ্বাস করেন। তিনি।

হাঁচি টিকটিকি মঙ্গলবার সব কিছুতেই পরম বিশ্বাস নবকুমারের। আজও পঞ্জিকাখানা হাতে নিয়ে উল্টে দেখছিলেন, কটা থেকে বেলা কটা পর্যন্ত মূলো খেতে নেই।

হঠাৎ এই ঘোড়ার গাড়ির শব্দ! এই বাড়ির দরজাতেই থামালো!

নবকুমার পঞ্জিকাখানা তাকের উপর রেখে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসেন, আর হাঁ করে দেখেন ভয়ঙ্কর অপরিচিত। আর বেশি পরিচিত এক নারীমূর্তি নেমে আসছে গাড়ি থেকে।

কে!

কে ও!

নবকুমার যেন আর্তনাদ করে ওঠেন। এত বাৰ্ধক্য এসেছে তাঁর, তাই এত দৃষ্টিবিভ্রম! না, না!

নবকুমার তাই আৰ্তনাদ করে ওঠেন।

কিন্তু এই বিচলিত ভাবটা মুহূর্তমাত্র স্থায়ী হলো, পরীক্ষণেই সে ভাব বদলে গেল। বিস্ময়বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখলেন নবকুমার, ভাড়াটে এই গাড়িটা, যাকে নাকি ছ্যাকরা গাড়ি বলা হয়, সেটা ওই নারী আরোহিণীকে নামিয়ে দিয়েই উল্টো মোচড় দিয়ে গড়গড় করে চলে গেল।

তার মানে যে পৌঁছুতে এসেছিল, সে নামল না। সে পত্রপাঠ বিদায় নিল।

অর্থাৎ মানুষটাকে নির্বাসন দিয়ে গেল।

এর মানে কি?

পরমাকাজ্যিক্ষত মূর্তির এ কী অনাকাঙ্ক্ষিত রূপে প্ৰকাশ!

ও এসে পায়ের ধুলো নিচ্ছে!

নবকুমার কি সেই নতমুখ নতদৃষ্টি কন্যাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরবেন? হাহাকার করে বলে উঠবেন, সুবৰ্ণ রে—এতদিন পরে এলি তুই? যখন তোর বাপের সব গেল!

না, পারলেন না।

সেই সহজ স্নেহ-উচ্ছাসের মুখে পাথর চাপিয়ে দিয়ে চলে গেছে সুবর্ণর পারের কাণ্ডারী।

এই চলে যাওয়ার চেহারার মধ্যেই বুঝি সুবৰ্ণলতার দুর্ভাগ্যের ছায়া।

তাই নবকুমার কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আগে প্রশ্ন করেন, কে? সুবৰ্ণ? কী ব্যাপার? মানে—

এখানে থাকতে চাই!

প্ৰণাম-নিবেদনকারিণী এবারে নবকুমারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্থির স্বরে বলে, আর কিছু চাই না। বাবা, শুধু এইখানে থাকতে চাই!

এইখানে থাকতে চাই!

এ আবার কী গোলমেলে প্রার্থনা! বিয়ে হয়ে পর্যন্ত এই এতগুলো বছর যার দর্শনমাত্র মেলে নি, যাঁর জন্যে কত দিন কত রাত শুধু প্ৰাণের মধ্যে হাহাকার করেছে, এবং ইদানীং যার দর্শন পাওয়া সম্পর্কে একেবারে আশা ছেড়ে দিয়েছেন, বলতে গেলে যাকে প্রায় ভুলেই বসে আছেন, সেই মেয়ে কিনা অকস্মাৎ এসে পায়ে আছড়ে পড়ে বলে, আমায় আশ্ৰয় দাও!

বলে, আমি থাকতে চাই!

অথচ শাখা-সিঁদুর-সোনায় জ্বলজ্বলাটি মূর্তি। এমন নয় যে ভাগ্যান্তর ঘটেছে!

বিহ্বল নবকুমার স্থলিত স্বরে বলেন, আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না। সুবর্ণ!

বুঝতে পারবে না। বাবা! সুবৰ্ণ তেমনি স্থির স্বরে বলে, পরে সব বুঝতে পারবে বাবা! এখুনি সব কিছু বুঝতে চেষ্টা করো না। পরে সব বলছি।

বলেছিল সুবর্ণ হাঁপাতে হাঁপাতে।

কিন্তু নবকুমার তো বলতে পারতেন, থাক মা, বলতে তোকে হবে না কিছু। তুই যে এসেছিস এই আমাদের ঢের। কতকাল তোর চাদমুখটি দেখি নি, হয়তো কোনদিন মরেই যেতাম, ভগবান বোধ করি। দয়া করেই তোকে এনে দিলেন।

বলতে পারতেন।

মেয়েকে সুস্থির হবার সময় দিতে পারতেন। কাছে বসিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে তৃষিত পিতৃহৃদয়ের ব্যাকুলতা প্রকাশ করতে পারতেন, কিন্তু নবকুমার তা করলেন না। নবকুমার কেমন যেন ভয় পেলেন।

আর সেই ভয়ের তাড়নাতেই চির অভ্যাসমত ছুটলেন দিদিকে ডেকে আনতে।

দিদি সৌদামিনী দেবী নবকুমারের নিজের দিদি অবশ্য নয়, পিসতুতো বোন, কিন্তু স্বামী থাকতেও বেধবা হয়ে দীর্ঘকাল তিনি মাতুলালয়ে বাস করেছেন, সেই সূত্রে নবকুমারের দিদিঅন্ত প্রাণ!

যখন রর বয়েস কম ছিল, এবং তারও প্রায় জামাইয়ের মতই স্ত্রী নিয়ে সমস্যার অন্ত ছিল না, ওই বল-বুদ্ধি-ভরসা হয়ে রক্ষা করেছেন।

তবে শেষরক্ষা করতে পারেন নি সৌদামিনী। সুবৰ্ণর বিয়ে উপলক্ষ করে সত্যবতী যখন এক অপরিসীম ধিক্কারে সংসার ত্যাগ করলেন, তখন তো শেষ পর্যন্ত সৌদামিনীই সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন, তথাপি ফিরিয়ে আনতে পারেন নি।

কিন্তু ফিরিয়ে আনবার চেষ্টাই কি করেছিলেন?

সে প্রশ্ন করেছিলেন নবকুমার দিদির কাছে হাহাকার করে, পারলে না সদুদি? তুমি পারলে না? তোমার চেষ্টাও বিফল হল?

সৌদামিনী ক্ষুদ্ধ হাসি হেসে বলেছিলেন, ও কথা বললে মিথ্যে কথা বলা হয় নবু। সত্যি বললে বলতে হয় চেষ্টা আমি করি নি।

চেষ্টা কর নি!

নাঃ। তার মুখ দেখে বুঝেছিলাম যে, কোনো চেষ্টাই সফল হবে না। বিশ্বাসঘাতক স্বামীর ঘর আর করবে না সে। বললে তুই দুঃখু পাবি, তুই ওর যুগ্যি ছিল না কোনদিনই। তবু স্বামী বলে ভালবাসতো, ভক্তিছেদা করতে চেষ্টা করতো, সে ছেদা তুই খোয়ালি। বৌ তোকে অসার অমনিষ্যি যাই ভেবে আসুক, একথা কোনোদিন ভাবে নি তুই ওকে ঠকাবি! সেই কাজ করলি তুই, আমি আবার কোন দুঃখে চেষ্টা করতে যাব বল!

বলেছিলেন সৌদামিনী এসব কথা। তত্ৰাচ নবকুমার দিদির শরণ ত্যাগ করেন নি। সদুদিকে আঁকড়েই আবার হালভাঙা নৌকোটোকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে এসেছিলেন তীরে। এখন আর ভাইয়ের সংসারটা দেখতে হয় না সৌদামিনীকে, ছেলের বৌ দেখে, তবে কারুর একটু মাথা ধরলে ছুটে আসতে হয়।

তাছাড়া এদের লক্ষ্মী, যষ্ঠী, মনসা, মাকাল, ইতু, মঙ্গলচণ্ডী ইত্যাদি করে গোরস্তঘরের যা কিছু নিয়ম-লক্ষণ, পাল-পার্বণ, তার দায় এখনো পোহান সৌদামিনী।

বলতে গেলে এখনো এ সংসারে অভিভাবিকার পোস্টটা সৌদামিনীরই।

অতএব আকস্মিক কন্যার এই আবির্ভাবে ভীত-ত্ৰস্ত-আতঙ্কিত নবকুমার সদুদিকেই ডাকতে ছুটলেন, মেয়েকে ভাল করে বসতে পর্যন্ত না বলে।

বসতে বললো সাধনের বৌ সুধীরবালা। কাছে এসে হাত বাড়িয়ে বলল, এসো ঠাকুরঝি, হাত-মুখ ধোও।

বৌ সপ্ৰতিভ আত্মস্থ। শ্বশুরের মত ভয় পেল না সে।

বুঝলো একটা ঝগড়াঝাঁটির ব্যাপার। বিয়ে হয়ে এসে পর্যন্ত ননদকে চক্ষে না দেখলেও ননদের কথা শুনেছে বৈকি, অনেকই শুনেছে। ননদের ভাইদের কাছে, পিসশাশুড়ির কাছে, কদাচিৎ শ্বশুরের কাছে। শ্বশুরের কাছে—বেশির ভাগই তার মেয়ে অন্নর সঙ্গে তুলনায় ব্যাপারে।

উঠতে বসতে অনুর দোষ দেখতে পান নবকুমার আর বলেন, তোর পিসি তো এমন ছিল না রে!

নাতিটি নবকুমারের নয়নমণি, নাতনীটি নয়। নাতনীটার মধ্যে থেকে বুঝি কেবলই অনেক দিন আগের একটা বালিকাকে খুঁজে পেতে চান নবকুমার, একদা এই বাড়িরই সর্বত্র যে ছড়িয়ে ছিল মুলুরু কণিকার মত। গোলগাল বেঁটেখাটো শ্যামলা রঙ অন্নর মধ্যে তার আভাস কোথায়? তাই বিরক্ত হন।

আগে এই বাসাটার ভাড়াটে ছিলেন নবকুমার, তার পর বাড়িওয়ালাকে বলে-কয়ে বাড়িটা কিনে নিয়েছেন।

কেন?

কে জানে কী রহস্য!

সাধনের আদৌ ইচ্ছে ছিল না পয়সা খরচ করে এই পচা বাড়িটাই কেনা হয়। বাড়ির অভাব আছে নাকি? ভাত ছড়ালে কাকের অভাব থাকে?

চলছিল বাপের সঙ্গে সামান্য কথান্তর, সদুই রক্ষা করলেন। আড়ালে ডেকে চুপি চুপি বললেন, বুঝতে পারছিস না বাবা, এই বাড়িখানাতেই তো তোর মা থেকেছে, সংসার করেছে, বলতে গেলে এর সর্বত্রই তোর মা বিদ্যমান। এ বাড়ি ছাড়লে সে একেবারে মুছে যাবে! তাই বোধ করি নবু প্ৰাণ ধরে–

সাধন চিরদিনই শান্ত গম্ভীর, গম্ভীর হয়েই বলেছিল সে, মার প্রতি খুব একটা ইয়েও তো দেখি না। মার নাম উঠলেই তো বাবা তেলে-বুগুনে জ্বলে ওঠেন। আর রাতদিন গাল পাড়েন!

সৌদামিনী হেসেছিলেন।

বলেছিলেন, ছেলেমানুষ তুই, তোকে আর কি বোঝাব! তবে বিয়ে তো করছিস, আপনিই বুঝতে পারবি পরোক্ষে। বেশিদূর যেতে হবে না, আমার জীবনটাই দেখ না কেন! তা সৌদামিনীর জীবনটা এ হিসেবে দ্রষ্টব্য বৈকি। দীর্ঘকাল পতিপরিত্যক্তা হয়ে মামা-মামীর সংসারে হাড়ে দুর্বো গজিয়েছে, স্বামী দ্বিতীয় পক্ষ নিয়ে সুখে সংসার করেছেন। হঠাৎ একদিন চাকা ঘুরলো, স্বামীর সংসারে আবার প্রতিষ্ঠিত হলেন সৌদামিনী রুগ্ন সতীনের কন্না করতে আর তার ষষ্ঠীর সংসারের খবরদারি করতে। তার পর স্বামী বড়গিনীতেই তদগত হয়েছেন, বড়গিনীতেই চক্ষে-হারা হয়েছেন। বলেছেন, প্রথম বলেছেন, ভালবাসা জিনিসটাই আলাদা বড়গিনী!

সমস্ত তো সাধনের চোখের সামনে।

তাই নিজের জীবনের দৃষ্টান্ত দেখান সৌদামিনী; বলেন, তোর বাপের মর্মকথা আমি বুঝি।

নবকুমারও তা জানেন, তাই মর্মকথার ভার নিয়ে ছোটেন দিদির কাছে। আজও ছুটলেন। অতএব সুধীরবালা এসে হাত ধরতে এল সুবর্ণর।

সুবৰ্ণ অবশ্য সে হাতে হাত রাখল না, এমনিই ঝেড়ে-পুড়ে উঠল। বলল, তুমিই বুঝি বৌ?

সুধীরবালা ঘাড় কাত করলো।

বিহ্বল সুবর্ণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল সেই তার বাল্যের লীলাভূমিকে। হাত বদল হয়ে জিনিসপত্রগুলো জায়গা বদল করেছে, কিন্তু ইট-কাটগুলো তো আঁচল আছে। ওই জানলাটার নিচে বসে বই পড়তো সুবর্ণর মা, ওই কোণটায় বসে কুটনো কুটতো।

আর দোতলার সেই ছোট্ট ঘরখানা?

যেখানায় সুবৰ্ণ আর তার মা শোবে বলে চৌকি পাতা হয়েছিল?

সাধনের বিয়ে হলে বৌ নিয়ে সাধন ভাল ঘরটায় শোবে, পাশের সরু ঘরটায় সুবৰ্ণকে নিয়ে তার মা সত্যবতী, আর হতভাগ্য নবকুমার অতএব ছোট ছেলেকে নিয়ে নিচেরতলায়।

এই ব্যবস্থার মাঝখানে হঠাৎ এল ঝড়, তছনছ হয়ে গেল। সংসার, ছেলের বৌকে নিয়ে সংসার করা হলো না। সত্যবতীর।

সেই ঝড়ের পরের সংসারটাকে তো আর দেখে নি সুবর্ণ!

সুবৰ্ণ তাই বিহ্বল দৃষ্টি মেলে হারানো দিনকে খুঁজছিল …ওই ওই সেই কুলুঙ্গটা যার মধ্যে সুবৰ্ণর বই-শেলেট থাকতো। এখনো তাই রয়েছে! ধ্বক করে উঠেছিল বুকটা, তার পর বুঝলো ওসব নতুন অধিকারীর ব্যাপার!

সুবৰ্ণ কি আবার এ বাড়ির একটা কুলুঙ্গী খুঁজে নেবে তার বই-খাতা রাখতে? বহুদিনের ধুলো ঝেড়ে হাতে তুলে নেবে সেগুলো? আর সেই পরম বস্তুটি হাতে নিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াবে? বলবে, মা, তুমি যা চেয়েছিলে তোমার সুবর্ণ তাই হয়েছে। তবে প্ৰায় তোমার মতই জীবন তার, শুধু তফাৎ এই তুমি সংসারকে ত্যাগ করেছ, আর সংসার সুবৰ্ণকে ত্যাগ করেছে।

চকিত দৃষ্টিপাতের মধ্যে এতগুলো কথা ভাবা হয়ে গিয়েছিল সুবর্ণর। শুধু যখন সহসা চাঁপা আর ভানু কানুর কাছে এসে ঠেক খেয়েছে, তখন সুধীরবালা বললো, এসো ঠাকুরবি!

সুবৰ্ণ ঝেড়ে উঠলো, বললো—তুমিই বুঝি বৌ?

তারপর বললে, বাবা তাড়াতাড়ি কোথায় চলে গেলেন?

সুধীরবালার বুঝতে আটকায় নি কোথায় গেছেন শ্বশুর। তবু ঘাড় নেড়ে বললো, জানি না।

সুবৰ্ণ অবাক হয়ে ভাবলো, বাবা কি মেয়ে এসেছে বলে তাড়াতাড়ি বাজারে ছুটলেন মিষ্টি আনতে।

অদ্ভুত তো! ভাল করে তো দেখলেনও না সুবৰ্ণকে!

এখন এই পরের মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে হবে। মনের অবস্থা তার অনুকুল নয়। এই অপরিচিত দুটো চোখের সামনে আপন দৈন্য নিয়ে–

বৌ আমার মিনতি করলো, হাত মুখ ধুয়ে নাও ঠাকুরঝি।

সুবৰ্ণ সে কথায় কান দিল না।

বলল, দাদা কোথায়?

বৌ একটু হাসলো।

বললো, কোথায় আর? কাছারিতে!

দাদা উকিল হয়েছে?

হ্যাঁ।

ছোড়দা?

ঠাকুরপো? বৌ হেসে হেসে থেমে থেমে বলে, তিনি তো সাহেব। রেলআপিসে মেজাসাহেব। বাঙালী নামে চলে না, নাম নিয়েছেন এস কে ব্যানার্জী।

সুবৰ্ণর বুকটা হঠাৎ যেন হাহাকার করে ওঠে।

কেন কে জানে?

সুবৰ্ণ কি এ বাড়ির ওই ছেলেটাকে হিংসে করছে? নাকি ওর সঙ্গে সুবর্ণর ব্যবধানের দূরত্ব মনে পড়ে বুকটা খা খা করে উঠল?

একটু থেমে বললো, তা সাহেব আসেন। কখন?

ও মা! তিনি এখানে থাকেন নাকি? তার তো মোগলসরাইয়ে কাজ। আগে ছিল বক্সার-

শেষ কথাটায় কান দেয় না সুবর্ণ।

ওর মাথার মধ্যে ধাক্কা দিতে থাকে মোগলসরাই! মোগলসরাই! যেটা নাকি কাশীর নিতান্ত নিকট। তার মানে ছোড়দা মার নিতান্ত নিকটজন হয়ে আছে এখন। নিশ্চয়। ছোড়দাকে মা ফেলতে পারবে না।

এই মেয়েটার সঙ্গে আর কথা বলতে ইচ্ছে করল না। বলল, আমি ছাতে যাচ্ছি।

ছাতে!

ঝুমুৱাই অবাক হল। বললো, ছাতে কেন?

এমনি।

তা হলে চলো-এই যে এদিকে সিঁড়ি–

জানি। সুবর্ণ তীব্ৰস্বরে বলে উঠল, জানি। চলে গেল সিঁড়ি দিয়ে।

সুধীরবালা অপ্রতিভা মুখে দাঁড়িয়ে থাকলো, আর গেল না। সঙ্গে। রাগও হলো। দিব্যি চলছিলো, হঠাৎ আবার এ কী বিপদ? এ বিপদকে ঠিক সাময়িকও মনে হচ্ছে না যেন। কে জানে কী ঘাড়ে পড়তে চলেছে!

মুখটা বেজার করে দাঁড়িয়ে থাকে সে বরের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়। সময় হয়ে এসেছে।

 

গায়ে লম্বা কালো চাপিকান, গলায় পাকানো চাদর, পরনে ধুতি, পায়ে জুতো মোজা, যথারীতি উকিলবাবুর সাজে বাড়ি ফিরলো সাধন শেয়ারের ঘোড়ার গাড়ি করে। মোড়ের মাথায় নামে, গাড়ি অন্যদিকে ঘুরে চলে যায়।

নিত্য অভ্যাসমতই নেমে পড়েই বাড়ির দিকে তাকিয়ে নিল একবার, আর তাকিয়ে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ভুরুটা কুঁচকে এল। তার।

ছাতে দাঁড়িয়ে কে??

আলসে থেকে অনেকটা উঁচু তে মুখ, ঘোমটা খোলা মাথা মনে হচ্ছে, এলো চুল!

সুধীরবালা?

সুধীরবালা কি অতটা লম্বা, অতটা ফর্সা?

তা ছাড়া সুধীরবালা এ সময় হাওয়া খেতে যাবে?

কেউ বেড়াতে এসেছে তা হলো!

কিন্তু কে?

বেজার মুখে বসে আছে।

অবাক হল সুবর্ণর দাদা সাধন।

কেউ যদি বেড়াতে আসবে, সুধীরবালা কেন এখানে এমন প্যাচামুখে?

বললো, ছাতে কে? আলসে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে মনে হলো, মাথার ঘোমটা খোলা, চুল খোলা–

ঘোমটা খোলা!

চুল খোলা!

সুধীরবালার বুকটা কেঁপে ওঠে।

এ কী কথা!

পাগল নয় তো? নাকি হঠাৎ পাগল হয়ে গেছে? তাই! তাই হয়তো শ্বশুরবাড়ির লোক ফেলে দিয়ে পালিয়ে গেছে। কী হবে!

সাধন আর একবার প্রশ্ন করলো, বল, কি? কে এসেছে?

সুধীরবালা নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু গলায় বলে, কে এসেছে পরে শুনো।

পরে শুনবো? তার মানে?

পরে শুনোটা তো ছিল! খবরটা স্বামীর কর্ণগোচর করবার জন্যে তো মরছিল! তবে লজ্জা?

তাই যেন না বললে নয়, এইভাবে বলে সুধীরবালা, এসেছে তোমাদের বোন।

বোন! বোন মানে? কোন বোন?

সাধন গলা থেকে চাদরটা নামিয়ে আলনায় রাখতে ভুলে গিয়ে হাতে করে ধরেই বলে, কোন বোন?

সাধনের কণ্ঠস্বর থেকে বিস্ময় যেন ঝরে ঝরে পড়ে—।

সুধীরবালাও চালাক মেয়ে, রয়ে-বসে পরিবেশন করে। বলে, বোন আর তোমাদের কটা আছে? একটাই তো বোন! সেই বোন।

সেই বোন! মানে সুবৰ্ণ?

হুঁ।

সাধনও বহুদিন অদেখা সেই বোনের আগমন-সংবাদে আনন্দিত না হয়ে ভীতই হয়। শঙ্কিত গলায় বলে, হঠাৎ এভাবে আসার কারণ?

কারণ! সুধীরবালা গলা খাটো করে বলে, কারণ কী করে জানবো? এসেই তো ঠরঠরিয়ে ছাতে উঠেছে!

বাবা নেই?

আছেন। মানে মেয়েকে দেখে তবে গেছেন!

দেখে তবে গেছেন? কোথায় গেছেন?

জানি না। বোধ হয় পিসিমার বাড়ি। দেখামাত্ৰই তো ছুটলেন।

সাধন বিরক্ত হলো।

বললো, বাবার তো কেবল ওই!

সাধন চিন্তিত হলো।

বললো, এলো কার সঙ্গে?

জানি না। চক্ষে দেখলাম না। তাকে। দরজা থেকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে।

হুঁ, গণ্ডগোল একটি বাধিয়েছেন আর কি! তা এসেই ছাতে উঠল যে?

ভগবান জানেন। সাতবার বলছি হাত-মুখ ধোও, তা নয়, ছাতে যাব!

অন্ন কোথায়? ডেকে আনতে বল—

অন্নও তো পিছু পিছু ছাতে উঠেছে। বললাম। কিনা, পিসি হয়।

ডাকো ডাকো! কি জানি মাথার দোষ হয়েছে কিনা!

কে ডাকবে?

তুমি চেঁচাও, আমি আর সিঁড়ি ভাঙতে পারব না।

পিসি! পিসির সঙ্গে কী এত কথা!

অপছন্দ ভাব দেখায় সাধন।

 

কিন্তু সাধনের মেয়ে হঠাৎ ভারি পছন্দ করে ফেললো পিসিকে।

আস্তে আস্তে গায়ে হাত দিয়ে বলেছে, তুমি পিসি?

তারপর কেমন করে না-জানি ভোব উঠেছে জমে। সুবৰ্ণকে সে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছে আর সুবর্ণ উত্তর দিচ্ছে।

হয়তো এমনিই একটা কিছু চাইছিল সুবর্ণ। বলতে চাইছিল নিজের কথাগুলো।

এই শিশুচিত্তের কৌতূহলের সামনে সেই বক্তব্য সহজ হলো।

অন্ন বলছে, এই বাড়িতে যদি জনেছ তুমি তো এখানে থাক না কেন?

এরা তাড়িয়ে দিয়েছে। শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।

আবার তবে এলে কেন?

আবার শ্বশুরবাড়িরাও তাড়িয়ে দিল।

তোমায় কেবল সবাই তাড়িয়ে দিল।

তাই তো দিচ্ছে।

কেন? তুমি তো খুব সুন্দর!

তাতে কি! সুন্দরের ওপরই তো পৃথিবীর রাগ!

য্যাঃ!

দেখিস বড় হয়ে!

অন্ন নিজের হাতটা পিসির হাতের উপর রেখে বলে, আমি কালো!

না না, তুমি ভালো।

ঠাকুরদা বলে, তুই বিচ্ছিরি, বোকা। তোর পিসি ছিল বুদ্ধির রাজা!

কে বলে এ কথা? কে বলে?

অন্ন পিসির এই আকস্মিক উত্তেজনায় থতমত খেয়ে বলে, ঠাকুরদা! তোমার বাবা!

তোর ঠাকুরদা আমার বাবা হয়, জানিস এ কথা?

ওমা— অন্ন গিন্নীর মত বলে, তা জানবো না! ও বাড়ির ঠাকুমা বলে দেয় নি বুঝি! আচ্ছা, তোমার বর নেই?

বর! আছে বৈকি—

নীচের তলায় তখন পিতাপুত্র গুপ্ত পরামর্শ চলছে।

না, সৌদামিনী তৎক্ষণাৎ আসতে পারেন নি, তার হঠাৎ বাত চেগেছে। কোমর নিয়ে উঠতে দেরি। বলেছেন, তুই যা আমি যাচ্ছি।

সাধন অবশ্য পিসির জন্যে অপেক্ষা করছিল না, অপেক্ষা করছিল বাপের জন্যে। বলল, তুমি কিছু জিজ্ঞেস না করেই চলে গেলে ওবাড়ি!

নবকুমার নিজেকে সমর্থন করেন, জিজ্ঞেস করবার আর কী আছে? বুঝতেই তো পারলাম ভুঞ্জ এসেছেন একটা কিছু। ঝাড়ের বাঁশের গুণ যাবে কোথায়? হয়ে উঠেছেন একখানি অনুমান করছি!

সুবৰ্ণ এ বাড়িতে দুর্লভ ছিল, সুবর্ণ যেন একটু বিষণ্ণতার আধারে ভরা একখণ্ড পরম মূল্যবান রত্ব ছিল, কিন্তু সহসা সুবৰ্ণর দাম কমে গেল।

বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নিতে এসে সুবৰ্ণ সব মূল্য হারালো।

সুবৰ্ণ বিপদের মূর্তি হলো।

সুবৰ্ণকে ছাত থেকে ডেকে পাঠিয়ে নবকুমার প্রশ্ন করলেন, হঠাৎ এরকম চলে এলি যে?

সুবৰ্ণ মুখ তুলে বাপের দিকে একবার তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললো, চলে তো আসি নি, ওরা তাড়িয়ে দিয়েছে!

সাধন বিরক্তকণ্ঠে বলে, তাড়িয়ে আমনি দিলেই হলো?

সুবৰ্ণলতা স্থিরভাবে বলে, হলো তো দেখলাম। সহজেই হলো। বললো-ছেলেরা আমাদের বংশধর, ওরা আমাদের কাছে থাক, তুমি তোমার মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি থাকো গে। আমি বললাম, সবাই থাক। মেয়েও তোমাদেরই।

তারপর?

তারপর আর কি! গাড়ি ডাকলো, তোরঙ্গটা নিয়ে গাড়ির মাথায় তুলে দিলো, গাড়িতে উঠলো, দরজায় নামিয়ে দিয়ে গেল, আমি ঢুকে এলাম।

নবকুমার ধৈর্য ধরে সবটা শোনার শেষে ক্ষোভ আর ক্রোধের সংমিশ্রণে গড়া একটি প্রশ্ন করেন, ব্যস! ঢুকে এলাম! বুঝতে পারলি না এটা ত্যাগ করা?

বুঝতে পারব না কেন? ওরা তো বলে-কয়ে—

তবে? কেঁদে পড়ে বলতে পারলি না, ছেলেদের ছেড়ে আমি থাকবো কি করে?

সুবৰ্ণও ব্যঙ্গ আর ক্ষোভে গড়া একটি প্রশ্ন করে, ছেড়ে থাকতে পারবো না, এ কথার কোনো মানে হয়? ওটা তো একটা হাসির কথা!

নবকুমার মুহূর্তের জন্য মাথাটা হেঁট করেন। তারপর বলেন, তা ভবিষ্যৎটা তো ভাবতে হবে?

ভেবে কি সত্যিই কেউ কিছু করতে পারে–? বাবা শব্দটা মুখে এসেও আসে না, অনভ্যাসে মুখের মধ্যেই যেন আটকে যায়, কত মেয়ে তো হঠাৎ বিধবাও হয়!

হরি হরি! নবকুমার ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলেন, যা মুখে এলো বললেই হলো! আশ্চর্য! কোথায় রইল মা, কোথায় রইল মেয়ে, প্রকৃতিটি হয়েছে দেখছি এক ছাঁচে ঢালা। মুখ দিয়ে বার করলি কি করে এ কথা!

সত্যি কথা বলতে বাধবে কেন?

এবার বোধ করি জোর করেই বাবা শব্দটা উচ্চারণ করে সুবর্ণ। বলে, তুমি কি আমায় থাকতে দিতে হবে ভেবে ভয় পাচ্ছ, বাবা?

নবকুমার হঠাৎ বিচলিত হন।

নবকুমারের চোখ দিয়ে একঝলক জল এসে পড়ে। সেই অবসরে সাধন, দ্বলে ওঠে, ভয় পাওয়ার কথা হচ্ছে না। তবে আশ্চর্য হচ্ছি বৈকি। যারা এই এত বছরের মধ্যে কক্ষণো পাঠাল না, তারা হঠাৎ ইচ্ছে করে–

এই সময়ে অন্ন কথা বলে ওঠে। বাবার হাঁটুর নীচে থেকে, পিসির শাশুড়ীর টাকা কমে গিয়েছিল বলে শাশুড়ীটা বলেছিল, বৌরা কিছুদিন বাপের বাড়ি থাক। আমার বেশি খরচ হবে না—, তা পিসি বলেছিল, কোন যাব? যাব না—তাই ওরা রেগেটেগে বলেছে, তবে চলে যাও। থাকতে হবে না। আমাদের বাড়িতে।

তা সে প্রস্তাবে রাজী হলে ক্ষতিটা কি ছিল? সাধন বলে, সেটা তো খারাপ কিছু ছিল না। কিছুদিন বেড়িয়ে যেতে!

নবকুমার বলে ওঠেন, সেটা তো ভালোই হতো। আহ্লাদ করে চলে এলেই পারতে। ফাঁকতালে দুদিন থাকা হয়ে যেত!

ফাঁকতালে পেয়ে যাওয়া কোনো জিনিসে আমার লোভ নেই বাবা!

নবকুমার যেন একটু চমকে ওঠেন। কথাটা কেমন নতুন লাগে তাঁর কাছে।

কিংবা নতুনও নয়, শুধু ভুলে যাওয়াটা একটা সুরের মত। সুবৰ্ণর মা সত্যবতীও যেন এইরকম সুরেই কথা বলতো না?

কিন্তু এখন সময়টা সঙ্গীন।

হারানো সুর নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নয়। যে মেয়ে তাঁর কাছে প্রায় মৃত, অথবা সম্পূর্ণ অপরিচিত, হঠাৎ সেই মেয়েকে ঠিক আছে, তুই চিরকাল আমার ঘর ভরে আমার বুক ভরে থাক। বলা শক্ত বৈকি।

কে জানে মেয়ের কী প্রকৃতি, কী রীতি, কেন তারা এমন করে বিদায় করে দিয়েছে, কিছুই তো জানা নেই! তা ছাড়া তিনি বাপ, মেয়ের হিতাহিত দেখতে হবে! মেয়ে যদি তেজ করে স্বামীর ঘর ত্যাগ করে–

নবকুমার বিচলিত গলায় বললেন, আর সব বৌরা কী বলেছিল?

আর সব বৌরা! সুবর্ণ বিদ্রুপের গলায় বলে, আর সব বৌরা তো বাপের বাড়ি যেতে পেলেই নাচে! মানমর্যাদা বোধ থাকলে তো!

হুঁ! যত মান-মৰ্যাদা তোমার, কেমন? হবেই তো। মানী মায়ের মানী মেয়ে! মা একটা সংসার ধ্বংস করে বসে আছেন, মেয়েও–

নবকুমার হঠাৎ চুপ করে যান।

হঠাৎ পিছন ফেরেন। হয়তো চোখ দুটো আড়াল করতেই।

সাধন এই সব ভাবপ্রবণতা পছন্দ করে না। সাধন বলে ওঠে, ওসব কথা থাক বাবা। কথা হচ্ছে। এ ব্যাপারের একটা বিহিত দরকার। কিনা—

কিনা মানে? নবকুমার উদ্দীপ্ত গলায় বলেন, করতেই হবে। তারা বললো ত্যাগ করলাম, অমনি ত্যাগ হয়ে গেল, এ কথাটা কথা নাকি? তাদের কাছে গিয়ে নাকে খৎ দিয়ে মাপ চাইতে হবে!

নাকে খৎ দিয়ে মাপ চাইতে হবে!

একটা ধাতুপাত্ৰ যেন কথা কয়ে ওঠে।

এ কী স্বর! কী ভয়ানক!

এ স্বর যে বড্ড পরিচিত নবকুমারের।

আশ্চর্য!

মায়ের মতনই হয়ে বসে আছে মেয়েটা? কেন, ভাইদের মত হতে পারত না? কিন্তু এর ভার বইবার শক্তি নেই নবকুমারের। তাই নবকুমার তরল হবার চেষ্টা করেন, তা হবেই তো। শ্বশুরবাড়ি বলে কথা! মায়ের মত খুব নাটক নভেল পড়বার অভ্যোস হয়েছে বুঝি? তাই এত মান-মর্যাদার জ্ঞান! ওসব বুদ্ধিকে প্রশ্রয় দিতে নেই। দু-চারটে দিন যাক, আমি নিজে সঙ্গে করে গিয়ে শাশুড়ীম্যাগীকে তোয়াজ করে আসবো—

আমি তো আর কখনো ওখানে যাব না। বাবা-

শান্ত স্বর সুবর্ণর।

মেয়ের কণ্ঠস্বরে উদ্বেগ অনুভব করেন নবকুমার, যা হোক করে বুঝিয়ে বাগে আনা যাবে বলে মনে হয় না। দেখা যাক, ভুলিয়ে ভালিয়ে আনা যায়। কিনা!

বলেন, শোনো ক্ষ্যাপা মেয়ের কথা! একেবারে কাটান-ছেড়ান করলে চলে? যাবো, বুঝিয়েসুঝিয়ে পাঁজি দেখিয়ে বরং আনবো একবার দু মাসের জন্যে। এ একটা ভাল হলো, শাপে বর হলো। আসা-যাওয়া ছিল না, আসা-যাওয়ার পথ খুললো—

সুবৰ্ণ ছাত থেকে নেমে এসে বসেছিল সিঁড়ির ধাপে। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, তুমিও তাহলে আমায় তাড়িয়ে দিচ্ছি। বাবা?

তাড়িয়ে! ছি:। ছি, এ কী কথা!

নবকুমার বলেন, সাধন শুনছিস তো বোনের কথা?

শুনছি। বৈকি। সাধন বলে, তবে মনে হচ্ছে মায়া-মমতার প্রশ্ন এখন নয়। মেয়েদের যেটা আসল আশ্রয়-

আসল আশ্রয়!

সুবৰ্ণ হেসে উঠে বলে, আসল আশ্রয়ের দাম তো ধরা পড়ে গেল দাদা! এক নিমেষের এদিকওদিক, বলে দিল বিদেয় হও। তবু সেই আশ্রয়কেই আসল আশ্রয় বলে আঁকড়ে থাকতে হবে?

সাধনের বৌ সুধীরবালা এইসব কথাবাতাঁর মধ্যেই তাড়াতাড়ি জলখাবারের আয়োজন করে ফেলেছিল। গৃহ প্রত্যাগত স্বামীর জন্যও বটে, আগন্তুক ননদের জন্যেও বটে।

দুখানি ধবধবে কাসার রেকবি করে ধরে এনে দেয় সে দুটো মানুষের সামনে। আগে আসন আনে। আনে। জলের গ্ৰাস।

শ্বশুর এ সময় খান না, অতএব তার জন্যে প্রয়োজন নেই।

সুবৰ্ণ সেই রেকবির দিকে তাকায়।

বড় বড় দুটি রসগোল্লা, দুখানা করে অমৃতি, আর দুখানা করে নিমকি।

সহসা হেসে ওঠে সুবর্ণ।

জোরে জোরে হেসে বলে, কী বৌ? বিদেয়ের ইশারা নাকি? বাঃ! তুমি তো বেশ বুদ্ধিমতী!

নবকুমার বৌয়ের মুখের দিকে তাকান।

গৃহিণীহীন গৃহের গৃহিণী।

তাই তাড়াতাড়ি বলেন, ও কি কথা সুবৰ্ণ? কতদিন পরে এসেছিস তুই, একটু মিষ্টিমুখ করবি না?

সুবৰ্ণ তিক্ত হাসি হেসে বলে, করলাম তো অনেক, রসগোল্লাটা আর সইবে না বাবা। তার চেয়ে তুমি বরং একটা গাড়ি ডাকো।

গাড়ি ডাকো!

নবকুমার ব্যস্ত গলায় বলেন, এখুনি গাড়ি ডাকবো মানে? আজই আমি ছাড়ছি কিনা! এক্ষুনি সদুদি এসে যাবেন, তোর সেই পিসি রে! মনে আছে তো? নাকি ভুলে গেছিস? বেতো মানুষ, মালিশ করাচ্ছে, বললো, যাচ্ছি। এখুনি। আজ আর নয়, বললাম তো দুটো দিন যাক, তারপর সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে সাত হাত নাকেখৎ দিয়ে দু মাস নিয়ে আসবার জন্যে অনুমতি চেয়ে আনবো।

কিন্তু সুবর্ণ কি হঠাৎ কালা হয়ে গেল? সুবৰ্ণ শুনতে পেল না। এসব কথা? তাই সেই আগের মত ধাতব কণ্ঠে উচ্চারণ করে উঠল, দাদা, একটা গাড়ি ডাকো-

সাধন এবার বোধ করি ঈষৎ সঙ্কুচিত হয়। বলে, আজই এই দণ্ডে যাবার কী দরকার? বরং আজ একবার আমি ওদের ওখানে গিয়ে-

সাধনের কথা শেষ হয় না, একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্ন বলে ওঠে, কেন খালি খালি বলছে বাবা? পিসি মরে গেলেও আর শ্বশুরবাড়ি যাবে না-

বটে? বটে? রাগে আগুন সাধন মেয়ের গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বলে, যাবে না! বলেছে তোমার কানে ধরে! পাজী ডেপো মেয়ে! হচ্ছেন তৈরি। আর একখানি!

আহা থাক থাক, কচি মেয়েটাকে কেন শুধু শুধু—, নবকুমার বলেন, কূটকচালে কথা রাখ দিকি, নে খা দাদার সঙ্গে বসে খেয়ে নে। সেই তোর ননীর দোকানের রসগোল্লা। ছোটবেলায় যার জন্যে জিভে জল পড়তো তোর। ননী বুড়ো এখনো-

ননীর নামে নরম হতে পারতো সুবর্ণ। ছেলেবেলার উল্লেখে কোমল।

কিন্তু কিসে থেকে যে কি হয়! হঠাৎ সুবৰ্ণলতা একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসে।

আচমকা বসে পড়ে নিজের কপালটা ঠাঁই ঠাঁই করে দেওয়ালে ঠুকতে ঠুকতে বলে, কেন? কেন তোমরা সবাই মিলে আমাকে অপমান করবে? কেন? কেন?

ভিতরের অব্যক্ত যন্ত্রণাকে প্রকাশ করবার আর কোনো ভাষা খুঁজে পায় না বলেই সুবৰ্ণলতা ওর এই এতদিনকার বিবাহিত জীবনের পুঞ্জীভূত সমস্ত প্রশ্নকে এই একটি শব্দের দ্বারা ব্যক্ত করতে চায়।

হয়তো বা শুধু তাও নয়, সমস্ত অবরুদ্ধ নারীসমাজের নিরুদ্ধ প্ৰশ্নকে মুক্তি দেবার দুর্দমনীয় বাসনা এটা, যা সত্যকার কোনো পথ না পেয়ে এমন উন্মত্ত চেষ্টায় মাথা কুটে মরে!

হয়তো বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধেও সভ্যতা আর প্রগতির চোখ-কালসানো আলোর সামনে সাজিয়ে রাখা রঙচঙে পুতুল মেয়েদের পিছনের অন্ধকারে আজও কোটি কোটি মেয়ে এমনিভাবে মাথা কুটে কুটে প্রশ্ন করছে—কেন? কেন?

সুবৰ্ণলতার যুগ কি শেষ হয়ে গেছে?

কোনো যুগই কি কোনোদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে শেষ হয়ে যায়?

হয়তো যায় না!

হয়তো বৃদ্ধা পৃথিবীর শীর্ণ পাঁজরের খাঁজে খাঁজে কোথাও কোনোখানে আটকে থাকে ফুরিয়ে যাওয়া যুগের অবশিষ্টাংশ, এখানে ওখানে উঁকি দিলে তার সন্ধান মেলে।

যেখানে মাথাকোটার প্রতিকার নেই। যেখানে লক্ষ লক্ষ কেন ছুটোছুটি করে মরছে।

তবে দৃশ্যমান মাথাকোটার প্রতিকার হয়। ও কি ও কি বলে ধরে ফেলেন নবকুমার। সাধন জল এনে কপালে ছিটোয়। সুধীরবালা ঘোমটা দিয়ে বাতাস করে।

আর ঠিক এই সময় সৌদামিনী এসে দাঁড়ান ভাঙা কোমর নিয়ে।

 ১.১১ তাসের আড্ডা রোজই বসে

তাসের আড্ডা রোজই বসে, সন্ধ্যে থেকে রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত চলে। বাড়ির মেয়েরা হাঁড়ি আগলে বসে থাকতে থাকতে হয় ঝিমোয়, নয়। ঘুমিয়ে নেয় এক পালা।

তবে নিশ্চিন্তের ঘুম তো নয়, কখনও যে বৈঠকখানা থেকে হুকুম আসে চারটি পান। সেজে পাঠিয়ে দিতে, তার তো ঠিক নেই!

বৌরা ঘুমিয়ে পড়েছে খবর পেলে তো গর্দান যাবে।

তাছাড়া ভাত গরম রাখার উদ্বেগও তো আছে। উনুনের উপর হাঁড়ি দমে বসিয়ে রেখে রেখেও তো বেদম ঠাণ্ডা মেরে যাবে। আর অতিক্ষণ তাস পিটিয়ে এসে ক্ষুধার্ত পুরুষ যদি দেখে ঠাণ্ডা ভাত, তা হলে মেজাজ ঠাণ্ডা রাখা তাদের পক্ষে শক্তি বৈকি।

তবু ছুটির দিনের সঙ্গে অন্য সব দিনের তুলনাই চলে না। ছুটির দিনে আড্ডাটা বসে মধ্যাহ্ন-ভোজনের পরমুহূর্তে থেকেই, চলে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত। পান সাজতে সাজতে বৌদের এবং তামাক সাজতে সাজতে ছোট ছেলেগুলোর প্রাণ বেরিয়ে যায়।

মুহুমুর্হু হুকুম আসে, আর তামিল করতে তিলার্ধ দেরি হলেই আসে হুঙ্কার।

সুবোধ বাদে বাকী তিন ভাই তাসের পোকা। সুবোধ একটু ঘুম-কাতুরে, সকাল সকাল খেয়ে ঘুমোয়, আর ঘুমোতে যাবার আগে বলে যায়, তাস দাবা পাশা, তিন কর্মনাশা! তোদের এই এক কর্মনাশা নেশায় ধরেছে!

প্রভাস তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, তা বটে। এর থেকে ঘুমটা অনেক মূল্যবান বস্তু, কি বল लाम्राl?

সুবোধ লজ্জিত হয় না, বলে, একশোবার! ঘুম হচ্ছে মগজের আহার। দেহের যেমন অন্ন, মগজের তেমনি ঘুম!

প্রভাস অবশ্য এই নতুন জ্ঞানলাভে ধন্য হয় না। বলে, অতিভোজনটাও ভাল নয়।

সুবোধ হাসে, অতি মানে? ভগবান ক ঘণ্টা দিবালোক দিয়েছে, আর ক ঘণ্টা অন্ধকার সে হিসেব করা?

তুমি কর! বলে প্ৰভাস।

প্রভাসের কথাবার্তার ধরনই ওই।

গুরুজনের সঙ্গে বাক্যালাপে যে নম্রতার নীতি বলবৎ আছে, প্ৰভাস সেটা কদাচিৎ মানে। প্ৰভাসকেই সকলে সমীহ করবে। এই নীতিই চালু হয়ে গেছে সংসারে।

এমন কি মুক্তকেশীও তার উকিল-ছেলেকে রীতিমত সমীহ করছেন, ওর বৌয়ের দোষের দিকে দৃষ্টিক্ষেপটা কম করছেন, এবং ছেলেকে প্রায়শই তুমি করে কথা বলছেন।

প্রভাস যদি তাস খেলার বিরোধী হতো, নিৰ্ঘাত বাড়িতে তাসের আড্ডা বসবার স্বপ্ন কেউ দেখত না। কিন্তু প্ৰভাসই এ যজ্ঞের হোতা! অতএব আড্ডা ক্রমশই আয়তনে বাড়ছে, দর্শক-বন্ধুর সংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে।

ছুটির দিনে পূর্ণিমার জোয়ার।

তবে অন্য দিনেও কম নয়।

প্ৰবোধ যখন ঘোড়ার গাড়ি করে মেজবৌকে নির্বাসন দিতে গেল, তখন প্ৰভাস বন্ধুদের মধ্যে থেকে খেলোয়াড় নির্বাচন করে বাজার বজায় রেখেছিল। তার মধ্যে যথারীতি পান দু ডাবর শেষ হয়েছে। রাতও প্রহর হয় হয়।

প্ৰবোধ বৌকে পৌঁছে দিয়ে এসে মার কাছ থেকে ঘুরে সবে জুৎ করে বসেছে।

এমন সময় দরজায় গাড়ি থামার শব্দ। বিতাড়িত হয়ে তাড়িত আবার ফিরে এসেছে।

কিন্তু দর্জিপাড়ার গলির মধ্যেকার এই রুদ্ধ কপাটের ভিতর পিঠে প্ৰবেশ-অধিকার কি সহজে মেলেছিল সুবৰ্ণর?

মেলে নি।

মাতৃভক্ত ছেলে প্ৰবোধ সদ্য জমে-ওঠা খেলায় জল ঢেলে শ্বশুরের সামনে এসে দরজা আটকে দাঁড়িয়ে ঘাড় গুঁজে ঘোৎ ঘোৎ করে বলেছিল, না, এমনি ঢুকে পড়া চলবে না, আমার সাফ কথা, আমার মায়ের পায়ে ধরে মাপ চাইতে হবে।

খেলা ফেলে প্ৰভাসও উঠে এসে বলেছিল, তালুইমশাই কি মেয়েকে এক সন্ধ্যেও দুটি খেতে দিতে পারলেন না?

পারলাম নাই বলতে হবে–, বলে গাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন নবকুমার।

ক্ষুব্ধ ক্ৰন্দন-বিজড়িত সেই কণ্ঠস্বর ভিতরের ইতিহাসের আভাস প্রকাশ করল।

সুবৰ্ণ খায় নি। জলটুকু পর্যন্ত না।

গাড়িতে ওঠার সময়ে বলেছিল, কী দরকার বাবা? দর্জিপাড়ার সেই গলিটাতে যদি আবার গিয়ে ঢুকতেই হয়, তাদের হাঁড়ির অন্ন খেতেই হয়, তবে আর একবেলার জন্যে জাত নষ্ট করি কেন?

সৌদামিনী গালে হাত দিয়ে বলেছিলেন, তুই যে দেখি তোর মায়ের ওপর গেছিস সুবৰ্ণ, বাপের ঘরে খেলে তোর জাত যাবে?

সময় বিশেষে তাও যায় বৈকি পিসিমা।… যাক গে বাবা, গাড়ি একখানা ডাকো, বেশি রাত হবার আগেই পৌঁছে দিয়ে এসো। অনেক কষ্ট তোমাকে পেতে হল। এই যা!

তা দরজা আটকানোর নাটকটা পাড়ার লোকে দেখেছিল বৈকি।

যারা তাস খেলছিল তারা, যারা আশেপাশের জানলায় মুখ দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তারা। আর নিজ নিজ বাড়ির সামনের রোয়াকে যারা বসে ছিল গা খুলে, বাড়ির বাচ্চা মেয়েদের একটা পাঁচ–ছ হাতি শাড়ি পর, তারা তো বটেই।

শেষ পর্যন্ত সে নাটকে যবনিকাঁপাত করলেন স্বয়ং মুক্তকেশীর তো আর এখন আব্রুর বালাই নেই, তাই দরজার কাছে এসে বলেছিলেন, দোর ছাড় পেবো, লোক হাসাস নে। মেজবৌমা, যাও বাছা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ো, আর কেলেঙ্কারী বাড়িও না।

না, সেদিন আর মুখে মুখে চোপা করে নি। সুবর্ণ। বলে নি, কেলেঙ্কারিটি তো ঘটালেন আপনিই!

সুবৰ্ণ শুধু ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল।

বাবার দিকে আর তাকায় নি।

মুক্তকেশী উদাত্ত গলায় বলেছিলেন, কত ভাগ্যে বেয়াইয়ের পায়ের ধুলো পড়ল, দোর থেকে ফিরে যাবেন বেয়াইমশাই? একটু জল খেয়ে যেতে হবে—।

আজ থাক, আজ থাক। বলে বোধ করি চোখের জল চাপতে চাপতেই গাড়িকে চালাতে বলেছিলেন নবকুমার।

 

খেলাটাই মাটি হল আজ, যত সব ঝামেলা— বলে প্ৰভাস ফের গিয়ে তাস ভাঁজতে বসলো, চক্ষুলজার দায়ে অগত্যা প্ৰবোধও।

মনের মধ্যে একটা আহ্লাদের ঢেউ বইছিল বৈকি।

ঝোঁকের মাথায়, আর স্ত্ৰৈণ অপবাদ ঘোচাতে, করে বসেছিল কাজটা, মনের মধ্যে তো বিছে কামডাচ্ছিল!

ԳO

যে সাংঘাতিক সিংহরাশি মেয়েমানুষ, কে বলতে পারে এ বিচ্ছেদ সত্যিই চিরবিচ্ছেদ হল। কিনা! তেমন কাণ্ড ঘটলে কতদূর জল গড়াতো কে জানে? দ্বিতীয় পক্ষ এসে কি আর ভানুকানুকে দেখতো? না চাঁপার সঙ্গে বনিয়ে থাকতো?

সে দুর্ভাবনা গেল।

এখন মান-ভাঙানোর খাটুনি।

রাতটা ওতেই যাবে আর কি!

কিন্তু সে রাতটা কি ওতেই গিয়েছিল প্ৰবোধের?

সেই রাত্রের মধ্যভাগে ভয়ানক একটা শোরগোল ওঠে নি বাড়িতে?

হ্যাঁ, ভয়ানক শোরগোলই উঠেছিল সুবর্ণর শাশুড়ীর আফিমের কৌটো চুরি করে মুক্তি পাবার হাস্যকর প্রচেষ্টায়।

হলো না কিছুই, হলো শুধু ধাষ্টিামো। তবুও কেলেঙ্কারিটা তো হলো। ডাক্তার আনতে হলো সেই মাঝরাত্তিরে, আর থানা-পুলিশের ভয়ে ডাক্তারকে দর্শনীর ওপর আবার ঘুষ দিতে হলো। যদিও গেলাস গেলাস নুনজল খাওয়ানো ছাড়া আর কিছুই করলো না ডাক্তার।

সে নির্লজ্জ খৃষ্টতার প্রসঙ্গে জীবনভোর অনেক লাঞ্ছনা-গঞ্জনা খেতে হয়েছে সুবৰ্ণাকে।

এমন কি যে ভাসুর কখনো কিছু বলে না, সে পর্যন্ত বলেছে, বস্তা বস্তা নাটক নভেল পড়ে এইটি হয়েছে আর কি!

তা সত্যিই হয়তো পড়েছে সুবর্ণ, বস্তা বস্তাই পড়েছে। সেই বস্তা বস্তার কল্যাণে বস্তা বস্তা কথাও হয়তো শিখেছে, কিন্তু আফিমের মাত্ৰাটা কতখানি হলে সেটা ধাষ্টামো না হয়ে মুক্তিফলপ্ৰসূ হয়, সে কথা শেখে নি!

তা যদি শিখতে পারতো, তা হলে সুবৰ্ণলতার জীবন-নাট্যে সেখানেই যবনিকা পড়ে যেত।

বিয়ের মাত্রা সম্পর্কে কোনো দিন কোনো জ্ঞানই যদি থাকতো সুবৰ্ণলতার! কিন্তু ওকথা থাক। এখন প্ৰবোধচন্দ্র আর সুবৰ্ণলতার যে বৃহৎ ফটোগ্রাফ দুখানা মুখোমুখি টাঙানো রয়েছে ওদের বড় ছেলের ঘরে, তাদের বেষ্টন করে ফুলের মালা দুলছে।

প্রতি বছর শ্ৰাদ্ধবার্ষিকীতে শুকনো মালা বদলে নতুন মালা দেওয়া হয়।

সার্থক জীবনের প্রতিমূর্তি ওই ছবিটা দেখে কে বলতে পারবে গায়ে কেরোসিন ঢালা বাদে আত্মঘাতী হবার যত রকম পদ্ধতি আছে, সবই একবার করে দেখে নিয়েছে মানুষটা!

কিন্তু আশ্চৰ্য, আশ্চর্য!

শেষ পর্যন্ত ক্ৰটি থেকে গিয়েছে সমস্ত পদ্ধতিতেই। হয়তো। ওটাই বিধিলিপি সুবৰ্ণর! নইলে কে কবে শুনেছে। ছাত থেকে লাফিয়ে পড়েও বাঁচে মানুষ!

অবিশ্যি রান্নাঘরের ছাত, একতলা, নিচু—তবু ছাত তো!

পড়েছিল সেই ছাত থেকে!

তদবধি ছাতের সিঁড়ির দরজাটা বন্ধ করা থাকতো। চাবি থাকতো মুক্তকেশীর হাতে।

মুগ্ধই কি দয়াদাক্ষিণ দেখিয়েছেন, কিছু?

