Site icon BnBoi.Com

মায়াজাল – আশাপূর্ণা দেবী

মায়াজাল - আশাপূর্ণা দেবী

১. এই সেই মেয়ে

মায়াজাল – উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী

এই সেই মেয়ে।

মেয়েটার পিঠের ওপর আলতো একটু হাতের স্পর্শ দিয়ে সুনন্দার দিকে ঠেলে দিলেন উকিল ব্রজনাথ।

ঠেলে দিলেন বললে হয়তো ঠিক বলা হয় না, ঠেলে দিতে চেষ্টা করলেন বলাই ঠিক।

কারণ মেয়েটা যেন মাটির সঙ্গে পুঁতে গিয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, নড়ল না।

কিন্তু সুনন্দাই কি আবেগে উথলে উঠল? ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে টেনে নিল তাকে? না, অন্তত এই মুহূর্তে তা করল না সুনন্দা। শুধু সোফার ওপর বসে পড়ল।

শিথিল দেহখানাকে যেন নিক্ষেপ করল আধহাত পুরু ডানলোপিলো সিটটার ওপর। সেই মুহূর্তে কোন কথা ও বলতে পারল না। ভারী ভারী বুকটা কেবল ওঠা পড়া করতে লাগল ভিতরের আলোড়নে।

এতক্ষণ মেয়েটাকে পাশের ঘরে রাখা হয়েছিল। এইমাত্র ডাকিয়ে আনা হয়েছে। ওর সম্পর্কে যা কিছু বলবার ওর আড়ালে বলে নিয়েছেন ব্রজনাথ। উনিশ বছর আগের সেই একটি রাতের কাহিনী।

সেই এক নীতিধর্মহীন অন্যায় বাসনা জর্জরিত নিষ্ঠুর পাপের কাহিনী।

জগতের নিষ্ঠুরতম পাপ। নিষ্ঠুরতম আর কুৎসিততম।

কুৎসিততম বৈকি! মায়ের বুক থেকে সন্তানকে কেড়ে নেওয়ার মত কুৎসিত পাপ আর কি আছে জগতে?

অস্ফুটবাক্ শিশু।

অর্থহীন দু একটি শব্দে শুধু মাকে বোঝতে শিখেছে ইচ্ছে অনিচ্ছে, চাওয়া না-চাওয়া। টলে টলে হাঁটে, দু চার পা গিয়ে বসে পড়ে। সাদা শিল্কের রিবন আঁটা লাল শাটিনের একটি ফ্রক পরা।

উনিশ বছর পরেও সেই শাটিনের ফ্রকটার গড়ন মনে করতে পারছে সুমন্দা। হয়ত উনিশ বছর ধরে মনে করেছে বলেই মনে করতে পারছে।

সেই ফ্রকটাকে কি হারিয়ে ফেলেছে ওরা? পরিয়ে নষ্ট করে ফেলেছে? জীর্ণবিবর্ণ হতে হতে কোন এক সময় ধূলোর সঙ্গে মিশে গেছে? সুনন্দা আর কোনদিন দেখতে পাবে না সেই ফ্রকটাকে?

কিন্তু ফ্রকটার ছবি সুনন্দার দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে ফেলছে কেন?

উনিশ বছর ধরে শুধু সেই লাল শাটিনের ফ্রকটাকেই কি মনে মনে লালন করেছিল সুনন্দা? তার জন্যেই অধীর হয়েছিল? আবেগে কম্পিত হয়েছিল?

ব্রজনাথ বললেন, আপনি কি অসুস্থতা বোধ করছেন মিসেস রায়। জল খাবেন?

সুনন্দা মাথা নাড়ল।

তাহলে তাকিয়ে দেখুন। দেখুন আপনার সেই সবে পাতাধরা চারা গাছটুকু কী সুন্দর হয়ে উঠেছে! কী লাবণ্য, কী সুষমা!

কবির মত করে কথা বলছেন ব্রজনাথ। সুনন্দার জন্যেই বলছেন। সুনন্দাকে সহজ করে তোলবার জন্যে, সচেতন করার জন্যে।

তবু সহজ হতে, সচেতন হতে দেরি লাগছে সুনন্দার।

শেষ পর্যন্ত জলই খেল এক গেলাস। পুরো এক গেলাসই খেল।

ব্রজনাথ আনালেন বেয়ারাকে দিয়ে।

জল খেয়ে আস্তে মেয়েটির দিকে হাত বাড়াল সুনন্দা। বলল–এস, কাছে এসে বসো।

না, ওর থেকে বেশি কিছু বলতে পারল না সুনন্দা।

সুনন্দার থেকে মাথায় লম্বা, এই কালোপাড় সাদা শাড়ি আর প্লেনকালো ব্লাউজ পরা কুড়ি বছরের তরুণী মেয়েটার মধ্যে সেই লাল শাটিনের ফ্রকটাকে খুঁজে পেতে দেরি লাগছে সুনন্দার।

ব্রজনাথ বললেন, লজ্জা পাচ্ছ কেন সীমা, সবই তো শুনে এসেছ তুমি। দেখ এই তোমার মাকে। এত ঐশ্বর্যের মধ্যে থেকেও কী দুঃখিনী! একটি মাত্র সন্তান, সবেধন নীলমণি। তাকে হারিয়ে ফেললেন। চোরে চুরি করে নিয়ে গেল। ভেবে দেখ সীমা, কী অসহায় সেই যন্ত্রণা, তারপর থেকে এই উনিশটি বছর সেই তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করে এসেছেন উনি। এতদিনে সমুদ্রের তীর দেখা গিয়েছে, রাত্রির শেষ হয়েছে। তুমি এসেছ তোমার মা-র কাছে। এখন তুমিই পারবে স্নেহ আর সেবা দিয়ে ওঁর এই দীর্ঘকালের যন্ত্রণার ক্ষত দূর করতে, ওঁর হাহা করা মনকে ভরিয়ে তুলতে।

ব্রজনাথ এ বাড়ির উকিল মাত্র।

তবু ব্রজনাথ সুনন্দার চরম দুঃখের পর পাওয়া এই পরম সুখের দিনে যেন আবেগে প্রকম্পিত হচ্ছেন।

কিন্তু সুনন্দা বিহ্বল। সুনন্দা কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

সুনন্দা সীমাকে টেনে নিয়ে চেপে ধরতে পারছে না সেই হাহা করা বুকটায়। অথচ ব্রজনাথ যখন বার্তাটি এনেছিলেন? যখন নরম নীচু গলায় বলেছিলেন অদ্ভুত একটা খবর আছে মিসেস রায়!

তখন? তখনও কি সুনন্দা অমন বিহ্বল দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে ছিল?

না। তা তাকায় নি।

তখন মুহূর্তের মধ্যে ছিটকে উঠেছিল সুনন্দা। তীব্র তীক্ষ্ণ বুকচেরা একটা স্বর বলে উঠেছিল, আপনি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করতে এলেন ব্রজনাথবাবু?

ব্রজনাথ হেসেছিলেন।

শ্রদ্ধা স্নেহ আর করুণার সংমিশ্রণে গঠিত একটু মৃদু হাসি। তারপর বলেছিলেন, ঠাট্টা করবার আমার কি সাধ্য বলুন? ঠাট্টা যা করবার স্বয়ং বিধাতা পুরুষই করছেন। তবে মানুষের পক্ষে বড় মর্মান্তিক সেই ঠাট্টা। তবু–তবুও আমি বলব মিসেস রায়, দেরিতে হলেও তিনি যে তার ভুল সংশোধন করেছেন, এর জন্য তার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

সেদিন ভয়ঙ্কর রকমের বিচলিত হয়ে উঠেছিল সুনন্দা। উনিশ বছর আগের সেই দুরন্ত শোক যেন নতুন করে তাকে উন্মাদ করে দিয়েছিল।

সেদিন সুনন্দা এলোমেলো হয়ে উঠেছিল।

ব্রজনাথ বলেছিলেন, স্থির হোন মিসেস রায়! স্থির হোন। ভগবানের অসীম করুণাকে স্মরণ করুন, কৃতজ্ঞতা জানান। এই আশঙ্কা করেই আমি আপনার হারানো সন্তানকে একেবারে আপনার কাছে এনে হাজির করি নি। জানতাম আপনি চট করে নিজেকে চেক করতে পারবেন না। আর সেও

ঢোক গিলেছিলেন ব্রজনাথ, তারপর আরও শান্তস্বরে বলেছিলেন সেও আতঙ্কিত হবে। …এটাই ভাল হবে যে একটা দিন সময় পাবেন আপনি, মনকে প্রস্তুত করতে। কাল আসবে সে আমার সঙ্গে।

তখন সুনন্দা ব্যাকুল হয়েছিল, উদ্ভ্রান্তের মত বলেছিল–না না, আজই আনুন তাকে।

ব্রজনাথ তা আনেন নি। ব্রজনাথ বুঝিয়েছিলেন তাতে সুনন্দার ক্ষতিই হবে। কারণ সে যদি এত আবেগ এত ব্যাকুলতা দেখে ভয় পায়, হয়তো সহজে কাছে আসতে পারবে না।

একটা দিন সময় নিয়েছিলেন ব্রজনাথ, আজ এনেছেন সীমাকে।

তার পালয়িত্রী মা যে নাম দিয়েছিল তাকে সেই নামেই এসে দাঁড়িয়েছে সে। কিন্তু সুনন্দার দেওয়া, ওর নিজের মা-র দেওয়া যে একটা নাম ছিল, সেটা কি মুছে গেছে? একেবারে ভুলে গেছে সুনন্দা?

না। সুনন্দার অস্থিমজ্জায় দেহের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে মিশে আছে সে নাম। সেই নাম বহাল হবে আজ থেকে সীমার।

সেই নামেই প্রথম ডাকল সুনন্দা।

যখন তার থরথর করা বুক একটু স্থির হল, যখন তার কথা বলবার সহজ স্বর ফিরে এল, তখন সোফা থেকে উঠে ওর কাছে এসে দাঁড়িয়ে দুটি হাত ওর দুকাঁধে রেখে বলল, তুই আমার কাছে আসতে ভয় পাচ্ছিস? তুই যে আমার টুলু। আমার টুলা।

ব্রজনাথ উদ্বেলিত হয়ে উঠছেন, ব্রজনাথ চেয়ারে স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছেন না। ব্রজনাথ উঠে দাঁড়ালেন। গলা থেকে কেমন একটা শব্দ উঠল।

যেন এই মুহূর্তটাকে একটা নাট্যমুহূর্তে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে ভিতরটা নিসপিস করছে ব্রজনাথের। ব্রজনাথ কি সীমাকে ঠেলে পাঠিয়ে দেবেন সুনন্দার বাহুবন্ধনের মধ্যে?

দিতে হল না। প্রাকৃতিক নিয়মেই গড়ে উঠল নাট্যমুহূর্ত। সীমা সুনন্দার বুকে এলিয়ে পড়ল।

সুনন্দা সীমাকে সেই বুকের মধ্যে মিলিয়ে নিতে চাইল। বুঝি বা পিষে ফেলতে চাইল। –টুলু! টুলা! আমার টুলটুল! মা বল, মা বলে ডাক একবার।

মা!

বড় রকমের একটা স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল ব্রজনাথের রুদ্ধশ্বাস বুক থেকে।

ব্রজনাথ আশঙ্কায় কণ্টকিত ছিলেন এতক্ষণ। ভাবছিলেন মিলনের প্রথম লগ্নটা যদি ব্যর্থ হয়, পরম প্রাপ্তির অনুভূতিটা যদি দেখা না দেয়, গান কি ঠিক সুরে বাজবে?

ব্রজনাথ এ সংসারের আত্মীয় নন। ব্রজনাথ উকিল মাত্র।

কিন্তু ব্রজনাথ কি আত্মীয়ের বেশি নয়?

সুনন্দার স্বামী শোভন রায় কি চিরদিন তার এই হিতৈষী বন্ধুটিকে বড় ভাইয়ের শ্রদ্ধা সম্মান দিয়ে আসেন নি? অবশ্য ব্রজনাথ খুব বেশি গায়ে-পড়া কোনদিনই নয়। শোভনলাল যতই ঘনিষ্ঠতার বন্ধনে বাঁধতে চেষ্টা করুন, ব্রজনাথ সাধ্যমত সম্পর্কের দূরত্ব বজায় রেখে এসেছেন। অন্তত শোভনলালের অন্তঃপুরে ঢুকে দাদার পোেস্টটা কায়েমী করে ফেলবার ঝোঁক তার কোনদিনই দেখা যায় নি।

সে ঝোঁক থাকলে হয়তো অবস্থা অন্যরকম হত।

কিন্তু ব্রজনাথ অবস্থাকে স্বাভাবিক সৌজন্যের রীতিতেই চালু রেখেছেন। শোভনলালের মৃত্যুর পর থেকে সুনন্দার সঙ্গে প্রায়ই দেখা করতে হয়, কিন্তু বাইরের দিকের বসবার ঘরে ছাড়া বসেন না কোনদিন।

মিসেস রায় ছাড়া সম্বোধন করেন না কখনো।

তবু হৃদয়ের আবেগ মাঝে মাঝে প্রকাশ হয়ে পড়ে। শ্রদ্ধার আবেগ, স্নেহের আবেগ, সুনন্দার ভাগ্যহত জীবনের জন্য করুণার আবেগ।

হ্যাঁ, ভাগ্যহত বৈ কি। প্রভূত ঐশ্বর্যের মাঝখানে বসেও সুনন্দা হতভাগিনী। কে কবে শুনেছে, কটা দিনের জন্যে বিদেশে বেড়াতে গিয়ে কেউ একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে আসে?

মৃত্যু নয়। চোর!

চোরে চুরি করে নিল সুনন্দার বুকের মাণিকটুকুকে। উনিশ বছর আগের তরুণী সুনন্দা, নতুন মা হয়েছে। সেই মাতৃত্বের গৌরবে আর পুলকে সর্বদা ছল ছল করছে।

টুলু যা কিছু করে, তারই এক আবেগময় ব্যাখ্যা করতে ছুটে আসে শোভনের কাছে। বলে, কী ছাইয়ের কাজ আর কাজ। বেড়াতে এসেছ তাও কাজ। দেখ তো এসে টুলু কেমন করে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে।

শোভন বলত–তুমি এত বেশি দেখছ যে আমার আর না দেখলেও চলবে।

ইস, তাই বৈকি! ছিঁড়ে দেব তোমার দোকানের হিসাবের খাতা।

তাহলে তোমার টুলুর রূপোর দোলনা-খাটের অর্ডারটা ক্যানসেল করা হোক?

হেসে হেসে বলত শোভন বাতিল করা হোক জাপানী পেরাম্বুলেটারের বায়না?

ভাল হবে না বলছি ওসব কথা বললে। ঠিক আছে। থাক তুমি তোমার সাধের ফার্নিচারের দোকান নিয়ে, আমার রইল টুলু।

ভারি অস্থির ছিল সুনন্দা। ভারি চঞ্চল।

আবার এক সময় ছুটে আসত, দেখ তো দেখ তো এই নতুন জামাটা পরে টুলাকে কেমন দেখাচ্ছে? উঃ বাবা, পথের শত্রু ফিরে চায় টুলুর দিকে, আর তুমি বাপ হয়ে একবার তাকিয়েও দেখ না।

শোভন বলত, পথের শত্রু নই বলেই তো তাকাই না। বেশি দেখলে নজর লাগে জান না? নজরে নজরে ক্ষয়ে যায়।

যায়! যত সব সেকেলে কুসংস্কার! ওই সব আবোল তাবোল বলে সাফাই গাওয়া হচ্ছে। ঠিক আছে, আমি আমার ধনকে নিয়ে বনকে যাব

শোভন হেসে ফেলত, বনে যাবার বাড়তি একটা টিকিট তাহলে আমার জন্যে কিনো। তুমি যেমন তোমার টুলুকে এক মিনিট না দেখলে অজ্ঞান হও, আমি যে তেমনি

বক্তব্যটা অবশ্য আর কথা দিয়ে শেষ করে না শোভন।

সুনন্দা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, আহা, কী তুলনার ছিরি হল?

ছিরি না হোক, সত্যভাষণ হল। বলত শোভন।

কিন্তু সে সত্য কি শেষ অবধি রাখতে পারলেন প্রৌঢ় শোভন রায়? পারলেন না, অনায়াসে ছেড়ে চলে গেলেন সুনন্দাকে। গেলেন বিনা নোটিসে।

দোকান থেকে এসে বললেন, এক গ্লাস জল দাও। বললেন, শরীরটা কেমন করছে।

ব্যস। তাকিয়েও দেখে গেলেন না সুনন্দার দিকে। ভেবেও দেখলেন না এতবড় বাড়িটায় একা সুনন্দা থাকবে কি করে?

কিন্তু সেদিন, সেই আগেকার দিনে সুনন্দার জন্যে ভাবনার অন্ত ছিল না শোভনের। নিজের শোককে চাপা দিয়ে, সুনন্দার সমস্ত অভিযোগে অবিচলিত থেকে সুনন্দার সঙ্গে সঙ্গে থেকেছেন। নীরব সান্ত্বনায় ভরিয়ে রেখেছেন তাকে।

তবু অবিরত একটা অভিযোগের ভাব মনে পোষণ করে এসেছে সুনন্দা টুলুর প্রতি শোভনের যথোপযুক্ত টান ছিল না, তাই ভগবান টুলুকে নিয়ে নিয়েছেন।

বেচারা শোভন হয়তো নীরবই থেকেছে, হয়ত বা কখনও বলেছে, ভগবান নেননি সুনন্দা। নিয়েছে মানুষ।

মানুষের কি সাধ্যি? ভেঙে পড়েছে সুনন্দা যদি ভগবান না বিমুখ হন?

শোভন কোনদিন একথা বলে নি, কিন্তু সুনন্দা, তোমার ভালবাসাটা কি তাহলে একেবারে মূল্যহীন? তোমার ত্রুটিহীন ভালবাসার সাধ্য হল না ঈশ্বরকে প্রসন্ন রাখতে?

তখন যে সুনন্দা শুধু কাঁদে। তখন তো আর সেই আগের সুনন্দা নয়।

কিন্তু যখন আগের ছিল? সেদিন ছুটে ছুটে এসে শোভনকে ঠেলা মেরে সচেতন করে তুলে বলেছিল, কালকের সেই লাল শাটিনটা ফ্রক করে ফেললাম। দেখ–দেখ কী মার্ভেলাস দেখাচ্ছে টুলাকে!

সেই ফ্রক পরে বেড়াতে গিয়েছিল টুলু চাকরের সঙ্গে।

এ বাড়ির আরও সব চেঞ্জার প্রতিবেশীদের বাসার কাছাকাছি নিয়ে বেড়াবার হুকুম দিয়েছিল সুনন্দা।

দেখুক, সবাই দেখুক তার টুলুকে। নজর লাগাকে বিশ্বাস করে না সে।

কিন্তু সেদিন কেউ কি দেখেছিল সেই লাল শাটিনের আবরণে মোড়া গোলগাল পুতুলটিকে?

না, কেউ সাক্ষী দিতে পারে নি, টুলু আর টুলুর চাকরকে দেখেছে।

বাতাস হয়ে উড়ে গেল চাকরটা? মন্ত্রবলে অদৃশ্য হয়ে গেল?

.

ছেলে হারানোর ঘটনা পৃথিবীতে নতুন নয়। কত রকম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই এ ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু নতুন নয় বলে কি মাতৃহৃদয়ের হাহাকার কিছু কম হয়?

তবু সে হাহাকারের ওপর হয়তো স্তর পড়ে নতুন শিশুর আবির্ভাবে। হারিয়ে যাওয়া সন্তানের তুলে রাখা জামা জুতো খেলনা পুতুলগুলি আবার মাটিতে নামে গভীরতর নিশ্বাসের মধ্য দিয়ে। যেসব বস্তু তাকে দিয়ে উঠতে পারা যায় নি, দেওয়া হয়নি, সে বস্তু সংগ্রহ করে এনে একে দিতে পারলেও যেন একটা শান্তি আসে। কথা প্রসঙ্গে একটি নিশ্বাসের সঙ্গে তার নামটুকু উচ্চারণ করা ছাড়া আর বড় কিছু থাকে না। কিন্তু সুনন্দার জীবনে আর নতুন শিশুর আবির্ভাব ঘটল না।

তাই উনিশ বছর ধরে সেই লাল শাটিনের ফ্রকটি সুনন্দার মনের মধ্যে জীবন্ত হয়ে আছে একটি রক্তাক্ত বিদারণ রেখা টেনে রেখে।

ডাক্তার বলেছিল, আর আশা নেই। প্রথম সন্তানের জন্মকালে ভিতরের যন্ত্র বিকল হয়ে গেছে। আশ্চর্য, সেই বিকলযন্ত্র দেহ আর বিকল মনটাকে নিয়ে অনায়াসে বেঁচে রইল সুনন্দা। আর শোভন রায় তাঁর অপরিসীম কর্মক্ষমতা আর অটুট স্বাস্থ্য নিয়েও ফেল করলেন হার্ট।

শোভন বেঁচে থাকতেও ইদানীং কাজ-কারবার বিষয়-সম্পত্তি সবকিছুর দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিলেন শুধু উকিল নয় ম্যানেজার ব্রজনাথকে। শোভন মারা যেতে তো আরোই দায়িত্ব পড়ল। সুনন্দা তো তাকিয়ে দেখা দূরে থাক, কানেও শোনে না। শোনাতে এলে শুনতে চায় না।

প্রথম প্রথম ভারি বিপন্ন বোধ করতেন ব্রজনাথ। বলতেন, আপনি এভাবে আমার সঙ্গে নন কোঅপারেশন করলে আমার কি অবস্থা হয় বলুন তো?

সুনন্দা বলত–ধরে নিন আমিও মারা গেছি!

অদ্ভুত অবস্থায় কেটে গেছে ব্রজনাথের সেই দিনগুলো।

সামান্য একটা সই করাবার দরকার হলেও সুনন্দার কাছে সাতবার আর্জি করতে হত।

দাসী কখনো এসে বলত, মা ঘুমোচ্ছেন। কখনো বলত, ডাকতে পারলাম না, কাঁদছেন। কখনো বলত, দরজায় খিল লাগিয়ে বসে আছেন, একশো ডাকাডাকিতেও খুললেন না।

অবশেষে একদিন ক্ষুব্ধ প্রশ্ন করলেন ব্রজনাথআপনি কি আমাকে অবিশ্বাস করেন মিসেস রায়?

অবিশ্বাস!

তা ছাড়া আর কি বলি বলুন? এক একটি সাইনের জন্যে এত অসুবিধেয় পড়তে হয় মাঝে মাঝে, নিশ্বাস ফেললেন ব্রজনাথ, আপনার দোকানের কর্মচারীরা কী যে ভাবে! যথাসময়ে মাইনে দেওয়াও সম্ভব হয়ে ওঠে না–

লজ্জিত হয়ে উঠেছিল সুনন্দা। মরমে মরে গিয়েছিল।

ছি ছি, নিজের শোককে নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছেকে এত বড় করে তুলে যথেচ্ছাচার করেছে সে। কিন্তু তা করলে চলবে কেন? সত্যিই যখন সে যথাসর্বস্ব মিশনে দান করে দিয়ে সন্ন্যাসিনী হয়ে চলে যাচ্ছে না।

চিরদিন বিলাসে অভ্যস্ত জীবন, কৃচ্ছসাধনের স্বরূপই জানে না ভাল করে। সে দিন থেকে চৈতন্য হল সুনন্দার।

বিনা বাক্যে, বিনা বিলম্বে ব্রজনাথের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে শুরু করল। কিন্তু সে কাজে কর্তব্য পালনই হয়, দিনের শূন্যতা পূর্ণ হয় না।

ক্রমশই অসহনীয় হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গতা।

একদিন ব্রজনাথকে ডেকে পাঠাল সুনন্দা। বলল, আর তো টিকতে পারছি না। ভাবছি আমার এক ভাইপোকে এনে কাছে রাখি।

ব্রজনাথ একটু চিন্তিত হয়ে বলেন, রাখবেন, সে তো খুবই ভাল কথা, কিন্তু একটা বাচ্ছার দায়িত্ব

সুনন্দা একটু হাসল। বাচ্ছা নয়।

বাচ্ছা নয়? তবে?

এঞ্জিনীয়ারিং পড়ছে।

ব্রজনাথের চোখে একটা ধূসর ছায়া পড়ল। কিন্তু কণ্ঠস্বর ছায়ামুক্ত, বরং যেন উৎফুল্ল।

ওঃ তবে তো কথাই নেই, বরং আপনার দায়-দায়িত্ব দেখতে পারবে।

সুনন্দা আর একটু হাসল, আমার দায়-দায়িত্ব দেখতে তো আপনিই আছেন, সে জন্যে না। এ শুধু আমার নিজের জন্যেই।

হ্যাঁ, শুধু নিতান্ত টিকতে না পারার কষ্টটা লাঘব করতে চায় সুনন্দা। কিন্তু ব্রজনাথকে না জানিয়ে তো কোনও কাজই করে নি সুনন্দা শোভনলালের মৃত্যুর পর থেকে। তাই এই প্রশ্ন।

ভাইপো!

ভাইয়ের ছেলে!

সুনন্দার দাদা বৌদিকে তো দেখেছেন ব্রজনাথ। সেই যে শোভনলালের আকস্মিক মৃত্যুর খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলেন প্লেনে করে।

পুনায় থাকেন। মিলিটারিতে চাকরি করেন। ছুটি কদাচ মেলে।

এসেছিলেন ভগ্নীপতির মৃত্যু সংবাদে, শ্রাদ্ধ শান্তি না ঢুকতেই চলে যেতে হয়েছিল। ছেলে মেয়ে অনেকগুলি, তাদের কাউকে নিয়ে আসেন নি, তাই কাউকে ব্রজনাথ দেখেন নি। যে ছেলেটির কথা বলছে সুনন্দা, সেটি সুনন্দার দাদা অলকেন্দ্রর মেজ ছেলে। তখন সে স্কুলের শেষ পরীক্ষা দিচ্ছে। এখন ছেলেটি যাদবপুর এঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তে এসেছে, হোস্টেলে ভর্তি হয়েছে, তাই সুনন্দার ইচ্ছে হোস্টেলে না থেকে পিসির কাছে থাকুক।

খুবই স্বাভাবিক ইচ্ছে, বলেছিলেন ব্রজনাথ, আপনার ঘর সন্তান সন্ততিতে পূর্ণ থাকলেও এ ইচ্ছে হতে বাধা ছিল না। এই তো নিয়ম সংসারের। নিকট আত্মীয় কলকাতায় থাকতে ছেলে হোস্টেলে থেকেই বা পড়বে কেন? কিন্তু কথা হচ্ছে–ব্রজনাথ বলেছিলেন, আপনার ভাইপো, বলাটা আমার সমীচীন হচ্ছে না, তবুও না বলে পারছি না মিসেস রায়, যা দেখছি আপনার ভাইপোর বয়েসটি বড় খারাপ, আর এই শহরটি ততোধিক খারাপ, এ ঝুঁকি নেওয়া সোজা নয়। হোস্টেলে থাকে চাপে থাকে, আপনার কাছে থাকা মানে বুভুক্ষু মাতৃহৃদয়ের উজাড় করা স্নেহের কাছে

সুনন্দা মৃদু হেসেছিল। বলেছিল, স্নেহাস্পদের অকল্যাণ ডেকে আনবে, এমন অসঙ্গত স্নেহ আমি দেব না ব্রজনাথবাবু, আর বয়সের কথা বলছেন? সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। সে ছেলে একটি হীরের টুকরো।

আর তবে কোন যুক্তি থাকতে পারে ব্রজনাথের?

–আপনার দাদার মত আছে তো?

–রাজী করিয়েছি।

অতঃপর সেই হীরের টুকরোটিকে বাড়িতে এনে প্রতিষ্ঠা করল সুনন্দা।

তা লেখায় পড়ায় আচারে আচরণে স্বভাব মাধুর্যে হৃদয়ের ঔদার্যে ছেলেটি হীরের টুকরোই বটে! সে এসে থাকার সঙ্গে সঙ্গে চাকর বাকরগুলো যেন তার চরণে হৃদয় সমর্পণ করে বসল।

মাঝে মাঝে রায় কোম্পানি, অর্থাৎ ফার্নিচারের ওই দোকানটাতেও যায় উদ্দালক। তারাও ওর কমনীয় মুখ আর কোমল কথায় মুগ্ধ।

আর সুনন্দা?

সে তো ব্রজনাথের ভাষায় তার বুভুক্ষু মাতৃহৃদয়ের উজাড় করা স্নেহ দিয়ে ডুবিয়ে রেখেছে উদ্দালককে, ডুবে বসে আছে নিজে।

শুধু ব্রজনাথই তেমন সুচক্ষে দেখেন না ছেলেটাকে। তার মনে হয় তার দিকে চোখ পড়লেই ও যেন ব্যঙ্গ হাসি হাসে।

হয়তো তাঁর সেই ধারণাটা নেহাৎ ভুলও নয়। ব্যঙ্গ না হোক, কৌতুকের হাসি হাসে উদ্দালক, ব্রজনাথের ওই সাজানো সাধু ভাষায় গড়া কথা শুনে। বলে, উনি যেন সর্বদা ওঁর মাই লর্ডের সামনে কথা বলছেন। যেন ওঁর দুদিকে দুপক্ষের মক্কেল দাঁড়িয়ে আছে।

এই কৌতুকটাকেই ব্যঙ্গ ভাবেন ব্রজনাথ, আর অপ্রসন্ন হন। কিন্তু অপ্রসন্ন হয়ে আর কি হবে। যতদূর দেখা যাচ্ছে, পাকাপাকি দত্তক না নিলেও, প্রায় পুষ্যিপুতুরই করে নিচ্ছে সুনন্দা উদ্দালককে। দেখা যাচ্ছে তার প্রথম সোপান।

ব্রজনাথ অবশ্য বলেছিলেন একদিন, আপনার তো অনেকগুলি ভাইপো ভাইঝি, তা সবাইকে বঞ্চিত করে একজনকে দিলে, একটু অবিচার করা হবে না কি?

