- বইয়ের নামঃ মায়াজাল
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. এই সেই মেয়ে
মায়াজাল – উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী
এই সেই মেয়ে।
মেয়েটার পিঠের ওপর আলতো একটু হাতের স্পর্শ দিয়ে সুনন্দার দিকে ঠেলে দিলেন উকিল ব্রজনাথ।
ঠেলে দিলেন বললে হয়তো ঠিক বলা হয় না, ঠেলে দিতে চেষ্টা করলেন বলাই ঠিক।
কারণ মেয়েটা যেন মাটির সঙ্গে পুঁতে গিয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, নড়ল না।
কিন্তু সুনন্দাই কি আবেগে উথলে উঠল? ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে টেনে নিল তাকে? না, অন্তত এই মুহূর্তে তা করল না সুনন্দা। শুধু সোফার ওপর বসে পড়ল।
শিথিল দেহখানাকে যেন নিক্ষেপ করল আধহাত পুরু ডানলোপিলো সিটটার ওপর। সেই মুহূর্তে কোন কথা ও বলতে পারল না। ভারী ভারী বুকটা কেবল ওঠা পড়া করতে লাগল ভিতরের আলোড়নে।
এতক্ষণ মেয়েটাকে পাশের ঘরে রাখা হয়েছিল। এইমাত্র ডাকিয়ে আনা হয়েছে। ওর সম্পর্কে যা কিছু বলবার ওর আড়ালে বলে নিয়েছেন ব্রজনাথ। উনিশ বছর আগের সেই একটি রাতের কাহিনী।
সেই এক নীতিধর্মহীন অন্যায় বাসনা জর্জরিত নিষ্ঠুর পাপের কাহিনী।
জগতের নিষ্ঠুরতম পাপ। নিষ্ঠুরতম আর কুৎসিততম।
কুৎসিততম বৈকি! মায়ের বুক থেকে সন্তানকে কেড়ে নেওয়ার মত কুৎসিত পাপ আর কি আছে জগতে?
অস্ফুটবাক্ শিশু।
অর্থহীন দু একটি শব্দে শুধু মাকে বোঝতে শিখেছে ইচ্ছে অনিচ্ছে, চাওয়া না-চাওয়া। টলে টলে হাঁটে, দু চার পা গিয়ে বসে পড়ে। সাদা শিল্কের রিবন আঁটা লাল শাটিনের একটি ফ্রক পরা।
উনিশ বছর পরেও সেই শাটিনের ফ্রকটার গড়ন মনে করতে পারছে সুমন্দা। হয়ত উনিশ বছর ধরে মনে করেছে বলেই মনে করতে পারছে।
সেই ফ্রকটাকে কি হারিয়ে ফেলেছে ওরা? পরিয়ে নষ্ট করে ফেলেছে? জীর্ণবিবর্ণ হতে হতে কোন এক সময় ধূলোর সঙ্গে মিশে গেছে? সুনন্দা আর কোনদিন দেখতে পাবে না সেই ফ্রকটাকে?
কিন্তু ফ্রকটার ছবি সুনন্দার দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে ফেলছে কেন?
উনিশ বছর ধরে শুধু সেই লাল শাটিনের ফ্রকটাকেই কি মনে মনে লালন করেছিল সুনন্দা? তার জন্যেই অধীর হয়েছিল? আবেগে কম্পিত হয়েছিল?
ব্রজনাথ বললেন, আপনি কি অসুস্থতা বোধ করছেন মিসেস রায়। জল খাবেন?
সুনন্দা মাথা নাড়ল।
তাহলে তাকিয়ে দেখুন। দেখুন আপনার সেই সবে পাতাধরা চারা গাছটুকু কী সুন্দর হয়ে উঠেছে! কী লাবণ্য, কী সুষমা!