কিছু না।

যোগে গঙ্গাস্নানের বায়না নিয়ে শাশুড়ীর সঙ্গে চুপি চুপি গঙ্গাস্নানে গিয়ে দেখেছে—হয় নি।

লাভ হয় নি!

কেউ কোনোদিন এ সন্দেহ করে নি, সুবৰ্ণ স্রেফ তলিয়ে যাবার জন্যে আপ্ৰাণ চেষ্টা করছে।

তাই চেষ্টা সফল হতো না।

সঙ্গে যারা যেত তারাই সহসা ওর হাত ধরে টান দিত, যাচ্ছ কোথায়? এই ঘাটের কাছে কাছে থাক না? অত এগোবার দরকার কি?

কিন্তু এতই বা অতিষ্ঠ কেন সুবৰ্ণলতা?

উমাশশী, গিরিবালা, বিন্দু, এরাও তো থেকেছে ওই একই পরিবেশে? কই, ওরা তো রাতদিন মরণের বাসনায় উদ্বেল হয় নি?

হয়তো সত্যিই মূল কারণ ওই বস্তা বস্তা নাটক-নভেল! আর তো কারণ দেখা যায় না!

কিন্তু সেই বস্তা বস্তার আমদানিকারক ছিল কে? ওই যুগের থেকে পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে থাকা বাড়িটার অন্ধকার অন্তঃপুরে এসে ঢুকতো তারা কোন পথে? নতুন নতুন বই আর পত্র-পত্রিকা এসে এসে ঢুকতোও তো!

চলতি সাহিত্যের ওই খবরটা কি সে রাখতো? ওই যোগানদার? নাকি সুবৰ্ণলতার নির্দেশে খুঁজে আনতো?

সুবৰ্ণলতার নির্দেশ!

সুবৰ্ণলতা আবার নির্দেশ দিতে যাবে কাকে?

তা ছিল একজন।

যে নাকি সুবৰ্ণলতার নির্দেশ মানতে পেলে কৃতাৰ্থ হতো।

ক্ষ্যাপাটে ক্ষ্যাপাটে ছেলেটা, ভালো নামের ধার কেউ ধারতো না, দুলো নামেই বিখ্যাত। স্কুলে ক্লাসে প্রমোশন পাওয়া ছাড়া আর কোনো ব্যাপারে হারাতে দেখা যেত না তাকে। অসাধ্য সাধন করার ক্ষমতা ধরতো দুলো।

সুশীলার কোন এক দূর সম্পর্কের ভাগ্নে, সেই সূত্র ধরে এদের বাড়িটাকে বলতো, মামার বাড়ি, সুবৰ্ণকে বলতো মামী।

সুবৰ্ণকে বই যোগাবার ভার নিয়েছিল সে।

কেন নিয়েছিল কে জানে!

হয়তো তার ক্ষ্যাপাটে বুদ্ধিতে অপরকে খুশি করবার প্রেরণাটাই এর কারণ। সবাইকে খুশী করতে সাধ হতো তার। তা ছাড়া মেজমামীর উপর অহেতুক একটা টান ছিল দুলোর।

বোধ করি হৃদয়ের ক্ষেত্রে কোথায় কোনোখানে তারা ছিল সমগোত্র। এ বাড়ির মেজবৌও যে একটু ক্ষ্যাপাটে, এ তো সর্বজনবিদিত।

কোথা থেকে যে দুলো নানাবিধ বই কাগজ সংগ্রহ করে আনতো দুলোই জানে। সুবৰ্ণলতা প্রশ্ন করলে বলতো, মল্লিকবাবুর বাড়ি থেকে আনি। মল্লিক। বাবু যে সক্কল বই কেনে গো! টাকার তো অধিবাদি নেই ওনার! আর বলে, দুলো রে, লক্ষ্মী সার্থক হয়। সরস্বতীকে কিনে।

কী সূত্রে যে দুলো সেই লক্ষ্মীর বরপুত্র ও সরস্বতীর প্রিয় পুত্র মল্লিকবাবুর বাড়িতে ঢুকে পড়বার ছাড়পত্র পেয়ে গিয়েছিল, সে কথা বোধ হয়। দুলো নিজেই ভুলে গেছে। তবে দেখা যায় দুলোর সেখানে অবাধ গতিবিধি। দুলো যথেচ্ছ বই আনে।

ব্যাপারটা সন্দেহজনক।

সুবৰ্ণরও হয়েছিল সন্দেহ। চুরি নয় তো?

সে সন্দেহ ব্যক্ত করেছিল সুবর্ণ অন্য প্রশ্নে। বলেছিল, তুই তো নিজে পড়তে লিখতে জনিস না, বই চাইলে রাগ করে না?

দ্যুলোকে কেউ কখনো তুমি করে না।

সুবৰ্ণও করলো না।

বলল, তুই তো পড়িস না? ওরা রাগ করে না?

দুলো মেয়েদের মত গালে হাত দিত, রাগ করবে, কী বল? যারা বই পড়তে ভালবাসে, মল্লিকবাবু তাদের খুব ভালবাসে। মেয়েছেলেরা পড়লে তো আরোই। বলে, মেয়েছেলেরা যতদিন না। মানুষ হচ্ছে, ততদিন আর আমাদের দেশের দুঃখু ঘুচিবে না। ওনার বাড়ির সবাই তো ক অক্ষর গো-মাংস! বলে, তুই একটা আমার ভক্ত জুটলি, তাও মুখ্যু! আমার কপোলই এই। আমি যদি পড়তে ভালবাসতাম, মল্লিকবাবু বোধ হয় আলমারি সুন্ধু সব বই দিয়েই দিত। আমায়! … আচ্ছা! মেজমামী, রাতদিন যে দেশের দুঃখু দেশের দুঃখুটা করে মল্লিকবাবু, দেশের দুঃখুটা কী?

আছে দুঃখু, তুই বুঝবি না—, সুবর্ণ উত্তেজিত হত, দেশের কথা আর কি বলেন তোর মল্লিকবাবু?

কত বলে! একগাদা লোক আসে, আর ওই গপপোই তো হয় বৈঠকখানায়া!

তুই শুনিস না সেসব কথা?

সুবৰ্ণলতার স্বর চাপা, উত্তেজিত।

দুলো মেজমামীর এই ভাবের কারণটা বুঝতে পারে না। হেসে ফেলে বলে, শুনবো না কেন? এক কান দিয়ে শুনি, এক কান দিয়ে বার করি।

কেন তা করিস? মনে রাখতে পারিস না?

দুলো অবাক হয়ে বলে, শোনো কথা, আমার কিসের দুঃখ যে ওই শখ করে টেনে আনা দুঃখুকে বরণ করতে বসবো? এ তো বেশ আছি!

না, বেশ নেই! সুবর্ণ উত্তেজিত গলায় বলে, আছে দুঃখু। বুঝতে হবে সেটা।

দুলো মনে মনে বলতো, মল্লিকবাবু আর আমাদের মেজমামীটা দেখছি। একই জাতের পাগল। তারপর বলে বসতো, মল্লিকবাবু ঠিক তোমার মতন কথা বলে। তোমাকে যদি দেখতে পেতো, নিৰ্ঘাত খুব ভালবাসতো। দেখার ইচ্ছেও রয়েছে—

সুবৰ্ণর গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে।

সুবৰ্ণ তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, দূর বোকা ছেলে। বলতে নেই। ও-কথা। খবরদার আর ও-কথা কখনো মুখে আনিস নি।

দুলো ভয়ে ভয়ে বলে, বাবু বলছিলো কিনা সেদিনকে-

কি বলছিল?

বলছিল, মেয়েমানুষ হয়ে এত শক্ত শক্ত বই এত তাড়াতাড়ি পড়ে ফেলে, দেখতে আহ্লাদ হয়। তোর মেজমামীকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে দুলো!

চুপ চুপ, একদম চুপ!

ক্ষ্যাপা ছেলেটাকে থামিয়ে দিত সুবর্ণ। কিন্তু থামাতে পারতো না নিজের ঘরটাকে, আর সে ঘরের মালিককে দেখতে? যাকে সুবৰ্ণ দেবতারূপে কল্পনা করে রেখেছে?

তা দেবতা ছাড়া আর কি?

যে ব্যক্তি বোঝে লক্ষ্মীর সাথীর্কতা সরস্বতীকে আহরণ করায়, আর দেশের দুঃখ যার মনকে স্পর্শ করে, দেবতাই সে!

সংসারে এইসব মানুষও আছে।

তিনি নাকি এই দুঃখ নিয়ে আলোচনা করেন, বক্তৃতা দেন, সুরেন বাঁড়ুয্যে, বিপিন পাল এঁদের সঙ্গে নাকি চেনা-জানা আছে তার, রবি ঠাকুরকে নাকি অনেকবার দেখেছেন তিনি। কী অলৌকিক কথা!

অথচ ওঁর বৌ নাকি ওসব দুচক্ষের বিষ দেখে। নাকি রাতদিন বাড়িতে গোবরজলের ছড়া দিয়ে বেড়ায় সে, ভিজে কাপড় পরে।

আশ্চর্য! আশ্চর্য! পৃথিবীটাই কি তাহলে এই রকম?

 

একখানা পত্রিকায় প্ৰবন্ধ পড়ছিল সুবর্ণ, ময়াল সাপের কথা নিয়ে।

ময়াল সাপ নাকি হিমশীতল আলিঙ্গনে গায়ের উপর পাকে পাকে এঁটে বসে, চোখে ধরা পড়ে না এমন আস্তে আস্তে চাপ দিতে থাকে, সে চাপ ক্রমশ বজকঠিন হয়ে বসে।…সেই অদৃশ্য নিষ্ঠুর পেষণে বাইরের চেহারাটা অবিকল রেখেও—চুর্ণ করে ফেলে অধিকৃত শিকারের হাড়গোড়।

পড়তে পড়তে উত্তেজিত হচ্ছিল সুবৰ্ণ, অন্য আর একটা কিসের সঙ্গে যেন ওই সাপটার প্রকৃতির মিলা খুঁজে পাচ্ছিল।…

ঠিক ঠক করে জানলায় টোকা পড়লো।

উৎফুল্ল মুখে উঠে বসলো সুবর্ণ।

আবার বই!

দুলোর ওপর কৃতজ্ঞতায় মন ভরে ওঠে। সুবর্ণর এতটা বয়সে একমাত্র ক্ষ্যাপাটে ছেলেটার মধ্যে অকারণ ভালবাসার প্রকাশ দেখেছে।

জানলায় টোকা, এটা বই আনার সঙ্কেত। একতলার একটা গলির পাশের ঘর বেছে নিয়েছে সুবৰ্ণ দুপুরবেলার বিশ্রামালয় হিসেবে।

এখান থেকে এই পদ্ধতিটায় কাজ সহজে হয়। দুলো জানলায় টোকা দেয়, সুবৰ্ণ জানলা খুলে দেয়, সেই পথে বই প্রেরণ করে দুলো।

এ ছাড়া উপায় কি?

নিত্য এত নাটক-নভেল সরবরাহ করছে দেখলে দুলোকে পাশপেড়ে কাটবে না। এ বাড়ির গিন্নী আর তার ছেলেরা?

এ ঘরটা প্রকৃতপক্ষে বাড়ির যত আপদ-বালাইয়ের ঘর! সিঁড়ির ওপর চিলেকোঠা তো নেই, তাই এই প্ৰায়-পাতাল ঘর!

ভিতরের অন্ধকার-অন্ধকার দালানের দিকে একটামাত্র দরজা, আর পিছনের অন্ধকার-অন্ধকার গলির দিকে দুটো জানলা। আয়তনের অনুপাতে যাদের গবাক্ষ বলাই সঙ্গত।

এই জানলা দিয়ে সরু যে দুটি আলোকরেখা ঘরে প্রবেশ করে, সেই হচ্ছে সুবর্ণর আলোকবর্তিকা।

ওইটুকুকে সম্বল করে যে পড়তে পারে, সে বোধ করি সুবর্ণ বলেই।

একদা ভাড়ারঘর থেকে একটা নড়বড়ে চৌকি বাতিল করে এ ঘরে ফেলে রাখা হয়েছিল, সেটাই সুবর্ণর রাজশয্যা।

এ ঘরটা বেশ ঠাণ্ডা, গোলমাল নেই। এই ছুতো দেখিয়ে দুপুরে এই ঘরেই পড়ে থাকে সুবর্ণ।

না, এখন আর দুপুরের অবসরে সুপুরি কাটা কি চাল-ডাল বাছার কাজ করতে হয় না বৌদের, তাদের মেয়েগুলো তো ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে, তারাই করে।

তা ছাড়া আর যে করে সে করে, সুবর্ণ কিছুতেই না। সুবর্ণর এই মৌতাতটি চাই।

চৌকির মাথার কাছের জানলা খুলে বই পড়ছিল সুবর্ণ, বাকি জানলাটা বন্ধ ছিল। টোকা পড়েছে সেটাতে।

সহাস্য মুখে চৌকি থেকে নেমে এসে জানলাটা খুলে দিয়ে চুপি চুপি বলে, আবার পেয়েছিস আজ?

চারটে-, দুলো বিগলিত আনন্দে বইগুলো বাড়িয়ে ধরে।

দুলোর মুখে যেন একটা চাপা আনন্দোচ্ছাস!

এ কী শুধুই বইয়ের আহ্লাদ।

সরু জানলা, ঘোষাৰ্ঘেষি গরাদে, একটি একটি করে বই টেনে নিতে হয়।

বইগুলো শেষ করেই বলে ওঠে দুলো, কপাটটা হাট করে খুলে এখানটায় দাঁড়াও তো মেজমামী!

কেন রে?

বিস্মিত প্রশ্ন করে সুবর্ণ।

দুলো ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে নিচুপের ইশারা করে। নিচু গলায় বলে, আছে। মজা, দাঁড়াও!

কাঠের গরাদেতে মুখটা চেপে ধরে সুবর্ণ বাইরেটা দেখবার চেষ্টা করে, কোথায় দুলোর মজা অবস্থান করছে।

ইতস্তত চাইতেই চমকে উঠলো। সিঁদুরের মত লাল হয়ে উঠলো মুখটা।

পরীক্ষণেই মাথাটা সরিয়ে নিয়ে চৌকির উপর এসে বসে পড়ল!

এই মজা!

বোকা ছেলেটার এ কী কাণ্ড!

কাকে ডেকে এনেছে ও জানলার নিচেয়?

সন্দেহ নেই। ওই মল্লিক। বাবু!

না বলে দিলেও বুঝতে অসুবিধে হয় না।

ছি ছি! এ কী করে বসলো দুলো!

 

অথচ অনেক বুদ্ধি খাঁটিয়ে এই ঘটনাটি ঘটিয়ে বসেছে দুলো।

এই দুটো মানুষই যে পরস্পরকে দেখতে পেলে খুশী হবে, এমন একটা ধারণা জন্মে গিয়েছিল তার, অতএব ভেবে নিয়েছিল সেই খুশিটা করতে হবে।

চালাকি একটু করতে হয়েছে।

মল্লিকাবাবুকে বলতে হয়েছে, মেজমামীর একান্তো। ইচ্ছে তোমায় একবার দেখে। বলে, এত বই কেনে, আবার অপরকে পড়তে দেয়, কেমন সেই মানুষটি একবার দেখতে সাধ হয় রে দুলো!

প্রায়ই বলেছে।

রোজই বলেছে।

এ কথাও বলেছে, মেজমামী যদি মেয়েমানুষ না হোত নিজেই আসতো। ওরাও তো আবার আপনার মতন দেশের দুঃখুর বাই!

অবশেষে এই ঘটনা।

ভদ্রলোক হয়তো ভদ্রতার বশেই এমন অভদ্র কাজটা করতে স্বীকৃত হয়েছেন।

কিন্তু সুবর্ণর সে-সব জানিবার কথা নয়, তাই সুবর্ণ ভাবে, ছিছি, উনিই বা কেমন!

তবে কি সুবর্ণ যা ভাবে তা নয়?

বোকা ছেলেটাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বই ঘুষ দেওয়াটাও কি তাহলে এই উদ্দেশ্যে?

কিন্তু তাই কি?

সেই মুহূর্তের দেখাতেও উজ্জ্বলকান্তি সেই মানুষটার দুই চোখে যে দৃষ্টি দেখেছে সুবর্ণ, সে কি অসৎ চরিত্র পুরুষের লুব্ধ দৃষ্টি?

তা তো নয়।

সে দৃষ্টিতে যেন সসম্ভ্রম পূজো!

সে দৃষ্টি আর কবে কোথায় দেখেছে সুবৰ্ণ?

দুলো ভেবেছিল ঘটনান্তে ঘুরে সদর দরজা দিয়ে বাড়ি এসে ঢুকবে সে, এবং মহোৎসাহে রসিয়ে রাসিয়ে গল্প করবে। কেমন করে এমন কৌশলটি করেছে। দুলো!

কিন্তু মেজমামীর সেই মুহূর্তের ভঙ্গিতেই সব সাহস উবে গেল তার।

সর্বনাশ করেছে!

মেজমামী রাগ করেছে!

অথচ বেচারা কত আশায় স্বপ্ন দেখতে দেখতে আসছে। পলায়ন করা যাক বাবা!

কিন্তু দুলোর সেদিন পলায়ন করা হয় নি।

এই ভয়ঙ্কর কাণ্ডটি চোখে পড়েছিল। আর কারো নয়, প্রভাসচন্দ্রের চোখে।

শরীরটায় তেমন জুৎ ছিল না বলে, অসময়ে কোর্ট থেকে ফিরে আসছিলো, দূরে থেকে দেখলো দুটো লোক যেন গলিতে ঢুকলো।

একটা তো দুলো, আর একটা?

ধীরে ধীরে ওদের পিছু নিয়েছিলো প্ৰভাস।

তার পরেই চোখে পড়ল। এই দুর্নীতিপূর্ণ দৃশ্য!

একটি সুকান্তি ভদ্রলোক ফিন্‌ফিনে আদির পাঞ্জাবি গায়ে, মিহি ধুতির লম্বা কোঁচা, মেজবৌয়ের বিশ্রামঘরের জানলার নিচে গিয়ে দাঁড়ালো—যেন জুলিয়েটের রোমিও! যেন যমুনাতীরের কেষ্ট!

দুলো হারামজাদা কী যেন একটা জিনিস। পাচারও করলো জানলা দিয়ে! এতেও পুরুষের রক্ত টগবগিয়ে ফুটে উঠবে না? বংশমর্যাদার চেতনা নেই মুক্তকেশীর ছেলেদের?

এ যদি প্ৰবোধ হত, খুন একটা হয়েই যেত আজ মুক্তকেশীর গলিতে! হয়। দুলো, নয়। ওই প্ৰেমিকটি!

প্ৰভাস বলেই প্ৰাণে বাঁচালো!

লোকটার গায়ে হাত দিতে বেধেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বড়লোকের ছেলে। পরে মোচড় দিয়ে উঁকিলের ঘরে কিছু এনে ফেলতে হবে।

তাই শুধু রূঢ় কথা, নাম-ঠিকানা জেনে নেওয়ার উপর দিয়েই গেল।

কিন্তু দুলো?

কুটুমের ছেলে বলে কি রেয়াৎ করা হোল তাকে?

না, তা হয়নি।

দুলোর বুদ্ধিটা কম, গতরটা কম গতরটা কম নয়। পাড়ার লোক তাকে গুণ্ডা নামে ডাকতো। সেই দুলো সেদিন মার খেতে খেতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।

চান্দা করে মেরেছিল পাড়ার লোকেরাও।

জ্বরো কুকুরের মত জিভ বার করে হাঁপাতে হাঁপাতে শেষ পর্যন্ত লটকে পড়েছিল ছেলেটা।

কিন্তু ওইটুকুই কি ঝড়?

মরে তো আর যায় নি যে ঝড়কে ঝড় বলা হবে?

গায়ের ব্যথা মরতে কদিন লাগবে?

ঝড়টা অন্য মূর্তিতে বাড়ির ওপর আছড়ে পড়েছিল।

এ বাড়ির মেজবৌ রাস্তায় বেরিয়ে এসে আধমরা ছেলেটাকে ওই হিংস্রতার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। মাথার ঘোমটা খুলে আর গলা তুলে বলেছিল, তোমরা মানুষ না কসাই?

বলেছিলো, ওকে কেন? মারো আমাকে মারো! এ মার তো দুলোর প্রাপ্য নয়, আমার প্রাপ্য!

বলেছিল, আমায় যদি মেরে শেষ করতে, তোমরাও রেহাই পেতে, আমিও রেহাই পেতাম।

শুধু যে গলাই খুলেছিল। তাই নয়, ছেলেটাকে হিচড়ে টেনে নিতে নাকি পাড়ার পুরুষদের হাতে হাত ঠেকেছিল তার।

এর পর যে একটা ভয়ানক ঝড় উঠবে, তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে!

সে ঝড়ের তুলনা মেলে চৈত্র-বৈশাখের সন্ধ্যায়। কালবৈশাখীতে।

সে ঝড়ে গাছ পড়ে, চাল ওড়ে, পাকাবাড়ির দেওয়াল সুদ্ধ দোলে।

যেমন ঝড়ে দর্জিপাড়ার এই গলিটা উদ্দাম হয়ে ওঠে, বীভর্ৎস হয়ে ওঠে। দশ-বারোটা বাড়ির বাসি উনুনের ছাই উচ্ছিষ্ট ভাত আর এঁটো শালপাতায় উপচে ওঠা ডাস্টবিনটা উল্টে গড়াগড়ি খেতে থাকে, পাতা আর নোংরা কাগজের টুকরো ঝাঁপটে এসে গৃহস্থের ঘরের মধ্যে এসে ঢোকে, সমস্ত গলিটা আবর্জনার কুণ্ডে পরিণত হয়।

সেই কালবৈশাখীর ঝড় উঠল। সেদিন মুক্তকেশীর বাড়িতে।

এতদিনে টের পেয়ে গেছে। সবাই, নির্জনে নিচের তলার ঘরে বিশ্রাম করার বাসনা কেন সতীলক্ষ্মী মেজবৌয়ের!

তেজী পাজী হারামজাদী এটাই জানতো সবাই, এখন তো দেখা গেল। কতখানি নষ্ট, কত বড় জাঁহাবাজ ও!

মুক্তকেশী বলেছিলেন, মানুষের রক্ত যদি তোর গায়ে থাকে তোও বৌকে লাথি মেরে মেরে ফেল পেবো। আর যদি জন্তু-জানোয়ার হোস তো পরিবারকে মাথায় করে ভেন্ন হয়ে যা। নষ্ট মেয়েমানুষ নিয়ে ঘর করতে মুক্ত-বামনী পারবে না।

১.১২ ডান হাতে টুকটুকে করে মাজা তামার ঘটি

ডান হাতে টুকটুকে করে মাজা তামার ঘটি, বা কাঁধের উপর গামছায় মোড়া ভিজে কাপড়ের পুঁটলি।

পিছনে বছর ছয়েকের একটা মেয়ে।

কাশী মিত্রের ঘাটের কাছাকাছি একটা পুরনো দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন মুক্তকেশী। মেয়েটাকে উদ্দেশ করে বললেন, দোরটা ঠেল দেখি, আমি আর ছোব না।

কারো বাড়ির বাইরের কপাটে হাত দেন-না মুক্তকেশী। কারণ রাস্তার ধাঙড়দের ঝাটার ধুলো যে উড়ে যে উড়ে উড়ে এই সব কপাটে এসে পড়ে, এ কথা আর কারো ইহঁশের মধ্যে না থাকুক, মুক্তকেশীর অবশ্যই আছে।

মেয়েটা দরজাটায় সজোরে একটা ধাক্কা দিয়ে প্রায় হুমড়ি খেতে খেতে রয়ে যায়, দরজাটা আলগা ভেজানো ছিল মাত্র।

মুক্তকেশী ভিতরে ঢুকে এসে হাঁক পাড়েন, জগু, ও জগু, আছিস নাকি?

জগু মুক্তকেশীর ভাইপো, এবং এই পুরনো দোতলাটি মুক্তকেশীর ভাইয়ের বাড়ি। ভাই অবশ্য গত হয়েছেন অনেককাল, আছেন বিধবা ভাজ শ্যামাসুন্দরী। তা জগুর বদলে তাঁর গলাই পাওয়া গেল। ননদিনীর সাড়া পেয়ে অন্যান্য দিনের মত ছুটে এলেন না। তিনি, কোথা থেকে যেন সাড়া দিলেন, থাকবে না তো আর যাবে কোন চুলোয়? পেড়োর মন্দিরে বসে ফোঁটা-চন্নন কাটছে বোধ হয়।

গঙ্গাস্নান-ফেরত প্রায়ই একবার ভাইপোর বাড়ি ঘুরে যান মুক্তকেশী, ভাজের সাহায্য অভ্যর্থনা জোটেই, আজ এ রকম দূরাগত বংশীধ্বনির হেতু?

যেন বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে সাড়া আসছে। মুক্তকেশী অবাক হয়ে বলেন, তুমি কমনে থেকে কথা কইছো বৌ?

এই যে যমের দক্ষিণ দোর থেকে। লক্ষ্মীছাড়া হাড়হাবাতে ছেলে ছেকল তুলে রেখে দিয়ে গেছে।

ওমা সে কি কথা!

মুক্তকেশী এগিয়ে আসেন।

পিছনের মেয়েটা হঠাৎ হি হি করে হেসে ওঠে, মামী-ঠাকুমাকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছে—

মুক্তকেশীর মুখেও একটু হাসি ফুটে ওঠে। তবে সেটা গোপন করে তাড়া দিয়ে ওঠেন, মরণ আর কি! হেসে মরছিস যে— তারপর কপাটের শিকলটা খুলে দেন ছড়াৎ করে।

রান্নাঘরের মধ্যে বসে কুটনো ফুটছিলেন শ্যামাসুন্দর, মুক্তকেশী ঢুকতেই বঁটিটা ঠেলে রেখে

মেয়েটা আর একবার হেসে ফেলে পরনের বৌপাগলা শাড়িখানার আঁচলটা মুখে চাপা দিয়ে বলে, মামী-ঠাকমা বুঝি দুষ্টুমি করেছিলে? তবে জ্যাঠামশাই শাস্তি দিয়ে গেছে?

শ্যামাসুন্দরী এ হাসির উত্তরে হাসেন না-বিরক্তি কুঞ্চিত স্বরে বলেন, দুষ্টুমি কেন, জন্ম জন্ম মহাপাতক করেছিলাম, তাই এত শাস্তি ভোগ করছি।

মুক্তকেশী মেঝোয় বসে পড়ে বলেন, হলো কি?

কী হলো তা জানে যম! আদালতে আজ নাকি মামলার দিন আছে, তাই আমার মাতৃভক্ত সন্তান মায়ের পাদোদক্ খেয়ে যাত্রা করবেন!

মুক্তকেশী মামলা সম্পর্কে কিছুটা অবহিত আছেন। দেশের জমিজমা নিয়ে মায়ের নামে মামলা ঠুকে বসে আছে জগু।

জমিজমা বাগান পুকুর আছে বেশ কিছু। সব জ্ঞাতিরা খাচ্ছে। তাই শ্যামাসুন্দরী সেই জ্ঞাতি দ্যাওর ও ভাসুরপোদের কড়া নির্দেশ দিয়েছেন, এই জবরদখলটি ত্যাগ করে তোমরা মানে মানে আমার প্রাপ্য অংশের টাকাটি ফেলে দাও।

জগু মাকে চোখ রাঙিয়েছে।

বলে, বলি প্ৰাপ্য কার? তোমার না। আমার? ওসব আমার ঠাকুর্দার বৈ তোমার ঠাকুর্দার নয়! তুমি পরের বাড়ির মেয়ে, উড়ে এসে জুড়ে বসে রমানাথ মুখুয্যের ভিটে থেকে তার বংশধরদের তাড়াবার কে হে?

অতঃপর মায়ে বেটায় লেগে গেছে লোগ। ঝামাঝাম, ফলশ্রুতি নালিশ! শ্যামাসুন্দরী দেবী জগন্নাথ মুখুয্যের ন্যায্য সম্পত্তির উপর অনধিকার হস্তক্ষেপ করছেন।

মুক্তকেশী জানেন এ কথা, কিন্তু দরজা বন্ধের ব্যাপারটা রহস্যজনক। তাই হেসে ফেলে বলেন, মায়ের সঙ্গে মামলা লড়ে মায়ের পাদোদক জল খেয়ে জিততে যাবে? তা বেশ। কিন্তু ছেকল কেন?

শ্যামাসুন্দরী উত্তর দেবার আগেই পিছন থেকে উত্তর দিয়ে ওঠে শ্ৰীমান জণ্ড। বাজখাই গলায় বলে ওঠে, ছেকল কেন? বলুক-বলুক, ওই নিকষা বুড়ী নিজেই বলুক ছেকল কেন? একদণ্ড পূজোয় বসেছি, অমনি ননদের কাছে ছেলের নামে লাগানো-ভাঙানো হচ্ছে, কেমন?

জগু একটা তাচ্ছিল্যের হুঙ্কার ছাড়ে।

পরনে ফরসা হলদেটে রং একখানা খাটো বহরের কেটে ধুতি, লোমশ বুকের উপর একছড়া রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা। পিসির গলার সাড়া পেয়ে নিঃশব্দে এসেছে দোতলা থেকে।

শ্যামাসুন্দরী মুখ বঁকিয়ে বলেন, ওই শোনো ঠাকুরঝি, নদেরচাঁদ ভাইপোর বাক্যি শোনো। তোর নামে লোকের কাছে লাগাতে বসবো, এত সস্তা জিভ আমার নয় রে লক্ষ্মীছাড়া!

শুনে যাও পিসি শুনে যাও—, জগু দরাজ গলায় বলে, দেখো পেটে পেটে কী শয়তানির প্যাঁচ। হবে না? দাদামশাইটি আমার কেমন ঘুঘু ছিলেন! নাম করলে হাঁড়ি ফাটে। তাঁরই কন্যে তো! যেই শুনেছে আজ মামলার দিন, অমনি পা নুকিয়ে বসে আছে! হেতু? না পাছে জবরদস্তি করে পাদোদক জলটুকু নিই।… আমিও বাবা তেমনি বজাত, দিয়েছি। দরজায় ছেকল তুলে। বেরোতে তো হবে একসময়। দেখি তখন কেমন করে পা আটকায়? পূজো সেরে এসে ওই চৌকাঠে জল ঢেলে ওৎ পেতে বসে থাকতাম। ছেকল খোলা পেয়ে যেমনি না বেরোবে, পড়বে তো পা জলের ওপর? সেই জল চেটে মেরে দেব-

নিজের বুদ্ধি-গরিমায় হা হা করে হেসে ওঠে জগু।

শ্যামাসুন্দরী তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন, ওরে আমার মাতৃভক্ত পুত্তুর রে! চব্বিশ ঘণ্টা মাকে পাশ পেড়ে কাটছেন, মায়ের নামে মামলা ঠুকে রেখেছেন আবার ঢং করে আসেন চন্নামেত্তর খেতে! জুতো মেরে গরু দান!

সমর্থনের আশায় নিনদের দিকে তাকান শ্যামা।

মুক্তকেশী কিন্তু ভ্ৰাতৃবধুর কথায় সমর্থন করেন না। অসন্তুষ্টভাবে বলেন, তা বললে কী হবে বৌ, এ তোমার অনেয্য কথা! তুমি যদি সোয়ামীর মরণকালে তার কানে বিষমন্তর ঝেড়ে পেটের ব্যাটাকে বঞ্চিত করে যথাসর্বস্ব নিজের নামে লিখিয়ে নিয়ে থাকো, ও কেন হকের ধন ছাড়বে? এ হলো নেয্য দাবির কথা। তা বলে ছেলের তুমি মাতৃভক্তির কসুর পাবে না।

শ্যামাসুন্দরী যদিও বড় ননদকে যথেষ্ট খাতির করে চলেন, তবু এতটা অসহ্য সব সময় সইতে পারেন না! গৰ্জন করে বলেন, অমন মাতৃভক্তির ক্যাথায় আগুন! ও ছেলের মুখদর্শন করলে নরক দর্শনের কাজ মেটে। বলি ঠাকুরঝি, সব্বস্ব নিজের নামে লিখিয়ে নেবো না তো কি সব্বস্ব ওই বাউড়ুলে উড়নচণ্ডে অকাল কুষ্মাণ্ড গেঁজেলটার হাতে তুলে দিয়ে ঘুচিয়ে পুচিয়ে দেব? ওর হাতে পড়লে এ ভিটেয় এসে দাঁড়াতে পেতে? একখানা একখানা করে ইট বেচে গাঁজা খেত না? আর ওর সেই গেঁজেল গুরুর সেবায় লাগাত না? আবার উদারতা কতা! জ্ঞাতিরা লুটেপুটে খাচ্ছে খাক! তাদের ঠাকুর্দার সম্পত্তি! নিজের যে তাহলে এরপর মালা হাতে করে ভিক্ষেয় বেরুতে হবে!

শ্যামাসুন্দরী একটু দম নেন।

মুক্তকেশী কিন্তু এহেন বিভীষিকার আশঙ্কাতেও দামেন না। জোর গলায় বলেন, তা হত হতই! ওর বাপের সম্পত্তি ও ওড়াতো! আর কারুর বাপের বিষয়ে তো নোখ ডোবাতে যেতো না! নেশা-ভাঙ আবার কোন বেটা ছেলেটা না করে? তাই বলে হকের দাবি পাবে না?

বিল তো পিসি বল তো!

জগু বুকে থাবড়া মেরে মিটমিটি হাসে।

শ্যামাসুন্দরী বিরক্ত গলায় বলেন, ভাইপোর সুয়ো হয়ে খুব তো বলছো ঠাকুরঝি, বলি আজ যদি আমি ওর হাতে পড়ি, কাল আমায় আঁচল পেতে ভিক্ষে করতে হবে না? আমার কি পেটের আর পাঁচটা আছে যে, ও না খাওয়াক আর একজন খাওয়াবে? আমি যাই মা বসুন্ধরার মতন সহ্যশীলা, তাই ওকে সহ্য করছি। অন্য মা হলে ওই ছেলের মুখে নুড়ো জ্বেলে দিয়ে চলে যেত।

ভাজকে যে ভালবাসেন না মুক্তকেশী তা নয়। সময়-অসময়ে অনেক করে ভাজ। তবু ঝোল তার কোলে টানেন না। বলেন, নুড়ো তোমার বুদ্ধির মুখেই জ্বালতে হয় বৌ! মামলা-মকদ্দমা হল বাইরের কাজ, বাপে-বেটায় হচ্ছে, ভাই-ভাইয়ে হচ্ছে, এই তোমার মতন গুণবতী মায়ের সঙ্গে হচ্ছে, তাই বলে মানুষ ধর্মাধর্ম ছাড়বে? মায়ে-বোটায় লাঠা-লাঠি বলে কি তুমি মরলে ও হবিষ্যি গিলবে না? না মাথা মুড়োবে না?

জগু এতক্ষণ দুই কোমরে হাত দিয়ে বীরের ভঙ্গীতে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিল, এবার পরম সন্তোষের সুরে বলে, এই দেখো জ্ঞানবানের কথা! বুঝলে পিসিমা, এই সহজ কথাটুকু আর ওই নিকষা বুড়ীকে বুঝিয়ে উঠতে পারলাম না! কথায় বলে, স্বৰ্গাদপি গরীয়সী! বলে কিনা? তুমি জ্ঞানবান, বুঝমান, তোমার সঙ্গে কথা কয়ে সুখ আছে!

শ্যামাসুন্দরী টিটকিরি দিয়ে ওঠেন, তা সুখ থাকবে না কেন? কোলে ঝোল টানলে সবাই জ্ঞানবান! বলি, তোমার ছেলেরা এ রকম হলে কী বলতে ঠাকুরঝি! ভাগ্যিগুণে তারা সবাই ভাল, তাই। আমার হচ্ছে এক ব্যানুন নুনে বিষ!

ভাগ্যিগুণে নয় হে-বুদ্ধির গুণে! জগু রায় দেয়, পিসির ছেলেরা কি আমনি ভাল হয়েছে? কথাতুই আছে, যেমন মা, তার তেমন ছা! তা যেমন তুমি তেমনি তোমার পুত

জ্ঞানপাপী!

বলে শ্যামাসুন্দরী মুখ বাঁকিয়ে আবার কুটনো কুটিতে বসেন।

মুক্তকেশী ও সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে বলেন, তাও বলি বৌ, ছেলে কেন বাউণ্ডুলে হবে না? বয়েস পার হয়ে গেল ছেলের, তুমি বিয়ে দিলে না–

কথাটা সত্যি।

বিয়ের বয়েস কোন কালে পার হয়ে গেছে জগুর। মুক্তকেশীর বড় ছেলে সুবোদের থেকেও বড় সে। কিন্তু পাত্র হিসেবে যে সুপোত্র নয় সে কথা বলাই বাহুল্য। লেখাপড়ায় জলাঞ্জলি দিয়ে ছেলেবেলা থেকে কেমন করে যেন গাঁজার আড্ডায় ভিড়ে পড়েছিল, আবার এখন এক অবধূত বাবার শিষ্য হয়েছে।

মুক্তকেশী আগে বহু চেষ্টা করেছেন হাল ধরতে, কিন্তু নৌকো ঠেলে নিয়ে যেতে সক্ষম হন নি। হন নি। অবশ্য জগুরই প্রবল প্রতিবন্ধকতায়, তবু তিনি যখন তখন ভাজকেই দোষী করেন। এখনো করলেন, বয়সের ছেলে, সময়ে বে-থা না হলে—

থামো ঠাকুরঝি, ওকথা মুখে এনে না। আর—, শ্যামাসুন্দরী গুরুজনের সম্মান ভুলে ঝঙ্কার দিয়ে ওঠেন, নিজে তো ওই এক ভূত বিইয়ে জ্বলে পুড়ে মরছি। আবার কি পরের মেয়ের কপালে তেঁতুল গুলতে সেই ভূতের বিয়ে দেব? পাগল তো হই নি এখনো!

প্রশ্নটা তামাদি হয়ে গেছে, তবু মুক্তকেশী অসন্তুষ্ট স্বরে বলেন, তার মানে তুমি চাও আমার বাপের বংশটা লোপ পাক?

পেলে আর করছি কি! শ্যামাসুন্দরী বলেন কত কত রাজা-বাদশার বংশ লোপ পাচ্ছে!

তবে আর কি! লোকের গলা কাটা যাচ্ছে তো আমার গলাটাও কাটি! তুমি না দাও, আমি এবার জগুর বিয়ে দেব। বলতে কি, সেই উদ্দিশ্যেই আসা আজ। গঙ্গার ঘাটে এক মাগী কেন্দে পড়লো। বলে, গলায় গলায় আইবুড়ো মেয়ে, ইচ্ছে হয় যে গলায় দড়ি দিই! দিদি যদি একটা পাত্তরটাত্তর দেখে দেন! আমার মনে এল জগুর কথা। এখনো যদি ধরে করে একটা বিয়ে দিতে পারা যায়–

জগু বলে ওঠে, এই দেখো পিসির দুর্মতি! বলি নিজেই তো বলে মর, ছেলেগুলো তোমার সব বৌয়ের গোলাম হয়ে আছে, বৌরা কান ধরে ওঠাচ্ছে বসাচ্ছে, আবার এ হতভাগার কানের মালিক আনার চেষ্টা কেন?

মুক্তকেশী সহাস্যে বলেন, শোনো কথা ছেলের! আগে থেকেই বুঝি গোলাম হয়ে বসছিস? বলি, সবাই তা হবে কেন? বৌকে পায়ের পাপোষ করে রেখে দিষ্টান্ত দেখা তুই!

হুঁ, দেখাবো বললেই দেখানো হয়! জগু বিচক্ষণের ভঙ্গীতে বলে, এই বেড়ালই বনে গেলে বন-বেড়াল হয়, বুঝলে পিসি? তার ওপর আবার আমার রক্তে আমার বাপের গুণ!

বটে, বটে। রে হতভাগা পাজী বাঁদর-, শ্যামাসুন্দরী ছিটাফিটিয়ে ওঠেন, দূর হ দূর হ আমার সুমুখ থেকে। মরা বোপকে গাল দিচ্ছিস লক্ষ্মীছাড়া? নরকেও ঠাঁই হবে তোর?

নরকে ঠাঁই চাইতে যাচ্ছে কে? জগু বুকে আর একটা থাবড়া মেরে বলে, সিগাগো থাকতে নরকে যেতে যাব। কী দুঃখে? মরণকালে মা মা করে মরব, মাতৃনামে তরে যাব। তবে ওই বিয়েটিয়ের কথা কইতে এসো না পিসি। বিয়ে করেছি। কি গোল্লায় গেছি!

তা যা বলেছিস-

মুক্তকেশী সহসা নিজ যুক্তি বিস্মৃত হয়ে একগাল হেসে বলেন, তা যা বলেছিস। এ ছোঁড়া দেখছি না পড়েই পণ্ডিত! বলেছিস ঠিক। আমার ছেলেগুলো কি আর মনিষ্যি আছে? বিশেষ করে পেবোটা! যেটা নাকি সব চেয়ে ডাকাবুকো ছিল! সেরেফ ভেড়া হয়ে বসে আছে। বৌ দজ্জালি করলে তেড়ে একবার করে মারতে আসে, আবার কেঁচো হয়ে গুটিয়ে পালায়। লাখোবার বলেছি, ও বৌ ত্যাগ দিয়ে আর একটা বিয়ে কর। সে সাহসও নেই। দিলে একবার বাহাদুরি দেখিয়ে বিদেয় করে, ওমা বৌ। কিনা তৎক্ষণাৎ বাপের সঙ্গে ফিরে এল!

এবার জগু একটু গম্ভীর হয়।

বলে, এটা পিসি তোমার অন্যায্য কথা হচ্ছে। তোমার মেজবৌকে তুমি অন্যায় নিন্দে করা। সুবো। আমায় বলেছে, আমার মায়ের হাতে না পড়ে অন্যত্র পড়লে, ওই বৌয়ের ধন্যি ধন্যি হত।

মুক্তকেশী সহসা যেন আকাশ থেকে হাত-পা ভেঙে ধপাস করে পড়েন।

সুবোধ!

সুবোধ বলেছে এই কথা!

কেন?

রীত-চরিত্তির মন্দ হয়ে যাচ্ছে না তো হতভাগার! ওই জাঁহাবাজ ভাদরবৌয়ের গুণ দেখেছেন তিনি! ভাদ্দরবৌ তাহলে গুণ-তুক করছে!

বড় দুঃখে আর রাগ আসে না-রুদ্ধকণ্ঠে বলেন, বটে! এই কথা বলেছে সুবো?

বলে তো! যখন তখন বলে! তা যাই বল পিসি, তুমিও তো সোজা মায়ের সোজা মেয়ে নও! জানি তো আমার ঠাকমাকে! কী নিধিটি ছিলেন!

মুক্তকেশী এবার ভয় খান।

কাণ্ডজ্ঞানহীন ছেলেটা কী বলতে কী বলে ঠিক কি?

উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, দুগৃগা, দুগ্‌গা, গঙ্গাচ্ছন করে এসে মাতৃনিন্দে শুনছি বসে বসে। চললাম বৌ।… এই ছুড়ি, চল। ওমা, কোথায় আবার গেল মুখপুড়ী?

গেছে। ওইদিকে বোধ হয়। পেয়ারা পাড়তে।

রাক্ষুন্সী যেন পেয়ারার যম। আবার এখন—

শ্যামাসুন্দরী আবহাওয়া হালকা করতে বলেন, তা সে আর কোন মেয়েছেলেটা নয়?

তা তো নয়—, মুক্তকেশী। আর একবার তোলা প্ৰসঙ্গ পেড়ে নামান, এই তো বললে তো? আমার মেজ বৌমার কাছে বল গিয়ে? শুনবে পেয়ারা খেলে নাকি পেট কামড়ায় ওঁর ছেলেমেয়েদের? চাপিটাকে সঙ্গে আনা বন্ধ করেছি কি সাধো? মা দজাল, মেয়েটা তো আমার পায়ের কাদা! ঠাকমা তোমার সঙ্গে যাব বলে রসাতল! মেম মা বলেন। কিনা, গঙ্গার ঘাটে বুড়ীদের দলে বসে রাজ্যের পাকা পাকা কথা শিখবে আর রাজ্যের ফল-পাকড় গিলে অসুখ করাবে—

আমি বলি, ও বটে! আচ্ছা! রইল তোমার মেয়ে। মাথা খুড়ে মরলেও আনি না। আর। বড়বৌমার এইটেকে নিয়ে আসি।

জগু বলে, এটা কিন্তু তোমার নিষ্ঠুরতা পিসি।

তা নিষ্ঠুর বলিস নির্মায়িক বলিস, সবই শুনতে হবে। মুক্তকেশী উদাস গলায় বলেন, সেদিন সেই কথার পর প্রবোধ কি এসে পরিবারের হয়ে হাতজোড় করে মাপ চেয়েছে? বলেছে কি মা, তুমি থোঁতা মুখ ভোঁতা করে ড্যাংডেঙিয়ে নাতনীদের নিয়ে গঙ্গাচ্ছনে যাবে, যা ইচ্ছা কিনে খাওয়াবে! বলে নি তো? তবে? তবে আর কিসের মায়া-মমতা আমার?

জগু সহসা উদ্দীপ্ত গলায় বলে ওঠে, তবে যদি বললে পিসি, এ তোমার শিক্ষার দোষ। এ যদি তোমার গোয়ার-গোবিন্দ জগু হত, বৌকে মেপে সাত হাত নাকে খৎ দেওয়াতো। মায়ের ওপর ট্যাফো! স্বৰ্গাদপি গরীয়সী না? আমার মা, আমি পাশ পেড়ে কাটতে পারি, তা বলে পরের মেয়ে উঁচু কথা বলবে? শাস্তরে বলেছে–

শ্যামাসুন্দরী বলেন, থাম খুব ধোষ্টামো হয়েছে! তোর মুখে শাস্ত্ৰবাক্য শুনলে স্বর্গে বসে মুনি ঋষিরা গালে মুখে চড়াবে!

ওই শোনো! দেখছো পিসি, কেন দু-চক্ষের বিষ দেখি বুড়ীকে? দিশে ধর্মে বলেছে কুপুত্ৰ যদ্যপি হয় কুমাতা কদাপি নয়। অথচ আমার ভাগ্যে হলো উল্টো! ভগবানের রাজ্যে একটা বেতিক্রম পটলের মা পলুতাপাতা, আর এই সংসারে এক বেতিক্রম জগার মা শ্যামাসুন্দরী! মাতৃনাম উচ্চারণে পাপ নিও না ঠাকুর। মাগো মা শ্যামা মা! যাক পিসি, বড়মানুষের মেয়েকে তুমি হুকুম করে যাও দিকি, ওই ওখানে শ্বেতপাথরের বাটিতে জল আছে, কৃপা করে একটু চরণ ড়ুবিয়ে রাখতে!

ফের জগা?

শ্যামাসুন্দরী ক্রুদ্ধ গলায় বলেন, ফের ধাষ্টামো?

চোখ রাঙিও না বলছি মা জননী— জগুও সমান গলায় বলে, বেশি বাড়াবাড়ি করবে তা ওই ঠ্যাঙ দুখানি ভেঙে এইখানে শুইয়ে রেখে দেব।

মুক্তকেশী আপসের সুরে বলেন, তুচ্ছ কথা নিয়ে তুমিই বা কেলেঙ্কার করছে কেন বৌ, দিয়ে দাও না!

শ্যামাসুন্দরী সহসা দুমদুম করে গিয়ে সেই পাথরবাটি-রক্ষিত জলে বা পায়ের বুড়ো আঙুলটা ড়ুবিয়ে আবার এসে বসে পড়েন।

জণ্ড সাবধানে বাটিটা উঠিয়ে নিয়ে সোল্লাসে বলে, ব্যাস, কেল্লা ফতে। দেখি এখন রাবন জেতে কি নিকষা জেতে!

ঝগড়ার শেষ শোনার সময় নেই, বেলা হয়ে যাচ্ছে। মুক্তকেশী ডাকেন, টেঁপি, এই হারামজাদী আয় না?

টেঁপি এগিয়ে আসে।

জগু তার হাতে চারটে পয়সা দিয়ে বলে, পুতুল কিনিস।

আবার পয়সা কেন? মুক্তকেশী অসন্তুষ্ট স্বরে বলেন, নিত্যি তোর পয়সা দেওয়া! ছুড়িও হয়েছে তেমনি লুভিষ্টে! হাত পেতেই আছে। নে চল চল, রোদ উঠে গেল। চলি বৌ। বলি হ্যাঁ গো, থরে থরে কত কুটনো কুটেছে! মা ব্যাটা দুটো মনিষ্যিতে তো খাবে!

শ্যামসুন্দরী চরম বিরক্তির স্বরে বলে, ব্যাটা যে একাই একশো! বাহান্ন ভোগ না হলে গলা দিয়ে ভাত নামবে? মাছ খাবি, চারখানা মাছ-সর্ষে রোধে দেব চুকে যাবে, তা নয়, মার হেঁসেলে নিরিমিষ্যি গিলবো! হাড়মাস পুড়িয়ে খেলো। আজ আবার আদালতের সমন, একথুনি বলবে ভাত দাও! তখন জলে পড়ি কি আগুনে পড়িা!

মুক্তকেশী আর দাঁড়ান না।

বাইরে আগুনের মত রোদ উঠে গেছে। বেলা দশটাতেই এত রোদ। মুক্তকেশীর মনে হয়, পৃথিবীর আবহাওয়াও বুঝি বদলে গেছে। তাঁদের বয়েসকালে আষাঢ় মাসে এত রোদ কখনো ছিল না।

পথে বেরিয়ে টেঁপি আবদারের সুরে বলে, একটা পালকি ডাকো না ঠাকমা, হাঁটতে ভালো লাগছে না।

মুক্তকেশী চড়া গলায় বলেন, ভাল লাগে না তো আসিস কেন লক্ষ্মীছাড়া! গঙ্গাচ্ছান করে মানুষের কাঁধে চড়বো!

আহা, গঙ্গার ঘাটের সেই মুটকি বুড়ীটা রোজ পালকি চড়ে না?

মুক্তকেশী বুড়ীর উল্লেখে হেসে ফেলে বলেন, সে বুড়ীর ক্ষ্যামতা নেই তাই চড়ে। পালকি আর আছেই বা কই? দেখতেই তো পাই না? যাবে, আস্তে আস্তে সবই উঠে যাবে। পালকি যাবে, আরু যাবে, গুরুজনে ভক্তিছেদা যাবে, ধর্মাধৰ্ম পাপপুণ্যি সবই যাবে। স্বদেশীর হুজুগে। দেশ ছারেখারে যাবে পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।… সাহেবের রাজ্যিপাট, তোরা যাচ্ছিস তাদের উৎখাত করতে! বলি ওদের উচ্ছেদ করে করবি কি! রাজ্যি চালাবি? হুঁ! সুখের পৃথিবীতে ইচ্ছে করে আগুন জ্বালা!

এসব কথা নাতনীর জন্যে নয়, মুক্তকেশীর এ স্বগতোক্তি পালকির সূত্রে বেরিয়ে পড়া ভিতরের উন্মা। পথে ঘাটে কেবলই শোনেন কিনা স্বদেশীওলারা সাহেবদের উচ্ছেদ করবার তালে আছে। বোমা করছে, গুলি বন্দুক গোছাচ্ছে। গঙ্গার ঘাটে ওই আলোচনা শুনে শুনে হাড়পিত্তি জ্বলে যায়। ওদের রাজ্যপাট, তোরা কেড়ে নিবি? ওদের সঙ্গে পারবি? বামন হয়ে চাদে হাত?

হঠাৎ স্বদেশীদের ওপর খাপূপা হয়ে ওঠেন কেন মুক্তকেশী কে জানে!

মনে হচ্ছে হঠাৎ যেন নিজের জীবনের একটা মস্ত বড় ফাঁক ধরা পড়ে গেছে তাঁর চোখে।

কিসের এই শূন্যতা?

তাঁর রাজ্যপাট তো পুরোদস্তর বজায় আছে। তবে হঠাৎ সাহেবের রাজ্যপাট বেদখল হবার চিন্তায় মেজাজ ক্ষিপ্ত হয় কেন?

গোঁয়ার-গোবিন্দ জগুর মার ওপর কি সূক্ষ্ম একটা ঈর্ষাবোধ আসছে? কেন? মুক্তকেশীর ছেলেরা কি মাতৃভক্তিতে কম? তাই জগুর অভিনব মাতৃভক্তি তাঁকে ঈর্ষার পীড়িত করেছে?

মাতৃভক্তিতে কসুর কোথায় মুক্তকেশীর ছেলেদের? তবু গভীর। এই শূন্যতার বোধটা ভরাট করে তুলতে পারছেন না বুদ্ধি দিয়ে যুক্তি দিয়ে। মুক্তকেশীর নিজের হৃদয়ে ছেলেদের ঠাঁই নেই, না ছেলেদের হৃদয়ে মুক্তকেশীর ঠাঁই নেই? ঠাঁই থাকলে ভরাটত্ব থাকবে না কেন? শ্যামাসুন্দরীর মধ্যে যে ভরাটত্বটা দেখে এলেন এইমাত্র?

ছেলের বিয়ে দেওয়াটাই কি তাহলে বোকামি? হাতের কড়ি পরকে বিলিয়ে দেওয়ার মত?

অ ঠাকমা, অত জোরে হাঁটছে। কেন? আমি বুঝি পারি?

পারিস না তো আসিস কি করতে? মুক্তকেশী গতিবেগ একটু কমিয়ে বলেন, আমি বুড়ী পারছি, তুমি জোয়ান ছুড়ি পারছি না? তোদের বয়সে লোহা ভাঙতে পারতাম, তা জানিস?

কথাটা হয়তো মিথ্যে নয়।

অসামান্য গতর ছিল, এখনো আছে। কথায় বলে মারা হাতী লাখ টাকা! আখ, কখনো দাঁতে ছাড়িয়ে ভিন্ন বাঁটিতে ছাড়িয়ে খান না, নিত্য ডালবাটা পোস্তবাটা খেয়ে অবলীলায় হজম করেন। জলের কলের মধ্যে চামড়া আছে, এই বিচারে বিধবা হয়ে পর্যন্ত কখনো কলের জল খান নি। দৈনিক দু ঘড়া করে ভরির গঙ্গাজল তার বরাদ্দ।

নিষ্ঠাবতী বলে বিশেষ একটা নামডাক্ষ আছে মুক্তকেশীর। পাড়ার লোক সমীহর দৃষ্টিতে দেখে। মুক্তকেশীকে পথে বেরোতে দেখলেই রাস্তার ছেলেরা ডাংগুলি খেলা স্থগিত রাখে, মারবেল খেলতে খেলতে চকিত হয়ে দাঁড়ায়।

দোবরা চিনিতে হাড়ের গুঁড়ো আছে বলে কখনো সন্দেশ রসগোল্লাটি পর্যন্ত খান না মুক্তকেশী, রাতে আচমনী খান না। অম্বুবাচীর কদিন অশুদ্ধ বসুমতীর সংস্পর্শ ত্যাগ করে দৈনিক একবার মাত্র গঙ্গাগর্ভে দাঁড়িয়ে মধু আর ডাব পান করেন। এমন আরো অনেক কঠোর কৃচ্ছসাধনের তালিকা আছে মুক্তকেশীর, তাই তার চেহারাতেও রুক্ষ-কাঠিন্য।

মুক্তকেশীর জীবন-দর্শনের সঙ্গে আজকের শূন্যতার মিল নেই। তিনি তো বরাবর ভালোবাসার চেয়ে ভয়কেই মূল্য দিয়েছেন বেশি। ভেবেছেন, ওটাই সংসারের পায়ের তলার মাটি। তবে আজ কেন গোয়ার জগুর মাতৃপাদোদক পান করার মত হাস্যকর ব্যাপারটা বার বার মনে পড়ছে? কেন মনে হচ্ছে শ্যামাসুন্দরী একটা উঁচু  পাথরের বেদীতে বসে আছেন, মুক্তকেশী নীচে থেকে মুখ তুলে দেখছেন?