সুনন্দা হেসে উঠেছিল বঞ্চিত করা বলছেন কেন ব্রজনাথ বাবু? তারা তো আর আমার এই সম্পত্তির ওপর দৃষ্টি দিয়ে বসে নেই? আমার দাদার অবস্থাও এমন কিছু খারাপ নয়, যথেষ্ট ভালই বরং। চারটি ছেলে তার, তাদের মধ্যে একজনকে যদি আমি একটু মেহদৃষ্টিতে দেখি, যদি তাকে কিছু দিই, আর সকলের ওপর অবিচার করা হবে কেন সেটা? তাছাড়া আর একটু হেসে কথার উপসংহারে এসেছিল সুনন্দা–তাছাড়া একেবারে বিনা স্বার্থেও তে দেব না আমি। আমার তো জীবনের শেষ পরিণতি আছে? ও আমাকে দেখবে। সম্পত্তিটা পেলে তো আমায় ফেলতে পারবে না?

এ কথা শুনে অবশ্য ব্যঙ্গ হাসি হেসেছিলেন ব্রজনাথ। বলেছিলেন, ফেলতে পারবে না সেটা লিখিয়ে নেবেন?

নাঃ, লিখিয়ে নেব না। শুধু অলিখিত একটা চুক্তি থাকবে দুজনের মধ্যে।

আমাকে মাপ করবেন মিসেস রায়, বলেছিলেন ব্রজনাথ, আপনার সরলতা আমার শ্রদ্ধা উদ্রেকের চাইতে হাস্যোদ্রেকই করছে। আমরা ল-ইআররা যেখানে বাস করি, সেটা হচ্ছে মনুষ্য

জগতের ভিতর পিঠ। যেখানে পালিশ নেই, মলাট নেই, একেবারে উগ্র নগ্নতা। তাই আপনার এই সরলতাকে প্রশংসা করতে পারছি না। নিজের গর্ভজাত সন্তানই মাকে কত ঠকায়, সে খবর রাখেন আপনি?

সুনন্দার মুখটা একটু লাল হল। বলল–তেমন দুর্ভাগ্য হলেও তো করবার কিছু থাকে না ব্রজনাথ বাবু! তবু বলব এ সন্দেহ করলে, আমার পিতৃবংশের সম্ৰান্ততার প্রতি অবিচার করা হবে।

ক্ষমা চাইছি আমার ধৃষ্টতার জন্যে, মিসেস রায়, তবু আপনার কাছে হাতজোড় করছি, এখুনি একেবারে যথাসর্বস্ব দান করে বসবেন না, এখনো আপনার জীবনের অনেক বাকী।

তা সুনন্দাও অবশ্য তখুনি সর্বস্ব ত্যাগ করতে বসে নি, শুধু ওই অলিখিত চুক্তি রচিত হচ্ছিল, উদ্দালকের সঙ্গে যতটা না হোক, তার মায়ের সঙ্গে।

ছেলে বড় জিনিস!

দশটি থাকলেও কারও মনে হয় না–অনেকগুলো আছে একটা বিলিয়ে দিই। অথবা আমার তো অনেক আছে, ওর নেই, ওকে দান করি।

দত্তক যারা দেয়, কোন প্রাণে দেয় কে জানে। তবে দিয়েদিলাম না, অথচ আমার ছেলেটিকে কেউ একটু বিশেষ স্নেহের দৃষ্টিতে দেখে প্রাণ ঢেলে দিচ্ছেগুচ্ছে, সেটা মন্দ নয়।

সুনন্দার ভাজও সেই হিসেব হাতে রেখেছেন। এমনিতে তো এঞ্জিনিয়ার ছেলে তার আঁচলতলায় বসে থাকবে না, দেশ বিদেশে ছুটবেই। কাছছাড়া তো হলই পড়ার শুরু থেকে। তা এই কাছছাড়া বাবদ যদি দুর্ভাগিনী ননদটার একটু শান্তি হয়, সেটা মহৎ লাভ। আবার সে বাবদ যদি ছেলেটার ভবিষ্যৎ জীবন পথ আরও মসৃণ হয়, সেটাও কম লাভ নয়।

তাই ক্রমশই উদ্দালক পিসিমার সম্পত্তিতেই পরিণত হচ্ছে।

ছুটি হলে মা বাপের কাছে যায়।

তাও সব সময় পুরো ছুটিটা কাটিয়ে আসে না। সুনন্দার দাদা লেখেন, বালগোপাল তো মা যশোদাকে ছেড়ে থাকতেই পারে না দেখছি, এসেই যাই যাই করছে।

তা সবটাই যে একেবারে পিসিমার প্রতি বিগলিত স্নেহ তাও নয়। কলকাতার খেলাধূলো বন্ধু আচ্ছা, এ বাড়ির সর্বেসর্বা হয়ে থাকার পরিতৃপ্তিময় স্বাধীনতার সুখ, এগুলোও কম কাজ করে না।

এসবের আকর্ষণ অনেক।

তাছাড়া উদ্দালুকের স্বভাব দরদী মন সুনন্দার নিঃসঙ্গতাকে সূক্ষ্ম তারে অনুভব করতে পারে।

কখনো কখনো বারান্দায় বেতের চেয়ার পেতে কখনো কখনো ছাদে পাটি পেতে চুপচাপ শুয়ে থাকে সুনন্দা। যেন আপনাকে অনন্ত শূন্যতার মাঝখানে হারিয়ে ফেলে।

তখন উদ্দালক এসে কাছে বসে। তখন তোলে সেই মেয়েটার কথা। সেই উনিশ বছর আগের কথা।

ও যেন অনুভব করে এই মুহূর্তে এ আলোচনার প্রয়োজন আছে। তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই সব প্রশ্নই করে, আচ্ছা পিসিমা ছবি নেই কেন?

একটা নিশ্বাস ছড়িয়ে পড়েছিল বাবা, কত ছিল। পুরো একটা অ্যালবামই ছিল। পুলিস থেকে চাইল, তখন আশায় পড়ে বুক ছিঁড়ে দিয়ে দিলাম। আর ফেরত দিল না। কতদিন ধরে ঘোরালো তারপর বলল হারিয়ে গেছে। মেয়েও গেল, তার চিহ্নটুকুও গেল।

আশ্চর্য! আচ্ছা, যে স্টুডিও থেকে তুলিয়েছিলে? তাদের কাছে তো নেগেটিভ থাকে?

সে খোঁজেও ত্রুটি হয় নি বাবা। তোমার পিসেমশাই শেষকালে খুবই চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ্য প্রবল হলে যা হয়। শুনলাম সে স্টুডিওই উঠে গেছে লোকসানের দায়ে। তার মালিকের কোনও পাত্তা পাওয়া যায় নি।

আচ্ছা পিসিমা, তোমার কি মনে হয়?

আগে কত কি-ই মনে হত বাবা, আবার কিছুই মনে হত না। সব কেমন ঝাপসা হয়ে যেত। মারা গেছে, চাকরটার সুষ্ঠু কোনও অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, ভাবতে চেষ্টা করতাম। কিন্তু ঝাঝার মত অতটুকু টাউনে ওরকম একটা কিছু ঘটলে সে কি চাপা থাকত?

পুকুর-টুকুর ছিল না?

নাঃ, পুকুর কোথা?

শুকনো কুয়ো-টুয়ো

সব দেখা হয়েছিল। লোক লাগিয়ে কাঁটা নামিয়ে।

ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই একই কথা।

আবার একসময় সুনন্দাই বলত, ভাবি সে আমার জিনিস ছিল না। থাকলে থাকত। এখন ভগবান তোকে বাঁচিয়ে রাখুন, সুস্থ রাখুন।

দুধের সাধ কি আর ঘোলে মেটে পিসিমা? হেসে উঠত উদ্দালক।

সুনন্দা বলে–তুই আমার ক্ষীর। আবার একটু পরে হয়ত বলত যাকগে ওসব কথা থাক। তুই বরং একটা গান গা।

গান! আমার আবার গান?

তা হোক। বেশ তো গাস তুই।

তা গায় উদ্দালক। শুধু গলায়। গলা ভাল সেইটুকুই কাজে লাগে।

এইভাবেই চলছিল। হয়ত এইভাবেই চলত। হঠাৎ নিস্তরঙ্গ জলে এসে পড়ল প্রকাণ্ড এক পাথরের চাই।

সে পাথর ফেললেন ব্রজনাথ।

ব্রজনাথ এসে সুনন্দাকে নিভৃতে ডেকে বললেন, অদ্ভুত একটা খবর আছে মিসেস রায়!

কী সেই খবর? যা একা সুনন্দাকে নিভৃতে ডেকে শোনাতে হয়? কারও কোনও ভয়ঙ্কর বিশ্বাসঘাতকতায় কি রায় কোম্পানি দেউলে মেরে যেতে বসল?

প্রথম মুহূর্তে সেই কথাই ভেবেছিল সুনন্দা। সঙ্গে সঙ্গে মনকে প্রস্তুত করে নিচ্ছিল সেই বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনী শোনবার জন্যে! কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনীর পরিবর্তে এতবড় একটা অবিশ্বাস্য কাহিনী শোনাবেন ব্রজনাথ একথা কে ভেবেছিল। উনিশ বছর আগের সেই রহস্যের যবনিকা উত্তোলিত হয়েছে। সেই অন্তহীন অন্ধ প্রশ্নের উত্তর মিলেছে।

একটা অসাড় চিত্তের পৃষ্ঠপটে কে যেন চকিত বিদ্যুতের ঝিলিক হানছে।… আলোর বুদ্বুদ উঠছে মিলিয়ে যাচ্ছে। আলোর কমলের ওপর এসে এসে পড়ছে কুয়াশার আস্তরণ।

বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের আলোছায়া। আশা-নিরাশার আলোছায়া। সুনন্দা ব্যাকুল হচ্ছে।

তারপর কী হল আগে বলুন–বলে বলে চিৎকার করে উঠছে সুনন্দা।

কিন্তু ব্রজনাথ দ্রুতছন্দে আসছেন না। ব্রজনাথ থেমে থেমে রয়ে রয়ে সেই অবিশ্বাস্য কাহিনী ব্যক্ত করছেন।

.

ব্রজনাথ বলছেন, উনিশ বছর আগে ছোট সেই টাউনটায় আরও একজন গিয়েছিল। এক সন্তানক্ষুধাতুরা বন্ধ্যানারী।

কিন্তু কেন গিয়েছিল? হাওয়া বদলাতে? নাকি সুনন্দার সঙ্গে পূর্বজন্মের শত্রুতা সাধতে? ঈশ্বর জানেন গত জন্মে কে কার কাছে অপরাধী ছিল। কে কার নিমিত্ত হল।

বন্ধ্যা নারী। একটি শিশুর বাসনায় উন্মাদ। সেই অতৃপ্ত হাহাকারের উপর আর এক শূন্যতার হাহাকার, স্বামী বিমুখচিত্ত। স্বামী উম্মুঙ্খল।

সেই মন নিয়ে ঈশ্বরের সাধনা করতে পারত সে। পারত লোকসেবায় মন দিতে। কিন্তু তা পারে নি সে। একটি কচি কোমল শিশুদেহের কল্পনা তাকে উন্মাদ করে দিত। সেই উন্মাদনার মুখে, দেখতে পেল টুলুকে। কেমন করে যেন একদিন সুনন্দার চাকর গিয়ে পড়েছিল তাদের বাড়ির সামনের বাগানে।

চোখ জ্বলে উঠল উন্মাদিনীর। হাতছানি দিয়ে ডাকল চাকরটাকে।

তারপর ধীরে ধীরে সেই হাতছানি দেওয়া হাত এগিয়ে এল টাকার তোড়া নিয়ে। চাকরটাকে হাত করতে দেরি হল না অতএব।

যে সন্ধ্যায় সেই হিতাহিত জ্ঞানহীনা ধর্মাধর্ম জ্ঞানহীনা নারী ওই ছোট্ট টাউনটা থেকে পালাবে, পালিয়ে গিয়ে মিলিয়ে যাবে একটা বিরাট শহরের অগাধ জনসমুদ্রের মধ্যে, সেইদিন বিকেলে লাল শাটিনের ফ্রক পরে বেড়াতে বেরিয়েছিল টুলু চাকরের সঙ্গে।

অনেক টাকা নিয়ে দেশে চলে যেতে পারলে, বিবেককে দাবানো যায় বৈকি। মহা মহা শিক্ষিত লোক দাবাচ্ছে, ভাল ভাল ন্যায়-নীতিজ্ঞরা দাবাচ্ছে, বড় বড় আইনের ধ্বজাধারীরা দাবাচ্ছে, আর এ তো সামান্য একটা চাষার ঘরের ছেলে।

টাকাটা নিয়ে গিয়ে দেশে বিঘেকয়েক জমি আর দুটো মোষ কিনতে পারলেই তো একজন গৃহস্থ হয়ে বসা যায়। ছেড়ে আসতে হয় না নবপরিণীতা বধূকে, দারিদ্রগ্রস্ত মা-বাপ ভাই বোনকে।

আর? আর জীবনভোর মনিবের জুতো ঝাড়তে হয় না। হয় না সে জুতোর ঠোক্কর খেতে।

সামান্য একটু বিবেকের কামড়। তার বেশি আর কিছু না। মেয়েটাকে মেরেও ফেলছে না, কেটেও ফেলছে না। পথেও ফেলে দিয়ে যাচ্ছে না।

একটা মা-র কাছ থেকে আর একটা মা-র কাছে গচ্ছিত রাখছে।

চাকরটা মনে মনে কী ভেবেছিল, তার ব্যাখ্যা ব্রজনাথই করেন এইভাবে। আরও বলেন, –ব্যাটা বোধহয় ভেবেছিল আপনার তো তবু আবার হবার সম্ভাবনা আছে। এই মানুষটার সে দিনও নেই আর। বয়সে মেয়েমানুষটা নাকি আপনার মায়ের বয়সী।

তারপর কী হল বলুন আগে।

তারপর?

তারপরের কথা তো আর পরপর জানেন না ব্রজনাথ। ব্রজনাথের এক ডাক্তার বন্ধু তার এক রোগিণীর মৃত্যুকালের স্বীকারোক্তির সূত্রে এই নাটকীয় কাহিনী শুনিয়েছিলেন ব্রজনাথকে।

ব্রজনাথকে সব বলে বলেছিলেন, আমার তো মনে হচ্ছে এই মেয়েই আপনার সেই শোভন রায়ের মেয়ে। স্থান-কাল-পাত্র সবই তো মিলে যাচ্ছে হুবহু।

এমন কি মৃত্যুপথযাত্রী নাকি এ কথাও বলেছে–লাল টুকটুকে জামা পরা সেই মেয়েটাকে বুকে চেপে ধরা মাত্র মনে হল, এ যেন আমারই জন্মজন্মান্তরের। লাল টুকটুকে জামাটাও কি মিলে যাবে অন্যের সঙ্গে?

এই সেই মেয়ে। আবার বলেছিলেন ব্রজনাথ।

একবছরের অস্ফুটবাক্ শিশুটি আজ কুড়ি বছরের ভরন্ত যুবতী।

রং? তা সেই দুধে শিশুর গোলাপী রং কি আর বজায় থাকে চিরকাল? তাছাড়া অনেক ঐশ্বর্যে ভরিয়ে রাখবার সংকল্প নিয়ে মেয়ে চুরি করেছিল যে, সহসা নিজেই সে হয়ে গেল গরীব। স্বামী মারা গেল। গেল আরও অনেক কিছু–দুঃখের সাগরে ভাসল মেয়েটাকে নিয়ে।

কিন্তু তার পরিচয়? ডাক্তার জানে না?

ওইটি প্রশ্ন করা চলবে না। সেই ডাক্তার বন্ধু বলেছিল ঘাড় নেড়ে, তা হয় না। সে বলা যায় না। তুমি তো জানো ভাই আমাদের ব্যবসার মূলমন্ত্র। ডাক্তার আর উকিল, এদের পেট আলগা হলে চলে না। রোগীর আর মক্কেলের লুকোনো কথা সযত্নে গোপন করতে হয়।

তা বলে এত বড় একটা অপরাধের কথাও?

তাতে কি। তুমি উকিল, তুমি আবার ধর্মকথা কইছ কোন্ মুখে? খুনীকে সাধু আর সাধুকে খুনী সাজানোই যাদের পেশা।

কিন্তু

ওর আর কিন্তু নেই। বুঝলাম জঘন্য অপরাধ। গর্হিত অপরাধ। কিন্তু আর কি সেই অপরাধিনীকে এনে তোমাদের ধর্মাধিকরণের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারবে? সুপ্রীম কোর্টের অনেক ঊর্ধ্বে আর এক মহাবিচারকের যে বিচারশালা, সেখানের কাঠগড়া আছে তার জন্যে।

সুনিপুণ ভঙ্গিমায় আলঙ্কারিক ভাষায় সমস্ত ঘটনা উদঘাটিত করলেন ব্রজনাথ। জানালেন এখন সম্প্রতি মেয়েটি আছে সেই মৃতা মহিলাটির পরিচিত একটি দরিদ্র পরিবারে। ডাইনে আনতে বাঁয়ে কুলোয় না তাদের, এর উপর আবার একটা পরের মেয়েকে পোষা! যতই মোটা ব্যবস্থায় থাক, তবু

শিউরে উঠেছিল সুনন্দা। তার টুলুর সম্পর্কে এই অবহেলাকর উক্তিতে প্রাণটা করকর করে উঠেছিল তার।

যে সুনন্দার বাড়িতে পাঁচ ছটা ঝি-চাকর রাজার হালে খাচ্ছে মাখছে, সেই তার টুলু রেশনের মোটা চালের ভাত খাচ্ছে, মোটা ক্যাটকেটে শাড়ি পরছে!

তবে হাঁ। সেই পালিকা মা এইটুকু করে গেছেন টুলুর। একটু লেখাপড়া শিখিয়ে গেছেন। নেহাৎ মুখ করে রেখে যাননি। ইন্টারমিডিয়েট অবধি পড়িয়েছিলেন তিনি। তারপর তো হয়েই গেল তার। এখন ওই উদ্বাস্তু কলোনিতে

উথলে উঠেছিল সুনন্দা।

আপনি এখনি নিয়ে আসুন।

ব্রজনাথ বললেন, না মিসেস রায়, সেটা ঠিক হবে না। এতদিনই যখন গেল, একটা দিনে আর–

আপনি কেন এতদিন পরে বললেন?

কী মুশকিল! শোনামাত্রই তো আপনাকে শুনিয়ে একটা এলোমেলো কাণ্ড করতে পারি না। যদি বাজে খবর হয়? যদি অন্য মেয়ে হয়? আপনাকে বৃথা আশায় কম্পিত করেনা মিসেস রায়, সেটা আমি যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করি নি। সব খোঁজ নিয়ে, জেনে বুঝে নিঃসংশয় হয়ে তবে। হ্যাঁ তবেই বলেছেন ব্রজনাথ, এবং একটা দিন প্রস্তুত হতে সময়ও. দিলেন মা মেয়েকে।

.

আজ নিয়ে এসেছেন।

আজ সুনন্দার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলছেন, এই সেই মেয়ে।

এখন কি নাম তোমার?

মেয়েটি এবার মুখ তুলে স্পষ্ট গলায় বলল, সীমা সেন।

না না, সেন নয়। আজ থেকে তুমি রায়।

তাহলে আমার ম্যাট্রিকের সার্টিফিকেট বদলাতে হবে!

সীমার এই স্পষ্ট ধরনের বাস্তব কথায় সুনন্দা কি একটু চমকালো? ভাবল কি, এর মধ্যে টুলু কোথায়?

কিন্তু ব্রজনাথ তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গকে সামলে নিলেন। বললেন, ওসব তোমার ভাবতে হবে না মা! ওর জন্যে আমি আছি। করতে তো এখন অনেক কিছুই হবে। রায় কোম্পানির এতবড় বিজনেস, এই সব বিষয় সম্পত্তি সব কিছুরই তো মালিক হলে তুমি এখন।

সীমাকে অন্তঃপুরে নিয়ে এল সুনন্দা।

স্নেহটা উথলে উঠতে গিয়ে কেমন যেন পিছিয়ে আসছে। এ যে সম্পূর্ণ আস্ত একটা মানুষ। একে তিল তিল করে গড়ে তোলবার তো কোথাও কোনখানে অবকাশ নেই।

আর, ওর মনের আবরণ? এই কুড়ি বছরের জল হাওয়া পরিবেশ পরিস্থিতিতে গঠিত কঠিন সেই আবরণ ভেদ করে ঢুকতে পারবে সুনন্দা ওর অন্তরে? না কি প্রতিহত হয়ে ফিরে আসবে সুনন্দার হৃদয়? তবু চেষ্টা করতে হবে বৈকি। সে চেষ্টায় জয়ীও হতে হবে সুনন্দাকে।

ছেলের বিয়ে দিয়েও আস্ত একটা মানুষকে তো ঘরে আনে লোকে। তার হৃদয় স্পর্শ করতে চেষ্টা করে।

.

এই তোমার ঘর। কাল সারাদিন ধরে গুছিয়েছি। সুনন্দা ওকে হাত ধরে খাটের ওপর বসাল।

চারিদিকে চোখ ফেলে দেখে সীমা। তার পরিচিত জগতের বাইরের সব বস্তু, বিলাসিতার উপকরণ। এরকম ঘরদোর জানলা মেজে খাট বিছানা আসবাব আয়োজন আর কোথাও দেখেছে সীমা?

দেখেছে। সিনেমার ছবিতে। দৈবাৎ এক আধদিন পরের পয়সায়। তা ছাড়া আর কোথাও না। কি সীমার জীবনটাও তো নাট্যকাহিনীর পর্যায়ে পড়ছে। সিনেমার ছবির মতই আশ্চর্য কাণ্ড ঘটছে।

এই দেখ, এইটে বাথরুম। এর মধ্যে তোমার যা যা দরকার সব জিনিসই পেয়ে যাবে।

সীমা তাকিয়ে দেখে হঠাৎ আড়মোড়া ভেঙে বলে, এসবের কিছুই দরকার হবে না আমার।

দরকার হবে না! দরকার হবে না কেন? সুনন্দা আহত দৃষ্টিতে তাকায়। মেয়েটার এত খটখটে কথা কেন?

সীমা হেসে উঠে বলে, দরকার হবে না কেন জানেন? জীবনেও কখনো ওসব জিনিস চোখে দেখি নি বলে। ব্যবহারই জানি না এত সবের।

ও, এই কথা। সুনন্দার স্নেহের সমুদ্রে জোয়ার ওঠে। আহা বাছা রে! কত কষ্টের মধ্যে মানুষ হয়েছে! কত দুঃখে কাটিয়েছে এতগুলো দিন! কথাবার্তাও ঠিক খটখটে নয়। কৃত্রিমতা বর্জিত, সরল। একেবারে সরল। সুনন্দাও অতএব হাসে।

অভ্যাস হতে আর কতক্ষণ লাগবে? এই তো, এইটা হচ্ছে শাওয়ারের ট্যাপ, এইটা স্নানের টবের

সীমা সেদিকে না তাকিয়েই বলে, আপনার বাড়িতে তো অনেক ঝি-টি থাকবার কথা, নেই? তাদেরই কাউকে পাঠিয়ে দিন না। আপনি কেন এত কষ্ট করছেন?

ঢেউ ফিরে আসে।

সুনন্দা আহত কণ্ঠ গোপন করতে পারে না। বলে, এতে আমার কষ্ট হচ্ছে ভাবছ কেন? আমার কত আনন্দ আজ। আর আমাকে আপনি বলছ কেন? আমি তোমার মা। তুমি বলবে।

নিজেই যে তুই বলতে গিয়েও বলতে পারছে না, তুমি বলছে, সেটা মনে পড়ে না সুনন্দার।

সীমা ওর ওই আহত কণ্ঠে বোধকরি একটু অপ্রতিভ হয়। তাই মাথাটা নীচু করে বলে, সময় লাগবে।

.

সময় লাগবে। সময় লাগবে! কিন্তু সময় লাগলে কি চলে? অনেক সময় যে বয়ে গেছে।

দাসদাসী আশ্রিত অনুগত আত্মীয় প্রতিবেশী সবাই এসে দাঁড়াচ্ছে, দেখছে, প্রশ্ন করছে। অধিক প্রশ্ন করা অবশ্য সুনন্দার নিষেধ। ছোট ছোট প্রশ্ন। নাম কি, কোন্ পাড়ায় থাকতে এতদিন, কতদূর পড়েছ, এই সব।

নাম?–তা নাম তো শুনেইছ সবাই, সীমা।

কোন্ পাড়ায় থাকত? একটা পাড়ায় তো আর আজীবন নয়। পূর্ববঙ্গ থেকে যখন চলে এসেছিল, কত ঘাটের জল খেতে হয়েছিল তখন ওর পালক পিতামাতাকে।

ও মা, কী সর্বনাশ! পাকিস্তানে টেনে নিয়ে গিয়েছিল মাগী?

পাকিস্তানে নয়, পূর্ব বাঙলায়। উনিশ বছর আগে পাকিস্তান কথাটার সৃষ্টি হয় নি।

পড়া? দুটো পাস করেছিল। পয়সার অভাবে আর পড়া হয়ে ওঠে নি।

পয়সার অভাবে? আহা হা! তোরই বাপের পয়সায় কত গরীবের ছেলে লেখাপড়া শিখে, তরে গেল।

না, এর আর উত্তর দেয় না সুনন্দার হারানো মেয়ে, খুঁজে পাওয়া মেয়ে।

আশ্চর্য, যখন খুঁজে খুঁজে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল, তখন পাওয়া গেল না। আর যখন সমস্ত খোঁজার শেষ হয়েছে, তখন–অপ্রত্যাশিত এই পাওয়া।

সীমাকে ওর ঘরে প্রতিষ্ঠিত করে স্বামীর জন্যে বড় কান্না কাঁদল সুনন্দা। সেই যদি পাওয়াই গেল, কটা বছর আগে কেন গেল না? শোভনকে কেন হাহাকার করা প্রাণটা নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হল?

কিন্তু না, সুনন্দার আর সে দিন নেই। ইচ্ছেমত পড়ে কদবার।

সুনন্দার জীবনে কর্তব্যের ডাক এসেছে। অপরিচিতাকে আপন করে নিতে হবে। দূরকে নিকট। সুনন্দাকেই ভাঙতে হবে আড়ষ্টতার বাধা। নিজের এবং ওর। নইলে শাস্ত্রে কেন বলেছে স্নেহ নিম্নগামী। সুনন্দাকেই অপর্যাপ্ত স্নেহ ঢেলে ভরিয়ে তুলতে হবে ওর শূন্যতা, ভিজিয়ে তুলতে হবে ওর শুষ্কতা। ওর দিক থেকেই দেখতে হবে সবটা। মায়ের প্রতি অগাধ ভালবাসা এখুনি কোথায় পাবে ও?

.

ব্রজনাথ পরামর্শ দিয়ে গেছেন এখুনি চট করে ওর গত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করে কাজ নেই। মনটা কঠিন হয়ে যাবে, বিমুখ হয়ে যাবে। তাছাড়া এত ঐশ্বর্য এত আড়ম্বর জীবনে তো কখনো চোখে দেখে নি, ভিতরে ভিতরে একটা হীনমন্যতা-বোধ আসাই স্বাভাবিক। আস্তে আস্তে সহজ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ওকে ওর বিচ্ছিন্ন শিকড়ের সঙ্গে জুড়তে হবে।

আর একটা কথা। বলেছিলেন ব্রজনাথ, আপনার ভাইপোটি তো এখন ছুটিতে বাড়ি গেছে। তা বলছিলাম কি, প্রথমটা তার হোস্টেলে এসে উঠলেই ভাল হত না?

সুনন্দা অবাক হয়ে বলেছিল, কেন?

না, মানে, বলছিলাম সীমা, মানে আপনার গিয়ে কি বলে টুলু, একটু অপ্রতিভ হতে পারে তার সামনে।

কী যে বলেন ব্রজনাথবাবু! নস্যাৎ করে দিয়েছিল সুনন্দা তার আশঙ্কা, বরং একটা কাছাকাছি বয়সের মানুষ পাবে। সেখানেও তো ভাইবোন ছিল না। একটা দাদা পেয়ে বাঁচবে। দুলুও তো আমার ছেলেই।

দুলু। উদ্দালকের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। টুলুর ধ্বনির সঙ্গে মিলিয়ে রাখা।

এ নাম সুনন্দার দেওয়া, আদরের ডাক নাম। বাড়িতে ওকে পুরো নামেই ডাকে সবাই।

সেই তো! সেইটিতো হচ্ছে কথা, বিজ্ঞ হাসি হেসেছিলেন ব্রজনাথ, আপনার প্রায় ছেলে বলেই তো ভাবনা। মানুষের মনস্তত্ত্ব বড় জটিল মিসেস রায়! পরস্পরের প্রতি ঈর্ষান্বিত হওয়াও অসম্ভব নয়।

কী আশ্চর্য! কি বলছেন ব্রজনাথবাবু? ঠিকরে উঠেছিল সুনন্দা। এ কী কথা?

