তোমার উপায়টা তো খুঁজে বার করলে,আমি কঠিন গলায় বললাম, আর আমার বাঁচবার উপায়?
প্রিয়মাধব থতমত খেল!
প্রিয়মাধব বলল, কী বলছ?
বলছি, গয়না কাপড়ে গা ঢেকে তোমার স্ত্রী আর তোমার সন্তানের মা সেজে একা তোমার বাংলোয় গিয়ে উঠব আমি, আমায় কে রক্ষা করবে?
প্রিয়মাধব আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। বোধহয় ওই রক্ষার প্রশ্নটা তার মাথায় আসেনি। বোধহয় নমিতাকে সুমিতা করে দেওয়ার মধ্যেই ও সব মুশকিলের আসান খুঁজছিল।
তাই কেমন যেন হয়ে গেল।
তারপর আস্তে বললে, আমিই করব।
আমিই করব!
ওই রক্ষাকবচ নিয়ে সুমিতার পরিত্যক্ত শাড়ি গয়না পরে নিলাম আমি। সুমিতার সিঁদুর-কৌটো থেকে সিঁদুর। সুমিতার ছেলে কোলে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। যারা বকশিশ নেবার জন্যে কাতার দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল গাড়ির ধারে, তারা কেউ ধরতে পারল না।
তারা মাসি মেমসাহেবের আকস্মিক অন্তর্ধানে আক্ষেপ প্রকাশ করতে লাগল।
.
নমিতার মৃত্যু হল।
সেই বিদীর্ণ খোলসে সুমিতার জন্ম হল।
নতুন জন্ম! দুটো সত্তার মেশানো একটা নতুন সত্তা নিয়ে ম্যানেজার সাহেবের ঘর করতে লাগল মেমসাহেব। নমিতার অফুরন্ত জীবনীশক্তি, আর সুমিতার গাম্ভীর্য, নমিতার দৃঢ়তা আর সুমিতার স্থিরতা এই দুইয়ের সংমিশ্রণে গঠিত নতুন মেমসাহেবকে ম্যানেজার সাহেব ভয় করে চলতে শুরু করল।
ক্রমশই ধরা পড়তে লাগল তার কাছে, মৃত্যুর খাদ কেটে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচতে চেয়েছিল সে। প্রিয়মাধব ক্রমশ বিকৃত হতে থাকল।
প্রথমটা বুঝতে পারেনি।
প্রথমদিন যেন অবিভূত গলায় বলেছিল, আরশির সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছ তুমি তোমাকে? চিনতে পেরেছ?
আমি ওর ওই বিহ্বল অভিভূত দৃষ্টিকে প্রশ্রয় দিইনি, কড়াগলায় বলেছি, থামুন!
ও ম্রিয়মাণ হয়ে বলেছিল, এখন ধরা পড়ছে তুমি সুমিতা নও। সুমিতা কোনওদিন জোরে কথা বলত না। সুমিতা কোনওদিন ধমক দিয়ে ওঠেনি কাউকে, চাকরবাকরকেও না। কিন্তু তুমি যখন চুপ করে বসে ছিলেহ্যাঁ, এতক্ষণ তুমি যে ওই জানলার ধারটায় বসে ছিলে, যেন ধরতে পারিনি তুমি সুমিতা নও। অবাক হয়ে দেখছিলাম।
তবু আমি আরও কড়া হলাম।
বললাম, ওসব বাজে কথা রাখুন। যমজ বোন আমরা চিরদিনই একরকম দেখতে, এটা আপনার নতুন আবিষ্কার নয়। দিদিকে খোঁজার কী হবে তাই বলুন।
দিদিকে খোঁজার
ও যেন শেখানো মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করল, দিদিকে খোঁজার?
রাগে আপাদমস্তক জ্বলে গেল। এই পরিস্থিতিতে ওর ওই ভাব বিহ্বলতা অসহ্য লাগল, বললাম, হ্যাঁ দিদিকে! কথাটা মাথায় ঢুকছে না নাকি?