ও ঠাকমা, পালকি নেবে না?

টেঁপির আবদারের সুর ধ্বনিত হয়।

মুক্তকেশী হঠাৎ যেন নরম হন। বলেন, পয়সা খরচা না করিয়ে ছাড়বি না, কেমন? কই দেখি কোথায় পালকি?

ওই তো। ওখানে বসে রয়েছে—

মুক্তকেশী দেখেন একটা গাছতলায় বসে রয়েছে বটে পালকি নামিয়ে দুটো বেহারা।

হাতছানি দিয়ে ডাকেন।

তারপর তাতে উঠে বলেন, তোর মা যা কঞ্জুষী, আক্কেল করে দেবে ভাড়াটা! দেবে না। চাঁপির মার আর কোন গুণ না থাক এটা আছে।

টেঁপি মুখখানা বোজার করে বলে, চাপির মার হাতে তো রাতদিন পয়সা, আমার মার আছে বুঝি? বলে মার একটা চাবির রিং কেনবার ইচ্ছে কবে থেকে, তাই হয় না!

মুক্তকেশী তাচ্ছিল্যাভরে বলেন, না হলে আর কার কী দোষ? লাখ টাকায় বামুন ভিখিরি! কেন, তোর বাবা কি উপায় কম করে?

হ্যাঁ, এ ধরনের কথা ক্ষুদে ক্ষুদে নাতি-নাতনীদের কাছে হামেশাই বলে থাকেন মুক্তকেশী। যা কিছু বলার ইচ্ছে, যা কিছু বক্তব্য, বেশীর ভাগই তো ওই ছোটগুলোকে মাধ্যম করেই উচ্চারণ করেন। ঠিক জানেন, সরাসরি বলার হাঙ্গামাটা না পুইয়েও সরাসরি বলার কাজটা এতেই হবে।

সঙ্গে সঙ্গেই তো গিয়ে মায়েদের কর্ণগোচর করবে ওরা।

ওরা পাকা পাকা কথা শিখবে?

ওমা, তাতে কী এল গেল!

ক্তকেশীর মেম মেজবৌমার মত আর কে বলতে যাবে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে পাকা কথা শিখবে! কিন্তু মুক্তকেশীর সেই মেজবৌ কি এখনো টিকে আছে তার বাড়িতে? সেদিনকার ঝড়ে উড়ে পড়ে যায় নি। সুবৰ্ণলতার শ্বশুরবাড়ির আশ্রয়?

তাই তো যাবার কথা।

রাগে দুঃখে অপমানে ধিক্কারে স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে বেরিয়ে যাবার কথা তো প্ৰবোধের। অথবা নষ্টচরিত্র স্ত্রীকে গলাধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বার করে দেওয়ার কথা!

কিন্তু তার কিছুই হয় নি।

আবার সুবর্ণ রান্নাঘরে এসে হেঁসেলের পালা ধরেছে, আবার খেয়েছ ঘুমিয়েছে, কথা বলেছে।

তারপর?

তারপর তো আরো দুই মেয়ে আর দুই ছেলে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল সুবৰ্ণর এ বাড়ির নীচের তলার সেই ঠাণ্ডা স্যাৎসেঁতে আঁতুড়ঘরটায়। যে ঘরে বছরে অন্তত পাঁচ-সাতবার সদ্যোজাতের কানু ওঠে।

অদৃশ্য অন্ধকার জগতে অবস্থিত যে সব বিদেহী আত্মারা পৃথিবীর আলো-বাতাসের আকাঙ্ক্ষায় লুব্ধ হয়ে ঘোরে, তাদের মুক্তির মাধ্যমে তো এই সুবৰ্ণলতার দল! ইচ্ছায় অনিচ্ছায় যারা মা হতে বাধ্য হয়! তাদের নিম্বফল নভেল পড়াটা বন্ধ করা দরকার। ও থেকেই যত অনিষ্ঠ এসে ঢোকে সংসারে!

অতএব কালীর দিব্যি দিয়েছে প্ৰবোধ স্ত্রীকে, দিয়েছে নিজের দিব্যি। রাত্রিকালে নিশ্চিন্ত অবকাশে বুঝিয়েছিল, নভেল পড়ার কি কি দোষ।

কিন্তু বেহায়া সুবৰ্ণ সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তেও এক অদ্ভুত কথা বলে বসেছিল। বলেছিল, বেশ, তুমিও একটা দিব্যি গালো!

আমি? আমি কি জন্যে? আমি কি চোরদায়ে ধরা পড়েছি?

না, তুমি কেন পড়বে, সব চোরদায়ে ধরা পড়েছে মেয়েমানুষ! কেন বলতে পারো? কেন?

কেন? শোনো কথা!

এর বেশি আর উত্তর যোগায় নি প্ৰবোধের।

সুবৰ্ণ হঠাৎ প্ৰবোধের একটা হাত ঘুমন্ত ভানুর মাথার ওপর ঠেকিয়ে বলে উঠেছিল, তুমিও দিব্যি কর। তবে, আর কখনোও তাঁস খেলবে না?

তাস খেলবো না! তার মানে?

মানে কিছু নেই। আমার নেশা বই পড়া, তোমার নেশা তাস খেলা। আমাকে যদি ছাড়তে হয় তো তুমিও দেখো, নেশা ছাড়া কী বস্তু। বল আর কখনো তাস খেলবে না!

প্ৰবোধের সামনে আসন্ন রাত্রি।

আর বহু লাঞ্ছনায় জর্জরিত স্ত্রী সম্পর্কে বুক-দুরু-দুরু আতঙ্ক।

আবার কী না কি কেলেঙ্কারী করে বসে কে বলতে পারে! তবু সাহসে ভর করে একবার বলে ফেলে, চমৎকার! মুড়ি-মিছরির সমান দর!

সুবৰ্ণলতা তীব্ৰস্বরে বলে উঠেছিল, কে মুড়ি কে মিছরি, তার হিসেবই বা করেছিল কে, আর তাদের দর বেঁধে দিয়েছিলই বা কোন বিধাতা, বলতে পারো?

আশ্চর্য, এত লাঞ্ছনাতেও দমে না মেয়েমানুষ। উল্টে বলে, লজ্জা আমার করার কথা, না। তোমাদের করার কথা সেটাই বরং ভাবো!

প্ৰবোধ। অতএব বলে বসেছিল, ঠিক আছে বাবা ঠিক আছে, করছি দিব্যি!

খেলবে না। আর কখনো তাস?

খেলবো না। হল তো! তা আমার বেলায় তো বেশ হলো, নিজের প্রতিজ্ঞা?

বলেছি তো, তুমি যদি আর তাস না খেলো, আমিও বই পড়বো না।

আমার সঙ্গে কি তা তো বুঝলাম না! হলো পরপুরুষের সঙ্গে মাখামাখি-

খবরদার! আর একবারও যেন ওকথা উচ্চারণ করতে শুনি না, ইতর ছোটলোক!

বাঃ, বাঃ, একেই তো বলে পতিব্ৰতা সতী! সতী স্ত্রীলোকেরা–

তোমাদের হিসেবমতন সতী আমি নই, নই, নই। হলো!

সুবৰ্ণ ক্রুদ্ধগলায় বলে, ছেলের মাথায় হাত দিয়ে দিব্যি করেছে। মনে রেখো। পয়সা বাজি ধরে তাস খেলা! ও তো জুয়া খেলা! জুয়া খেললে পাপ হয় না তোমাদের? নাকি পুরুষের পাপ বলে কিছু নেই?

পুরুষের আবার পাপ নেই! প্ৰবোধ বলে, মহাপাপ হচ্ছে বিয়ে করা। বলেই সবলে আকর্ষণ করে সুবৰ্ণলতার পাথর-কঠিন দেহটাকে।

 

তারপর?

গড়িয়ে চলে দিনরাত্রি।

যথানিয়মে সকালে সূর্য ওঠে, সন্ধ্যায় অস্ত যায়, মুক্তকেশী গঙ্গাস্নানে যান, মুক্তকেশীর ছেলেরা প্রতিদিন সন্ধায় আর ছুটির দিন সারাদিন তাসের আড্ডা বসায়, বড়বৌ রাশি রাশি পান সেজে বৈঠকখানায় পাঠায়, বাড়ির ছেলেরা ঘন ঘন তামাক সাজে।…

আজকাল আবার আর এক নতুন ফ্যাসান উঠেছে চা খাওয়া। চায়ের সাজসরঞ্জাম কেনা হয়েছে, মহোৎসাহে চা বানিয়ে তাসের আড্ডায় সরবরাহ করা হচ্ছে।

চলছে যথারীতি।

কিন্তু মুক্তকেশীর মেজছেলে!

সে কি যোগ দিচ্ছে তাসের আড্ডায়?

তার চরিত্র কোন কথা বলে?

 ১.১৩ বাসনমাজ ঝি হরিদাসী

বাসনমাজ ঝি হরিদাসী পূজোয় পাওয়া কাপড়খানা বাসায় নিয়ে গিয়ে আবার ফেরত দিতে এল।

বলল, নাটুমার্কা কাপড় চলবে নি। ঠাকুমা, ও বিলিতি কাপড় আমাদের বস্তিতে বারণ হয়ে গেছে।

সন্ধ্যের দিকে ইদানীং যেন মুক্তকেশী চোখে একটু কম দেখছেন, তাই সহসা ঠাহর করতে পারলেন না ব্যাপারটা কি। চোখ কুঁচকে ঘর থেকে গলা বাড়িয়ে বললেন, কি বললি! কিসের কি হয়েছে?

বারণ হয়ে গেছে গো ঠাকুমা, বিলিতি কাপড় পরা বারণ হয়ে গেছে! ও পরলে নাকি দেশের শতুরতা করা হবে!

মুক্তকেশী চোখে-কনে যদিই বা কিঞ্চিৎ খাটো হয়ে থাকেন, গলায় খাটো হন নি। ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলেন, কাপড় ফেরত দিতে এসেছিস! এত বড় আস্‌পদ্দা! বাজারের সেরা কাপড় এনে দিয়েছে মেজবাবু, আর তুই… কই পেবো কোথা গেল? দেখে যাক ছোটনোককে নাই। দেওয়ার ফল! কাঁচা পয়সা হয়েছে তাই দু হাতে পয়সা ছড়াচ্ছে বাবু। ঝিয়ের কাপড় চোদ্দ আনা! ওই যে—পরিবার রাতদিন বলেন, ঝি বলে কি মানুষ নয়? গরীব বলে কি মানুষ নয়? তারই ফল! তখনই বলেছিলাম, এত বাড়াবাড়ি ভাল নয় পেবো, যা রয়-সয় তাই কর। ও-কাপড় বদলে আট-ন আনার একখানা কাপড় এনে দে। সে কথা শোনা হল না, এখন দেখে যাক আসপদ্দা! সেই কাপড় অপছন্দ করে ফেরত দেওয়া—

হরিদাসী বোজার মুখে বলে, অপছন্দ আমি করি নি। ঠাকুমা, বলেছি পরা চলবে নি।

ওলো থাম থাম, তুই আর কথার কায়দা শেখাতে আসিস নি! যার নাম ভাজাচাল তার নামই মুড়ি, বুঝলি? ছোটমুখে লম্বা লম্বা কথা!

হরিদাসী আরো বোজার গলায় বলে, ছোটনোকে কথা কইলেই তোমাদের কানে লম্বা। ঠেকে ঠাকুমা! বদলে না দাও কাপড় চাই না, গালাগাল কোর না।

গালাগাল! গালাগাল করি আমি? মুক্তকেশী ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন, বলেন, বেরিয়ে যা! বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে! ভাত ছড়ালে কাকের অভাব?

তা কালটা তখনো তাই ছিল।

ভাত ছড়ালে কাকের অভাব ঘটত না। তবু কে জানে কোন দুঃসাহসে হরিদাসী চাকরি যাওয়ার ভয়ে কেঁদে পড়ে বলে উঠল না, কাল মা দুগৃগার পূজো, এই বছরকার দিনে তুমি আমার অন্নটা খেলে ঠাকুমা!

না, বলে উঠল না।

কে জানে কোন শক্তিতে শক্তিলাভ করে অপ্ৰসন্ন গলায় বলে উঠল, অন্যায় রাগ করলে নাচার ঠাকুমা! তোমার একখানা কাপড় পরে বাসায় আমি জাতে ঠেকা হয়ে থাকতে পারি না। দেখ গে যাও না, রাস্তায় কী কাণ্ডটাই হচ্ছে! পুলিসের হাতে মার খেয়ে মরছে, তবু মানুষ বন্দে মাতাং! বলছে! এতটুকুন-টুকুন ছেলেগুলো পর্যন্ত মার খাচ্ছে, গান গাইছে। দোকান থেকে কাপড় লুঠ করে বাবুরা সব বিলিতি কাপড়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বস্তর-যজ্ঞি করছে, এরপর সব নাকি স্বদেশী হবে, নেকচারবাবুরা সেই সেই নেকচারই দিয়ে বেড়াচ্ছে।… আমাদের বস্তিতে পর্যন্ত তোলপাড় কাণ্ড চলছে। খালি এ বাড়ির বাবুদেরই চোখে কানে ঠুলি আটা!

ছেলের বার্লির বাটি হাতে করে রান্নাঘর থেকে আসছিল সুবৰ্ণলতা, দাঁড়িয়ে পড়েছে কাঠ হয়ে। বাটিটা কাত হয়ে গিয়ে বার্লি পড়ে গড়াতে শুরু করেছে সে খেয়াল নেই।

এ বাড়ির বাবুদের চোখে-কনে ঠুলি আটা!

এ বাড়ির বাবুদের চোখে-কনে ঠুলি আটা!

এ বাডির বাবুদের!

চোখে-কানে ঠুলি!

সুবৰ্ণলতার মাথার মধ্যে লক্ষ করতাল বাজতে থাকে, এ বাড়ির বাবুদের—।

বাসনামাজা ঝিয়ের মুখে শুনতে হলো, এ বাড়ির বাবুদের চোখে কানে ঠুলি! যে কথা সুবৰ্ণলতা ভাবছে, সে কথা ওর চোখেও ধরা পড়ে গেছে তাহলে!

সুবৰ্ণলতা তো জানতো, শুধু এ বাড়ির বাবুদের চোখেই নয়, ঠুলি আটা এ বাড়িটারও। আষ্টেপৃষ্ঠে ঠুলি আঁটা। রাজরাস্তার মুখর হাওয়া এ গলির মধ্যে ঢুকে আসে না। বস্তিতে যায়, যায় গাছতলায়, শুধু এ গলির মধ্যে ঢুকতে চাইলে, গলির বাঁকে বাকে ভাঙা দেওয়ালের গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে বোবা হয়ে যায়।

কিন্তু আশ্চৰ্য, সুবৰ্ণলতার চোখ-কান এত খোলা থাকে কি করে! সুবৰ্ণলতা কেন বাইরের জগতের বাতাসে স্পন্দিত হয়, বাইরের ঝড়ে বিক্ষুব্ধ হয়, বাইরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকাকে ঘৃণার চোখে দেখে!

সুবৰ্ণলতাকে এই চারখানা দেয়ালের ভিতরে বাইরে জগতের বার্তা এনে দেয় কে?

আর যে বার্তা অন্য সকলের কানের পাশ দিয়ে ভেসে যায়, গায়ের চামড়ার উপর দিয়ে ঝরে পড়ে, সে বার্তা সুবৰ্ণলতার গায়ের চামড়াকে জুলিয়ে ফোস্কা পড়িয়ে দেয় কেন? কেন ক্যানের মধ্যে গরম সীসে ঢেলে মনের মধ্যে তীব্র ক্ষতের সৃষ্টি করে?

হরিদাসীর চোখে যদি ধরাই পড়ে থাকে এ বাড়ির বাবুদের চোখে-কনে ঠুলি আটা, তাতে সুবৰ্ণলতার চোখ দিয়ে আগুন ঝরাটা বাড়াবাড়ি নয় কি? আর সুবৰ্ণলতা যদি সেই ঠুলি উন্মোচন করতে চায়, ধৃষ্টতা ছাড়া আর কি?

সারাজীবন কি শুধু ধৃষ্টতাই করবে সুবৰ্ণলতা?

 

সংসারের সমস্ত সদস্যের পূজোর কাপড় কেনা প্ৰবোধচন্দ্রের ডিউটি, কারণ তাঁর পয়সা কাঁচা পয়সা! আর তার পরিবারের বুদ্ধিটা কাঁচা বুদ্ধি!

সুবৰ্ণ বলেছিল, এবারে বিলিতি কাপড় আনা চলবে না। জেলা তাতির জেলে গামছা কাপড়ও তার চেয়ে ভাল।

প্ৰবোধ নাক তুলে বলেছিল, তোমার ভাল তো পাগলের ভাল! সে কাপড় কে ছোঁবে?

সে চৈতন্য এনে দিলে সবাই ছোঁবে, মাথায় করে নেবে!

চৈতন্যদায়িনী দিক তবে চৈতন্য, আসছে। বছর কাজে লাগবে। বলে সুবর্ণর কথা হেসে উড়িয়ে দিয়ে একবোঝা যথারীতি বিলিতি কাপড়ই এনে ফেলেছিল প্ৰবোধ। এনেছিল আলতা, চীনেসিঁদুর, মাথা ঘষার মশলা।

যার যার কাপড় তার তার ঘরে উঠে গেছে, ছোট ছোট ছেলেগুলো দিন গুনছে কখন পরবে: সেই পূজোর কাপড়, আর ছোট ছোট মেয়েগুলো হিসেব করছে। কার কাপড়ের পাড়টা ভাল!

সুবৰ্ণ ভেবে রেখেছিল যে যা করে করুক, সে পরবে না ও শাড়ি। সে আপনার সংকল্পে অটুট থাকবে।

ষষ্ঠীর দিনে যখন নতুন কাপড়ের কথা উঠবে, সুবর্ণ বলবে পূজোর পুণ্যদিনে অশুচি বস্ত্ৰ পরিবার প্রবৃত্তি নেই তার। কোনো দিনই নেই। সে ত্যাগ করবে। এবারের পূজোর কাপড়।

কিন্তু হরিদাসীর ধিক্কারে সে সঙ্কল্পের পরিবর্তন হল।

দাউ দাউ আগুন জ্বেলে জুলিয়ে পুড়িয়ে খসিয়ে দাও ওই ঠুলি। নয়তো মুক্তি দিক সুবৰ্ণলতাকে এই নাগপাশ থেকে। তাড়িয়ে দিক ওরা সুবৰ্ণলতাকে, দূর করে দিক তাকে তাঁর ভয়ঙ্কর দুঃসাহসের জন্যে।

মীরাবাঈয়ের মত পথে বেরিয়ে পড়ে দেখবে সুবৰ্ণ পৃথিবীর পরিধিটা কোথায়?

কতদিন কল্পনা করেছে সুবৰ্ণলতা এরা সুবৰ্ণকে তাড়িয়ে দিল, সুবর্ণ সাহস করে চলে গেল।

বাইরের লোকের কৌতূহলী চোখকে এড়াবার জন্য ঢুকে পড়ল না তাড়াতাড়ি মুক্তকেশীর শক্ত বেড়ার মধ্যে।

তারপর সুবৰ্ণলতা পথে পথে ঘুরছে, ঘুরছে তীর্থে তীর্থে, ঘুরছে ওই সব মহাপুরুষদের দরজায় দরজায়, যাঁরা স্বদেশী করেন।

 

চোখ জ্বালা করানো ধুমকুণ্ডলী পাক খেতে খেতে নিচে নামছে…তার সঙ্গে নেমে আসছে। তীব্ৰ আর পরিচিত একটা গন্ধ।

এ বাড়ির ছাদের আকুলতা আকাশে ওঠবার পথ পায় না, তাই নিরুপায় ধোঁয়াগুলো ছাদের আলসে টপকে পাতালের দিকে নামতে চায়।

প্রথমটা কারো খেয়াল হয় নি, খেয়াল হল চোখ জুলায়। তারপর পোড়া গন্ধ। ন্যাকড়া পোড়ার গন্ধ তো আর চাপা থাকে না!

ছোটদের চেঁচামেচিটা নতুন নয় এ বাড়িতে, কাজেই সবশেষে অনুভবে এল সেটা।

কোথায় কি সর্বনাশ ঘটাচ্ছে পাজীগুলো!

সর্বনাশে উমাশশীর বড় ভয়, উমাশশী এদিক-সেদিক তাকিয়ে দেখতে দেখতে আবিষ্কার করল ঘটনাটা!

রান্নাঘরের ছাদে ধুমালোক, জড়ো-করা চারটি কাপড় পুড়ছে, তার ধারে কাছে কটা ছেলেমেয়ে চোখের জ্বালা নিবারণ করছে চোখ রগড়ে রগড়ে, আর তার সঙ্গে করছে হৈ চৈ।

কিন্তু শুধুই কি ছোটরা?

তার সঙ্গে নেই পালের গোদা মেজগিন্নী?

উমাশশী থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

উমাশশীর মুখ দিয়ে কথা বেরোল না।

ইচ্ছে করে এ কী পোড়াতে বসেছে মেজবো? কাপড় না। ভবিষ্যৎ? তা সে তো পোড়াচ্ছেই জীবনভোর! আ-জীবনই তো ধ্বংসকার্য চালাচ্ছে! তবু সে আগুনটা ছিল অদৃশ্য, এবার কি বাড়িটাতেই আগুন ধরাবে মেজবৌ?

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েই রইল উমাশশী। তারপর আঁচল দিয়ে চোখটা মুছল। জল পড়ছে চোখ দিয়ে, জ্বালা করছে।

ধোঁয়ায়?

না সুবৰ্ণলতার অসমসাহসিক দুঃসাহসের স্পর্ধায়?

অবিরত এইরকম করে চলেছে সুবৰ্ণলতা, তবু তার ভাগ্য উথলে উঠছে দিন দিন। দু হাতে খরচ করছে, চাঁদির জুতোয় সবাইকে কিনছে, সোনার ঠলি দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখছে লোকের।

মেজকর্তা করেন?

সেটা তো বাইরের হাত!

ভিতরের ঘরের অধিকারটা কারি?

মেজঠাকুরপো যখন সকলের পূজোর কাপড় কিনে এনে মায়ের কাছে ধরে দেন, তখন কি মনে হয় না মেজবৌই দিল?

অনেক দুঃখে আর অনেক ধোয়ায় বাষ্পাচ্ছন্ন চোখ দুটো মুছে নিয়ে উমাশশী রুদ্ধকণ্ঠে বলে ওঠে, এ কী হচ্ছে মেজবৌ!

মেজবৌ কিছু উত্তর দেবার আগেই একটা ছেলে বলে উঠল, বস্তর-যজ্ঞি হচ্ছে জেঠিমা। সাহেবদের তৈরি কাপড় আর পরা হবে না, পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে সেই ছাইয়ের টিপ পরবো আমরা।

ছাইয়ের টিপ!

এসব কী কথা!

কোন ভাষা!

উমাশশী দিশেহারা হয়ে তাকিয়ে দেখে মেজবৌয়ের দিকে। ধোঁয়া উঠছে বিলক্ষণ, তবুও আগুনে জ্বলছে দৰ্প দৰ্প করে, আর সেই আগুনের আভায় আনন্দের আভার মত জ্বলজ্বল করছে সুবৰ্ণলতার মুখ। মাথার কাপড় খোলা, গায়ের কাপড়ও অবিন্যস্ত, এ বাড়ির ঐতিহ্য অগ্রাহ্য করে সেমিজ পরে এই যা!

ওকে যেন তাদের পরিচিত মেজবৌ মনে হচ্ছে না। ওকে ধিক্কার দেবে উমাশশী?

কম্পিত্যকণ্ঠে উচ্চারণ করলো, এ কী কথা মেজবৌ?

মেজবৌ সেই আহ্লাদে জুলজুল মুখে বলে, হোম হচ্ছে!

উমাশশীর আর কথা যোগাতো কি না কে জানে, তবে কথা থামাতে হল। মাথার ঘোমটাটা দীর্ঘতর করতে হল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখে সুবৰ্ণলতাও মাথায় আঁচলটা তুলে দিল!

ভাসুর নয়, দ্যাওর। তবু বয়সে বড় বিজ্ঞ পুরুষ দ্যাওর। ভাসুরের মতই সমীহ করা দরকার বৈকি। সেটাই বিধি।

প্রভাস চলে এসেছে। ছাতে, তার হাতে হাত জড়িয়ে চাপা। চাঁপার চোখ ক্ৰন্দনার্যক্ত। কাঁদতে কাঁদতে কাকাকে ডেকে এনেছে সে, মা তাদের পূজোর কাপড় আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে দিচ্ছে বলে।

বাড়ির বিচারকের পোস্টটা সেজকাকার, সেই জানা আছে বলেই পাকা মেয়ে চাপা তার কানেই তুলেছে খবরটা।

কি কচ্ছে মা?

ধমকে উঠেছিল। সেজকাকা।

পূজোর কাপড় পুড়িয়ে দিচ্ছে! সব কাপড়!

হু-হু করে কেঁদে উঠেছিল চাপা। কই কোথায়— বলে বীরদৰ্পে এগিয়ে এসেছে প্ৰভাস, তবু এ ধারণা করে নি।

এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে সে-ও।

পরীক্ষণেই ব্যাপারটা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না তার। কারণ পথে-ঘাটে এ ব্যাপার ঘটতে দেখছে যে!

কিন্তু বাড়িতে?

বাড়িতে সেই থিয়েটার?

আর সেই থিয়েটারের অভিনেত্রী বাড়ির বৌ?

বড় ভাজ। কানে হাত দেওয়া চলবে না, অতএব তার ছেলেটাকেই কান ধরে টান মারে প্রভাস, যতটা জোর টানলে শুধু ছিঁড়ে পড়তে বাকি থাকে।

পলিটিক্সের চাষ হচ্ছে বাড়িতে? পলিটিক্সের চাষ? লীডার কে? মা জননী? তা বাড়িতে শাড়ি পড়ে বসে ঘোমটার মধ্যে খ্যামটা নাচ নেচে ছেলেগুলোর পরকাল ঝরঝরে করবার দরকার কি? কুছ কুছা এটি রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেই হয়। ইংরেজরাজকে খবর পাঠাই, তোমাদের অন্ন এবার

ব্যঙ্গ মুখটা বিকৃত করে প্রভাস।

সুবৰ্ণলতা যে স্রেফ পাগল হয়ে গেছে তাতে আর সন্দেহ কি! নচেৎ অত বড় দ্যাওরের সামনে গলা খুলে কথা বলে? আর তাকেই বলে?

বলে কিনা, যার যেমন বুদ্ধি, তার তেমন কথা! এ বাড়ির পুরুষদের চেয়ে হরিদাসীর ভাইও অনেক উঁচুদরের মানুষ!

হঠাৎ উমাশী দ্রুত পায়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে দুড়-দুড় করে চলে যায়।

দ্যাওরের হাতে বড় ভাজের মার খাওয়া দেখতে পারবে না। সে।

আর ততক্ষণে তো আরো সবাই গিয়ে জুটেছে ছাতে! তার মানে সভাস্থলে লাঞ্ছনা!

কিন্তু আশ্চর্য! আশ্চর্য!

লাঞ্ছনা হলো না সেদিন সুবৰ্ণলতার।

বোধ করি মূক হয়ে গেল সবাই সুবৰ্ণলতার বুকের পাটায়। কিংবা ভোবল পাগল হয়ে গেছে! সুবৰ্ণর ব্যবহারে এরা যখন বাক্যাহত হয়ে যায়। তখন এরা বলে, পাগল হয়ে গেছে! মাথার চিকিৎসা করা দরকার!

আজও বলল।

প্রভাসই বলল।

হয়তো মান বাঁচাতেই বলল।

মারতে গেলে ফিরে উল্টে মার খাওয়া অসম্ভব নয়। আর সত্যিই কিছু আর একটা শিক্ষিত ভদ্রলোক বড় ভাইয়ের স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে পারে না।

এক মারানো যেত মেজদাকে দিয়ে!

কিন্তু তাই বা হচ্ছে কই?

মেজদাকেও যে গুণন্তুক করেছে!

সংসারে যখন ভয়ঙ্কর কোনো ঢেউ তোলে সুবৰ্ণলতা, মনে হয় এবারে আর রক্ষা নেই তার। এবারে সত্যি সত্যিই মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে গলির বার করে দেওয়া হবে তাকে।

কিন্তু নাঃ, সে আশঙ্কা গর্জন করতে করতে তেড়ে এসে হঠাৎ ভেঙে গিয়েই কেমন ছড়িয়ে পড়ে। যেন ফেনার। রাশির মত স্তিমিত হয়ে মিলিয়ে যায় বালির স্তরে।

প্ৰবোধচন্দ্র এসে সব শুনলো।

মুক্তকেশী কথাটা আর এক সুরে বললেন। বললেন, বছরকার দিনে লক্ষণ করে কেনা পূজোর  কাপড় চোপড়ে আগুন, সেই অবধি ভয়ে আমার বুকের কাঁপুনি থামছে না। বাবা! না জানি কী দুর্ঘটনা আসছে, কী অলক্ষণ ঘটবে সংসারে! কাপড়ের একটা সুতো উড়ে আগুনে পড়লে স্বস্তেন করতে হয়, আর এ কী! তোমার পরিবার যখন এমন দুর্দান্ত তখন তোমার উচিত হয় নি। ওর অমতে কাজ করা!

প্ৰবোধ মীরমে মরে যায়।

প্ৰবোধ ঘটা করে ভাইদের সঙ্গে পরামর্শ করতে যায় বহরমপুরের পাগলাগারদে পাঠাতে হলে কি কি উপায় অবলম্বন করা দরকার।

তারপর প্রবোধ মার হাতে একশোখানি টাকা তুলে দেয়। বলে, মা, কাপড় কেনায় ঘেন্না দরে গেছে আমার, এ টাকা থেকে প্ৰকাশকে দিয়ে যা হয় করে কিছু কিনিয়ে নিও।

কিন্তু বহরমপুরের টিকিট কি কেনা হয়েছিল সুবর্ণর?

কোথায়?

টিকিট যা কেনা হল সে তো স্বদেশী মেলার!

বাড়িসুদ্ধ ছেলেমেয়েকে আর ননদ বিরাজকে নিয়ে মহোৎসাহে দুখানা গাড়ি ভাড়া করে স্বদেশী মেলা দেখতে গেল সুবৰ্ণ।

কিনে স্বদেশী দেশলাই, স্বদেশী চিরুনি, স্বদেশী সাবান। সবাইকে বিলালো। বললো, পূজোয় এবার কাপড় কেনা হবে। ঢাকাই আমাদের নিজস্ব বাংলাদেশের জিনিস।

হেরেও কোন উপায়ে জিতে যায় সুবর্ণ, মার খেতে গিয়েও মাথায় চড়ে বসে, এ এক অদ্ভুত রহস্য।

যে যতই তড়পাক, শেষ পর্যন্ত কোথায় যেন ভয় খায়।

আর বিজয়িনী সুবৰ্ণলতা খানিকটা করে এগিয়ে যায়। এ বাড়ির বৌরা মেলায় যাবে, এ কথা কেউ দশ দিন আগেও কল্পনা করতে পারতো?

অথচ সেই আকল্পিত ব্যাপার ঘটাল সুবর্ণ। আর আহ্লাদে ভাসতে ভাসতে বলল, আসছেবারে আমিও মেলায় দোকান দেব!

আসছেবার আমিও মেলায় দোকান দেব! বলেছিল সুবৰ্ণলতা আহ্লাদে ছলছল করে। ভেবেছিল এইবার বুঝি বন্ধনমুক্তির মন্ত্ৰ পেল সে। ভেবেছিল আলোর রাস্তায় হাঁটবার অধিকার অর্জন করবে। সে রাজপথে।

চাঁপাকে সুবৰ্ণ ঘৃণা করে, চাঁপা যেন তার মে–। সেজমেয়ে চন্দনটা বোকাটে নিরীহ। ছেলেদের ওপর অনেক আশা। এ আশা ও পোষণ করছে এখন থেকেই, আর একটু বড় হোক ভানু, ওকে সঙ্গে নিয়ে কাশী চলে যাবে সে একদিন। গিয়ে দেখবে তার সেই কুল ভেঙে অকুলে ভাসা মাকে।

আজ পর্যন্ত নিয়ে গেল না প্ৰবোধ! খুব ভাল মানসিক অবস্থায় কখনো কি ইচ্ছে প্ৰকাশ করে নি সুবৰ্ণ? বলে নি কি, ন বছর বয়সে সেই শেষ মাকে দেখলাম! আর কি বাঁচবেন মা? জীবনে আর দেখা হবে না!

বলেছে।

প্ৰবোধও প্ৰবোধ দিয়েছে, কেন বাঁচবেন না? ধুৎ! কত বয়েস তোমার মার! আমার মায়ের থেকে তো আর বড় নয়? তোমার এই এণ্ডি-গেণ্ডি নিয়ে তো আর কাশী যাওয়া চলে না! ওগুলো একটু বড় হোক!

সুবৰ্ণ ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলতো, ওগুলো বড় হলেই শখ মিটবে তোমার? রেহাই দেবে?

প্ৰবোধ অভিমানাহত গলায় বলতো, এই নিয়ে চিরদিন ঘেন্না দিলে। তবু ভেবে দেখলে না। কোনোদিন আমার সেজভাই ছোটভাইয়ের মতন স্বভাব খারাপ করতে যাই নি!

আশ্চর্য, ওই মোক্ষম কথাটা ভেবে দেখত না সুবর্ণ।

বরং বলতো, ওরাই জগতের আদর্শ পুরুষ নয়!

তারপর একদিন কোথা থেকে একটা কবিরাজি পান এনে হাজির করল প্ৰবোধ। চুপি চুপি বললো, ভোরবেলা খালি পেটে খেয়ে নেবে, ব্যস! তুমি যা চাও তাই হবে, আর ন্যানজারি হতে হবে না!

সুবৰ্ণ হেসে বলেছিল, বিষ দিচ্ছ না তো আপদের শান্তি করতে?

প্ৰবোধ সর্পাহতের মত মুখে বলেছিল, এই কথা বললে তুমি আমায়? এই সন্দেহ করলে? ভুলিয়ে তোমায় বিষ খাওয়াচ্ছি। আমি? বেশ তা যদি ভেবে থাকো, খেও না!

সুবৰ্ণলতা আরো হেসে উঠেছিল, নাঃ, ঠাট্টাও বোঝে না! মাথা না বুনো নারকেল! আর বিষ বলে ভয় পাবো কেন গো? বিষের জন্যেই তো হাহাকার করে বেড়াই। তারপর ঈষৎ আড়ষ্ট গলায় বলেছিল, খেলে পাপ হবে না?

তা বিষের কথাটায় কান দেয় নি। প্ৰবোধ, শেষের কথাটায় দিল, পরম আনন্দে মশগুল হয়ে বলল, পাপ কিসের? এগিয়ে দিয়েছিল সেই কবিরাজী পান।

সুবৰ্ণও বোধ করি আশায় কম্পিত হয়েছিল। রেহাই যদি নেই তো উপায় একটা ধরা হোক। সেজভাই ছোটভাইয়ের মত প্ৰবোধেরও যদি স্বভাব খারাপ হত, সুবর্ণ কি বাঁচিত না? বলেছেও তো কতবার বরকে! তাই হও তুমি। আমি বাঁচি।

কিন্তু খারাপ হতে যাবার জন্যে যে সাহসের দরকার তাই বা কোথায় প্ৰবোধের?

নেই।

তাই প্রবোধ সুবৰ্ণলতার কাছে পান নিয়ে এসে দাঁড়ায়। বলে, মহৌষধ।

মহৌষধ।

সুবৰ্ণ তাই তারপর থেকে নিশ্চিন্ত আছে। সুবর্ণ বিশ্বাস করেছে আর ন্যানজারি হবার ভয় নেই তার। তাই আহ্লাদে ছলছলিয়ে বলে উঠেছে, আসছেবারে আমিও স্বদেশী মেলায় দোকান দেব! মেয়েরা দিচ্ছে!

ভেবে দেখে নি, যে মেয়েরা স্বদেশী মেলা খুলে দোকান দিচ্ছে তারা কাদের ঘরের মেয়ে!

তারা কি সুবর্ণর ডাস্টবিন ওলটানো সরু সরু গলির মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে?

নাঃ, তারা রাজরাস্তার, তারা প্রাসাদের।

তাদের জন্যে তাদের অকৃপণ বিধাতা রেখেছেন অনেক আলোর প্রসাদ। ভাগ্যের টীকা ললাটে পরেই পৃথিবীর মাটিতে অবতীর্ণ হয়েছে তারা।

সুবৰ্ণ যদি নিজের ওজন বুঝতে না শিখে তাদের রাস্তায় হাঁটতে চায়, তাদের আকাশে চোখ তুলতে চায়, সুবর্ণর কৃপণ বিধাতা ঘা মেরে সচেতন করিয়ে দেবেন বৈকি।

সুবৰ্ণর মাকেও তো দিয়েছিলেন।

সুবৰ্ণর মা যখন ভেবেছিল, আমি পাই নি, কিন্তু আমার মেয়ের জন্যে মুঠোয় ভরে আহরণ করে নেব সেই আলো, আর সেই আলোর সাজে সাজিয়ে তাকে পাঠিয়ে দেব ওই রাজপথে, যেখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আর এক পৃথিবীর মেয়েরা!

তখনও কি সুবর্ণর মায়ের বিধাতা বড় একটা হাতুড়ি বসিয়ে দেন নি তার ধৃষ্টতার উপর?

সুবৰ্ণর মা যদি বাকী জীবনটা শুধু এই কথাই ভেবে ভেবে দেহপাত করে—ইচ্ছায় অনিচ্ছয়, প্ৰতারকের প্রতারণায়, অহঙ্কারীর নির্লজ্জ শক্তির মত্ততায়, যে কোনও ঘটনায় ঘটিত বিয়েও চিরস্থায়িত্ব পাবে কেন, মানুষকে নিয়ে মানুষ পুতুল খেলা করবে কেন? —তবু সুবর্ণর তাতে কোন লাভটা হবে?

সুবৰ্ণর পরবর্তীকাল লাভবান হবে? সুবৰ্ণ দেখতে পাবে সে লাভ?

সুবৰ্ণ যদি ওর সরু গলির শিকলটা ভাঙবার দুরন্ত চেষ্টায় নিজেকে ভেঙে ভেঙে ক্ষয় করে, কোনো একদিন শিকল খসে পড়বে?

কে জানে কে কথা!

সুবৰ্ণ অন্তত জানে না।

সুবৰ্ণ পরবর্তী কালকে জানে না।

সুবৰ্ণ নিজে চায় শিকল ভেঙে বেরিয়ে পড়তে। চায় আলোর মন্দিরের টিকিট কিনতে।

কেনা হবে না!

তার বিধাতা তাকে আঘাত করবে, ব্যঙ্গ করবে!

 

সেই ব্যঙ্গ ধরা পড়ল সুবর্ণর কাছে।

ধরা পড়েছিল, তবু চোখ বুজে ছিল। খারাপ মনটাকে নিয়ে জোর করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, হঠাৎ সেই অনেক দিন আগে পড়া ময়াল সাপের প্রবন্ধটা মনে পড়ে গেল।

ভাবতে ভাবতে নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে এল। তার, বিস্ফারিত হয়ে এল চোখ দুটো, আড়ষ্ট কঠিন হয়ে উঠিল শরীর। হাত দুটো আপনি মুঠো হয়ে গেল।

ঘরে কেউ থাকলে দেখে চমকে যেত, চেঁচিয়ে উঠত।

এর পর আর কি করতো সুবৰ্ণ কে জানে!

কে জানে চিৎকার করে কেঁদে উঠতো, না দেয়ালে মাথা ঠুকতো?

মোক্ষম সময়ে প্ৰবোধচন্দ্র এসে ঘরে ঢুকলো।

দেরাজ থেকে তোলা তাসজোড়াটা বার করে নিতে এসেছিল প্ৰবোধ।

আড্ডায় লোকসংখ্যা বেশি হয়ে গেছে, কাজেই একদল বেকার ব্যক্তি খেলোয়াড়দের পিছনে বসে উসখুসি করছে আর চাল বলে দিয়ে খেলার পিপাসা মেটাচ্ছে।

অবস্থাটা অস্বস্তিকর!

প্রভাস বলেছে, দূরছাই, আর একটা বাসর বসুক! তোমার ঘরে আরও তাস আছে না?

প্রভাস ইচ্ছে প্ৰকাশ করেছে, প্ৰভাস বলেছে! হস্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছিল প্ৰবোধ তোলা তাসটা নিতে! কিন্তু সুবর্ণর মূর্তি দেখে থমকে দাঁড়ালো।

মুঠোপাকানো হাত, আর সে হাতের স্ফীত শিরাগুলো দেখে ভয়ই হলো তার। সত্যি বলতে, এমনিতেই সুবৰ্ণকে ভয়-ভয় করে প্রবোধের। নিয়ে ঘর করে বটে, কিন্তু কোথায় যেন অনন্ত ব্যবধান!

সত্যি, বাড়ির সমস্ত স্ত্রীলোকগুলিকে বুঝতে পারা যায়, পারা যায় না। শুধু নিজের স্ত্রীকে! এ কি কম যন্ত্রণা!

অথচ ওই বুঝতে না পারাটা স্বীকার করতে রাজী নয় বলে না-বোঝার জায়গাগুলো চোখ বুজে এড়িয়ে যেতে চায়, ভয় করে বলেই শাসনের মাত্রায় সহসা মাত্রা ছাড়ায়।

আশ্চর্য!

মেয়েমানুষ পর্যচর্চা করবে, কোদল করবে, ছেলে ঠেঙাবে, ভাত রাধবে, আর হাঁটু মুড়ে বসে। এককাসি চচ্চড়ি দিয়ে একগামলা ভাত খাবে, এই তো জানা কথা। ভাত বাড়া দেখে ঘরের পুরুষেরা পাছে মুচকে হেসে প্রশ্ন করে, বেড়াল ডিঙোতে পারবে কিনা। তাই পুরুষের চোখের সামনে কখনো ভাত বাড়বে না নিজেদের। এই সবই তো চিরাচরিত।

প্ৰবোধের ভাগ্যে সবই উল্টো।

সৃষ্টিছাড়া ব্যতিক্রম!

ইচ্ছে হচ্ছিল, না দেখার ভান করে কেটে পড়ে, কিন্তু হলো না। চোখোচোখি হয়ে গেল। অগত্যাই একটু এগিয়ে এসে বলতে হলো, কী ব্যাপার? শরীর খারাপ হচ্ছে নাকি?

সুবৰ্ণ শুধু চোখ তুলে তাকালো, সুবর্ণর নিঃশ্বাসটা আরো দ্রুত হলো।

হলো কি? কামারের হাপরের মত আমন বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলাছ কেন? শরীর খারাপ লাগছে? বড়বৌকে ডেকে দেব?

এবারে আর নিঃশ্বাসটা ফোঁস করে উঠল না, ফোঁস করে উঠল সুবর্ণ নিজেই, কেন, বড়বৌকে ডেকে দেবে কেন?

বাঃ, ডেকে দেব কেন! কী হলো না হলো বড়বৌ বুঝবেন।

সুবৰ্ণ শুধু ফোঁসই করে না, এবার তীব্র একটা ছোবল দেয়, বড়বৌ বুঝবেন! আর তুমি বুঝবে না? কবিরাজী পান এনে ভোলানো হয়েছিল, কেমন? মিথু্যক, জোচ্চোর!

প্ৰবোধ ওই আরক্ত মুখের দিকে তাকায়।

প্ৰবোধের ব্যাপার বুঝতে দেরি হয় না।

আর বোঝার সঙ্গে সঙ্গেই ভয়টাও কাটে। ওঃ, শরীর খারাপ নয়, রাগ। বাবাঃ, স্বস্তি নেই!

ক্যাবলা-ক্যাবলা হাসি হেসে বলে, ও ফেঁসে গেছে বুঝি তুক? বাবা, কী ইয়ে—

বোধ করি বলতে যাচ্ছিল কোনো বেফাঁস কথা, সামলে নিল। ওই সামলে নিতে নিতে কথার ধরনই সভ্য হয়ে যাচ্ছে। একমাত্র এই তাসের আড্ডাতেই যা ইচ্ছেমত মুখ খুলতে পাওয়া যায়। স্ত্রী তো নয়, যেন গুরুমশাই!

বলে মিথ্যেও নয়!

গুরুমশাইয়ের ভঙ্গীতেই ধমকে ওঠে তার স্ত্রী, খবরদার বলছি, দিদিকে ডাকবে না!

ডাকিবো না? বাঃ! শেষে একলা ঘরে দাঁতকপাটি লাগিয়ে বসে থাকবে? ওসব মেয়েলী কাণ্ড বড়বৌই ভাল বুঝবে!

মেয়েলী কাণ্ড!

মেয়েলী কাণ্ড!

আর সর্পিণী নয়, যেন বাঘিনীর মত ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় সুবর্ণ স্বামীর উপর। যেন নখে করে ছিঁড়ে ফেলতে চায় ওর ওই বোকামির মুখোশ।

আর মুখোশ ছিঁড়ে ফেলা সেই কুৎসিত জীবটাকে কটুক্তির চাবুকে জর্জরিত করে ফেলতে পারলেই বুঝি সুবৰ্ণলতার নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

কিন্তু সত্যিকার নখ দিয়ে তো আর সে মুখোশ ছেড়বার নয়, তাই কিছুই হয়ে ওঠে না। শুধু একটা আগুনঝরা প্রশ্ন ঠিকরে ওঠে, মেয়েলী কাণ্ড! কচি খোকা তুমি!

প্ৰবোধ এই আগুনের খাপরার কাছ থেকে সরে পড়তে পারলে বাঁচে, তাই একটা সাজানো হাসি হেসে বলে, হল কি রে বাবা! থেকে থেকে যেন ভূতে পায়। তাসজোড়াটা কোথায়? দেরাজে আছে?

প্রশ্নটা বাহুল্য।

ঘরে ওই দেরাজটা ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই।

না, আর একটা জিনিস আছে।

ইট দিয়ে উঁচু  করা একটা চৌকিও আছে। যার নীচে বাক্স-প্যাটরা চালান করবার জন্যে ওই উঁচু  করা। যে চৌকিটার উপর অনেকদিন পর্যন্ত দুটো ছেলে-মেয়ে নিয়েও আড়াআড়ি শুয়ে এসেছে সুবর্ণ আর প্রবোধ। তিনটে হবার পর থেকেই সেটাকে ছেড়ে মাটিতে শয্যা বিছিয়েছে সুবর্ণ।

চৌকিটায় এখন সারাদিন গাদা করে বিছানা তোলা থাকে, আর রাত্ৰে প্ৰবোধ একা হাত পা ছড়িয়ে শোয়। কচি-কাঁচা নিয়ে শুতে পারে না। আর সে। বয়েস হয়েছে, শরীর ভারী হয়েছে, তাছাড়া-কাঁচা পয়সার গুমোরও হয়েছে কিছু।

মনে জানে, আরাম চাইবার দাবি জন্মেছে তার।

সুবৰ্ণ মাটিতে বিছানা বিছিয়ে শোয় ছেলে-মেয়ে নিয়ে, দিনের বেলা মাদুরে। ঘরের এ-প্ৰান্ত থেকে ও-প্রান্ত অবধি বিছানা কাঁথার সমাবেশ, কে জানে অদূর ভবিষ্যতে আরও একটা জায়গা

তাসজোড়াটা থাকলে দেরাজেই থাকবে। কিন্তু সেই সহজ নির্দেশটা দিল না। সুবর্ণ, উঠে দাঁড়িয়ে কটুকণ্ঠে বলল, আবার তাস?

আস্তে! প্ৰবোধ বলে, গলা যে ভাসুরের কান ফাটিয়ে দিচ্ছে!

কিন্তু ভাসুরের নামোল্লেখেও দমে না। সুবৰ্ণ, সমান তেজে বলে, ওঃ, ভারি একেবারে সাতমহলা অট্টালিকা, তাই ভাদরবৌয়ের গলা ভাসুরের কানে পৌঁছবে না! সারা বাংলায় বোবা মেয়ে ছিল না? বোবা মেয়ে! তাই একটা খুঁজে নিয়ে বিয়ে করতে পারো নি.?

ঘাট হয়েছিল। তাই উচিত ছিল। প্ৰবোধ বলে ওঠে, জিভ তো নয়, ছুরি!

প্ৰবোধ বানাৎ করে দেরাজ টেনে তাসটা বার করে।

তাস নেবে না বলছি, ভাল হবে না! সেদিনের প্রতিজ্ঞার কথা মনে নেই? ছেলের মাথায় হাত দিয়ে দিব্যি করেছিলে না? বেহায়া নির্লজ! জোচ্চোর!

একখানা ঘরের ব্যবধানে ভাইরা আর খেলার বন্ধুরা, এ সময়ে আর গোলমাল বাড়তে দিয়ে একটা কেলেঙ্কারি করা চলে না। নইলে প্ৰবোধের কি ইচ্ছে হচ্ছিল না, ফুটবলের মত লাথিয়ে লাথিয়ে ঘরের বাইরে বার করে দেয় ওই অবিশ্বাস্য ঔদ্ধত্যকে!

তাই কষ্টে মুখে হাসি টেনে এনে বলে, ফুঃ, সঙ্কটকালে আমন কত প্ৰতিজ্ঞা করতে হয়। তাই বলে যদি রাতের প্রতিজ্ঞা দিয়েও মানতে হয়, তাহলে তো বাঁচাই চলে না।

কী? কী বললে?

সুবৰ্ণ আবার বসে পড়ে।

প্রতি মুহূর্তে স্বামীর অপদার্থতার পরিচয় পায় সুবর্ণ তবু চমকে চমকে ওঠে।

অথচ অপদার্থতা সুবৰ্ণর মাপকাটিতেই। অন্য অনেক মেয়েমানুষই অমান বর পেলে ধন্য হয়ে যেত।

প্ৰবোধ পালায়।

স্রেফ পালায়। তাড়া-খাওয়া জানোয়ারের ভঙ্গীতে।

শুধু বলে যায়, ওঃ, কাকে কি বলছি হঁশ নেই, কেমন? নিজে নিত্যি ফ্যাসাদ বাধিয়ে বসবেন, আর মেজাজ হবে যেন আগুন!

কাকে কি বলাই বটে!

কিন্তু ইশ কি সত্যিই নেই সুবর্ণর?

নাকি ও চায় অপমানের অন্ধুশে আহত হয়ে একবার অন্তত জ্বলে উঠুক প্ৰবোধ? পুরুষের মত জ্বলে উঠুক, বজের তেজ নিয়ে জ্বলে উঠুক? মা ভাইয়ের কাছে মুখ রাখতে শাসনের প্রহসন নয়, সত্যিকার শাসন করুক। সুবৰ্ণকে তাড়িয়ে দিক, মেরে ফেলুক। সেই মরণের সময়ও যেন জেনে মরে সুবৰ্ণ, যে প্রাণীটার সঙ্গে ঘর করছিল সেটা মানুষ!

কিন্তু ফলটা ফলে বিপরীত।

সুবৰ্ণলতা যত উগ্র হয়ে ওঠে, প্ৰবোধচন্দ্র ততো নিস্তেজ হয়ে যায়। পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়।

কিন্তু সুবর্ণই বা কি!

তার মধ্যেই কি পদার্থ থাকছে আর? যেটুকু ছিল, সেই আত্মঘাতী সংগ্রামে ক্ষয় হয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে না? তার নিজের ভিতরকার যে সুরুচি, যে সৌন্দর্যবোধ এই কুশ্রী পরিবেশ থেকে মুক্তি পাবার জন্যে সর্বদা ছটফট করে মরতো, সে যে প্রতিনিয়ত এই নিস্ফল চেষ্টায় বিকৃত হয়ে উঠছে, সে বোধ কি আর আছে সুবৰ্ণলতার?

এই বাড়ি আর এই বাড়ির মানুষগুলোর অসৌন্দর্য ঘুচিয়ে ছাড়াবার জন্যে নিজে সে কত অসুন্দর হয়ে যাচ্ছে দিন দিন, এ কথা তাকে কে বুঝিয়ে দেবে!

 

কী হে প্ৰবোধবাবু, তাস আনতে যে বুড়ো হয়ে গেলে!

অভ্যস্ত কথা, অভ্যস্ত ঠাট।

বুঢ়ী আঁচল ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করছে না বুঝি?

হুঁ, গিন্নী!

প্ৰবোধ গুছিয়ে বসে বলে, প্ৰবোধচন্দ্ৰ অমন গিন্নী-ফিনীর ধার ধারে না। দেরি হল তাসটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না বলে।

বাড়ির অখ্যাতি বন্ধুমহলেও প্রচার হয়ে গেছে, তাই প্ৰবোধের সগর্ব উক্তিতে একজন হেসে ফেলে বলে, আরো রেখে দাও তোমার গুমোর! গিন্নী তো শুনি তোমার কান ধরে ওঠায়, কান ধরে বসায়া!

হাসি।

হাসিই একমাত্ৰ মুখরক্ষার ঘোমটা।

তাই হাসতে থাকে প্ৰবোধ তাস ভাজতে ভাঁজতে, নাঃ, তোমরা আর মান-মৰ্যাদা রাখলে না!

এই সময় সুবোধের ছেলে বুদো এক ডাবর সাজা পান এনে আড্ডার মাঝখানে বসিয়ে দেয়, প্ৰবোধের লজ্জায় ছেদ পড়ে। পর পর তিন মেয়ের পর ছেলে, তবু বেচারা যেন নিতান্তই বেচারী।

 

রবিবারটা বুদোর দুঃখের দিন।

খেলতে যেতে পারে না, সারাক্ষণ আসরের খিদমদগারী খাটতে হয়।

বিশেষ এক-একটা ভার যে কেমন করে বিশেষ এক-একজনের ঘাড়ে এসে চাপে, সেটাই বোঝা শক্ত। বাড়িতে আরো ছেলে আছে, কিন্তু বুন্দোরই সব রবিবার দুঃখের দিন।

অবশ্য ভানু কানুর এ আসরের মুখে হবার জো নেই। তাদের মা তাহলে তাদের ধরে ধোবার পাটে আছাড় দেবে। এবং যে তাদের ফরমাস করবে, তাকেও রেহাই দেবে না। এটাও জানা। তাই বাড়িতে ভানু কানু নামের দু-দুটো ছেলে থাকতে বুদের ঘাড়েই সব বোঝা।

প্ৰবোধ বলেছিল, ওরা কিছু করে না, একা দাদার ছেলেটাই খেটে মরে—এটা স্বার্থপরের মত দেখায় না!