ব্রজনাথ কিন্তু অপ্রতিভ হন নি। বলেছিলেন, আপনার সরলতাই জয়ী হোক এই প্রার্থনা করি মিসেস রায়। তবে কথাটা কি জানেন? মানুষ জীবটা নেহাৎ রক্ত-মাংসেই তৈরী। আর সেটা আমরা উকিলরা বড় বেশি জানি।

তাঁ, সুনন্দাও তা জানে। মানুষ রক্ত-মাংসে তৈরী। কিন্তু সেই রক্ত-মাংসটাই তার শেষ কথা এ কথা সে মানে না। মানুষ শব্দটার অন্য অর্থ আছে।

দুলু এসে টুলুকে হিংসে করবে! এত অনিয়ম সম্ভব? পৃথিবীতে তা হলে চন্দ্র সূর্য ওঠে কেন? বর্ষার পর শরৎ, আর তারপর হেমন্ত আসে কেন?

উদ্দালক ছুটিতে বাড়ি গেছে। সুনন্দা তার জীবনের এই আকস্মিক তোলপাড় কাণ্ডর কথা আর চিঠি লিখে জানায় নি ভাইয়ের বাড়ি। জানানো সম্ভব হয় নি তার পক্ষে।

কাগজ কলম নিয়ে বসেছিল একবার, কিন্তু শ্রীচরণেষু দাদা–বলেই থামাতে হয়েছে। কলম। কোন ভাষাই সুনন্দার মনের স্ট্যাণ্ডার্ডে পৌঁছতে পারে নি। তার জানা বাংলা ভাষাকে নিতান্তই জৈালো, পঙ্গু, দীন মনে হয়েছে।

উদ্দালককে লিখবে তবে? নাঃ, তাও হয় না। তার থেকে সে আসুক। দেখুক। তারপর নিজের মা-বাপকে যেমন করে পারে খবরটা জানাক।

কবে যেন আসবে উদ্দালক? ক্যালেণ্ডারে দাগ দেওয়া আছে না?

তা সে যে ছেলে, কবে কখন কোন গাড়িতে আসছে কিছুই জানাবে না হয়তো। দুম্ করে একদিন এসে পড়বে। মেয়াদ ফুরোবার আগেই।

.

স্নান সারা হয়েছে। সীমা ঘুরে ঘুরে দেখছে। দাসী নিয়ে বেড়াচ্ছে। বাড়িটার সর্বত্র।

শুনেছিল এদের আর কোন ছেলেমেয়ে নেই। গিন্নীও তো বিধবা। তবে পুরুষের ব্যবহারের এত জিনিস কেন সর্বত্র?

ওই সুন্দর সাজানো-গোছানো ঘরটা কার? আর স্ট্যান্ডের ওপর বসানো ওই ছবিখানা? মুখের সঙ্গে সুনন্দার মুখের তো যথেষ্ট আদল আছে। ছেলে আছে না কি মহিলাটির? এটা কি হল তবে? অঙ্কে মিলছে না তো! দেখে ফিরে যাচ্ছিল নীরবে, হঠাৎ বলে উঠল, ছবিটি কার?

ঝি তারুর মা বলল, ওই যে বললাম, দাদাবাবুর ঘর এটা। কান কর নি বুঝি?

দাদাবাবু? ছেলে আছেন?

আহা, তা ছেলে বললেই ছেলে। ভাইপো আর ছেলে কি ভেন্ন? এই তুমি তো কথায় শোওয়া বয়সেই কোল ছাড়া, মানুষটার কী হাহা করা মন তা বল? তবু বাবু য্যাখন ছিল একরকম। বাবু যেতেই পাগল হয়ে ওই ভাইপোটিকে এনে কাছে রাখল। তবু তো বুক ঠাণ্ডা। তা তুমি সে বিষয়ে মনে কিছু কোরো নি। সে তোমার ছেলে একদিকে, দেবতা একদিকে। তোমায় যে হিংসে করবে তা ভেব না।

হিংসে! সীমা ভুরু কুঁচকে বলে, আমায় হিংসে করতে যাবেন কেন?

বলে ফেলেই বুঝেছিল তারুর মা, কথাটা বলা ভাল হয় নি। তাই সামলে নিয়ে বলে, না, সে কিছু না। ও এমনি কথার কথা বললাম। দাদাবাবু কি আর হিংসে করবার ছেলে?

তা কোথায় তিনি? কলেজে গেছেন বুঝি?

না, কলেজে নয়। ছুটি হয়েছে তাই মা-বাপের কাছে গেছে। এই বছর শেষ পড়ার পরীক্ষা দেবে।

কৌতূহল সন্দেহজনক কি না, সেটা না ভেবেই প্রশ্ন করে সীমা, সেটা কোথায়? ওই মা বাবার বাড়ি?

সেই যে গো ডেরাডুন না কোথায়। মায়ের দাদা তো মিলিটারি। তা মায়ের দাদাই বা বলছি কেন? তোমার তো মামা হন গো। সবই জানতে পারবে ক্রমশ। ঘরের ছেলে পরের হয়ে ছিলে এতদিন, চেনা-পরিচয় তো কিছুই নেই।

আড়ালে গিয়ে ঝিমহলে কিন্তু এই হৃদ্যতার সুর বজায় রাখে না তারুর মা। বলে, কোথায় কাদের কাছে মানুষ হয়ে এসেছে এতকাল, দিব্যি পাকাচোকাটি হয়ে উঠেছে। এল বটে, ধাড়ি শালিখ পোষ মানলে হয়। বলব কি দাদাবাবুর ছবিখানা যেই চোখে পড়েছে, যেন কাঠ। তারপর নানা জেরা, এ ছবি কার? ছেলে নাকি? ভাইপো, তবু ভাল। তা থাকে কোথায়? …মানে মনের মধ্যে তো খেলছে আমিই সর্বেসর্বা।

রজনী বলে, যাই বল বাপু, সত্যি কথা বলছি, মায়ের আহ্বাদ হয় হোক, আমার কেমন প্রাণের মধ্যে সুর বাজছে না। সেই ছোটকালে আসত তো আসত। এ যেন উড়ে এসে জুড়ে বসা। দাদাবাবুকে কি আর স্থলকূল দেবে?

মানুষ রক্তমাংসের জীব। এ তথ্য সবাইয়ের জানা। শিক্ষিত-অশিক্ষিত আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই বোঝে–এই পরম সত্যকে চোখ বুজে অস্বীকার করা যায় না।

অথচ সুনন্দা সেই চোখটাই বুজে বসে আছে। তাই থাকবে এই পণ।

.

পুজোর শেষে পুজোর ঘর থেকে কুশী ভরে ঠাকুরের চরণামৃত নিয়ে এঘরে আসে সুনন্দা। একটু পেটে পড়ক মেয়েটার, কে জানে কিভাবে মানুষ হয়েছে, কী না কি অখাদ্য খেয়েছে। পদবী তো বলল সেন। জাতটা বোধহয় খারাপ নয়, কিন্তু আচার-আচরণ?

যে মেয়েমানুষ অতবড় পিশাচী, তার আবার আচার-আচরণের কোনও ঠিকঠাক আছে? শিক্ষা-দীক্ষা নিশ্চয়ই ভাল দেয় নি, নইলে অমন মুখখানি, কিন্তু কোমলত্ব নেই। কেমন যেন কাঠ কাঠ ভাব। যাক, সুনন্দা ঠিক করে নেবে। ভালবাসায় বনের পশু বশ হয়, এ তো নিজের পেটের সন্তান।

নিজের পেটের সন্তান! ভাবতে গিয়েও যেন কিছুতেই অনুভবে আনা যাচ্ছে না। অত সব প্রমাণ দেখালেন ব্রজনাথবাবু, দ্বিধা করবার কিছুই তো নেই, নেই সন্দেহের। তবু যেন সেই অনুভূতির জায়গাটা থেকে থেকে অসাড় হয়ে যাচ্ছে।

একেবারে অজানা ঘর থেকে মেয়ে নিয়ে এসে ছেলের বৌ করলে যেমন মনটা হয়ে থাকে, সুনন্দার মানসিক অবস্থাও অনেকটা তেমনি।

হৃদয় উজাড় করে ভালবাসা দিতে ইচ্ছে করছে, ভাড়ার উজাড় করে উপহার, অথচ সন্দেহ জাগছে, যোগ্য পাত্রে পড়বে তো?

তবু সুনন্দা জিতবেই। ওই মেয়েকে, তার টুলুকে, ভুলিয়ে দেবে সেই পিশাচীর শিক্ষা দীক্ষা স্মৃতি। আস্তে আস্তে ওর মধ্যে চেতনা জাগাবে, ও কোন্ ঘরের মেয়ে, ওর সামাজিক মান মর্যাদা কতখানি?

স্নেহ ভালবাসা, অর্থ প্রতিষ্ঠা, স্বাচ্ছন্দ্য স্বাধীনতা, আড়ম্বর উপকরণ,–এতগুলো মন্ত্র দিয়ে বশ করে ফেলা যাবে না একটা তরুণী মেয়েকে?

দারিদ্র্য আর অসুবিধের মধ্যে জীবন কেটেছে যার! কেটেছে প্রতিষ্ঠা পরিচয়হীন অতি সাধারণ এক গৃহকোণে।

.

না, অতিসাধারণ বললে তো কিছুই বলা হয় না। নির্লজ্জ কুৎসিত এক নগ্ন দারিদ্র। সেই দারিদ্র্যের দরজায় এসে নামলেন ব্রজনাথ।

টিনের চাল, হঁট বার করা দেওয়াল, হ্যাঁচাবেড়ার রান্নাঘর, মাটির দাওয়া। সবই প্রায় নিজের হাতেই গড়া যতীন সেনের। জবরদখল কলোনির একাংশে তার এই বাড়ি। দু-একটা ঘরামীর সাহায্যে এই আস্তানাটি গড়ে তুলেছিল সে শেয়ালদা স্টেশন থেকে উঠে এসে।

একটা চটা-ওঠা এনামেলের কাসিতে চারটি তেল-নুন মাখা মুড়ি নিয়ে খেতে বসেছিল যতীন সেন। কিন্তু একা ভোগের অধিকার জোটে নি। গোটা তিন চার ছেলে-মেয়ে হুমড়ি খেয়ে বসেছিল গুটিকয়েক প্রসাদ কণিকার আশায়।

যতীনের যে ভাগ দেবার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তা নয়, সারাদিনের পর জলখাবার বলতে তো এইটুকু জুটেছে। কিন্তু ছেলেগুলো তো পাড়ার ছেলে নয় যে দূর দূর করে খেদিয়ে দেবে? তাই দু-চারটে দিতেই হচ্ছে। একান্ত নিজের বলতে ফাটা কাঁচের গ্লাসটায় আধ গ্লাস কালো ঝুল চা।

যতীনের পরনে একটা ময়লা চিরকুট খাটো লুঙ্গি, গা খালি, গলায় গোল করে পরা কালো দড়ির মত পৈতে।

ছেলে-মেয়েগুলোর পরন-পরিচ্ছদ বাপের সাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যবর্জিত নয়। ছোট ছেলেটা বলে উঠল, বাবা, চা খাব।

আবার চা-ও চাই? ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটি ছোঁড়ায় গিঠবাঁধা শাড়িপরা আধবয়সী স্ত্রীলোক। বলে উঠল, এক্ষুনি রুটি গিলিয়ে রেখেছি, তবু দেহি দেহি? পেটে কি রাক্ষস এসেছে নাকি? খবরদার বলছি, আহ্লাদ দিয়ে চাটুকু ওর গলায় ঢালবে না। উঃ, কবে যে এ দুর্গতির অবসান হবে!

যতীন সেন বলে, ঘণ্টা মিনিট গুনছি। দেখি–

বৌ বলে, ভগবানই জানেন। ভাবলে তো হাত পা কাঁপে!

এই পরিস্থিতির সামনে ব্রজনাথ এসে দাঁড়ালেন। গাড়ি থেকে নামবার প্রশ্ন নেই। গাড়ি রাখতে হয় তিনবাঁকা গলির সেই শেষ প্রান্তের মোড়ে। কেঁচার আগা হাতে ধরে সন্তর্পণে কাদাজল বাঁচিয়ে এসেছেন।

ব্রজনাথকে দেখেই যতীনগিন্নী ঝট করে ঘরের মধ্যে ঢুকে যায়, এবং ছেলে-মেয়ে কটা একটু সভ্য ভঙ্গী করে বসে।

যতীনও মুড়ির কাসিটা একটু ঠেলে দিয়ে লুঙ্গিটা টেনে পায়ের ওপর নামিয়ে দিয়ে আসুন আসুন করে ওঠে।

থাক, থাক, খাচ্ছ খাও, ব্রজনাথ বলেন, একটু বসলে হত।

ওরে, এই শীগগির টুলটা–যতীন নিজেই ব্যস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ওঠে। কোল থেকে গোটাকয়েক মুড়ি ঝরে পড়ে, এবং চোখে পড়ে লুঙ্গিটায় এমন একটা গর্ত যে লজ্জা নিবারণ দুরূহ।

ব্রজনাথের মত মাননীয় অতিথিকে দেখেও আসামাত্রই কেন যে যতীন তখন তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায় নি সেটা বোঝা গেল।

তা নড়াচড়া করতে হল না যতীনকে। বৌ ঘর থেকে একটা পায়া নড়বড়ে টুল এনে বসিয়ে দিয়ে গেল।

যতীন নীচু গলায় বলল, তারপর?

তারপর আর কি। হয়ে গেল সবই। তবে আড়ালে তো পেলাম না যে, আর একটু বুঝিয়ে পড়িয়ে দেব। যেমনটা আশা করেছিলাম, ঠিক তেমনটা হল না!

তাই নাকি? যতীনের মুখটা শুকিয়ে যায়, গিন্নী কোন রকম ইয়ে করল নাকি?

না, ইয়ে করবার কোনও স্কোপ রাখি নি। ব্রজনাথ বলেন, ব্রজ উকিল এমন কাঁচা কাজ করে না। তবে মেয়েকে তোমার নির্জনে আর একটু বোঝাতে হবে। মানে বিশ বছর আগের শুকিয়ে যাওয়া স্নেহধারা, তাকে আবার বালি খুঁড়ে বার করে নিয়ে গাছে সিঞ্চন! তা ইয়ে আপাতত কিছু রাখ খরচা বলে–

যতীনের চোখ দুটো জ্বলে ওঠে। যেমন জ্বলে ওঠে ক্ষুধার্ত জানোয়ারের চোখের সামনে খাবার দেখলে। মনে হয় বুঝি ব্রজনাথের হাত থেকে কেড়েই নেবে টাকাটা।

তবে নেয় না। শুধু ঠোঁটটা একটু চেটে নিয়ে বলে, কত আছে?

যা আছে দেখে নাও। আবার দেখা করব তোমার সঙ্গে।

এই সময় যতীনের বৌ আবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। চাপা গলায় বলে–সীমাকে আর দেখা করতে দেবে না?

দেবে। দেবে না কেন? তা এক্ষুনি কেন? এই তো দু দিন হল গেছে। মনটা একটু বসুক, একটু হতু হোক। আনব, আমিই আনব সঙ্গে করে। তবে বাসাটা তোমাদের বদলাতেই হবে।

বদলাবার জন্যে তো হাঁ করে আছি। যতীন বলে, এই নরকের মধ্যে জানোয়ারের মত থাকতে থাকতে জানোয়ারই বনে গেছি। নইলে আর

ব্রজনাথ ওঠেন। যতীন লুঙ্গির ভেঁড়াটার সঙ্গে নোটের গোছাটা মুঠো করে চেপে ধরে মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যায়। আস্তে আস্তে কথা হয় তখন।

ছোঁড়া ছুঁড়ীগুলো অবোধের মত চেয়ে থাকলে কি হবে, হাঁ করে কথা গিলবে। ব্রজনাথ চলে গেলেই হাজার প্রশ্ন করবে।

ওদের মা-টিও তত কম নয়। ওদের তবু ধমকে ঠাণ্ডা করা যায়, তার বেলায় তাও চলবে না। এই পরিস্থিতিতে মানুষ হয়েছে সীমা। এইখান থেকে গিয়ে উঠেছে সুনন্দার অট্টালিকায়।

.

কোন্ কলেজে পড়েছিলে তুমি? জিগ্যেস করে সুনন্দা।

সীমা মুখ তুলে বলে, কোনও কলেজেই নয়, প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়েছিলাম।

প্রাইভেটে! ওঃ। তা আবার বি. এ. পড়। কলেজেই পড়।

আপনার যা ইচ্ছে তাই হবে।

জানলার কাছে বসে আছে সীমা। একধার থেকে মুখে আলো পড়েছে। নিষ্পলকে তাকিয়ে দেখছে সুনন্দা। ওই দৃঢ় কঠিন রেখাঙ্কিত মুখের কোন্ খাঁজটায় টুলু লুকিয়ে আছে। কই! কোথায়! ভগবান

সেই অ্যালবামখানাও যদি থাকত! তাহলে সুনন্দা তার প্রত্যেকখানি ছবি ধরে ধরে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখত কোন্ ভঙ্গীটার মধ্যে সাদৃশ্য আবিষ্কার করা যায়।

গান-টান শিখেছ কখনো।

না সুযোগ পাই নি।

শিখতে ইচ্ছে করত না?

প্রশ্ন করে করে সুনন্দা কি ওর অন্তঃস্থল পর্যন্ত দেখে নিতে চায়? না কি বলবার মত কথা খুঁজে পাচ্ছে না বলেই এই সব অপ্রয়োজনীয় কথার চাষ?

কিন্তু মেয়েটা সত্যিই বড় কাঠখোট্টা। সুনন্দার ইচ্ছে করে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। চুলগুলি মনের মত করে আঁচড়ে বেঁধে দেয়। কিন্তু ও তো কাছে ঘেঁষেই না।

তাই ও যখন বলে, যে ইচ্ছে মিটবে না, সে ইচ্ছে করে লাভ? সুনন্দা তখন চুপ করে থাকে। তারপর বলে, এখন তো তোমার অনেক ইচ্ছেই মিটতে পারে, কই কোন ইচ্ছেই তো জানাও না আমার কাছে? কোন আবদারই কর না?

সীমা একটু হাসে। বলে, বিনা আবদারেই এত দিচ্ছেন, ইচ্ছে প্রকাশের আগেই এত পাচ্ছি, ইচ্ছে আবদারের ফাঁক পাচ্ছি কোথায়?

আবার ঢেউ ওঠে। সুনন্দার মনটা আবার গলে পড়ে। ওর ওই হাসিটা তো বড় সুন্দর! হাসলে তো কই মুখের কাঠিন্য ধরা পড়ে না! আহা, সব সময়েই যদি এমনি হেসে থাকত, তাহলে সুনন্দা নিশ্চয় পারত ঘনিষ্ঠ হয়ে বসতে, গায়ে মাথায় হাত বুলোতে, চুল বেঁধে দিতে। আর, আর হয়ত সেই ফাঁকে টুলুকে খুঁজে পেত!

এই বেলা হাসির রেশটা রয়েছে। সুনন্দা সাহস সংগ্রহ করে তাই কাছে সরে এসে বলে, তা হোক, আমার তো সাধ হয়?

আচ্ছা চেষ্টা করব। কিন্তু কি চাইতে হয় তাই তো জানি না। আপনার বাড়িতে এসে তো কত নতুন নতুন জিনিসের নাম শিখলাম, কত কত নতুন জিনিস দেখলাম। আর যে কি আছে জগতে তাই কি জানি?

সুনন্দার বুকের ফল্গুধারায় কি বন্যার বেগ এল? সুনন্দা কি ভাবছে ওকে আমি ভুল বুঝছি? ও মোটেই কাঠখোট্টা নয়। শুধু, বড্ড বেশি সরল। গোড়া থেকেই ভুল করছি আমি। আমি কেন ভাবছি না ও কত অন্যরকম পরিবেশে মানুষ হয়েছে, কেন ভাবছি না এক বছর বয়সের পর ও আর আমাকে দেখে নি। আমি ওর ত্রুটি আবিষ্কার করছি, কই আমি তো ওকে স্নেহের বন্যায় ভাসিয়ে দিতে পারছি না? তাই খুব কাছে, আরও কাছে, সরে এসে বলে, বেশ তো, গাড়ি করে দোকানে নিয়ে যাই চল। যা দেখবে, যা ইচ্ছে হবে

শুধু শুধু এত টাকা নষ্ট করবেন কেন? শুকনো স্বর, শ্রীহীন বাক্য।

সুনন্দা চমকে ওঠে। এ কী কথা! ও কি এক্ষুনি ওর বিষয় সম্পত্তি আঁট করতে চায়, তাই প্রথমেই সুনন্দার অপচয় নিবারণে হাত বাড়াচ্ছে?

একে তবে স্নেহের বন্যায় ভাসাবে কি করে সুনন্দা?

তা সেই পাপিষ্ঠ মেয়ে মানুষটার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েই তো বেড়ে উঠেছে ও! হয়ত আবুহোসেনের মেজাজ নিয়ে অধিকারের দাবিতে সুনন্দার সঙ্গে লড়াই করতে আসবে।

ও যে শোভন রায়ের মেয়ে, এ অধিকার কিনা না, ছি ছি! বড় সন্দিগ্ধ মন সুনন্দার। এখন যে ও বড় সুন্দর কথা বলছে। বড় পবিত্র, বড় মহৎ। আমি তো কত পাচ্ছি, আবার কেন মিথ্যে খরচ করবেন। কত গরীব লোক আছে জগতে, খেতে পায় না পরতে পায় না, অসুখ করলে ওষুধ পায় না

সুনন্দার লজ্জা করে। তাই তাড়াতাড়ি বলে, সে তো বুঝি। তবু ভেবে দেখ আমি এই উনিশ বছর ধরে হাহাকার করে বেড়িয়েছি। আমার তো ইচ্ছে হয় কেউ মা বলে ডেকে বলুক মা আমায় এটা দাও চোখটা সজল হয়ে আসে সুনন্দার।–তখন শুধু বলতে শিখেছিল, দুদ থাবো না। তকোলেত দাও—

শিখেছিলই বলে সুনন্দা–শিখেছিলি নয়। কি করবে দুটোয় যে মিলছে না। মেলানো যাচ্ছে না।

এতদিন পরেও সে কথা মনে আছে আপনার?

মনে থাকবে না? সুনন্দা চোখ মোছে। আর কি কেউ মা বলে ডাকল আমায়? আর কি কেউ দাও বলে চাইল? এতদিন পরে যদি বা ভগবান তোমায় এনে দিলেন, সুনন্দা উথলে ওঠে–তুমি এখনো আমায় আপনি বলছ। পর ভাবছ। আবদার করতে লজ্জা পাচ্ছ।

সুনন্দার চোখের জল দেখে কি সুনন্দার টুলুর চিত্ত বিগলিত হয়? তাই নরম গলায় বলে, আপনিও তো আমায় তুই বলছেন না, বকছেন না, শাসন করছেন না।

বকব? শাসন করব? তোকে?

সহসা এক উত্তাল ঢেউ সুনন্দার যত্নে বাঁধা বাঁধ ভেঙে দেয়। ভেসে যায় মান-মর্যাদা। সুনন্দা দুই হাতে জড়িয়ে ধরে তার টুলুকে। তোকে আমি শাসন করব?

কথা শেষ হয় না। দরজার কাছে শব্দ ওঠে, কী ব্যাপার পিসিমা! শুনছি নাকি লোমহর্ষণ কাণ্ড! অলৌকিক ঘটনা! বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতে রিপোর্টাররা

ঘরে আর ঢুকতে হয় না উদ্দালকের। ভিতরের দৃশ্য দেখে চুপ হয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

কিরে দুলু এলি? চোখে জল আর মুখে হাসি নিয়ে মুখ ফিরিয়ে দেখে সুনন্দা। বলে, দেখ, ভগবান কী নিধি মিলিয়ে দিয়েছেন।

সীমা আস্তে সুনন্দার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। সরে যায়। উদ্দালক একটু হেসে বলে, একেবারে নাটকীয়। আর আমি এসে পড়লাম ভয়ানক এক নাট্য মুহূর্তে।

.

আবার দেখা হয় খাবার টেবিলে। উদ্দালক আগে-ভাগেই এসে বসেছে। চেয়ারে বসে চেয়ারের পিঠটাকে পিঠ দিয়ে ঠেলছে। পা নাচাচ্ছে। স্থির হয়ে থাকতে পারে না সে একতিলও। সুনন্দা এখনো এসে হাজির হয় নি। উদ্দালকের প্রিয় তরকারি নারকেল কুমড়ো রান্না হচ্ছে নিরামিষ ঘরে। সুনন্দা তার তদারকিতে ব্যস্ত। বামুনঠাকুরের স্বাধীনতার ওপর ছেড়ে দিয়ে এলে স্রেফ নষ্ট।

সীমা চেয়ারে বসে নি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অকারণ টেবিলের সাজসরঞ্জাম নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।

টেবিলে খেতে প্রথম দু-একদিন খুব অসুবিধে হয়েছিল, কিন্তু সে অসুবিধে কাটিয়ে উঠতে দেরি হয় নি তার। হয়ও না। বিলাসিতার অভ্যাস একদিনেই আরম্ভ করা হয়। তবু স্থির করেছে সীমা আজ উদ্দালকের সঙ্গে বসবে না। কি জানি, যদি হঠাৎ তার কোন অপটুতা উদ্দালকের চোখে পড়ে যায়।

ছেলেটার মুখটায় যেন একটা ব্যঙ্গ হাসি মাখানো। ছবিতেও ছিল। কিন্তু ছবিটা তত খারাপ লাগে নি। ছবির হাসি সহ্য করা যায়, জলজ্যান্ত মানুষটাকে সহ্য করা শক্ত।

কেন ওর ওই ব্যঙ্গ হাসি? সীমার উপস্থিতি কি ওকে ঈর্ষান্বিত করছে? ভাবছে সর্বেসর্বা ছিলাম, এ আবার কি উৎপাত! তাই সীমার লোভ, সীমার হ্যাংলামি, সীমার দুঃসাহসিক স্পর্ধাকে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের ছুরি দিয়ে বিঁধতে চাইছে? ব্রজনাথ তো মহা সর্বনেশে লোক! কই, এই ছেলেটার কথা তো বলেন নি সীমার কাছে?

না, সত্যিই বলেন নি। সীমার কাছে না, সীমার মা-র কাছেও না। তারা জেনেছে, বাড়িতে কেবলমাত্র বিধবা মহিলাটিই থাকেন।

যতীন সব জানে। যতীনের সঙ্গে আড়ালে চুপি চুপি কথা। এই ছেলেটার খবর জানলে সীমা বিদ্রোহ করত। বিধবা ধনবতীর কবরিত মাতৃস্নেহকে কবর থেকে তুলে কাজে লাগাতে আসত না।

উদ্দালকের চেয়ারটা পড়তে পড়তে রয়ে গেল।

হচ্ছিল! বলে ফেলল সীমা। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

উদ্দালক নিজেকে সোজা করে নিয়ে মৃদু হেসে বলে, যাক, শ্ৰীমতী নিধির তাহলে কণ্ঠস্বর আছে। আমি তো ভাবছিলাম, বিধি যদি বা পিসিমার নিধিকে এতদিনে এনে জুটিয়ে দিলেন, সেটি আবার মূকবধির।

সীমার মুখটা লাল হয়ে ওঠে। সীমা জানে না উদ্দালকের প্রকৃতিই ওই, ও হেসে ঠাট্টা করে ভিন্ন কথা বলে না। জানে না তাই যে ভুল ব্রজনাথ করেন, সেই ভুল সীমাও করে। ভাবে অহঙ্কারী, উন্নাসিক।

উদ্দালক আবার বলে, তারপর, শ্রীমতী নিধি, আপনার আজকের গতিবিধির প্রোগ্রাম কি? আগে থেকেই ঠিক-ঠাক হয়ে আছে? না

সীমা রুষ্ট মুখে বলে, সেটা আপনার পিসিমাকেই জিগ্যেস করবেন।

উদ্দালক যেন আকাশ থেকে পড়ে, আপনি মানে? আমি হচ্ছি সবেধন নীলমণি একটি দাদা, আমায় আপনি! অচল অচল।

সীমা আরও রুষ্ট মুখে বলে, আপনিও আমাকে আপনি বলেছেন।

আহা হা, সেটা তো কৌতুকার্থে—

গরীবদের প্রতি বোধহয় আপনার কৌতুক ব্যঙ্গ এসব খুব প্রবল?

গরীব? গরীব আবার কে এখানে?

কে তা আপনিও জানেন, আমিও জানি।

কী সর্বনাশ! আমি তো জানি, এখন আমি আমার পিসিমা ঠাকুরানীর হারানিধি এবং রায় কোম্পানীর একেশ্বরী মালিকানী মিস রায়ের সঙ্গে কথা বলছি–

সীমা হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণস্বরে বলে, খুব হিংসে হচ্ছে, না?

হিংসে? সেটা আবার কী হল?

ওঃ জানেন না বুঝি? অবোধ শিশু! কিন্তু আমি জানতে পারছি

কি পারছ?

আমাকে দেখে রাগে হিংসেয় আপনার সর্বাঙ্গ জ্বলছে।

হঠাৎ তড়াক করে চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠে উদ্দালক, সর্বাঙ্গে দুহাত চাপড়াতে চাপড়াতে বলে, কই?

