শুধু তাকিয়ে রইলাম।
ও অন্যদিকে তাকিয়ে বলে উঠল, মানে ভাবছি ওই বরণ-টরণগুলো অন্য আর কেউ করুক। দেশের বড় খুড়ি বা সত্যদার বউ!
পা থেকে মাথা পর্যন্ত আকস্মিক যে একটা অনুভূতি খেলে গেল আমার, তাকেই কি বিদ্যুৎ শিহরন বলে?
তারপর অনেকদিন পরে আমি ব্যঙ্গে তীক্ষ্ণ হলাম।
বললাম, কেন, আমি কী অপরাধ করলাম?
ও অপ্রতিভ গলায় বলল, না না অপরাধের কথা হচ্ছে না। মানে এসব তো মেয়েলি নিয়ম লক্ষণের ব্যাপার
বুঝলাম সেদিন ঝোঁকের মাথায় একটা বড় দানপত্রে স্বাক্ষর করে বসে ও এখন পস্তাচ্ছে। ছেলের কল্যাণ অকল্যাণের চিন্তা ওর চক্ষুলজ্জার দুর্বলতার উপর জয়ী হচ্ছে। ওর মনে পড়েছে আমি বিধবা, আমার কোনও শুভকর্মে যোগ দেবার অধিকার নেই।
মায়া হল।
ছেলে যে ওর প্রাণ! জানি তো?
তবু সুরটা বজায় রাখলাম।
মুচকি হেসে বললাম, চওড়া লাল পাড়ের বেনারসী গরদটা তা হলে মাঠে মারা?
ও তাড়াতাড়ি বলল, তা কেন? শাড়িটা পরবে না কেন? নিশ্চয় পরবে, পরে বিয়েবাড়ি ঝলসে বেড়াবে। শুধু
ও বুঝেছি, নিরীহ গলায় বললাম, শুধু বরণ করব না!
তুমি রাগ করছ?
কী মুশকিল, রাগ করব কেন? কী করতে হবে তাই জেনে নিচ্ছি। কিন্তু খোকার আসল মা কেন বউ বরণ করছে না তারও কোনও গল্প বানিয়ে কৈফিয়ত দিতে হবে? সে গল্পটা?
ও ফ্যাকাসে গলায় বলল, গল্প আবার কী? শরীর খারাপ-টারাপ কিছু একটা বলবে।
আমি আরও দুষ্টু হাসি হেসে বললাম, তা যেন বললাম, কিন্তু জরির আঁচলা দুলিয়ে বিয়েবাড়ি ঝলসে বেড়াব, অথচ শরীর খারাপ বলব, সেটা একটু বেমানান লাগবে না?
ওর চোখ দুটো হঠাৎ ছলছলিয়ে উঠল। কাতর গলায় বলল, তুমি তো সবই বোঝো, আমার মনটাও তো বুঝতে পারছ, তবে কেন–
আর নিষ্ঠুর হতে পারলাম না।
বিশেষ করে যখন ও শুভ কাজে বসতে যাচ্ছে। হেসে উঠে বললাম, তুমি-ই বা কিচ্ছু বোঝে না কেন? খোকার শুভাশুভ আমি দেখব না? তুমি বলেছ বলেই কি আমি বউ বরণ করতে বসতাম? তোমাদের দেশের জ্ঞাতি খুড়িমাকেই বলে রেখেছি।
বলে রেখেছ? সত্যি?
ও আমার এই বিবেচনার পরিচয়ে যেন বর্তে গেল। চলে গেল তাড়াতাড়ি ওদিকে ডাকাডাকিতে।
আমি তাকিয়ে রইলাম সে দিকে।
ভাবতে লাগলাম, এই গোলমালের বাড়ি থেকে কোনও এক ফাঁকে পালিয়ে গেলে কেমন হয়?
এর মধ্যে পালালে সহসা কেউ ধরতে পারবে না।
ভাবতেই লাগলাম।
যেমন সারাজীবন আত্মহত্যার কথা ভেবেছি।
সে সাহস হল না কোনও দিন।
সাহস দেখাতে যাই আজেবাজেতে।
যেমন দেখাতে গেলাম বিয়ের নেমন্তন্নর ছুতোয় প্রফুল্ল মাস্টারের সঙ্গে দেখা করে।
না, পুরনো গুরু বলে ভক্তিতে উথলে নয়। ভেবেছিলাম দেখি তো মাস্টার, তোমার প্রেম কত খাঁটি, তোমার দৃষ্টি কেমন নির্ভুল!