দেখায়! সুবর্ণ বলেছিল, কি করা যাবে, দেখাবে!

তোমারই যত ইয়ে, কই ওরা মা তো এত রাগ করে না?

ওর মা মহৎ।

তা মহৎই!

নইলে ওই ডাবর ডাবর পানই বা সে একা সেজে মরে কেন?

জনৈক আড্ডাধারী পকেট থেকে জর্দার কোটো বার করে তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, পান কে সেজেছে রে বুদো? তোর মা বুঝি?

মেয়েদের সম্পর্কে প্রশ্ন করতে হলে তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞার সুর মেশাতে হয়, এটাই রীতি। ভদ্রলোক সে রীতিতে বিশ্বাসীও।

নির্বোধ বুদো এ প্রশ্নে কৃতাৰ্থমন্য হয়ে একগাল হেসে বলে, হ্যাঁ।

তোর মাকে শিখিয়ে দিগে যা বাপ, পান দিলে তার সঙ্গে একটু চুন দিতে হয়।

যেন একটি ক্ষুদে লাটের ভঙ্গীতে একটা পান তুলে নেন। ভদ্রলোক।

এই এঁদের অভ্যস্ত ভঙ্গী।

পৃথিবীটা এঁদের কাছে করতলগত আমলকীবৎ। সর্ববিধ ব্যাপারকে নস্যাৎ করে দেবার কৌশলটি এঁদের জানা। দেশ যখন স্বদেশী আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গে উদ্বেল, এরা তখন ঘরে বসে রাজা-উজির মারছেন, সেই আন্দোলনকে তুড়িতে ওড়াচ্ছেন।

পাড়ার প্রত্যেকটি বাড়ির বৌদের খবর এঁরা রাখেন এবং সমালোচনায় তৎপর হন। এ বাড়ির বড়বৌটিকে ওঁরা অগ্রাহ্য করেন,–মেজটিকে ব্যঙ্গ করেন, সেজটিকে স্বার্থপর বলে ছিছিক্কিার করেন এবং ছোটটিকে অবজ্ঞা করেন।

গুণানুসারেই করেন। অবশ্য, এবং মনোভাব চাপতেও চান না।

শুধু পাড়াপাড়শীই নয়, ওঁদের আড্ডায় কাটা পড়ে না। এমন মাথা নেই। এঁরা ব্ৰাহ্মকে বলেন বেম্ম, ব্ৰাহ্মণপুরুতকে বলেন, বামনা, বিদুষী মেয়ের নাম শুনলে বলেন, লীলাবতী!

এঁরা দেশনেতাদের পাগলা আখ্যা দিতে দ্বিধা করেন না, পরমহংসের বুজরুকীর ব্যাখ্যায় আমোদ পান, বিবেকানন্দের আমেরিকায় গিয়ে হিন্দুধর্ম প্রচারের বার্তা নিয়ে হাসাহাসি করেন এবং মেয়েদের লেখাপড়ার অগ্রগতি লক্ষ্য করে সকৌতুক ব্যঙ্গ যখন তখন ঈশ্বর গুপ্ত থেকে উদ্ধার করে বলেন, আরো কত দেখবে হে! দেখবার এখুনি হয়েছে কি? এরপর সব–

এ, বি, সি, শিখে বিবি সেজে
বিলিতি বোল কবেই কবে।
আর হুট বলে বুট পায়ে দিয়ে
চুরুট ফুকে স্বর্গে যাবে।

বাড়ি বাজার আর অফিস, এই ত্রিভুজ তাঁতে আনাগোনা করতে করতে মরচে পোড়ে গেছে ওঁদের জীবনের মাকুটা।

এঁরাই সুবৰ্ণলতার স্বামীর বন্ধু।

কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর এই অফিসবাবুর দল কি এ যুগে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে?

আজকের পৃথিবীর এই দুরন্ত কর্মচক্রের দুর্বর গতির তাড়নের মাঝখানেও, অলস গতি আর অসাড় আড্ডা নিয়ে আজও কি টিকে নেই তারা? আজও কি তাদের জানার জগতে শুধু এই কথাই নেই, মেয়েমানুষ জাতটাকে ব্যাঙের আর অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখতে হয়, তারা পানের পাশে চুন রাখতে ভুলে গেলে তাদের সমঝে দিতে হয়? আছে। ওঁরা যে আধুনিক নন, এই ওঁদের অহমিকা, এই ওঁদের গৌরব।

নাঃ, একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি।

আজও আছে বৈকি কিছু কিছু।

আছে দর্জিপাড়া আর কিনুগোয়ালার গলি, ছিদাম মিস্ত্রী আর রাণী মুদিনীর লেনের অন্তরালে।

এখনো ঐরা জানেন পুরুষ জাতটা বিধাতার স্বজাতি বলেই শ্রেষ্ঠ।

এঁরা আছেন।

হয়তো চিরকাল থাকবেন।

পৃথিবীর দুরন্ত অগ্রগতির পথে বাঁধা দেবার প্রয়োজনে বিধাতাই এঁদের সৃষ্টি করে চলেছেন, কম-বেশি হারে।

অথচ আবার হয়তো ওঁদের অন্তঃপুরের রঙও বদলাচ্ছে, ওঁরাই আব্রুর কড়া শিকল শিথিল করে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন, ওঁরাই ওঁদের মেয়েদের নিয়ে স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে আসছেন বিয়ের বাজারে দাম বাড়াবার আশায় আর মেয়েদের বিয়ের বয়েসটা বারো থেকে ষোলোয় তুলছেন পারিপার্শ্বিকের চাপে।

এঁদের নাম মধ্যবিত্ত।

এঁরাই নাকি সমাজের কাঠামো।

এঁরা এদের মধ্যবিত্ততা এবং মধ্যচিত্ততা নিয়ে রক্ষা করে চলেছেন সেই কাঠামো। তার সঙ্গে চলেছে সময়ের স্রোত।

১.১৪ মুটের মাথায় ফলের ঝোড়া

মুটের মাথায় ফলের ঝোড়া, আঙুলের ফাঁকে ঝোলানো বড় দুটো কলার ছড়া—জগু এসে পিসিমার দরজায় হাঁক পাড়লো, পিসি গো পিসি!

কে র‍্যা, জগু নাকি?

মুক্তকেশী জপের মালা হাতেই বেরিয়ে আসেন।

হ্যাঁ গো হ্যাঁ! তা নইলে এ বাজাখাই গলা আর কার হবে? জগু চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়েই কথা সারে, ও সর্বনাশ, এতখানি বেলা হয়ে গেল এখনো তুমি মালা ঠকঠকাচ্ছে! পুণ্যির ছালা রাখবে কোথায়?

মুক্তকেশী এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলেন, কি ব্যাপার? এত কলা কিসের?

কলা তোমার ভাইবৌয়ের ছেরাদ্দর! বলে ছড়া দুটো একবার দুলিয়ে নিয়ে জগু মহোৎসাহে বলে, কী আক্রাগণ্ডার বাজারই পড়লো! মাত্তর দুছড়া কলা তিন-তিন গণ্ডা পয়সা!

মুক্তকেশী মুখ বাঁকিয়ে বলেন, ঠকিয়েছে তোকে। আমি আনাপিছু ছড়া আনছি। নিত্য! বলি এত ফল কী হবে রে?

বললাম তো, তোমার আদরের ভাজ শ্যামাসুন্দরীর ছোরাদ।… মাগো মা, শ্যামা মা, মাতৃনাম উচ্চারণে অপরাধ নিও না। সিন্নি হবে গো সিন্নি। শ্যামাসুন্দরী দেবী যে মামলা জিতেছেন! কাল রায়। বেরিয়েছে। সত্যনারায়ণের সিন্নি মানা ছিল, তাই শোধ হচ্ছে আজ। যেও সন্ধ্যেবেলা, সেই কথাই বলতে এলাম। মা ঠাকরুণ পইপই করে বলে দিয়েছেন।

মুক্তকেশী যাকে বলে বিস্ময়বিস্ফারিত লোচনে বলেন, মা জিতেছে! তার মানে তুই হেরেছিস?

তা শ্যামাসুন্দরী দেবী জিতলেই আমাকে হারিতে হবে, এ তো পড়েই আছে কথা! বাদীপ্রতিবাদীর সম্পর্ক যে দিন-রাত্তিরের মত! এ আছে তো ও নেই, ও আছে তো এ নেই।

মুক্তকেশী বিরক্ত কণ্ঠে বলেন, থামা ব্যাখ্যানা! বলি হেরে মরে আবার থেতা মুখ ভোঁতা করে মায়ের মানুতি পূজোর নৈবিদ্যির যোগাড় দিচ্ছিস?

জগু অসন্তুষ্ট স্বরে বলে, ওই, ওই জন্যেই তোমার সঙ্গে মাঝে মাঝে বিরোধ হয় আমার পিসি! বলি আমি যোগাড় করে দেব না তো কোন যম এসে দেবে? আর ককুড়ি ব্যাটা আছে তোমার ভাজের? আবার তো কাল ভোরবেলা তাকে নিয়ে ছুটতে হবে কালীঘাটে। পূর্বজন্মে কত মহাপাতক ছিল তাই এক পুত্তুর হয়ে জনেছি! যেও তাহলে।

জগু চলে যাচ্ছিল, মুক্তকেশী হাতের ইশারায় দাঁড় করিয়ে হাতের মালা কপালে ঠেকিয়ে বলেন, দেখ, সত্যনারায়ণ কাঁচাখেকো দেবতা, তার নাম করে অন্যায্য উপরোধ করিস নে। আমার বাপের বংশধরকে বঞ্চিত করে বৌ ড্যাং ড্যাং করে মামলা জিতে সিনি। দেবে, আর আমি সেখানে পেন্নাম ঠুকতে যাবে? আমার বাড়ির এক প্ৰাণীও যাবে না।

জগু আরো অসন্তোষের গলায় বলে, এই দেখ, আমি পারবো। ড্যাবডেবিয়ে দেখতে, আর তুমি, পারবে না? বলি ঠাকুরটা তো আর ওনার খানাবাড়ির খানসামা নয় যে ওঁকেই পুণ্যফলটুকু ধরে দেবে?… ওগো বৌমারা, একখানা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে ঝি সঙ্গে করে শাশুড়ীকে নিয়ে যেও সন্ধ্যেবেলা। মামীশাশুড়ী বলে দিয়েছে, ভারি ঘটার সিন্নি!.. ভাইরাও যদি পারে তো যায় যেন। চললাম, অনেক কাজ। বড়লোকের কন্যের আহ্লাদ মেটাতে মেটাতেই—

চলে যেতেই সেজবৌ মুখ বাঁকিয়ে বলে, ভাসুর গুরুজন, বললে অপরাধ, তবে ও বাড়ির বটুঠাকুরের বুদ্ধির বালাই নিয়ে মরতে ইচ্ছে করে।… হাসবো, না কাঁদবো?

কোথায় ছিল সুবৰ্ণলতা, কটু করে বলে ওঠে, এ বাড়ির কর্তারা যদি ও বাড়ির বটুঠাকুরের পায়ের নখের যুগ্যিও হতেন, তাহলে দুবেলা তাদের পা-ধোওয়া জল খেতাম।

সেজবৌ অনেকদিন মেজদির সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ রেখেছিল, আজ মেজদিই। যখন ভাঙলো সেটা, তখন আর উত্তর দিতে বাধা রইল না।

বলে উঠল, কি বললে মেজদি?

যা বলেছি ঠিকই বলেছি।

কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা? ও বট্‌ঠাকুর তো মানুষের আকৃতিতে একটি—যাক গুরুজন, বলব না কিছু। সেই যে কথায় বলে না। কিসের আর কিসেয়, সোনায় আর সীসেয়, তোমার তুলনাটা তেমনি।

ঠিকই বলেছে। সেজবৌ! সোনা আর সীসেয় তুলনাটাই ঠিক। তবে সে সোনা কে সীসে সেটাই প্রশ্ন। তোমাদের হিসেবের সঙ্গে আমার হিসেব মেলে না। এই যা।

 

তা কারো হিসেবের সঙ্গেই কি মেলে সুবর্ণর?

মিললে কি সে ছোট তিনটে ছেলেমেয়েকে নিয়ে ভরাসন্ধ্যেবেলা একা একটা বিরে সঙ্গে একখানা ভাড়াটে ঘোড়ার গাড়িতে গিয়ে উঠত?

চাঁপা ফরকেছে, চাপা যায় নি। যায় নি। ভানু-কানু। শুধু চন্নন পারুল খোকা। এদের এখনো মা ছাড়া চলে না।

ফুলের গন্ধ, ধূপের গন্ধ, আর সদ্য-কাটা তাজা ফলের গন্ধ বাড়িটাতে যেন দেবমন্দিরের বাতাস পৌঁছে দিয়ে গেছে। আর দরজা থেকে সুনিপুণ আলপনার রেখা যেন তার সুষমাময় স্বপ্ন নিয়ে অপেক্ষা করছে দেবতার আবির্ভাবের।

কী অপূর্ব

কী সুন্দর!

কী অনাস্বাদিত এই স্বাদ!

সুবৰ্ণর মনে হলো কোন এক স্বৰ্গলোকের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে সুবর্ণ।

মুক্তকেশী তীৰ্থ করেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে বেরিয়ে, মুক্তকেশী মানতি পূজো দেন দেবমন্দিরে গিয়ে গিয়ে। মুক্তকেশীর ঘরে এমনভাবে দেবতার আহবান নেই। থাকার মধ্যে আছে শুধু বছরে বারকয়েক সুতিকাষষ্ঠীয় পূজো!

কিন্তু তাতে কি এমন মোহময়, সৌন্দর্যময় আর সৌরভময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়?

সুবৰ্ণ এই সুরভিত বাতাসের সুযোগে আচ্ছন্ন হয়ে আস্তে ভিতরে ঢোকে।

শ্যামসুন্দরী সস্নেহে বলেন, এসো মা এসো! দাদা দিদিরা এসো ভাই! থাক থাক, দূরে থেকে প্ৰণাম করো বৌমা! ঠাকুরবি কই?

সুবৰ্ণ মৃদুস্বরে বলে, আসতে পারলেন না।

আসতে পারলেন না? শ্যামসুন্দরী বিস্ময় আর বিরক্তির সঙ্গে বলেন, সত্যনারাণে আসতে পারলেন না? তোমার আর সব জায়েরা?

ওরাও বোধ হয় আসতে পারবে না।

বোধ হয়টা বাহুল্য।

পুরো একখানা গাড়িতে সুবর্ণ তিনটে মাত্র কাচ্ছাবাচ্ছা নিয়ে এসে গিয়েছে আর কারো আসার প্রশ্ন নেই।

শ্যামাসুন্দরী বলে ওঠেন, পারবে না, না আসবে না? বুঝেছি, এসব ঠাকুরঝির নিষেধ। আসবে না। আমার বাড়ি।

সুবৰ্ণ ভদ্র গলায় বলে, তা কেন, আমি তো এলাম!

বুদ্ধিমতী শ্যামাসুন্দরী বোঝেন এখানে বিরুদ্ধ মন্তব্য চলবে না। বুঝে। অবশ্য প্রীতিই হন, বৌয়ের পক্ষে এটা সদগুণ! ঈষৎ হাস্যের সঙ্গে তুমি তো আমার ক্ষাপা মেয়ে বলে কর্মান্তরে প্রস্থান করেন।

কথা এমন মিষ্ট করে বলা যায়!

সুবৰ্ণ একটুক্ষণ অভিভূতের মত দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর ছেলেমেয়েদের নিচের তলায় বসিয়ে রেখে উঠে যায় দোতলায়। এ বাড়িতে আগে এসেছে কয়েকবার। শ্যামাসুন্দরী তখন মাঝে মাঝে ননদ ও ভাগ্নে-বৌদের নেমন্তন করতেন।

এখন গুষ্টি বড় হয়ে গেছে, হয়ে ওঠে না। নেমন্তন করলে অন্তত এক কুড়ি পাত সাজাতে হবে।

দোতলার বড় ঘরটাই শ্যামাসুদীর, দক্ষিণ খোলা রাস্তার ওপর। এর জানলায় দাঁড়ালে বড় রাস্তা দেখা যায়।

বাড়িটা বড় নয়, তবু যেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত জায়গা। দোতলায় ওই রাস্তার দিকটা বাদে আরো দুখানা ঘর, সামনে টানা দালান। কিন্তু জগুর আবার ভূতের ভয়, একা ঘরে শুতে পারে না, তাই বড় ঘরটায় মা ছেলে দুজনের বিছানা পাতা হয়। দুটো সরু সরু চৌকিতে।

শ্যামাসুন্দরী বলেন, তোর যা নাক ডাকে, ভয় পাবার কথা আমারই। তুই নিজের ঘরে শুগে না। বাবা, আমি শেষরাত্তিরে উঠে একটু ঠাকুরদেবতার নাম করে বাঁচি!

জগু বলে, কেন, আমি ঘরে থাকলে তোমার ইষ্টিদেবতাও ভয় খাবে? হুঁ!

অতএব এদিকের ঘর দুটো শেকল তোলা থাকে। মামলায় কে জিতবে এ নিয়ে দুই মায়েবেটায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে তর্ক-বিতর্ক চলে। তর্কের শেষে অবশ্য জগুরই জয় হয়, কারণ সে শেষ রায় দেন, ভগবান যদি থাকে তো জিত আমারই। বুঝলে? বিষয়টা আমার বাপের, তোমার ঠাকুর্দার নয়।

শ্যামাসুন্দরী সে কথা অস্বীকার করতে পারেন না। আবার ভগবান নেই। এ কথাও বলা চলে না।

সুবৰ্ণ অবশ্য মা-ছেলের সেই অপূর্ব বাকবিনিময়ের কথা জানে না, শুধু দুটি সরু চৌকি দেখে মুগ্ধ হলো।

পূর্ণিমা তিথি।

জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসেছে, ঘরের মেঝোয় কালো কালো গরাদের ছায়া। দোতলায় এখন কেউ নেই, কাজেই হ্যারিকেন লণ্ঠন দুটো নিচেয় নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

কোনো জগতে এসে পড়েছে।

নির্জনতার বুঝি নিজস্ব একটা সত্তা আছে। আর সে সত্তা অলৌকিক সুন্দর। অনেকগুলো লোকের উপস্থিতি কী ক্লেদাক্ত বিশ্ৰী!

কত বড় দুঃসাহস দেখিয়ে সে একা এভাবে চলে এসেছে, সে চিন্তা মনে আসে না, ফিরে গেলে কপালে কী লাঞ্ছণা জুটবে সে চিন্তা করতে ভুলে যায়, শুধু লক্ষ্যহীন দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবে সুবৰ্ণ, অনন্তকাল ধরে যদি এমনি দাঁড়িয়ে থাকতে পেতাম!

এমনি চলমান পথিকের স্রোতের দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা!

সুবৰ্ণ কেন ওই রাস্তার হেঁটে-যাওয়া লোকেদের একজন হলো না? সুবৰ্ণ কেন মেয়েমানুষ হয়ে জন্মালো?

ও আমার কপাল, তুমি এখেনে—, পিছনে হরিদাসীর কণ্ঠে ভাঙা কাসি ঝনঝনিয়ে ওঠে, হ্যাঁগো মাজবৌদিদি, তোমার আক্কেলটা কী? নিচেয় ভট্টচাষ এসেছে, পূজো বসে গেছে, পাড়াপাড়শীতে ঘর বোঝাই, ছেলেপেলেগুলোকে ফেলে রেখে এসে তুমি এখেনে ভূতের মত দাইড়ে আছো? আদারের ভয় লাগে না গো?

ভয় আবার কি—, পৃথিবীর মাটিতে নেমে-আসা সুবর্ণ অপ্রতিভ হয়ে বলে, বেশ তো তুই, আমায় ডাকিস নি যে?

ডাকি নি আবার? কত ডাকছি! শেষে—

তাড়াতাড়ি নেমে আসে সুবর্ণ, আর এসেও চোখ জুড়িয়েই যায়। সত্যনারায়ণ ব্ৰতের আয়োজন কি সত্যিই এর আগে দেখে নি। সুবৰ্ণ? দেখেছে। পাড়াপাড়শীর বাড়ি কদাচ, বাড়িশুদ্ধ সকলে ভিড় করে গিয়ে। নিজেদের চ্যা-ভ্যাঁ-তেই ত্ৰাহি ত্ৰাহি লেগেছে।

এখানে সকলেই বেশ গিন্নীবামী, শ্যামাসুন্দরীর বান্ধবীকুলই সম্ভবত, শান্তভাবে বসে আছেন যুক্ত করে।

ধুপ ধুনো চন্দন ফুল চৌকি মালা ঘট পট সব মিলিয়ে দেবতা যেন সত্যই একটি সত্তা নিয়ে বিরাজ করছেন।

আশ্চর্য, সুবৰ্ণর ছেলেমেয়েরাও তো এখানে দিব্যি চুপ করে জোড়হাতে বসে আছে! অথচ ওরাই দলে মিশে যেন অন্য অবতার। ঠেলাঠেলি, হাসোহাসি, অসভ্যতা, লোলুপতা, এই তো মূর্তি ওদের।

পরিবেশ।

পরিবেশই মানুষকে ভাঙে গড়ে।

পুরোহিত পুথি খুলে গলা ঝেড়ে কথা শুরু করেন।

কলাবতীর গল্প!

কলাবতীর মৃত স্বামীকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সত্যনারায়ণ, সুবর্ণলতার জীবনযাত্রার গতিটা ফিরিয়ে দিতে পারেন না?

কলাবতীর সত্যকারী ভক্তি ছিল!

সত্যকার ভক্তিটা কেমন বস্তু? আর তার আকুলতাটাই বা কেমন?

গাড়ি অনেকক্ষণ আগে নামিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছে। কথার শেষে পড়াশীরা বিদায় নেয়, শ্যামাসুন্দরী এদের ছাড়েন না। রাতের খাওয়াটা খাইয়ে দেবেন বলে লুচি ভাজতে বসেন। অভিভূত সুবৰ্ণ আপত্তি করে না, সুবৰ্ণ যেন ভুলে গেছে সে কাদের বাড়ির। ভুলে গেছে আবার সে-বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে তাকে।

কিন্তু মনে থাকলেই কি মনে করতে পারতো, সেই দাঁড়ানোর চেহারাটা এমন হবে? ভয় ছিল একা আসার জন্যে, ভয় ছিল রাত হওয়ার জন্যে, তবু এ ভয় ছিল না, সেই দরজা তার সমস্ত কদৰ্যতাকে উদঘাটিত করে বন্ধ হয়ে থাকবে।

ছেলেমেয়ে কটা বাবা কাকা জেঠা প্রভৃতি অনেককে ডেকে ডেকে শেষ অবধি বাইরের দরজার ধুলো-জঞ্জালের ওপরই বসে পড়েছে।

একেই গুরুভোজনে ক্লান্ত, তাছাড়া রাতও হয়েছে।

ঝি হরিদাসী কড়া নেড়ে নেড়ে হতাশ আর অবাক। মন্তব্য প্রকাশের ভাষা যোগাচ্ছে না আর তার।

গলির মধ্যের এপাশের ওপাশের সমস্ত বাড়ি এই দোর-ঠ্যাঙানোর সমারোহে সচকিত, জানলায় কৌতূহলী দৃষ্টির উঁকিঝুঁকি।

শেষবারের মত দরজায় প্রচণ্ড একটা ধাক্কা দিয়ে হরিদাসী পরাজিতের সুরে বলে, আমার দ্বারা আর হবে নি মেজবৌদি, আর দাঁড়াবার ক্ষ্যামতা নেই। বেশি আত্তির হলে বাড়িউলি আবার সদর কপাট বন্ধ করে দেয়। তোমার সঙ্গে গিয়ে ভালো বিপদ হল দেখছি। তোমার মামীশাউড়ীর যে আবার আদর উথলে উঠল, নুচি ভেজে খাওয়াতে বসলো!

রাত দশটা না বাজতেই এদের ঘুমের বহর দেখে সুবৰ্ণও প্রথমটা সত্যিই যেন অবাক হয়ে গিয়েছিল, এখন অবাক হওয়াটা পার হয়ে গিয়েছে।… তারপর মনে পড়ল ভাসুর এখন উপস্থিত নেই। মেজ বোন সুবালার বরের অসুখ শুনে খবর নিতে গেছেন তার গ্রামে।

এসব কর্তব্য সুবোধই করে থাকে। তাছাড়া সুবোধ বাড়িতে থাকলে যে বাড়িসুদ্ধ সবাই এমন করে ঘুমে পাথর হয়ে যেতে পারত না, সেটা নিশ্চিত।

সুবৰ্ণ আরক্ত চক্ষু মেলে বলে, তোমার রাত হয়ে যাচ্ছে হরিদাসী, বাসায় যাও।

হরিদাসী দোদুল্যমান মনকে রাশে এনে বলে, শোনো কথা! আতদুপুরে এই কুচোকাঁচা সমেত তোমাকে আস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে নিশ্চিন্দি হয়ে বাসায় যেতে পারি? হলো কি এদের? কেউ নিদুলী মন্তর দিল নাকি?

সামনের বাড়ির বসাক-কর্তা অনেকক্ষণ সহ্য করে এবার রণাঙ্গণে নামেন। ভারী গলায় হাঁক পাড়েন, ও প্ৰবোধবাবু, বলি কী রকম ঘুম মশাই আপনাদের! বাড়ির মেয়েছেলে দু ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে!

এবার বুঝি মুক্তকেশী-নন্দনদের ঘুম ভাঙে, প্রভাসচন্দ্রের ভারী গলার উত্তর পাওয়া যায়, আমাদের বাড়ির মেয়েবৌরা কেউ রাতদুপুরে একা বাইরে থাকে না মশাই। নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোন খোলা জানলাটা সজোরে বন্ধ হয়ে যায়।

এ হচ্ছে তেজ-দম্ভর কথা! হরিদাসী অকৃতজ্ঞের গলায় বলে ওঠে, এ হচ্ছে তেজের কথা, দ্বেষের কথা। আগে কি জানি ছাই—তোমাদের ভেতরে এত মনকষাকষি। এমন যখন অবস্থা যাওয়া তোমার উচিত হয় নি। পুরুষের রাগ হচ্ছে চণ্ডাল! সেই চণ্ডালকে-

তুই যাবি, যা, যা বলছি—

হরিদাসী বিরক্তভাবে বলে, ওমা, দেখ একবার! যার জন্যে চুরি করি সেই বলে চোর! বেশ যাচ্ছি। এই ধর তোমাদের সিনীর পেসাদ।

ও তুই নিয়ে যা।

আমি নে যাবো কিগো? এ যে এখেনের জন্যে দিল মামীমা!

ঠিক আছে, তুই না নিস রাস্তায় ফেলে দিগে যা।

দুগ্‌গা, দুগ্‌গা! হরিদাসী সভয়ে প্ৰসাদটা মাথায় ঠেকিয়ে বলে, হিন্দুর মেয়ে হয়ে—

এই খানিক আগে নগদ চারগণ্ডা পয়সা বখশিশ দিয়েছে মেজবোঁদি, তাই মুখে বেশি বলে না, মনে মনে বলে, সাধে আর গুষ্টিসুদ্ধ লোকে তোমার নিন্দে করে!

বসাক-কর্তা বয়সে প্রবীণ, তবু রাতদুপুরে একা সুবর্ণর কাছে যেতে তার সাহস হয় না। গৃহিণীর সাহায্য নেন।

বসাক-গৃহিণী নেমে এসে করুণা-ঢালা সুরে বলেন, ইস্, ছেলেপুলে যে ঘুমিয়ে পড়েছে দেখছি! রাস্তার ওপর! ধুলোয় মাখামাখি! ব্যাপার কি মেজবৌমা, একা কোথায় গিয়েছিলে?

মেজবৌমা নিরুত্তর।

বসাক-গৃহিণী আরো মমতা ঢালেন, বুঝেছি, রাগারগির ব্যাপার। কিন্তু যতই যা হোক, রাতদুপুরে বৌ-ছেলেকে পথে বসিয়ে রেখে দোর দিয়ে ঘুমোবে, এমন দুর্দান্ত রাগ? কোথায় গিয়েছিলে? বাপের বাড়ি বুঝি?

মেজবৌমার বাপের বাড়ি বস্তুটা যে কোন পর্যায়ে আছে, সেটা পাড়ার কারোরই অবিদিত নেই, তবু ও ছাড়া আর কিছুও মনে পড়ে না মহিলাটির।

সুবৰ্ণ এবার কথা কয়।

স্থির গলায় বলে, না।

তা হলে?

বোকা হলেও চন্ননটা ইদানীং খুব কথা শিখেছে, সে ঘুম-চোখেও বলে ওঠে, মামীঠাকুমার বাড়ি সিনী ছিল, তাই নেমন্তন গিয়েছিলাম–

মামীঠাকুমার বাড়ি? বসাক-গৃহিণী ক্রমশই কৌতূহলোক্রান্ত হন, তোরা একা গিছলি? আর কেউ যায় নি? ঠাকুমা?

না। মেয়েটার চোখের ঘুম ছেড়ে আসে, বলে, না, মামীঠাকুমা যে মকদ্দমায় জিতেছে, ঠাকুমা যাবে কেন?

বসাক-গৃহিণীর আর ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করতে দেরি হয় না, কারণ মুক্তকেশীর ওই ভাঁজ বনাম ভাইপোর মামলা জানতে কারো বাকী নেই। সাত বছর চলছিল।

বসাক-গৃহিণী বুজতে পারেন।

গম্ভীরভাবে বলেন, তা তোরা গেলি যে?

তা জানি না। মা গেল তাই। দিদি, দাদা, মেজদা তো যায় নি। দিদি বলেছিল, যেখানে ঠাকুমা যাচ্ছে না, সেখানে—

চন্নন, তুই চুপ করবি?

মায়ের ধমকে চমকে চুপ করে যায় চন্দন।

সঙ্গে সঙ্গে বসাক-গৃহিণীর করুণার প্রস্রবণও শুকিয়ে যায়। চুপ করবার নির্দেশ দিয়ে এই যে ধমক, এ কি সুবর্ণর শুধুই মেয়ের প্রতি?

ওই ধমক তাঁর কৌতূহলের ওপরও একটা চড় বসিয়ে দেওয়া নয় কি?

পড়শিনীর ঘরের এই অদ্ভুত কেচ্ছাটা সম্পর্কে কৌতূহল তার হয়েছিল, হবেই তো। যা নয় তাই কাণ্ড, তবু হবে না কৌতূহল? বেশ, ঠিক আছে।

গম্ভীর গলায় বলেন, থাক্‌, মেজবৌমা, তোমাদের ঘরের ‘কেলেঙ্কার’ সোনবার দরকারও নেই আমার, প্রবৃত্তিও নেই। তবে যা দেখছি, আজ রাতে আর দরজা ওরা খুলবে না। তা কুচোকাঁচা নিয়ে সারারাত পথ পড়ে থাকবে? মানুষের চামড়া চোখে নিয়ে এ অবস্থায় ফেলে চলে গিয়ে নিশ্চিন্দির ঘুম তো ঘুমানো যাবে না? বাকি রাতটুকু আমার ঘরে এসে শোও।

পাড়ার গিন্নীদের সঙ্গে কথা কওয়ার রেওয়াজ বৌ-ঝির নেই, কিন্তু সুবর্ণ ওই রেওয়াজটার উপর দিয়ে চলে। সুবৰ্ণ কথা বলে।

এখনও বলল।

শোবার আর দরকার হবে না বসাক-কাকীমা!

বসাক-গৃহিণী তবু টলেন না, সুবর্ণর একটা হাত ধরবার চেষ্টা করে বলেন, আচ্ছা না শোও, নয় বসেই থাকবে, তবু তো একটা আচ্ছাদনের নিচে! তোমার দরকার নেই, ছানাপোনা কটার দরকার আছে। এভাবে পড়ে থাকলে রাতের মধ্যে নিমুনি হবে যে!

হবে না। কাকীমা, কিছু হবে না। হলেও ওরা মরবে না, রক্তবীজের ঝাড় কিনা! আপনি আর ব্যস্ত হবেন না, যান ঘুমোন গে যান।

বাটে!

যান ঘুমোন গে যান!

বসাক-গৃহিণী প্রসারিত হাতটা ফিরিয়ে নিয়ে বলেন, ও মাগো! কলিতে ভালোর বালাই নেই।… চলো গো চলো, দোর দিয়ে শুয়ে পড়বে চল। সাধে কি সুবোর মা অমন করে! বৌ নিয়ে জ্বলেপুড়ে মরেই—বাকীবাঃ, বৌ নয় তো যেন কেউটের ফণা!

রাগ করে বাড়ির দরজায় খিল লাগান বসাক-গৃহিণী, অথচ কৌতূহলকে রোধ করতে পারেন না, সেই রাতদুপুরে ছাতে উঠে দেখতে থাকেন, কী হয় শেষ অবধি।

জ্যোৎস্নায় চারিদিক ফাটছে, দেখা যাচ্ছে সবটাই … কিন্তু নতুন আর কী দেখবেন, সেই তো বৌ একই ভাবে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে রয়েছে—ছেলেগুলো সেইভাবেই ঘুমোচ্ছে।

কতক্ষণ আর দেখা যায় ছাতে দাঁড়িয়ে? রাত গম্ভীর হতে হতে ক্রমশ শেষ হয়ে যায়।

সকালবেলা দরজা আটকে রাখা শক্ত, গোয়ালা আসবে, আসবে পঝি, আসবে শাক-তরকারিওয়ালী।

কখন কার ফাঁকে ছেলেমেয়েগুলো ঢুকে পড়ে টুপটাপ করে খুব খানিকটা ব্যঙ্গ প্রশ্নের সামনে গিয়ে পড়ে।

যেখানে গিয়েছিল, সেখানেই থাকল না কেন, এ প্রশ্ন করতে থাকে। সেজকাকা, ছোটকাকা, আরো ভাইবোনেরা। তারা অপ্রতিভা হয়ে বলতে চেষ্টা করে, তোমরা এমন ঘুম ঘুমোবে জানলে তাই থাকতাম!

কিন্তু সে তো ওরা, সুবৰ্ণলতা?

সুবৰ্ণলতাও কি খোলা দরজার সুযোগে আবার ঢুকে পড়ল?

নাঃ, সুবৰ্ণকে ধরাধরি করে তুলে নিয়ে যেতে হল মুক্তকেশী আর তাঁর মেজছেলেকেই।

উপায় কি? কথাতেই তো আছে— দোরের মড়া ফেলবি তো ফেল!

মড়া অবিশ্যি নয়, মরা এতো সোজাও নয়। মরণ এত সহজ হলে মানব-হৃদয়-ইতিহাসের রক্তাক্ত অধ্যায়গুলো তো লেখাই হতো না।

সুবৰ্ণলতা মরে নি, শুধু শক্ত কাঠ হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তারের যাকে বলে মূৰ্ছা, আর বিজ্ঞ পরিজনেরা বলে আদিখ্যেতা।

এত বড় আদিখ্যেতার পরও কিন্তু ভয়ানক রকমের অদ্ভুত কিছু ঘটল না। হ্যাঁ, সেই এক আশ্চর্য রহস্য! হয়তো বা-এই গলিটা নিতান্তই গলি। আর গলির বাসিন্দারা নেহাতই মধ্যবিত্ত বলে তাদের জীবনের সব লীলাগুলোই ওই মধ্যপথে থেকে যায়, চরমে পৌঁছতে পারে না।

না, চরমও জানে না। এরা, পরমও বোঝে না, তাই সেই চিরাচরিত কড়া মন্তব্য, বিস্ময়াহত মন্তব্য, আর তীব্র তিরস্কার, ব্যস তার বেশি কিছু নয়।

যেন বড় একটা আয়োজন করে ফেঁসে যাওয়া!

আর সুবৰ্ণ?

সে তো বেহায়া।

তাই সে জ্ঞান হয়েই বলে, তুলে আনতে মাথার দিব্যি দিল কে? লোকলজ্জা? তা সে লজ্জা তো ঘুচেই গিয়েছিল।… পাড়াসুদ্ধ সকলেই তো জেনে ফেলেছিল, এ বাড়ির মেজবৌ কুলের বার হয়ে গিয়েছিল—

 ১.১৫ সুবৰ্ণর লজ্জা নেই

সুবৰ্ণর লজ্জা নেই, কিন্তু সুবর্ণর বিধাতার বোধ করি কিছু পরিমাণ লজ্জা অবশিষ্ট ছিল, তাই হঠাৎ একটা নতুন ঢেউ আনিয়ে কটা দিনের জন্যে অন্তত ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন সুবৰ্ণরুক্ষণাৎ আবার ভাতের হাঁড়ির ধারে পাঠিয়ে দিলেন না তাকে।

হঠাৎই।

হঠাৎই প্ৰকাশচন্দ্র দেশের মহামারীর খবর নিয়ে এসে আছড়ে পড়ল।

প্লেগ।

আবার প্লেগ! যে প্লেগ ক-বছর যেন আগে শশান করতে বসেছিল দেশটাকে!

কলেরা, বসন্ত তবু ভালো। কিন্তু প্লেগ?

ওরে বাবা, সাক্ষাৎ যম!

পালাও পালাও।

যে যেখানে পারো পালাও! দক্ষিণের লোক উত্তরে এসো, পুবের লোক পশ্চিমে। চললো সেই

কলকাতার বাইরে যেখানে যত লোক আছে, তাদের বাড়ি ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। আগত আগন্তুকে। যাবেই তো।

প্লেগ থেকে রক্ষা পেতে যে সব অসহায় আত্মীয় ছুটে এসে পড়েছে, তাদের তাড়িয়ে দেবে কী করে তারা?

সব বৌরাই বাপের বাড়ি কি মাসীর বাড়ি, নিদেনপক্ষে পিসির বাড়িও ছুটেছে।… শুধু সুবৰ্ণলতার ব্যাপার আলাদা।

সুবৰ্ণলতার বাপের বাড়ি নেই। বাপের গুষ্টির কেউ নেই ঠাঁই দেবার।

তবে?

সুবৰ্ণলতা কোথায় গিয়ে রক্ষা পাবে?

সুবৰ্ণলতার শাশুড়ী পর্যন্ত নবদ্বীপে গুরুপাটে গিয়ে উঠেছেন। চাপা তার সঙ্গে যাবে কিন্তু সুবৰ্ণলতা আর তার ন্যানজারি। কটা?

সুবৰ্ণলতা বলল, আমি মরব না, এ প্রমাণ তো হয়ে গেছে, প্লেগ আবার কী করবে। আমার?

কিন্তু সেটা তো কাজের কথা নয়।

পুরুষেরা যে কোনো মুহূর্তে পালাতে পারে, শহরের অবস্থা আরো ভয়াবহ হয়ে উঠলে পালাবেও। অফিস-কাছারিও তো খোলা থাকবে না। আর বেশিদিন, তালা পড়ল বলে। স্কুলগুলো তো বন্ধ হয়েই যাচ্ছে। ইঁদুর দেখলেই মারার বদলে, দেখামাত্রই মরে যাচ্ছে লোকে।

তা সেই অবস্থায় তুমি লক্ষ্মীছাড়া মেয়েমানুষ কোলে কাঁধে পাঁচটা আর জঠরের অভ্যন্তরে একটা আপোগণ্ড নিয়ে পুরুষদের পায়ে বেড়ি হয়ে বসে থাকবে? তুমি তো বলছি তোমার ছেলেদের অন্য কারো সঙ্গে পাঠিয়ে দাও! কে নেবে ভার?

বলে নিজের ভারেই অস্থির লোকে!

ওদের নিয়েই মরতে চাও?

বটে! ওরা তোমার খাস তালুকের প্রজা! তাই মারতে ইচ্ছে হলে মারবো! ওদের বাঁচাবার দুইড্রোমায় চলে যেতে হবে কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে যেখানে এই রাক্ষসী মহামারীর থাবা C

কিন্তু কোথায় সেই জায়গা?

সহসা সুবর্ণর ভাসুর সুবোধচন্দ্ৰ বাতলে দিল সেই জায়গা।

চাঁপতা!

সুবালার বাড়ি।

সম্প্রতি দেখে এসেছে সুবোধ, দেখেছে দৈন্যের মধ্যেও সুখের সংসার সুবালার। গোয়ালে গরু, পুকুরে মাছ, বাগানে তরকারি, ক্ষেতে ধান।

তবে দৈন্যটা কোথায়?

দৈন্যটা নগদ টাকায়। তবু মনে দৈন্য নেই সুবালার আর তার বরের। এই তো মা-ভাই সাতজন্মে। খোঁজ নেয় না, একবার অসুখ শুনে ভাই একটু দেখতে গিয়েছিল বলে যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে।

কী যত্ন! কী আদর!

সুবৰ্ণকে অনাদর পেতে হবে না।

যে মানিনী উনি, যেখানে সেখানে থাকতে পারবেন না তো।

তাই তো প্রকাশের বৌয়ের সঙ্গে তার শ্বশুরবাড়িতে যাবার কথা হয়েছিল একবার, সুবর্ণ হলো রাজী?

এই বেশ।

এই ঠিক জায়গা।

সুবোধচন্দ্র নিজেই হঠাৎ হাল ধরলো।

রান্নাঘরের দরজার কাছে এসে নেপথ্যের উদ্দেশ্যে বলল, মেজবৌমা, আমার ইচ্ছে নয়। তুমি এই মড়কের সময় এখানে থাকো, সুবালার কাছে গিয়ে থাক দু-দশদিন।

একটা ছেলে ঘর থকে বলে ওঠে, জেঠাবাবু, মা বলছে, সবাই চলে গেলে আপনাদের রোধে দেবে কে?

সুবোধ হেসে উঠে বলে, ও হরি, এই কথা! সে যা হয় হবে। বামুনদের ছেলে দুটো ফুটিয়ে নিয়ে খেতে পারা যাবে না? তাছাড়া আমরাই বা আর কদিন? এ শহরে যা অবস্থা হয়ে উঠছে ক্ৰমশ…যাক, ওই কথাই থাকল।

ছেলেটা বলল, আচ্ছা জেঠাবাবু, তুমি যা বলছি তাই হবে।

তাই হবে!

সুবৰ্ণ বলছে তাই হবে!

অবাক কথা বৈকি!

তবু রীতিমত স্বস্তির কথা।

সবাইকে স্বস্তি দিয়ে সুবর্ণ তার প্রায় অপরিচিত ননদের বাড়ি যাত্রা করে মড়কের হাত থেকে বাঁচতে।

মরার জন্যেই যার আজীবন আকিঞ্চন।

 

কেউ বোধ হয় ছুটে গিয়ে খবর দিয়ে এসেছে, সুবালা ভিজে শাড়ি সপসপিয়ে জলভর্তি ঘড়াটা কাখে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এক মিনিটে এসে হাজির।

দুম করে ঘাড়াটা দাওয়ায় বসিয়ে সেই ভিজে কাপড়েই একটা পেন্নাম ঠুকে উল্লসিত স্বরে বলে ওঠে, মেজদা গো, তোমাদের কলকেতায় পেলেগ। এসেছিল, তাই না। এই কাঠকুড়ুনীর কুঁড়োয় মহারাণীর পদধূলি পড়লো!

সুবৰ্ণ তার বয়সে বড় মান্যে ছোট ননদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল। দেখল ব্যঙ্গ নয়, কৌতুক। হুল নয়, মধু।

মনটা জুড়িয়ে গেল।

চোখ জুড়োচ্ছিল রেলগাড়িতে উঠে পর্যন্ত। এই গ্রামে নেমে পর্যন্ত। গরুর গাড়িতে আসতে হয়েছে খানিকটা, সেও তো পরম লাভ। সুবৰ্ণ তো যতক্ষণ তাদের গলি ছেড়েছে, ততক্ষণ ওই কথাই ভেবেছে।

ভাগ্যিস কলকাতায় প্লেগ এসেছিল!

কে বলতে পারে, সেই ভয়ঙ্কররূপী সুখদাতা না এলে সুবর্ণর জীবনে কখনো আর রেলগাড়ি চড়া হতো। কিনা।

হয়তো হতো না।

অতএব গ্রাম দেখাও হতো না। আর কখনো।

কিন্তু সুবর্ণ কি কখনো গ্রাম দেখে নি?

দেখেছে বৈকি।

সেই তার পিতৃভূমি বারুইপুর গ্রাম।

সেও এমনি ছায়া-সুশ্যামল নিভৃতে শীতল বাংলার পল্লীগ্রাম। কিন্তু সুবর্ণর স্মৃতিতে সে ছায়া কেবল অন্ধকার। সে শ্যামলিমায় দাবদাহ। হায়, সুবর্ণ যদি সেবার গ্রীষ্মের ছুটিতে বাবার সঙ্গে ঠাকুমার কাছে যাব বলে না নাচতো!

সুবৰ্ণর দেখা গ্রামের স্মৃতিতে সুবর্ণর জীবনের অভিশাপ জড়িত, তবু এই মাঠ পুকুর ফল বাগান, ছোট ছোট ঝোঁপঝাড়, সব কিছু তার সবুজের সমারোহ। আর শীতলতার স্পর্শ নিয়ে সুবৰ্ণকে যেন মায়ের মেহের স্বাদ যোগাচ্ছিল।

খাস কলকাতার বৌ না হয়ে সুবর্ণ যদি এরকম এক গ্রামের বৌ হতো!

গরুর গাড়িতে আসতে আসতে বলেও ফেলেছিল সুবৰ্ণ সে কথা।

আমার যদি এরকম একটা পাড়াগায়ে শ্বশুরবাড়ি হতো!

প্ৰবোধচন্দ্র অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে মোহভঙ্গ করিয়ে দিতে বিদ্রপহাস্যে বলেছিল, বল কি! তোমার মতন আলোকপ্ৰাপ্তার এই পচা পাড়াগা পোষাতো? এখানের মেয়েরা স্বপ্নেও কখনো দেখেছে বৌমানুষ বসে খবরের কাগজ পড়ে? বৌমানুষ রাতদিন মুখে মুখে তর্ক করে? বৌমানুষ দেশের কথা ভেবে মাথা গরম করে?

সুবৰ্ণ দৃপ্তকণ্ঠ বলেছিল, দেখে নি, দেখতো।

হুঁ! তা হলে আর ভাবনা ছিল না। সে বৌকে টেকিতে ফেলে কুটতো। শহরের দোতলায় পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে থাকবার সুখ জুটলে সবাই অমন পাড়াগার শোভা দেখতে পায়। ক্ষারে কাপড় কাচতে কাচতে আর টেকিতে পাড় দিতে দিতে জান নিকলে যেত!

সুবৰ্ণ মৃদু তীক্ষ্ণ হাসির সঙ্গে বলেছিল, তেমন নিকলোলে একটা সুবিধে তো রয়েছেই। দীঘিপুকুর! ঝাঁপ দিলেই নিশ্চিন্দি!

প্ৰবোধচন্দ্ৰ সহসা স্ত্রীর একটা হাত চেপে ধরে বলে উঠেছিল, তোমায় এখানে আনা দেখছি ঠিক হয় নি। সর্বনেশে মেয়েমানুষ তুমি, তোমায় বিশ্বাস নেই!

ছোট ছেলেমেয়েরা সকৌতুকে দেখছিল, বাবা মার হাত ধরেছে। দশ এগারো বছরের ভানু কানু দুই ভাই যেন লজ্জিতও। সুবৰ্ণ সেটা অনুভব করে আস্তে হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু প্ৰবোধ ছাড়ে না। ভয়ানক আতঙ্কিত গলায় বলে, তুমি এই আমায় গা ছয়ে দিব্যি কর, ওসব দুর্মতি করবে না!

সুবৰ্ণ মৃদু হেসে বলে, দুর্মতি যদি করি, এই পৃথিবীর সঙ্গে তো সব সম্পর্কই চুকে যাবে, গা ছুঁয়ে দিব্যির আর কি মূল্য থাকবে?

প্ৰবোধ আহত হয়ে হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলে, ওঃ! তাই বটে। তুমি তো আবার সম্পর্কটা যে জন-জন্মান্তরের সে কথা মানোই না!

তুমি মানো? সকৌতুকে প্রশ্ন করে সুবৰ্ণ।

প্ৰবোধ সতেজে বলে, হিঁদুর ছেলে হয়ে জনেছি, মানবো না! সবই মানি।

আচ্ছা তা হলে তো এ কথাও মানো, অপঘাতে মলে ভূতপেত্নী হয়?

আলবৎ মানি। না হলে আর শাস্ত্ৰে বলত না অপঘাতে অনন্ত নরক!

তবেই তো। সুবৰ্ণ হেসে ওঠে, আমি ধর অপঘাতে মরে অনন্ত নরকে পচছি, তুমি মহত্তর বলে স্বর্গে গিয়ে ইন্দ্ৰত্ব করছ, তখন? তখন ওই জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্কটার গতি?

কুতার্কিক মেয়েমানুষের সঙ্গে কেউ কথায় পারবে না!

বলে রাগ করে মুখ হাঁড়ি করে বসেছিল প্ৰবোধ। কিন্তু সুবর্ণ তা নিয়ে বিচলিত হয় নি। সুবর্ণ দেখছিল গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট মাটির কুড়ে, তার সামনের উঠানে তুলসীমঞ্চ, পিছনে গোয়াল। উঠানগুলি মাটিল্যাপা, গোয়ালগুলি খড়ের চালের, ছবির মতই সুন্দর।

এই সৌন্দর্যকে লালন করছে তো গ্রাম তার হৃদয়ারস দিয়ে।

চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল।

তবু মনের মধ্যে ছিল একটা তীক্ষ্ণ প্রশ্ন। যেখানে যাদের কাছে যাচ্ছে, তারা নিকট-আত্মীয় হলেও দূরত্বের ব্যবধান অনেকখানি। সুবৰ্ণরা তো সাতজন্মেও ওদের নাম মুখে আনে না। সুখের সময় তাদের বিস্মৃত হয়ে থেকে অসুবিধের সময় গলায় এসে পড়া, এর চাইতে নির্লজ্জতা আর কী আছে?

মেজননদ যদি সেই নির্লজ্জতার দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেখায়! যদি বলে, কিগো, এখন বুঝি দায়ে পড়ে রায়মশাই? দরকারে পড়ে বোন? বলা তো অসম্ভব নয়!

যে কেউই এ অবস্থায় বলতে পারে এ কথা।

তার উপর আবার সুবালা মুক্তকেশীর মেয়ে।

কিন্তু মুক্তকেশীর মেয়ে মুক্তকেশীর মত মুখে মুখে উপর্যুক্ত জবাব দেবার জন্যে তৎপর হলো না। সে উল্লাসে পুলকে বলে উঠল, ভাগ্যিস পেলেগ। এসেছিল, তাই মহারাণীর পদধূলি পড়লো!

কান জুড়িয়ে গেল সুবর্ণর, জুড়িয়ে গেল প্ৰাণ।

সুবৰ্ণর আবির্ভাবে কেউ পুলকিত হচ্ছে, এ অনুভূতিটা নতুন।

সুবৰ্ণ এর স্বাদ জানে না।

সুবৰ্ণ জানে, সুবর্ণর আবির্ভাবও নেই, তিরোভাবও নেই। সে যেখানে বিরাজিত, সেটা তার নিত্যধাম। জানে তার সেই নিত্যধামের চারিপাশের বায়ূমণ্ডল সমালোচনার প্রখর তাপে তপ্ত থাকবে, আর তার মাথার উপরের আকাশ আর পায়ের নিচের মাটি সর্বদা স্মরণ করিয়ে দেবে, তোমাকে আচ্ছাদন দিয়েছি। এই ঢের, তোমাকে দাঁড়াতে দিয়েছি। এই যথেষ্ট!

সুবৰ্ণ তুমি এলে? কী আনন্দ কী সুখ!

এ ভাষা সুবর্ণর জন্য নয়।

অথচ জগতের দীনীতিতম দীনের জন্যও আছে। এ ভাষা। ভিখারিণী মাও প্রার্থনা করে, নবমী নিশি গো, তুমি আর পোহায়ো না-

সুবৰ্ণর জন্যে এ প্রার্থনা নেই।

সুবৰ্ণ কি মূল্যহীন?

সুবৰ্ণ মূল্যবান হবার সৌভাগ্য থেকে চিরবঞ্চিত?

সুবৰ্ণর মূল্য ধার্য হয়েছে শুধু একটা অভ্যাস-মলিন শয্যায়। সেখানে সুবর্ণর জন্যে আগ্রহের আহবান অপেক্ষা করে।

কিন্তু সে আগ্রহ কি প্রেমের?

সে আহবান কি পুরুষের?

তা নয়।

সে শুধু অভ্যাসের নেশা।

তাই সে আহবান সুবর্ণর চেতনাকে বিদ্রোহী করে, স্নায়ূদের পীড়িত করে, আত্মাকে জীৰ্ণ করে।

তাই সুবর্ণর মূল্য কি জানে না সুবর্ণ।

তাই এক যৌবন-থাকতে-প্রৌঢ়া, খেটে খেটে শীর্ণ, শ্ৰীহীন মেয়ের এই খুশিটুকু সুবর্ণর প্রাণ জুড়িয়ে দেয়।

প্ৰবোধ বলে, তা পড়লো পায়ের ধুলো! কিন্তু এই পঞ্চাশ ক্রোশ দূরে থেকে চিনে তো ফেলেছিস ভাজটিকে? মহারাণীই বটে। এখন মহারাণীর মেজাজ বুঝে চলতে নাজেহাল হ!

আহা, এখনই নয় যাওয়া-আসা নেই তেমন, তা বলে কি দেখি নি। আমি ওকে! সুবালা পায়ের দিকের শাড়ীটা নিংড়ে নিংড়ে জলটা ফেলতে ফেলতে বলে, আমার মা জননীর হাতে পড়লে শিবও বাদর হয়ে ওঠে। গুরুজন নিন্দে করছি না, তবে বুঝি তো।

সুবৰ্ণ অবাক হয়ে তাকায়।

ওই হাতে-পায়ে শির ওঠা, শীর্ণ মুখ, পাতলা চুল, প্রায় বাসনামাজা ঝিয়ের মত চেহারার মানুষটার মধ্যে এমন স্বচ্ছ পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিশক্তি! সুবৰ্ণকে বুঝতে পারে ও!

প্ৰবোধ অবশ্য অবাক হয় না। হেসে বলে ওঠে, শালুক চিনেছেন গোপাল ঠাকুর। তা যাক, বোনাইকে দেখছি না যে?

দেখবে কোথা থেকে? এখন যে মর্নিং ইস্কুল! ছেলে ঠেঙাতে গেছে সেই প্ৰাতঃকালে উঠে। বাড়িও তাই ঠাণ্ডা দেখছ, সবগুলো তো সেই গোয়ালে—

সুবৰ্ণ ফস করে বলে বসে, মেয়েরা?

