ওরা নিশ্চয় মাসি মেমসাহেবের শাশুড়ি-ভক্তি দেখে ধন্য ধন্য করেছে। তা ছাড়া প্রশংসাও করেছে বিস্তর। বলেছে, এমন লোক হয় না। বলেছে, এরপর নতুন জায়গায় একা মেমসাহেবের খুব কষ্ট হবে। তারপর বকশিশ পেয়ে চলে গেছে।
নতুন বাগানে কেউ মাসি মেমসাহেবের নাম শোনেনি।
সেখানে শুধু সুমিতা, তার স্বামী-পুত্র নিয়ে সংসার করেছে। করেছে নিপুণ হাতে, অবলীলায়।
মরে গিয়ে কি নমিতা তার কর্মক্ষমতার ক্ষমতাটুকু তার চিরদিনের ভালবাসার দিদিকে দিয়ে গেল?
এটা একটা জিজ্ঞাসার চিহ্ন বইকী! যে চিহ্নটা আমার মনের মধ্যে চিরদিন খাঁড়ার মত উদ্যত হয়ে রইল।
কিন্তু এই আমিটা কে।
আমি কি সুমিতা? না আমি নমিতা? আমি যদি নমিতা হই, আমি তো তা হলে মারা গেছি। হ্যাঁ, প্রিয়মাধবের সেই বদলির তারিখে তো নমিতা মারা গেল। রইলাম শুধু আমি সুমিতা।
অথচ সুমিতাই হারিয়ে গিয়েছিল।
হ্যাঁ, সেই বদলির দিন গাড়িতে উঠবার আগের মুহূর্তে আসল সুমিতাকে আর দেখতে পাওয়া গেল না। সুমিতা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
.
সুমিতা কি কর্পূরের পুতুল ছিল?
তাই উবে গেল?
কী জানি কী ছিল সুমিতার মনে। বোঝা তো যেত না। মনে হত সোনারুপোর ও নয়, নেহাত মাটির পুতুল। কিন্তু মাটির পুতুল কি উবে যেতে পারে?
সুমিতা তবে কীসের পুতুল ছিল?
স্ফটিকের? ওর গায়ে কিছু লেগে থাকত না, তাই মনে হত খুব শক্ত। লেগে থাকত না? কে জানে। কিন্তু পুতুলটা হারিয়ে গেল। যেন বাতাসে উড়ে গেল।
ঘরে বারান্দায় ছাতে বাগানে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না তাকে।
চা বাগানের এলাকা থেকে হারিয়ে যাওয়া শক্ত, তবু সেই শক্ত কাজটা করে বসল সুমিতা।
অপটু সুমিতা যে এমন ভয়ানক একটা শক্ত কাজ করে বসতে পারবে এ কথা কে কবে ভেবেছিল?
অথচ সুমিতা তো পারল।
নিজেকে মুছে দিয়ে চলে গেল।
.
বিষ পোকা তা হলে ওকেই কামড়েছিল? যে পোকা আস্ত একটা মানুষকে খেয়ে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারে, মুছে দিতে পারে সবটা?
কিন্তু ঠিক সেই মোছার দিনটাকে কিছুতেই স্পষ্ট করে মনে আনা গেল না কোনওদিন। সুমিতা কি চলে যাবার সময় তার যমজ বোনের স্মৃতিশক্তিটাও মুছে দিয়ে গেল?
তাই শুধু খাপছাড়া খাপছাড়া কতকগুলো দৃশ্যের টুকরো যেন দাঁত খিঁচিয়ে ওঠে চোখের সামনে!