সীমা অবাক। না বলে পারে না, কি কই?

আগুন! উঃ, এমন ভয় লাগিয়ে দিয়েছিলে! ভাবলাম অবোধ শিশু বৈ তো নয়, সর্বাঙ্গ জ্বলছে খেয়াল করছি না।

আমাকে এত ব্যঙ্গ বিদ্রূপ না করলেও চলবে আপনার। আমি চলে যাব।

চলে যাবে। মানে?

মানে আবার কি! কারও স্বার্থের হানি করে থাকার রুচি আমার নেই।

না, বোবা কালা নয়, শুধু হেডঅফিসে একটু গণ্ডগোল। হেসে ওঠে উদ্দালক, আহা বেচারী পিসিমা, যদি বা বিনা ব্যঞ্জন ভাতে একটু শাক চচ্চড়ি জুটলো, তো সে আবার নুনে পোড়া। শেষে একটা পাগল মেয়ে–

সীমা দৃঢ়স্বরে বলে, আচ্ছা বার করুন আপনার তূণে আর কি কি অস্ত্র আছে দেখি–

অস্ত্র? অস্ত্র মানে? এ যে একেবারে নির্ভেজাল সত্য। পাগল না হলে বড়ভাইকে কেউ খামোকা গালমন্দ করতে বসে?

বড়ভাই! শব্দটা মনের তার ছুঁয়ে গেল না–ঝঙ্কার তুলল না। সীমা বিরসমুখে বলে, ওসব আমার আসবে না।

কি আসবে না?

এই বড়ভাই টাই–

সর্বনাশ! তবে কি ছোটভাই বানিয়ে দিদি সাজতে চাও নাকি? চলবে না, চলবে না। আমিও তাহলে অধিকার কায়েম রাখতে তুই বলতে শুরু করব। বুঝলে হে শ্ৰীমতী নিধি! কমসে কম আমি তোমার থেকে তিনটি বছরের বড়।

সীমা ভুরু কুঁচকে বলে, আপনি বুঝি আমার ঠিকুজি কুষ্ঠী দেখে নিয়েছেন ইতিমধ্যে?

ইতিমধ্যে মানে? পূর্বেবহুপূর্বে, তব জন্মক্ষণে। পিসিমা এবং পিসিমার ভ্রাতার খাতায় মহাশয়ার জন্মের সাল তারিখ মাস বার ক্ষণ লগ্ন সব কিছু লেখা আছে, বুঝলেন? চালাকিটি চলবে না।

সীমা কি একটা বলতে উদ্যত হচ্ছিল, এই সময় সুনন্দা এসে দাঁড়াল উদ্দালকের স্পেশাল ডিশ নিয়ে।

এই তোর নারকেল কুমড়ো। ও কিরে, টুলু তুই বসিস নি? হারে দুলু কি হল? বললাম বোনটিকে নিয়ে খেতে বোস ততক্ষণ, আমি আসছি। ভাত শুকোচ্ছে এদিকে, হাত গুটিয়ে বসে আছিস!

উদ্দালক উদাস উদাস ভঙ্গী করে বলল, আর হাত! নেহাৎ গুটিয়ে বসে আছি তাই, নইলে হাতাহাতি হয়ে যেতে পারত।

হাতাহাতি!

তা না তো কি! তবে নেহাৎ নাকি তোমার এই গুণধর ভাইপোটির মেজাজ ওই ফ্রিজিডেয়ারের জলের মত, তাই কিছু একখানা হয়ে যায় নি। উঃ, তোমার এই কন্যাটির যা মেজাজ!

সুনন্দা হেসে ফেলে। সুনন্দা এখন বিগলিত। সুনন্দার ভিতরকার দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। সুনন্দা সীমাকে টুলু বলে গ্রহণ করতে পেরেছে তাই সুনন্দা খোলা মনের হাসি হেসে ওঠে।

হল শুরু? কুঁদুলে ছেলে! বুঝলি টুলু, তোর এই দাদাটির একটি মাত্র কাজ আছে সংসারে, সবাইকে ক্ষেপিয়ে বেড়ানো। আমাকেও ক্ষ্যাপাচ্ছে, পুরুতমশাইকেও ক্ষ্যাপাচ্ছে, ডাক্তারবাবুকেও ক্ষ্যাপাচ্ছে; চাকর ঠাকুর বুড়ী তারুর মা কারুর রেহাই নেই ওর কাছে। আর এমন সব দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলেও মাথায়!

উদ্দালক বলে, তা বলে পিসিমা অরিজিন্যাল ক্ষ্যাপাকে ক্ষ্যাপাবার সাহস আমার নেই। আমার তো ধারণা হচ্ছে ওর হেডঅফিসে রীতিমত গণ্ডগোল।

দুলু, বাক্যি থামাবি? ভাত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। আয় টুলু বোস। সুনন্দার কণ্ঠে সুধা, চোখে বিগলিত স্নেহ।

কিন্তু টুলু এগিয়ে আসে না। নীচু অথচ স্পষ্ট গলায় বলে, আমি একটু পরে খাব মা।

ওমা সে কি কথা-সুনন্দার কণ্ঠে উদ্বেগ–পরে আবার কখন খাবি কার সঙ্গে? এই কদিন একা একা খেয়ে সারা হচ্ছিস। লজ্জা কি মা? ও তো তোর দাদা হয়। শুনতেই মামাতো ভাই, দেখিস নিজের দাদার থেকে অনেক বেশী। একঘণ্টায় আপনার করে নিতে পারে মানুষকে

সহসা এক ঝলক বিদ্যুৎ খেলে যায় সীমার চোখে। হাসি গোপন করে বলে, ছাই পারেন। ঝগড়াটে!

ওরে দুষ্টু মেয়ে, তুইও তো দেখছি কম যাস না। ইতিমধ্যেই ভাবটাব হয়ে গেছে? চালাকি হচ্ছে আমার সঙ্গে? নে বোস এখন। খেতে বসে দুজনে ঝগড়ার কমপিটিশান চালা।

হারব, স্রেফ হেরে যাব পিসিমা। এতদিনের অহমিকা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে আমার। এতসব উচ্চাঙ্গের কথার্বাতা জানেন তোমার শ্রীমতী নিধি, যে আমি উত্তর খুঁজে পাই না, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি।

হুঁ, তুমি যে আমার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবার মত ছেলে! সুনন্দা হেসে বলে, আমার দেখছি এখন চাকরি হল তোদের ঝগড়া থামানো। তোরা-সহসা চোখ ভরে জল এসে যায় সুনন্দার, তোরা দুটি ভাইবোন হাসবি খেলবি ঝগড়া করবি, বাড়ি আমার সত্যিকার মানুষের বাড়ির মতন হয়ে উঠবে। শুধু তিনিই বুকভরা হাহাকার নিয়ে চলে গেলেন। কিছুই দেখতে পেলেন না।

ঘরের হালকা আবহাওয়া সহসা ভারী হয়ে উঠে। সীমা একটা চেয়ারের পিঠে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকে, সুনন্দা পিছন ফিরে চোখের জল মোছে, আর উদ্দালক ঈষৎ অপ্রতিভ ভাবে এদিক ওদিক তাকিয়ে, আর কিছু না পেরে জলের গ্লাসটাই মুখে তুলে ধরে।

কিন্তু বেশীক্ষণ এ আবহাওয়া থাকে না। উদ্দালকই থাকতে দেয় না। হঠাৎ বলে ওঠে, পিসিমা, তোমার নিধির পোশাকী নামটা কি বল তো?

সুনন্দা চোখে জল মুখে হাসি নিয়ে বলে, তা আমায় জিগ্যেস করছিস কেন, যার নাম তাকেই জিগ্যেস কর?

কি জানি, হয়তো ওই সূত্রেই আবার লাঠালাঠি হয়ে যেতে পারে।

ওমা, নাম জিগ্যেস করার মধ্যে লাঠালাঠির সূত্র কোথায় রে?

কী বলা যায়! খলের ছলের অভাব থাকে না জানোই তো।

আড়ে আড়ে তাকায় উদ্দালক সীমার দিকে। হয়ত বলে বসবেন, কেন নাম জেনে কী দরকার? নাম নিয়ে কি হবে? নামেতে কী আসে যায়?

সুনন্দা একটু অস্বস্তি বোধ করে। কি জানি মেয়েটা উদ্দালকের এই কৌতুকে কি ভাবছে। কিভাবে নিচ্ছে এই বেপরোয়া কথাবার্তা। তাই তাড়াতাড়ি বলে, নাঃ বাপু তুই-ই একের নম্বর ঝগড়াটে। দেখ দিকি ও বেচারা কেমনতর হয়ে যাচ্ছে তোর এই সব কথা শুনে।

সীমা কিন্তু এ করুণা গায়ে পেতে নেয় না। গম্ভীর ভাবে বলে, কেমনতর হবার কিছু নেই। তবে ওঁর প্রকৃতিটা অনুধাবন করছি।

প্রকৃতি মানে?

মানে নেই। স্রেফ অর্থহীন, উদ্দালক বলে, কিন্তু তোমার এই জংলি মেয়েটাকে মানুষ করে তুলতে হবে তো?

ওমা, আমি কোথায় যাব গো! তুই যে আমার টুলুকে জংলি টংলি যা খুশি তাই বলছিস!

বলব না? ভীষণ খুশি লাগছে যে! তাইতো যা খুশি বলতে ইচ্ছে করছে। উঃ ভাবছি, ইহ সংসারেও মাঝে মাঝে গল্প উপন্যাসের কাহিনী ঘটে। কি বল পিসিমা? এখন বলুন তো ভদ্রমহিলা আপনার এতাবৎকালের ইতিহাস। স্মৃতির সমুদ্র মন্থন করে দেখুন দিকি মনে পড়ে কিনা প্রথম যখন আপনি চুরি হলেন, তখন

সুনন্দা ঈষৎ বিচলিত স্বরে বলে, ওসব গল্প এখন রাখ দুলু, খেতে বোস বাবা। টুলু বোস মা। হারে নারকেল কুমড়ি খাস তো? আমার দুলু তো

একটা এলোমেলো প্রসঙ্গ এনে সুনন্দা সীমার পুরানো জীবনের প্রসঙ্গ চাপা দিতে চেষ্টা করে। ব্রজনাথবাবু বলেছেন, এখন ওসব কথা না তুলতে। কারণ নানাকষ্টে মানুষ হয়েছে সীমা। সে সব কথা উঠলে বেচারা লজ্জা পাবে।

কিন্তু সীমা বুঝি নিজের ভার নিজেই হাতে তুলে নিচ্ছে। তাই সুনন্দার প্রশ্নে মৃদু হেসে বলে, বাঙালদেশের মেয়ে নারকেল কুমড়ি ভালবাসব না?

ওহে মহিলা, ভুল হচ্ছে, উদ্দালক বলে ওঠে। বাঙালদেশের মেয়ে নয়, তৎদেশে মানুষ!

নে বাবা, তোদের খাওয়া আজ মাথায় উঠল দেখছি। দাদা বৌদি কেমন আছেন তা পর্যন্ত শোনা হল না এখনো। বল্ শুনি কেমন আছেন ওঁরা। কেমন আছে ছেলেমেয়েরা?

সুনন্দা যেন আগলে বেড়ায় সীমাকে। ওর যেন মনে হয় সীমা আবার হারিয়ে যাবে।

২. বসবার ঘরে

ব্রজনাথবাবু ডেকে পাঠান সীমাকে। বাইরে বসবার ঘরে। সুনন্দাকে জানিয়েছেন নাম পদবী বদলাতে সই স্বাক্ষর দরকার, দরকার দরখাস্ত করবার।

নামটা থাক না। সীমা মুখ নীচু করে বলে, ডাকের নামটা তো রইলই মা তোমার, ওটা তো তোলা, পোশাকী, ওতে আর কী ক্ষতি?

আমি যে তোকে একেবারে ধুয়ে মুছে নতুন করে নিতে চাই টুলু!

সীমা হেসেছিল একটু। আমার এই কুড়ি বছরের জীবনটাকে কি একেবারে ধুয়ে মুছে উড়িয়ে দিতে পারবে মা? জ্ঞান হয়ে অবধি নিজেকে সীমা বলে ভাবার অভ্যাস হয়ে গেছে, হঠাৎ নতুন কোনও নামকে সত্যি আমার ভাবতে

সুনন্দা অবুঝ নয়। সুনন্দা এ কথার যৌক্তিকতা বুঝেছে। সত্যিই তো, সুনন্দা মুছে ফেলতে চাইলেও ও ওর সেই অনেক ঘাটের জল আর অনেক আগুনে পোড়-খাওয়া জীবনটাকে মন থেকে মুছে ফেলবে কেমন করে? শ্বশুরবাড়িতে আসা মেয়ের বাপের বাড়ির স্মৃতির মত থাকবেই খানিকটা। আস্তে আস্তে ঝাপসা হবে।

ব্রজনাথবাবু বলেছেন, যাদের কাছে ছিল, তারা নাকি একবার দেখবার জন্যে নির্বেদ প্রকাশ করছে।

সুনন্দা বলেছিল–বেশ তো, আনুন না তাদের একদিন। না হয় নেমন্তন্ন করেই আসুন। আমারও তো উচিত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। অপকর্ম যে করেছিল, সে তো মরেই গেছে। এরা তো কোনও দোষে দোষী নয়? বরং নিজেদের দুরবস্থার মধ্যেও একটা পরের মেয়েকে ঠাই দিয়েছিল। এরা ভাল, এরা সৎ। হা হা, আনুন তাদের একদিন।

ব্রজনাথ মাথা নেড়েছিলেন–আসবে না। হতদরিদ্র অবস্থা হলে কি হয়, খুব মানী। নিজেদের ছেঁড়া জামা কাপড় পরে বড়লোকের বাড়িতে আসবে না। শুধু বলছিল সীমা যদি একদিন

এ কথারও যৌক্তিকতা অস্বীকার করতে পারে নি সুনন্দা। সত্যি, বড়লোকের থেকে গরীবের আত্মাভিমান বেশী, এ তো চিরকালের জানা কথা। তাই বলেছিল–বেশ, একদিন যাবেখন। আপনিই আনবেন ঘুরিয়ে।

হ্যাঁ হ্যাঁ, সে তো নিশ্চয়। আপনার ড্রাইভারও যে তাদের অবস্থাটা দেখে এ তাদের ইচ্ছে। নয়। তাই ভাবছি ট্যাক্সি করে–

ট্যাক্সি করে? ওমা, তাই বা কেন? ড্রাইভার না যায় দুলুই নিয়ে যাবে। কথার উপসংহারের ছেদ টানে সুনন্দা। তারপর আবার বলে ওঠে, যাক, ওই যে কি, পদবী বদলাতে টুলুকে আপনার দরকার হবে বলছিলেন–

হ্যাঁ হ্যাঁ। বিশেষ দরকার। নাম পদবী দুই-ই তো পালটাতে হবে।

না না, বলছিলাম ওই নামটা বদলাবার দরকার নেই, শুধু পদবী।

নামটা থাকবে! ব্রজনাথ হাঁ করেন। সুনন্দাই তো নতুন নামের পক্ষে ছিল।

সুনন্দা বলে, থাক, থাকুক। টুলুর নইলে মনে কষ্ট হবে। মনে মনে যতই যা হোক, ও তো সেই রাক্ষুসীকেই মা বলে জানত, তার দেওয়া নাম। সেন্টিমেন্ট বলে কথা আছে একটা।

বেশ, আপনার যা ইচ্ছে। মেয়েদের পদবী বদলানোটা কিছুই না, বিয়ে হলে বদলায়ই তো। নামটা বদলানোরই অসুবিধে ছিল। যাক, সে যখন দরকার নেই

.

টুলু এসে দাঁড়িয়েছে, একা। সুনন্দা চলে গেছে। বলেছে, দুলুকে বলিগে। ব্রজনাথ সীমাকে বলেন, না না, ও সব দুলু-ফুলুকে দরকার-টরকার নেই। ট্যাক্সিই ভাল, বুঝলে? তবে বেশিক্ষণ থাকা চলবে না।

সীমা মুখ তুলে নীচুস্বরে বলে, টাকা দিয়ে এসেছিলেন ওখানে?

নিশ্চয়! নিশ্চয়! কী বলছ তুমি মা! আমি কি এমনই অবিবেচক?

না আপনি মহৎ। সীমার ওষ্ঠে অতি সূক্ষ্ম অতি মিষ্ট একটু হাসি ফুটে ওঠে।

তা মহৎ বৈকি। ওঁরই চেষ্টায় তো একটা সন্তানহারা জননীর চিত্তের প্রদাহ শীতল হল! আর ওঁরই বদান্যতায় তো একটা দুঃস্থ পরিবার উপবাসের উত্তাপ থেকে অব্যাহতি পাচ্ছে।

যতীন সেনের মর্মান্তিক দুরবস্থা দেখে পর্যন্ত প্রাণটা ফেটে গেছে ব্রজনাথের। তাই না নিজের পকেট থেকে মুঠো মুঠো টাকা দিয়ে আসেন তাকে খরচ বলে। ভদ্রলোকের ছেলে, সাহায্য বললে আহত হবে।

মহৎ টহৎ কিছু না। মানুষের কর্তব্য যতটা সম্ভব করা যায়। যাক, মিসেস রায় তোমার ব্যবহারে সন্তুষ্ট তো?

কি করে বলব বলুন?

বাঃ সে কি! না না এটা তো ঠিক নয় মা। তুমি জানবে না? আমি তো তোমায় খুব বুদ্ধিমতী বলেই জানি। সর্বদা ওঁর সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। ওঁর হৃদয়ের সব স্নেহটুকু–যা ওঁর হারানো মেয়ের জন্যে হৃদয়ে ভরা ছিল, তার সবটুকু নিংড়ে বার করে নেবে। ওই ইয়ার ছোকরাটি, ওই ভাইপোটি মহা ঘোড়েল বুঝলে? ওঁকে একেবারে কবলিত করে ফেলেছিল, ওঁর সব স্নেহ ভালবাসা কেড়ে নিয়েছিল। আর কিছুদিন দেরি হলেই সব লেখাপড়া করিয়ে নিত নিজের নামে।

যাক, নেয় নি তো? আবার সেই হাসির ব্যঞ্জনা ফুটে ওঠে সীমার মুখে, তাড়াতাড়ি বাঁধটা দিতে পেরেছেন।

তুমি আমায় ব্যঙ্গ করছ সীমা? ব্রজনাথ আহত হলেন। অভিমানী ব্রজনাথ।

কি আশ্চর্য! ব্যঙ্গ করব কি? আপনি আমাকে দুর্দশার পাতাল থেকে স্বর্গে এনে পৌঁছে দিয়েছেন, আমি আপনাকে–

কিছু না, কিছু না, আমি নিমিত্ত মাত্র। সবই নিজ নিজ অদৃষ্ট! নইলে মিসেস রায়ের তো আরো ভাইপো-ভাইঝি আছে, ওই ইয়ার ছোকরাটিই বা কেন! যাক, ওই কথাই রইল। আমি আসছি বিকেলে। ট্যাক্সিতেই যাব।

ওদিকে কিন্তু সুনন্দা অন্য ব্যবস্থা করেছে ইত্যবসরে! উদ্দালককে নির্দেশ দিয়েছে টুলুকে তার পুরনো আস্তানায় একবার ঘুরিয়ে আনতে। বলেছে–সেখানে যেন বেশিক্ষণ থাকে না। সেই তো শুনেছি বস্তি, গলি, নোংরা আর নেহাৎ-ই হা-ঘরে মতন–তুই বরং তারপর ওকে একটু গড়ের মাঠে কি লেকে কোথাও

উদ্দালক গিয়ে সে কথাই বলে–শ্ৰীমতী নিধি আজ বিকেলে একটু প্রস্তুত থাকবেন। আপনার মাতৃদেবীর আদেশ হয়েছে আপনাকে হয় লেকে নয় গড়ের মাঠে চরিয়ে আনতে। এখন যে মাঠের ঘাসে আপনার অভিরুচি।

–দেখুন, ভাল হবে না বলছি।

–যতক্ষণ আপনি আজ্ঞে ততক্ষণ ভাল হবার কোন আশা নেই। মান্য ভক্তি করে দাদা বলবে। গড় করবে তবে

সীমা তীক্ষ্ণ একটু হেসে বলে, দাদা বলতে আমার দায় পড়েছে। দাদা আপনাকে আমি জীবনেও বলব না।

–আচ্ছা, কেন বলত? উদ্দালক ঈষৎ অবাক হয়ে বলে–লক্ষ্য করে দেখছি প্রথমাবধিই তোমার আমাকে দাদা বলায় আপত্তি। কেন বলত? দাদা তো লোকে যাকে তাকেই বলে। বলে–পাড়াতুতো দাদায় দেশ ভরা। আর এ তো সত্যিকার জলজ্যান্ত মামাতো ভাই

সীমার মুখটা কি পাংশু হয়ে ওঠে হঠাৎ? কিন্তু কেন? সুনন্দাকে তো নিতান্ত সহজেই মা বলতে পারছে আজকাল। তবে উদ্দালকের বেলাতেই বা ওই নিতান্ত সহজ দাদা ডাকটা কিছুতেই মুখে আসে না কেন? কেন, শুনলেই মনটা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে? পণ করে বসে থাকে বলব না বলব না। বড় ভাইয়ের স্নেহ নিয়ে তো এগিয়ে আসছে উদ্দালক। সীমা কেন ছোট বোনের হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করতে পারছে না তা?

আপনাকে আমার ভাবনা ভাবতে হবে না। আমার যেখানে যাবার নিজেই যাব।

–তোমার ভাবনা ভাবতে আমার দায় পড়েছে। দায় পড়েছে কথাটার ওপর জোর দেয় উদ্দালক সীমার অনুকরণে। আবার বলে–আমি ভাবছি আমার পূজনীয়া পিসিমার কন্যার কথা। বিকেলে প্রস্তুত থেকো। তোমার সেই আগের বাড়িতে নিয়ে যেতে বলেছেন। ড্রাইভার বুঝি ছুটি নিয়েছে–

সীমা ওর কথায় কান না দিয়ে বলে–আপনি গাড়ি চালাতে পারেন?

গাড়ি? গাড়ি চালাতে পারব না? গাড়ি চালানো আবার একটা কাজ নাকি? শিখতে চাও? বল তো শিখিয়ে দিতে পারি।

-মাইনে দেবার ক্ষমতা নেই, চাই বললে চলবে কেন? বিনা মূল্যে কিছু নিতে পারা যায়?

উদ্দালক সহসা একটু গম্ভীর হয়ে যায়। বলে,–পারবে না কেন? ইচ্ছে থাকলেই পারা যায়। কিন্তু সে ইচ্ছে তোমার নেই।

সীমা মুখ তুলে একটুক্ষণ চেয়ে থাকে। তারপর বলে–আর এমন যদি হয়, ক্ষমতাই নেই।

মাঝে মাঝে তাই মনে হয়, উদ্দালক বলে মনে হয়, জীবনে কখনো বুঝি তুমি স্নেহ ভালবাসা শ্রদ্ধা সম্মান কিছুই পাও নি। তাই তার স্টকই নেই তোমার মধ্যে।

উদ্দালক চলে যায়। উদ্দালক আহত হয়েছে।

ওর মত ছেলেও আহত হয়? তা হয় বৈকি। কতগুলো দিন কেটে গেল, কত আগ্রহ করে ভাইয়ের ভালবাসা নিয়ে এগিয়ে এল সীমার হৃদয়ের কাছে, কিন্তু সীমা তার প্রতিদান দিতে পারছে না। সে ভালবাসা প্রতিহত হয়ে ফিরে যাচ্ছে।

কিন্তু সীমা কি করবে? সীমার নিজেরও যে শাসন নেই। সীমার জিভ দুধের জন্যে উন্মুখ নয়, সে চায় লবণ স্বাদ। কিন্তু সমুদ্রে কি সে স্বাদের সাধ মেটে? মেটে না। তাই উদ্দালকের স্নেহ সমুদ্র কাজে লাগছে না।

.

যতীন সেনের বাড়িটা আজকে একটু ভব্য মূর্তি ধারণ করেছে।

দাওয়াটা ঝাড়া মোছা, তার উপর একখানা নতুন মাদুর বিছানো। ঘরের ভিতরের চৌকির উপরকার বিছানাটা বহুকালের নিরাবরণতার গ্লানি থেকে মুক্ত হয়েছে একখানা কোরা মার্কিনের চাদর মুড়ি দিতে পেয়ে।

ছোট ছেলেমেয়ে তিনটের গায়েও নতুন গেঞ্জি, কোমরে জাঙিয়া। হ্যাঁ, সোজাসুজি একই পোশাক এনে দিয়েছে যতীন, ছেলেমেয়ে বলে আলাদা বিভাগ রাখে নি।

কি দরকার। আলাদা টালাদা করতে গেলেই তো একজনেরটা ভিজে থাকলে আর একজনেরটা পরার অসুবিধে। মেয়েটা গেঞ্জি পরতে পারে। ছেলেরা তো ফ্রক পরতে চাইবে না।

অপেক্ষাকৃত বড় মেয়েটা তার সবচেয়ে ভাল শাড়িটাই পরে বসে আছে।

যতীনের পরনে ফুটোহীন লুঙ্গী।

যতীনের বৌয়ের অঙ্গে শুধু ফরসা শাড়িই ওঠে নি, একটা জামাও উঠেছে। আধ-ছেঁড়া একটা ব্লাউস। একজনের পরিত্যক্ত। সে আর কোনদিন ওইটার ওপর দাবী জানাতে আসবে না নিশ্চয়। সে এখন বড় লোক হয়েছে। দারুণ বড় লোক।

মোটমাট যতীনের বাড়িটা আজ উৎসবের চেহারা ধারণ করেছে, যতীনদের বাড়ির সদস্যদের মনেও একটা আবেশময়, সম্ভাবনাময় উৎসবের ছোঁয়াচ।

যতীনের বৌ ধীরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে,হ্যাগো, তিলের নাড় খাবে সীমা?

-খাবে না কেন? যতীন বলে–তুমি নিজেই তো বললে-খুব ভালবাসে।

-সে তো তখন বাসতো। তাই বাধীরার চোখে জল আসেজুটতো কই? কিন্তু এখন কত রাজা উজিরী জিনিস খাচ্ছে, আর কি মুখে রুচবে তিল আর ভেলিগুড়?

যতীন মুখটা বিস্বাদ করে বলে মানুষের মেয়ে হলে রুচবে। অমানুষের মেয়ে হলে রুচবে না।

বাপের হিসেব ধরতে হলে তো রুচবেই না। বলে ঠিকরে উঠে দাঁড়াল ধীরা, নামের মর্যাদা না রেখেই। না, নামের মর্যাদা রাখার ক্ষমতা আর নেই ধীরার। অনেক দিন হারিয়েছে।

অথচ ছিল। যখন সেই এক নিভৃত পল্লীর কাকচক্ষু পুকুরের ধারে নতুন বানানো ছোট্ট গোলাপী রঙের বাড়িটিতে মাথায় ঘোমটা টেনে টেনে বেড়াতো। তখন ছিল সেই ক্ষমতা শেয়ালদা স্টেশনের পরিবেশ তার ঘোমটা খুলে দিয়েছে। শুধু মাথারই নয় মনেরও।

জমিদারের গোমস্তা গেরস্ত যতীন সেন আজ সরকারের ভোল নিয়ে খাচ্ছে আর জবর দখলি জমিতে বাস করছে-তার বৌ কি আর কাজল পরা চোখ তুলে মিহি হাসি হাসবে?

ওদের একটা জীবন ছিল। সে জীবনটা ওরা হারিয়ে ফেলেছে, ভুলে গেছে ওরা, আর একটা নতুন জাত তৈরি হয়েছে। হ্যাঁ নতুন জাত। সেই জাতের মাথার মধ্যে আর কোন কিছু নেই। আছে শুধু প্যাঁচ। কোন্‌খানে কতটা প্যাঁচ দিলে কি আদায় হতে পারে এ চিন্তা ছাড়া আর কোনও চিন্তা নেই যতীন সেনদের।

সেই চিন্তাই করছিল যতীন। তুমি ব্ৰজ উকিল পাঁচ কসছ বসে বসে, ভাবছ যতীন যেন অবোধ অজ্ঞান। তোমার ভিক্ষামুষ্ঠিটুকুই তার পরম পাওয়া। কেন? বলি কেন? তোমার বুদ্ধি আছে আর তার নেই? তুমি বেড়াও ডালে ডালে তো সে বেড়ায় পাতায় পাতায়। সে ও

দিদি এসেছে! দিদি এসেছে! তুমুল কলকল উঠল গুটি তিন চার কণ্ঠ থেকে।

না বাড়ির গাড়ি নয়। রায় কোম্পানির কর্তীর সেই বিরাট গাড়িখানা এ পাড়ার রাস্তাতেই ঢুকবে না। ট্যাক্সিই। মোড়ের মাথা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ব্রজনাথ ছেড়ে দিয়ে গেছেন। সীমার তাই ইচ্ছে।

দিদি দিদি। আমাদের জন্যে কি এনেছ?

সীমা মাদুরের ওপর বসে পড়ে। আর সহসা যেন একটা সূক্ষ্ম ঈর্ষার জ্বালা অনুভব করে। দাওয়াটায় দিব্যি একখানা মাদুর পাতা হয়েছে। সীমার আমলে এ সব হয় নি। দু-খানা বই খাতা নিয়ে বিছিয়ে বসবার জায়গা পায় নি কোনদিন।

আবার তখনি লজ্জায় লাল হয়ে গেল, ছি ছি, এই টুকুতে এই ভাবছে সীমা? কেন তবে চলে গেল সীমা এদের ছেড়ে? এদের দাওয়ায় মাদুর পড়বে, এদের বিছানায় চাদর পড়বে, এদের পেটে ভাত পড়বে, তাই না।

কই দিদি দেখাচ্ছ না?