মেয়েরা? সুবালা উঠোনের দড়ি থেকে গামছাখানা টেনে নিয়ে চুলগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে হেসে ওঠে, বড়টা তো শ্বশুরবাড়ি, ছোট তিনটে ওই গোয়ালেই।

ইস্কুলে?

হুঁ। আমার দ্যাওর যে গায়ের লোকের পায়ে ধরে ধরে গাঁয়ে একটা মেয়ে-পাঠশালা বসিয়েছে গো! তা নিজেদের ঘরের মেয়েদের তো আগে পাঠাতে হবে! নচেৎ ফাঁসি!

তোমার দ্যাওর? আহ্লাদে উজ্জ্বল দেখায় সুবর্ণর মুখ, খুব ভাল, তাই না?

ভাল বল ভাল, বাউড়ুলে বল বাউড়ুলে, তবে— সুবালা গলা একটু নামিয়ে বলে, ইদানীং স্বদেশী বাতিকে বড়ভাইকে একটু ভাবনায় ফেলেছে—

ভিজে কাপড় ছাড়তে ঘরের মধ্যে ঢুকে যায় সুবালা। চেঁচিয়ে বলে, হাতমুখ ধুতে যেন ঘাটে যেওনা বাপু, আমি দিচ্ছি জল।

প্ৰবোধ চিন্তিতভাবে বলে, এই হল এক ঝামেলা। ভগ্নীপতির ভাই যদি আবার স্বদেশী-ফিদেশী হয় তাহলেই তো—

কী তা হলে? তোমার ফাঁসি হবে?

আমার কথা হচ্ছে না। তোমাদের রেখে যাব-পুলিসকে তো জানো না, পচা গণ্ডগ্রামের বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে, পুকুরের পাকের নিচে থেকে আসামীকে টেনে বার করে—

কলকাতার রাজরাস্তা থেকেও করছে।

করছে! আমরা তো আর কেউ ওই সব গোয়াতুর্মির মধ্যে মেতে যাই না! বলে গোলমালের টু শব্দটি উঠলে সে পথের দিক দিয়ে হাঁটি না।

সাবধানী প্ৰবোধ আপনি সাবধানতার মহিমায় স্ফীত হয়।

সুবৰ্ণ এখন আর তর্ক করতে বসে না, সুবৰ্ণর মনের মধ্যে স্পন্দিত হতে থাকে, একটা স্বদেশীবাতিক ছেলেকে দেখতে পাবে সে! কত বড় সেই দ্যাওর? বিয়ে হয়েছে? ঘর-সংসারী? মনে হয় না, সুবালা বলেছে বাউণ্ডুলে।

 

এরপরই সুবালা আতিথ্যের ধুম লাগায়। মাজা ঝকঝকে গাড়ুতে জল এনে দেয় হাত-মুখ ধুতে, বড় বড় ফুল কাঁসার রেকাবিতে করে ঢেলে দেয় মুড়ি, নারকেল কোরা, নাড়ু।

ভাইপো-ভাইঝিদের সযত্নে কাছে টেনে টেনে খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করে। আর তারপরই বলে ওঠে, ওই যে আমার দ্যাওর আসছে।…এই খবরদার, কেউ পেন্নাম করতে যাবি না! পেন্নাম করা দেখতে পারে না। দুচক্ষে।

পেন্নাম করা দেখতে পারে না। দুচক্ষে। এও এক অভিনব ভাষা! যা সুবর্ণর কানকে আর একবার শীতল করে। হয়তো বা মুখটাকেও দীপ্ত করে।

কিন্তু প্ৰবোধের কাছে এই আগ্রহন্দীপ্ত মুখমণ্ডল অবশ্যই প্রীতিকর হয় না। হবার কথাও নয়। প্ৰবোধের মনে হয়-ছেলেদের কাটাকে তাদের পিসির কাছে রেখে সুবৰ্ণকে নিয়ে চলে যায়। কে জানতো যে সুবালার সংসারে আবার এরকম একটা সাংঘাতিক জীব আছে!

স্ত্রীকে এরকম একটা বাউণ্ডুলে পরপুরুষের কাছাকাছি রেখে চলে যাওয়ার থেকে তাকে যমের মুখে তুলে দেওয়াও ভাল।

একেই তো নিজের মনের কাছে নিজের দিকের বাটখারা তার হালকা, সুবর্ণর মন যে তার নাগালের অনেক উঁচু তে তা আর জানতে বাকী নেই প্ৰবোধের। কোনোমতে আগলে আগলে রেখে বয়েসকালটা পার করে দেওয়া এই পর্যন্ত!… কিন্তু সেই কালটার ঠিক নির্দিষ্ট সীমারেখাটা কি? বারো বছরের মেয়ে সুবর্ণর, আরও পাঁচটা ছেলে-মেয়ে তার নিচে, তবু তো দেখলে মনে হয় না। বয়েসকালটা চলে যাচ্ছে তার!

সেকালের নবাবরা যে বেগমদের হারেমে পুরে রাখতো, সেটাই ঠিক ছিল। হায়, কোথা থেকে এই প্লেগের হুড়ো এল! আশ্চর্য, প্ৰবোধের এমন বুদ্ধি হলো না যে রেখে যাবার আগে একবার দেখে যায়, জায়গাটা কেমন?

সুবালার সংসারই আছে শুধু, আর বুড়ী শাশুড়ী আছে, এইটাই তো জানা, ওই দ্যাওরটার কথা তো জানা ছিল না।

কক্ষনো যেন না। ওর সামনে বেরোয় সুবর্ণ।

প্ৰবোধ অতএব ভ্ৰভঙ্গী করে স্ত্রীকে ভিতরে যেতে নির্দেশ দেয়, কিন্তু বিফল হয়। সেই ইশারা। সুবৰ্ণও ভ্ৰাভঙ্গীতে জানায়, কেন, হয়েছে কি?

ইত্যবসরে সেই ভয়ঙ্কর জীবটি উঠোনের বেড়ার দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে নতুন একটি সংসার দেখে ঈষৎ থমকে দাঁড়ায়।

কিন্তু মুহূর্তই।

সুবালা সহৰ্ষে বলে ওঠে, আমার মেজদা আর মেজবৌ গো! আর এরা ভাইপো-ভাইঝি! এর নাম ভানু, এর নাম কানু, এ চান্নন, এ পারুল, এ খোকা। ডাকনামই জানি বাপু, পোশাকী নাম জানি না। কই চাঁপাকে তো দেখছি না মেজবৌ? হারেকেষ্ট, এতক্ষণ খেয়ালেই আসে নি! সে?

প্ৰবোধ কিছু বলার আগেই ফন্ট করে সুবর্ণ ওই ছোঁড়ার সামনে বলে বসে, সে তার ঠাকুমার সঙ্গে গেছে।

শুনে মাত্র সর্বাঙ্গ জ্বলে যায় প্ৰবোধের।

কেন?

তোমার তাড়াতাড়ি কণ্ঠসুধা বিতরণ করা কেন? কী দরকার ছিল? ছোঁড়া কি খোকা নাকি? শুটকো হাড়গিাল্লের মত দেখতে, তাই মনে হচ্ছে কম বয়স। সুবর্ণর থেকে ছোট হবে না। কক্ষনো। আর ছোট হলেই বা বিশ্বাস কি? দেখতে খারাপ? তাতেই বা কি? অবিশ্বাসিনী মেয়েমানুষের কাছে ওসব বাধা বাধাই নয়।

হায় হায়, কী কাজই করে বসলো প্ৰবোধ!

আবার কিনা আজই চলে যেতে হবে তাকে! জাহাজঘাটার অবস্থা টলমল, কুলি-কামিন সব পিটটান দিচ্ছে-প্লেগের ভয় যত না হোক, জোর করে টিকে দেওয়া হবে এই ভয়ে।

দু-চারদিন থাকতে পারলে লক্ষ্য করা যেত, আর তেমন বেচাল দেখলে টেনে নিয়ে যাওয়াও যেত। এ যে কিছুই হচ্ছে না।

হচ্ছে না।

অথচ ওদিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

হতভাগা ছোঁড়া ফাট করে খোকাকে কোলে তুলে নিয়ে বলে, বাঃ, গ্র্যান্ড দেখতে তো! সকলকেই দেখছি খাসা! মেজবৌদির যত্নের গুণ আছে। হেলদি ছেলের বড় অভাব আমাদের দেশে।

নমস্কার মেজদা, কিছু মনে করবেন না, আমি একটু বেশি কথা বলি। এই যে এই বৌদিটি, আমার নামকরণ করেছেন বাক্যবাগীশ! ওঁকে রাতদিন গঞ্জনা দিই। আমি, ছেলেমেয়েগুলোর হাড়সার চেহারার জন্যে—

হঠাৎ আরো ভয়ানক আরো অসমসাহসিক এক কাণ্ড করে বসে সুবর্ণ।

শুধুই কি অসমসাহসিক?

কুশ্ৰীতা নয়? অসভ্যতা নয়? শাস্ত্রসমাজের বিরোধী নয়? কেন? কেন এই বদমাইশি?

ফট করে বলে বসলো। কিনা, আর আপনার নিজের কী?

আচ্ছা সুবালা তো গায়ের বৌ, সুবালাই বা ভাজকে এই নির্লজ্জতার জন্যে কিছু বলল না কেন? তার মানে বুদ্ধি-সুদ্ধির বালাই নেই। বালাই থাকলে কখনো এর পরও হাসে? হেসে উঠে বলে, ওর কথা বাদ দাও। ও যে দেশোদ্ধার করছে! ওর কি নাইবার-খাবার অবকাশ আছে? অযত্নে অযত্নে অমন পোড়াকাঠের মত দশা—

বৌদি, আমি আপত্তি করছি—, ইয়ারটা বলে ওঠে, একজন ভদ্রমহিলার সামনে কিনা পোড়াকাঁঠ বিশেষণ দেওয়া! মেজদা, দেখুন। আপনার বোনের কাণ্ড!

মেজদা তাঁর বোনের কোণ্ডর দিকে না তাকিয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠেন, এই চন্নন, হচ্ছে কি? এত মুড়ি ছড়াচ্ছিস যে?

বাকি সবাই চমকে ওঠে, থমকে যায়।

তবু চলে যেতে হয়।

প্ৰাণপাখীকে পিঞ্জর ছাড়া করে বনে-জঙ্গলে উড়িয়ে দিয়ে।

উপায় কি?

সত্যি তো পাগল নয় যে বলবে, নিয়ে চলে যাই ওকে!

তবে একটা খবরে একটু ভরসা এসেছে, ছোঁড়া অমূল্যর নিজের ভাই নয়, জ্ঞাতিভাই। অন্য বাড়িতে থাকে। আবার বেশি ভরসাও নেই, —শূন্য একটা বাড়িতে থাকে বলে এ বাড়িতে খায়। সুবালাই ধরে-করে এই ব্যবস্থা করেছে, ওর একমাত্র দেখবার লোক পিসি মরে পর্যন্ত।

বাউণ্ডলে যাকে বলে!

কেউ কোথাও নেই, শূন্য একখানা বাড়িতে একা থাকা!

প্ৰবোধ বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করেছিল, তা বিয়ে করেন নি কেন দয়াময়?

সুবালা দাদার রাগে হেসেই খুন।

হিরোকেষ্ট। ও বিয়ে করবে তো দেশ স্বাধীন করবে। কে?

ফাজলামি। বলি আজ না হয় তুই ওর ভাত রাধছিস। চিরকাল পরের ঘাড় দিয়ে চলবে?

সুবালা আহত হয়।

সুবালা গম্ভীর হয়।

বলে, পর বললে পর, আপনি বললে আপনি, তবে কদিন ভাত রাঁধতে পাবো। ওর, তাই বা কে জানে! কোন দিন যে জেলের ভাত খেতে হয়, এই ভয়ে কাটা হয়ে আছি।

প্ৰবোধের নিজের বোনকেও আদিখ্যেতার জাহাজ মনে হয়। জ্ঞাতি দ্যাওরকে নিয়ে এত আদিখ্যেতা! আরও বিরক্তস্বরে বলে, আর সেই লোককে বাড়িতে আসতে দিচ্ছিস?

সুবালা অবাক হয়।

আসতে দেব না? কাকে? অম্বিকা ঠাকুরপোকে; কী যে বল মেজদা!

তা তোর না হয় আদর কর্তব্য উথলে উঠল, বলি অমূল্যর হাতে দড়ি পড়লে?

সুবালা বিচলিত হয় না।

সুবালা বলে, নিয়তি ছাড়া পথ নেই মেজদা, সে নিয়তি থাকলে–

আগুনে হাত ড়ুবিয়ে যদি বলি, নিয়তি থাকলে পুড়বে, তবে আর বলবার কিছু নেই— প্ৰবোধ প্ৰায় খিঁচিয়ে ওঠে, তবে কাজটা ভাল হচ্ছে না। এ বাড়িতে ওর যাতায়াত কমাও! খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা অন্যত্র করতে বলতে হবে—

সুবালা হেসে ওঠে।

সুবালা ওর পূজনীয় মেজদার কথা অমৃতং বালভাষিতং হিসেবে গণ্য করে। তাই সুবালা আর তর্ক না করে বলে, পাগল হয়েছ? ওকে খাওয়াতে হয় ধরেবেধে, তিনবেলা না খেলেও ওর খেয়াল থাকে না।

তবে আর কি? কৃতাৰ্থ—, প্ৰবোধ বলে, তোমরা নিজের কপালেও তেঁতুল গুলিছো, ছেলেপুলেদেরও ক্ষতি করছে।… ওইরকম একটা ব্যাড় এগজাম্পল চোখের সামনে—

সুবৰ্ণ এতক্ষণ ভাইবোনের ওই তর্ক-বিতর্ক, স্নেহ-আলাপের মাঝখানে কথা বলে নি। এইবার বলে উঠল, বলল, চোখের সামনে এটা কুদৃষ্টান্ত নয়, বরং মহৎ আদর্শ! মেজঠাকুরঝির ছেলেদের ভাগ্য ভাল যে এমন একটা আদর্শ চোখের সামনে পাচ্ছে।

চমৎকার! যখন পুলিস এসে ঠেঙাতে ঠেঙাতে ধরে নিয়ে যাবে, তখন মহৎ আদৰ্শর লীলা বুঝবে। এমন জানলে আনতাম না তোমাদের!

সুবৰ্ণ তীব্ৰকণ্ঠে বলে, তোমাদের সহোদর বোন যেখানে রয়েছে, সেখানে তোমার বৌ-ছেলে থাকতে পারবে না?

থাকতে পারবে না কেন? বিপদের আশঙ্কা, সেই কথাই হচ্ছে।

সে আশঙ্কা তোমার বোন-ভগ্নীপতিরও আছে–

চুলোয় যাক ওরা—, প্ৰবোধ বলে ওঠে, মাথার মধ্যে আগুন জ্বলছে আমার!

 

তা সেই মাথার মধ্যে জ্বলন্ত আগুন নিয়েই বিদায় নিতে হলো প্ৰবোধকে। উপায় কি? আর সমস্ত রাগটাই শেষ পর্যন্ত সুবর্ণর ওপর পড়ল। সুবৰ্ণই বা আসতে রাজী হল কেন?

এদিকে তো এত জেদ, পাহাড় নড়ে তো জেদ নড়ে না, অথচ ভাসুর একবার অনুরোধ করলেন তো গলে গেলেন! চিরকাল দেখছি, এই আমি হতভাগ্য কেউ নয়, ভাসুরের কথা শিরোধার্য! বদ মেয়েমানুষদের স্বধৰ্মই এই। কেদারবাবুকে নিয়ে কত আদিখ্যেতা। সে বুড়ো আর আসে না। তাই বাঁচা গেছে।

গুরুজন বলে যদি ছেদ্দা করতো তো মাকে আগে করতো। তার বেলায় নয়। তার বেলায় রাতদিন শাশুড়ীর মুখে মুখে চোপা! আসল কথা বেটা ছেলে! সেটা হলেই হলো! যা বুঝছি, সুবালাটা মুখ্যুর ধাড়ি, ওই ঘোড়েল অম্বিকাটা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে খাচ্ছে—দাচ্ছে। অতএব সুবালার ওপর ভরসা নেই। ওর চোখের সামনেই অনেক কিছু ঘটে যাবে, টেরও পাবে না।

সুবালার শাশুড়ীটি যে কোথায় থাকেন দেখতেও পাওয়া গেল না। তবু একটা বুড়ো মানুষ ছিল

নাঃ, ওসব বুড়ো-ফুড়োর কর্ম নয়, অমূল্যকেই বলে এলে হতো, তোমার শালাজের বাপু একটু পুরুষ-ঘেষা স্বভাব আছে, চোখে চোখে রেখো।

বলে এলে হতো।

বলা হয় নি।

এ কথা যত ভাবতে থাকে প্ৰবোধ, ততই তার মাথা ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে।

কী উপায়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসা যায় সুবৰ্ণকে?

ভগবান! প্লেগকে যদি আবার তোমার ভাণ্ডারে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে না পার তো তোমার এই ভক্তপ্ৰজা প্ৰবোধকে প্লেগ দাও! অত বড় একটা কারণ ঘটলে অবশ্যই আনা যাবে সুবৰ্ণকে!

১.১৬ পড়ন্ত বেলার রোদ সরতে সরতে

পড়ন্ত বেলার রোদ সরতে সরতে দাওয়া থেকে উঠোনে নেমেছে, ফুলেশ্বরীও তার সেলাইয়ের সুগ্নসহ সরতে সরতে দাওয়া থেকে উঠোনে নেমেছেন। এরপর ছাদে উঠবেন।

প্ৰদীপের আলোয় আর চোখ চলে না। আজকাল, তাই দিনের আলোর শেষ বিন্দুটির পিছনেও ছুটোছুটি।

ছেলে নিষেধ করে। বলে, মা, তুচ্ছ ওই কথা কাঁথা করে চোখের মাথাটা আর খেও না। জীবনভোর তো কাঁথায় ফুল তুললে, আর কেন?

অমূল্যর মা ফুলেশ্বরী ছেলের এই বকুনিতে হাসেন। বলেন, জীবনভোর তো ভাত খাচ্ছি, তবু আবার খাই কেন?

তার সঙ্গে এর তুলনা! না মা না, তুমি এবার ক্ষ্যামা দাও। নইলে শেষ অবধি অন্ধ হয়ে যাবে–

ফুলেশ্বরী সতেজে বলেন, অন্ধ অমনি হলেই হল? ভগবানের লীলা নিয়ে কাজ করছি—

সুবৰ্ণ শুনতে পায়।

সুবৰ্ণ অবাক হয়।

সুবৰ্ণ প্রশ্ন না করে পারে না।

প্রশ্ন করে, কিসের কাজ করছেন?

সুবালা হেসে ওঠে, জানো না? আর জানবেই বা কোথা থেকে? আমার শাশুড়ীর এই এক বাতিক! বারো মাস কাঁথা সেলাই করছেন। কে শোবে, কার দরকার, সেসব চিন্তা নেই। ওই সেলাই! আর তাই কি সোজাসুজি ফুল-লতা যে, হলো না হলো মিটিয়ে নিলাম? তা নয়, কাঁথায়। এখন মধুসূদার ননী মন্থন লীলাটি সেলাই করে করে তুলছেন!

সে কি?

তবে আর বাতিক বলছি কেন! ওই লীলার যাবতীয় খুঁটিনাটি সব বসে বসে সিলোচ্ছেন। যতক্ষণ আকাশের আলো থাকবে, ততক্ষণ তাকে কাজে লাগাবেন। আমি বলি তা একরকম ভালো। পাড়ার অন্য গিন্নীদের মতন পরকুচ্ছে না করে বসে বসে কথা সিলোন, তা ভাল।

সুবৰ্ণ প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে।

সুবালার ছেলেমেয়েরা তো বড় হয়ে গেছে, ও কাঁথায় শোবে কে?

শোবে কে?

ও বাবা, ও কি শোবার কথা? মা যশোদার মূর্তি আঁকা! ও শুধু গায়ে দেবার। গায়ে দেবে সুবালার ভবিষ্য-কালের নাতি! ফুলেশ্বরী তো আর থাকবেন না তখন, হাতের কাজটুকু রেখে যাবেন। লোকে সোনাদানা রেখে যায়, ওঁর তো সেসব নেই, তাই—

সুবৰ্ণ ভাবে, কী সুন্দর!

বাড়ির গিন্নী বাড়ির সকলের ওপর চোখ ফেলে ফেলে তাদের খুঁত বার করে করে গালমন্দ করে না বেড়িয়ে ছুঁচের ওপর চোখ ফেলে সুতোয় আঁকা ছবিটিকে নিখুঁত করছেন বসে বসে।

সুবালা কী সৌভাগ্যবতী!

সুবৰ্ণ নিঃশ্বাস ফেলে।

সুবৰ্ণ বলে, সোনাদানা থেকে ঢের দামী! আচ্ছা, ছুঁচে সুতো পরতে পারেন?

ও বাবা! আমার থেকে ভাল। পঞ্চাশটা ছুঁচে পঞ্চাশ রকম সুতো পরাচ্ছেন চব্বিশ ঘণ্টা। নেশা নেশা!

নেশা! নেশা মাত্রেই কি ক্ষতিকর?

অপর মানুষের গায়ে ছুঁচ বিঁধবার প্রবৃত্তির থেকে তো অনেক ভাল নেশা এই কাঁথায় ছুঁচের ফোঁড় তোলা!

কী অদ্ভুত নিষ্ঠা!

বিশ্বাস রাখেন দেবতার লীলা আঁকতে বসে চোখ নষ্ট হতে পারে না!

ওই কাঁথার ফুল থেকেই মুক্তি মানুষটার!

নামটিও তেমনি সুন্দর, ফুলেশ্বরী!

সুবালা তারি ভাগ্য সম্পর্কে কৃতজ্ঞ কিনা কে জানে!

কিন্তু সুবর্ণ যদি ওই ফুলেশ্বরীর বৌ হতো!

সুবালা আরো বলেছে, কারুর সাতে-পাচে নেই, জগৎ আছে কি নেই জ্ঞান নেই, ওই শিল্পকন্ম নিয়েই মশগুল।

তবু বলবে না। সুবর্ণ, সুবালা কী ভাগ্যবতী?

সুবৰ্ণ আস্তে আস্তে ফুলেশ্বরীর কাছের গোড়ায় গিয়ে বসে।

ফুলেশ্বরীর ছুঁচে সুতো পরাতে পরাতে বলেন, কে? কলকাতায় বৌমা? এসো বসো! ছেলেরা?

এদিক-ওদিক ঘুরছে।

আহা, শহুরে বেচারাদের কী কষ্ট!

কষ্ট কি মাউ-ই মা, সুখ বলুন। এমন খোলামেলা, আলো-বাতাস জীবনে দেখেছে ওরা?… আচ্ছা মাউ-ই মা, ছেঁড়া কাপড়ের কথা, তাতে এত খেটে কি হয়? এত ফুল কেটে কি হয়?

সুবৰ্ণর কি এ কথা নিজের কথা?

না, ওই বৃদ্ধার মর্মকথা আদায় করতে চায় সে?

তা মৰ্মকথাই বলেন ফুলেশ্বরী। হেসে ফেলে বলেন, ফুল কাটি কি আর ছেঁড়া কাঁথার গায়ে মা, ফুল কাটি মনের গায়ে। জীবনভোর তো শুধু ধান সেদ্ধ করছি, গোবর কুড়োচ্ছি, কাঠ কাটছি, জল তুলছি, ভাত রাঁধছি, ভাল কাজের তো কিছুই করলাম না, তবু একটা ভাল কাজ—

হঠাৎ গলা নামান ফুলেশ্বরী।

বলেন, তোমার কাছে ছেঁড়া পাড় আছে কলকাতায় বৌমা? রগরগে ঝকঝকে পাড়? যাতে সুতো ভাল ওঠে—

গলা নামালেও কথাটা সুবালার কানে ওঠে।

সুবালা বলে ওঠে, মার যেমন কথা! কদিনের জন্যে এসেছে মেজবৌ, ও বুঝি ছেঁড়া কাপড় নিয়ে এসেছে!

সহসা সুবর্ণ বলে ওঠে, এনেছি, এনেছি মাউ-ই মা, এক্ষুনি দিচ্ছি!

ফুলেশ্বরী বলে ওঠেন, রাজরাণী হও, হাতের নোয়া বজ্জর হোক।… কী পাড় আছে? লাল আছে?

লাল কালো দুই-ই আছে।

আহা, আমার সোনার মেয়ে! ওই দুটো রঙের জন্য কাজ আটকে পড়ে আছে। …তা হ্যাগা কলকাতার বৌমা, বিলিতি কাপড়ের পাড় নয় তো? তা হলে কিন্তু অম্বিক আস্ত রাখবে না। আমায়া!

সুবৰ্ণ একবার ফুলেশ্বরীর মুখের দিকে তাকায়। অবাক হয়। বলে, এই কাপড়, এই সব সুতো, সমস্ত দিশী জিনিস?

ফুলেশ্বরী মৃদু হাসেন।

বলেন, মিছে কথা বলব কেন, এ কাপড়ও বিলিতি, এর সুতোও অর্ধেক বিলিতি। আরম্ভ যখন করেছি, তখন দেশী বিলিতির ধুয়ো ওঠেই নি। দেখছি না, আগের সেলাই সব ঝকঝকে, এখনকার সব ম্যাড়মেড়ে! মন ওঠে না। কিন্তু কি করবো, ছেলেটা মনে কষ্ট পায়। বলে, ওইটুকু চকচকেটাই বড় হল তোমার? বলে, নেহাৎ নাকি মা যশোদা এঁকে বসে আছ তাই, নইলে পুড়িয়ে দিতাম! তা স্বদেশী পাড়ের সুতো থাকে যদি—

এই যে এক্ষুনি দিচ্ছি—, উঠে যায় সুবর্ণ।

সুবালা বলে, সাধে বলেছি বাতিক! যাকে পাবেন তাকেই বলবেন, ছেঁড়া কাপড়ের পাড় আছে? তুমি ছেঁড়া পাড় কোথায় পাবে বল তো?

পাবো পাবো, এই যে আছে গো!

সুবৰ্ণ তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে যায়, ট্রাঙ্ক খুলে আস্ত আস্ত দুখানা শাড়ি বার করে ফ্যাসফ্যাস করে তার পাড় ছিঁড়ে স্তুপাকার করতে থাকে। পাড়ের রং একটু ম্যাড়মেড়ে, সেটাই রক্ষে।

১.১৭ বড় গলায় আশ্বাস দিয়েছিল সুবোধ

বড় গলায় আশ্বাস দিয়েছিল সুবোধ তার ভাদ্রবৌকে, বামুনের ছেলে, দুটো ভাত সেদ্ধ করে নিতে পারবো না?

কিন্তু কাৰ্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ব্ৰাহ্মণ-সন্তানের গৌরব অক্ষুন্ন থাকছে না। জগতের সহজতম এবং ওচতম কাজ ওই ভাত সেদ্ধটাই চার চারটে জোয়ান পুরুষকে হিমসিম খাইয়ে ছাড়ছে।

হয় অতিসেদ্ধ হয়ে পিণ্ডি পাকিয়ে বসে থাকে, ফেন ঝরানোর অবস্থা থাকে না, নয়তো অতি সাবধানে প্ৰায় চালই থেকে যায়। অথবা হয়তো জলের অঙ্কে ঘাটতি ঘটে সহসা সুগন্ধে পাড়া আমোদিত করে তোলে। তা ছাড়া ফেন ঝরাতে আঙুলের ডগায় ছোটখাটো ফোস্কা চারজনেরই হয়েছে। কুর একজনের অপটুতায় ব্যঙ্গহাসি হেসে অপরজন হাত লাগাতে এসেছে কিনা!

আনুষঙ্গিক ব্যাপার উনুন ধরানোও সোজা কাজ নয়। হয়তো বা তুল্যমূল্য। উনুনের ভিতরদিকে যুঁটে পেতে পেতে আগুন জ্বেলে দিয়ে তার উপর কয়লা ঢেলে দিতে হয়, এ পদ্ধতিটা অবিদিত কারুরই নেই! গেরস্থের ছেলে, মা চিরকাল খেটেছে, ওরা আশেপাশে ঘুরেছে।

কিন্তু সেই জানা জগতের কাজটা যে হাতে-কলমে করতে গিয়ে এমন রহস্যময় হয়ে উঠবে এটা কে জানতো?

পদ্ধতিমত কাজ হয়, কিছুক্ষণের মত বাড়িটা ধূম্রলোকে পরিণত হয়, কিন্তু সেই ধূমজাল থেকে মুক্ত হয়েই দেখা যায় ধূমের পিছনে বহ্নি নেই। কেন যে এমনটা হয় সেটা দুর্বোধ্য! ওই একই পদ্ধতিতেই তো আবার জ্বলেও শেষ পর্যন্ত! বার তিন-চার ধোঁয়া খেয়ে খেয়ে শেষ অবধি আগুনের দেখা মেলে।

কাজ দুটো যে এমন গোলমেলে, তা তো কই মনে হতো না কোনোদিন? বরং চোখে একটু ধোঁয়া লাগলেই রাগারগি করা হয়েছে, এত ধোয়া কেন? রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে রাখা হচ্ছে না কেন?

মুখরা হরিদাসী বলতো, চুলোয় আগুন দিলে ধোঁয়া হবে না তো কি পুষ্পবৃষ্টি হবে দাদাবাবুরা? আপনারা বোঠকখানা ঘর থেকে তেরিমেরি করছে, অথচ বৌদিরা ওই ধোয়ার মধ্যে বসে কুটনোবাটনা করছে। কই তারা তো কিছু বলছে না!

হরিদাসীর এই দুঃসাহসিকতার উপর মুক্তকেশীর ধমক এসে পড়তে, তুই থাম তো হরিদাসী! কাদের সঙ্গে কাদের তুলনা? বৌদিরা ধোঁয়ায় বসে আছে বলে দাদাবাবুরাও থাকবে তাই? বলি পায়ে মাথায় এক হবে?

হরিদাসী মুক্তকেশীকেও ছেড়ে কথা কইত না, বেজার গলায় বলতো, জানি নে মা, কে পা, কে মাথা! আর মাথাটাই দামী, পা-টাই সস্তা, তাই বা কেন, তোমরাই জানো সে-কথা। পায়ের ওপরই তো দাঁড়ায় মাথাটা। আর আমরা তো পায়ের তলা, তবু তো আমাদের নইলে তোমাদের দিন চলে না দেখি। ভগবান সকল মনিষ্যির শরীল একই বস্তু দিয়ে তৈরি করেছে, সেই কথাই কইছি।

তা কইবি বৈকি, মেজবৌদির সাকরেদ যে! ব্রাতদিন তো ওই সব কথার চাষ করছেন মাজননী! বলে থামতেন মুক্তকেশী। কারণ জানেন। হরিদাসীর মতন পরিষ্কার কাজ শয়ে একটা মেলে কি না মেলে। ওকে বেশি চটানো চলবে না।

ওখানে চুপ করে এখানে ছেলেদের কাছে এসে অভিযোগ করতেন মুক্তকেশী, দেখছিস তো মাগীর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা! মেজবৌমাই এইটি করছেন। অনবরত ওদের সামনে গাওয়া—গরীবরা কি মানুষ নয়?… ছোটলোক কথাটা কারুর গায়ে লেখা থাকে না, ব্যাভারেই ছোটলোক ভদরলোক! … মাইনে দিয়ে রাখা হয়েছে বলেই কি আমরা ওর মাথা কিনে নিয়েছি? ও কাজ দিচ্ছে। আমরা পয়সা দিচ্ছি, হয়ে গেল শোধবোধ।… এতে আর ছোটলোকের মাথা বিগড়োবে না?

ছেলেরা বলতো, বিদেয় করে দাও না মাগীকে। ঝি আর মিলবে না। কলকাতা শহরে?

মুক্তকেশী ভিতরের রহস্য ব্যক্ত করতেন না, বলতেন, না, অমনটি আর সহজে মিলবে না। বলতেন, যে আসবে লঙ্কায়, সেই হবে রাক্ষোস! মেজবৌমা হয়তো আবার তাকে নিয়ে পাঠশালা। খুলবে। এই তো শুনি নিত্যি বলছে, হরিদাসী, তোর ছেলেটাকে এই বয়সেই পানের দোকানে কাজ করতে দিয়েছিস? কেন, একটু লেখাপড়া শেখাতে হয় না? আমাদের এখানে আনিস না সন্ধ্যেবেলা ছেলে।পুলের কাছে বসে থাকবে, পড়া শুনে শুনেও শিখবে একটু!

এ কথা শুনে হেসে উঠেছে। ওরা হা হা করে। হরিদাসীর ছেলের লেখাপড়ার ভাবনায় মেজাগিনীর আমাদের ঘুম হচ্ছে না! ভাল ভাল। কী বলবো, ওই মেয়ে লেখাপড়া করলে নিৰ্ঘাত মামলা এঁটে কাছারি যেত।… তবে হরিদাসীর যে রকম বোলচাল ফুটছে, তাতে ওকে ছাড়িয়ে দেওয়াই দরকার। এর ওপর আবার নাকি স্বদেশীবাবু-দের চ্যােলা হচ্ছেন। বিদেয় কর, বিদেয় কর।

কিন্তু এখন মুক্তকেশীর ছেলেরা কাতর আক্ষেপে বলছে, হরিদাসীটা সুদ্ধ ভাগলো! ওটা থাকলে তো এমন ঝঞাটে পড়তে হত না!

প্রকাশ-ই বেশি খাপ্পা, কারণ ঐটা বাসন মাজার দায়টা পড়েছে সম্পূর্ণ তারই ঘাড়ে। সে ছোট, তারই এটা কর্তব্য। বড়রা তো আর ছোেটর এঁটো সাফ করবে না! আবার সুবোধ যে প্রস্তাবটা করেছিল, যে যার নিজ নিজ থালা সাফ করে নেবার, তাতে রাজী হতেও চক্ষুলজ্জায় বাধে।

অতএব প্ৰকাশের কষ্ট বেশি।

ভাত সেদ্ধ এবং চুলো ধরানো ব্যাপারে প্রত্যেকেই প্রত্যেককে নস্যাৎ করতে এসে নিজে নস্যাৎ হয়েছে। এখন সকলেই একযোগে রান্নাঘরে এসে হুটোেপাটি করে, প্ৰকাশকে আবার উঠোনেও নামতে হয়।

ঘর, দালান, সিঁড়ি সাফ করার প্রশ্ন অবশ্য ওঠে না, মেয়েরা যাওয়া পর্যন্তই ও কাজটা বাদ। হরিদাসী তো আগেই গেছে। এঁটো থালাটা যে অমোঘ, অনিবাৰ্য! তাই চৌবাচ্চার পাড়ের উপর থালাটা বসিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাজাপর্ব সারতে সারতে প্ৰকাশ খিঁচিয়ে ওঠে, আমার হাতে যদি সংসারের ভার থাকতো, মাগীকে কেমন যেতে দিতাম দেখতে! উনি সুদ্ধ ছুটলেন মড়ক থেকে প্ৰাণ বাঁচাতে! বন্ড দামী প্ৰাণ! লোকসান গেলে পৃথিবী একেবারে অন্ধকার হয়ে যাবে!

কথাটা সুবোধের কানে যেতে প্রতিবাদ করে উঠল সে, তা পৃথিবীর লোকসান না হোক, তার তো লোকসান রে বাপু। নিজের প্রাণ সকলেরই নিজের কাছে দামী। মড়কের ভয়ে কে না পালাচ্ছে!

ও বাবা! দাদাও যে দেখছি ভাদরবৌয়ের চ্যােলা হচ্ছে। প্ৰকাশ হেসে ওঠে, বলি এই আমরা তো রয়েছি। দিব্যি জলজ্যান্ত বেঁচেও রয়েছি। হরিদাসীর চাইতেও কিছু আর অধম নই আমরা!

আহা তা কেন? আমাদের যে প্রাণের মায়ার থেকে চাকরির মায়া অধিক, ওদের তা নয়। ওরা বলবে, আগে তো বাঁচি, তারপর দেখা যাবে কাজ! –

আচ্ছা দেখে যেন। এলে কিন্তু আমার হাতে ওর শাস্তির ভার দিতে হবে তা বলে রাখছি। দেখি কেমন করে আবার ও এ বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোয়!

সহসা কথায় ছেদ পড়াতে হয়।

একটি বাজখাই গলা কৰ্ণ বিদারণ করে চেঁচিয়ে ওঠে, কার চৌকাঠ ডিঙানো বন্ধন হুকুম হচ্ছে রে? আমি তো এই ডিঙোলাম!

আরো জগুদা নাকি?

এরা বেরিয়ে আসে রান্নাঘর থেকে।

জগু সবিস্ময়ে বলে ওঠে, আরে, তিনটে মদতে মিলে রান্নাশালে কী করা হচ্ছে?

কী আবার করা হবে! প্ৰবোধ বীরত্বের গলায় বলে, রান্না করা হচ্ছে!

রান্না! তোরা আবার রান্না শিখলি কবে রে?

জগু হা-হা করে হেসে ওঠে আকাশ-ফাটানো গলায়, দেখি নি তো কখনো অন্দরমহলের ধারেকাছে! হ্যাঁ, সে বটে। আমি। রোধে রোধে হাড়পাকা। স্বৰ্গদপি গরীয়সীর অসুখ করলেই তো এই হতভাগার প্রমোশন! ওই ভয়ে জননী আমার রোগ অসুখ লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়ান। আমিও তেমনি ঘুঘু, মুখচোখের বেভাব দেখলেই তেড়ে আসি। নাড়ি দেখি, জিভ দেখি, দিব্যি দিই। শেষ অবধি গাল পাড়তে পাড়তে গিয়ে কথা মুড়ি দিয়ে শোয়।

প্রভাস সকৌতুকে বলে, তা বেশ! রান্নায় ওস্তাদ তো—এখন তো স্বপাক চলছে? আচ্ছা! একদিন খেয়ে আসা যাবে তোমার হাতে।

জগু চোখ কুঁচকে বলে, কেন, এখন স্বপাক কেন? বলতে নেই। ষষ্ঠীর কৃপায় বাছা এখন আছেন ভাল।

আছেন!

অর্থাৎ শ্যামাসুন্দরী এখনো এই মড়কের কলকাতায় বিরাজমান?

এরা হৈ-চৈ করে ওঠে, মামী। এখেনেই আছেন নাকি? দেশের বাড়িতে চলে যান নি?

দেশের বাড়িতে!

জগু আর একবার আকাশ ফাটায়।

দেশের জ্ঞাতিদের সঙ্গে যে মায়ের আমার একেবারে গলায় গলায়! বলেছিল একবার মানদা পিসি, আমি যাচ্ছি। বড়বৌ, যাবি তো চ। আমি সাফ বলে দিলাম, কেন? এই হতভাগা গরীবটাকে মাতৃহীন করতে সাধা? হাতে পেলে শ্যামাসুন্দরীকে জ্যান্ত রাখবে তোমরা? মেরে পুকুরপাড়ে গুঁজে রাখবে কিনা বিশ্বাস কি?

সুবোধ আক্ষেপের গলায় বলে, ইস, তা তো জানি না। ওই মানদা মাসীই মাকে বলেছিল, আমি যাচ্ছি, বড় বৌকে সঙ্গে নিয়ে যাব। তাই জানি। ইস, এমন জানলে মামীকে তো মায়ের সঙ্গে নবদ্বীপে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতাম। তখন একেবারে ছুটোছুটি, হুড়োহুড়ি—

জগু হেসে ওঠে, হ্যাঁ, যমের বাড়িকে ফাঁকি দেবার তালে কত লোক কত শালার বাড়িতেই ঠেলে উঠলো। শালার বাড়ি, বোনাইয়ের বাড়ি, মামার বাড়ি, পিসির বাড়ি, গুরু-বাড়ি, বলি যমের বাড়িটা কোন বাড়িটায় নেই বল দিকি? পালিয়ে প্ৰাণ বাঁচিয়ে যমের হাত এড়াবি? সে ব্যাটা পেয়াদা

তা হলেও, এটা তোমার উচিত হয় নি জগুদা! বিপদ মেয়েছেলেকে নিয়েই! প্ৰভাস বলে, আমার এক মক্কেল নবদ্বীপেই যাচ্ছে কাল, মামীকে বরং তার সঙ্গে—

ক্ষেপেছিস? জগু সতেজে বলে, যেখানে মা, সেখানে ছা, আমার হচ্ছে এই সাদা বাংলা। দুজনে দু ঠাঁই হই, আর যম ব্যাটা দূত পাঠক, তখন? হয় মা বেটি ছেলের হাতের আগুন পাবে না, নয় ছেলে ব্যাটা মরণকালে মায়ের পায়ের ধুলো পাবে না। রক্ষে করো। জগু শৰ্মা ওসব গোলমেলে কাণ্ডর মধ্যে নেই! মা আবার মেয়েছেলে। কী রে? জগজননীর অংশ না?

তা বটে!

পাগলা জগার কথায় চিরকালই সবাই হাসে। এখনও হাসলো। বলল, তা বটে!

জগু এবার এগিয়ে এসে বলে, পাকশালের ভার তাহলে এখন তোদের ঘাড়ে? দেখি তো তিন মদীয় কী পঞ্চও-ব্যঞ্জন রোধেছিস!

দুম দুম করে রান্নাঘরে ঢুকে আসে জণ্ড, এদের একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও। রান্নার পদ যা হচ্ছে কদিন, সে তো কহন্তব্য নয়। যা কিছু আনাজ-তরকারি সবই তো সেই ভাতসেদ্ধর সঙ্গে সেদ্ধ। তাতেই তেল, নুন, কাঁচালঙ্কা মেখে যায় হয়!

আজ আবার ভাতের ফেন পড়ে রান্নাঘরের এক কিভূতকিমাকার অবস্থা। অন্যদিন তো খানিকটা জল ঢেলে দিয়ে ঘর ধোওয়া হয়। আজ যে কী হবে!

সারা ঘরেও যেন ভাত ছড়াছড়ি।

জণ্ড এসেই হৈ-হৈ করে ওঠে, কী ব্যাপার! এ যে একেবারে অন্নের বৃন্দাবন, শ্ৰীক্ষেত্রের মেলা! এত ভাত ছড়াছড়ি কেন?

ও কিছু না, ওই ফেনটা ঝরাতে গিয়েই—

হুঁ, তা তো দেখছি-ই-, জগু বলে, দৃশ্য দেখেই মালুম হচ্ছে সব। পিসি ঠাকুরুণটি যে আমার সভ্য করে ছেলে মানুষ করেছেন! আরে বাবা অনুচিন্তা সর্বত্ৰ! কখন কোথায় কী অবস্থায় পড়তে হয়! সঙ্গে স্ত্রীলোক না গেলে খেতে পাবি না?

পাব না মানে? প্ৰভাস বীরদৰ্পে বলে, এই তো আজ সাতদিন ওরা কেউ নেই, খাচ্ছি না দুবেলা?

হুঁ। যা খাচ্ছিস তা তো দেখতেই পাচ্ছি। সার দিকি, আমিই আজ তোদের ভালমন্দ দুটো রোধে খাইয়ে যাই। কাল থেকে দুবেলা ও বাড়ি গিয়ে খাবি, বুঝলি? এর আর নড়াচড় হয় না যেন।

এরা অবশ্য দুটো ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই সমস্বরে প্রবল প্ৰতিবাদ জানায়। আজ রোধে খাওয়ানো এবং কাল থেকে ওবাড়ি খাওয়া, দুটোর বিরুদ্ধেই।

কিন্তু জগু তো ততক্ষণে উনুনের সামনে গুছিয়ে বসেছে।

ভাতের মধ্যে থেকে তরিতরকারিগুলো বাছতে বাছতে বলে, এ ভাত তো দেখছি গরুর মুখে ধরে দিতে হবে। মানুষের ভোগ্য তো হয় নি। আর চারটি চাল বার করা, চড়িয়ে দিই। মাছ-টাছ এনেছিস, না কি আনিস নি? তা না এনেছিস, নাই হল। ভাল। বড়ি আছে? আমসি? শুকনো কুল? আছে নিশ্চয়। পিসি তো আমার অগোছালো নয়!

ওরা মুখ-চাওয়াচাওয়ি করে।

আছে হয়তো জিনিসগুলো, কিন্তু কোথায় আছে কে জানে?

জগু মেয়েলী ভঙ্গীতে বঁটিতে আলু ছাড়াতে ছাড়াতে বলে, বুঝতে পেরেছি, জানিস না। যাক খুঁজে নেব। মাছ আনবি তো আন।

যত সব মেয়েলী! প্রভাস হাত ধুয়ে এদিকে সরে এসে বলে, বসেছে দেখ! যেন একটা গিন্নী! মেয়েলী ব্যাটাছেলে আমার দু-চক্ষের বিষ!

সুবোধ বলে, বাজারে মাছ-ই বা কোথা? মেছুনী জেলেনীরা আছে? সব ভেগেছে। তোমাদের বাজারে পাচ্ছি নাকি?

আমাদের? আমাদের খুঁজছে কে? মাছ কি আমাদের লাগে?

সে কী? তুমি খাও না?

দূর, কবে ও পাট চুকিয়ে দিয়েছি!

সুবোধ অবাক গলায় বলে, কেন? তোমার তো আর বোষ্টম মন্তর নয়, শাক্ত মন্তর। তবে মাছ খেতে বাধা?

বাধা!

জগু আগ্রহভরে বলে, বাধা কিসের? দুই মায়ে-পোয়ে থাকি, অত ঝামেলায় দরকার? মায়ের ঘাড়েই তো দু হেঁসেলের ভার পড়বে!

তাই বলে তুমি মাছ খাবে না?

তুমিটার ওপর জোর দেয় সুবোধ।

জগু চালের থেকে ধান বাছতে বাছতে বলে, তা আমি ব্যাটাই বা কি এত তালেবর? এত বিধবা হবিষ্যি করছে—

শোন কথা! সাধে আর তোমায় পাগল বলি জগুদা! কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা!

জণ্ড জুৎ করে হাঁড়িটা উনুনে বসিয়ে দিয়ে সরে এসে উদাত্ত উত্তর দেয়, কিসের সঙ্গে কিসের মানে? মানুষের সঙ্গে মানুষের তুলনাই করছি। মেয়েছেলেরা চিরজন্ম হবিষ্যির উপর থাকতে পারে, ব্যাটাছেলেরা থাকতে পারে না! বলতে চাস ব্যাটাছেলেগুলো মেয়েছেলের অধম! হুঁ! কোনো বিষয়ে খাটো হতে রাজী নই, বুঝলি? নে, সর দিকি, দেখি পিসির কোথায় কি আছে! মাছ না আনিস বয়ে গেল, দেখবি এমন পোস্তচচ্চড়ি বানাবো, খেয়ে যে বয়েসে আছিস, সেই বয়েসেই থাকিবি। কই, শিলপাটাটা কই?

খুঁজে-পেতে শিলটা এনে পেতে, তাকের উপরকার শিশি-কোটো, হাঁড়ি-মালসা উটকোতে থাকে জগু।

পিসি ফিরে এসে তো আর এসব নেবে না, আগাগোড়া ধোবে, মাজবে। ছুত নাড়তে বাধা কি?

মেয়েলী কাজে যে মেয়েদের থেকে একতিলও খাটো নয় জগু, তার প্রমাণ দেয়।

এই সাতদিন পরে ওরা আজ রান্নার গন্ধ পায় এবং ঠিকমত শব্দও। রূপও দেখা যাচ্ছে, রসাস্বাদটার জন্যে রসনা উৎকণ্ঠিত!

রোধেবেড়ে হাত ধুয়ে কোঁচায় মুছতে মুছতে দৃঢ় আদেশ দেয় জগু, ব্যস! কাল থেকে খবরদার আর হাঁড়ি নাড়বি না! ওখানে চলে যাবি—

মনে মনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও সুবোধ বলে ওঠে, তাই কি হয়? চার-চারটে মানুষ মামীর ঘাড়ে চাপা—

ঘাড়ে চাপা মানে? রাধেই, দুটো বেশি করে রাঁধবে, এই তো! কেন, মা কি আমার গতিরকুড়ে? প্যান প্যান করিস নে বাবা! হ্যাঁ, মামারবাড়ির আদর জুটবে এ আশা দেব না, ডাল-চচ্চড়ি-ভাত দুটো খাবি, ব্যস।

ডাল-চচ্চড়ি!

হায়, ডাল-চচ্চড়ি-ভোতই যে এদের কাছে এখন কী পরম পদার্থ তা জগু কি বুঝবে! চচ্চড়ি নামটা কানে আসা মাত্ৰই তো রোমাঞ্চ এসে গেছে!

কোন বস্তুর যে কতটা মূল্য, তা বোধ করি তার অভাব না হলে বোঝা যায় না।

এখন যেন মনে হচ্ছে, ভাত সেদ্ধ করা বা ডাল-চচ্চড়ি রাধাটা একেবারে তুচ্ছ নয়। মনে হচ্ছে মেয়েমানুষহীন বাড়ি শশানতুল্যই বটে।

আজকের খাওয়াটি মন্দ হল না, কাল থেকে বাড়া ভাতের আশ্বাস, মনটা ভাল হবার কথা। কিন্তু প্ৰবোধের মনের মধ্যে পাগলা জগুর কথাগুলো যেন বিধিছিল।

জগুদা আবার মানুষ?… জগুদার কথা আবার কথা! এই তো চিরদিনের মনোভাব, কিন্তু আজ যেন মনে হচ্ছে লোকটা যা বলে খুব ভুল বলে না।

কোন বাড়িতে যমের বাড়ি নেই?… যমের পেয়াদার হাত এড়িয়ে যাবে কোথায় মানুষ? … নিয়তির ওপর কথা নেই।… রাখে কেষ্ট মারে কে?

প্ৰত্যেকটি কথাই হীরের টুকরোর মত দামী!

যতক্ষণ খুন্তি নেড়েছে ততক্ষণ বকবক করেছে, কিন্তু কথাগুলো বলেছে মূল্যবান।

বলছিল, আমার পিসির খুরে গড় করি। তোর যাবার কি দরকার ছিল শুনি, তোর যাবার কি দরকার ছিল? এখনও মৃত্যুভয়? মরে যাবি, ড্যাং ড্যাং করে চার ছেলের কাঁধে চড়ে কাশী মিত্তিরের ঘাটে চুল যাবি, চুকে গেলা যত দিন না মরিস ছেলেদের ভাতজল কর। তা নয়।

ঠিক।

ঠিক বলেছে জগুদা।

মার যাওয়া উচিত হয় নি।

মা অনায়াসে থাকতে পারতো।

আর মা থাকলে, অনায়াসে একটা বৌকেও রাখা যেত। বলাই যেত, যাদের বাপের বাড়ি, মাসি-পিসির বাড়ি আছে তারা যাক; যার সেসব নেই, সে থাকবে। উপায় কি? রাখে কেষ্ট মারে কে?

হায়, জগুদা যদি তখন একবার বেড়াতে আসতো, মাকে জ্ঞান দিত!

বিপদের কথা কি বলা যায়!

এই যে পুকুরের দেশে রেখে এল প্ৰবোধ ছেলে।পুলেকে, তাতে বিপদ হতে পারে না? যুক্তি ক্রমশই ভারী হতে থাকে। এবং শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছয়, সামনের রবিবারেই গিয়ে নিয়ে আসবে। আর এই তো বেশ দিব্যি ঠাণ্ডা! বলা হরি কদাচিৎ শোনা যাচ্ছে।

তবে?

তবে কেন প্ৰাণপাখীকে খাঁচার বাইরে বার করে বেড়াল-কুকুরের মুখে রেখে আসা?

ভগবান জানেন ইত্যবসরেই থাবা বসিয়েছে কি না!

মেয়েমানুষটির তো বুদ্ধি-সুদ্ধির বালাই নেই, স্বদেশী শুনেই গলেছেন। নিৰ্ঘাৎ এতদিনে দিব্য মাখামাখি চলছে!

নিশ্চয়।

তা। নইলে চিঠি দিল না একটা? অথচ নিজমুখে বলেছিল, চিঠি দিলে রাগটাগ করবে না তো?

হ্যাঁ, প্ৰবোধের ফেরার সময় সেই কাঠ-কাঠি ভাবটা বদলে গিয়েছিল যেন সুবৰ্ণলতার। অনেকদিন আগের মত নরম আর হাসি-খুশি দেখিয়েছিল। নিচু হয়ে নমস্কার করে পায়ের ধুলো নিয়ে হেসে বলেছিল, হঠাৎ যদি মরেটরে যাই, মাপ চেয়ে রেখে দিলাম।

প্ৰবোধের কি ইচ্ছে হচ্ছিল সেই বনবাদাড়ের মধ্যে ওই সুবৰ্ণলতাকে ফেলে রেখে চলে আসে। কিন্তু উপায় কি? না না, ফিরিয়ে নিয়ে চলে যাই বললে পাগল বলবে না লোকে?

তা ছাড়া বোন-ভগ্নীপতির পক্ষে রীতিমত অপমানও সেটা। অতএব প্ৰাণ রেখে দেহটা নিয়ে চলে আসা!

ইচ্ছে হচ্ছিল একবার সাপটে ধরে আদর করে নেয়। কিন্তু ছেলেগুলো আশেপাশে ঘুরছে। তাই চোখে দীনতা ফুটিয়েই মনোভাব প্ৰকাশ।.

চিঠি দিলে রাগ করবো?

তা কি জানি, তোমাদের বাড়িতে ও রেওয়াজ আছে কি না! বিয়ে হয়ে এস্তক তোমাদের গলাতেই তো পড়ে আছি, চিঠি লেখা কাকে বলে জানিই না।

এইবার জেনো।

বলে-চলে এসেছিল প্ৰবোধ, ফিরে ফিরে তাকাতে তাকাতে।

ঠিক যে অবিশ্বাসিনী হবে সে ভয় অবশ্য নেই। কিন্তু স্বভাবটাই যে পুরুষ-ঘেষা। যেখানে পরপুরুষ, সেখানেই চোখ কান খাঁড়া। আবার বলে কিনা, কান পেতে শুনি নতুন কথা কিছু বলছে কি না। … বলে, নাঃ, সই গঙ্গাজল পাতাবার শখ আমার নেই। কার সঙ্গে পাতাবো? কারুর সঙ্গে মনই মেলে না। রাতদিন আর ওই মেয়েলী গল্প শুনতে ইচ্ছে করে না।

তা হলেই বোঝো!

মেয়েমানুষ তুমি, তোমার মেয়েলী গল্পে অরুচি, কারো সঙ্গে তোমার মন মেলে না!

তবে আর কি, একটা ব্যাটাছেলে খুঁজেই তবে মনের মানুষ পাতাও! বলেছিল প্ৰবোধ কতকটা রাগে, কতকটা ব্যঙ্গে।

সই পাতানোর একটা ঢেউ এসেছিল তখন।

সই গঙ্গাজল বাদেও নতুন নতুন সব আঙ্গিকে।

সেজবৌ তার বাপের বাড়ির দিকের কার সঙ্গে ল্যাভেণ্ডার পাতিয়ে এল, ছোটবৌ এখানেরই পাশের বাড়ির বৌয়ের সঙ্গে পাতালো গোলাপপাতা!

