দীর্ঘকালের বিচ্ছিন্ন সম্পর্ক বাবার মৃত্যু যে ওকে এভাবে বিচলিত করে তুলবে, তা কে জানত!
এতদিনের কর্তব্যের ত্রুটি, আর নিজের এই ভেজাল জীবনের গ্লানি, একে অহরহ অপরাধবোধের তাড়নায় বিঁধছিল, শুধু স্বভাবগত চাপল্যে ভাসা ভাসা হালকা হয়ে থাকত, এই একটা ধাক্কায় বদলাতে শুরু করল।
দিদি চলে যাবার পর কিছুদিন যে বিকৃতি এসেছিল, এ বদল ঠিক তেমন নয়। এ যেন ওর মধ্যে একটা হিংস্র নিষ্ঠুরতা জন্ম নিচ্ছিল। যে হিংস্রতা অকারণ পুলকে উল্লসিত হয় অপরকে যন্ত্রণা দিয়ে, পীড়ন করে।
আর সেই পীড়নের পাত্র নমিতার মতো এমন আর কোথায় পাওয়া যাবে? এত হাতের কাছে, এমন নিরুপায়?
নমিতা যে কোনওদিন প্রিয়মাধবকে ধমক দিত, তীক্ষ্ণ বাক্যের বাণে বিদ্ধ করত, প্রতিপদে হেয় করত, সে কথা ভুলে গেল নমিতা। অতএব প্রিয়মাধবও ভুলল। তাই ভূমিকার বদল হল।
নমিতা সেই চিঠি পোড়ানোর পর থেকে নিজে পুড়ে পুড়ে খাক হল।
অথচ এখন আর উপায় কী?
কলেজে পড়া অরুণমাধবের সামনে, বিয়ের যুগ্যি অরুণমাধবের সামনে নমিতা কি প্রকাশ করতে বসবে এবার নমিতা-সুমিতার রহস্য!
আর হবে না কিছুই হবে না, নমিতাকে এখন শুধু তার ভাঙা নৌকোখানা ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে পৌঁছতে হবে কোনও এক অজানা লোকের উদ্দেশে।
তার আগে কিছু হবে না।
প্রিয়মাধবকে তার ছেলের সামনে ধিকৃত করবার শক্তি নেই নমিতার মধ্যে। শক্তি নেই তাকে পৃথিবীর চোখে হেয় করবার। তাকে সম্মানের উচ্চ শিখরে বসিয়ে রাখবার সাধনায় সব বিষ পান করে হাসিমুখে সংসার করতে হবে নমিতাকে!
কারণ?
কারণ একদা নমিতা নামের একটা আবেগপ্রবণ মেয়ে প্রিয়মাধব নামের একটা সর্বনাশাকে ভালবেসে বসেছিল।
কিন্তু প্রিয়মাধব তো সেই ভালবাসা বাসেনি!
তাই প্রিয়মাধব ওকে অপমান করেই সুখ পায়, পীড়ন করেই উল্লাস অনুভব করে।
অথচ ওর ভালবাসার এই রীতি।
তাই প্রিয়মাধবকে দোষ দিতে পারি না আমি। এ ছাড়া আর কী হতে পারত ও?
কিন্তু আমাকেই বা আমি দোষ দেব কেন? আমি যদি দিদির হাতের লেখার সাদৃশ্য দেখে শিউরে উঠি, সে কি খুব বেশি করেছি?
আমার অবস্থায় আমি এর বেশি কী হতে পারতাম?
দিদিকে আমি ভয় করব না?
দিদির সেই চোখ?
সেই ভয়ংকর অর্থবহ শূন্যদৃষ্টি?
সেই চোখ আজীবন আমাকে তাড়া করে ফিরেছে, আমাকে বিদ্রূপ করেছে, করুণা করেছে, ঘৃণা করেছে, আহা করেছে।
অনেকবার ভাবতে চেষ্টা করেছি, দিদির এই চলে যাওয়া সম্পূর্ণ বোকামি। চিরকেলে বোকাটা অভিমান করে সর্বস্ব খোয়াল। কিন্তু ওই চোখ? ও কি বোকার? তাই দিদিকেই আমি দোষী করব। চিরদিন করে এসেছি।
ওকে আমি ক্ষমা করতে পারলাম না কোনওদিন, ভালবাসতেও না। চিরদিন হিংসে করে এসেছি দিদিকে, চিরকাল করব। দিদি আমার জীবনের শনি!
.