সীমা সঙ্গে করে আনা সুটকেসটা খোলে। জামা কাপড় তেল সাবান বিস্কুট মিষ্টি! জনে জনে সকলের নাম করে।

ভাগাড়ে চিল পড়ার মত কাণ্ড ওঠে একটা। এত সব কেন কিনেছে সীমা? সীমা কি দীর্ঘ দিনের অন্নঋণ শোধ করতে চায়?

ধীরা জামাগুলি তুলে তুলে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, এত সব ভাল ভাল জামা কেন আনা বাপু, এই দামে দুটো তিনটে হত।

সীমা মৃদু গলায় বলে, আবার হবে।

ওমা, তা মাপটাপগুলো তো ঠিক হয়েছে, ধীরা বলে, চোখের আড়ালে থেকেও হয়েছে তো ঠিকঠাক।

সীমা কিছু বলে না। শুধু ধীরার দিকে একবার চোখ তুলে তাকায়। লাল লাল ভারী ভারী চোখে।

ধীরা লজ্জিত হয়ে তাড়াতাড়ি উঠে যায়। বলে, যাই মিষ্টি আনি। তিলের নাড় করেছি তোর জন্যে।

তিলের নাড়ু! তবু ভাল। যতীন সেনের সংসার যে একদিনের বাজার খরচ বাঁচিয়ে সীমার জন্যে রাজভোগ আনিয়ে রাখে নি, এতেই কৃতজ্ঞ সীমা।

যতীন বলে, মাগী কিছু বুঝতে-টুঝতে পারছে না তো?

সীমা চোখ তুলে বলে, ওঁর সম্পর্কে একটু ভালভাবে কথা বল বাবা।

ও বাবা! ইরি মধ্যেই খুব যে টান দেখছি। মেয়ে সন্তান এমনিই হয়, যতীন বলে, হুঁ, তা সেই মহিয়সী মহিলাটিই না হয় বলছি। সন্দেহ-টন্দেহ করছে না তো?

না।

করবে না জানতাম। তুই তো আমার কম ঘুঘু মেয়ে নয়। বলে কলোনিতে থিয়েটার করে ফাস্ট হলি সেবার। একটা ভাইপো আছে না?

আছে।

সে ছোঁড়া কেমন? ব্রজ উকিল তো বলে—

বাবা আমি যাই।

সে কি, এখুনি যাবি কি? তোর মা-র সঙ্গে দুটো গাল গল্প কর? ও যে একেবারে সীমা সীমা করে মরে যাচ্ছে

কেন! সীমা দাঁড়িয়ে ওঠে। তীব্রকণ্ঠে বলে, আমার জন্যে আবার মরবার কি আছে? আমি, কত সুখে আছি, রাজার হালে আছি। সোনার খাটে গা রূপোর খাটে পা। ছানা চিনি আমার মুখে রোচে না, চপ কাটলেট আমি চিবিয়ে ফেলে দিই–

যতীনের ছোট ছেলেটা আঁকড়ে ধরে সীমাকে। বলে, দিদি! ফেলে দিস?

সীমা ওর দিকে তাকায়। যেন মাতালের নেশা ভঙ্গ হয়। ওর গায়ে হাত রেখে বলে, পাগল হয়েছিস? তাই আবার পারে মানুষ? ঠাট্টা বুঝিস না?

বয়সে একটু বড় হয়ে যাওয়া বোন রীতা মুখটা সিঁটকে বলে, ঢং করে এ রকম একটা বাজে শাড়ি পরে এসেছিস কেন দিদি? ব্রজ উকিল তো গল্প করে গেল–গিন্নীর তিন আলমারি শাড়ি নাকি তোকেই দিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া প্রতিদিন শাড়ির ওপর শাড়ি আসছে।

সীমা ওর ওই বিদ্বেষ তিক্ত মুখটার দিকে তাকায়। বিষাক্ত একটা কথা মুখের আগায় আসে, সামলে নেয়। না, আর নেশায় বুদ্ধিভ্রংশ হবে না সে।

ছোট বোনের গায়ে হাত রেখে বলে, কেন শুনিস বুড়োর বাজে কথাগুলো। ওঁর ওসব। শাড়ি-টাড়ি পাবে ওই ভাইপোর বৌ। সে-ই সর্বেসর্বা!

ভাইপো-বৌ! ধীরা চমকে ওঠে, সে আবার কে? ভাইপো-বৌ আছে নাকি?

আহা ভাইপো যখন আছে, বৌও আসবেই একদিন!

তবে যে বুড়ো বলেছিল কেউ কোথাও নেই। শুধু মাগী একলা।

সীমা এত বিচলিত হচ্ছে কেন? সীমা কি এর আগে এই কলোনির লোকের কথাবার্তা শোনে নি?

ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা সম্পর্কে এর চাইতে সমীহ সম্ভ্রমপূর্ণ বিশেষণ কবে ব্যবহার করেছে যতীন, ধীরা, ওদের ছেলে মেয়েরা?

সীমা কী হঠাৎ আকাশ থেকে পড়ল? তাই এখান থেকে এই বন্ধ বাতাস থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাবার জন্যে প্রাণ ছটফট করছে তার?

যতীন সেন স্ত্রীকে ধমকায়, থামো, যা জানো না, তা নিয়ে ভ্যান-ভ্যান করো না। ভাইপো বোনপো ভাগ্নে ভাগ্নী থাকবে না লোকের? তা নিয়ে চিন্তার কি আছে? তবে ব্রজ উকিল যে মনে করেছে সে একাই ঘুঘু তা যেন ভাবে না। আমিও যতীন সেন। তেমন দেখলে ওই উকিলের কাছা খুলে দিয়ে

বাবা আমি যাই।

যাবে। যাবে। আর যে এখানে তিষ্ঠোতে পারছ না তা বুঝতেই পারছি। তা সঙ্গে কিছু এনেছ?

না। সব খরচ করে ফেলেছি।

কি, ওই সব জামা জুতো সাবান এসেন্স কিনে? কেন? অত সবের দরকার কি ছিল? নজর তিন দিনেই লম্বা হয়ে গিয়েছে দেখতে পাচ্ছি। সেই যে বলে না ফোঁটা চন্ননের ব্যাটা চন্দন বিলাস, এ দেখছি তাই। বলে টাকার জন্যে মরে যাচ্ছি আমি। হাঁ করে আছি কবে তুই আসবি, টাকার গোছা আনবি। নইলে ঘরের মেয়েকে কেউ পরকে বিলিয়ে দেয়? অনেক দুঃখেই

সীমা উঠে দাঁড়াল। বিষতিক্ত একটু হাসি হেসে বলে, বিলিয়ে দেওয়া কথাটার অন্য মানে বাবা। অভিধানে দেখা। কিন্তু আমার কাছে অনেক বেশি আশা করলে চলবে কেন? আমার হাতে তো আর ওদের লোহার সিন্ধুকের চাবি নেই? তোমার আশ মিটবে এত টাকা আমি কোথায় পাব? আমায় হাত খরচ করতে যা দেন

লোহার সিন্ধুকের চাবি বাগাবে। সেইজন্যেই তো পাঠানো হয়েছে তোমায়। গাঁজাখোর গোঁয়ারের মত চেঁচিয়ে ওঠে যতীন। শুধু তুমি রাজকন্যে হয়ে আরাম খাবে, এইটুকুর জন্যে এই রিস নিয়েছি আমি? এই বলে দিচ্ছি যে কোনও কৌশলে টাকা কিছু হাতাবে

কথা দিতে পারছি না বাবা। সীমা শান্ত ভঙ্গীতে উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু কথার শেষটা কি ভঙ্গীর সঙ্গে খাপ খেল? শেষ কথা বলে, কিন্তু এই ভেবে অবাক হয়ে যাচ্ছি কি দাম ধার্য করা হয়েছিল তোমার সবচেয়ে সেরা মেয়ের? কটা টাকায় বেচেছিলে তাকে ব্রজ উকিলের কাছে? যে, সেই মেয়ে-বেচা টাকা এখুনি ফুরিয়ে গেল? তার থেকে দরিদ্রদশার এক কণাও ঘুচল না? এবার তবে আবার কোনও নতুন গল্প ফাঁদো। আরও একটা মেয়ে তো রয়েছে তোমার। বড় হয়ে ওঠা মেয়ে। এবার তাকে বেচে–রাগে ছুটে বেরিয়ে যায় সীমা। বোধকরি চোখের জল ঢাকতেই অত ছুট।

.

অনেকক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসে রইল ধীরা। তারপর নিশ্বাস ফেলে বলল, পয়সার গরম এমনি জিনিস। ভাইবোনগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে দেখল না, একবার মা বলে গলাটা ধরল না। আর আমি

যতীন ঘৃণা আর তাচ্ছিল্যের সংমিশ্রণে গঠিত একটা শব্দ করে বলে, মেয়েমানুষ যে! নেমকহারামের জাত।

অন্য দিন হলে এই মেয়েমানুষ শব্দটা নিয়ে খণ্ডপ্রলয় বেধে যেত ধীরার সঙ্গে। আজ আর কিছু হল না। চুপ করে রইল ধীরা। যেন এতদিন সীমা ওর কাছে ছিল, আজই প্রথম হারিয়েছে তাকে। আজই প্রথম বিচ্ছেদ।

রীতা বলল, পদ্মদি মিনাদি রাধা ঊষা সবাই বেড়ার ওধারে ভীড় করে দাঁড়িয়ে রইল, কারুর দিকে তাকাল না দিদি। গট গট করে চলে গেল।

হুঁ।

যতীন নাকের পথে একটা দাবদাহকে বুক থেকে নামিয়ে বলে, যা বুঝেছি প্যাজ পয়জার দুই-ই হল! ঘরের চেঁকিই বিভীষণ হয়ে উঠল। এর থেকে যে সিনেমায় নামাতে চেয়েছিলাম, সে একশো গুণ ভাল ছিল। জটিল কুটিল পথ ধরতে গেলেই এই হয়। তখন মনে হত সংসারের অবস্থা ফেরাতে মেয়ে আমার বুঝি প্রাণ দিতে পারে, ইজ্জত দিতে পারে। উবে গেল সে মায়া মমতা! সনৎ দাসের মেয়ে দুটো তো দেখছি ওর চেয়ে ঢের ভাল। ইজ্জত বিকোচ্ছে, কিন্তু মা বাপ ভাই বোনকে বুকে করে আগলে রেখেছে। সংসারের অবস্থা ফিরে গেছে সনৎ দাসের।

.

আলোচনা ক্রমশই উদ্দাম হয়ে ওঠে।

ঘৃণা আর ধিক্কারের ভাষা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। কলোনির আরও অনেকে এসে জড় হয়। পদ্ম মীনা রাধা ঊষা। যারা এতক্ষণ বেড়ার ওধারে থেকে নাটক অবলোকন করছিল।

তারা অবশ্য প্রকৃত রহস্য জানে না।

তারা জানে সীমাকে না কি কোন এক বড়লোকের বিধবা পুষ্যি নিয়েছেন। তাই কপাল ফিরে গেছে সীমার। এখন সীমা সোনা চিবোচ্ছে রূপো মাড়াচ্ছে। আর স্রেফ হাত খরচার জন্যে যা পাবে, তাতে যতীন সেনের অবস্থা ফিরিয়ে দিতে পারবে।

প্রশ্ন উঠেছিল বটে জগতে এত লোক থাকতে যতীন সেনের মেয়েকেই বা হঠাৎ পুষ্যি নেবার ইচ্ছে হল কেন সেই বড়লোকের বিধবার? আর তাই যদি হল সব চেয়ে বড় মেয়েটা কেন? আরও তো ছেলে মেয়ে আছে যতীনের। ধাড়ি শালিখ কি পোষ মানে?

এর আর নতুন কোনও উত্তর নেই, একটাই উত্তর। বহু নামে এক বরাত! অদৃষ্ট! কপাল।

পাতা চাপা কপাল সীমার।

সামান্য একটু বাতাসে সে পাতা উড়ে গিয়ে কপাল খুলে গেছে!

সেই খোলা কপাল সীমাকে দেখতে এসেছিল ওরা। তার আগে বলাবলি করেছে অনেক কিছু। খুব কি সেজেগুজে আসবে সীমা? এক গা গহনা পরে? বড়লোকের পুষ্যি কন্যে হয়েছে যখন।

তা হয়তো আসবে না। লজ্জা করবে।

ছোট ছোট ভাই বোনের গায়ে জামা জোটে না। মার পরনে ছেঁড়া শাড়ী। অবিশ্যি বেশিদিন আর থাকবে না এরকম। সীমাই দুঃখু ঘোচাবে এদের। চাইকি সেই ধর্ম-মাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে আর দুএকটা ভাই বোনেরও গতি করে নেবে। নেবে না কেন, তাদের যখন লক্ষ্মীর ভঁড়ার।

যতীন সেন না কি এই কলোনি থেকে উঠে যাবে। যা যাওয়াই স্বাভাবিক। বড়লোক হয়ে যাওয়া সীমা কি আর বাপ মাকে ফেলে রাখবে এখানে? তা ছাড়া নিজেই বা সে এই পচা গলিতে ঢুকবে কেন আর? বড়লোকদের তো অমন দশ বিশ খানা ভাড়াটে বাড়িও থাকে, তারই একখানা বিনি ভাড়ায় পাইয়ে দেবে বাপকে! পাতা চাপা কপাল একা সীমারই নয়। যতীন সেনেরও।

এমনি অনেক আলোচনা অনেক কল্পনা চলেছে ওদের, সীমা চলে গিয়ে অবধি। যতীন সেনের প্রতি তীব্র একটা ঈর্ষায় গা জ্বালা করেছে। তবু দেখবার সাধ ষোলো আনা।

তাই আজ যখন ধীরা পাবলিক কলে জল নেবার সময় টিপে টিপে খবরটা ছেড়েছিল, আর বলেছিল সীমার জন্যে খাবার করে রাখতে হবে, দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবার সময় আজ আর নেই ওর, অতএব সবাই তফাৎ যাও, সত্যিই সবাই তফাতে সরে গিয়েছিল ধীরাকে আগে সেরে নিতে দিয়ে।

আশ্চর্য! টাকা বস্তুটা এমনই প্রভাবময়। টাকাবানের প্রতি হিংসে আসে, বিদ্বেষ আসে, কিন্তু কিছুতেই অগ্রাহ্য আসে না।

তা ধীরা চলে গেলে ওরা জটলা করে ঠিক করেছিল সীমা যখন আসবে, দেখতে যাবে। অবিশ্যি লেখাপড়া নিয়েই বেশি বেশি থাকত সীমা, এই পদ্ম মিনা রাধা ঊষাদের মত শুধু ঘরসংসারী কাজ আর পাড়াবেড়ানো নিয়ে থাকত না। তবু একরকম বন্ধু বৈ কি। ওদের জন্যে সীমা এখানে একটা ইস্কুল বসাবার অনেক চেষ্টা করেছে, হয়ে না ওঠায় ওদের সেলাই ইস্কুলে ভর্তি হতে পরামর্শ দিয়েছে, আরও কত সূত্রে কথা বলেছে, মিশেছে।

ওরা দেখবে না সীমার কখানা হাত বেরুলো?

.

এমনও হওয়া অসম্ভব নয়, সীমা সবাইকে মনে রেখে সকলের নামে নামে একখানা করে শাড়ী আনবে। খুব দামী না হোক, মাঝারি মত। বাচ্ছাদের জন্যে লজেঞ্চুস চকোলেট আনতে পারে। নয়তো এও হতে পারে আশে পাশে যে বাচ্ছাগুলো বড় ঘোরে। তাদের হাতে হাতে টাকা দেবে কিছু খাস বলে।

.

সারাদিন এইসব জল্পনার শেষে, এসে দাঁড়িয়েছিল ওরা।

কিন্তু সীমা যেন ওদের বড় যত্নে আঁকা একখানা সুন্দর ছবির উপর কালির পোঁচ টেনে দিয়ে গেল। সীমা যেন ওদের সাজানো খেলাঘরে একখানা থান ইট বসিয়ে দিয়ে গেল।

.

সীমা চলে যেতেই বেড়ার এদিকে চলে এল ওরা। মুচকি হেসে বলে, কিরে রীতা, দিদি কি দিল?

রীতা ঠোঁট উল্টে উত্তর দেয়, ওই যে ওখানে পড়ে আছে।

তবু ভাল। আমাদের তো মনে হল চিনতেই পারল না তোদের দিদি। না একটু হাসি গল্প, না একটু খানিক বসা। বড় মানুষের পুষ্যি হলে বুঝি এমনিই হয়? রীতা দিদির উপর রাগে জ্বলছিল। অনেক আশায় নিরাশ করেছে দিদি।

গিন্নীর সেই তিন আলমারি শাড়ীর থেকে লুকিয়ে দুচারখানা শাড়ী দিদি রীতার জন্যে নিয়ে আসবে, এটা যেন নিশ্চিত ছিল। তার বদলে কিনা একখানা সাধারণ ধনেখালি ডুরে!

যখন লেখাপড়া করত, তখন যে খুব বলা হত, দেখ রীতা, মেয়ে বলেই যে বড় হয়ে গেলেই বিয়ে করতে হবে আর ঘরসংসার করতে হবে, তার কোন মানে নেই। মেয়েকেও ছেলের মত হতে হবে। দেখিস আমি কক্ষণো বিয়ে করব না। চাকরী করব, বাবার কষ্ট ঘোচাব সংসারের অবস্থা ফেরাব।

রীতার অবশ্য তাতে খুব সায় ছিল, তবে রীতার বিয়েটা হওয়া দরকার। রীতা ঘরসংসার ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না। কিন্তু সে যাক, চাকরী না করেই তো দিদি রাজ ঐশ্বর্যের মালিক হয়ে গেল, তা এই কি প্রতিজ্ঞা রক্ষার নমুনা? দশটা টাকা দিয়ে গেল না মার হাতে? অথচ রীতা ভেবে রেখেছিল হয়তো একশো দুশো টাকা রীতাকেই দিয়ে যাবে হাতে গুঁজে, চোখের জল ফেলে।

ছি ছি ছি!

চারিদিক থেকেই ছি ছি ধ্বনি উঠছিল।

এই ছিছিক্কারের মধ্যে ব্রজনাথ এসে দাঁড়ালেন।

বলা বাহুল্য মোটেই সসম্ভ্রম সম্বর্ধনা পেলেন না।

যতীন সেন বলে ওঠে, কোন ঘোটলোকের বাড়ি মেয়েটাকে ভর্তি করলেন মশাই? এই কদিনেই তো মেয়ে বাপের নাম ভুলে গেল! এ করব, তা করব অনেক তো আশ্বাস দিয়েছিলেন, নমুনা তো দেখছি চমৎকার। মেয়ে আমার এলেন শূন্য হাত ঢনঢনিয়ে, মা বলে দশটা টাকা হাতে দেবার ক্ষ্যামতা হল না। বলি মেয়েকে যে আমি আপনার হাতে সঁপে দিয়েছি সে কি অমনি? ….এর থেকে পাবলিক থিয়েটারে প্লে করতে দিলে তো আমার ছিল ভাল।

ধীরা ওঘর থেকে শব্দভেদী বাণ ছোঁড়ে। বেশ ভালই ছোঁড়ে।

ব্রজ উকিল রাগেন না, হেঁ হেঁ করেন।

এসব যে একটু আধটু শুনতে হবে সে কথা ব্রজ উকিলের জানা। যেখানে শুধু অর্থলোভে এতবড় কাণ্ডটায় সায় দিতে পারে মানুষ, সেখানে সে লোভের পুরণ যে সহজে হবার নয় সে কথা ঘুঘু ব্রজনাথ না বুঝবেন কেন?

কিন্তু সে যাক, আসামী কই? কোথায় সীমা? এসেই কি পাড়া বেড়াতে গেছে নাকি?

পুরানো বান্ধবীদের জন্যে কাতর হয়েছিল বোধ হয়? অবিশ্যি হতে পারে। কিন্তু তাকে যে ব্রজ উকিল বলে নিয়ে এসেছেন দেরী না করতে।

ডাক ডাক, কোথায় গিয়ে বসে আছেব্রজনাথ তাড়া দেন।

আর সঙ্গে সঙ্গে তাড়া দিয়ে ওঠে যতীন সেন। ডাকব? কোন চুলো থেকে? সে কি এখনো এই আঁস্তাকুড়ে আছে নাকি? তিনটে বৈ চারটে কথা বলেনি, ঠিকরে বেরিয়ে গেল। আমায় কেবল মারতে বাকি রেখেছে

তা রাখুক। বাকী না রাখলেও আপত্তি ছিল না ব্রজনাথের, নিজেরই তার দুঘা বসিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল ওই মেয়ে চামারটাকে। কিন্তু আসল কথায় যে মাথায় হাত পড়েছে।

চলে গেছে! একা গেছে!

এল ব্রজনাথের সঙ্গে, ফিরবে একা, সুনন্দা কি বলবে!

আবার বলছে রাগারাগি করে চলে গেছে। গিয়ে রাগের মাথায় যদি ফাঁস করে দেয়।

উঃ কী আপদ! এই হুঁড়ি হারামজাদীগুলো কি এতও নেমকহারাম!

ছিলি ছাই গাদায় উঠেছিস সিংহাসনে, তার জন্যে চির কৃতজ্ঞ থাকবি তো–যে লোকটা হাত ধরে সেখানে উঠিয়েছিল তার কাছে! তা নয়, যেন ছুরি শানিয়ে বসে আছে খোঁচা মারবার জন্যে।

তবু একটা ভাল যে গিন্নীর ওই পাজী ভাইপোটার সঙ্গে তেমন ভাব হচ্ছে না। হবে কি করে, পাজীটা মুখে যতই উদারতা দেখাক, মনে তো বুঝছে আমার বাড়া ভাতে ছাই পড়ল।

আর মেয়েটাও বুঝছে ওই ভাইপোটার চোখ বিপজ্জনক। একা মহিলাকে অভিভূত করে রাখা যায়। কিন্তু ছোঁড়াটা ধুরন্ধর।

ভাব হয়নি সেটা ভাল। কিন্তু এসব কি! মেয়েটা এত অসভ্য!

তখন তো একেবারে সাদা কাগজে সই মারলি, আমায় যা করতে বলবেন করতে রাজী আছি, বলুন কি করতে হবে? হারানো মেয়ের অভিনয়? বেশ! এমনিতেই তো বাবা চেষ্টা করে বেড়াচ্ছিলেন যাতে পর্দায় নামাতে পারি। শুধু একটা শর্ত। এই সংসারটাকে টেনে তুলবেন আপনি। আমাকে দিয়ে যদি তার ব্যবস্থা হয়, মরতেও প্রস্তুত আছি আমি।

এই তার পরিণাম। দুদণ্ড এসে ঝগড়া করে চলে গেলি!

ছি ছি ছি! তবু ব্রজনাথের দায়িত্ব আছে। ছুটে ফিরে যান।

.

সীমা ফিরেছে? ব্যস্ত হয়ে এসে প্রশ্ন করেন।

দুর্ভাগ্য তার যে পড়লেন উদ্দালকেরই সামনে। উদ্দালক হাতে একটা বই লোফালুফি করতে করতে বলল, গেল আপনার সঙ্গে, আর আপনি এসে জিগ্যেস করছেন ফিরল কি না?

বরাত আমার তাই জিগ্যেস করছি। সেখানে ছেড়ে দিয়ে একটু ঘুরে আসতে গিয়েছিলাম। জানি গল্পগাছা করবে বসে বসে, করে নিক। মা বাপের–ইয়ে ওই যাদের মা না মাসী বলত তাদের সঙ্গে আর কি–আমি ঘুরে এসে নেব। তা গিয়ে শুনলাম একা গট গট করে চলে এসেছে।

কই এখানে তো আসেনি!

আসে নি তার মানে?

মানে আপনিই জানেন।

দেখ ছোকরা। তোমার ঔদ্ধত্য আমি অনেক সহ্য করেছি আর না–ব্রজ উকিল ক্ষেপে ওঠেন। সীমার অসভ্য আচরণ, যতীনের যাচ্ছেতাই, ধীরার গালমন্দ সর্বোপরি উদ্দালকের এই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভাব ক্ষেপে ওঠার ইন্ধন জোগায়।

তোমার পিসি ঠাকরুণ, ওই মিসেস রায়কে বলব, হয় আমায় রেহাই দিন, নয় তোমাকে সরান।

সে কি, আপনাকে এক্ষুনি রেহাই দেবেন কি? উদ্দালক নিতান্ত ভাল মানুষের মত মুখে বলে, রায় কোম্পানীকে দেউলে করান, ব্যবসা লাটে তুলে বেনামীতে নীলামে ডেকে নিন, তবেই তো? এতদিন ধরে নৌকা বেয়ে কূলে এসে তরী ডোবাবেন?

কী বললে! কী বললে বেয়াদপ ছোকরা–রাগে থর থর করে কাঁপতে থাকেন ব্রজনাথ। সন্দেহ থাকে না তার–সর্বনাশী মেয়েটা সব ফাস করে দিয়েছে। চড়াগলায় বলে ওঠেন, নিশ্চয় সে এসেছে, ডাকো তাকে, কেন সে আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করল শুনে যাই।

ডাকা যাবে না, উদ্দালক নিরীহ গলায় বলল, মাথা ধরেছে। ঘর অন্ধকার করে ঘুমোচ্ছে।

বেড়িয়ে ফিরে ঘর অন্ধকার করে ঘুমোচ্ছে?

সুনন্দা বিরক্তি-মেশা গলায় বলে নিশ্চয় মাথা-টাথা ধরেছে। এই রকম একটা কিছু হবে এ-ভয় আমার ছিল। তাই ইচ্ছে ছিল না আবার পুরনো জায়গায় যাওয়া আসা করে। যতই হোক এতকালের জায়গা, চেনা পরিচিত জগৎ! মন খারাপ তো হতেই পারে।….তা দরকার কি ডেকে কষ্ট নেওয়া, ছেঁড়া চুলে গেরো দেওয়া! আমার তো এখনো ঠাকুর ঘরের কাজ শেষ হয়নি। আরতি পুজো সবই বাকি। শোবার ঘরে ঢুকতে পারব না, কি না কি ছুঁয়ে মরব। দুলু, দ্যাখ দিকি একবার মেয়েটা পড়ে কাঁদছে কিনা।…কাঁদছে নির্ঘাৎ। দ্যাখ বাবা!

নিতান্ত বিরক্ত মন নিয়েই ঠাকুর ঘরে ঢোকে সুনন্দা। এ মন নিয়ে পুজো হয় না। কিন্তু উপায় কি? তাড়াতাড়ি সেরে নিয়েই যেতে হবে মেয়েটার কাছে।

তবে পুজোর মন নিয়ে পুজোর ঘরে কবেই বা ঢুকতে পেয়েছে সুনন্দা!….ঢুকেছে কেবলই কান্নার মন নিয়ে। বিরহের কান্নার মন।

সে কান্না পুজোর ঠাকুরকে পাবার আকুলতায় চিরবিরহী আত্মার ক্রন্দন নয়, নিতান্তই একটা ছোট্ট পুতুল হারিয়ে ফেলার কান্না সে।

যখনই কোন কারণে মন উদ্বেল হয়ে উঠেছে, তখনই সুনন্দা কান্না লুকোতে ঠাকুর ঘরে ঢুকেছে। এই একটা পরম আশ্রয়ের আর আড়ালের জায়গা মানুষের। মানুষের দেওয়া আঘাতের বেদনাকে নিয়েও সেখানে গিয়ে উজাড় করে দেওয়া যায় নিজেকে। …আর কোন এক সময় হয়তো সেই আঘাতের বেদনাই বিরহ বেদনায় রূপান্তরিত হয়ে ওঠে।

কিন্তু আজ সুনন্দার মনে বেদনা নয়, বিরক্তি। এই মন নিয়ে বসে বসে নিজেকে উজাড় করে দেবার ইচ্ছে হবে না। কোনমতে হাতের কাজ সেরে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে আনতে কষ্ট হবে। তাই উদ্দালককে পাঠিয়ে দিয়ে ব্যস্ত হাতে আরতির যোগাড় করতে থাকে সুনন্দা।

.

এ ঘরে উদ্দালক এসে ঢোকে।

ফট করে আলোটা জ্বালতেই ধড়মড় করে উঠে বসে সীমা। বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকায়।

উদ্দালক খাটের বাজুটার উপর উঠে পা দোলাতে দোলাতে বলে–যাক তবু ভালো, চোখ শুকনো। জলের বদলে আগুন! অবশ্য প্রাণবধের ব্যাপারে দুটোই সমান কার্যক্ষম। দেখো বাপু নিধি, ভস্ম-টস্ম করে বোসো না।

সীমা চোখের সেই আগুনকে আরও তীব্র করে বলে ওঠে–আপনি এ ঘরে এসেছেন কেন? কে আপনাকে আসতে বলেছে?

–বলেছেন অবশ্য আমার বিবেচনাময়ী পিসিমা। মানে স্বয়ং গৃহকর্ত্রী।

–গৃহকর্ত্রী হলেই তিনি যাকে যা খুশি অর্ডার দিতে পারেন? কাউকে যদি কোনও একটি ঘরে দয়া করে থাকবার অনুমতি দিয়ে থাকেন তার সুবিধে, অসুবিধে পর্যন্ত দেখবেন না?