বিরাজ তার জায়ের বোনের সঙ্গে পাতিয়ে নিল বেলফুল, এমন কি মুক্তকেশী পর্যন্ত এই বুড়ো বয়সে মকর সংক্রান্তিতে সাগরে গিয়ে দু-দুটো গিন্নীর সঙ্গে সাগর আর মকর পাতিয়ে এলেন।

বিধবার পাতাপাতিতে তো খরচ বেশি নেই।

মাছ নয়, মিষ্টি নয়, পান-সুপুরি নয়, শাড়ি নয়, শুধু পাঁচখানা বাতাসা আর কাঁচা সুপুরি হাতে দিয়ে সূর্য সাক্ষী করে চিরবন্ধনের প্রতিজ্ঞা!

সধবাদের খরচ বেশী।

তা সধবারা সাধ্যমত করেছে।

শাড়ি সিঁদুর, পান মিষ্টি!

কিন্তু সুবৰ্ণ কারুর সঙ্গে কিছুই পাতালো না। হেসে বললো, বন্ধুত্ব যদি হয়। কারো সঙ্গে এমনিই হবে। পূজো পাঠ করে না করলে হবে না! ওতে আমার রুচি নেই।

ওরা আড়ালে বলেছিল, তা নয়, কাউকে তুমি যুগ্য মনে কর না, তাই!

সুবৰ্ণর বরও রাগে ব্যঙ্গে বললো, তবে আর কি, মেয়েমানুষে যখন রুচি নেই, তখন একটা ব্যাটাছেলে খুঁজে মনের মানুষ পাতাও?

সুবৰ্ণর চোখে কৌতুক ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল। সুবৰ্ণ মাথা দুলিয়ে প্ৰবোধের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া একটি ভঙ্গী করে বলেছিল, তা বলেছ মন্দ নয়! তেমনি যদি কাউকে পাই তো বন্দেমাতরম পাতাই।

বন্দেমাতরম!

এতদিন পরে হঠাৎ সেই কথাটা মনে পড়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল প্ৰবোধের।

ঘটে যায় নি তো সেই ঘটনা?

পাতানো হয়ে যায় নি তো?

কে বলতে পারে মনের মানুষ জুটে বসে আছে কিনা?

নাঃ, রবিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করার হেতু নেই। কাল-পরশুই চলে যাওয়া যাক। কাল হবে না, বেম্পতিবার। পরশু-পরশুই!

আর দ্বিধা নয়।

সুবৰ্ণর সেই কৌতুকের ভঙ্গীটা মনে পড়ে গেল।

সে ভঙ্গী যেন ভুলেই গেছে সুবৰ্ণর!

অথচ কী হাসিখুশিই ছিল আগে! সেই ছোটবেলায়!

মাঝে মাঝে ক্ষেপতো বটে, কিন্তু স্বভাবটা কৌতুকপ্ৰিয়ই তো ছিল। এবং অত হাসিখুশি অত রঙ্গরস দেখলে বিরক্তিই ধরতো প্ৰবোধের, মাঝে মাঝে তো রাগে মাথার রক্ত আগুন হয়ে উঠত। তার জন্যে শাসনও করেছে কত!

সেই একবার প্রকাশের ফুলশয্যায় আড়িপাতা নিয়ে? শাসনের মাত্রাটি বড় বেশিই হয়ে গিয়েছিল সেদিন! তা রাগটা যে প্ৰবোধের বেশি, সে তো প্ৰবোধ অস্বীকার করে না। মাপও তো চায় তারপর।

কিন্তু কাৰ্যক্ষেত্রে সামলাতে পারে না নিজেকে। বিশেষ করে ওকে পুরুষদের কাছাকাছি দেখলেই। বিরাজের ছোট দ্যাওরটা বুঝি প্রকাশের বন্ধু। সেটাও জুটেছিল সোহাগের মেজবৌদির সঙ্গে।

আর করেও ছিল তেমনি কাণ্ড!

রান্নাঘরের ছাতের আলসে ডিঙিয়ে কার্নিশ বেয়ে ঘুরে চলে গিয়েছিল। ফুলশয্যায় ঘরের জানলায়। তার সঙ্গে সেই ছোঁড়া। একটু ঠেলাঠেলি হলেই স্রেফ নিচের গলিতে।

আর সেই দৃশ্য চোখে পড়ে গেল ঠিক প্ৰবোধেরই। কোথা থেকে? না পাশের বাড়ির ছাত থেকে—যাদের ছাতে হোগলা দিয়ে লোকজন খাওয়ানো হয়েছে। অবশেষে প্ৰবোধ তদারক করছিল বাসনপত্র কিছু পড়ে আছে কি না। হঠাৎ গায়ে কাটা দিয়ে উঠল।

ওটা কী ব্যাপার?

ওরা কে ওখানে? সুবর্ণ? আর ও?

পরবর্তী ঘটনাটা একটু শোচনীয়ই।

প্ৰহারটা বড় বেশী হয়ে গিয়েছিল।

এতদিন পরে সেই কথাটা মনে পড়ে মনটা কেমন টনাটনিয়ে উঠল প্ৰবোধচন্দ্রের। অতটা না করলেও হত! ছোঁড়াটা তো সেই বোকা হাবা গদাই! গোঁফই বেরিয়েছিল, পুরুষ নামের অযোগ্য। আর তা নইলে প্রকাশটার বন্ধু হয়?

আশ্চৰ্য, ওই হাবাটাকে মানুষ বলে মান্য দিত সুবর্ণ।

সুবৰ্ণর মুখের হাসি তো প্ৰবোধের চিরকাম্য, কিন্তু ঘরের বাইরে কোথাও সেই হাসি দেখলেই যে কেন মাথায় রক্ত চড়ে যায়!

জায়ে জায়ে কথা কইতেও হয়তো কখনো হেসে উঠল, আমনি মনটা বোজার হয়ে গেল প্ৰবোধের। আমার এ রোগটা সারাতে হবে, মনে মনে ঠিক করে প্রবোধ। সুবর্ণর স্বভাবটা হয়তো ওতেই ক্রমশ এত কাঠ হয়ে যাচ্ছে। নইলে এমন তো ছিল না!

চোখের আড়ালে থাকায় সুবর্ণর দোষগুলো নিষ্প্রভ আর গুণগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মনে পড়ে, সুবৰ্ণর মনে আপন-পর নেই। সুবর্ণ যদি সাবান কাচে তো বাড়িসুদ্ধ সবাইয়ের বিছানার ওয়াড় খুলে এনে ফর্সা করে। সুবৰ্ণ যদি জুতো সাফ করে তো সকলের জুতোয় কালি লাগাতে বসে।… ছেলেকে একটা জিনিসের বায়না করলে, বাড়ির সব কটা ছেলেমেয়েকে দিয়ে তবে নিজের ছেলেকে দেয়। এসব সদগুণ বৈকি!

কাৰ্যকালে প্ৰবোধ আদৌ এগুলোকে সদগুণ বলে না, বরং বাড়াবাড়ি বলেই অভিহিত করে। কিন্তু এখন বোধ করি হঠাৎ নিজের মধ্যেই সদগুণের উদয় হওয়ায়, সুবর্ণর ওই গুণগুলোকে সদগুণ স্বলে মনে হচেছ তার!

 

পিয়ন এ বাড়িতে দৈবাৎ আসে।

সুরাজ চিঠি দেয় মাঝে মাঝে, এইটাই প্রধান, আর সবই কালে-কস্মিনের ব্যাপার।

তথাপি পাড়ায় তার আমার একটা টাইম আছে।

সেই টাইমে দাঁড়িয়ে থাকে প্ৰবোধ রাস্তায়।

কিন্তু কোথায়?

সুবৰ্ণর সেই মুক্তোর মত সাজানো অক্ষরে লেখা ঠিকানার চিঠি কোথায়?

তার উপর ভয়ানক কষ্ট হল, বুকে হাতুড়ীর ঘা পড়ল, প্রকাশের নামে এক খামের চিঠি আসা দেখে। আঁকা-বাঁকা অপটু অক্ষর। বাড়ির মালিকের নামে লিখেছে ক্যায়ার অব সুবোধচন্দ্র মুখোপাধ্যায়!

তবু চিঠি তো! বৌয়ের চিঠি!

প্ৰকাশের এ ভাগ্য হল।

অথচ প্ৰবোধের হল না।

যার বৌ রাতদিন খাতায় গান তুলছে, ছেলেদের হাতের লেখা মক্স করাচ্ছে। হাতের লেখা দেখলে কে বলবে মেয়েমানুষের লেখা।

ছোট ভাই। ভাবতে লাজ।

তবু বুকের মধ্যে ঈর্ষার জ্বালা অনুভব করে প্রবোধ।

প্ৰকাশের চিঠিটা যে তার হাতেই এসে পড়লো!

ছোট ভাইকে তো আর হাতে হাতে দেওয়া যায় না, ওর ঘরে রেখে এসে ডেকে বলে দিল, ওরে পোকা, তোর নামে বোধ হয় একটা চিঠি এসেছে।

মামীর কাছে খাচ্ছে কাল থেকে, কোজ নেই কিছু, কাজেই শূন্য প্ৰাণ আরও শূন্য লাগে। তাসের আজড়াও এই হুজুগে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। জমছে না তেমন।

ঘরে বৌ না থাকলে কোনো কিছুতেই জুত্ হয় না। কারুরই না।

তাকে দেখি বা না দেখি, তবু থাকুক।

এই হচ্ছে কথা!

প্ৰবোধ সংকল্পে দৃঢ় হল!

কালই যাত্ৰা!

বিনি খবরেই যাবে! গিয়ে বলবে, চিঠিপত্র নেই, এদিকে হঠাৎ একটা দুঃস্বপ্ন দেখে-

এখানে?

এখানে বলবার কথাও ঠিক করে ফেলেছে। বলবে, মামীর ঘাড়ে আর কতদিন খাওয়া যায়? ওদিকে বোনাই-বাড়িতেই বা কতদিন স্ত্রী-পুত্র রাখা যায়?

কিন্তু কী দেখব গিয়ে?

আনন্দ আর আতঙ্ক এই দুয়ের তাড়নায় ছটফটিয়ে বেড়ায় প্ৰবোধ।

১.১৮ ঠাকুমার সঙ্গে নবদ্বীপে আসায়

ঠাকুমার সঙ্গে নবদ্বীপে আসায় উৎসাহের অন্ত ছিল না চাঁপার। উঃ, ভগবান রক্ষে করেছেন যে মা জবরদস্তি করে নি। মা যদি জেদ করতো, যেতেই হত মায়ের সঙ্গে। ঠাকুমা যতই রাগী হোক, চাঁপাদের ব্যাপারে যে শেষ পর্যন্ত ঠাকুমার কথা খাটে না, মার কথাই বজায় থাকে, সে জ্ঞান জন্মে গেছে চাঁপার!

অতএব কাঁটা হয়ে ছিল চাঁপা, —ওই বুঝি মা বলে বসে, না, সবাই আমার সঙ্গে যাবে!

কিন্তু চাঁপার ঠাকুর ফুল নিলেন।

ঠাকুমা যখন বললো, চাপি মল্লিকা আমার সঙ্গে চলুক, চোখে চোখে থাকবে। ক্রমশ তো ডাগর হয়ে উঠছে। তখন সুবৰ্ণলতা না না করে উঠল। না। শুধু বললো, নিয়ে গেলে তো আপনারই ঝঞ্ঝাট। ওরা কখন খাবে, কখন শোবে, এই চিন্তা করতে হবে। একা গেলে যখন যা খুশি করলেন।

ঠাকুমাও বোধ করি আশঙ্কিত ছিলেন, তাই এক কথায় ছাড়পত্র পেয়ে হৃষ্টচিত্তে বলেন, সে কিছু অসুবিধে হবে না। শুধু আপনার হাত-পা নিয়ে বসে থাকার থেকে বরং কাজ থাকবে একটা। তীর্থে তীর্থে ঘোরা সে এক, এ তো একই ঠাঁই চেপে বসে থাকা। তাও দিন নির্দিষ্ট নেই, কবে কলকাতার অবস্থা ভাল হবে। চলুক ওরা।

অতএব চলুক।

নে থো করে গুছিয়ে নেওয়া, তবু ওরই মধ্যে মা কাপড়, জ্যাকেট, চুলের দড়ি-কাটা সব গুছিয়ে দিল। দুজনেরই দিল। মল্লিকার মা তো এদিকে তেমন গোছালো নয়। ভাড়ার গোছাতেই পটু। ছেলেমেয়েদের দিকটা তাকিয়েও দেখে না। আর সে না দেখাটাকেই সে বেশ একটু মহত্ত্ব ভাবে। বড় বড় মেয়েগুলোর সাজ-সজ্জার তদ্বির চাঁপার মা-ই করে। এতে যে চাঁপার হিংসে হয় না। তা নয়, কিন্তু সে হিংসে প্রকাশ করা চলে না। মা তাহলে জ্যান্ত পুতবে।

সে যাক, মা তো দিল গুছিয়ে দুজনকার। ঠাকুমার পুটলিও গুছিয়ে দিল। আহ্লাদে নাচতে নাচতে বেরোবে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে মল্লিকা বিশ্বাসঘাতকতা করে বসলো। জেদ করে, কেঁদে-কেটে চলে গেল তার মার সঙ্গে।

বললো, ভাই-বোনদের জন্যে মন-কেমন করছে।

ভাই-বোনদের জন্য মন-কেমন!

বিশ্বাস করবে। চাপা এই কথা?

বলে দুদণ্ড ওরা চোখ ছাড়া হলে নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচা যায়। রাতদিন উৎখাত করছে, রাতদিন চ্যাঁ-ভ্যাঁ করছে, খাটতে খাটতে প্ৰাণ যাচ্ছে ওদেরই জন্যে। আবার মন-কেমন।

চাপা তো বরং বলে না, কারণ সত্যি বলতে চাঁপার মা মেয়েকে পড়া পড়া করে ব্যস্ত করলেও অন্য কাজে তত খাটায় না। কিন্তু মল্লিকাকে খাটতে হয়, আর মল্লিকা বলতেও ছাড়ে না। বড়দের আড়ালে এলেই—কোলের ভাইটা-বোনটাকে ঠুকে ঠুকে বসায়, আর বলে, শতুর শত্ৰুর! একটু যদি শান্তি দেয়! মার যদি এই সাতগণ্ডা ছেলেমেয়ে না হত, একটু হাত-পা ছড়িয়ে বাঁচতম রে! এই চ্যাঁ-ভ্যাঁ গুলোর জ্বালায় জান নিকলে গেল!… জ্ঞান হয়ে পর্যন্তই কথা পাট করছি আর ছেলে বইছি!

অবিশ্যি চাপাও ও-দোষে দোষী।

পুতুলের বাক্স তার প্রাণ। কেউ হাত দিলে বাঘিনীর মত ঝাঁপিয়ে না পড়ে পারে না। কিন্তু চাঁপা তো। ঢং করে বলতে যায় নি, ভাই-বোনের জন্যে মন-কেমন করছে!

মন-কেমন! রাতদিন যাদের বলছে মর মর, এক্ষুনি মীর লক্ষ্মীছাড়ারা! যমের বাড়ি যা, নিমতলার ঘাটে যা! তোরা মলে আমি হরির লুট দিই! তাদের জন্যে মন-কেমন! ন্যাকামি! চালাকি! শেষ অবধি ওর মা কিছু লোভটোভ দেখিয়ে কি ঘুষঘাষ দিয়ে মেয়েকে ফাঁদে ফেলেছে। জানে তো মেয়ে নইলে চলবে না!

বিয়ে হয়ে গেলে করবে কি?

তখন তো চালাতেই হবে!

মাঝখান থেকে চাঁপারই ঘোরতর কষ্ট!

তুলের বাক্সটা এনেছে চাঁপা, কিন্তু খেলার সঙ্গিনীই যে ভাগল্‌বা! মল্লিকার এই বিশ্বাসঘাতকতায় হৃদয় বিদীর্ণ হয়েছিল চাঁপার। তবু প্ৰথম দুচার দিন ঠাকুমার সঙ্গে মন্দিরে মন্দিরে ঠাকুর দেখে বেড়িয়ে, গঙ্গায় নেয়ে এবং ঠাকুমার গুরুবাড়ির সংসারযাত্রার নতুনত্ব দেখে একরকম ভালই কাটছিল, ঠাকুমাও মেয়েটা একা পড়েছে বলে একটু হৃদয়বত্তার পরিচয় দিচ্ছিলেন। কিন্তু সে অবস্থা আর থাকল না।

গুরুর নিজেরই মেয়েজামাই, নাতিনাতনী আর শ্বশুরবাড়ির দিকে কে সব এসে হাজির হল, কে জানে কী উপলক্ষে! তবে সেই উপলক্ষে চাপা মুক্তকেশীর আদর ঘুচিলো।

ঘরের অকুলান হওয়ায় দালানের চৌকিতে শুতে হল। ঠাকুমা-নাতনীকে, এবং গুরুমার ব্যাজার ব্যাজার ভাব যেন সর্বদাই স্মরণ করিয়ে দিতে লাগল, তোমরা এখন অবান্তর। প্রশ্ন করতে লাগল, আর কতদিন?

অন্য কোথাও এ ভাব দেখলে নিৰ্ঘাত মুক্তকেশী পুঁটলি-বোঁচকা গুটিয়ে চলে যেতেন। কিন্তু জায়গাটা গুরুবাড়ি, দীনহীন হয়ে থাকাই নিয়ম। তাই মুক্তকেশী গুরুমার কাজের সাহায্য করেন, গঙ্গাজল বয়ে এনে দিয়ে মন রাখতে চেষ্টা করেন।

কিন্তু চাঁপার মন কে রাখবে?

মুক্তকেশী ওদিকে যতই আহত হন, ততই এদিকে ঝাল ঝাড়েন। উঠতে বসতে আপদ, বালাই, পায়ের বেড়ি, ঘাড়ের বোঝা ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করতে থাকেন নাতনীকে। নাতনীর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাটি মনঃপূত না হলে নাতনীকেই টিপে টিপে গঞ্জনা দেন এবং বলতে থাকেন, নিরিমিষ্যি মুখে রুচিছে না! সাহেবের গিন্নী হবেন! কত ভাগ্যে নারায়ণের অনুপেসাদ জোটে তা জানিস হারামজাদি?

বলা বাহুল্য, গুরুমার কানেই যায় কথাটা। কিন্তু নিরিমিষের কষ্ট পূরণ করতে এখন আর দুধ টুকু, দইটুকু, আচারটুকু, আমসত্ত্বটুকু পাতে পড়ে না। নারায়ণের বালভোগের জোড়া মণ্ডটি তো গুরুর ছোট নাতির একচেটি হয়ে গেল। অথচ প্রথম দিকে গুরুদের পূজো করে উঠে এসেই মেয়ে কই? মেয়ে কই? করে ডেকে ডেকে ওই মণ্ডটি হাতে দিতেন চাঁপার।

কিন্তু তাঁকেও দোষ দেওয়া যায় না।

চাঁপা একটা বুড়ো মেয়ে, ছোট্ট কেউ বাড়িতে নেই বলেই আদর জুটছিল তার। নাতি এল একটা, তিন-চার বছরের শিশু, আদরটা স্বভাবতই তার দিকে গড়াবে। আর নিজের নাতি এবং যজমানের নাতনীতে আদরের পার্থক্য থাকবে না, এ আবার হয় নাকি? সংসারত্যাগী যোগী গুরু নয়, ঘরসংসারী গৃহী গুরু। যজমান-ঘর বিস্তর, তাই অবস্থা ভাল। আর সেই জন্যেই যজমানরা নবদ্বীপ এলে ওঠে ওঁর কাছে। আদর্যযন্ত্বও পায়।

কিন্তু সে তো আর অনির্দিষ্ট কালের জন্যে নয়, ব্যাজার আসাই স্বাভাবিক।

ব্যাজার আসাই স্বাভাবিক, এটা মনে মনে হৃদয়ঙ্গম করেন মুক্তকেশী, তাতেই মেজাজ আরো খাপ্পা হয়। এবং সেই মেজাজটা চাঁপার উপরই পড়ে।

প্রথম প্রথম এখানে ঠাকুমার ভক্তিবিগলিত নম্র মূর্তি দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিল চাঁপা, কারণ ঠাকুমার এ মূর্তি তাদের কাছে অভূতপূর্ব। কিন্তু ভাগ্যে সাইল না। এখন ঠাকুমা উঠতে বসতে চাঁপাকে খিচোচ্ছেন। হয়তো নিরুপায়তার প্রকাশই এই। অধস্তনের উপর বীরত্ব ফলানো।

তাই পুরুষজাতি যখন দরবারে না মুখ পায়, তখন ঘরে এসে বৌ ঠ্যাঙায়।

চাঁপা এত মনস্তত্ত্ব বোঝে না, চাপা ঠাকুমার ভর্ৎসনায় মর্মাহত হয়। এবং তেমন দুঃখময় মুহূর্তে বলেও বসে, কেন আনলে আমাকে? মল্লির মতন মায়ের সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেই হত?

তখন আবার আর এক হাত নেন মুক্তকেশী।

নিঃসঙ্গ চাপা অতএব বড়ই মনঃকষ্টে আছে। এখন ওর সর্বদাই মনে হয়, মা বকলেও এমন নিষ্ঠুরের মত বকে না। মা ঠাকুমার মতন এমন বিতিকিচ্ছিরী করে চুল বেঁধে দেয় না, মার কাছে থাকলে কখন কি পরতে হবে ভাবতে হয় না। ভাবতে হয় না। জ্যাকেট কাপড় শুকলো কিনা, ভিজেগুলো সময়ে মেলা হল কিনা।

গুরুমার মেয়ে আবার খুব সরেশ।

চাঁপা যে কিছু কাজ জানে না, সেটা ইতিপূর্বে ধরা পড়ে নি, ধরা পড়লো ওই মেয়ের চোখে। দুদিন না যেতেই সে বলে বসলো, নাতনী যে তোমার কুটো ভেঙে দুটো করতে শেখে নি মুক্তদি! শ্বশুরঘরে যেতে হবে না?

বাবার শিষ্য, অতএব দিদি!

আর বয়েস যাই হোক, তুমি!

মুক্তকেশী নিজের সাফাই গাইতে তাঁর মেজবৌমার গুণকীর্তন করেন, এবং ওই বেঁটির জন্যেই যে তাঁর নাতি-নাতনীকে সনাতন হিন্দুধর্মে তালিম দিতে পারেন নি, সে কথা ঘোষণা করেন।

চাঁপার মাতৃভক্তির খ্যাতি নেই, নিজেরা যখন জাঠতুতো পিসতুতো বোনেরা একত্র হয়, তখন চাঁপা মাতৃনিন্দায় পঞ্চমুখ হয়, কিন্তু নিতান্ত পরের সামনে এসব কথা ভালো লাগে না তার। তাছাড়া মার কাছ থেকে দূরে এসে কেমন যেন অসহায়-অসহায় লাগে নিজেকে।

কেউ কোথাও যেন নেই চাপোর—এমনি মনে হয়। বাড়িতে তো ঠাকুমাই ছিল পৃষ্ঠবল, এখানে কেন তেমন মনে হয় না কে জানে!

মনটা সর্বদাই দুঃখু-দুঃখু লাগে।

তাছাড়া শুধু কলকাতার জন্যেও যেন মন-কেমন করে। কলকাতার বাড়ি, কলকাতার রাস্তা, মামীঠাকুমার বাড়ি, গঙ্গার ঘাট, যা মনে করে তাতেই প্ৰাণ হুঁ-হুঁ করে ওঠে!

কলকাতায় যে কী আছে তা বলতে পারবে না চাপা, তবু যেন মনে হয় কত কী আছে!

আরো কষ্ট হয়েছে চাঁপার-ওই নতুন আসা লোকগুলোর মধ্যে একটা যে ছেলে এসেছে তার ব্যবহারে। গুরুর শ্বশুরবাড়ির কে যেন। শ্ৰীীরামপুর থেকে এসেছে। কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ আছে খুব, কিন্তু কলকাতার নিন্দে ছাড়া কথা নেই মুখে!

কতই বা বয়েস?

চাঁপার থেকে ছোট হবে তো বড় হবে না, কিন্তু কী পাকা পাকা কথা! চাঁপা-মল্লিকাকে সবাই পাকা মেয়ে বলে, আর এই ছেলেটা কী?

মুখে মুখে আবার ছড়া বলে!

আর চেনা নেই জানা নেই, তুই!

খোঁচা খোঁচা চুল, মোটা মোটা পা, বেঁটে বেঁটে গড়ন—দেখলে গা জ্বলে যায়! আর সেইটা বুঝতে পারে বলেই উৎখাত করে চাঁপাকে, তোমাদের কলকাতায় আছে কি? কিছু না। খালি কায়দা আর কল! কাল আর কেতা, এই দুই নিয়ে কলকেতা! কেতা মানে জানিস? কেতা মানে কায়দা। কলকোত্তাই বাবুদের আছে শুধু কায়দা!

চাঁপাও অবশ্য নীরব থাকে না, রেগে উঠে বলে, থাকবেই তো কায়দা। যত সায়েবদের আপিস কলকাতায় না? লাটসায়েবের বাড়ি কলকাতায় না?

হি-হি করে হাসে ঘণ্টু।

বলে, তবে তো সবাই লাট, কি বলিস? তোর বাবা লাট, তোর কাকা লাট।

চাপা ক্রুদ্ধ গলায় বলে, এই, তুই আমার বাবা তুলে কথা বলছিস? বলে দেব?

ঘণ্টু কিন্তু রাগের ধার দিয়ে যায় না; বলে, দে না বলে! আমি বলবো, বাবার নাম করলেই বুঝি বাবা তোলা হয়? তাহলে তো ওকে ওর বাবার নাম জিজ্ঞেস করাও চলবে না।

মুখরা চাঁপা নিষ্প্রভ হয়ে যায়।

এবং বোকার মতই রাগে, তা কালকেতাকেই বা নিন্দে করবি কেন?

করবো! নিন্দের যুগ্যি তাই নিন্দে করবো!

নিন্দের যুগ্যি?

নিশ—চয়।

তা হলে তোদের শ্রীরামপুরও খুব বিচ্ছিরী! যত ইচ্ছে নিন্দে করবো!

ঘণ্টু চোখ পিটপিটয়ে হাসে। বলে, কর। দেখি কি নিন্দের কথা বার করতে পারিস!

চাপা অবশ্য পারে না।

কারণ শ্রীরামপুর নামটা শুনেছে সে এই ঘণ্টুদের দৌলতেই। কোথায় সেই পরমধাম, কী তার গুণাগুণ কিছুই জানে না। তাই বিপন্ন হয় চাপা।

ঘণ্টু পরিতুষ্ট মুখে বলে, পারলি না তো? পারবি কোথা থেকে? দোষ থাকলে তো? কলকেতা? হিহিহি!

কলকোত্তাই বাবু
এক ছটাকে কাবু!
কোঁচার বুলি লম্বমান,
উদর ফাঁকা মুখে পান।

আশ্চর্য, ওইটুকু ছেলে, মুখস্থও করেছে এত!

নিৰ্ঘাত ওদের বাড়িটা ঘোরতর কলকাতা-বিদ্বেষী, রাতদিন এরই চাষ চলে। চাঁপার এত হাতিয়ার নেই, ওর সম্বল শুধু রাগ। সেই সম্বলেই লড়তে আসে সে, আর তোদের শ্রীরামপুরে বুঝি কেউ পান খায় না?

খাবে না কেন? ভরা পেটে খায়।

কলকাতার লোক ভাত খায় না?

ঘণ্টু গম্ভীরভাবে বলে, সে গরীব-দুঃখীরা খায়। বাবুরা খায় শুধু চপ কাটলেট আর মদ!

মদ!

চাঁপার চোখ গোল হয়ে যায়।

চাঁপার মুখ লাল হয়ে ওঠে, মদ খায়! তার মানে আমরা মদ খাই?

তোরা? হি হি হি, তোরা কি বাবু? তোরা তো মেয়েমানুষ। হচ্ছে বাবুদের কথা। শুনবি আরো? চড়েন। বাবু জুড়ি গাড়ি, চেনেন খালি শুড়ির বাড়ি! শুড়ির বাড়ি মানে জানিস?

জানবে না কেন, কী না জানে চাপা? রাতদিন তো শুনছে। এসব। নিজেরাই ঝগড়ার সময় বলে, শুড়ির সাক্ষী মাতালা! কিন্তু সত্যি মানে ভেবে বলে নাকি? অথচ এই পাজী ঘণ্টুটা!

কক্ষণো তুই কলকাতার নিন্দে করবি না বলছি, চাপা অগ্নিমূর্তি হয়।

ঘণ্টু নির্বিকার।

ঘণ্টু নিৰ্ভয়।

ঘণ্টুর এই মেয়েটাকে ক্ষ্যাপানোই আপাতত শৌখিন খেলা। আর খেলোটাকে সে নির্দোষই ভাবে। তাই ঘণ্টু হঠাৎ তারস্বরে বলে ওঠে, আচ্ছা করবো না নিন্দে, বল তবে একটা ধান গাছে কখানা তক্তা হয়?

চাঁপা ক্ষোভে দুঃখে উঠে যায়।

ঘণ্টু মহোৎসাহে চেঁচায়, কলকেতার বিবিদের ছড়াটা শুনে গেলি না?

চাপা গিয়ে কেঁদে পড়ে, ঠাকুমা, ওই ঘণ্টুটা যা ইচ্ছে বলছে! বলছে কলকাতা ছাই-বিচ্ছিরি! থাকবো না। আর আমি!

মুক্তকেশীর অজানা নয় ব্যাপারটা, তাই ব্যাজার মুখে বলেন, ও ক্ষ্যাপাচ্ছে বলেই তুই ক্ষেপবি? বাড়িতে তো খুব দুদে, এখানে একেবারে কচি খুঁকি হয়ে গেলি যে!

গুরুকন্যা বলে ওঠেন, যা বলেছ মুক্তদি, নাতনীর তো তোমার বিয়ের বয়েস বয়ে যায়, কী ন্যাক বাবা! ঘণ্টু কি একটা মানুষ, তাই ওর কথায় ক্ষেপছে!

মুক্তকেশী আড়ালে গিয়ে চাপা গলায় বলেন, নেকি, তুমি রাতদিন ওই দস্যি ছোঁড়ার সঙ্গে মেশই বা কেন? ওসব হচ্ছে পাজীর পা-ঝাড়া! খবরদার ঘণ্টুর সঙ্গে মিশবি না।

চাপা কেঁদে ফেলে।

কলকাতার দুঁদে চাঁপার সব মর্যাদা ঘোচে। বলে, আমি কি মিশতে যাই? ওই তো আসে সোধে সোধে!

তা হোক। তুই আমার কাছে কাছে থাকিবি।

তোমার কাছে? তুমি যেন বড্ড থাকো? রাতদিন তো রাস্তায়। তার থেকে চলে যাই চল।

চলে যাই বললেই তো হয় না? তোর বাপ-জ্যাঠা হুকুম দেবে, তবে তো?

চাঁপা অতএব এদের ছাতে উঠে কাঁদতে বসে।

কলকাতার নিন্দেয় তার এমন জ্বালাই বা করে কেন? কলকাতার কথা মনে পড়লেই বা প্ৰাণের মধ্যে এমন হুঁ-হুঁ করে ওঠে কেন?

ছাতে নির্জনে বেশিক্ষণ বসা যায় না, বেলা পড়ে গেলেই গা ছমছম করে, আর দুপুরবেলা বুক টিপটিপ করে।

তবু আসে একবার একবার।

আলসের ধারেই একটা নারকেল গাছ, তার পাতাগুলো ঝিরবির করে, সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চাঁপার মনটা হারিয়ে যায়।..

যে বাড়ির দেওয়াল চারখানা চাঁপার মার কাছে জেলখানার দেওয়ালের মত লাগে, সে বাড়ির ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ায় চাঁপার মন।… আর সকাল থেকে রাত অবধি যেখানে যা কিছু হয় সব মনে পড়ে যায়। বাবা জ্যাঠা কাকারা কে কি করেন, কখন খাওয়া হয়, কখন শোওয়া হয়। তাছাড়া সক্কালবেলায় মাথায় বড় একটা হাঁড়ি নিয়ে যে লোকটা গলির মধ্যে এসে হেকে যায়-মুড়ির চাকতি, ছোলার চা-কতি-সে লোকটার গলার আওয়াজ যেন এখান থেকেই কানে এসে বাজে।… কাজন বাজে চাই কুলপী।… মা—লাই কুলপী! কানো বাজে চুড়িউলির চুড়ি চা-ই চুড়ি! আতা চাই আতা, টেঁপারি, টোপাকুল, নারকুলে কু-ল?

চলছেই তো সারাদিন।

এখানেও শব্দের অবধি নেই। সে কেবল ঘণ্টা-কাঁসরের শব্দ।

ঠাকুর জাগছেন, ঠাকুর খাচ্ছেন, ঠাকুর ঘুমোচ্ছেন, ঠাকুর সাজছেন, সব কাঁসর পিটিয়ে পিটিয়ে জানানো! বাবাঃ! এই ঠাকুরের দেশে আর থাকতে সাধ নেই।.. ঢের ভালো ওই বহুবিধ শব্দতরঙ্গে তরঙ্গায়িত কলকাতা!… এখানে একটা গাড়ির শব্দ শুনতে পাওয়া যায় না—আশ্চৰ্য্য!…

এখানে পয়সা হাতে দিয়েই কী বলবেন ঠাকুমা?

পেন্নাম কর! পয়সাটা ওই থালায় ছুঁড়ে দে!

দূর!

অথচ ওখানে একটা পয়সা পেলে কত কী করা যায়! ডবল পয়সা পেলে তো কথাই নেই। আধলা একটা ঘরের মেঝোয় কুড়িয়ে পেলেও তা দিয়ে দুখানা মুড়ির চাকতি কিনে ফেলা যায়।

মা মোটেই পয়সা হাতে দিতে চায় না। আঁচলে পয়সার পুটলি নিয়ে বেড়ায়, তবু একটা পয়সা চাইলে দেবে না। চাইলেই বলবে, কী চাই শুনি? কি কিনতে হবে?

কি কিনতে হবে তা কি ঠিক থাকে? পয়সাটাই আসল। ওটা পেলেই কত কীই কেনা চলে। কিন্তু তা হবে না। বলতে হবে। অগত্যাই যা হোক একটা কিছু বলে ফেলতে হয়। পেয়ারা কি আতা, ঝালবিস্কুট কি তিলকুট!

ব্যস, গুষ্টির যে যেখানে আছে, মা সবাইয়ের জন্যে কিনতে বসবেন। এতে কি রোজ রোজ আবদার করা যায়? চাঁপার বাবার যে বেশী পয়সা, তার জন্যে আলাদা কোন সুখ নেই চাঁপার! অথচ বাবাদের ওই হেমা মাসী? তাদের বাড়িতে নাকি তাঁর বড় ছেলের ছেলেমেয়েরা মুড়ি খায়, আর ছোট ছেলের ছেলেমেয়েরা পরোটা খায়!

কেন?

ওই পয়সা কম বেশি বলেই।

মার সামনে বল দেখি ওসব কথা, খুন করবে!

চুড়িউলি এলে সবাই চুড়ি পরবে, মা দাম দেবে। কিন্তু চাঁপা একটু বেশি পরতে যাক দিকি? নয়তো রেশমী চুড়ি পরতে যাক? হবে না! পারলে সবাই পরবে।… তা এখন তো চুড়ি পরাও ঘুচেছে। চুড়ি নাকি বিলিতি! কে জানে বাবা!

তা বাবা দেয় পয়সা। লুকিয়ে দিয়ে বলে, খবরদার, তোদের মাকে দেখাস নে।

কিন্তু লুকিয়ে কিনে লুকিয়ে খাওয়া কী কম গেরো?

তবু আঁচলে দু-একটা পয়সা থাকলেই মনটা কি ভরাট থাকে! আর রাস্তা দিয়ে যখন ওলারা হেঁকে যায়, কী আহ্লাদ হয়!… আর হাকছেই তো চব্বিশ ঘণ্টা!.. সেই কলকাতাকে কিনা বলে খারাপ?

সন্ধ্যে হয়ে আসছিল।

নারকেলপাতায় ঝিরঝিরিনিটা যেন জমাট জমাট দেখাচ্ছে। নিচে নামবার জন্যে উঠে পড়ে চাঁপা…মনে পড়ে যায় কলকাতায় এ সময় রাস্তার গ্যাসবাতি জ্বালনেওয়ালারা মই ঘাড়ে করে বেরিয়ে পড়ে।

চাঁপাদের গলির বাঁকে একটা গ্যাস আছে, লোকটাকে চাঁপাদের মুখস্থ হয়ে গেছে। বাতিওলা চলে যেতে না যেতেই ফুলওলার আওয়াজ পাওয়া যায়। গলিতে ঢোকে না, বড় রাস্তা থেকেই আওয়াজ আসে, চাই বেলফুল।… চাই কে—য়া ফুল!

ছোট খুড়ি কেয়াফুলের ধুলোগুলো দিয়ে কেয়া খয়ের বানায়। বাবাদের তাশের আডার লোকেরা বলে, আপনাদের বাড়ির পানটি ভালো!

যে কথাটাই মনে পড়ে যায়, প্ৰাণটা হু-হু করে ওঠে।

কলকাতা আর কলকাতার ওই বাড়িটা যেন চাঁপাকে লক্ষ বাহু দিয়ে টানতে থাকে।

আর এই আশঙ্কাটা এযাবৎ যেন চোখের সামনে একটি রঙিন ফুলের মত দুলছিল।

ইদানীং ঠাকুমাকে প্রায়ই লোকে বলতে শুরু করেছে, আর কি, চাঁপা-মল্লিকা তো দিব্যি বিয়ের যুগ্য হল, এবার নাতজামাই খোজো?

ঠাকুমাও অনুকূল একটা জবাব দিচ্ছেন। কাজেই অদূর ভবিষ্যতেই যে সেই দিনটি আসছে তা বুঝতে পারছে চাপা। আর সেই বুঝতে পারার আশেপাশে ঝলসে উঠছে নতুন গহনা, জরির শাড়ি, মালচন্দন, লোকজন, ডাক-হাঁকি, ঘটপটা।

টোপর পরা একটা ছেলেও আছে বৈকি এই সমারোহের কোনো একখানে।… কাজেই সবটা মিলিয়ে ওই একটি রঙিন ফুলই।

কিন্তু আজ, ঠিক এই মুহূর্তে ফুল উধাও হল। একটা বুনো জন্তু যেন হাঁ করে এল।

বিয়ে হওয়া মানেই তো ওই বাড়ি থেকে চলে যাওয়া। হয়তো বা কলকাতা থেকেও? কত মেয়েরই তো বিয়ে দেখছে চাঁপা, কই, কলকাতায় কোথা? অতএব চাঁপার ধরে নিতে হবে, কলকাতা থেকে বিতাড়ন!

হঠাৎ যেন ড়ুকরে। কান্না পায় চাঁপার।

যেন এখনই কলকাতা থেকে নির্বাসন ঘটে গেছে তার।

তা যাওয়াই।

আর বড় জোর ছ মাস এক বছর।

তার বয়সী কত মেয়েরই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।

হায় হায়, কেনই বা বিয়েটাকে ভাল মনে হত তার!

আচ্ছা, যদিই বা কলকাতাতেই বিয়ে হয় তার ছোট পিসির মত, কিন্তু পড়তে তো হবে একটি দজ্জাল শাশুড়ীর হাতে, তার ঠাকুমার মত। পিসির শাশুড়ী কেমন চাপা জানে না, মা খুড়ির শাশুড়ীকেই দেখে আসছে জীবনভর। কাজেই শাশুড়ী শব্দটার সঙ্গে সঙ্গেই মুক্তকেশীর মুখটাই ভেসে ওঠে। বলা বাহুল্য, তাতে বুকে খুব একটা বল আসে না।

সন্ধ্যার ছায়া মনে নিয়ে নিচে নেমে আসতে আসতে আরো একটা কথা মনটাকে তোলপাড় করে তোলে চাঁপার।

চাঁপার মার নাকি ন বছরে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তার মানে চাঁপার বয়েস থেকে দু বছর আগে। আর মা বেচারীকে এসে পড়তে হয়েছিল। ঠাকুমার মত শাশুড়ীর হাতে!

উঃ কী কষ্ট! কী কষ্ট!

জীবনে এই প্রথম বোধ করি মাকে বেচারী ভাবল চাঁপা।

তারপর আরো আতঙ্ক গ্ৰাস করতে বসলো চাঁপাকে। শুনেছে মার ঠাকুমা নাকি মার মাকে লুকিয়ে, আর মাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে ফেলেছিলেন!

সেই রাগে মার মা, যিনি নাকি চাঁপাদের দিদিমা, সংসার ত্যাগ করে কাশী চলে গেছেন। জীবনে আর মা তার মাকে দেখতে পেল না।

চাঁপার ঠাকুমাও যদি হঠাৎ এইখানে কারুদের বাড়িতে বিয়ে দিয়ে ফেলে তার!

ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে চাঁপার। বলা যায় না, বিশ্বাস নেই! মার ঠাকুমা তো চাঁপার ঠাকুমার সইমা! একই রকম বুদ্ধি হতে পারে।

হে ঠাকুর, তা হলে কি হবে?

লোকে চাঁপার দিদিমার গল্প শুনে বলে, বাবা, এত রাগ? বলে, অনাচ্ছিষ্ট। বলে, মাথার দোষ ছিল বোধ হয়।

কিন্তু চাঁপার তা মনে হয় না।–

চাঁপার ঠাকুমা যদি আমন কাণ্ড করে বসে, চাঁপার মাও নির্ঘাত চাঁপার দিদিমা সত্যবতী দেবীর মতনই করে বসবে।

করবেই! সন্দেহ নাস্তি!

অথচ চাঁপার মা সুবৰ্ণলতা পাগল-টাগল কিছুই নয়। তা পাগল না হোক, চাপা কিন্তু কিছুতেই তার মার মতন হবে না। বাপ, রাতদিন যেন মারমুখী! তার থেকে সেজ খুড়ি, ছোট খুড়ি, জেঠি, পিসি সবাই ভাল।

দিদিমা ওইভাবে মাকে বাঘের মুখে ফেলে দিয়ে চলে যাওয়াতেই বোধ হয় মার মেজাজ। অমন খাপ্পা। সত্যি মা হয়ে তুমি দেখলে না একবার! কী নিষ্ঠুর!! চাঁপার মাও ঠিক তাই হবে। তাছাড়া আর কি হবে?… হে ভগবান, ঠাকুমা যেন চাঁপার বিয়ে দিয়ে না বসে!

আগে আগে, যখন চাপা ছোট ছিল, মাঝে মাঝে মাকে বলতে শুনেছে, সেই ন বছর বয়সে এদের সংসারে এসে পড়েছি, মা বস্তু কী তা ভুলেছি!

এখন আর বলে না।

সুবৰ্ণলতার যে কখনো কেউ ছিল, তা আর বোঝা যায় না।

ঠাকুমা যদি লুকিয়ে লুকিয়ে চাঁপার বিয়ে দিয়ে ফেলেন? তখনও তাহলে বোঝা যাবে না, সুবৰ্ণলতার একটা চাপা নামের মেয়ে ছিল।

আর বাঁধা মানে না।

উথলে উথলে কান্না আসে।

তাড়াতাড়ি পুতুল বাক্সটা টেনে বার করে খেলতে বসে!

কিন্তু খেলতেও তো সেই পুতুল-বৌয়ের শ্বশুরবাড়ির জ্বালা আর খাটুনি। তাছাড়া আর কী ভাবেই বা খেলা যায়? কিন্তু এখন যেন সব কিছুই মধ্যেই চাপা নিজের ছায়া দেখছে।

পুতুলও আকর্ষণ হারালো!

মুক্তকেশীর কাছে ড়ুকরে গিয়ে পড়লো, ঠাকুমা, আমরা আর এখানে থাকব না, বাড়ি চল।

১.১৯ অন্য ভুবন

অন্য ভুবন।

সুবৰ্ণলতার কাছে এ এক আশ্চর্য নতুন ভুবন! অন্য ভুবন! এ ভুবনে শুধু আকাশেই উদার উন্মুক্ত আলো নেই, মানুষগুলোর মধ্যেও রয়েছে সেই আলো, উদার, উন্মুক্ত, উজ্জ্বল!

পাড়ার লোকের কথা জানে না। সুবৰ্ণলতা, জানে না সেখানে আলো না অন্ধকার, সে শুধু এই সংসারটাকেই জানছে। দেখছে আর জানছে।

ভেবে অবাক হয় সুবৰ্ণ, সুবালাকে বরাবর সবাই গরীব বলে এসেছে। এই সেদিনও ভাসুর গিয়ে বললেন, গরীবের সংসার বটে, তবে অমূল্যাটা পরিশ্রমী আছে তো? খেটেঁপিটে সংসার করে। গোয়ালে গরু, পুকুরে মাছ, বাগানে ফল-তরকারী, গায়ে-গন্তরে খেটে সব বজায় রেখেছে। তাতেই চলে যায় একরকম করে।

চলে যায় একরকম করে!

গরীব!

কিন্তু সুবালা যদি গরীব, তো ঐশ্বর্যবতী কে? হোক আড়ম্বরহীন টানাটানির সংসার, তবু এই সংসারখানির সম্রাজ্ঞী। তো ওই সুবালা। এ সংসার পরিচালিত হচ্ছে সুবালার ইচ্ছানুসারে, সুবালার নির্দেশে। শাশুড়ী নির্লিপ্ত কিন্তু নির্মায়িক নয়। যথাসাধ্য খাটেন। তিনি, কিন্তু সে খাটুনির বেশির ভাগ ছেলে-বৌ নাতি-নাতনীদের যত্ব পরিচর্যা বাবদ।

সুবালা যদি বলে, খাক গে বাবা ঠাণ্ডা দুধ—, ফুলেশ্বরী ব্যস্ত হয়ে বলেন, ওমা কেন? জ্বালানির ঘরে অত নারকেল পাতা, আমি একটা বুড়ী বসে রয়েছি ঠাণ্ডা খাবে কেন? ঠাণ্ডা খেলে শ্লেষ্মা বৃদ্ধি হয় বৌমা।

সুবালা দিব্যি উত্তর দেয়, শ্লেষ্মা বৃদ্ধি হয় না হাতী বৃদ্ধি হয়! ও কেবল আপনার নাতিনাতনীদের সোহাগ করা।

ফুলেশ্বরী রেগে উঠে যাচ্ছেতাই করেন না, হেসে উঠে বলেন, তো তাই! তোমার নাতিপুতিকেও তুমি করবে সোহাগ!

আমার বয়ে গেছে—

হুঁ, দেখবো!

সুবালা স্বচ্ছন্দ গলায় বলে, দেখবেন তো সেই স্বর্গে বসে! কী দেখলেন তা নিয়ে কে তর্ক করতে যাবে?

রাগারগি নয়, কড়া কথা নয়, সহজ হাস্য-পরিহাস। আশ্চর্য! সুবালার কী সাহস! সুবৰ্ণলতা তো দুঃসাহসের জন্য বিখ্যাত, কিন্তু এ সাহসের সঙ্গে তুলনা হয়? সুবৰ্ণলতার সাহস হচ্ছে-তিক্ততার শেষ সীমানায় পৌঁছে তীব্ৰতায় ফেটে পড়া।

আর সুবালার?

সুবালার সাহস আদরিণীর সাহস, বিজয়িনীর সাহস, প্রশ্রয়ের সাহস।

সুবালার শাশুড়ী সুবালার কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছেন, কারণ তার বৌমা বোঝে বেশি, জানে বেশি, বৌমার বিবেচনা ভালো।

এ কথা স্বীকার করা মানেই তো তাকে অর্ঘ্য দেওয়া।

সুবালার সংসার সুবালাকে সে অর্ঘ্য দিয়েছে। কারণ শুধু ফুলেশ্বরীই নয়, ফুলেশ্বরীর ছেলেও সেই সমৰ্পিত-প্ৰাণ! ফুলেশ্বরীর ছেলে খাটো ধুতি পরে, খালি পায়ে মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়ায়, কাঁধে করে ধামা বয়ে আনে, আর কথায় কথায় বলে, অত সব বুঝি না বাপু, মুখ্যু চাষা বৈ তো নাই।

তবু সে শহুরে চাষার মত ভাবে না, মেয়েমানুষকে শাসনে না রাখলেই সে মাথায় ওঠে! মেয়েমানুষের জায়গা হচ্ছে জুতোর নিচেয়! ভাবে না, তাই সে প্রতি পদে বলে, মহারাণীর যা ইচ্ছে… তুমি যা বলবে,… যা বোঝো করো।

পূজার মন্ত্রের চাইতে কি কিছু কম এটা?

কিন্তু সুবৰ্ণলতা তার এতখানি বয়সে যা দেখেছে তা হচ্ছে এই— তোমার বুদ্ধি আছে স্বীকার করবো। এ কথা? হুঁ! গায়ের জোরে প্রতিপন্ন করে ছাড়বো না তুমি নির্বোধ, তুমি মুখ্যু? … তোমার বিবেচনা আছে, মানবো এ কথা? বরং ভুল পথে গিয়ে লোকসান খাবো, তবু তোমার কথা শুনবো না।… তোমার ইচ্ছানুসারে চলবো? গলায় দিতে দড়ি নেই। আমার? তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধাচরণই ব্ৰত হোক…ভারী তুমি আত্মসম্মানী, তোমায় পেড়ে ফেলে তবে কাজ আমার!

কারণ?

কারণ তুমি মেয়েমানুষ!

তুমি বৌ মানুষ!

তোমার যে এ হেন বাড়িতে বিয়ে হয়েছে, এই তোমার ভাগ্য!

এই দেখেছে সুবৰ্ণলতা।

কারণ জীবনে একটা বৈ দুটো সংসার দেখে নি সে।

পিতৃগৃহের ছবি তার কাছে অস্পষ্ট। তাছাড়া তার মা ভিন্ন আর কোনো মেয়েমানুষ ছিল না সে বাড়িতে, তার বাবা ভিন্ন আর কোনো পুরুষ। সে সংসারে অন্যকে টেক্কা দিয়ে পৌরুষ দেখানোর চেষ্টা ছিল না, চেষ্টা ছিল না। অন্যকে খেলো করবার জন্যে বাহাদুরি দেখানোর।

সুবৰ্ণলতাদের সংসারে ভাইয়ে ভাইয়ে চলে সেই বাহাদুরির প্রতিযোগিতা।

সেই প্রতিযোগিতার বলি মেয়েমানুষেরা।

যথেচ্ছ অবজ্ঞা করো তাদের, পৌরুষের প্রশংসাপত্ৰ পাবে। নিষ্ঠুর হতে পারলে আরো ভালো, অত্যাচারী হতে পারলে কথাই নেই। ভাইরা বুকুক আমি পুরুষ, আমি স্ত্রী-বশ নই।

মা-বাবার সংসারে এটা ছিল না।

তবু–

মায়ের সেই একলার সংসারেই বালিকা সুবৰ্ণলতার চোখেও ধরা পড়তো, তার মায়ের মধ্যে কোথায় যেন একটা তীব্ৰ জ্বালা, মানে বুঝতে পারত না। হয়তো এখনো সঠিক বোঝে না। মাঝে মাঝেই ভাবে, কেন বাবা অত ভালমানুষ—

আবার ভাবে, হয়তো শুধুই ভালমানুষ। কিন্তু তাকে দিয়ে কি একটা মানুষের হৃদয় ভরাট হয়?

সুবৰ্ণলতার স্বামীও তো এক এক সময় বশ্যতা স্বীকার করে, সুবৰ্ণলতা যদি তার মনের মত হতে পারতো, যদি সুবৰ্ণলতা কৃপণ হত, যদি সংকীর্ণচিত্ত হত, যদি স্বার্থপর হত, যদি স্বামীর কাছে মধুময়ী এবং অন্যের সম্পর্কে মুখরা হত, হয়তো সে বশ্যতা স্থায়ী হত।

যাকে আর পাঁচজন আখ্যা দিত স্ত্ৰৈণ!

কিন্তু অমূল্য কি স্ত্ৰৈণ!

না।

স্ত্রীর প্রতি অমূল্যর যে মনোভাব, তাকে বলা যায় সম্ভ্রম ভাব।

এ কথাটা শুনলে দর্জিপাড়ার গলি হয়তো হাসিতে ফেটে পড়বে! বলবে, আহা তাই তো, জগতে ভক্তি-সম্ভ্রমের যুগ্য আর কে আছে? গুরু-গোসাঁই তুচ্ছ করে পাদ্য-অর্ঘ্য দাও গিন্নীকে।

বলবে, নিশ্চিত এই কথাই বলবে।

কারণ দর্জিপাড়ার সেই গলি সন্ধু কথাটার অর্থ জানে না। কারণ নিজেকে কোনোদিন সম্ভ্রম করে নি সে।

এ সংসার সম্ভ্রম শব্দটার অর্থ জানে।

এ সংসারে কোথাও কোনো জ্বালা নেই।

যদিও সুবালা প্রতি পদে বলে, কী জ্বালা!

বলে। ওটাই ওর মুদ্রাদোষ। সবাইকে বলে। সুবৰ্ণকে বলে, কী জ্বালা, মাত্তর ওই কটা মুড়ি খাবে তুমি? ওই আধ-ছটাকী বাটিতে?

ভাইপো-ভাইঝিকে বলে, কী জ্বালা, চাষাভুষোর মত রোদে বেড়াতে শিখলি যে!

শাশুড়ীকে বলে, কী জ্বালা, আবার আপনি এখন কাঁথা পেড়ে বসলেন? খাওয়া-দাওয়া হবে না?

বরকে বলে, কী জ্বালা! তোমার জ্বালায় জ্বলে পুড়ে মরলাম যে! এই ভরসন্ধ্যোয় আবার বেরোচ্ছে তুমি?

অমূল্যর বেরোনো অবশ্য বন্ধ হয় না। তাতে, হাসতে হাসতে বলে যায়, তা আমার জ্বালায় জুলবে না তো কি পাড়ার গয়লা বুড়োর জ্বালায় জুলবে? একজন আমার জ্বালায় আজন্ম জুলবে বলেই তো বিয়ে করে ঘরে পরিবার আনা।

সুবালা হাড় বার করা মুখে হেসে ওঠে।

এই ভয়ঙ্কর সত্যটা নিয়ে কৌতুক ওর। এইভাবে ওদের জ্বালায় গল্প।

সুবৰ্ণ কি তবে ঈর্ষায় জ্বলবো?

না না, সুবর্ণ এত নীচ নয়। সুবর্ণ এদের সুখ দেখে সুখী। তবু বুকের মধ্যে কোথায় যেন চিনচিন করে ওঠে।

আবার আহ্লাদও হয়। সুবালা যখন তার বাউণ্ডুলে দ্যাওরটাকে বলে ওঠে, কী জ্বালা, এই এতখানি বেলায় এলে তুমি? ভাত যে পান্তো হয়ে উঠলো!