সেই চিঠিখানার স্মৃতি ক্রমশ ধূসর হয়ে এসেছিল, ধূসর হয়ে এসেছিল অপরাধবোধের সেই তীব্র আগুন। ক্রমশই মনে হয়েছে হাতের লেখার সেই ছোবল সম্পূর্ণই আমার মনের ভুল। দড়িকে সাপ ভেবেছি আমি, সিঁদুরে মেঘকে আগুন। মানুষে মানুষে কত সাদৃশ্য থাকে, হাতের লেখাতেও থাকে। আমার মনে দুর্বলতা আমাকে ভয় দেখিয়েছে। দিদি নেই! পৃথিবীর কোথাও নেই। থাকলে–
মাঝখানে আর একটা ঘটনা ঘটে গেল।
বৃন্দাবন থেকে এক অচেনা হাতের লেখা চিঠি এল, আপনার মাতাঠাকুরাণী শ্রীমতী বিন্দুবাসিনী দেবী গত পূর্ণিমায় শ্রীশ্রীদ্বারকাধামে দেহরক্ষা করেছেন, গুরুদেবের আদেশে আপনার জ্ঞাতার্থে জানানো হইল। তাঁহার পারলৌকিক কার্যাদি শ্রীশ্রীগুরুদেবের নির্দেশানুযায়ী সম্পন্ন হইয়াছে, ইচ্ছা হইলে মাতাঠাকুরাণীর নামে ভাণ্ডারা দিয়া পুণ্য অর্জন করিতে পারেন। ব্রজবাসী মথুরামোহন দীনদাস, বৃন্দাবন, এই ঠিকানায় টাকা পাঠাইলে চলিবে।
পোস্টকার্ডের চিঠি।
বাপের মৃত্যুতে যতটা বিচলিত হয়েছিল, ততটা বিচলিত হল না প্রিয়মাধব, শুধু বলল, জানতাম আমি জানতাম, আমার যে এই শাস্তি হবে তা জানতাম আমি।
তারপর সেই ব্রজবাসীর নামে তিনশো টাকা পাঠিয়ে দিল।
সেই সময় সাহসে ভর করে বলেছিলাম, বৃন্দাবনে মা যেখানে থাকতেন, যাও না সেখানে একবার।
ও ভুরু কুঁচকে বলল, কেন? গোড়া কেটে আগায় জল দিতে?
তবু খৃষ্টের মতো বললাম, তা কেন, স্মৃতির জায়গাটা দেখে আসতে
অত ন্যাকামিতে কাজ নেই, বলে চলে গেল ও।
এই রকমই কথাবার্তা হয়েছে ওর ক্রমশ।
বুঝতে পারি ওর এই ত্রুটির জন্যে মনে মনে আমাকেই দায়ী করে ও। আশ্চর্য! চাকরি বজায় রাখতে ও কী করে বসেছিল তা ও ভেবে দেখে না। কিন্তু ওর এই নির্লজ্জতাকে কেটে চিরে বিশ্বের সামনে উদঘাটিত করতে পারি না ওকে, এমনকী ওর সামনেও পারি না। বলতে পারি না, তা আমায় শোনাতে এসেছ কেন ও কথা? আমাকে তোমার গলায় গাঁথো, পায়ে ধরে বলতে এসেছিলাম এ কথা? নিজের গলায় নিজে পাথর বেঁধেছ তুমি। এখন আমায় দোষ দিতে এলে চলবে কেন?
বলতে পারি না।
আমার সব তেজ সব দর্প সব সাহস কোথায় যেন চলে যাচ্ছিল, আমি শুধু নিজেকে খোলসের মধ্যে ঢুকিয়ে নিচ্ছিলাম। অতএব ও আমাকে যা ইচ্ছে বলে পার পাচ্ছে।…
আবার দু-একদিন পরে হয়তো নিজেই নরম হয়ে কথা কইতে আসে।
আমি কি তখন কথা বলব না?
মান-অভিমানের লীলা করব?
কীসের দাবিতে?
অথচ মনে হয় ও যেন সেটাই প্রত্যাশা করে। আমি মান করব, ও যে মান ভাঙাবে এই আশা নিয়েই যেন সন্ধি করতে আসে। আর আমি যখন পুরনো কটুক্তির বাষ্পমাত্র ভুলে গিয়ে নিতান্ত সহজভাবে কথা বলি, ও হতাশ হয়, ক্ষুব্ধ হয়, বুঝিবা বিরক্তও হয়।