উদ্দালক ঈষৎ অবাক হয়ে বলে–তুমি হঠাৎ হঠাৎ রেগে আগুন হয়ে ওঠো কেন বল তো? গুরুজনের সম্মান রাখার প্রশ্নটাও যেন ভুলে যাও মনে হয়। মানে বোঝা যায় না। ঈশ্বর জানেন কোন ধরনের পরিবেশে বেড়ে উঠেছ তুমি। তবু লেখাপড়াও তো শিখেছ? এভাবে কেন নিজেকে এ বাড়ির থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে চাও? স্বাভাবিক বুদ্ধি, এবং বিদ্যেসাধ্যি এই দুটো মিলিয়ে একটা হিতাহিত জ্ঞানও তো থাকা উচিত।

–যা উচিত তা যদি সকলের মধ্যে না থাকে? সীমা তীব্রস্বরেই বলে,–সবাই যদি আপনার মত মহামহিম না হতে পারে? এখন যান, আমার ভীষণ মাথা ধরেছে!

উদ্দালক ঈষৎ গম্ভীর হয়ে বলে,–সে তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু রোগটা সারানোও তো দরকার?

–না, কোনও দরকার নেই। আপনি যান।

উঁহ উদ্দালক দৃঢ়স্বরে বলে–এত সহজে আমাকে হঠাতে পারবে, এ আশা ছাড়ো। পিসিমা আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন তার আদরিণী হারানিধি নির্জনে পড়ে অশ্রুবিসর্জন করছেন কিনা দেখতে। আর আমি ঠিক করেছি, শুধু দেখতে নয়, সে অশ্রুর মূল উৎপাটন করতে। কেন তুমি মন খারাপ করবে? যাঁদের কাছে এতদিন থেকেছ, তাদের জন্যে মন কেমন করা খুবই স্বাভাবিক, না করলেই বরং হৃদয়হীন বলতাম। তাই বলছি–তাদের তো কাছাকাছি এনে রাখলেই ভাল হয়

-পাগলের মত কথা বলবেন না।

নাঃ, সেই আপনি আজ্ঞে, দাদা না বলা! এর একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার। আর তার প্রধান সোপান হচ্ছে, টুলু তুই! টুলু তুই এমন বেয়াড়া আড়বুঝো মেয়ে কেন রে? আমাকে কিছুতেই দাদা বলবি না কি জন্যে? কিছুতেই আপনার ভাববি না কি জন্যে? তাহলে লোকে যা বলে, সেটাই সত্যি বলে ধরে নিতে হবে?

সীমা চমকে উঠে রুদ্ধকণ্ঠে বললে–কী বলে লোকে?

–বলে? তা বেশ ভালো ভালো উঁচুদরের কথাই বলে। বলে, তোর বাবার বিষয় সম্পত্তিতে আমি নাকি আগে থেকেই ভাগ বসিয়ে বসে আছি, তাই তুই আমায় দুচক্ষে দেখতে পারিস না। তুই নাকি দারুণ হিংসুটে

ভুল ভুল! সব মিথ্যে, সব বাজে।–বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ে সীমা।

উদ্দালক আবার পা দোলানো সুরু করে বলে, তা বেশ, সেটা যে মিথ্যে, বাজে, ভুল, সেটাই প্রমাণিত করছিস না কেন? কেন সহজ প্রসন্ন মনে আমাকে দাদা বলে গ্রহণ করতে পারছিস না? এতে পিসিমা মনে কত কষ্ট পান সেটা ভেবে দেখ? ভেবে দেখ বেচারী মহিলাটির সারাজীবনের ইতিহাস।….সেই কোন অতীত কালে একটি শিশুকে কোলে পেলেন, নেহাতই আধো ভাষায় মা ডাক শুনলেন, তারপর হারালেন সে সব। ভগবান নিল না, নিল কিনা মানুষ! কতবড় কষ্ট সেটা ভাব! এমনি ভাগ্য, তারপর আর কোনও শিশু এল না ওঁর কাছে, সেই মা ডাক আর শুনলেন না। এর মধ্যে স্বামী গেছেন, একা সংসারে চলার কষ্ট পাচ্ছেন, উকিল ম্যানেজার সবাই মিলে ঠকাবার তাল খুঁজছে–

–শুধু তারাই নয়,সীমা আবার উঠে বসে। বিদ্যুৎ গতিতে যেন।

তারপর বিদ্যুৎ গতিতেই বলে,–শুধু তারাই নয়, সবাই। পৃথিবী সুদ্ধ সবাই আপনার পিসিমাকে ঠকাবার তাল খুঁজে বেড়াচ্ছে, ঠকাচ্ছে।

উদ্দালক হেসে ফেলে বলে,–কথাটা অবশ্য খুব মিথ্যে বলনি। আত্মীয় বন্ধু, চাকর দাসী, যে সেখানে আছে, কেউ কিছুতেই সমর্থন করতে পারে না, একটি মাত্র বিধবা মহিলার এত টাকা থাকবে, রায় কোম্পানীর মত অতবড় একটা কোম্পানী থাকবে। কাজেই সে ভারটা যাতে সহজে লাঘব হয় তার চেষ্টা করবে না?…এই তো বেশী কথা কি, আমিই কি কম ঠকাচ্ছি, পিসিমা আমাকে পুষছেন, তাকে একটু দেখাশোনা করব বলে। অথচ ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে তিনিই আমার দেখাশোনা করছেন। আমি শুধু অন্ন ধ্বংসাচ্ছি। এও একরকম ঠকানো বৈকি। তা ওটা পৃথিবীর ধর্ম। তবু মানুষের হৃদয়ের দিকেও তাকাতে হবে। ভাবতে হবে ওই প্রতারিত বঞ্চিত আর চিরদুঃখে নিমজ্জিত মানুষটা যখন এতকাল পরে সেই হারানো সন্তানকে ফিরে পেল, তখন–সে যাতে সেই পাওয়াটা সম্পূর্ণ পেতে পারে তার জন্যে সবাই মিলে চেষ্টা করি।

সীমা একটু অদ্ভুত হাসি হেসে বলে,আর যদি এমন হয় ওই ফিরে পাওয়াটাই একটা মস্তবড় প্রতারণা, তা হলে আর সর্ণের স্বাদ কে দিতে পারবে?

উদ্দালক ঈষৎ থতমত খেয়ে বলে–ফিরে পাওয়াটা প্রতারণা! তার মানে?

–কি? এত স্পষ্ট পরিষ্কার স্বীকারোক্তির পরও আপনি মানে খুঁজছেন?…হঠাৎ একটা নিষ্ঠুর। হাসি হেসে ওঠে সীমা,–ভারী আক্ষেপ আপনার, আপনাকে দাদা বলিনা বলে। তাই না? জানেন, আমি কী? ….কতবড় ঠগ জোচ্চোর! তবে আরও স্পষ্ট করে বলি শুনুন–এই রায় বংশের কেউ নই আমি। কোনদিনও ছিলাম না। স্রেফ নন্দীবাগান কলোনির যতীন সেনের মেয়ে।

কী? কী বলছ?

–ঠিক বলছি–আরও নিষ্ঠুর আর আত্ম-ধিক্কারের হাসি হেসে ওঠে সীমা–আরও শুনতে চান? শুনুন–শুনছেন যখন ভাল করেই শুনুন–আমার বাবা বেশ একটি মোটা টাকা নিয়ে আমাকে বেচেছেন, আপনাদের ধর্মপ্রাণ ব্রজ উকিলের কাছে। উকিল মশাই অবশ্য বিরাট এবং মহান একটি উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেই এই পুণ্য কাজটি করেছেন।

.

বারে বারে হাসির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।

পুজোর ঘরে বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সুনন্দা। ধীরে ধীরে হাত চালায়। ঠাকুরের ভোগ হবে, শয়ন হবে, সকালের আরতি পুজোর জন্যে আবার বাসনপত্র ধুয়ে মেজে রাখতে হবে, কাজ তো কম নয়। আর এ ঘরের সব কাজ সুনন্দা নিজের হাতেই করে।

মনটা শান্ত করে নিত্যকর্মে মন দিল সুনন্দা। হাসছে টুলু। তার মানে মনের মেঘ কেটে গেছে। যাবে, যেতেই হবে। দুলুর হাতে পড়লে মরা মানুষও হাসে। ওর কাছে আর টুলুর মনখারাপ, মাথাধরা এসব ধোপে টিকল না।…এবার থেকে যেখানেই যাক, দুলুর সঙ্গেই যেতে বলব। কিছুতেই ওই উকিলবাবুর সঙ্গে পাঠাব না।…স্বীকার করছি তিনি আমার মস্ত উপকারী। উনি যা করেছেন তার জন্যে চিরঋণী হয়ে থাকব আমি, শুধু এ জন্মে কেন, হয়ত শত জন্মেও ওঁর ঋণ শোধ করতে পারব না আমি। উনিই আমার হারানো মাণিক উদ্ধার করে এনে দিয়েছেন, তবু হে ঠাকুর, তোমার কাছে তো কিছু ঢাকা থাকে না, সবই দেখছ তুমি, সবই জানছ বুঝছ, তাই তোমার কাছে স্বীকার করছি ওঁকে আমার ভাল লাগে না। ওঁকে আমার ভয় করে। মনে হয় উনি যেন টুলুকে নিয়ে কী এক প্যাঁচ কষছেন, যেন দিয়ে আবার কেড়ে নেবেন! …লোকটা চিরদিনই আমার হিতৈষী, এই রায় কোম্পানী উনিই দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, তবু চিরদিনই দেখলে কেমন যেন বিতৃষ্ণা আসে। টুলুও যে ওঁকে দেখতে পারে, তাও নয়। তাই ভাবছি ওঁর সঙ্গে আর পাঠাব না টুলুকে।….দুলু আমার সোনার ছেলে, চাদে কলঙ্ক আছে তো দুলুতে নেই। ও নিয়ে যাবে ওর বোনকে। সেই ভালো।

চারদিক থেকে ভেবে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে বাঁচে সুনন্দা। আরও বাঁচে আর একবার খুব সতেজ হাসির শব্দ শুনে।

হ্যাঁ, হাসছিল টুলু। ক্ষুব্ধ ব্যঙ্গের হাসি।

ঠিক সেই সময় আর একবার হেসে উঠল, সশব্দ সতেজ।

হেসে উঠে বলছিল, হা, ওই আপনাদের রায় কোম্পানীর সর্বেসর্বা ব্রজনাথ উকিল! যেহেতু উনি দেখলেন, দীর্ঘকাল ধরে সিঁধ কেটে কেটে উনি যখন সবে সেই সিধের গর্তের মধ্যে দিয়ে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছেন, তখনই হঠাৎ রায় কোম্পানীর মালিক, তার এক ভাইপো পুষতে শুরু করলেন, আর ধূর্ত ভাইপোটার চোখে উকিলের স্বরূপ ধরা পড়ে গেল, সেই হেতু সেই ভাইপোটাকে সরিয়ে ফেলবার একটা উপায় আবিষ্কার করতে বসলেন তিনি।….ছলে বলে কৌশলে যে করেই হোক ওই ভাইপোটাকে গদিচ্যুত করতে হবে, সেই চিন্তা থেকেই আমার উদ্ভব।….

উদ্দালক প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলে,কী? বলছ কী?

–যা সত্য ঘটনা সবই বলছি। বলতে যখন বসেছি, সবটাই বলতে দিন। এই ছদ্মবেশ অসহ্য হচ্ছে। নিজেকে নরকের কীট মনে হচ্ছে। আর প্রতিনিয়ত আপনার ভোলা মনের স্নেহের ডাককে ফিরিয়ে দিতে দিতে–যাক কী বলছিলাম? হ্যাঁ, বুদ্ধিমান উকিলটি ভাবলেন, এই পরিস্থিতির মাঝখানে আসল কোনও মালিককে যদি খাড়া করা যায়, যে ওই ব্রজ উকিলের কথায় উঠবে বসবে নাচবে গাইবে, নাটক অভিনয় করবে, তাহলে তার সব দিক বজায় থাকে।…অতএব রচিত হল একটি গল্প। অনবদ্য গল্প! এক অলীক ডাক্তার, আর অলীক মহিলাকে নায়ক নায়িকা করে! নায়িকাটি মৃত্যুকালে ডাক্তারের কাছে স্বীকার করছেন

টুলু!

খাটের বাজুতে বসে থাকা উদ্দালক হঠাৎ বিছানায় বসে থাকা সীমার কাধটা চেপে ধরে রুদ্ধকণ্ঠে প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে–টুলু!

সীমা মুখ তুলে তাকায়।

আস্তে নিজের কাঁধটা সরিয়ে নেয়।

আর এবার ঈষৎ আস্তেই বলে,–খুব ভয় পাচ্ছেন, না? আর ঘৃণায় শিউরে উঠছেন? …ভাবছেন এতবড় পাপও সম্ভব? কিন্তু সীমা একটু হাসে, ব্রজ উকিল বললেন, ধর্মকাজ করলাম। একটি সন্তানহারা নারীর শূন্যকোলে তার হারানো সন্তানকে ফিরিয়ে এনে দিলাম, আর একটি বাস্তুহারা অন্নহারা দুঃখী পরিবারকে অন্ন জোগানোর প্রতিশ্রুতি দিলাম।…ভারি সুন্দর করে কথা বলতে পারেন উকিলবাবু। তবে ভদ্রলোক এত দেখে আর এত জেনেও এটা জানেন না যে, মানুষ যখন কিছু খেতে পায় না, তখন মুখ বুজে বসে থাকে। কিন্তু খেতে পেলেই তার হাঁ খোলে। সেই খোলা হাঁ তখন আরও চাওয়ার দাবি তোলে। অন্ন পেলে বস্ত্র চায়, বস্ত্র পেলে বাড়ি গাড়ি চায়, আর তাও যদি পেয়ে যায় তো কুবেরের ভাণ্ডারটাকেই চেয়ে বসে।…তাই জবর-দখল কলোনীর যতীন সেন এই রায় বাড়ির লোহার সিন্ধুকের চাবিটাই দাবি করে বসতে দ্বিধা করে না তার সেই বিক্রীকরা মেয়ের কাছে।

কথার শেষে ঝুপ করে আবার শুয়ে পড়ে সীমা, আবেগে উদ্বেল হয়ে ওঠে তার দেহ।

উদ্দালক এতক্ষণ অবাক অপলক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে তাকিয়ে শুনছিল এই অসম্ভব অভাবনীয় কাহিনী। ভাবছিল–এ কী সত্যি! না এই মেয়েটা এতদিনের পরিবেশ থেকে চলে এসে বেদনায় আর পিসিমার বুভুক্ষু মাতৃস্নেহের প্রবল ধারায় হাঁপিয়ে উঠে শিকল কাটতে চায়। তাই এই গল্প। কে বানাচ্ছে এক অসম্ভব অনবদ্য গল্প? উকিল ব্রজনাথ, না সীমা নিজেই?

কিন্তু সেই বানানো কাহিনী বলতে কি এমন আবেগ আসে?

তবু উদ্দালক ধীর স্থির বিবেচনাশীল।

উদ্দালক বোঝে, যদি সত্যিই সীমার গল্প সত্যি হয়, যদি সত্যিই সীমাকে নিয়ে এই ভয়ানক একটা ষড়যন্ত্র রচিত হয়ে থাকে, কিছুতেই চলবে না সে ষড়যন্ত্র সহসা উদঘাটিত করে বসা।

তাহলে সুনন্দা পাগল হয়ে যাবে! সুনন্দা হার্টফেল করবে!

সুনন্দাকে সেই শোচনীয় পরিণতি থেকে বাঁচাতেই মিথ্যার জাল বজায় রাখতে হবে যথাযথ। বজায় রাখতে হবে সুন্দর সুনিপুণ ভাবে।

অতএব উদ্দালককেও নিতে হবে সেই ষড়যন্ত্রের অংশ। সেই মিথ্যার জাল বোনার কাজে তাকেও লাগাতে হবে হাত। পিসিমাকে সুখী করবার চেষ্টায় আনতে হবে নতুন উৎসাহ, ভাবতে হবে নতুন চিন্তায়।

তাই উদ্দালক আস্তে ওর কেঁপে ওঠা পিঠটায় একটু হাত রেখে বলে,–সত্যি ঘটনা যাই হোক টুলু, তোমায় হাত জোড় করে মিনতি করছি যা বলেছ তা এখন ভুলে যাও। পিসিমার কাছে চট করে কিছু বলে বোসো না। বড় বেশি আঘাত পাবেন। বহুদিন ধরে ক্ষয় হয়ে যাওয়া মানুষটা হঠাৎ এই নতুন আঘাতের ধাক্কা সহ্য করতে পারবেন না। আমার এ মিনতিটা রাখো।

তুই শব্দটা আর যেন সহজে মুখে আসে না। টুলু সেই সহজের মুখটায় পাথর চাপিয়ে দিল।

সুনন্দার ঠাকুর ঘর বন্ধ করার শব্দ পাওয়া গেল। এইবার এখানে এসে পড়বেন।

উদ্দালক তাড়াতাড়ি খাটের বাজু থেকে নেমে পড়ে, ব্যস্ত চাপা গলায় বলে–এই লক্ষ্মীমেয়ে, দোহাই তোমার উঠে পড়। অভিনয়ের ক্ষমতাটা আরও কিছুটা ভাল করে দেখিয়ে দাও……

–আমি পারব না।

–ভগবানের দিব্যি টুলু, দোহাই তোমার।

সীমা উঠে পড়ে তীব্র ভৎর্সনাময় অথচ বেদনালাঞ্ছিত দুটি চোখ তুলে একবার উদ্দালকের দিকে তাকিয়ে রুদ্ধগলায় বলে–বেশ! তবে যেদিন এই মিথ্যা-জাল বাইরের ঝোড়ো হাওয়ায় ছিঁড়ে পড়বে, সেদিন আর আমার কোনও হাত থাকবে না। সেদিন ওঁকে বাঁচাবার দায়িত্ব কে নেবে, আপনিই বুঝবেন।

জল উপছে পড়ে সেই দুই চোখে। আগুন উঁকি দেয় তার কোণে।

উদ্দালক সেই বিচিত্র দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আস্তে বলে–উনি নয় টুলু, মা।

.

ব্রজ উকিল কি সত্যই অভিমানে রায়বাড়ি ত্যাগ করলেন? মনের দুঃখে বিবাগী হয়ে গেলেন?

আহা তাই কি সম্ভব! কূলে আসা তরণী নিজের হাতে ডুবিয়ে দেয় মানুষ, তাতে একটা ঢিল এসে পড়েছে বলে? যে দেয় দিক, ব্রজ উকিল অন্তত দেন না।

তিনি বিষমুখে আবার হাসি টেনে এনে এ বাড়িতে এসে হাজির হন।

অবশ্য মনে-মনে প্রস্তুত হয়েই হন।

যদি ওই হাড় বজ্জাত মেয়েটা সব প্রকাশ করে দিয়েই থাকে, তিনি বলবেন–আমি কি করব বলুন? আমি যা শুনেছি, তাই আপনার কাছে এসে বলেছি। আমার সরল মন, পৃথিবীতে যে এত কাপট্য আছে, তা আমার ধারণার বাইরে, জ্ঞানের বাইরে।…তবে হ্যাঁ, সাজা যদি আপনি আমায় দিতে চান, যা দেবেন মাথা পেতে নেব। পুলিশে দিতে চান, তাও দিন। বুঝব এতক্কাল ওকালতি করে খেয়ে এসে যদি এমন ফাঁদে পড়তে পারি, তবে সে আহাম্মকির সেই শাস্তিই আমার হওয়া উচিত।

নিজেকে মজবুত করেই পরদিন এলেন ব্রজ উকিল।

শুধু একটা ভাবনা, ঢুকতে ঢুকতেই যদি সেই লক্ষ্মীছাড়া বদ ছেলেটার সামনে পড়ে যান। ওকে দেখলেই যেন ব্রজনাথের মাথা খারাপ হয়ে যায়। বুদ্ধিসুদ্ধি গুলিয়ে আসে। মেজাজ ঠাণ্ডা রেখে খেলায় চাল দিতে পারেন না। চালে ভুল হয়ে যায়।

ছেলেটার কোনও বিপদ হয় না কেন ভগবান! শহরে এত লোক গাড়িচাপা পড়ে মরে!

ভগবান অবশ্য ব্রজনাথের সব প্রার্থনা পূর্ণ করে উঠতে পারেন না। তবে একটা করেন। বাড়ি ঢুকতে ঢুকতেই দেখা হয় না উদ্দালকের সঙ্গে।

আর দেখেন, অবস্থা যথাযথই আছে। ব্রজনাথকে দেখে কেউ বঁটা বা জুতো নিয়ে তেড়ে আসে না, চাকর যেমন চেয়ার এগিয়ে দেয়, তেমনই দিল, যেমন বাড়ির মধ্যে থেকে চা আসে তেমনই এল।

তার মানে ফাঁস কিছু হয়ে যায়নি।

পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে মনে মনে একটু হাসলেন উকিল।

হুঁ হুঁ বাবা, পথে এসো!

এ জীবনে দেখলাম ঢের! মুখে আস্ফালন করে অন্যকে অপদস্থ করা যত সোজা, স্বার্থহানি করে বসা তত সোজা নয়।….বাছা তখন তো খুব মান দেখালেন, তেজ দেখালেন, বাপকে অপমান করে এলেন, ফিরে এসে তো বুঝলেন, কী রাজ্যিপাটটি ভাগ্যে জুটেছে!….

তেজ দেখিয়ে সব ফাস করে ফেললেই তো এই সোনার খাটে গা আর রূপোর খাটে পা ত্যাগ করে ফের সেই যতীন সেনের ছেঁড়া কাঁথায় ফিরে যেতে হবে!

হুঁ!

বেশ গুছিয়েই বসেন উকিল।

সুনন্দা আসে। বলে আজ আবার কি কাজ? সই?

ব্রজনাথ হাসেন। অমায়িক হাসিনা আজ আর কোনও কাজ নিয়ে আসি নি। আজ শুধু ওই ইয়ে আপনার মেয়েকে দেখতে এসেছিলাম! কাল সেই পুরনো ইয়েদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের পর মনটা কেমন থাকল–মানে, হঠাৎ একা একা চলে এসেছিল তো? তাই ভাবলাম–

সুনন্দা অবাক হয়ে বলে–সে কি? একা চলে এসেছে কি? আপনি?

ব্রজ উকিল প্রমাদ গোনেন। এ যে তিনি নিজেই খাল কেটে কুমীর আনলেন! এ আলোচনা না ফাঁদলেই হত! হারামজাদা মেয়েটা এখানে এসে কিছুই বোস কাণ্ড করে নি তাহলে?

উঃ কত বড় শয়তান!

বাপকে অপমান করে আসার অর্থ তাহলে অহঙ্কার। সেই ছেঁড়া মাদুর আর ঘেঁড়া লুঙ্গি দেখে নাক সেঁটকানি! বুঝেছি!

তা এসব চিন্তা ক্ষণ মুহূর্তের।

নিজেকে তার মধ্যেই সামলে নেন ব্রজনাথ। হেসে বলেন–হ্যাঁ তা সে একরকম তাই বৈ কি, মিসেস রায়! আমি ওকে পৌঁছে দিয়ে ভাবলাম ওদের ওখানে বসে থেকে কি করব, যতই হোক আমি একটা বাইরের লোক, কথাবার্তা কইতে অসুবিধে বোধ করবে, একটু ঘুরে আসি। আধঘণ্টা–জাস্ট আধঘণ্টা, তার বেশি দেরী করিনি। গিয়ে শুনি–সেখান থেকে নাকি কেঁদে কেটে চলে এসেছে

দুরুদুরু বক্ষে অপেক্ষা করেন ব্রজনাথ সুনন্দার অভিব্যক্তির।

সুনন্দা ঈষৎ ভুরু কুঁচকে বলে, হ্যাঁ আমিও তাই বুঝলাম। মাথা ধরেছে বলে শুয়ে ছিল। দুলু অনেক ডেকেডুকে কথা বলে তবে–আচ্ছা সেই বাড়িটা কোথায়?

উকিল হাত জোড় করে বলেন, ওইটি মাপ করতে হবে। তাদের কাছে আমি বাক্যদত্ত আছি। প্রকাশ করব না। জানে তো–আপনি অবস্থাপন্ন, আপনি মহৎ। নিশ্চয়ই তাদের ডাকবেন, দয়া প্রকাশ করবেন, তাই আগে থেকে সাবধান হয়েছে। এই তো দেখুন না, মেয়ে চলে আসার পর যখন গেলাম, বলল, দেখুন মায়ায় পড়ে দেখতে চেয়ে ছিলাম, এখন বুঝছি চাওয়াটা উচিত হয়নি। ওর মনে আর পুরনো স্মৃতি না জাগানোই ভাল।…আর চাইব না!

সুনন্দা সেই অদেখা, অজানা ভদ্রলোকের মহৎ বিবেচনায় মুগ্ধ হয়। অতএব সেও কিছুটা মহৎ বিবেচনায় আসে, না না সে কি কথা! যাবে বৈ কি! যাবে। তাঁরা ওর কত করেছেন। তবে আরও কিছুদিন যাক। মনটা বসুক।

–এরপর ব্রজনাথ প্যাঁচের কথায় আসেন।

–তা আমায় এবার ছুটি দিন মিসেস রায়।

–আপনাকে ছুটি? সে কী? কেন?

সুনন্দা একসঙ্গে তিন চারটে প্রশ্ন করে বসে। এ ছুটি যে দু-চার দিনের নয়, চিরদিনের ছুটি, তা যেন ব্রজনাথের কথার সুরেই ধরে ফেলে সুনন্দা।

ব্রজ উকিল মৃদু হেসে বলেন, কেন? অনেকদিন তো আপনার কাছে খাটলাম, এবার ক্লান্তি এসেছে। তাছাড়া আপনার ভাইপো বড় হয়েছে, সব বুঝতে শিখেছে, তাকেই দিন ভার।

সুনন্দা হেসে ওঠে,–তাকে ভার দেব? হঠাৎ এ কী কথা?

না না হঠাৎ নয়। এ আমার চিন্তার ফল মিসেস রায়। সে বুদ্ধিমান বিচক্ষণ, শিক্ষিত ছেলে, তার পিসির বিষয় সম্পত্তি নষ্ট হচ্ছে কি না সে বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক দৃষ্টি, কাজেই

সুনন্দা বোঝে এ হচ্ছে অভিমান।

উদ্দালকটা নির্ঘাৎ কোনও কড়া পরিহাস করে বসেছে। অতএব সুনন্দা উদ্দালককেই স্রেফ ওড়ায়। তার কথা যে ধর্তব্যের বস্তু নয়, সে কথা বলে বারবার। এবং এ কথাও বলে, উকিল সাহেব ছিলেন তাই এখনো রায় কোম্পানী টিকে আছে, ইত্যাদি ইত্যাদি…

তবু অভিমান দেখান ব্রজনাথ। বলেন রায় কোম্পানীর আসল মালিক তো এসেই গেছে, আর কারোরই কিছু করার দরকার হবে না।

সুনন্দা সে কথাও উড়িয়ে দেয়, বলে ওটা একটা কথাই নয়।

অতঃপর ব্রজনাথ প্রসন্নমনে প্রস্থান করেন।

আর ভাবতে ভাবতে যান। আসল জালের ফাসটাই হাত ছাড়া হয়ে গেছে যেন। লক্ষ্মীছাড়া মেয়েটা যে হঠাৎ এমন বিগড়ে যাবে, কে জানত!

প্রথম সেই অবস্থাটা মনে পড়ল ব্রজনাথের। তখন সীমার কী উৎসাহ! হেসেখেলে কথা

–অভিনয় আমি খুব করতে পারব। দেখবেন ফার্স্ট প্রাইজের যোগ্য অভিনয় করব। এ বরং ভালোই যে, একটা বাড়ির মধ্যে একটি মাত্র মহিলার কাছে মেয়ে সেজে অভিনয়। সংসার চালাবার জন্যে তো পাবলিক স্টেজেই নামতে যাচ্ছিলাম। যা তোক একটা কিছু না করে আর পারছি না, অবস্থা অসহ্য হয়ে উঠেছে।….

আসার সময়ও কত সাহস! তাদের কত সান্ত্বনা দেওয়া! এ বাড়ির ভাত খেয়েই মতি বুদ্ধি বদলে গেল! ছি ছি!…আমায় যেন একেবারে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভাবে। আচ্ছা কেমন তুমি ঘুঘু দেখছি! ফাঁদটা আগে দেখ তুমি!

.

কিন্তু ব্ৰজ উকিল আর নতুন কি জাল বিস্তার করবেন?

সুনন্দাকে আঘাত থেকে বাঁচাতে, সুনন্দার জাল মেয়েকে যে নিত্য নতুন জালে জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে। তাকে কে বাঁচাবে সেই জটিল জাল থেকে? জালের ফাস যে হাতে নিয়েছে সে তো শুধু মজা দেখছে।

.

সুনন্দা বলে, যা দুলু, টুলুকে একটা সিনেমা দেখিয়ে নিয়ে আয়। ছেলেমানুষ, কত আর পড়ালেখা করবে?

উদ্দালক বলে,–তুমিও চল না পিসিমা?

