এই শোন্য সেজদি, বেশি চালাকি করিস না, ইতিমধ্যে কটা খাতা ভরালি দেখবো। এনেছিস তো?
পারুল উড়িয়ে দেয় সে কথা। তারপর একসময় হেসে উঠে বলে, প্রেমের কবিতা বড় ভয়ানক বস্তু রে! ও লোকবিশেষকে জলবিছুটি দেয়। প্রেম ব্যতীত প্রেমের কবিতা এ তার বিশ্বাসের বাইরে।
হুঁ! বকুল আস্তে বলে তার মানে— উচ্চশিক্ষা জিনিসটা শুধু একটা শার্টকোটের মত! গায়ের ওপর চড়িয়ে বাহার দেবার!
পারুল একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, কি জানি, সর্বত্রই তাই, না কোথাও কোথাও সেটা অস্থিমজ্জায় গিয়ে মিশে চিত্তকে উচ্চে তোলে!
এই সত্যি, সেজ জামাইবাবু প্রেমের কবিতা দেখলে চটে?
চটে! উঁহু না তো,–পারুল হেসেই বলে, চটে না! শুধু বলে গুপ্ত প্ৰেম না থাকলে এত গভীর প্রেমের কবিতা আসতেই পারে না। পাতায় পাতায় এই যে তুমি আর তোমার জন্যে হাহাকার, তার লক্ষ্যস্থল যে হতভাগা আমি নয়, সে তো বুঝতেই পারা যাচ্ছে। তা এই প্রেম যখন আইবুড়ো বেলা থেকেই আছে, তখন আর এ হতভাগার গলায় মালা দেওয়া কেন?
চমৎকার! কবিরা সব প্রেমে পড়ে পড়ে। তবে—
থাক বকুল, ও কথা রাখ। তোর কথা বল এতদিন এখানে কি হলোটলো বল।
সে তো মহাভারত!
পারুল হাসে। পারুল তার ভেতরের সমস্ত বিক্ষোভকে নিজের মধ্যে সংযত রেখে স্থির থাকবে, এই বুঝি পারুলের পণ! অভিমানের কাছে সব পরম কে বলি দেবে এই বুঝি ওর জীবন-দর্শন!
তাই পারুল সব কিছুকে চাপা দিয়ে বলে, তবে তো হাতে সুপুরি হতুকি নিয়ে বসতে হয় রে। মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস ভনে শুনে পুণ্যবান।
তা যে যেভাবেই হোক, এ বিয়েটার উপলক্ষে আমোদ-আহ্লাদটা করলো খুব, নববিবাহিত মানু একদিন নিজের পয়সা খরচ করে সবাইকে নতুন একটা জিনিস দেখালো, বাংলা বায়োস্কোপ!
চন্নন একদিন নতুন বৌয়ের ছুতোয় গুষ্টিবৰ্গ সবাইকে নেমস্তন্ন করলো। শুধু সব কিছু আহ্লাদ থেকে বঞ্চিত থাকলো সুবর্ণ। সুবৰ্ণকে আবার ঘুষযুষে জ্বরে ধরেছে।
আর বকুল কোনো আমোদেতে যোগ দেয় না। তার স্বভাবগত কুনোমিতে।
তবু সুবর্ণর যে মনে হয়, অসুস্থ মা একা বাড়িতে পড়ে থাকবে এটা অনুমোদন করছে না বলেই বকুলের এতটা কুনোমি। নইলে সেজদি পারুলের সঙ্গে তো আছে হৃদ্যতা।
বায়োস্কোপ দেখতে, নেমন্তন্ন খেতে দুদিনই মায় প্ৰবোধ সবাই বেরিয়ে যায়। সুবর্ণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকে, যেন দেওয়ালে কত কি লেখা আছে, পড়ছে সেই সব।
সুবৰ্ণর ছোট ছেলে সুবল কোথায় থাকে বোঝা যায় না, শুধু হঠাৎ এক এক বার এসে ঘরের মাঝখানে স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে পড়ে আস্তে বলে, ওষুদ-টষুধ কিছু খাবার ছিল নাকি? নয়তো বলে, বলছিলে নাকি কিছু? অথবা বলে, খাবার রেখে গেছেন ওঁরা?… জল আছে?