কবির মত করে কথা বলছেন ব্রজনাথ। সুনন্দার জন্যেই বলছেন। সুনন্দাকে সহজ করে তোলবার জন্যে, সচেতন করার জন্যে।
তবু সহজ হতে, সচেতন হতে দেরি লাগছে সুনন্দার।
শেষ পর্যন্ত জলই খেল এক গেলাস। পুরো এক গেলাসই খেল।
ব্রজনাথ আনালেন বেয়ারাকে দিয়ে।
জল খেয়ে আস্তে মেয়েটির দিকে হাত বাড়াল সুনন্দা। বলল–এস, কাছে এসে বসো।
না, ওর থেকে বেশি কিছু বলতে পারল না সুনন্দা।
সুনন্দার থেকে মাথায় লম্বা, এই কালোপাড় সাদা শাড়ি আর প্লেনকালো ব্লাউজ পরা কুড়ি বছরের তরুণী মেয়েটার মধ্যে সেই লাল শাটিনের ফ্রকটাকে খুঁজে পেতে দেরি লাগছে সুনন্দার।
ব্রজনাথ বললেন, লজ্জা পাচ্ছ কেন সীমা, সবই তো শুনে এসেছ তুমি। দেখ এই তোমার মাকে। এত ঐশ্বর্যের মধ্যে থেকেও কী দুঃখিনী! একটি মাত্র সন্তান, সবেধন নীলমণি। তাকে হারিয়ে ফেললেন। চোরে চুরি করে নিয়ে গেল। ভেবে দেখ সীমা, কী অসহায় সেই যন্ত্রণা, তারপর থেকে এই উনিশটি বছর সেই তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করে এসেছেন উনি। এতদিনে সমুদ্রের তীর দেখা গিয়েছে, রাত্রির শেষ হয়েছে। তুমি এসেছ তোমার মা-র কাছে। এখন তুমিই পারবে স্নেহ আর সেবা দিয়ে ওঁর এই দীর্ঘকালের যন্ত্রণার ক্ষত দূর করতে, ওঁর হাহা করা মনকে ভরিয়ে তুলতে।
ব্রজনাথ এ বাড়ির উকিল মাত্র।
তবু ব্রজনাথ সুনন্দার চরম দুঃখের পর পাওয়া এই পরম সুখের দিনে যেন আবেগে প্রকম্পিত হচ্ছেন।
কিন্তু সুনন্দা বিহ্বল। সুনন্দা কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
সুনন্দা সীমাকে টেনে নিয়ে চেপে ধরতে পারছে না সেই হাহা করা বুকটায়। অথচ ব্রজনাথ যখন বার্তাটি এনেছিলেন? যখন নরম নীচু গলায় বলেছিলেন অদ্ভুত একটা খবর আছে মিসেস রায়!
তখন? তখনও কি সুনন্দা অমন বিহ্বল দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে ছিল?
না। তা তাকায় নি।
তখন মুহূর্তের মধ্যে ছিটকে উঠেছিল সুনন্দা। তীব্র তীক্ষ্ণ বুকচেরা একটা স্বর বলে উঠেছিল, আপনি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করতে এলেন ব্রজনাথবাবু?
ব্রজনাথ হেসেছিলেন।
শ্রদ্ধা স্নেহ আর করুণার সংমিশ্রণে গঠিত একটু মৃদু হাসি। তারপর বলেছিলেন, ঠাট্টা করবার আমার কি সাধ্য বলুন? ঠাট্টা যা করবার স্বয়ং বিধাতা পুরুষই করছেন। তবে মানুষের পক্ষে বড় মর্মান্তিক সেই ঠাট্টা। তবু–তবুও আমি বলব মিসেস রায়, দেরিতে হলেও তিনি যে তার ভুল সংশোধন করেছেন, এর জন্য তার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
সেদিন ভয়ঙ্কর রকমের বিচলিত হয়ে উঠেছিল সুনন্দা। উনিশ বছর আগের সেই দুরন্ত শোক যেন নতুন করে তাকে উন্মাদ করে দিয়েছিল।
সেদিন সুনন্দা এলোমেলো হয়ে উঠেছিল।
ব্রজনাথ বলেছিলেন, স্থির হোন মিসেস রায়! স্থির হোন। ভগবানের অসীম করুণাকে স্মরণ করুন, কৃতজ্ঞতা জানান। এই আশঙ্কা করেই আমি আপনার হারানো সন্তানকে একেবারে আপনার কাছে এনে হাজির করি নি। জানতাম আপনি চট করে নিজেকে চেক করতে পারবেন না। আর সেও