–আমি? আমি সিনেমা যাব? না বাবা! তোর পিসেমশাই গিয়ে পর্যন্ত

অতএব দুলু তারস্বরে ডাক দেয়,–এই টুলু, চল তোকে পথ দেখিয়ে সিনেমা দেখিয়ে আনি। মেলা যেন সাজতে বসিস নি আবার। তোদের মেয়েদের তো

কোনদিন সুনন্দা বলে,–দুলু, টুলুকে নিয়ে একটু নিউ মার্কেটে যা না। কতদিন কিছু সখের জিনিস কেনে নি।

দুলু চেঁচিয়ে বলে,–তাহলে অন্তত হাজারখানেক টাকা দাও সঙ্গে। টুলু যে সেই তৃষিত চাতকের মত সমস্ত দোকানের দিকে তাকাতে তাকাতে মার্কেটে ঘুরবে সে অসহ্য। আবার বলে,–এই টুলু, মনে মনে ঠিক করে নে কি কিনবি। নইলে হয়তো বাঁশবনে ডোম কানা হয়ে গোটাকতক সতরঞ্চিই কিনে বসবি।

তারপর পথে বেরিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে বলে,–কেমন বাঁচিয়ে দিচ্ছি?

–বাঁচিয়ে? না মরিয়ে? সীমা বদ্ধগভীর দৃষ্টিতে বলে,–দিনে দিনে তো আরও মরণের পথে এগিয়ে চলেছি।

উদ্দালকও তেমনি দৃষ্টিতে বলে,–শুধু তুমি একা?

–আর পারছি না। এবার মাকে বলে দিই একদিন। বলি মা, তোমার এই জাল মেয়েটাকে এবার বিদায় দাও।

-তারপর?

তারপর আর কি। জবরদখল কলোনীতে তো আজও আছে যতীন সেনের মাটির প্রাসাদ।

–তারা আবার নেবে?

–পায়ে পড়লে নেবে।

–পিসিমার একটি ভাইপো বৌয়ের দরকার নেই?

–চুপ! খবরদার! লোভ দেখিও না।

–তাহলে কি চাও যে পিসিমার ভাইপোটা সন্নিসী হয়ে বেরিয়ে যাক?

কথার ফুলঝুরি! কথার আলপনা! পথে ঘাটে বাইরে।

বাড়ি এলে অবলীলাক্রমে টুলুর বেণী ধরে টেনে পিসিমার কাছে ধরে আনে উদ্দালক। বলে, এই দেখ পিসিমা, তোমার আদরের কন্যেটি আমাকে আদৌ মানছে না। বলছি যে আয় একটু অঙ্ক শেখাই, নইলে স্রেফ গাড়ু খাবি! বলে, কি দায় পড়েছে তোমার কাছে পড়তে।

সুনন্দার চোখে নন্দনকাননের ছবি! এই তো চেয়েছিল সে। দুই ভাইবোন মিলে মিশে খাবে খেলবে, খুনসুড়ি করবে। সুনন্দার শূন্য হৃদয় পূর্ণ হয়ে থাকবে। তারপর একটি মনের মত পাত্র খুঁজে

না, ঘরজামাই কথাটা শুনতে খারাপ। রায় কোম্পানীর একজন ডিরেক্টর করে দিলেই, মান মর্যাদা বজায় থাকবে তার।আর সুনন্দার এতবড় বাড়ি খালি পড়ে থাকতে কোথায় আর বাড়ি বানাতে যাবে সুনন্দার জামাই? অনেক স্বপ্ন, অনেক ছবি।

ওদিকে সীমা বলে,–মা-র সঙ্গে আর এই ছলনা চালিয়ে যেতে পারছি না।

ছলনা ভাঙলে মা-র খুব সুখ?

তবে এই ভাবেই ন্যাকামি করে চালিয়ে যাব? কোনও দিক থেকে কোনও আঘাত আসবে না? মা তো আমার জন্যে পাত্র খোঁজবার কথা ভাবতে শুরু করেছেন।

-তাই নাকি? বল কি?

–আহা, আকাশ থেকে পড়লে যেন! বিয়ের বয়েস হয়নি আমার?

–তাহলে তো দ্রুত ভাবতে হয় উপায়!

কিন্তু কি ভাববে? কি ভেবে ঠিক করবে? সত্য প্রকাশ করলেই তো এই মুহূর্তে জালিয়াতির দায়ে ব্রজ উকিল আর কলোনীর যতীন সেনের সঙ্গে হাজতে গিয়ে উঠতে হবে সীমাকে। উঠতেই হবে।

এতবড় মর্মান্তিক অপমান সহ্য করতে পারবে না সুনন্দা। নালিশ ঠুকে দেবেই। হয়তো বা অন্য রকমও হতে পারে। আশা, বিশ্বাস, ভালবাসা, হঠাৎ সবকিছু হারিয়ে হয়তো সুনন্দা হার্টফেল করে বসবে। অনেক দিনের দুর্বল হার্ট। সীমাকে যে বড় ভালবেসেছে সুনন্দা! বড় বেশি বিশ্বাস করেছে।

সীমা এই বিশ্বাসের কাছেই কি পরাজিত হয় নি? সেও তো এসেছিল জেনে বুঝে, জালিয়াতির ধর্ম গ্রহণ করে। কলোনীর সনৎ দাশের মেয়েদের মত ইজ্জত বেচে ডুবে যাওয়া সংসারকে বাঁচাবার চেষ্টা না করে, করতে এসেছিল সতোকে বেচে।

ভেবেছিল খুব সহজ। ভেবেছিল, আমি অভিনয়ে খুব পটু। ব্রজ উকিল থাকবে সহায়। বিষয়-সম্পত্তি সব কিছু আস্তে আস্তে চলে আসবে সীমার হাতে, তারপর সে হাত থেকে কিছু কিছু চলে যাবে হস্তান্তরে। তাই খুব পারব বলে দম্ভ করে কাজে নেমেছিল সীমা, কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে গেল!

সীমা ভাবে ভালবাসাটাকে অঙ্কের মধ্যে রাখি নি আমি। বিশ্বাসটাকে হিসেবের মধ্যে ধরি নি। আর বিবেককে? বিবেকের যন্ত্রণাকে? ওকে তো ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু সবাই আজ অসুবিধে ঘটাচ্ছে।

সুনন্দার মনে কষ্ট না দিয়ে আরও কিছুদিন এইভাবে চালিয়ে যাওয়া যেত হয়তো, যদি না উদ্দালক এসে সামনে দাঁড়াত। সুনন্দাকে বাঁচাতে হলে উদ্দালককে ছাড়তে হয়। ছাড়তে হয়। জীবন, জীবনের স্বপ্ন, মন, চৈতন্য, আত্মা।

না না, উদ্দালককে ছেড়ে আমি বাঁচতে পারব না–মনে মনে বলে সীমা–যা হয় তোক।

কিন্তু যা হোকের স্বরূপ তো দেখিয়ে দিয়েছে উদ্দালক, বুঝিয়ে দিয়েছে। হাজত, জেল, বিচার, বিচারশালা! কুশ্রীতা, গ্লানি, লাঞ্ছনা, অপমান!

তবে কি হবে? সুনন্দা কি তার মেয়েকে, মামাতো ভাইকে বিয়ে করতে দেবে? সে মেয়ে অনেকদিন অন্যত্র ছিল বলে? তাই কি সম্ভব?

এদিকে সুনন্দা তখন অন্য জগতে আছে। ও তলে তলে ভাই ভাজকে চিঠি লিখে লিখে এবার আনাচ্ছে। সে চিঠিতে অভিমান আছে, অভিযোগ আছে। সুনন্দার এতদিনের হারানিধি ফিরে পাওয়া গেল, আর সুনন্দার সবচেয়ে যারা নিজের লোক, তারাই রইল উদাসীন হয়ে?

একবার দেখতে এল না?

দাদা লেখে–আরে বাবা, উদাসীন-টুদাসীন কিছু না। মিলিটারিতে চাকরি তো করলি না কখনো? বুঝবি কি? যাই হোক, এবার তারা আসছেন। উদ্দালককে জানাতে বারণ করেছে। সুনন্দা। হঠাৎ অবাক করে দিতে চায় তাকে।

আর দাদা বৌদির উপস্থিতিতে উদ্দালকের পাশ করাকে উপলক্ষ করে দিতে চায় বিরাট একটি ভোজ।

গোপন উদ্দেশ্য আরও গভীর। সীমাকে পরিচিত করাতে হবে আরও ব্যাপকভাবে। বন্ধু আত্মীয় দূর কুটুম্ব সকলের কাছে।

কৌতূহলপরবশ হয়ে যারা এসেছে, তারাই শুধু দেখে গেছে, নেমন্তন্ন করে ডেকে এনে সুনন্দা তো এতবড় আনন্দের ভাগ দেয়নি কাউকে? সেই ত্রুটি পূরণ করবে সুনন্দা।

৩. বাড়ির মধ্যে নয়

বাড়ির মধ্যে নয় বাইরে।

চার দেয়ালের মধ্যে নয়, খোলা আকাশের নীচে।

গাড়ি করে কোনও একখানে বেড়াতে যাওয়াটা তো হাতের মধ্যে।

চির-অবোধ সুনন্দা দের টুকরো ছেলেটার ওপর আস্থা রেখে নিশ্চিন্ত আছে। নিশ্চিন্ত আছে ভাই-বোন সম্পর্কের রক্ষাকবচে। বরং এতেই ওর সায়। মেয়েটার মন বসাবার এটাই মুখ্য উপায় বলে মনে করে। এতদিন অন্যত্র থাকা, অন্য পরিবেশে বেড়ে ওঠা মনটা যে সীমার সুনন্দার এই সোনার খাঁচার মধ্যে প্রকৃত স্বস্তি পাচ্ছে না, তা সুনন্দা বুঝতে পারে। বুঝতে পারে, এ ঘরকে এখনো নিজের ঘর বলে ভাবতে পেরে উঠছে না সীমা। সেই না পারার যন্ত্রণা সীমার মুখে চোখে, আচারে আচরণে, প্রত্যেকটি ভঙ্গীতে।

সীমার ঘরের আলমারি, দেরাজ, ওয়ার্ডরোবের চাবির রিং সীমাকে দিয়ে রেখেছে সুনন্দা। তবু সীমা নিজে হাতে করে একটা জিনিসের চাবি খোলে না। শাড়ী বার করে বদলে বদলে পরে না। যা শাড়ী জামা সুনন্দা বার করে আলনায় গুছিয়ে রাখে, তাই পরে চলে। সুনন্দা দেখে, সীমা পর পর তিন দিন একই শাড়ী পরছে। সুনন্দাই অগত্যা আবার শাড়ী জামা বার করে রেখে দেয়, অনুযোগ করে।

অনুযোগ তো সর্বদাই করে।

সীমার সঙ্গে যা কিছু কথা সুনন্দার, সবই তো অনুযোগের কথা।

–টুলু, টয়লেটের জিনিসগুলোর প্যাকই খুলিসনি এখনো? কি মেয়েরে তুই? টুলু, দুধ না কি খাসনি, ফেরৎ দিয়েছিস! দুবেলা একটু একটু করে দুধ না খেলে কী করে চলে বল তো বাছা! শরীরটা একটু না সারলে

..টুলু নিজে নাকি ব্লাউসে সাবান দিয়েছিস? কোথায় আমি যাব রে! এতগুলো লোক থাকতে

টুলুই যদি বলতে হয় তো বলিটুলু এসব কথার উত্তর বড় দেয় না, চুপ করেই থাকে। এক আধ বার হয়তো আস্তে বলে, বরাবর নিজের কাজ নিজে হাতে করার অভ্যাস ছিল, অন্যকে বলতে মনে থাকে না।…হয়তো বলে–জীবনে কখনো দুধ খেয়েছি কি না সন্দেহ, তবু তো দিব্যিই বেঁচে আছি। শরীর আর বেশী সেরে কী হবে?…হয়তো বা বলে–ওসব কৌটো শিশি তুলি বুরুশের ব্যবহারই জানি না মা, খুলে কি করব!

সুনন্দা বলে ওঠে, ও আমার সোনা, শিখে নাও মাণিক!

সুনন্দা আড়ালে চোখ মোছে। সুনন্দার মেয়ে জীবনে দুধ খেয়েছে কিনা সন্দেহ শুনে চোখের জল মুছে শেষ করতে পারে না।

শুধু সুনন্দা যখন বলে–ও টুলু, সারাক্ষণ কেন ঘরের মধ্যে বন্দী হয়ে পড়ে আছিস মা, যা দাদার সঙ্গে একটু বেড়িয়ে আয়–তখন টুলু প্রস্তুত হয়।

যদিও টুলুর দাদা বলে–আচ্ছা পিসিমা, নির্জন কারাগারে বন্দী হয়ে পড়ে থাকারই বা কী দরকার? ঘরে যে অমন চমৎকার রেকর্ড চেঞ্জার রয়েছে, সেটাকে খানিক খাটানো যায় না? ….শুয়ে শুয়ে দুটো গান শুনতেও এত কষ্ট! বলে–তোমার ওই নিধিটিকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েই কি সুখ আছে? হয়তো এমন হাঁড়ি মুখ করে বসে থাকবে, মনে হবে এই মাত্র ব্যাঙ্কফেলের খবর পেয়েছে।

এই সব বলে হাঁক দেয়–নিধি, চলে এসো গাড়ী প্রস্তুত।

এই। এই অবস্থা।

সন্দেহই বা করবে কি করে সুনন্দা?

কি করে ভাববে তারই বাড়িতে তার অলক্ষ্যে এক নতুন নাটক রচিত হচ্ছে। ভাবে না, ভাবতে পারে না।

শুধু নতুন সেই নাটকের নায়ক নায়িকা দুটি ভাবনায় জর্জরিত হতে থাকে।

উদ্দালক আগে বেশি ভাবত না। বলত–নিয়তির হাতে নিজেকে সমর্পণ করে দিয়ে বসে থেকে দেখো না।….কিন্তু ইদানীং সীমার যন্ত্রণা তাকেও চিন্তিত করে তুলেছে।

অদ্ভুত এক যন্ত্রণার জগতে বাস করছে সীমা। একদিকে একখানি ভালবাসার হাত, অপরদিকে একখানি আকুল অস্থির ভালবাসার হৃদয়। নিশ্চিন্তে সেই হাতে হাত রাখবে এমন উপায় নেই। নির্মল চিত্তে সেই হৃদয়ের কাছে ধরা দেয় সে ক্ষমতা নেই।

তা ছাড়াও-যন্ত্রণার আর কোনও কারণ নেই?

যতীন সেন নেই? নেই তার কটুভাষিণী স্ত্রী? বুভুক্ষু ছেলে মেয়ে?

তাদের সঙ্গে কী ব্যবহার করে এসেছে সীমা?

সেদিনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন ধরে ধরে পেরেক বিধতে থাকে সীমাকে। যেন মরচে ধরা একটা অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে কেটে চলে।

সেই কটু কদর্য মুহূর্তগুলোকে যদি ফিরিয়ে নেওয়া যেত! সীমা তাহলে তার মা বাপ ভাই বোন আর পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে একটু সদ্ব্যবহার করে আসত।

সীমা কি আবার যাবে?

গিয়ে আছড়ে পড়ে বলবে, মা গো তুমি কেবল আমার বাইরেটাই দেখলে, ভিতরটা দেখতে পেলে না? মনে ভাবলে কি হবে, বাস্তবে আর একবার যাওয়ার কথা চিন্তাতেও আনতে পারে না। যতীন সেনের সেই কলোনী। সেই কলোনীর বাসা, তার সমস্ত পারিপার্শ্বিকতা যেন একটা ডেলাপাকানো আতঙ্কের মত জমাট হয়ে বসে আছে।

সর্বদা একা থাকতে ইচ্ছে হয় সীমার। একা একা ভাবতে ইচ্ছে হয়, কেমন ছিল সেই পুরানো জীবনটা। সে জীবনে কষ্ট ছিল, অসুবিধে ছিল, অভাব ছিল, দুঃখ ছিল, কিন্তু গ্লানি ছিল কি?

ভাবতে থাকে সীমা।

তা ছিল বৈ কি।

দারিদ্র বস্তুটাই তো গ্লানিকর। সে দারিদ্র যদি চরম পর্যায়ের হয়, গ্লানিটাও চরমই হয়। সেই চরম গ্লানির মধ্যেই কেটেছে প্রায় জীবনের সব দিনগুলো।

সেই গ্লানির ক্লেদ মাখা একটা মেয়েকে দেখতে পায় সীমা।

জরাজীর্ণ একটা ব্লাউস গায়ে, ততোধিক জীর্ণ একখানা বিবর্ণ রঙিন শাড়ী। হাত দুখানা, ফ্যাসানের জন্যে হয়, শুধু অভাবের জন্যেই খালি।

সেই মেয়েটা একটা টিনের চালের ঘরের কাঠের খুঁটিটা ধরে কঠিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

পাড়ার লোকের কাছে ধার চাইতে যেতে পারবে না। অথচ তার অভাবজীর্ণ কটুভাষী বাপ সমানে তর্জন গর্জন চালিয়ে যাচ্ছে সেই কুৎসিত কাজটা করতে যাবার জন্যেই।

ধার চাই। কিছু একটু ধার না পেলে এই নিয়ে তিন বেলা হাঁড়ি চড়বে না। হয় টাকা, নয় চাল, নিয়ে আসুক চেয়ে।

মেয়েটা এতক্ষণ শুধু একভাবে জানিয়ে এসেছে, আমি পারব না, আমার দ্বারা হবে না। এবার এক সময় চড়ে ওঠে। সীমা দেখতে পায় সেই চড়ে ওঠা মেয়েটা চড়া গলাতেই বলে–তা নাই বা চড়লো হাঁড়ি। এই হতভাগা সংসারে হাঁড়ি যদি আর কোনোদিনই না চড়ে, সবকটাতে মিলে যদি না খেয়ে মরা যায়, কী লোকসান হয় পৃথিবীর?

মেয়েটার মা এবার আসরে নামে।

পতির সুয়ো সতী হয়ে বলে,–ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও তুমি ওই আপ্তসারা স্বার্থপর মেয়েকে। তোমার সংসারের মুখ চাইতে ওর দায় পড়েছে। ওর মান মর্যাদাটা বজায় থাকলেই হল।

আবার বাপ কথা বলে ক্ষোভের গলায়–তা বটে! মান মর্যাদা! আর ওই সনৎ বাবুর মেয়েরা! সতীলক্ষ্মী জগদ্ধাত্রীর মত মেয়েরা! বাপের কষ্ট চোখে না দেখতে পেরে নারীধর্মের সারধর্ম ইজ্জৎ বেচে ঘরে পয়সা আনছে।….দশে ধর্মে সবাই জানছে, তবু বলুক দিকি কেউ কিছু? রে রে করে পড়বে সনৎ। বলবে–ভাত দিতে পারো? তাই জাত নিতে এসেছ? বেশ করছে। আমার মেয়েরা। তবু তো সংসারের মুখে দুটো অল্প তুলে দিচ্ছে!

সীমা দেখতে পাচ্ছে, বলতে বলতে লোকটার শীর্ণ মুখটা যেন কেমন একরকম পাশবিক হয়ে উঠছে। কী ভয়ানক একটা লোকসানের আক্ষেপে যেন বিকৃত হয়ে উঠছে। আর সেই মুখে আরও গলা চড়াচ্ছে সে, আমিও বলব সেই কথা। বেশ করছে সনতের মেয়েরা। চাকরী করতে গেলেও তো খাটতে হয়, মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। এও ধরে নাও চাকরী।….ভালভাবে ধরলেই ভাল। চোখের সামনে মা ভাই উপোস করে মরছে দেখে মান ইজ্জত নিয়ে গাট হয়ে বসে থাকার চেয়ে অনেক ভাল।…..কিন্তু আমার ললাটটি? চমৎকার! আমার মেয়ে মাথা হেঁট করে কারো বাড়ি গিয়ে দুটো টাকা কর্জ চাইতে পারেন না।

সীমার চোখের সামনে দিয়ে ঘটে যাচ্ছে ঘটনাটা, সীমা দেখছে মেয়েটা মুখ তুলে লাল লাল চোখ মেলে বলছে,–আনি নি কোনও দিন?

–এনেছ! ঘাড় হেট করে স্বীকার করছি এনেছ? বাপের মাথা কিনে এনেছ দু একবার! তা তাতেই চিরদিন চলবে?

মেয়েটা রুদ্ধ গলায় বলে ধার করে চিরদিন চলে?

–চলে না জানি। তাই তো নিজের গালে রাত দিন সাত জুতো মারছি। আঁকার ওজনে টাকা আনবার ক্ষমতা যদি নিজের থাকত, কোন্ হারামজাদা শালা তোমার মত মেয়ের এতটুকু অনুগ্রহ ভিক্ষে করত!

মেয়েটা এবার কেঁদে ফেলেছে।

কেঁদে ফেলে বলছে, ধার কি কেউ দিতে চায় আর? সক্কলের কাছে নিয়ে নিয়ে রেখেছ, শোধ দাওনা, কে দেবে? এত বড়লোকই বা কে আছে? আমরা কারও বাড়ি গেলেই ভয় খায়, ভাবে ধার চাইতে গেছি।

লোকটার ভঙ্গীটা এবার একটু দুর্বল দুর্বল দেখায়। বলে–তা অভাবের সময় পাড়াপড়শীতে এমন দেখেই থাকে। নইলে আর মানুষ বলেছে কেন? মানুষ বলেই মানুষকে দেখে! আরধার। কি আমি শোধ দেব না বলেছি? দিন এলেই শোধ দেব!

দিন!

মেয়েটা হেসে ওঠে–দিন ফিরে আসবে এ ভরসা তা হলে আছে তোমার বাবা?

বাবা বোধকরি এ প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে যায়। বাবা একটু চুপ করে যায়। হাল ধরে মা। বলে ওঠে,তুমি ইচ্ছে করলেই ফেরে মা! সনৎবাবুর মেয়েদের মত হতে আমি বলছি না! কিন্তু আজকাল তো তাবড় তাবড় নামকরা ঘরের সব মেয়েরা সিনেমায় নামছে, থিয়েটারে নামছে। নিন্দে তো দূরের কথা–মুখোজ্জ্বল হচ্ছে বরং তাদের। তাতে তো কোনও দোষের, দেখি না আমি! দুদিনে সংসারের চেহারা ফিরে যাচ্ছে তাদের।

মেয়েটা হঠাৎ ঘাড় তুলে বলে ওঠে, বেশ, তাই করব আমি। ঢুকিয়ে দাও আমায় কোনখানে।

–আমি? আমি দেব ঢুকিয়ে?

মা ঠিকরে ঘরে ঢুকে যায়। ঘরের মধ্যে থেকে বলে ওঠে–সে পথ যদি জানা থাকত, সে দরজা যদি চেনা থাকত, তাহলে কি আর তোমার খোসামোদ করতে যেতাম মা? নিজেই যেতাম। ঝিয়ের পার্টেরও তো দরকার হয়!

সীমা দেখছে, সমগ্ৰ সংসারটা যেন প্রবল একটা আক্রোশের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওই মেয়েটার দিকে।

কেন!

হয়তো ভয়ানক একটা আশাভঙ্গের আশঙ্কায়। অনেকদিন ধরে তাকিয়েছিল তারা সংসারের এই বড় হয়ে ওঠা মেয়েটার দিকে। আশা করছিল ও ওর কর্তব্য করবে। দায়িত্বটা নিজের হাতে তুলে নেবে।

কিন্তু যেমন ভাবছিল তেমন হচ্ছে না।

ও একটা কর্পোরেশন স্কুলের মাস্টারী করে, সব কর্তব্য সারা হল ভেবে আত্মপ্রসাদ অনুভব করছে!

অথচ একটা যুবতী মেয়েকে দিয়ে কী না হতে পারে!

.

সীমা দেখতে পাচ্ছে, সেই মেয়েটা মাথা হেঁট করে পাড়ার একজনদের বাড়িতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের বাড়ির আধবুড়ো কর্তাকে বলছে–আপনি তো স্টুডিওতে যাওয়া আসা করেন জগবন্ধু কাকা, আমাকে একবার ইনট্রোডিউস করিয়ে দিতে পারেন না?

জগবন্ধু কাকা হতাশ গলায় উত্তর দেন–আমি! আমি আর কী পদের কাজ করি মা, আমার তো কাজ ড্রেস সাপ্লাই। আমার কি সাধ্য

বেশ আমাকে শুধু একদিন নিয়েই চলুন, যা বলবার আমি নিজেই বলব।

–যেতে চাও সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি–জগবন্ধুকাকা আরও নিরুৎসাহের বাণী ঘোষণা করেন গিয়ে দেখবে গাদা গাদা উমেদার বসে আছে। কর্তারা কেউ তাদের দিকে তাকিয়েও দেখছেন না। পায়ে পায়ে ঘুরছে, এখন সময় নেই বলে ভাগাচ্ছেন।….দেখেছি তো চোখের সামনে।

তবু সেই নিরুৎসাহী ব্যক্তির স্কন্ধে চেপেই গিয়েছে মেয়েটা। একদিন নয়, দিনের পর দিন। কেউ কথা বলেনি। কেউ তাকিয়ে দেখেনি।

বাস ভাড়া দেবার ক্ষমতা নেই, পাড়ার কাকা আর কদিন বাস ভাড়া দেবে?

.

এমনি এক ভয়ঙ্কর সময়ে এলো ব্ৰজ উকিলের প্রস্তাব। যতীন সেনের মামার এককালের সহপাঠী।

মেয়েটা হাতে চাঁদ পেল।

ভাবল, তার একান্ত আকুলতায় ঈশ্বর মুখ তুলে চাইলেন। ভাবল, অভিনয়ে নামতেই তো চেয়েছিলাম, তার সুযোগ পাচ্ছি। এর থেকে পবিত্র শুচিস্নিগ্ধ অভিনয় আর কি হতে পারে? প্রেমের অভিনয় নয়, নয় কুটিলা নায়িকার অভিনয়। একটি সন্তানহারা মায়ের কাছে সন্তান হয়ে থাকা!

গ্লানিহীন সুন্দর! তখন তাই ভেবেছিল সীমা।

ভাবেনি, সেই সহজ অভিনয়টা এতখানি মারাত্মক হয়ে উঠবে। সীমার যদি হৃদয় বলে কোনও বস্তু না থাকত, না থাকত বিবেক বলে কোনও জিনিস, তা হলে তার অঙ্কটা নির্ভুল হত।

কিন্তু সাজানো সংখ্যার মধ্যে বাড়তি ওই দুটো সংখ্যা এসে পড়ল, হৃদয় আর বিবেক! এলোমেলো হয়ে গেল সব অঙ্ক!

তাই এই খোলা আকাশের নীচে, এলোমলো বসন্ত হাওয়ার মাঝখানে একান্ত প্রিয়তমের হাতে হাত রাখতেও মন গুটিয়ে আসছে সীমার। কে যেন মুঠোয় চেপে ধরে রয়েছে ওর সমস্ত সত্তাকে!

হাতে হাত রাখে না। উভ্রান্ত গলায় বলে ওঠে–আমি আর পারছি না! আমি আজই বলব। তারপর যা হয় তোক।

উদ্দালক মৃদুস্বরে বলে–কিন্তু জানো বোধহয়, পিসিমা একটা ঘটনার আয়োজনে মেতেছেন। কী অসম্ভব উৎসাহে তার তোড়জোড় করছেন। তুমি লক্ষ্য করোনি হয়তো, কিন্তু আমি তো করেছি!..টাকার পাহাড়ের ওপর বসে আছেন মানুষটা, জীবনে কখনো একটা উৎসব করতে পাননি, বাড়িতে কাউকে একমুঠো খেতে ডাকতে পাননি। সেই রুদ্ধ আবেগকে বাঁধ ছেড়ে দিয়ে খুব একটা আহ্লাদ নিয়ে মেতেছেন, এসময় এতবড় একটা শক্‌

সীমা ম্লান বিষণ্ণ স্বরে বলে,–শক তো উনি সব সময়ই পাবেন উদ্দালক! এ বরং ভালই হবে যে, অতটা আনন্দের পর হঠাৎ যবনিকা পতনের কষ্টটা সইতে হবে না। তাছাড়া অনেক লোক আসবে বলছ, ধর যদি কেউ চিনে ফেলে? যদি সেই সভার মধ্যে হাটে হাঁড়ি ভেঙে যায়?

এ সম্ভাবনা যে উদ্দালকের মনের মধ্যে আসেনি তা নয়, তবে তার উত্তরটাও ভেবে রেখেছে সে। সেই উত্তরটাই বলে–ভাঙবে না কিছুই। এতদিন যে তুমি কোনও একখানে কারুর একজনের মেয়ের পরিচয়ে ছিলে, সে কথা তো জানেন পিসিমা! কেউ যদি হাঁড়ি ভাঙতে আসে, নতুন কোনও লোকসান ঘটাতে পারবে না!

–অনেক লোকের সামনে দাঁড়াতে হবে ভেবে এখন থেকেই অস্থির হয়ে যাচ্ছি আমি উদ্দালক!

–কিন্তু সীমা, তুমি তো বলেছ, এক সময় সিনেমা থিয়েটারে নামবার জন্যেও মরীয়া হয়ে উঠেছিলে তুমি। মনে কর না এটা তোমার সেই মঞ্চ! হাজার হাজার দর্শকের সামনে পড়েও ঘাবড়াবে না।

–সে অভিনয়ের সঙ্গে কি প্রাণের কোনও যোগ থাকে উদ্দালক?