তোমার খাবার— এ স্পষ্ট করে বলে না। শুধু খাবার।
তবু মায়ের জন্যে যে উৎকণ্ঠিত সে, এটা বোঝা যায়।
কিন্তু সুবর্ণর এই ছোট ছেলে যদি এসে বিছানার ধারে বসে পড়ে বলতো, মা, তোমার কি বেশী জ্বর এল নাকি?… কিংবা নীরবে কপালে হাতটা রেখে অনুভব করতে চেষ্টা করতো উত্তাপের মাত্ৰাটা কতখানি?
হয়তো সুবৰ্ণ বেঁচে যেত।
তা সে করে না।
শুধু মার ধারে-কাছে কোথায় যেন তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, একটু কাশির শব্দ পেলেই দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। হয়তো ওর ইচ্ছে হয়, মার বিছানার ধারে বসে মার গায়ে হাত রাখে, অনভ্যাসের বশে পারে না। তাই শুধু তার চোখে-মুখে এতটা বিপন্ন উৎকণ্ঠার ভাব ফুটে ওঠে।
দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকলেও সুবর্ণ অনুভব করতে পারে সেই মুখচ্ছবি। তবু সুবৰ্ণও তো বলে না, আয় না। সুবল, আমার কাছে এসে একটু বোস না।
বলে না নয়, বলতে পারে না।
সুবৰ্ণর সমস্ত অন্তরাত্মা বলবার জন্য আকুল হয়ে ওঠে। তবু বোবা হয়ে থাকে বাকযন্ত্র। যেন ক্ষুধিত তৃষ্ণার্তা সুবর্ণর হাতেই মজুত রয়েছে তার ক্ষুধার খাদ্য, তৃষ্ণার জল, কিন্তু রয়েছে একটা সীল করা বাক্সে, আর সেই সীল ভেঙে ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটাবার ক্ষমতা সুবর্ণর নেই।
২.২৬ মেয়েরা একে একে বিদায় নিল
মেয়েরা একে একে বিদায় নিল।
পারুলের যাত্রাকালে বকুল আস্তে বলে, ভুল করিস না। সেজদি! চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাবি তুই?
পারুল ঈষৎ কঠিন হাসি হেসে বলে, চোরের সঙ্গে কাড়াকড়ি করে থালার দখলটা নেবার প্রবৃত্তিও নেই!
তা বলে তুই কবিতা লেখা ছেড়ে দিবি? অত ভাল লিখতিস?
বকিস না, পারুল হেসে ওঠে, শালুক চিনেছে গোপাল ঠাকুর! ভারী তো লেখা! ছেড়ে দিলে পৃথিবীর ভারী লোকসান!
পৃথিবীর না হোক, তোর নিজের তো অনেক লোকসান।
পারুল অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, লবণ-সমুদ্রে বাড়তি একমুঠো নুন ফেললে কি ইতারবিশেষ হয় বল তো? জীবনটাই তো লোকসানের।
কিন্তু সেজদি, অমলবাবু তো—
আরে কী মুশকিল, তোদের অমলবাবুর নিন্দে করছি নাকি আমি? মহদাশয় ব্যক্তি, স্ত্রীর একটু আরাম-আয়েসের জন্য ভাড়ার ভেঙে খরচা করতে পারেন, শুধু প্রেমের কবিতা চলবে না।
বেশ তো, ভগবানের বিষয় নিয়ে লিখবি-
পারুল ওর মাথাটায় একটু আদরের নাড়া দিয়ে বলে, ভারী তো লেখা, তার জন্যে ভেবে ভেবে মুণ্ডুটা তোর গেল দেখছি! বিদ্বন-মুখুদের নিয়ে আবার অনেক জ্বালা রে! ঈশ্বরই যে মানুষের আদি-অনন্তকালের প্ৰেমাস্পদ, এ ওদের মগজে ঢোকে না। আবেগ আর ব্যাকুলতা, এ দেখলেই তার মধ্যে আঁশটে গন্ধ পায় ওরা। যাক গে মরুক গে, মাও তো জীবনভোর কত কি লিখলেন, তার পরিণাম তো নিজেই বললি!