সেই দৃষ্টির ধাক্কায় সারাদিন পালিয়ে পালিয়ে, রাত্রে ভাঁড়ার ঘরের জাল আলমারিটার গায়ে ঠেশ দিয়ে বসে পড়ল নমিতা, দু হাতে চোখ চাপা দিল।
কিন্তু সেই ভয়ংকর দৃষ্টি তো আর চোখের সামনে ছিল না। সে যে নমিতার মনের উপর, নমিতার সমস্ত জীবনের উপর পুঁতে রেখে দিয়ে চলে গিয়েছিল সুমিতা।
নমিতা তাকে উপড়ে ফেলতে চেষ্টা করল, পারল না। নমিতা ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকাল, দেখল ওখান থেকে দড়ি ঝোলানো যায় কিনা।
দেখল কোম্পানি বাড়ি করবার সময় ভেবে দেখেনি হঠাৎ কারও এমন একটা দরকার পড়তে পারে। প্লেন পরিষ্কার সিলিং। তখন নমিতা ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে বাগানের দিকে বেরিয়ে এল, বাগানের বাইরের দিকে তাকাল, চোখের সামনে ঘন জঙ্গলাবৃত পাহাড়, দূরে দূরে ছড়ানো ছিটনো বাড়ি। আলো জ্বলছে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেই আলোটা হয়তো দুচার মাইল দূরে। নমিতা হাঁটতে শুরু করলে কেউ কোথাও দেখতে পারে কি? কিন্তু কতটা হাঁটবে নমিতা? কোন দিকে, রাস্তায় কেউ দেখতে পাবে না? চা-বাগানের এলাকা যে শক্ত ঘাঁটি। এখান থেকে কি পালানো সহজ? যদি কেউ জিজ্ঞেস করে কে তুমি?কী পরিচয় দেবে নমিতা? রাতদুপুরে রাস্তায় বেড়ানোর কৈফিয়তই বা কী দেবে? খাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো সুযোগ জোগাড় করার আগেই যদি ওই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়? নমিতা বাগানের সীমানা থেকে সরে এল।
নমিতা ভাবল বিষ নামের জিনিসটা নমিতা আগে থেকে কেন সংগ্রহ করে রাখেনি? নমিতার জীবনে যে কোনও মুহূর্তে ওর দরকার পড়তে পারে, এটা নিশ্চয় ভাবা উচিত ছিল নমিতার।
নমিতা এ যাবৎ কেবল নিজের বুদ্ধির অহংকারে স্ফীত হয়েছে, অথচ নমিতা এত বড় একটা বোকামি করে রেখেছে।
নমিতা যখন বাগানের দরজায় দাঁড়িয়ে নিজের এই অপরিসীম মূঢ়তার জন্যে ধিক্কার দিচ্ছিল নিজেকে, তখন প্রিয়মাধবও সেখানে এসে হাজির হল। খুব ব্যস্ত গলায় বলল, তুমি একা? সুমিতা কই?
নমিতা ভুরু কোঁচকাল।
বলল, দিদি? সে রাতদুপুরে বাগানে বেড়াতে এসেছে, হঠাৎ এ কথা ভাবার হেতু?
তা হলে গেল কোথায়? কোথাও তো দেখছি না!
সর্বত্র ঘুরে বেড়াবার অবস্থা রয়েছে নাকি তার? বাথরুমে গেছে বোধহয়। নিশ্চিন্ত গলায় বলল নমিতা।
এক মিনিট আগেও যে নমিতা খাদে লাফিয়ে পড়তে যাবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল, সে কথা বোঝ গেল না ওর গলার স্বরে।
প্রিয়মাধবই অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠল, না না! সব দেখলাম তো! কোথায় গেল সে?
এ কি শুধুই প্রশ্ন?
না রুষ্ট অভিযোগ?
যেন সুমিতা কোথায় যায় না যায় তার খবর রাখার সব দায়িত্ব নমিতার। তাই প্রশ্নটা তীব্র। এই তীব্র প্রশ্নের ধাক্কায় বুকটা ধড়াস করে উঠল নমিতার।
আর সেই মুহূর্তে মনে হল তার, সুমিতা হারিয়ে গেছে, সুমিতাকে আর পাওয়া যাবে না!
আশ্চর্য, নমিতার সেই মুহূর্তের অনুমানটাই এমন সত্য হয়ে গেল?
আর একটা ছবির টুকরো দেখতে পায় নমিতা, তীব্র একটা টর্চের আলো দিকভ্রান্তের মতো এদিকে ওদিকে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে। বাইরের ঘন অন্ধকারের গায়ে সেই আলোটা যেন প্রেতের চোখের মতো ক্ষণে ক্ষণে জ্বলছে আর নিভছে।