আর অম্বিকাও ওর সুরাটা নকল করে বলে ওঠে, কী জ্বালা! ভাত পান্তো হয়ে উঠলো বলে দুঃখ? ঘরে ভাত থাকলে তবে তো সে পান্তো হবার অবকাশ পাবে?

তখন ভারী একটা আহ্লাদে মনটা খুশি-খুশি হয়ে ওঠে সুবর্ণর।

অথচ এতেও ঈর্ষার কারণ ছিল।

দ্যাওর-ভাজের মধ্যে যে অনাবিল প্ৰীতির সম্বন্ধ, সেটাই বা কবে দেখলো সুবৰ্ণ? দেবীররা ভ্ৰাতৃজায়াদের ব্যাখ্যানা করবে, এটাই তো মুক্তকেশীর বাড়ির নীতি। তারা ব্যঙ্গ করবে, হুল ফোঁটাবে, নিন্দে করবে, এই তো নিয়ম। কে জানে এ নিয়ম শুধুই মুক্তকেশীর বাড়ির, না। আরো অনেক অনেক বাড়ির!

কিন্তু এদের বাড়িতে—?

হ্যাঁ, সুবালার বাড়িতে অন্য নিয়ম।

আই না। অন্য ভুবন!

এই অন্য ভুবনে অম্বিকা তার বৌদির কথায় বলে ওঠে, নাও কোথায় তোমার পান্তো-টান্তো আছে বার করো দেখি, পেটকে শান্ত করি। খাণ্ডবদাহন হচ্ছে সেখানে।

বসে পড়ে নিজেই পিঁড়ি পেতে।

সুবালা পরম যত্নে ভাত বেড়ে দিয়ে বলে, ভারী তো ছিরির রান্না, ভাতটা গরম থাকতে খেলে তবু-

অথচ এ ছাড়া আর কিছু ব্যবস্থা হয়ও না।

ঝি-চাকরের তো পাট নেই, সুবালাকেই বাসন মাজতে হয়, রান্নাঘর নিকোতে হয়, এতক্ষণ অবধি আলাদা গরম ভাতের তদ্বির নিয়ে থাকলে সময়ে কুলোয় না।

অম্বিকা বলে, ছিরির মানে?… আচ্ছা মেজবৌদি, আপনার কি আপনার ননদের রান্না বিচ্ছিরি লাগে?

সুবৰ্ণর হঠাৎ খুব ভালো কোনো কথা যোগায় না, তাই তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, কী যে বলেন! আমার তো অমৃত মনে হয়।

হুঁ, দেখুন! আমিও তো তাই বলি, অমৃততুল্য। আহা, যখন জেলের লিপসি খেয়ে দিন কাটবে, তখন আপনার ননদিনীর হাতের এই মৌরল মাছের ঝালের স্মৃতিতে মনটা কেঁদে কেঁদে উঠবে।

থামো তো! সুবালা বকে ওঠে, সব সময় জেল জেল করো না।

আহা, সইয়ে রাখছি। নচেৎ আচমকা ঘায়ে মুর্ছা-টুর্ছা যাবেন।

সুবালা বোঝে সব, তবু বলে, বলি তুমি কি চোর-ডাকাত, না খুনে গুণ্ডা যে জেলে যাবে?

তার থেকে কিছু কমও নয়।

অম্বিকা কড়াই ডাল মাখা ভাতটা শাপ শপ করে মুখে তুলতে তুলতে বলে, বরং বেশি মাতৃভূমিকে মা বলা তো গুণ্ডামির অধিক!

সুবালা বলে, এই হল শুরু। মেজবৌ, তুই শোন বসে বসে। তোর মনের মতন প্রসঙ্গ। আমি বরং ততক্ষণ ওই রাবণের গুষ্টির জলপানিগুলো গোছাই।

সুবৰ্ণ আহত গলায় বলে, ওকি মেজ ঠাকুরবি, নিজের ছেলেদের ওই সব বলতে আছে?

সুবালা হেসে হেসে বলে, সত্যি কথা বলতে দোষ কি? রাবণের গুষ্টি ছাড়া আর কি? ভগবান এক মনে দিয়েছে, আমি একমনে নিয়েছি, গোনাগুণতি করি নি। জ্ঞানচক্ষু হতে দেখি আধ কুড়ির কাছাকাছি!

উঠে চলে যায়।

সত্যিই কাজের তার অবধি নেই।

তাছাড়া সুবর্ণ বসে থাকে বলে স্বস্তি থাকে একটু। বেটা ছেলে একা বসে খাচ্ছে, এটা তো আর হতে পারে না।

সুবালা চলে যায়, অম্বিকা সুবৰ্ণর দিকে তাকিয়ে বলে, এই একটি মহিলা, একেবারে নিৰ্ভেজাল!

সুবৰ্ণ বলে, আপনার মত মানুষের ধারে কাছে থাকতে থাকতে আপনিই বিশুদ্ধ হয়ে যায় মানুষ।

হ্যাঁ, প্ৰবোধের সন্দেহকে করে। এইভাবেই একটা অপর পুরুষে বিমোহিত হচ্ছে সুবর্ণ।

রোদে পোড়া রুক্ষ কালো শীর্ণ একটা ছেলে, তবু তাকে দেখলে সুবর্ণর মনটা আহ্লাদে ভরে ওঠে। তাকে অনেক উঁচু স্তরের মানুষ মনে হয়। মনে হয় কী সুন্দর!

প্ৰশস্তি গাইতে ইচ্ছে করে তার।

অম্বিকা বলে, সেরেছে! পুলিসে ধরে নিয়ে যাবে আপনাকে।

একদিন হঠাৎ বলে বসলো, আচ্ছা, শুনেছি তো আপনার ন বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল, আরমনে করবেন না কিছু দাদার শ্বশুর বাড়িটিই যখন আপনার শ্বশুরবাড়ি, তখন সেখানেই স্থিতি, তবে এত সুন্দুকুর কথা লুড়ে খেলুড়ো করে বলুন তো?

সুবৰ্ণ বিমূঢ়ভাবে বলে, সুন্দর করে?

হ্যাঁ, তাই তো দেখি। যা কিছুই বলেন, বেশ বিদুষী-বিদুষী লাগে।

সুবৰ্ণ হেসে উঠে বলে, ওঃ লাগে! যেমন পেতলকেও অনেক সময় সোনা-সোনা লাগে।

অম্বিকা বলে, আপনার মত পেতল যদি আমাদের এই সোনার বাংলার ঘরে ঘরে থাকতো, দেশ উদ্ধার হয়ে যেত, বুঝলেন উদ্ধার হয়ে যেত!

দেশ উদ্ধার!

ব্যস, এই খাতে এসে পড়ে আবেগের বন্যা।

সুবৰ্ণর চোখে এসে যায়। জল, মুখে ফুটে ওঠে। দীপ্তি।

সুবৰ্ণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতে বসে স্বদেশী ছেলেদের কথা। কী তাদের কার্যকলাপ, কী তাদের পদ্ধতি, কী বা তাদের সাফল্য!

অম্বিকা হাসে।

গলা নামিয়ে বলে, এই মেজবৌদি, টিকটিকি পুলিসের মত অত জেরা করবেন না, সব কথার উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। দেওয়ালের কান আছে।

সুবৰ্ণ লজ্জিত হয়।

বলে, বড্ড ইচ্ছে করে সব জানি।

তার মানে আপনি অনুভব করেন জিনিসটা। অম্বিকা বলে, বুঝতে পারেন। পরাধীনতার গ্লানি কি! সেটাই আশ্চর্য করে আমাকে।

সুবৰ্ণ উদ্দীপ্ত হয়, বলে, আশ্চর্যের কি আছে? পিরাধীনতার যন্ত্রণা আমরা মেয়েমানুষরা বুঝবো না তো আর কে বুঝবে? আমরা যে চাকরেরও চাকরানী।

রাণী হতে হবে। অম্বিকা জোর দিয়ে বলে, মেয়েদেরও এসে হাত মেলাতে হবে!

নেবেন? নেবেন আপনারা? সুবৰ্ণ আরো উদ্দীপ্ত হয়, মেয়েমানুষকে নিতে রাজী আছেন আপনাদের দলে?

দলে!

অম্বিকা ধীর গলায় বলে, বলে কয়ে টিকিট কেটে দলে নেওয়া তো নয়। মেজবৌদি, যে আসতে পারবে সে এসেই যাবে। বৃষ্টি যখন পড়ে, হাজার হাজার গাছের একটা পাতাও শুকনো থাকে না, কিন্তু পাতা ধরে ধরে ভেজাতে গেলে?… দেশ জাগবে, মেয়েদের মধ্যে আসবে সেই প্ৰবল প্রেরণা, আপনিই দলে এসে পড়বে। করছে বৈকি, অনেক মেয়েই দেশের কাজ করছে—কিন্তু থাক। এ আলোচনা।

সুবৰ্ণ হতাশ গলায় বলে, আলোচনাটুকুও যদি করতে নেই তো কি করে এগিয়ে যাবে মেয়েরা? আমি যদি আজ বলি সে প্রেরণা আছে আমার-

অম্বিকা আরো আস্তে বলে, বুঝতে পারছি। অনুভব করছি আছে, কিন্তু আপনার পক্ষে অসম্ভব। আপনার ছেলেমেয়ে রয়েছে-

সুবৰ্ণ হতাশ গলায় বলে, জানি, জানতাম! আমার যে সব দিক থেকে হাত-পা বাধা তা জানি!

অম্বিকা ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকায়।

তারপর সহসাই হেসে উঠে বলে, আপনাকে দলে নিই, আর আমাদের মেজদা পুলিস লেলিয়ে দিয়ে আমাদের জন্যে ফাঁসির ব্যবস্থা করুন। ওনাকে তো দেখেই ভয় করছিল।

সুবৰ্ণ ব্যঙ্গ হাসি হাসে।

বলে, কেন? খুব তো সুকান্তি সুপুরুষ!

সে কথা কোনো কাজের কথা নয়, অম্বিকা বলে, বাইরে ভেতরে এক, এ আর কজনের হয়? আমাদের সঙ্গে একটা ছেলে আছে, তাকে দেখলে মনে হবে দাঁড়কাক, কিন্তু তার ভিতরটা চাঁদের মত সাদা সুন্দর!

সুবৰ্ণ খপ করে বলে বসে, আচ্ছা, আমাকে দেখলে আপনার কী মনে হয়? বাইরে ভিতরে দুরকম?

অম্বিকা মাথা নিচু করে বলে, আপনার মত মেয়ে আমি আর দেখি নি মেজবৌদি। শুধু এই ভেবে দুঃখ হয়, আমাদের দেশের কত সম্পদের অপচয় হচ্ছে সর্বদা। আপনি যদি দেশের কাজে আসতে পারতেন–

সুবৰ্ণ অভিমানে ফেটে পড়া মুখে বলে, ওসব আপনার মৌখিক কথা। এক কথায় তো নাকচ করে দিলাম। যার ছেলেমেয়ে ঘরসংসার আছে, সে একেবারে পতিত হয়ে গেছে, এই তো কথা!

এভাবে সাড়া দিতে হলে যে সর্বস্ব পণ করতে হয়। মেজবৌদি, সর্বস্ব ত্যাগ করতে হয়।

তুমি কি ভাবো-

আবেগের মাথায় হঠাৎ তুমি বলে সুবৰ্ণ, তুমি কি ভাবো মেয়েরা পারে না তা? আমি এই বলে রাখছি, এই মেয়েদের কাছেই একদিন মাথা হেট করতে হবে তোমাদের।… বলতে হবে, এতদিন যা করেছি। অন্যায় করেছি। সত্যিই তোমরা শক্তিরূপিণী।

অম্বিকা এবার মাথা তুলে বলে, আপনার কথা বেদবাক্য হোক। দেশ যেদিন একথা বলতে পারবে, সেদিন দেশ এই অপমানের কুণ্ডু থেকে ঝেড়ে উঠবে।… সত্যি ভাবুন, কী অপমান, কী অপমান! সমুদ্রের ওপার থেকে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এক মুঠো লোক এসে এই এত কোটি লোকের উপর প্রভুত্ব করছে, তাই দেখছি বসে বসে আমরা আর নিঃশ্বাস ফেলছি। একসঙ্গে সবাই যদি রুখে উঠতে পারতো! মেয়ে বলে নয়, ছেলে বলে নয়, দেশের সন্তান বলে—

সুবৰ্ণ আরো ব্যগ্রভাবে কী বলতে যাচ্ছিল, অমূল্য এসে হাজির হয়। বলে, এই হয়েছে তো! জুটেছেন দুটি পাগলে!

সুবৰ্ণর তো এখানে এসে খুব বাড় বেড়েছে। অমূল্যর সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলে সে।

বলে, পৃথিবীতে যা কিছু মহৎ কাজ, তা এই পাগলেরাই করে। যা কিছু বড় ঘটনা ঘটেছে, তার মূল মানুষই হচ্ছে পাগল, বুঝলেন?

অম্বিকা সপ্ৰশংস দৃষ্টিতে তাকায়!

অমূল্য হেসে উঠে বলে, বুঝলাম!… কিন্তু অম্বু, তুই যেন আবার তোর ওই মহৎ কাজের মধ্যে এই পাগলটিকে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করিস নি, তাহলে আমার সেই গুণ্ড শালা এসে তোর মাথা ফাটাবে!

অম্বিকা বোঝে, দাদা তাকে সাবধান করছে। অম্বিকা জানে দাদার তাকে নিয়ে স্বস্তি নেই। তাই মৃদু হেসে বলে, সেই কথাই তো বোঝাচ্ছিলাম মেজবোঁদিকে। তবে দেশের কাজ তো মাত্র একটাই নয়! বাইরে থেকে যেমন এই দুশো বছরের পাপ ধ্বংস করতে হবে, ভেতর থেকে তেমনি আরো অনেক বছরের পাপ ধুয়ে সাফ করতে হবে।…মেয়েদের মধ্যে চেতনা জাগানোও একটা মস্ত কাজ মেজবৌদি। সে চেতনা জাগানো, তাদের বোঝানো কোনটা সম্মান কোনটা অসম্মান। বোঝানো শুধু খেয়ে পরে সুখে থাকাই মানুষের ধর্ম নয়। বোঝানো কেউ খেয়ে উপচে বসে থাকবে। আর কেউ না খেয়ে মরবে, এটা ভগবানের নিয়ম নয়। এই পৃথিবীর অন্ন সবাই সমান ভাগ-বীটোয়ারা করে খাবে, সবাই পৃথিবীর সন্তান।

অমূল্য প্রশংসার গলায় বলে, বললি তো ভালো, শুনলাম ভালো, কিন্তু শুনছে কে?

সুবৰ্ণও বলে, হ্যাঁ, সেই কথাই বলছি, শুনবে কে? পাথরে কি সাড় আসে?

আনতে হবে। অম্বিকা বলে, অসাড় পাথরে প্রাণসঞ্চার করতে হবে। মাটি-পাথরের বিগ্রহে যেমন প্ৰাণ-প্ৰতিষ্ঠা!

সুবৰ্ণ আস্তে মাথা নাড়ে।

বলে, চন্দ্র-সূর্যের মুখ দেখলে রসাতল, পর্দার মধ্যে জীবন, তারা আবার কাজ করবে! শিক্ষা নেই দীক্ষা নেই–

ঠিক! অম্বিকা বলে, এই জন্যেই আপনাকে আমার এত ভাল লাগে। আপনি সব বুঝতে পারেন। এই দেখুন, গলদের ঠিক মূলটি বুঝেছেন। আপনি। শিক্ষা, সকলের আগে চাই শিক্ষা। এই হতভাগা দেশের সব আছে, নেই খালি চোখের দৃষ্টি। সেই দৃষ্টি এনে দিতে হবে। আমার কোনো সুবিধে নেই, আমার হবে কি করে বললে চলবে না। মাটি কাটতে হয়, পাথর ভাঙতে হয়, তবে তো রাস্তা তৈরি হয়, তবে তো সেই রাস্তা দিয়ে জয়রথ চলে।

ঠাকুরপো! সুবৰ্ণলতা ব্যাকুল গলায় বলে, জানো, একথা আমার মার কথা!

আপনার মারে কথা?

অম্বিকা একটু আশ্চর্য হয়ে তাকায়।

সুবৰ্ণ তেমনিভাবে বলে, হ্যাঁ। মার স্মৃতি আমার কাছে ক্রমশই ঝাঁপসা হয়ে আসছে, তবু এ কথাটা মনে আছে। মা বলতেন এ কথা। আমি জন্মাবার আগে মা মেয়েদের পাঠশালায় পড়াতে যেতেন।

পড়াতে যেতেন! আপনার মা! অম্বিকা অবাক গলায় বলে, তাজ্জব তো! সে তো আরো আগের ব্যাপার। সমাজ আরো কড়া ছিল। তবু নিশ্চয়ই তিনি আরো শক্তিমতী ছিলেন! কতদিন হল মারা গেছেন?

সুবৰ্ণ শিউরে ওঠে।

সুবৰ্ণ তাড়াতাড়ি বলে, মারা যান নি। আছেন, কাশীতে থাকেন।—আমার মায়ের কথা বলবো আপনাকে। আপনিই পারবেন বুঝতে।

অম্বিকা ধীরে বলে, বুঝেছি, এই মন আপনি কোথায় পেলেন ভেবে অবাক হতাম, এখন বুঝতে

অমূল্য বুদ্ধিমান।

অমূল্য সমাজ-সংসারের জীব।

অমূল্য তার এই স্বদেশী ভাইটার জন্যে সর্বদাই চিন্তিত। তাই দুজনের এই বিমুগ্ধ ভাবটা তাকে অস্বস্তিতে ফেলে। সন্দেহ নেই এই মুগ্ধতা অতি পবিত্ৰ, অতি নিৰ্মল, তথাপি এ থেকেও বিপদ আসতে পারে। আসা অসম্ভব নয়। সুবৰ্ণ স্বদেশী করে ক্ষেপে উঠলেই তো সর্বনাশ। সুবর্ণ তার বাড়ির অতিথি।

সুবৰ্ণ সম্পর্কে তাকে বেশি অবহিত হতে হবে।

তাই অমূল্য বলে ওঠে, হ্যাঁ, মেজবৌদির মা অন্য ধরনের ছিলেন। আমিও জানি কিছু কিছু, বলবো পরে। মা ভাল না হলে কি আর ছা ভাল হয়? কিন্তু বসে বসে গল্প করছিস, আজ তোর কোজ নেই?

নাঃ, আজ বেরুব না। আজ শরীরটা একটু ইয়ে আছে।

অমূল্য আর একটু বাঁধ দেয়।

অন্তত ভাবে, বাঁধ দিচ্ছি।

বলে, তবে আর কি, কোটরে বসে পদ্য লিখা গে।

কিন্তু ফল বিপরীত হয়।

এই উল্টো বাঁধে উপচে ওঠে নদীস্রোত। পদ্য? কবিতা লেখেন, আপনি? চমকে ওঠে সুবর্ণ।

আপনি নয়, আপনি নয়, একটু আগে তুমি বলেছেন-

ওমা, কখন আবার?

বলেছেন। অজ্ঞাতসারে। তবে সেটাই বহাল থাক।

আচ্ছা থাক তাই। আমি তো বড়ই। কিন্তু কথা চাপা দিচ্ছ তুমি! তুমি কবিতা বল নি তো?

অম্বিকা হেসে ওঠে, মাইকেলের থেকে সামান্য কম, তাই আর বলি নি! দাদার যেমন কাণ্ড, কবিতা লেখে!

অমূল্য বলে, আহা, কেন? লিখিস তো বাপু সেই ছেলেবেলা থেকে। বুঝলেন মেজুবৌদি, বারো-তেরো বছরের ছেলে, দেশমাতা নিয়ে ইহা বড় এক পদ্য!… তা আপনার ননদিনী তার গুরুদেব দ্যাওরটির গুণগরিমার কথা সব বলেন নি? তোলা আছে বোধ হয় সে পদ্য আপনার ননদের কাছে। দেখবেন?

আমি সব কবিতা দেখবো। ঠাকুরপো, তোমার কবিতার খাতা দেখাতে হবে।

খাতা!

অম্বিকা হেসে ওঠে।

খাতা কোথায় পাবো? ছেঁড়া কাগজের ফালি হচ্ছে আমার ভাবের বাহন। হাতের কাছে যখন যা পেলাম!

তা তাই দেখবো।

কে তুলে রেখেছে!

দেখো, তুমি আমায় ঠকাচ্ছে। বেশ তো, নতুন একটা লেখো।

এই সেরেছে। দাদা, বুঝতে পারছে? বিশ্বাস করছেন না। আমার বিদ্যে। হাতে হাতে প্ৰমাণ চান।

মোটেই না। আমি শুধু দেখতে চাই।

তবে তো লিখতেই হয়—, অম্বিকা হেসে ওঠে, দাদা আবার মাতালকে মদের বোতলের কথা মনে পড়িয়ে দিলেন!

অমূল্য বলে, তবে যা, ঘরে বসে মাতাল হগে যা। চললাম। আমি। ভীষণ কাজ।

দুজনকে বিভোর হয়ে গল্প করতে দিতে অস্বস্তি বোধ করে অমূল্য পাড়ার লোকের চোখের জন্যে। চোখগুলি তো ভাল নয়। সুবালার মত সরল আর কজন আছে?

ভাইকে এই ইঙ্গিতটা দিয়ে কাজে চলে যায় অমূল্য।

অনুমান করতে পারে না, খাল কেটে কুমীর এনে গেল।

অনুমান করতে পারল না, ইঙ্গিতের মর্ম বুঝবে না। এরা। তার পাগলী শালাজ অম্বিকার সেই কোটরে গিয়ে উঠবে কবিতা হাতড়াতে।

 ১.২০ চাঁপার ধারণা ভুল ছিল না

চাঁপার ধারণা ভুল ছিল না।

বড় মেয়ে মল্লিকাকে স্রেফ ঘুষ দিয়েই নিজের দিকে টেনে এনেছিল–উমাশশী। পুরো আস্ত একটা টাকাই ঘুষ দিয়ে বসেছিল। ঝাঁটি-বাঁধা মহারাণী মার্কা এই টাকাটি কবে থেকে যেন তোলা ছবি লুকানো একটি কোটায়, সেটি দেখিয়েছিল মেয়েকে।

ভীরু ভীরু গোপন অনুরোধ।

চল না। আমার সঙ্গে, দিয়ে দেব এটা।

মল্লিকার লুব্ধ দৃষ্টি জ্বলে উঠেছিল বটে, তবু সে বোজার মুখে বলেছিল, আহা, তোমার সঙ্গে যাই আর তোমার ছেলে বইতে বইতে প্ৰাণ যাক আমার!

বলেছিল।

বলে দিব্যি পার পেয়েও ছিল।

সাধে কি আর চাঁপা আড়ালে বলে, আমি যদি জেঠিমার মেয়ে হতাম, হাজারগুণ ভালো হত আমার।

 

চাঁপার জেঠিমা এ-হেন অপমানেও জ্বলে ওঠে না, বরং আরো মিনতির গলায় বলে, ওখানে গিয়ে ছেলে বইতে হবে কেন রে? ওখানে কি আমাকে হেঁসেল সামলাতে হবে? শরৎ দির বাড়িতে কত ঠাকুর চাকর লোকজন!

ঠাকুর চাকর লোকজন সমৃদ্ধ সেই বড়লোক মাসতুতো মাসীর বাড়ির লোভনীয় আকর্ষণে আর একবার মনটা টলে মল্লিকার, তবু অটল ভাব দেখায়, লোকজন তো লোকজন, তুমি তোমার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলে ঠাকুমা তোমার গলা টিপে দেবে না?

নিয়ে যেতে চাইলে!

উমাশশী শিউরে বলে, আমি চাইবো কি বল? তুই বলবি যে মন-কেমন করছে!

আহা রে! লোকে যেন বিশ্বাস করবে!

এবার উমাশশীর চোখের কোণে জলের আভাস দেখা দেয়, লোকে বিশ্বাস করবে না? মাভাই-বোনদের জন্যে মন কেমন করাটা অবিশ্বাসের?

মল্লিকা ঈষৎ অপ্রতিভ হয়।

বলে, আর চাঁপি? চাঁপিকে যে তাহলে একলা যেতে হবে! চাঁপি আমার গায়ে ধুলো দেবে না?

উমাশশী অতঃপর চাপির সম্পর্কে ঠাকুমার একদেশদর্শিতার উল্লেখ করতে বাধ্য হয়। বলে, চাঁপাকে তো মা বুকে করে রাখবেন। যত টান তো ওর ওপরেই, দেখিস না? তোর অভাব ও টেরই পাবে না।

চাঁপা সম্পর্কে যে মুক্তকেশীর কিঞ্চিৎ দুর্বলতা আছে, সে কথা এরা সকলেই জানে, কিন্তু এমন স্পষ্টাম্পষ্টি আলোচনা হয় না কোনো দিন। উমাশশী নিরুপায় হয়েই আজ সে আলোচনা করে। একএকটা দিনের উদাহরণ দেখায়, যে উদাহরণে চাঁপা-মল্লিকার ঝগড়া মেটাতে মুক্তকেশী মল্লিকাকে ধমক এবং চাঁপাকে পয়সা দিয়েছেন, এমন বৰ্ণনা আছে।

ঝগড়া?

তা হয় বৈকি দুজনের।

ভাবও যত, ঝগড়াও তত।

তা সে যাই হোক, শেষ পর্যন্ত মেয়েকে রাজী করাতে সক্ষম হয়েছিল উমাশশী এবং একপাল ছেলেমেয়ে নিয়ে রওনা দিয়েছিল।

ব্যাণ্ডেলে মাসতুতো দিদি শরৎশশীর বাড়িতে। যে সে দিদি নয়, দারোগাগিন্নী।

কিন্তু দশটা ছেলেমেয়েকে নিয়ে প্রায় অপরিচিত মাসতুতো ভগ্নীপতির সংসারে এল কি বলে উমাশশী? সুবোধই বা পাঠালো কোন লজ্জায়?

তা জীবনমরণের কাছে আবার লজা!

তাছাড়া—আপাতত উমাশশীর মা সুখদা বোনঝির বাড়িতেই বাস করছিলেন। অতএব মা যেখানে ছা সেখানে।

শরৎশশী। অবশ্য হৃষ্টচিত্তেই গ্ৰহণ করেছে মাসীর মেয়েকে এবং তার বাহিনীকে। কারণ নিজের তার ষষ্ঠীর কৃপা নেই। অথচ ঘরে মা-লক্ষ্মী উথলে পড়ছেন। এই উথলে ওঠা চেহারা আত্মজনকে দেখাতে পারাও তো একটা পরম সুখ।

অবশ্য উমাশশীর ওপর একটু অভিমান তার ছিল, কারণ উমাশশীর যখন এ বছর আর বছর হচ্ছে, আর নিজে সে বন্ধ্যাই এ সত্য স্থিরীকৃত হয়ে গেছে, তখন ও মাসীর মারফৎ প্রস্তাব করেছিল, উমির একটা ছেলেকে দত্তক দিতে।

উমাশশী রাজী হয় নি।

উমাশশী বলেছিল, এ প্রস্তাব শুনলে আমার শাশুড়ী আমায় বঁটি দিয়ে দুখানা করবেন।

সুখদা বার বার বলেছেন, তা ভাবছিস কেন? লক্ষ্মীর ঘরে ছেলেটা সুখে থাকবে, রাজার হালে কাটাবে–

তুমি বল তধ্যে শাশুড়ীকে।

আমি কেন বলে দোষের ভাগী হতে যাব বাবা! তোর শাউড়ী বলবে, দুঃখী মাগী হয়তো বোনঝির কাছে ঘুষ খেয়ে বলছে!

অতএব প্ৰস্তাবটা হয় নি।

শরৎশশী তখন চিঠি লিখেছিল।

বলেছিল, পাকাঁপাকি দত্তক না দিস, মানুষ করতে দে আমায় একটিকে। তোর পাঁচটি আছে, আমার ঘর শূন্য।

উমাশশী শিউরে উঠে ষাট ষাট করেছিল এবং মার কাছে কেঁদে ফেলে বলেছিল, শাশুড়ী হয়তো রাজী হবেন, আমিই পারবো না মা। যার কথা ভাবছি, তার জন্যেই বুক ফেটে যাচ্ছে।

সুখদা বিরক্ত হয়েছিলেন।

বলেছিলেন, বুক তো ফাটছে, কিন্তু কি সুখেই বা রাখতে পেরেছ ছেলেপেলেকে? নেহাৎ মোটা চালের মধ্যেই আছে। অথচ শরতের পুষ্যি হলে—

তা হোক, পারবো না মা। গোরস্ত ছেলে, গোরস্ত হয়েই থাক।

ভগ্নদূতের বার্তা সুখদাকেই বহন করতে হয়েছিল এবং মেয়ের দুর্মতিতে পঞ্চমুখ হয়েছিলেন তিনি বোনঝির কাছে। তদবধি শরৎশশী উমাশশীর প্রতি ক্ষুন্ন। অথচ মা ছেলে ছাড়ল না এটাকে ঠিক অপরাধ বলেও ভাবতে পারে নি। তবে যোগাযোগও রাখে নি। এবারে যখন মান খুইয়ে নিজেই এল উমাশশী, খুশিই হল শরৎশশী।

বললো, তবু ভালো যে দিদি বলে মনে পড়লো।

তারপর খাওয়ামাখা আদরযত্বের স্রোত বহালো। … সুখদা আড়ালে মেয়েকে বলেন, দেখছিস তো সংসার! তখন বুঝলি না, আখের খোয়ালি। এখন ওর মন বদলে গেছে। বলে, ভগবান না দিলে কার সাধ্যি পায়!। তবে— ফিসফিস করেন সুখদা, নজরে ধরাতে পারলে, মেয়ের বিয়োতেও কিছু সুরাহা হতে পারে।

এসব প্রসঙ্গ অস্বস্তিকর।

কিন্তু তদপেক্ষা অস্বস্তিকর জামাইবাবু করালীকান্তর পেশাটা।

পুরুষমানুষ সকালবেলা তাড়াহুড়ো করে মানাহার সেরে আপিস কাছারী যায়, সন্ধ্যের মধ্যে বাড়ি ফেরে এই উমাশশীর জানা, মেজ দ্যাওর ব্যবসা না কি করে বটে, তবু তারও আসা-যাওয়া সুনিয়ন্ত্রিত। কিন্তু এ কী?

না আছে আসা-যাওয়ার ঠিক, না আছে নাওয়া-খাওয়ার ঠিক। অর্ধেক দিন তো বাড়াভাত পড়েই থাকতে দেখা যায়, খাওয়াই হয় না। এসে বলে, অসময়ে আর ভাত খাব না, দুখানা লুচি দাও বরং।

তখন আবার তাড়াহুড়ো পড়ে যায় লুচি রে আলুর দম রে করতে।

আর শুধুই কি দিনের বেলা?

হঠাৎ হঠাৎ রাতদুপুরে ঘুম ভেঙে দেখে আলো জ্বলছে, চাকর-বাকর ছুটোছুটি করছে, শরৎদি হতে হাতে জিনিস নিয়ে ঘুরছে, আর জামাইবাবু পুলিসী ধড়াচুড়ো আঁটছেন।

চুপিচুপি দেখে, জামাইবাবু বেরিয়ে যাচ্ছেন, একটা লালমুখো ঘোড়ার গাড়িতে গিয়ে উঠছেন, হারিয়ে যাচ্ছেন বিমঝিম করা নিকষ অন্ধকারের মধ্যে।

দেখেশুনে উমাশশীর হাত-পা ঝিমঝিম করে আসে। খামোকা উঠে নিজের ঘুমন্ত ছেলেমেয়েগুলোর গায়ে হাত দিয়ে দেখে, হয়তো বা গোনে। যেন হঠাৎ দেখবে একটা কম।

বুকটা ছমছম করতে থাকে কি এক আশঙ্কায়।

কেন যে এমন হয়!

এমনিতে তো জামাইবাবু দিব্যি রসিক পুরুষ। শালী শালী করে ঠাট্টােতামাশাও করেন। মন ভাল থাকলে ডাক-হাঁক করেন, ওহে বিরহিণী, গেলে কোথায়? একলা বসে শ্ৰীমুখচন্দ্ৰ ধ্যান করছে। বুঝি?

কথা শুনে লজায় মরতে হয়।

ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে।

কিন্তু মন যখন ভাল থাকে না জামাইবাবুর?

তখন কী রুক্ষী! মুখে কী কটু কুৎসিত ভাষা! চাকরদের গালাগাল দেওয়া শুনলে তো কানে আঙুল দিতে ইচ্ছে করে। শরৎশশীও বাদ যায় না, তাকেও কাঁদিয়ে ছাড়েন। তাছাড়া এক এক সময়, বিশেষ করে রাতের দিকে সহসাই যেন বাড়ির হাওয়া বদলে যায়, বাইরে বৈঠকখানায় নানারকম সব লোক আসে, দরজা বন্ধ করে কথাবার্তা হয়, কী যেন গোপন ষড়যন্ত্র চলতে থাকে, জামাইবাবু বাড়ির মধ্যে আসেন যান, স্ত্রীর সঙ্গে চাপা গলায় কী যেন কথা বলেন, হয়তো সেই লোকগুলোর সঙ্গেই বেরিয়ে যান, কোন রাত্তিরে যে ফেরেন, টেরই পায় না। উমাশশী।

দিদি না খেয়ে বসে থাকলো, না খেলো কে জানে!

এমন গোলমেলে সংসার ভাল লাগে না উমাশশীর। মনেই যদি স্বস্তি না থাকলো তো কী লাভ রাশি রাশি টাকায়, ভাল ভাল খাওয়া-পরায়!

সেই কথাই একদিন বলে বসে উমা।

আর বলে মল্লিকার মুখে একটা কথা শুনে। মল্লিকা নাকি দেখেছে মেসোমশাই বাগানের ওধারে একটা লোককে মুখ বেঁধে চাবুক মেরে মেরে অজ্ঞান করে দিয়েছেন। আর সে নাকি চোর-ডাকাতের মতন মোটেই নয়, ভদ্রলোকের ছেলের মতন দেখতে।

উমাশশী বলে বসে, যাই বল দিদি, ও তোমার গোরস্তাবলী চাকরিবাকরিই ভাল। টাকা গয়না কম থাকলেই বা কি, মনে শান্তি থাকে। জামাইবাবুর কাজটা বাপু ভাল নয়।

সুখদা চমকে যান।

আড়চোখে বোনঝির মুখের দিকে তাকান, দেখেন সেখানে দৰ্প করে আগুন উঠেছে জ্বলে।

হয়তো কথাটা বড় আতৌ-ঘা-লাগা বলেই।

হয়তো নিজেও শরৎশশী অহরহ ওই কথাই ভাবে। ধু-ধু মরুভূমির মত জীবনের স্তব্ধ বালুভূমিতে যখন টাকার স্তূপ এসে পড়ে, তখন সে টাকাকে যে বিষের মতই লাগে তার।

বাড়িতে গোয়ালভর্তি গরু, রাশি রাশি দুধের ক্ষীর ছানা মিষ্টি খাবার তৈরি করে শরৎশশী, যদি তার দুটো খায় তো দশটা বিলোয়। কোথা থেকে কে জানে বড় বড় মাছ এসে পড়ে উঠোনে, কাটলে যজ্ঞি হয়, সেই মাছ চাকর-বাকরে খায় তিন ভাগ। কারণ পাড়ার লোককেও সর্বদা দিতে অস্বস্তি বোধ হয়।

বাগানের ফল আসে বুড়ি ঝুড়ি, আম কাঁঠাল কলা পেঁপে, এটা সেটা। এখন উমাশশী রয়েছে তাই আদর হচ্ছে সেই ফলোদের, নচেৎ তো ফেলাফেলিশ

শরৎশশীর গায়ে এবং বাক্সে গহনার পাহাড়। কিন্তু সুখ কোথায় তার? বরের মাইনে জানতে না পারলেও, উমাশশীর বরের মাইনের চেয়ে কম বৈ বেশি নয়, এ জ্ঞান শরতের আছে। তবে? কিসের টাকায় এত লিপচপানি করালীকান্তর?

উপরি আয়েই তো!

আর দারোগার উপরি আয় কোন ধর্মপথ ধরে আসে?

ভিতরে জ্বালা আছে শরৎশশীর।

তদুপরি জ্বালা আছে স্বামীর চরিত্র নিয়ে। কিন্তু সেসব তো প্রকাশের বস্তু নয়। উমাকে আর তার ছেলেমেয়েকে খাইয়ে-মাখিয়ে দিয়েথুয়ে চোখ ধাঁধিয়ে রেখে নিশ্চিত ছিল, হঠাৎ দেখতে পেল নির্বোধ উমারও চোখ ফুটেছে। কিসে শান্তি, কিসে সুখ, সেটা ধরে ফেলেছে।

অতএব শরৎশশীর চোখে দৰ্প করে আগুন জ্বলে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক।

শরৎশশী সে আগুন চাপা দিতেও চেষ্টা করে না। বলে ওঠে, জামাইবাবুর কাজটা ভাল নয়? ও! তবে ভালটা কার? চোর ডাকাত খুনে গুণ্ডাদের? ওলো, এই খারাপ কাজ করা লোকগুলো আছে বলেই এখনো রাজ্য চলছে, বুঝলি? নচেৎ অরাজক হয়ে উঠতো।

ভীতু উমাশশী ভয়ে কাটা হয়ে যায়, শিউরে উঠে বলে, তা বলি নি দিদি। বলছি জামাইবাবুর পক্ষে ভাল নয়। সময়ে নাওয়া-খাওয়া নেই, দিনে রাতে জিরেন নেই, সদাই ভয়-ভয়—

হঠাৎ নিজেকে সংবরণ করে নেয়। উমা, অলক্ষ্যে মার কাছে চিমটি খেয়ে।

চিমটির সাহায্যে সতর্ক করে দিয়ে সুখদা নিজেই হাল ধরেন।

না ধরে করবেন কি?

বলতে গেলে শরৎশশীর সাহায্যেই মোটামুটি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, বছরে দু-চার মাস তো থাকেনই তার কাছে, তাছাড়া বাকী সময়টা যেখানেই থাকুন, হাতখরচটা এখান থেকেই যায়!

নেহাৎ নাকি বদলির চাকরি করালীকান্তর, তাই এক নাগাড়ে থাকা হয় না। ব্যাণ্ডেলে বদলি হয়ে এসে পর্যন্ত আছেন। এখানে যত বড় কোয়াটার, তত বড় বাগান, তত লোকজনের সুবিধে, এলাহি কাণ্ড! এর অধিকারিণীকে চটাবেন? হাল অতএব ধরতেই হয়।

ধরেন, বলে ওঠেন, আগে কি এমন ভয়তরাস ছিল? না এত খাটুনীই ছিল? সোজাসুজি চুরিডাকাতি খুনখারাপি হতো, সোজাসুজি ব্যবস্থা ছিল। পোড়ার মুখো স্বদেশী ছোঁড়াগুলো যে উৎপাত করে মারছে। গুলি বারুদ তৈরি করে ব্রিটিশ রাজত্ব উড়িয়ে দেবে! ভাদ্দরঘরের ছেলে হয়ে ডাকাতি করবে! এইসব জ্বালাতেই বাছার নাওয়া-খাওয়া নেই। লক্ষ্মীছাড়া ছোঁড়াদের না হয় মা-বাপ নেই, পুলিস বেচারাদের তো ঘরে বৌ ছেলে আছে!

স্বদেশী স্বদেশী, এই শব্দটা অনবরতই কানে আসে বটে। উমাশশীর, কিন্তু স্বদেশী ছোঁড়াদের গুণাগুণ কি, তাদের কার্যকলাপ কি, তা নিয়ে মাথা ঘামাতে যায় নি কোনদিন, তাই আজ একটু থতমত খায়।

ভয়ে ভয়ে বলে, রাগ কোর না। শরৎদি, এত কথা তো জানি না। তাই বলছিলাম—

না, রাগের কি আছে? শরৎশশী উদাস গলায় বলে, আগেকার আমলে চোরের পরিবার ভয়ে কাটা হয়ে থাকতো বর কখন ধরা পড়ে, আর এখন পুলিসের পরিবারকে সশঙ্কিত হয়ে থাকতে হয়, বর। কখন মারা পড়ে, এই আর কি! কাজটা ভাল নয়, একপক্ষে বলেছিসই ঠিক। নিঃশ্বাস ফেলে শরৎশশী। হয়তো উমার কুণ্ঠা লজ্জা ভয় দেখে মায়া হয়, তাই আগুনটা সামলে নেয়, বলে, প্ৰাণ হাতে করে থাকা! এই যে রাত-বিরেতে বেরিয়ে যাচ্ছে মানুষ, যাচ্ছে তো সাপের গর্তে হাত দিতে, বাঘের গুহা খোঁচাতে! ফিরবে তার নিশ্চয়তা আছে? তবু বুক বেঁধে থাকতেই হবে, কতৰ্য্য করতেই হবে। ইংরেজের রাজত্বটা তো লোপাট হতে দেওয়া চলে না!

সুখদা ফোঁড়ন কেটে ওঠেন, কার অন্ন খাচ্ছিস? কার হাতে ধনপ্ৰাণ? তা ছোঁড়ারা ভাবছে না গো। কই, পারছিস গোরাদের সঙ্গে? শয়ে শয়ে তো জেলে যাচ্ছিাস, পুলিসের লাঠিতে মুখে রক্ত উঠে মরছিস, তবু হায়া নেই!

রক্ত ওঠায় কথায় শিউরে ওঠে উমা। আস্তে বলে, জামাইবাবুর হাতে ধরা পড়েছে। কেউ?

পড়ে নি? শরৎশশী দৃপ্ত গলায় বলে, গাদা-গাদা! তোর জামাইবাবু বলে, আমি গন্ধ পাই। সুমুদুরের তলায় লুকিয়ে থাকলেও টেনে বার করতে পারি।

উমা একটা নিঃশ্বাস ফেলে।

জামাইবাবুর কর্মদক্ষতায় খুব বেশি উৎসাহ বোধ করে না। হলেই বা স্বদেশী ছোঁড়া, মা-বাপের ছেলে তো বটে। আর এই সূত্রে তার মেজ জায়ের কথা মনে পড়ে যায়।

স্বদেশী শব্দটার ওপর যার প্রাণভরা ভক্তি।

অথচ আসলে ওই শব্দটা যে ঠিক কি তাই ভাল করে জানে না। উমা।

মানুষ?

না জিনিস?

নাকি কোনো কাজ?

কে জানে! ঠিক ধরা যায় না!

মেজ বৌকে জিজ্ঞেস করতেও ভয় করেছে। ওসব কথায় এমন চড়ে ওঠে, এমন বিচলিত হয়, দেখলে ভয় করে। উমা ভাবে, থাক গে, জেনেই বা কি হবে? আদার ব্যাপারী জাহাজের খবরে দরকার কি?

কিন্তু এখানে এসে জামাইবাবুর কার্যকলাপ দেখে মনে হচ্ছে, একটু বুঝি জানা-বোঝা ভালো। তাহলে এমন অন্ধকারে থাকতে হয় না। বুঝতে পারা যায়, কোনটা পাপ কোনটা পুণ্যি!

সুখদা সগৌরবে বলেন, শুনিলি তো?

সুখদার কথায় শরৎশশী সচেতন হয়। বলে, থাক মাসী ওসব কথা। দেশের সর্বনাশ যে আসন্ন তা বোঝাই যাচ্ছে। গোরারা একবার ক্ষেপলে কি আর রক্ষে থাকবে! তবে যারা কর্তব্যনিষ্ঠ, যারা বৃটিশের নেমক খাচ্ছে, তারা মরবে। তবু নেমকহারামী করবে না, এই হচ্ছে সার কথা। তাতে প্ৰাণ চলে যায় যাক।

কিন্তু এইটাই কি শরৎশশীর প্রাণের কথা? নাকি সে শাক দিয়ে মাছ ঢাকে? কথা দিয়ে মুখ বন্ধ রাখে! ওই নির্বোধ উমাটা একেই দশমাতা হয়ে অহঙ্কারে মরছে, তার পর যদি টের পায়, পুরষ্কাশীর যা কিছু চাকচিকা সবই ভুয়ো, যা কিছু আলো জােনাকির আলো, তা হলে আর রইলো কি?

তা যতই শরৎশশী তার ভাগ্যকে আড়াল করুক, ছোট ছেলেমেয়েগুলোর চোখ এড়ায় না। তারা মহোৎসাহে খবর সন্ধান করতে থাকে।

তারা টের পেয়ে যায় মেসোমশাই যাদের সঙ্গে চুপি চুপি কথা কন, তারা হচ্ছে গোয়েন্দা, যেখানে ওই স্বদেশী গুণ্ডারা লুকিয়ে আছে সেখানের সন্ধান এনে দেয় ওরা। মেসোমশাই তখন ছোটেন সেখানে। সেই ছেলেদের চাবুক মারতে মারতে পিঠের ছাল তোলেন, লাথি মারতে মারতে পেট ফাটান, ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে জেলে পোরেন।

ভীষণ একটা উত্তেজনা অনুভব করে ওরা। নেহাৎ ছোট পাঁচটাকে বাদ দিলেও, বাকি কজন আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারে। আর সেই সূত্রে পাকা মেয়ে টেঁপি একটা প্রখর সত্য দাদা-? দিদিদের সামনে ধরে দেয়।

মেজখুড়ি যদি টের পায় আমরা পুলিসের বাড়িতে আছি, মেজখুড়ি আর ছোঁবে না। আমাদের। কথাই কইবে না।

চমকে যায়। তার দাদা-দিদিরা।

বলে, তাই তো রে, টেঁপি তো ঠিক বলেছে!

বাঃ, আমরা বুঝি ইচ্ছে করে পুলিসের বাড়িতে আছি? বললো একজন।

আর একজন চিন্তিতভাবে বলে, তা বললে কি হবে, মেজখুড়ির রাগ জানিস তো। তার ওপর আবার শুধু পুলিস নয়, স্বদেশী মারা পুলিস!

মেজখুড়ি রাগ করলো তো বয়ে গেল, এ কথা ওরা ভাবতেই পারে না। মেজখুড়ির অপ্ৰসন্নতা, সে বড় ভয়ঙ্কর দুঃখবহ।

অবশেষে ওরা ঠিক করে, বলা চলবে না। দরকার কি রাগিয়ে মেজখুড়ীকে!

মল্লিকা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, মার জন্যেই এইটি হল আমার। চাপির সঙ্গে ঠাকুমার সঙ্গে চলে যেতাম চুকে যেত। তখন বললো, ছেলে সামলাতে হবে না রে— মাির ভঙ্গীর অনুকরণ করে মল্লিকা, আমাকে তো আর হোসেল সামলাতে হবে না। ওখানে—, এখন দেখছিস তো? রাতদিন কথা বদলা, ন্যাতা কেচে আনি, দুধ খাইয়ে দে! কেনই যে এতগুলো ছেলে-মেয়ে হয় মানুষের? ছোট খুড়ির বেশ! শুধু বুদো—ব্যস!

হঠাৎ মল্লিকার ভাই গৌর হেসে বলে ওঠে, তাহলে তো তোকে আর জন্মাতেই হোত না। শুধু আমি ব্যস! তুই নিতাই, রামু, টেঁপি, টগর, ফুটি, পুঁচকে খোকা, খুকী, সব্বাই পড়ে থাকতো ভগবানের ঘরে।

এটা অবশ্য খুব একটা মনঃপূত হল না মল্লিকার। মল্লিকা জন্মায় নি, সেটা আবার কেমন পৃথিবী!

অনেক আলোচনান্তে অবশেষে কিন্তু স্থির হয় মেজখুড়ির কাছে কিছুই গোপন করা চলবে না, কারণ মেজখুড়ি পেটের ভেতরকার কথা টের পায়। স্পষ্টই তো বলে, আমার একটা দিব্যচক্ষু আছে, বুঝলি! তোরা কে কি লুকোচ্ছিস সব বুঝতে পারি। মিথ্যে কথায় বড় ঘেন্না মেজখুড়ির, অতএব বলা হবে। তবে এটাও জোর করে বোঝাতে হবে, তাদের কী দোষ? তারা তো ইচ্ছে করে মাসীর বাড়ি বেড়াতে আসে নি?

হঠাৎ একসময় শরৎশশীর নজরে পড়ে, সব কটায় মিলে কি যেন গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এসে ভুরু কুঁচকে বলে, কি করছিস রে তোরা?

ওরা অবশ্য চুপ।

শরৎশশী বিস্মিত হয়, বার বার প্রশ্ন করে এবং সহসাই বিশ্বাসঘাতক টেঁপি বলে ওঠে, মেসোমশাই পুলিস তো, সেই কথাই হচ্ছে—

দাদা-দিদিদের সব ইশারা ব্যর্থ হয়।

চিমটি কাটা বিফলে যায়।

শরৎশশী। যখন কঠিন গলায় বলে, পুলিস তো কি হয়েছে! তখন টেঁপি বলে ওঠে, স্বদেশীমারা পুলিস খুব বিচ্ছিরি তো। মেজখুড়ি যদি শোনে আমরা এ বাড়িতে আছি, তাহলে আর ঘেন্নায় ছোঁবে না। আমাদের, তাই মেজখুড়িকে বলা হবে না—

মেজখুড়ি!

শরৎশশী। শুধু এইটুকুই বলতে পারে।

টেঁপি মহোৎসাহে বলে, হ্যাঁ, মেজখুড়ি যে স্বদেশীভক্ত! জানো না? পুলিসকে ঘেন্না করে, সাহেবকে ঘেন্না করে।

শরৎশশী মুহূর্তকাল স্তব্ধ হয়ে থাকে। তারপর সহসাই কঠোর গলায় বলে ওঠে, বেশ, তবে থাকতে হবে না পুলিসের বাড়ি, চলে যা নিজেদের ভাল বাড়িতে। আজই যা!

১.২১ স্বাধীনতা পরাধীনতা নিয়ে

স্বাধীনতা পরাধীনতা নিয়ে যে যেখানে মাথা ঘামাক, সত্যিকার স্বাধীনতা যদি কেউ পেয়ে থাকে তো পেয়েছে সুবৰ্ণলতার ছেলেমেয়েরা পিসির বাড়ি এসে।

রাতদিন অনেকগুলো রক্তচক্ষুর তলায় থাকতে থাকতে ওরা জানতো না মুক্তির স্বাদ কি, স্বচ্ছন্দচারণের সুখ কি? কারণে-অকারণে হঠাৎ আচমকা কেউ ধমকে উঠবে, এমন আশঙ্কা নিয়েই তাদের জীবন।

বিশেষ করে সেজকাকা!

ছেলেপুলেকে একবার একটু হুড়োহুড়ি করতে দেখলেই বা একবার তাদের একটু হেসে উঠতে শুনলেই তিনি সেই ছেলেপুলের পেটের পিলে চমকে দিয়ে হাঁক দেবেন, কে ওখানে? শুনে যা এদিকে!

ব্যস, তাতেই এমন কাপুনি ধরে যায় যে এদিকে আসবার ক্ষমতা আর থাকে না। অতএব সেই না আসার অপরাধেই বিরাশী সিক্কা, মোগলাই গাট্টা, রামচিমটি, শ্যামচিমটি ইত্যাদি করে অনেক কিছুরই স্বাদ পেতে হয়।

সুবৰ্ণলতা তার ছেলেদের মারে না বলেই বোধ করি সুবৰ্ণলতার ছেলেদের মারবার জন্যে এত হাত নিসপিস করে সেজকাকার।

মা ঠেঙায় না ছেলেদের, এমন মেমসাহেবীয়ানা অসহ্য বলেই হয়তো সেজকাকা মায়ের সেই মেমসাহেবীয়ানার শোধ নেন।

ভাগ্নের গায়ে হাত তুলতে না হয়। হাত কাপে, ভাইপোর গায়ে হাত তোলায় তো সে আশঙ্কা নেই!

সেই আবহাওয়া থেকে এসে মাঠে-মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা। কাদা, মাটি, খড়, বাশ, পাতা লতা নিয়ে যতরকম খেলা তা সব খেলছে। পিসতুতো ভাইবোনেরা সঙ্গী।

কিন্তু আসল মজা হচ্ছে, এখানে এসে অবধি শুধু পিসতুতো দাদা-দিদিরাই নয়, আরো একজন তাদের খেলার মহোৎসাহী সঙ্গী। তিনি হচ্ছেন মা।

হ্যাঁ, মা!

সুবৰ্ণলতা তার বয়েস এবং পদমর্যাদার ভার ফেলে সমবয়সীত্বে নেমে আসে, রীতিমত যোগ দেয় খেলায়। যেমন ছেলেরা উঠোনে মাঝখানে দুদিকে দুটো পুকুর কেটে মাঝখানে একটা সঁকো বানাবে, অথচ জুৎ করতে পারছে না, কঞ্চি আর বাঁখারি নিয়ে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে, সুবৰ্ণলতা এসে পড়ে এবং বসে পড়ে একগাল হেসে বলে ওঠে, আমায় যদি তোদের খেলায় নিস তো আমি করে দিতে পারি।

মাকে নেওয়া না-নেওয়া আবার একটা কথা নাকি? ছেলেরা কৃতাৰ্থমন্য হয়ে বলে ওঠে, তুমি আসবে?

বললাম তো, যদি নিস!

নেবো নেবো, এসো তুমি খেলতে।

অতঃপর নেমেই আসে সুবৰ্ণলতা, নেমে আসে শিশুর খেলাঘরে। তোড়জোড় দেখে কে।

এই, একটা বাঁশ নিয়ে আয় দিকিন!.এই, একটা বড় দেখে গাছের ডাল নিয়ে আয় দিকি!… ওই চারটি বুনো ফুলের চারা আনতে পারিস? আলাদা একটু বাগান করবো!

এমন সব ফরমাশ করে সুবৰ্ণলতা, আর সেই আদেশ পালন করে। ধন্য হয় ছেলেরা।

মা একমুখ হাসছেন।

মা সহজ হালকা সোতে গা ভাসাচ্ছেন। এর থেকে আনন্দের আর কি আছে!

তা আজও সেই আনন্দ দিতে এল সুবৰ্ণলতা।

ওরা কৃতাৰ্থমন্য হয়ে এগিয়ে আসে।

সুবৰ্ণলতা বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে, খেলবো তোদের সঙ্গে। কিন্তু একটা শর্তে!

সুবৰ্ণলতার মুখটা আলো-আলো দেখায়।

তারপর মাটি মাখতে মাখতে আসল কথাটি বলে সুবৰ্ণলতা, আমায় তোদের অম্বিকাকাকুর বাড়িতে একবার নিয়ে যাবি?

অম্বিকাকাকুর বাড়ি!

পরস্পর দৃষ্টি-বিনিময় করে হেসে ওঠে।

অম্বিকাকাকুর বাড়ি! সে তো ওই-ওইটা। ওখানে আবার নিয়ে যাওয়া কি?

অর্থাৎ ওটা আবার একটা নিয়ে যাবার জায়গা নাকি!

সুবৰ্ণলতাও কি তা জানে না?