প্রিয়মাধব বলল, কী মুশকিল, তুমি যাবে মাস্টারের বাড়ি? বেঁচে আছে কিনা তার ঠিক নেই।
বললাম, আমি বেঁচে রয়েছি, তিনিই বা না থাকবেন কেন? কতই আর বেশি বয়েস? তবে আরও একটা বাঁচা আছে, সেটাই দেখতে যাচ্ছি।
তবে চল!
ও চলল ওর দীর্ঘ বলিষ্ঠ দেহ নিয়ে এক জোয়ান পুরুষের মতো টগবগিয়ে, আমি গেলাম ধীর শান্ত ভঙ্গিতে। আমাকে তো মনে রাখতে হবে আমি সুমিতা!
.
তুমি সুমিতা!
চমকে উঠেছিল প্রফুল্ল মাস্টার।
গায়ে চাদর জড়ানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি, এক প্রায় অথর্ব বুড়ো।
বলল, তুমি সুমিতা! তুমি সুমিতা!
প্রিয়মাধব মুচকি হেসে নিমন্ত্রণ পত্রটা নামিয়ে দিয়ে আমাদের আসার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করল।
কিন্তু প্রফুল্ল মাস্টার যেন দিশেহারার মতো তাকিয়ে রইল।
আমি সুমিতার ভঙ্গি নকল করতে চেষ্টা করলাম। নকল করতে চেষ্টা করলাম সুমিতার গলা। বিনয়ে মধুর নরম গলায় বললাম, আপনি নিশ্চয় আমাকে ভুলেই গেছেন?
মাস্টার এ কথায় যেন ব্যস্ত হয়ে উঠল। বলল, সে কী সে কী, ভুলে যাব কি! তুমি ছেলের বিয়েতে আমায় মনে করে নেমন্তন্ন করতে এসেছ, আর আমি ভুলে যাব?
প্রিয়মাধব হেসে উঠে লুকোনো বিদ্রুপের গলায় বলল, না মানে আর কি, আগে তো ভুলে গিয়ে থাকতে পারেন? এতদিন কি আর আপনি কবেকার কোন ছাত্রীকে মনে রেখেছেন?
মনে রাখিনি?
সেই অথর্ব ভাবের মধ্যে সহসা উত্তেজনার বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল।
মনে রাখিনি! বলেন কি! তবে মানে তুমি অনেক বদলে গেছ সুমিতা!
সুমিতা!
কতকাল ধরেই প্রিয়মাধবের মুখে এই সুমিতা ডাক শুনে আসছি, কানে তো সয়েই গেছে, তবু সেদিন মাস্টারের মুখে ওই ডাক শুনে যেন বুক কেঁপে উঠল।
মনে হল কে যেন কোথা থেকে এসে এই জালিয়াতি ধরে ফেলে ব্যঙ্গ হাসি হেসে উঠছে।
তবু সামলে নিতে হল।
বলতে হল, বাঃ বয়েস হচ্ছে বদলাব না? আপনিও তো কত বদলে গেছেন মাস্টারমশাই!
মাস্টার স্তিমিত হয়ে গেল।
বলল, তা বটে! সকলেই বদলে যায়। গলার স্বরটার সুষ্ঠু বদল হয়! তবু হঠাৎ যেন কেমন খাপ খাওয়াতে না পেরে বলে, আচ্ছা তোমার যে সেই যমজ বোন ছিল? মানে সেই নমিতা–
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, সে তো অনেকদিন হল মারা গেছে।
মারা গেছে।
মাস্টার থতমত খেল।
মাস্টার অপ্রতিভ গলায় বলল, খবরটবর তো জানা নেই। কিছু মনে কোরো না।
না মনে করার কি? যাবেন তো?
যাব? আমি আর কী যাব? কাউকে চিনি না!
বাঃ আমায় তো চেনেন? অত স্নেহ করতেন আমায়!
দুঃসাহসের এই পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে তাকিয়ে রইলাম নির্নিমেষ! দেখলাম সেই খোঁচা খোঁচা দাড়িওলা বুড়োটে চিবুকটা কেমন নড়ে উঠল, চোখ দুটো কেমন কাঁচ কাঁচ হয়ে উঠল, তারপর স্নান গলায় উচ্চারিত হল, হ্যাঁ, তা তো ঠিক! কিন্তু মানে আমার শরীরের অবস্থাও তো দেখছ। না পারলে কিছু মনে কোরো না।
৬. হেসেই অস্থির
বাইরে এসে প্রিয়মাধব হেসেই অস্থির। উঃ আচ্ছা বিপদে ফেলেছিলে বুড়োকে! তবু ভাগ্যিস নাম দুটো মনে রেখেছিল!