ও এবার বিহ্বলতা ত্যাগ করল। যুক্তির গলায় বলল, ঢুকবে না কেন। কিন্তু পথ তো খুঁজে পাচ্ছি না। এ বাগানে তো এখন ভয়ংকর গোলমাল। আজই ভোর থেকে হঠাৎ ছোট ডিরেক্টর রবার্ট সাহেবকে নাকি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই সন্দেহ করছে খুন হয়েছে সাহেব। অবস্থা আয়ত্তে আনতে পারব কিনা বুঝতে পারছি না। এই তো এক্ষুনি বেরিয়ে যাব, জানি না কখন ফিরতে পারব।
বললাম, তা হলে খোঁজা হবে না? ম্যানেজার সাহেবের কাছে স্ত্রীর চাইতে চাকরিই বড়?
ও বলল, বড় ছোটর কথা হচ্ছেনা, হচ্ছে সম্ভব অসম্ভবের কথা। এখন যদি আমি চাকরিতে রিজাইন দিতে চাই তার পরিণাম জেল, তা জানো? বন্ডে সই করে চাকরি নিয়ে এসেছি
আমি কিন্তু বিশ্বাস করলাম না ওর কথা, মনে করলাম ও আমাকে নিবৃত্ত করতে বাজে ভয় দেখাচ্ছে। তাই উড়িয়ে দিলাম ও কথা। বললাম, রাখুন ও কথা, দিদির মতন বোকা পাননি আমায় যে, যা ইচ্ছে বুঝিয়ে ভয় খাইয়ে রাখবেন। বেশ তো, নিজে সময় না পান খোঁজবার জন্যে তোক লাগান।
ও বিমূঢ় গলায় বলল, লোক? লোকের কাছে বলব? তবে তোমাকে এই শাস্তি দেবার অর্থ?
আমি মনে মনে কেঁপে উঠলাম ওর কথায়। মনে হল ও তো বলছে শাস্তি, কিন্তু আমার কাছে কি আমার এই অদ্ভুত রূপান্তর সত্যি শাস্তি হয়েই দেখা দিয়েছে? আমি বাদ প্রতিবাদ করছি বটে, তবু কি এই অচিন্তনীয় পরিস্থিতি আমাকে একটা উগ্র রোমাঞ্চের স্বাদ এনে দিচ্ছে না? ঝাল আচারের মতো আকর্ষণীয় এই স্বাদ কি আমার তারিয়ে তারিয়ে পেতে ইচ্ছে করছে না? ঝালে চোখে জল এলেও।
করছে।
বোধ করি মদের আস্বাদ এই রকমই।
শুনেছি সে স্বাদেও নাকি বুক জ্বলে যায় পেট জ্বলে যায়, তবু মাতাল সেই জ্বালাতেই ডুবে থাকতে চায়। আমিও একটা তীব্র জ্বালাময় অনুভূতির রসে জারিত হচ্ছিলাম, তবু মান মর্যাদা রাখতে ওর সঙ্গে বাদ প্রতিবাদ করছিলাম আমি দিদিকে খোঁজা নিয়ে।
কিন্তু শুধুই কি মান মর্যাদা রাখতে?
দিদির জন্যে কি ভয়ংকর একটা শূন্যতা বোধ করছিলাম না? তাও করছিলাম। হাহাকার করছিল প্রাণ, আর ভয়ংকর একটা অপরাধবোধের ভারে শিথিল হয়ে যাচ্ছিলাম। আর সেই ভারাক্রান্ত হৃদয়ের ভার হালকা করতে অনবরত ওকে আঘাত হানতে ইচ্ছে করছিল, ওকে দোষী সাব্যস্ত করতে ইচ্ছে করছিল। তাই বাদ প্রতিবাদের চেহারাটা অনেকটা এই ধরনের হয়েছিল।
ওর ওই বিমূঢ় প্রশ্নের উত্তরে আমি বলেছিলাম, আমার শাস্তির জন্যে মাথা ঘামাবার দরকার নেই। লোককে জানাবেন তো–কি নিজে উদভ্রান্ত প্রেমিকের মতো পথে পথে সুমিতা সুমিতা করে খুঁজে বেড়াবেন? বেশ তো রাষ্ট্র করুন গে ম্যানেজার সাহেবের শালিই হারিয়ে গেছে
সে পথ তো আগেই বন্ধ করে রেখেছি, লোকে তো জানে সে কলকাতায় চলে গেছে।