তবু সুবৰ্ণলতা তার ছেলের সাহায্য প্রার্থনা করে।

একা ফট্‌ করে যেতে পারে না তো, শুধু একটা পুরুষ ছেলের নির্জন ঘরে যাওয়া!

ছেলে একটা সঙ্গে থাকাই ভাল।

তাই কৌতুক-কৌতুক মুখ করে নিয়ে বলে, তা জানি রে বাপু, তবু চল না। মানে খেলার শেষে!

আজকের খেলা একটা সত্যিকার বাড়ি তৈরি। গতকাল অনেক মাটি মেখে ছোট ছোট চৌকো। চৌকো ইট তৈরি করে রেখেছিল, আজ সেইগুলো জুড়ে জুড়ে সত্যিকারী পাকা বাড়ি করা হবে।

প্ল্যান!

সে তো মাথাতেই আছে।

ছোট ছোট সেই ইটগুলো রোদে ভাজা ভাজা হয়ে শক্ত হয়ে গেছে। সুবৰ্ণলতা সেগুলি নাড়তে নাড়তে বলে, এই ঠিক কাজ করছিস। ইট তৈরি করে নিয়ে তবে বাড়ি বানানো খুব ভাল। মজবুত হয়। কারণ শুধু কাদার দেওয়াল নেতিয়ে পড়ে!

তারপর ইটের পর ইট সাজিয়ে দেওয়াল তুলে দেয় সুবর্ণ ওদের। তৈরি হয় শোবার ঘর, খাবার ঘর, রান্নাঘর, ভাড়ারঘর, ঠাকুরঘর।

ভানু পুলকিত গলায় বলে, মা!

কী রে?

তুমি আর-জন্মে বোধ হয় মিস্ত্রি ছিলে!

সুবৰ্ণ হেসে ওঠে, তা ছিলাম হয়তো।

তারপর সুবৰ্ণ কাদামাটির হাত ধুতে ধুতে বলে, এইবার তবে চল!

চলো।

অকৃতজ্ঞ ভানু অনিচ্ছা-মন্থর গতিতে চলে। এইমাত্র মা তাদের বাক্যদত্ত করিয়ে নিয়েছে তাই, নিচেৎ কে চায় এই খেলা ফেলে অম্বিকাকাকার বাড়ি যেতে?

যে অম্বিকাকাকাকে নিত্য দেখতে পাওয়া যায়!

তবু চলে।

সুবৰ্ণলতাও যায়।

সুবৰ্ণলতার বুকটা দুরদুর করে, মনটা ভয়-ভয়, উত্তেজিত-উত্তেজিত।

যেন বিরাট এক অভিযানে বেরিয়েছে সে।

 

কবিতার সন্ধানে অম্বিকার বাড়িতে এসে হাজির সুবৰ্ণলতা।

সংসারজ্ঞানহীন অম্বিকাও কিঞ্চিৎ বিপন্ন না হয়ে পারে না। এতটা সেও আশা করে নি। বারেবারেই তাই বলতে থাকে, কী মুশকিল, বলুন তো! আপনি নিজে এলেন, হুকুম হলে গন্ধমাদন পর্বতটাই বয়ে নিয়ে যেতম!

তারপর হেসে ফেলে বলে, অবশ্য তারপর নিশ্চয়ই হতাশ হতেন। বিশল্যকরণীর চিহ্ন খুঁজে পেতেন না।

কিন্তু কি পেত। আর না পেত। সেকথা ভাবতে বসছে না সুবৰ্ণলতা। সুবৰ্ণলতা রুদ্ধনিঃশ্বাসে আর দুরন্ত আবেগে একটা ধূলিধূসরিত সেলফের মধ্যে রাখা প্রায় জঞ্জালসদৃশ্য কাগজের স্তূপ হাতড়াচ্ছে।

প্ৰকাণ্ড সেলফটার তাকে তাকে নেই। হেন জিনিস নেই। খবরের কাগজের কাটিঙের ফাইল, ইংরেজি-বাংলা নানা পত্রিকার সম্ভার, গোছাগোছা প্রবন্ধের পাণ্ড়ুলিপি, ক্যালেণ্ডার, হ্যাণ্ডবিল, চিঠিপত্রের রাশি, কী নয়! এর মধ্যে থেকে কবিতা উদ্ধার করতে হবে। তাও খাতায় নয়, খুচরো কাগজে লেখা।

সুবৰ্ণলতা সব উল্টোতে থাকে।

অম্বিকা ব্যস্ত হয়ে বলে, দেখছেন তো কী অবস্থা! সৃষ্টির আদি থেকে ধুলো জমে চলেছে। পর পর কেবল চাপানেই হয়, নামানো তো হয় না কোনদিন!

পদ্য-টদ্য এই জঙ্গলের মধ্যে রাখো কেন? ক্ষুব্ধ আবেগে বলে সুবৰ্ণলতা।

পদ্যই বলে। কবিতা বলতে হয়, বললে ভাল শোনায়, অত খেয়াল করে না!

অম্বিকা হেসে বলে, রাখি না। তো, ফেলি। কোনো কিছু ফেলার পক্ষে জঙ্গলই শ্রেষ্ঠ জায়গা।

অম্বিকাদের এই বাড়িটা জ্ঞাতিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বড় বাড়ির ভগ্নাংশ নয়, ছোট্ট একটু একতলা, সম্পূর্ণ আলাদা। অম্বিকার বাবা জ্ঞাতিদের থেকে পৃথক হয়ে আম-জাম-কাঁঠালের বাগানের ধারে এই ছোট বাড়িখানা করিয়েছিলেন। অম্বিকার মা বেঁচে থাকতে ছবির মত রাখতেন বাড়িটিকে, রাখতেন ধূলিমালিন্য শূন্য করে। কিন্তু ছেলের ঘরের এই সেলফটিতে হাত দেওয়ার জো ছিল না। তাঁর। হাত দিলেই নাকি অম্বিকার রাজ্য রসাতলে যেত।

এখন সারা বাড়িতেই ধুলো।

সুবালা অথবা তার মেয়েরা এক-আধাদিন এসে ঝাড়ামোছা করে দিয়ে যায়, অম্বিকা বিকাব্যকি এবং ঝাটা কড়াকড়ি করে, ব্যস!

কিন্তু সুবর্ণর তো ধুলোর দিকে দৃষ্টি নেই। সে ধুলোর আড়াল থেকে মাণিক খুঁজছে।

আরো সেই খোঁজার সূতের পেয়ে যাচ্ছে অনেক মণিরত্ন। কত বই, কত পত্রিকা! ইস, ভাগ্যিাস এল সুবর্ণ এখানে!

ঠাকুরপো, এত বই তোমার? কই বল নি তো?

অম্বিকা অপ্ৰতিভ হাস্যে বলে, বই দেখে এত খুশী হবেন, জানি না তো।

জানো না, বাঃ। সুবর্ণ বলে ওঠে, আমি কিন্তু এগুলো সব পড়বো। রয়েছি তো এখনো, পড়ে নেব তার মধ্যে। w

অম্বিকা হাসে, পড়লে তো বেঁচে যায় ওরা। ধুলোর কবরের মধ্যে পড়ে আছে, উদ্ধার হয় তার থেকে।

সুবৰ্ণ দীপ্ত প্ৰসন্নমুখে বই বাছতে থাকে, এবং বেছে বেছে প্ৰায় গন্ধমাদনই করে তোলে। আলো-জুলা মুখে বলে, এই আলাদা করা থাকলো, কিছু কিছু করে নিয়ে যাব, আবার পড়ে পড়ে রেখে যাবো।

অম্বিকা বলে, জিনিসগুলো এত অকিঞ্চিৎকর যে বলতে লজ্জা করছে, রেখে না গেলেও ক্ষতি নেই, নিয়েই রাখতে পারেন। রাখলে ওই মলাট-ছেড়া ধুলোমাখা কাগজপত্রগুলো কৃতাৰ্থ হয়ে যায়।

সুবৰ্ণ এবার হাসিমুখে বলে, অত্যয় কাজ নেই, একবার পড়তে পেলেই বর্তে যাই। এতদিন রয়েছি, জানি কি ছাই! জানলে তো রোজ এসে হানা দিতাম। উঃ, আজও যাই ভাগ্যিস এসেছিলাম!

আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সুবৰ্ণলতার চোখমুখ সর্বাবয়ব।

অম্বিকা সুবৰ্ণলতার মা সত্যবতীকে দেখে নি। দেখে নি, তাই সহসা অনুভব করতে পারে না। এই আলোর উৎস কোথায়!

অম্বিকা অবাক হয়।

অম্বিকা বোধ করি অপ্ৰতিভাও হয়।

যেন সুবৰ্ণলতা যে এতদিন টের পায় নি। অম্বিকার ঘরের সেলফে চারটি মলাট-ছেড়া সেলাইঢ়িলে পত্রিকা আছে, সেটা অম্বিকারই ক্রটি। সেই অপ্ৰতিভা অপ্ৰতিভা মুখে বলে, আমারই উচিত ছিল আপনাকে দিয়ে আসা-

সুবৰ্ণলতা সরল আনন্দে হেসে ওঠে।

ওমা! তুমি কী করে জানবে যে তোমাদের মেজবৌদি এমন বই-হ্যাংলা! কিন্তু তা তো হলো, যার জন্যে এলাম তার কি! তোমার পদ্যের খাতা কোথায়?

কী মুশকিল! বললাম তো, খাতাটাতা নেই, কদাচ কখনো প্ৰাণে জাগলো কিছু, হাতের কাছে যা পেলাম তাতেই লিখলাম, তারপর কোথায় হারিয়ে গেল!

কখনো না, তুমি ঠিকাচ্ছ।

আরে না, বিশ্বাস করুন।

অম্বিকা হাসে, এই যে তার সাক্ষী–

হঠাৎ বালিশের তলা থেকে টেনে বার করে কয়েক টুকরো বালির কাগজ।

হেসে হেসে বলে, কাল রাত্রে হচ্ছিল খানিকটা কবিত্ব।

কই দেখি দেখি–

সুবৰ্ণ পুলকিত মুখে হাত পাতে।

অম্বিকা চৌকির ওপর রাখে।

হেসে বলে, যা হস্তাক্ষর, তার ওপর আবার কাটাকুটি–

সুবৰ্ণ অবশ্য ততক্ষণে টেনে নিয়ে দেখেছে এবং হস্তাক্ষর সম্পর্কে যে অম্বিকা অতি বিনয় করে নি তা অনুভব করেছে। তাই কুণ্ঠিত হাস্যে বলে, বেশ, তবে তুমিই পড়া।

সুবৰ্ণলতা অবোধ বৈকি।

প্ৰস্তাবটা যে অশোভন, অসামাজিক, এ জ্ঞান হয় না কেন তার? হলেই বা পাঁচটা ছেলে-মেয়ের মা, তবু বয়েস যে তার আজো ত্রিশেও পৌঁছয় নি, এ খেয়াল নেই? একটা সম্পূর্ণ অনাত্মীয় যুবাপুরুযের একক গৃহে এসে বসে তার মুখে কবিতা শুনতে চাওয়ার কথা উচ্চারণ করলো সে কী বলে?

আর অম্বিকা?

সেও কি বাংলার গ্রামের ছেলে নয়?

হয়তো এ একটা নতুন উত্তেজনা বলেই লোভটা সামলাতে পারছে না। তা লোভই। লেখে সে ছেলেবেলা থেকেই, কিন্তু তার কবিতা সম্পর্কে কে কবে আগ্ৰহ দেখিয়েছে! কে কবে এমন আলোেভরা উৎসুক মুখ নিয়ে তাকিয়ে থেকেছে শোনোও বলে!

তাছাড়া আর পাঁচজনের থেকে তফাত বৈকি অম্বিকা। তার পরিমণ্ডলে একটা নির্মল পবিত্রতা, তার অন্তরে একটা অসঙ্কোচ সরলতা। তার কাছে সুবালা এবং সুবৰ্ণলতা একই পর্যায়ের গুরুজন। সুবালার প্রতিও তার যেমন একটি সশ্রদ্ধ ভালবাসা, সুবর্ণর প্রতিও তেমনি একটি সশ্রদ্ধ প্ৰীতি।

তাই সেই খুচরো কাগজ কটা গুছিয়ে নিতে নিতে হেসে বলে, শুনে বুঝবেন বৃথা সময় নষ্ট। এটা হচ্ছে দেশের এখনকার এই পরিস্থিতি নিয়ে—

মা! ভানু ডেকে ওঠে। আমি যাই!

সুবৰ্ণলতা চমকে ওঠে।

ভানু যে এখনো এখানেই ছিল তা খেয়ালই ছিল না। বই দেখেই পাগল হয়ে গিয়েছিল।

এখন ঈষৎ চঞ্চল হয়ে বলে, কেন, চলে যাবি কেন? অম্বিকাকার লেখা পদ্য শোন না!

পদ্য সম্বন্ধে ভানু যে বিশেষ উৎসাহী, ভানুর মুখ দেখে তা মনে হল না। বললো, আমাকে ওরা দেরি করতে বারণ করেছে।

কেন, তুই আবার কী রাজকাৰ্য করে দিবি ওদের?

এমনি।

হঠাৎ সুবৰ্ণলতা ছেলের ভবিষ্যৎ-চিন্তায় তৎপর। হয়। লেখাপড়া তো সব শিকেয় উঠেছে, কর এবার! এরপর যেতে হবে না ইস্কুলে?

অম্বিকা হেসে ওঠে, না, আপনি বড় সাংঘাতিক! একে বেচারাকে জোর করে কবিতা গোলাবার প্ৰস্তাব, তার উপর আবার পড়ার কথা মনে পড়িয়ে দেওয়া। যেতে দিন ওকে। চলুন, বরং ও-বাড়ি গিয়েই পড়া যাক। আমার লাজলজ্জার বালাই নেই। দিব্যি ছাত ফাটাবো!

অম্বিকা স্বাভাবিক বুদ্ধিতেই সুবৰ্ণলতার সঙ্কোচ বোঝে, তাই ও-বাড়ির কথা তোলে।

কিন্তু সুবর্ণ সহসা লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে।

ছি ছি, কী মনে করলো অম্বিকা ঠাকুরপো!

মনে করলো তো, সুবর্ণ একা তার ঘরে বসতে ভয় পাচ্ছে, অস্বস্তি পাচ্ছে।

ছি ছি!

সুবৰ্ণলতা সেই অস্বস্তিকে কাটালো।

সুবৰ্ণলতা দৃঢ় হলো।

বলে উঠল, না না, আবার এখন এ-বাড়ি ও-বাড়ি। পড় তুমি।… এই মুখুটা, যা তুই, পিসি জিজ্ঞেস করলে বলিস, আমি এখানে আছি।

 

সুবৰ্ণ বলেছিল, বলিস। আমি এখানেই আছি। কিন্তু সত্যিই কি তা ছিল সে?

না, আর এক জগতে এসে পড়েছিল!

তা মুখ দেখে তাই মনে হচ্ছিল বটে।

আর এক জগতের-!

অম্বিকা পড়ছিল।

ওই শোনো শোনো সাড়া জাগিয়েছে
কালের ঘূর্ণিপথে—
ভাঙনের গান গেয়ে ছুটে আয়
মরণের জয় রথে।
ওই দেখ, কারা আসে দলে দলে,
দেশজননীর পূজাবেদীতলে,
অক্লেশে প্ৰাণ করে বলিদান
হোমের আহুতি হতে।
তাই দ্বারে দ্বারে ডাক দিয়ে যাই
চল চল ছুটে চল—
কে ওরা ভাঙিছে বন্দিনী মা’র
চরণের শৃঙ্খল।
ওদের সঙ্গে দে মিলায়ে হাত,
বৃথা পশ্চাতে কর আঁখিপাত,
বাঁধিবে কি তোরে শিশুর হাস্য,
প্রিয়ার অশ্রু জল?
এখনো না। যদি ভাঙিতে পারিস-

পড়তে পড়তে থেমে যায় অম্বিকা। কুণ্ঠা-কুষ্ঠা হাসি হেসে বলে, দূর, নিশ্চয় আপনার ভাল লাগছে না।–

ভাল লাগছে না!

সুবৰ্ণ উত্তেজিত গলায় বলে, ভাল লাগছে না। মানে? কে বলেছে ভাল লাগছে না? পড়ো— পড়ে যাও। যে লাইনটা পড়লে, আবার ওইট থেকে পড়ে যাও।

অম্বিকার অস্বস্তি হচ্ছিল।

অম্বিকার নিজের মন যতই উদার আর নির্মল হোক, পাড়াগায়ের ছেলে সে। অনাত্মীয় তো দুরের কথা, নিকট-আত্মীয় পুরুষের ঘরেও এমন একা বসে গল্প করলে যে মেয়ের ভাগ্যে ভর্ৎসনা জোটে, তার নামে নিন্দে রটে, তা তার জানা।

তার ওপর আবার কবিতা শোনা!

তবু সুবর্ণর ঐ আবেগ-আবিষ্ট ভাল লাগার মুখটা বেশ একটা নতুন আনন্দের স্বাদ এনে দিচ্ছে। সত্যি এমন করে এমন একটা আগ্রহ-উৎসুক। মনের সামনে কবে অম্বিকা নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি করতে পেরেছে?

তাছাড়া অস্বস্তি যেমন ওদিকে, তেমনি এদিকেও। অম্বিকার অস্বস্তি ভাবটা যদি মেজবৌন্দির মুখ ধরা পড়ে যায়। তাতেও লজ্জার সীমা নেই। উনি স্ত্রীলোক হয়ে সাহস করে বসে রইলেন, আর অম্বিকা–

দূর, উনি কত বড় গুরুজন, ওঁর কাছে আবার—

অতএব আবার গলা ঝেড়ে শুরু করে দেয় অম্বিকা,

এখনো না। যদি ভাঙিতে পারিস,
কখনো কি হবে আর?
লৌহনিগড় গড়িবে আবার
প্ৰবলের অনাচার।
মরণকুণ্ডে ঝাঁপ দিতে এসে,
নতশিরে কি করে ফিরে যাবি শেষে?
মস্তকে বহি কাঁটার মুকুট
ললাটে অন্ধকার!
বিশ্বজগৎ টিটকারি দেবে
ধিকৃত উপহাসে,
ষষ্টি-আহত পশুর সমান
কাপুরুষ ক্রীতদাসে। ভা
বী তনয়ের ললাটে কি ফেরা
দিয়ে যাবি এই কলঙ্ক-জের—

এই সেরেছে!

অম্বিকা হাতের কাগজগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে থাকে। বিপন্নমুখে বলে, এর পরের পৃষ্ঠােটা আবার কোথায় গেল?

নেই!

সুবৰ্ণ চমকে ওঠে।

আশা ভঙ্গের উত্তেজনায় বলে, কি করে রাখো কাগজপত্ৰ! কি করলে ছাই! রয়েছে তো কাগজ তোমার হাতে-

অম্বিকা অপ্রতিভা মুখে বলে এটা শেষ পৃষ্ঠা। মাঝখানটা একটা টুকরো কাগজে ছিল—

আশ্চর্য! সুবৰ্ণর মনে আসে না, সুবর্ণ অম্বিকার অভিভাবক নয়। মনে আসে না, ওকে তিরস্কার করবার তার অধিকার আছে কিনা। প্রায় অভিভাবকের ভঙ্গীতেই ক্রুদ্ধ তিরস্কার করে ওঠে, ধন্যি ছেলে! আমন-ভাল জিনিসটা হারিয়ে ফেললে?

অম্বিকা অপরাধী-অপরাধী ভাবে বালিশের তলায় হাত বুলোয়, তোষক উল্টে দেখে। সুবৰ্ণও চৌকির তলায় উঁকি মারে হেট হয়ে, তারপর বিফলমনোরথ হয়ে বলে, নাঃ! সে নির্ঘাত হাওয়ায় উড়ে বনেজঙ্গলে চলে গেছে। মুখস্থ নেই?

অম্বিকা কুণ্ঠিত হাসি হাসে, নাঃ! এই তো মাত্ৰ কাল রাত্রে লিখেছি—

যাক গে, শেষটাই পড়। এত ভাল লাগছিল!

অম্বিকা আবার পরের পাতাটায় চোখ ফেলে। বোধ করি নিজের ওই মুখস্ত না থাকার জন্যে মরমে মারে। সেই কুণ্ঠিত গলাতেই পড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই—

কালিমাখা মুখে পৃথিবীর বুকে
টিকে থেকে কিবা ফল,
অকারণ শুধু ধ্বংস করিতে
ধরার অন্নজল?
যে মাটি আগুলি রহিবি বসিয়া–
দাবিদাওয়াহীন সে মাটির ঋণ
শোধ দিবি কিসে বল?
নাড়া দিয়ে ভোঙ। পুরনো দেওয়াল,
কতকাল রবে খাঁড়া?
মাথা তুলে আজ দাঁড়া!
বীরদাপে যারা করে অন্যায়,
তারা যেন আজ ভাল জেনে যায়,
বিষবৃক্ষের উচ্ছেদ লাগি,
মাটিতেও জাগে সাড়া!

অম্বিকা ঠাকুরপো!

সহসা যেন একটা আৰ্তধ্বনি করে ওঠে সুবৰ্ণলতা। কী ভাগ্যি অম্বিকার হাতটাই চেপে ধরে নি!

অম্বিকা ঠাকুরপো, ওইখানটা আর একবার পড়ো তো—

অম্বিকা বিস্মিত হয়।

অম্বিকা বিচলিত হয়।

তাকিয়ে দেখে সুবর্ণর মুখে আগুনের আভা, সুবৰ্ণর চোখে জল।

আশ্চর্য তো!

মানুষটা এত আবেগপ্রবণ?

একটু যেন ভয়-ভয় করছে।

কই পড়ো?

সুবৰ্ণর কণ্ঠে অসহিষ্ণুতা, এ তো শুধু এই পরাধীন দেশের কথাই নয়। এ যে আমাদের মতন চিরপরাধীন মেয়েদের কথাও। কী করে লিখলে তুমি? পড়ো, পড়ো আর একবার—

অম্বিকা যেন বিপন্ন গলায় আর একবার পড়ে—

নাড়া দিয়ে ভোঙ পুরোনো দেওয়াল–
কতকাল রবে খাঁড়া?
মাথা তুলে আজ দাঁড়া!
বীরদাপে যারা করে অন্যায়,
তারা যেন আজ–

নাঃ, সুবৰ্ণলতার আজকের দিনটা বুঝি একটা অদ্ভুত উল্টোপাল্টা দিয়ে গড়া!

ভালো আর মন্দা!

আলো আর ছায়া!

পদ্ম আর পঙ্ক!

তা নইলে এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটে?

যখন সুবৰ্ণলতা মুগ্ধ বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একটা পরপুরুষের মুখের দিকে, যখন সুবর্ণর মুখে আলোর আভাস আর চোখে জল এবং যখন এই অনাসৃষ্টি দৃশ্যের ধারে-কাছে কেউ নেই, তখন কিনা সে দৃশ্যের দর্শক হবার জন্যে দরজায় এসে দাঁড়ায় সুবৰ্ণলতার চিরবাতিকগ্ৰস্ত স্বামী! যে নাকি এযাবৎকালে আপন চিত্তের আগুনেই জ্বলে-পুড়ে খাক হলো!

সেই জ্বলে-পুড়ে মরা মানুষের সামনে জ্বলন্ত দৃশ্য!

দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।

থিয়েটারি ঢঙে বলে উঠেছে, বাঃ বাঃ—কেয়াবাৎ! এই তো চাই!

পুরনো দেওয়াল অটুট রইল, বিষবৃক্ষেত্র পাতাটি মাত্র খসলো না, মাটির সাড়া মাটির মধ্যেই স্থির হয়ে রইল, সুবৰ্ণ তাড়াতাড়ি মাথার কাপড়টা একটু টেনে দিয়ে বলে উঠলো, তুমি হঠাৎ? চাঁপা ভালো আছে তো?

হ্যাঁ, যে মুহূর্তে আচমকা দরজায় প্ৰবোধের মূর্তিটা ফুটে উঠেছিল, সেই চকিত মুহূর্তটুকুতে চাঁপার কথাটাই মনে এসেছিল সুবৰ্ণলতার।

হঠাৎ ও কেন এমন বিনা খবরে? চাঁপার কোনো রোগবালাই হয় নি তো?

কিন্তু সেই চকিত চিন্তার পরমুহূর্তেই দূর হয়ে গেল সে আশঙ্কা! তেমন হলে ঐ থিয়েটারি ঢঙে কোয়াবাৎটা হতো না নিশ্চয়। এ আর কিছু নয়, গোয়েন্দাগিরি!

ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠলো মাথা, সারা শরীরের মধ্যে বয়ে গেল বিদ্যুৎপ্রবাহ, তবু ফেটে পড়তে পারা গেল না। সামলে নিতে হলো নিজেকে। মাথায় কাপড় টেনে উদ্বিগ্ন গলায় বলতে হলো, তুমি যে হঠাৎ? চাপা ভালো আছে তো?

বিদ্যুৎপ্রবাহকে সংহত করতে শক্তিক্ষয় হচ্ছে বৈকি, তবু উপায় কি? ঐ সভ্য ভদ্র উদার ছেলেটার সামনে তো আর সুবর্ণ তার স্বামীর স্বরূপটা উদঘাটিত করতে পারে না, তাদের ভিতরের দাম্পত্য সম্পর্কের স্বরূপ!

কিন্তু সুবর্ণর শক্তিক্ষয়ে কি রক্ষা হলো কিছু?

সুবৰ্ণর স্বামী কি মহোল্লাসে নিজের গায়ে কাদা মাখল না? নিজের মুখে চুন-কালি?

মাটিতে মিশিয়ে দিল না। সুবর্ণর সমস্ত সম্ভ্রম? দিল। সুবর্ণর জীবনের সমস্ত দৈন্য উদঘাটিত করে দিল সুবর্ণর স্বামী। বলে উঠলো, চাপা? ওসব নাম মনে আছে তোমার এখনো? আশ্চয্যি তো!-চাঁপার খবর জানি না, তবে চাঁপার মা যে খুব ভালো আছে, তা প্রত্যক্ষ করছি। বাঃ! চমৎকার! সাধে কি আর শাস্ত্ৰে বলেছে, সাপ আর স্ত্রীলোক এই দুইকে কখনো বিশ্বাস করতে নেই।

সুবৰ্ণ হঠাৎ অদ্ভুত রকমের শান্ত হয়ে যায়।

শান্ত-শান্ত ভাবেই হেসে ওঠে। হেসে উঠে বলে, শাস্ত্ৰে বলে বুঝি? দেখছো অম্বিকা ঠাকুরপো, আমার স্বামীর কী শাস্ত্ৰজ্ঞান! তা বলেছ ঠিকই, ভালই আছি। খুব ভাল আছি। তোমার এই বোনের দেশ থেকে যেতেই ইচ্ছে হচ্ছে না-

যেতেই ইচ্ছে হচ্ছে না! প্ৰবোধ নিমপাতা গেলা গলায় বলে, তা অনিচ্ছে তো হবেই, এখানে যখন এত মধু!… কী মশাই, আপনিই না। আমার বোনাইয়ের সেই দেশোদ্ধারী ভাই? তা দেশোদ্ধারের পথটা দেখছি ভালই বেছে নিয়েছেন! নির্জনে পরস্ত্রীর সঙ্গে রসালাপ—

আঃ মেজদা, কী বলছেন যা তা—, অম্বিকা যেন ধমক দিয়ে ওঠে, ছোট কথা বলবেন না। ছোট কথা আর কারো ক্ষতি করে না, নিজেকেই ছোট করে!

মেজদা! ধমক!

প্ৰবোধ একটু থিতামত খায়, কারণ প্ৰবোধ এই উল্টো ধমকের জন্যে প্ৰস্তৃত ছিল না। তবে থতমত খাওয়াটা তো প্ৰকাশ করা চলে না, তাই সামলে নেয়। তবে গলায় আগের জোর ফোটে না।

ফিকে ফিকে গলায় বলে, ছোট! ই, আমরা ক্ষুদ্র মনিষ্যি, আমাদের আবার ছোট হওয়া!

ক্ষুদ্ৰই বা ভাববেন কেন নিজেকে? অম্বিকা ধীর গলায় বলে, নিজেকে ক্ষুদ্রও ভাবতে নেই, অধমও ভাবতে নেই। মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের বিকাশ!

ওঃ, লম্বাচওড়া কথা! উপদেশ! শুরু এসেছেন! প্ৰবোধ এবার নিজ মূর্তিতে ফেরে। বলে, ওঃ, নিরালায় ঈশ্বরসাধনাই হচ্ছিল তা হলে? আমি এসে ব্যাঘাত ঘটালাম! কী আর বলবো, আপনি কুটুমের ছেলে, বোনাইয়ের ভাই, আপনার অপমান তার অপমান। তাই পার পেয়ে গেলেন। এ অন্য কেউ হলে তাকে জুতিয়ে পিঠের ছাল তুলতাম। আর এই যে বড়সাধের মেজবৌদি! চল তুমি, তোমাকে আমি দেখে নিচ্ছি গিয়ে। অবাক কাণ্ড! একঘর ছেলেপিলে, বয়সের গাছপাথর নেই, তবু কুবাসনা ঘোচে না? তবু ইচ্ছে করে পরপুরুষের দিকে তাকাই? যাক, তার জন্যে ভাবি না। মেয়েমানুষকে কি করে শায়েস্তা করতে হয় তা আমার জানা আছে।

অবাক কথা বৈকি, তবু সুবর্ণ ফেটে পড়ে না। বরং প্রায় হেসেই বলে, জানো নাকি? তা তবু তো শায়েস্তা করে উঠতে পারলে না। আজ অবধি।… নাও চলো, এখন দেখ শায়েস্তা করে শূলে দেবে কি ফাঁসি দেবে! এই ভালমানুষ ছেলেটাকে আর ভয় পাইয়ে দেব না বাপু, পালাই। … অম্বিকা ঠাকুরপো, ওই পদ্যটা কিন্তু আমার চাই ভাই। একটু কষ্ট করে ওর একটা নকল করে দিও আমায়।

তা প্ৰবোধ দেবতা নয়!

রক্তমাংসের মানুষ সে।

অতএব গোড়ার জিনিস ঐ রক্তটাই তার টগবগিয়ে ফুটে ওঠে স্ত্রীর ঐ প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গের দাহে। সুবৰ্ণ যদি ভয় পেত, যদি গুটিয়েসুটিয়ে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে আসতো, আর ঐ পাজী লক্কা ছেলেটা যদি প্ৰবোধকে দেখে বেত-খাওয়া-কুকুরের মত ঘাড় নিচু করে পালিয়ে প্ৰাণ বাঁচাতো, তা হলে হয়তো প্ৰবোধ এত ফেটে পড়তো না।

কিন্তু সেই স্বাভাবিক হলো না।

হলো একটা অভাবিত বিপরীত।

ছোঁড়াটা এলো বড় বড় কথা কয়ে উপদেশ দিতে, আর সুবর্ণ কিনা স্বামীকেই ব্যঙ্গ করলো!

অতএব প্ৰবোধও ফেটে পড়লো।

উগ্ৰমূর্তিতে বলে উঠলো, শূল কেন, ফাঁসি কেন? পায়ে জুতো নেই। আমার? জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে না দেওয়া পর্যন্ত তোমার মতন বেহায়া মেয়েমানুষের মুখ বন্ধ করা যাবে না! বেরিয়ে এসো! বেরিয়ে এসো বলছি! এতদিন পরে স্বামী এলো, ধড়ফড়িয়ে উঠে আসবে, তা না, পরপুরুষের বিছানায় বসে বসে স্বামীকে মস্করা! আর তুমি শালা-

তা অনেক সামলেছে নিজেকে প্ৰবোধ। স্ত্রীর চুলের মুঠি ধরে নি, এবং শালা শব্দটা উচ্চারণ করেই থেমে গেছে।

সুবৰ্ণ এবার উঠে আসে।

কেমন একটা অবিচলিত ভাবেই আসে।

আর সব চেয়ে আশ্চর্য, এর পরেও সেই পরপুরুষের সঙ্গে কথা কয়। বলে, মিথ্যে তোমরা দেশ উদ্ধারের স্বপ্ন দেখছো অম্বিকা ঠাকুরপো। দেশকে আগে পাপমুক্ত করবার চেষ্টা করো। …এই মেয়েমানুষ জাতটাকে যতদিন না। এই অপমানের নরককুণ্ডু থেকে উদ্ধার করতে পারবে, ততদিন সব চেষ্টাই ভস্মে ঘি ঢালা হবে।

প্ৰবোধের সঙ্গে এসেছিল সুবালার ছোট ছেলেটা। তাকেই বলেছিল সুবালা, এই যা। যা, ছুটে যা, তোর মেজমামীকে ডেকে নিয়ে আয়, অম্বিকা কাকার বাড়িতে আছে বোধ হয়।

প্ৰবোধ সেই মাত্র খুলে রাখা জুতোটা আবার পায়ে গলিয়ে বলেছিল, চল, আমিও যাচ্ছি!

সুবালা প্ৰমাদ গনেছিল।

সুবালা তার মেজদাকে অনেকদিন না দেখলেও একেবারে চেনে না তা তো নয়! তাই বলে উঠেছিল, তুমি আবার কি করতে যাবে গো! এই তেন্তেপুড়ে এলে, তুমি বোসো, হাতমুখ ধোও, ও যাবে আর আসবে! তুমি ততক্ষণ একটু মিছরির পানা খাও—

প্ৰবোধ বোনের এই সহৃদয় আতিথ্যের আহবানে কর্ণপাত করে নি। গাঁট গট করে এগিয়ে গিয়েছিল ছেলেটাকে চল বলে একটা হুমকি দিয়ে।

সুবালা কিংকৰ্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, মেজদার পিছু পিছু গেলে যে ভাল হতো, সেটা তখন মনে পড়ে নি। তার।

মনে পড়িয়ে দিলেন ফুলেশ্বরী। বললেন, তুমিও গেলে পারতে বৌমা, মনে হচ্ছে মেজ ছেলে একটু রাগী মানুষ-

একটু রাগী? সুবালাও রেগে ওঠে, বলে, আজন্মের গোয়ার! বেঁটাকে কি তিলার্ধ স্বস্তি দেয়! রাতদিন সন্দেহ, ওই বুঝি বৌ মন্দ হলো! তার ওপর আবার—মেজবৌই বা মরতে একা মেয়েমানুষ পদ্য শুনতে ওর ঘরে গেল কোন ছাই, তাও জানি না।

পদ্য শুনতে!

হ্যাগো, বললো তো তাই কানু। মা অম্বিকা কাকার বাড়ি আছে পিসি, পদ্য শুনবে! পদ্যটদ্য লেখে তো ঠাকুরপো, আর মেজবৌও তেমনি পাগলী! জানিস যখন বর ওইরকম—

ফুলেশ্বরী আস্তে বলেন, সংসারে এই পাগলদেরই সবচেয়ে বিপদ বৌমা। সুবর্ণর মতন মেয়ে সংসারে দুর্লভ। কিন্তু সবাই তো ওকে বুঝবে না। একা বেটাছেলের বাড়িতে যেতে নিন্দে, এ বোধই নেই। ওর, গঙ্গাজলে ধোওয়া মন ওর।

তা তো ধোওয়া! এখন জানি না কি খোয়ার হয়। যা আগুন হয়ে গেল মেজদা!

তাতেই বলছিলাম, তুমি সঙ্গে গেলে পারতে!

তাই দেখছি। কিন্তু এখন আবার গেলে—

তা হোক বৌমা, তুমিও যাও। রাগের মাথায় যদি ছেলে সুবৰ্ণকে একটা চড়া কথা বলে বসেন, ভারী লজ্জার কথা হবে। অম্বু আমাদের আপনি, ওদের তো কুটুম!

তবে যাই। উনুনে যে আবার দুধ বসানো।

দুধ আমি দেখছি। তুমিও যাও। আমার মন নিচ্ছে দাদা তোমার বকাবিকি করবে।

সুবালা অতএব দাওয়া থেকে নামে।

আর মনে মনে ভাবে, মেজদার এই দুম করে আসাটাই ফন্দির। জানি তো সন্দেহবাতিক মানুষ। আর মজা দেখ, কোনোদিন মেজবৌয়ের এ খেয়াল হয় না, মরতে ছাই আজই! মেজদাকে বলিহারি! আমন পরিবার, মর্ম বুঝল না। বুঝবে কি, মৰ্ম বস্তু নিজের থাকলে তো!

দ্রুত এগোতে থাকে সুবালা।

হয়তো সুবালা ঠিক সময় পৌঁছতে পারলে ব্যাপার সমে আসতো। হয়তো সুবালাই গিয়ে বলে উঠতো— কী জ্বালা! মেজবৌ, তুই এখানে বসে বসে পদ্য শুনছিস? আর মেজদা যে ইদিকে মনকেমনের জ্বালায় ছুটেপুটে চলে এসে তোকে না দেখে বিশ্বভুবন অন্ধকার দেখছে!

হয়তো যা হোক করে কেটে যেত ফাঁড়া।

কিন্তু কাটবার নয়, তাই কাটল না।

সুবালা বেরিয়ে দুপা যেতেই গরুর রাখালটা কাঁদো কাঁদো হয়ে ধরলো, অ মা, মুংলির বাছুরটা পেলে গেছে—

পালিয়ে গেছে!

হিঁ গো মা! ক্যাতো খুঁজানু—, বরে বিবরণ দিতে বসে তার খোঁজা পর্বের।

আচ্ছা তুই দাঁড়া, আমি আসছি—, বলে সুবালা এগিয়ে যায়, কিন্তু যখন পৌঁছায়, তখন তার মেজদা শেষ বাণী উচ্চারণ করছে।

জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে না দিলে যে মেয়েমানুষ শায়েস্তা হয় না, সেই অভিমত ব্যক্ত করছে।

সুবালার মরমে মরে যায়।

অম্বিকা ঠাকুরপোর সামনে এইসব কথা! তা-ও সুবালারই দাদার মুখ থেকে! নিরুপায় একটা আক্ষেপে হঠাৎ চোখে জল আসে তার। যেমন এসেছিল তেমনি দ্রুতপায়ে ফিরে যায়।

সুবৰ্ণলতা টের পায় না, তার এই অপমানের আরো একজন সাক্ষী রয়ে গেল।

 

কিন্তু অত অপমানের পর আবার সুবৰ্ণ সেই স্বামীর পিছু পিছু সেই স্বামীর ঘরে ফিরে গেল? সুবৰ্ণলতা না। সত্যবতীর মেয়ে?

 ১.২২ সুবৰ্ণলতা না সত্যবতীর মেয়ে

তাই তো! সুবৰ্ণলতা না সত্যবতীর মেয়ে! যে সত্যবতী স্বামীর কাছ থেকে আঘাত পেয়ে এক কথায় স্বামী-সংসার ত্যাগ করে গিয়েছিল, আর ফেরে নি!

মায়ের সেই তেজের কণিকামাত্ৰ পায় নি। সুবৰ্ণলতা? সত্যবতী তার মেয়ের এই অধোগতি দেখে ধিক্কার দেবে না? বলবে না, ছিছি সুবর্ণ তুই এই!

সে ধিক্কারের সামনে তো চুপ করে থাকতে হবে সুবৰ্ণকে মাথা হোঁট করে!

নাকি করবে না মাথা হেঁট?

মুখ তুলেই তাকাবে মায়ের দিকে?

বলবে, মা, তোমার অবস্থায় আর আমার অবস্থায়? সেখানে যে আকাশ-পাতাল তফাৎ!

তা বলতে যদি পারে সুবর্ণ, বলতে যদি পায়, মিথ্যা বলা হবে না। আকাশ-পাতালই। সুবর্ণর মার র পৃষ্ঠাপটে ছিল এক অত্যুজ্জ্বল সূৰ্যজোতি, সত্যবতীর বাবা সত্যবতীর জীবনের ধ্রুবতারা, সত্যবতীর জীবনের বনেদ, সত্যবতীর মেরুদণ্ডের শক্তি

সুবৰ্ণর পৃষ্টপটে শুধু এক টুকরো বিবর্ণ ধূসরতা! সুবর্ণর কাছে বাবার স্মৃতি-বাবা, প্রতারণা করে তার বিয়ে ঘটিয়ে জীবনটাকে ধ্বংস করে দিয়ে নির্লিপ্ত হয়ে বসে আছে।

সুবৰ্ণর বাবা সুবর্ণর ভাগ্যের শনি!

আর স্বামীভাগ্য?

সেও কি কম তফাৎ? সত্যবতীর স্বামী অসার অপদার্ধ ছিল। কিন্তু অসভ্য অশ্লীল ছিল না। সত্যবতীর অযোগ্য হতে পারে, তবে সে অত্যাচারী নয়। কিন্তু সুবৰ্ণলতার ভাগ্যে তো মাত্র ওই দ্বিতীয় বিশেষণগুলোই। আজীবন সুবৰ্ণকে একটা অসভ্য, অশ্লীল আর অত্যাচারীর ঘর করতে হচ্ছে!

ত্যাগ করে চলে যাবে কখন?

সোজা হয়ে দাঁড়াতে শেখাবার আগেই তো ঘাড়ে পিঠে পাহাড়ের বোঝা উঠছে জমে। ওই বোঝার ভার নামিয়ে রেখে চলে যাবে সুবৰ্ণ তার সন্তানদের মধ্যেও নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখতে? হয়তো আরো কালিমাখা হবে সে ছবি।

সুবৰ্ণ তাই তার মার সামনে মুখ তুলে বলতে পারবে মা, তোমার মেয়ে তোমার মত নিষ্ঠুর হতে পারে নি, এই তার ক্রটি! তোমার মত হাল্কা ছোট্ট সংসার পায় নি, এই তার দুর্ভাগ্য!

তোমার মেয়ে মায়ে-তাড়ানো বাপে-খেদানো তেজটা ফলাবে তবে কোন পতাকাতলে দাঁড়িয়ে? ধিক্কার তুমি দিতে এসো না মা, শুধু এইটুকু ভেবো, সকলের জীবন সমান নয়, সবাইকে একই মাপকাঠিতে মেপে বিচার করা যায় না! যাকে বিচার করতে বসবে, আগে তার পরিবেশের দিকে তাকিও!

সুবৰ্ণর পরিবেশ সুবৰ্ণকে অসম্মানের পাকেই রেখেছে, সুবৰ্ণ আবার এইটুকু অসম্মানে করবে কি? আর সুবর্ণর দেহকোটরে এখনো না শক্রির বাসা! তাকে বহন করে নিয়ে যাবে কোন মুক্তির মন্দিরপথে?

সুবৰ্ণকে অতএব সেই পথেই নেমে যেতে হবে, যে পথের শেষে কি আছে সুবৰ্ণ জানে না, পথটা অন্ধকারে ভরা এই জানে শুধু।

কিন্তু সুবর্ণ হয়তো একদিন তার সন্তানের মধ্যে সার্থক হবে। মাথা তুলে দাঁড়াবে পৃথিবীর সামনে। সেই স্বপ্নই দেখে সুবর্ণ। সেই ভবিষ্যতের ছবিতেই রং দেয়।.

এখন অতএব আর কিছু করার নেই সুবর্ণর, তাই স্বামীর পিছু পিছু চলে যাওয়া ছাড়া!

 

ফুলেশ্বরী ন্যাড়া মাথাটায় ঘোমটা টানেন।

ফুলেশ্বরী অবাক গলায় কুটুমের ছেলেকে সম্বোধন করে বলেন, সে কি বাবা? এই এসে এই চলে যাবে কি? বোনের বাড়ি এসেছি, একটা বেলাও তো থেকে যাবে?

প্রবোধচন্দ্র গম্ভীর গলায় বলে, থাকবার জো থাকলে থাকা যেত, সময়ের অভাব।

আহা, আসছে কাল তো ছুটির বার–

অন্য কাজ আছে।

নীরস গলায় বলে কথাটা প্ৰবোধ, মাউমার অনুরোধের সম্মান রাখবে এমন মনে হয় না।

কিন্তু ফুলেশ্বরী তবু অনুরোধ করেন।

কারণ ফুলেশ্বরীর বৌ তাঁর শরণ নিয়েছে। বলেছে, মা, যা মুখ করে বসে আছে মেজদা, দেখেই তো পেটের মধ্যে হাত-পা সেঁধিয়ে যাচ্ছে। আপনি একটু বলুন। আপনার কথা ঠেলতে পারবে না। আহা, অকস্মাৎ এমন দুম করে নিয়ে যাবে, পোয়াতি বেঁটাকে একটু মাছ-ভাত মুখে না দিয়ে পাঠাবো কোন প্ৰাণে?

ফুলেশ্বরী তাই আপ্ৰাণ করেন।

বলেন, বুঝলাম কাজ আছে, কিন্তু যো-সো করে সামলে নিও বাবা। পুরুষ ছেলে, তোমাদের অসাধ্যি কি আছে? মেজো মেয়ে এই অবস্থায় যাত্রা করবে, একটু মাছ-ভাত মুখে না নিয়ে যেতে দিই কি করে? আমি তোমার হাতে ধরে অনুরোধ করছি বাবা—

কিন্তু প্ৰবোধের কি এখন ওই সব তুচ্ছ ভাবপ্রবণতার মানরক্ষা করার মত মানসিক অবস্থা?

মাথার মধ্যে রক্ত তার টগবগ করে ফুটছে না? সেই উত্তাপকে প্রশমিত করে সেই এই পাপপুরীতে রাত্রিবাস করবে? গুছিয়ে-গাছিয়ে বোনাইয়ের পুকুরের মাছের ঝোল খেয়ে তবে যাত্রা করবে? এই দণ্ডে সুবৰ্ণকে কোনো একটা নির্জন জায়গায় ঠেলে নিয়ে গিয়ে মেরে পাট করে দিতে ইচ্ছে করছে না?

বোন!

বোনের বাড়িতে বিশ্বাস করে পরিবার রেখে গিয়েছিলাম, বোন সে বিশ্বাসের মান রেখেছে যে! কেন চোখে চোখে রাখতে পারে নি? শাসন করতে পারে নি? বলতে পারে নি, বেচাল কোরো না মাজবৌ?

তা নয়, সোহাগের দ্যাওরের সঙ্গে মাখামাখি করতে ছেড়ে দিয়েছেন!

সেই বোনের মান রাখতে যাব আমি!

অতএব প্ৰবোধকে বলতেই হয়, বৃথা উপরোধ করছেন, আজ না গেলেই নয়।

এবার অমূল্য গলা বাড়ায়।

বলে, তা কাজটা যখন এত জরুরী, সেরে নিয়ে দুদিন বাদে এলে তো ভালো হতো মেজদা।

মেজদা ভুরু কুঁচকে নেপথ্যবর্তিনীর উদ্দেশ্যে একটি কড়া দৃষ্টি হেনে তেতো গলায় বলে, ই, কারুর কারুর অন্তত ভালো হতো, তাতে আর সন্দেহ কি!

অমূল্য অত বোঝে না। বলে ফেলে, সত্যি, সেটাই ভালো ছিল মেজদা। এমন হঠাৎ এঁদের যাবার তো কোনো কথা ছিল না—

কথা ছিল না!

আইন দেখাতে এসেছ!

ফুটন্ত রক্ত উছলে ওঠে, বরাবর তোমার বাড়িতে থেকে যাবে, এমন কথাও ছিল না নিশ্চয়? আমার পরিবার, তার ওপর আমার জোর চলবে না?

হঠাৎ নেপথ্যবর্তিনী বেরিয়ে আসে, বলে ওঠে, চলবে না কি বল? একশোবার চলবে। ইচ্ছে হলে কোমরে দড়ি বেঁধে কাঁটাবন দিয়ে হিচড়ে নিয়ে যাওয়াও চলবে।… যাত্রার আয়োজন করে দিন আপনি ঠাকুরজামাই। গরুর গাড়িকে তো বলে পাঠাতে হবে!… ঠাকুরঝি, তুমি মনখারাপ করো না।

তাতে রুচি নেই ভাই। মুখ ফুটে বললামই সে কথা!

সুবালা মনে মনে শিউরে উঠে বলে, দুৰ্গা দুৰ্গা! অমূল্যও বোধ করি বিচলিত হয় এবং অমূল্যের মেজ শালা হঠাৎ গগনবিদারী চীৎকারে বলে ওঠে, শুনলে? শুনলে তো? নিজ কর্ণে শুনলে তো? এই মেয়েমানুষকেও সতী বলে বিশ্বাস করতে হবে! তোমরা কি বল? মেয়েমানুষ স্বামীর অকল্যাণ চায়, তার রীতি-চরিত্তির ভাল, একথা বল তোমরা?

 

কেউ আর কিছু বলে না।

গরুর গাড়ি আসে।

ছেলেমেয়েগুলো কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে ওঠে। সে গাড়িতে। বড় আশা ছিল তাদের, আরো কিছুদিন থাকবে। কত সুন্দর করে আজই তারা ইট সাজিয়ে পাকা বাড়ি তৈরি করেছিল, সব গোল ঘুচে।

সুখ বস্তুটা তা হলে জলের আলপনা? অতি সুন্দর নক্সা নিয়ে ফুটে উঠেই মুহূর্তে মিলিয়ে যায়?

আনন্দ কি বস্তু, স্বাধীনতা কাকে বলে, ভারহীন মন কেমন জিনিস, এখানে আস্বাদ পেয়েছিল। তারা। কিন্তু কদিনই বা? শিকারী ঈগলপাখীর গল্পের সেই ঈগলটার মতই যেন বাবা ঠকাস করে এসে নামলো আর ছোঁ। মেরে নিয়ে গেল!

কানু, ভানু আর চন্নর ওরই মধ্যে যতটা পারলো সংগ্রহ করে নিল–কষা। পেয়ারা, কাঁচা কুল, টক বিলিতি আমড়া, ইত্যাদি। তা ছাড়াও থোড়, করমচা, গাব, মাদার পর্যন্ত অনেক কিছুই জমে উঠলো তাদের সঞ্চায়ের ঘরে।

তা জমে উঠতে উঠতেই তো জীবনের জমা-খরচ!

শুধুই কি জমে ওঠে। ঘৃণা ধিক্কার অসন্তোষ? জমে ওঠে না ভালবাসার সঞ্চয়, কৃতজ্ঞতার সঞ্চয়, শ্রদ্ধার সঞ্চয়?

না জমলে পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে কি করে? নিজের কেন্দ্ৰে পাক খেতে খেতে এই যে তার অনন্তকালের পরিক্রমা, এ তো কেবলমাত্র ভারসাম্যের উপর!

তাই সুবৰ্ণলতার শুকিয়ে ওঠা স্নায়ূশিরার আবরণের মধ্যে কাঠ হয়ে থাকা আগুনের ডেলার মত চোখ দুটো দিয়েও জল ঝরে পড়ে।

বারে বারে পড়ে।

সুবালা যখন আলতা পরিয়ে দিতে দিতে অনবরত হাঁটুতে মুখ ঘষটে চোখ মোছে তখন পড়ে, সুবালার ছেলেরা যখন সুবর্ণর ছেলেদের জন্যে এক চুপড়ি সেই ওদের মাটির ইট এনে রেখে যায় সুবৰ্ণর তেরঙ্গের কাছে তখন পড়ে, আর উথলে উপচে শতধারে পড়ে, যখন ফুলেশ্বরী তাঁর সুদূর ভবিষ্যতের প্রপৌত্রের উদ্দেশে রচিত বহু পরিশ্রমসঞ্জাত আর বহু কারুকার্যখচিত কাঁথাখানি ভাজ করে এনে বলেন, জিনিসের মতন জিনিস একটু হাতে করে দেবার ভাগ্যি তো করি নি মেজমেয়ে, একখান লালপেড়ে কোরা শাড়ি এনে দেবার সময়ও দিলেন না ছেলে। এইখানি রাখো, যে মনিষ্যিটুকু আমার সংসারে কদিন বাস করে গেল, অথচ কিছু দেখল। না জানল না, তার জন্যে ঠাকুমার হাতের এই চিহ্নটুকু-

তখন!

তখন চোখের জলে পৃথিবী ঝাঁপসা হয়ে গেল সুবর্ণর।

সুবৰ্ণর মুখ দিয়ে কথা বেরোল না, সুবৰ্ণ শুধু সেই অমূল্য উপহারখানি হাতে নিয়ে মাথায় ঠেকালো।…

 

সুবৰ্ণর চোখে এত জল!

সুবৰ্ণর আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মত যাত্রাকালে কেঁদে ভাসাচ্ছে!

একটু যেন অপ্রতিভ হলো প্ৰবোধ, একটু যেন বিস্মিত। যাত্রাকালে তাই বেশি শোরগোল তুলল না, আর গরুর গাড়িতে ওঠার পর অমূল্য যখন বিরাট একটা বোঝা এনে চাপিয়ে দিল গাড়িতে, তখনও বিনা প্ৰতিবাদে নিল সেই ভার।

আরও একবার চোখের জল!

সুবৰ্ণ সেই বোঝাটার দিকে তাকালো। সুবর্ণ মুহূর্তখানেক স্তব্ধ হয়ে রইল। সুবর্ণর চোখ দিয়ে আস্তে আস্তে বড় বড় মুক্তোর মত কয়েকটি ফোঁটা গড়িয়ে পড়লো।

ধূলো মাখা মলাট ছেঁড়া দড়ি দিয়ে থাক করে করে বাধা একবোঝা পুরনো মাসিকপত্র।

নিয়ে এল অমূল্য।

ব্যস্ত ভঙ্গীতে বললো, মেজদা, যদি একটা উপকার কর! বইগুলো কলকাতায় একজনকে দেবার কথা, তো এই সুযোগে তোমার গলায় চাপাচ্ছি, যদি নিয়ে যাও-

প্ৰবোধ আমার দ্বারা হবে না বলে চেঁচিয়ে উঠল না। নিমরাজির সুরে বললো, তা আমি কাকে দিতে যাবো–

আরে না না, তোমায় দিতে যেতে হবে না, সে যখন কলকাতায় যাওয়াটাওয়া হবে, দেখা যাবে। তুমি শুধু সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে তোমার ঘরে রেখ দিও।

এত জায়গা কোথায়? ঘর তো বোঝাই-

এইটুকু বলে প্ৰবোধ।

অমূল্য আরো ব্যস্ততার ভাবে বলে, চৌকির তলায়টলায় যে করে হোক! দেখতেই তো পোচ্ছ দামের জিনিস নয়, তবে জহুরীর কাছে জহরের আদর! জায়গা একটু দিও দাদা—

চোখের জল পড়ে পড়ে এক সময় শুকিয়ে যায়, সুবর্ণ। তবু নির্নিমেষে সেই জহরগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।

আর এক সময় খেয়াল হয় তার, অম্বিকা নামের সেই উদোমান্দা ছেলেটা সরল বটে, কিন্তু নির্বোধ নয়!

কিন্তু এই নির্মল ভালবাসার উপহারগুলির পরিবর্তে একটু নির্মল প্রীতির কৃতজ্ঞ হাসি হাসবার অবকাশও পেল না। সুবর্ণ। হয়তো জীবনেও পাবে না।

আগে ইচ্ছে হয়েছিল, ওদের গ্রামের আওতা থেকে বেরিয়ে একবার রেলগাড়িতে উঠতে পারলে হয়, সুবৰ্ণকে