–জানি,–উদ্দালক বলে–বুঝতে পারছি তোমার অসুবিধে, কিন্তু তবুও তোমায় মিনতি করছি, পিসিমার এই আহ্বাদটায় বাধা দিও না। তারপর একটা প্ল্যান আমার মাথায় এসেছে

–আর প্ল্যানের কথা শুনতে ইচ্ছে নেই উদ্দালক!

–আহা শোনই না মন দিয়ে। এতে হয়তো দুদিক রক্ষে হতে পারে। মানে হবেই।…এই উৎসবে তো আমার মা আসছেন? আমি ঠিক করেছি মার কাছে সব খুলে বলব। আর একথাও বলব–উদ্দালক মোহন একটু হাস্য করে–একথাও বলব–এই মেঘবরণ-কেশ কন্যাটিকে না পেলে আমার চলবেই না। অতএব–অতএবটা কি জানো? মাকে দিয়ে আস্তে আস্তে পিসিমাকে বলাব–ব্যাপারটা একটা ধাপ্পাই, তবে তুমি এর মধ্যে নেই। আসল নায়ক ওই ব্ৰজ উকিল, পার্শ্বনায়ক তোমার বাবা। আর তোমার বাবা যদি বলেন তুমি তার নিজের মেয়ে নও, পালিতা কন্যা, তোমার কি উপায় আছে তার সত্য মিথ্যা যাচাই করবার? তোমার ছোট ভাই বোনেরা ইনোসেন্ট, তুমিও তাই। এরপর আর তোমার আমার মধ্যে ব্যবধান কি?

–থামো উদ্দালক–সীমা ক্লান্ত গলায় বলে, এতবড় একটা মিথ্যের ওপর জীবনটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব না। তার থেকে ধুলোয় লুটিয়ে যাক অপ্রতিষ্ঠিত অপরাধীর জীবন!

উদ্দালক গভীর কণ্ঠে বলে–তাকাও আমার দিকে! এবার জবাব দাও! বল–অপরাধীর জীবনের জন্যে না হয় ধূলোয় লুটোনোর ব্যবস্থা, কিন্তু নিরপরাধীর জীবনের জন্যে ব্যবস্থাটা কি? বল?

উদ্দালক! সীমা বেঞ্চটায় বসে পড়ে বলে–উদ্দালক, সব জেনেও আমায় ঘৃণা করছ না কেন? কেন তোমার মন ফিরিয়ে নিচ্ছ না?

উদ্দালক তেমনি গভীর স্বরেই বলে–দেখ সীমা, বেশ গুছিয়ে টুছিয়ে কথা আমি বলতে পারি না, কাজেই এলোমেলো করেই বলছি–মন বস্তুটা কি ফিরিয়ে নেবার? ইচ্ছে করলেই ফিরিয়ে নেওয়া যায়? তাছাড়া–সব জেনে ফেলার পরই তো মনটা ছুটে এগিয়ে গেল! ঘৃণা করবার সময় পেল কোথায়? শ্রদ্ধায় বিগলিত হয়েই তো–নাঃ বড্ড নাটুকে নাটুকে হয়ে যাচ্ছে কথাবার্তা!…মোটকথা, আমি তোমার ওসব নীতি দুর্নীতি বুঝি না, আমার প্রথম কথা, শেষ কথা, এবং একটাই মাত্র কথা, তোমাকে হারানো আমার চলবে না! লাভ করতেই হবে। তা সে ছলে বলে কৌশলে যে করেই হোক!…সাপ না মরুক লাঠিটা ভাঙবই–এ গোঁয়ার্তুমিতে দরকার কি? উল্টোটা যদি হয় সেটাই তো ভাল!

–কিন্তু উদ্দালক, মন বলে তো একটা বস্তু আছে আমার?

উদ্দালক এবার হাসে।

মৃদু হাসির সঙ্গেই বলে-উঁহু সেটা আর তোমার নেই, সেটা আমার সম্পত্তি হয়ে গেছে!

আরও খানিকক্ষণ বসে থাকে ওরা, আর শেষ পর্যন্ত উদ্দালকের মতেই মত দিতে হয় সীমাকে। অন্তত সুনন্দার এই উৎসবের আয়োজনটি সার্থক সুন্দর হতে দেবে সীমা।

হতে দেবে যতদূর সম্ভব নিপুণ অভিনয় করে।

তারপর?

মুখ দেখাবার মুখ যদি না থাকে, মুখ তো দেখাবে না সীমা। এই লাঞ্ছিত মুখটা নিয়ে তলিয়ে যাবে অন্ধকারের অতলতায়।

উদ্দালক বলে–যেতে দিলে তো!

এরপর ফিরে আসে দুজনে গাড়িতে। আর তখনই ভাবতে থাকে সীমা…আমি কি শুধু উদ্দালকের অনুরোধ রাখতেই ফিরে এলাম? আমার মধ্যে কি আর কোনও কিছু কাজ করছে না? রায় বাড়ির উঁচু লোহার গেটের মধ্যে ফিরে না যেতে চাইলেই যে আমাকে সেই কলোনীর যতীন সেনের দাওয়ার ধারে গিয়ে দাঁড়াতে হবে, অবচেতনায় কি সেই স্পষ্ট বাস্তবটা দাঁত খিঁচিয়ে বসে নেই?

তারপর সেখানে আর এখানে কত ধূলোর ঝড় উঠবে, কত পঙ্কিল আবর্তের সৃষ্টি হবে সেই সত্যভাষিণী সীমাকে ঘিরে, সে কথাও কি জানছে না সীমার মনের ভিতরের মন!

ভাবতে ভাবতেই বাড়িতে এসে পৌঁছে যায়।

আর সেই উঁচু লোহার গেটটা পার হয়ে বারান্দার মার্বেল পাথরের সিঁড়িতে পা রাখতেই অজান্তে একটা স্বস্তির নিশ্বাস পড়ে সীমার।

এ বাড়িতে এসে পর্যন্ত একদিনের জন্যও তো স্বস্তি পায়নি সীমা, একবারের জন্যেও যথার্থ আশ্রয় বলে ভাবতে পারেনি, তবু আজ এই ছেড়ে চলে যাবার দৃঢ়সংকল্পের মুখে হঠাৎ যেন ভারী একটা স্বস্তির আশ্রয়ে এস পড়ার শাস্তি অনুভব করে সীমা!

যেন বাঁচল!

যেন বহু দুর্গতির ঝড় থেকে সরে জানলা দরজা লাগানো ঘরের মধ্যে এসে বসল।

.

বেরোবার মুখে সুনন্দা দুএকটা জিনিসের ফরমাস করেছিলেন। বলেছিলেন–ফেরার সময় কিনে আনিস তোরা।

সেই ফরমাসটা মনে পড়ল বাড়ি ফিরে।

উদ্দালক বলল–ওই যাঃ পিসিমার ঠাকুরের অগুরু আর চন্দন কাঠ আনা হল না!

সীমা দাঁড়িয়ে পড়ে বলে–এখন মনে পড়ল? যাকগে আবার বেরিয়ে পড়, গ্যারেজ তো বন্ধ হয়নি এখনও।

গ্যারেজ বন্ধ হয়নি, দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে–উদ্দালক হাতের ঘড়িটা দেখে নিয়ে বলে–রাত নটা তো বাজে প্রায়।

সীতা হতাশ গলায় বলে–এত দেরী করলে তুমি! এখন ওঁকে কি করে যে মুখ দেখাব।

ওঁকে না বলে মাকে বললেও পায়রা সীমা–উদ্দালক বলে–মা বলাটা আর এত কি শক্ত? সকলকেই তো বলা যায়!

উদ্দালকের গলায় দুঃখের সুর।

সীমা লজ্জিত হয়। আর বোধকরি লজ্জা ঢাকতেই হঠাৎ এক বেস কথা বলে বসে।

বলে–এরপর আবার তো মা বদলে পিসিমা ডাকবার হুকুম হবে! বলেই মরমে মরে যায়।

ছি ছি, বেহায়ার মত এ কী বলে বসল সে! এতক্ষণ ধরে সকলের সঙ্গে সম্পর্কছেদ করে চলে যাবার সংকল্প ঘোষণা করছিল বসে বসে উদ্দালকের কাছে?

উদ্দালক আর সীমা করিডোেরটার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

একটু দাঁড়িয়ে পড়ে উদ্দালক। সীমার বিপর্যস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে। মৃদু হেসে বলে–হুঁকুম আরও কতরকম হবে। সহজে পার পাবে না কি?

.

দুজনে একসঙ্গে সুনন্দার সামনে দাঁড়াবে এ সাহস হয় না সীমার, তাই পাশ কাটিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। উদ্দালক প্রমাদ গণে।

এই দৃশ্যটা শোভন হল না।

যতই সরল আর নির্মলচিত্ত হোন সুনন্দা, সীমার ওই চোরের মত ঝপ করে ঘরে ঢুকে যাওয়াটা নিশ্চয় তারও চোখে কটু ঠেকবে। ভাইবোন সম্পর্কটাকে যতই বড় করে তুলে ধরুন সুনন্দা, সত্যিই তো এক্ষেত্রে তত বড় নয়। একে তো মামাতো পিসতুতো ভাইবোনের স্নেহ প্রীতির বাড়াবাড়িটা তত উদারচক্ষে দেখতে পারে না লোকে, তার ওপর এ আবার সাতজন্মের অজানা অচেনা।

বেশি উদার দৃষ্টিতে কে দেখবে?

হারানো মেয়ে খুঁজে পেয়ে সুনন্দা তাকে বুকে ধরবেন বলে যে, সুনন্দার ভাইপোকেও তাই। ধরতে দেবেন, এ তো আর হতে পারে না!

সন্দেহের চোখে দেখতে পারেন সুনন্দা।

অতএব উদ্দালককেই চেষ্টা করতে হয়–আবহাওয়াকে সহজ রাখবার। চেঁচিয়ে বলতে হয়, তাড়াতাড়ি বদ্ধ ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়বার দরকার নেই টুলু, বাইরে এসে হাওয়ায় বোস। বরং একটা সারিডন খা।

সুনন্দা চমকে ওঠে।

সুনন্দা কাতর গলায় বলে–কেন মাথা ধরল না কি?

–মাথা তো তোমার কন্যার ধরেই আছে পিসিমা! দামী মাথা! সেই থেকে বলছি টুল বাড়ি চল ঠাণ্ডা লাগছে, তা নয় বাবু গঙ্গার ধারে বসে হাওয়া খাচ্ছেন! খাও হাওয়া!

–এই দেখ কাণ্ড!

সুনন্দা উদ্বিগ্ন হয়ে সীমার ঘরে এসে ঢোকে।

না, সীমা এখন আর আড়ষ্ট হবে না। সীমা উদ্দালকের ওই সামলে নেবার অলৌকিক ক্ষমতা দর্শনে স্তম্ভিত হয়ে গেছে, লজ্জিত হয়ে উঠেছে। নিজেকে সামলে নেবার শক্তি খুঁজে পাচ্ছে।

তাই সহজ ভাবে বলে ওঠে–কেন শোনেন মা ওর কথা? বাজে কথার রাজা! মোটেই মাথা ধরেনি আমার। ভাল শাড়িটা বদলাবো বলে তাড়াতাড়ি

মা! মা!

সীমার মুখে এমন সহজ কথা! সীমার মুখে একসঙ্গে এতগুলো কথা!

সুনন্দা যেন বর্তে যায়, ধন্য হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি চেঁচিয়ে বলে–হ্যাঁরে দুলু, কী ছেলে রে তুই! শুধু-শুধু কি না–আর হারে টুলু, ভাল শাড়ি বলে তাড়াতাড়ি বদলাবার কী দরকার রে? আমি দেখি না একটু ভাল শাড়ি পরা মূর্তিটা! কত ভাল ভাল শাড়ি আলমারিতে পচছে, তুই আবার শাড়ি বাঁচাতে বসছিস! রাতদিন ভাল ভাল পরে বেড়াস তুই, এই আমার ইচ্ছে।

সীমা একটু হেসে বলে–মায়া লাগে! দুটো ভিন্ন তিনটে শাড়ি একসঙ্গে পরিনি কখনো, সহ্য হয় না।

সুনন্দা একটু থতমত খায়।

তারপর সামলে নিয়ে বলে–সেই জন্যেই তো আরও বেশি করে সব পরবি, খাবি, খরচ করবি। এতদিনের শোধ তুলবি। তা হ্যাঁ রে টুলু, মনে কিছু না করিস তো একটা কথা বলি–যাঁরা এতদিন তোকে দেখাশুনা করেছেন, তারা তো তেমন অবস্থাপন্ন নন শুনেছি, তা তুই যদি চুপিচুপি তাদের হাতে কিছু দিস, নেবেন না?

সীমা চমকে ওঠে।

সুনন্দা যে হঠাৎ এমন একটা কথা বলে বসবে সেটা তার ধারণার মধ্যে ছিল না। সহজ ভাবটা তবে আর সহজে বজায় রাখে কি করে বেচারী?

আস্তে বলে–হঠাৎ একথা কেন বলছেন?

-না না, অন্য কিছু ভেবে বলিনি রে–সুনন্দা ব্যস্ত হয়ে ওঠে–মানে এতকাল যাকে মা বলে ডেকেছিস, তার প্রতিও তো একটা কর্তব্য আছে? ওই যে দুটো বৈ তিনটে শাড়ী না থাকার কথা বলছিস, তা তাঁর তো সে অবস্থা রয়েই গেল? তোর এত হল, তুই তাকে

সীমা উত্তর দেয় না, মাথা হেঁট করে।

হেঁট করে, হয়তো উত্তর দেবার ক্ষমতা থাকে না বলেই।

সুনন্দা মৌনং সম্মতি লক্ষণং ধরে নিয়ে মহোৎসাহে বলে–ধর তুই জোড়া দশেক শাড়ী, দু। ডজন সায়া-ব্লাউস, অনেক করে তেল সাবান স্নো পাউডার

সীমা হেসে ফেলে বলে–স্নো পাউডার?

–আহা না হয় তা না হল, আরও যা সব দরকারি জিনিস আছে, অনেক করে কিনে নিয়ে তুই একদিন–মানে তুই উপহার দিলে অবিশ্যিই নেবেন।

সীমার চোখে এবার জল আসে।

কী নির্মল মন! কী পবিত্র দৃষ্টি! আর কী বিশ্বাসী হৃদয়!

উনি সেই অবধি ধরেই থেকেছেন সীমার পূর্বজীবনের মা বাপ গরীব বলেই বড় বেশি আত্মসম্মান জ্ঞান তাদের। অথচ তাদের সাহায্য করতে ইচ্ছে এঁর হৃদয় উজাড় করে!

এই মানুষকে ঠকাতে এসেছে সীমা। ঠকাচ্ছে, ঠকিয়ে চলেছে।

শুধু কি হারানো মেয়ে সেজেই ঠকাচ্ছে? উদ্দালকের সঙ্গে গোপন এক সম্পর্ক গড়ে, চাতুরীর জোরে চাপা দিয়ে রাখছে না? প্রতিনিয়ত ঠকিয়েই চলেছে এঁকে সীমা!

.

সুনন্দা দেখে সীমার চোখে জল।

ভাবে, তাদের জন্যে মনটা এখনো পুড়ছে মেয়েটার। তাহলে বলতেই হবে মায়ার প্রাণ!

হবে বৈ কি। হবে না? কেমন মানুষের মেয়ে! কী মায়ার প্রাণই ছিল তার! স্বামীর কথা স্মরণ করে বুকটা ব্যথায় টনটনিয়ে ওঠে সুনন্দার। দেখতে পেলেন না। শূন্যপুরী পূর্ণ হয়ে ওঠা দেখতে পেলেন না।

তারপর ভাবে, আমার মত হয়নি, তার মত হয়েছে মেয়েটা, মায়া মমতায়-ভরা বুক, কিন্তু চাপা।

যেখানে যে পরিবারেই মানুষ হোক, মূল কাঠামোর গুণ যাবে কোথায়? আচ্ছা, এই সব জিনিসপত্র কিনে গোছ করে একদিন পাঠিয়ে দেব সীমাকে, দিয়ে আসবে। আগে ভেবেছিলাম ওদের সঙ্গে আদৌ আর মেলামেশা না করা, এখন মনে হচ্ছে সেটা ভুল হবে। জোর করে কিছু সুফল হয় না। কোনও ক্ষেত্রেই না। নিজে থেকেই হবে। আস্তে আস্তেসহজে। যেমন করে বাপের বাড়ির মেয়ের মন বসে শ্বশুরবাড়িতে।

সে ক্ষেত্রেও তো বড় হয়ে যাওয়া মেয়েই। তবু প্রথমটা তারা শ্বশুরবাড়ি আসতে কাঁদে, পরে বাপেরবাড়ি যাবার সময় পায় না।

সুনন্দা হাসে একটু মনে মনে–তবে তারা একটা বাড়তি পায়, বর। একেও বর দিতে হবে একটা তাড়াতাড়ি। তারপর সুনন্দা সেই নবীন যুগলকে নিয়ে….ভগবান এত দুঃখের পর এত সুখও লিখেছিলে সুনন্দার জন্যে!

মেয়েটা মুখটা শুকিয়ে বসে আছে।

এবার অন্য প্রসঙ্গে আসে সুনন্দা। ….দুলু, আমার ধূপ চন্দন কাঠ?

দুলু সাড়া দেয়।

ধূপ চন্দন কাঠ? জিগ্যেস কর তোমার আদরের মেয়েকে। রাত নটা বাজিয়ে দিলেন গঙ্গার ধারে বসে। দোকানদাররা যেন দরজা খুলে বসে থাকবে ওর জন্যে!

সুনন্দা ব্যস্ত হয়ে বলে-থাক বাপু, আমার কিছু আর অচল হচ্ছে না ওর জন্যে। কাল আনলেই হবে!

তারপর বোধকরি সীমাকে উৎসাহ দিতেই সুরু করে সুনন্দা, আগামী উৎসবের আলোচনা।

–তোকে এবার মামা মামী দেখাব, বুঝলি টুলু। দেখিস কী মানুষ! বৌদি তো ভালই, তবে দাদার তুলনাই হয় না। আমার যে যেখানে আছে সবাইকে আমি নেমন্তন্ন করব দুলুর পাশকরা উপলক্ষে।

উদ্দালক কটাক্ষপাত করে সীমার দিকে, বলা বাহুল্য উৎসাহের লেশ দেখে না সেখানে। তাড়াতাড়ি আবহাওয়া সরস করে নেবার চেষ্টা করে,–উপলক্ষ! শুনে রাখ টুলু, নট লক্ষ্য। লক্ষ্যটি কে বুঝতেই পারা যাচ্ছে। ভাল ভাল! কিন্তু পিসিমা, খাওয়া দাওয়ার দিকে একটু লক্ষ্য করলে ভাল হত না এবার?

এই একটা প্রসঙ্গ, যে প্রসঙ্গ তুললে সুনন্দা গুরু ইষ্ট ভুলে যায়। খিদে পেয়েছে কারও একথা শুনলেই সুনন্দা ষাট ষাট করে ছুটে যায় তার ব্যবস্থায়।

গেল।

টুলু উদ্দালকের দিকে তাকাল।

টুলু আস্তে বলল,–ওই সবের আগেই আমি পালাব!

উদ্দালক গভীর দৃষ্টিতে তাকায়।

— গলা নামিয়ে বলে তাহলে আমাকেও পালাতে হবে।

–তোমাকে?

-হ্যাঁ! না-তো কি? ফিরিয়ে আনবার সাধনা করতে খুঁজে ফিরতে হবে!

সীমা মাথা নীচু করে।

সীমা এই পরম ঐশ্বর্যকে হেলায় ত্যাগ করে চলে যাবে, কলোনীর যতীন সেনের কাছে গিয়ে আশ্রয় চাইবে?

.

এমনি দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে চলে দিন। এগিয়ে আসে সেই দিন।

ভোরবেলা উদ্দালককে ডেকে তোলে সুনন্দা-ওরে গাড়ি নিয়ে স্টেশনে যেতে হবে যে? উদ্দালক পাশ ফিরে বলে–তার এখনো তিন ঘণ্টা দেরী। সাড়ে আটটায় গাড়ি আসবে।

-দেখো মুশকিল, সাড়ে আটটা কোথা? ব্রজবাবু যে বললেন আটটা সাতাশ মিনিটে এসে ইন করবে।

–আটটা সাতাশ! ব্রজবাবু বলেছেন?

হেসে ওঠে উদ্দালক–মানতেই হবে ব্রজবাবুর থেকে অনেক বেশি গাঁইয়া আমি। সেকেন্ড মিনিট দিয়ে সময়ের হিসেব করতে শিখিনি, শুধু ঘণ্টাই জানি। কিন্তু এখন আমি কিছুতেই উঠব না। কেটে ফেললেও না। আটটা সাতাশে স্টেশনে যেতে হবে বলে, পাঁচটা পঁচিশ থেকে তোড় জোড় করতে পারব না আমি।

–অভদ্র ছেলে! তোর না নিজের মা বাপ!

–তাকে কি! নিজের পরের তফাৎ কিছু নেই আমার! তোমার মা বাবা স্টেশনে এলেও ঠিক একই ব্যবহার করতাম আমি।

–আমার মা বাপ?

সুনন্দা গালে হাত দেয়। বলে–মনেও বা পড়ল তোর। জীবনে দেখিস নি তাদের

–তাতে কি, ছিলেন তো? সেটা তো অস্বীকার করা যায় না?

বলতে বলতে উঠেই বসে। বলেনাঃ মৌজের ঘুমটাই নষ্ট করে দিলে! আর শুয়ে কি হবে?

সুনন্দা হাসতে হাসতে চলে যায়।

উদ্দালক ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ায়, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই বারান্দার ওপ্রান্তে এসে দাঁড়ায় আর একটা মানুষ।

সদ্য ঘুম ভাঙা চোখে পূবের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে সে। উদ্দলককে দেখতে পায়নি।

উদ্দালক দূরে থেকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ, তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়।

সীমা চমকে ওঠে। সীমা চোখ তুলে তাকায়। মৃদুস্বরে বলে–এক্ষুণি উঠেছ যে?

উদ্দালক আজ আর হেসে উঠে উত্তর দেয় না। গভীর দৃষ্টি মেলে বলে,–সে কথা তো আমিও জিগ্যেস করতে পারি।

–আমি রোজই এ সময় উঠি। আরও আগেই উঠি। বেশি ভোরে ঘর থেকে বেরোতে অস্বস্তি হয় তাই

উদ্দালক তেমনি স্বরেই বলে–খানিকটা ঘুমের আরামের জন্যে রোজ কতটা করে লোকসান ঘটিয়েছি তাই ভেবে আপশোষ হচ্ছে।

–লোকসান? কিসের লোকসান?

–এই দৃশ্যটির! তুমি এসে পূব আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে, মনে হল যেন-কোন শিল্পীর আঁকা ছবি!

-ঠাট্টা করা হচ্ছে?

–ঠাট্টা নয় সীমা সত্যিই!

–ছবির মত দেখতে বলে কোনও অহঙ্কার তো কোনদিন ছিল না,সীমা মৃদু হেসে বলে–হঠাৎ কি করে ভাবি ঠাট্টা নয়, সত্যি?

তুমি ছবির মত দেখতে, একথা তো বলিনি। বলেছি–দৃশ্যটা যেন শিল্পীর আঁকা ছবি! ভুল নয় সেটা। মহাশিল্পীর হাতের ছাপ পড়েছে এখানে। ওই পূব আকাশ, এই ভোরের রং। এই স্নিগ্ধ শান্তিবহা বাতাস

–ওমা আবার এখন গল্প করতে বসলি?

পিছন থেকে সুনন্দার স্বর শোনা যায়। স্নান সেরে এসে পূজো করতে যাচ্ছে। শাদা গরদের থান, হাতে ফুলে ভর্তি সাজি।

না, সন্দেহের গলায় অভিযোগ করে ওঠেনি সুনন্দা, সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় নি। শুধু ব্যস্ততার ছাপ তার চোখে মুখে।

উদ্দালক একটু হেসে বলে–পিসিমা, একটা কথা বোধ হয় ভুলেই গেছ?

–কি ভুলে গেছি?

–তোমার দাদাটির শৈশব পার হয়ে গেছে, এবং হাওড়া স্টেশনে এসে ট্রেন থেমে পড়ে, ছুটে পালায় না?

–শোনো কথা আমি যেন তাই বলছি। মুখ ধুবি, চা খাবি, কাজ নেই বুঝি? টুলু সাজবে টাজবে

উদ্দালক এবার জোর হেসে উঠে বলে–সাজবে? বিয়ে না কি?

–আহা সাজবে মানে, ইয়ে একটু পরিষ্কার টরিষ্কার হবে তো? মামা মামী এই প্রথম দেখবে।…টুলু তুই তোর সেই হালকা নীল রঙের নাইলন শাড়িটা পরে নিস কেমন? আর সেই সোনালী বুটি-ব্লাউসটা

–আর তোর সেই হীরের মুকুটটাউদ্দালক বলে–মুক্তোর মালাটা, পান্নার দুলটা

-থাম বাছা, সকাল বেলা খালি কাজ পণ্ড! ঠিক সময় স্টেশনে যাবি, এই বলে দিয়ে চললাম পূজোর ঘরে।

সেই দিকে তাকিয়ে সীমা নিশ্বাস ফেলে বলে–উনি যদি এত ভাল না হতেন, হয়তো আমার কাজ অনেক সোজা হত।

.

খানিক পরে বেরিয়ে যায় উদ্দালক গাড়ি নিয়ে।

খানিক পরে এসে পড়েন উদ্দালকের মা মামা। এসে পড়ে তাদের ছোট তিনটি ছেলে মেয়ে।

দাদা দাদা করে অস্থির করে তারা উদ্দালককে।

সুনন্দা বলে,–চল এবার দিদি দেখবি। দাদা তো দেখা, দিদি নতুন।

.

এতদিন ধরে মনের মধ্যে এমনি কত চিন্তাই চলছিল সুনন্দার।

কেমন করে পরিচয় করাবে টুলুর সঙ্গে সকলের, কেমন করে সবাইকে দেখাবে তার ফিরে পাওয়া হারানো নিধিকে। তারপর উৎসবের স্রোত ববে।

তলায় তলায় আয়োজন করিয়েছে গানের, বাজনার, ম্যাজিকের।

সন্ধ্যার দিকে আসবে তারা।

খাওয়া দাওয়ার আয়োজনের অবসরে চলবে এই চিত্ত বিনোদনের পালা।

দীর্ঘকালের শোকভারাক্রান্ত মন, যেন সেই ভার ফেলে দিয়ে পুতুল খেলায় মেতে উঠেছে।

কিন্তু অন্য আর এক জায়গায় চলছিল না কি আর এক খেলা? হ্যাঁ চলছিল যতীন সেন আর ব্রজ উকিলের মধ্যে।

তাদের সম্পর্কটা মনোমালিন্যের–ওঠা পড়ার কোঠা থেকে ক্রমশ গিয়ে পড়েছে পরম শত্রুতার পর্যায়ে। তাই মনে মনে চরম পথ বেছে নিয়েছে কাণ্ডজ্ঞানহীন গোঁয়ারগোবিন্দ যতীন সেন। অনেক আশার স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে তার।

বড় আশা ছিল ওই গিন্নীটার কাছে মায়া কাড়িয়ে ছলে কৌশলে অবিরত টাকাকড়ি জিনিসপত্র আদায় করে লুকিয়ে লুকিয়ে পাচার করবে সীমা, ঢেলে দিয়ে যাবে তার অভাবগ্রস্ত বাপের সংসারে, নয় একদিন এসে মা বাপকে যাচ্ছেতাই শুনিয়ে দিয়ে গিয়ে নিজে রাজকন্যা হয়ে রাজসুখ করতে লাগলি? মেয়ে না পিশাচী?…অবস্থাটি কেমন? সোনার খাটে গা, রূপোর খাটে পা, রাতদিন হাওয়াগাড়ি চড়ে হাওয়া খাচ্ছেন।…আবার সঙ্গে নাকি সেই বজ্জাত ছোঁড়াটা লেগে থাকে। গিন্নী না হয় জানেন সম্পর্কটা ভাই-বোন। তুই হারামজাদী তো জানিস সব? তার মানে ছোঁড়াটার সঙ্গে ল করছিস তুই।

যত ভেবেছে, আর জ্বলে পুড়ে মরেছে যতীন সেন, অবশেষে একদিন ঘোষণা করলে তীব্র সংকল্প।

–ঠিক আছে, মরি মরব মেরে মরব। আমি ব্যাটা যে ভিখিরি সেই ভিখিরি থাকলাম, কন্যে আমার গিয়ে রাজসুখ করবেন? অসহ্য! প্রকাশ করে দেব সব ষড়যন্ত্র। ফাঁস করে দেব সব জালিয়াতি।

যতীন গিন্নী ভয়ার্ত গলায় বলে–তা ফাস করতে গেলে তো নিজেও ফসবে গো! হাতে দড়ি পড়বে!

পড়ুক! তার সঙ্গে ওই হারামজাদীরও পড়বে। নাবালিকা নয় যে, বলবে বোঝেনি, ভুলিয়ে ওকে দিয়ে করিয়েছে লোকে!

–ভেবে দেখ ভাল করে বাপু,

–দেখেছি ভেবে। অনেক ভেবেছি।

-আমি ভাবছি একে তো দুঃখের দশা, আবার ইচ্ছে করে থানা পুলিসের হাতে পড়তে যাবে? এগুলো যে না খেয়ে মরবে!

–মরবে না! এই আমি হতভাগা বিদেয় হলেই দেখবে পাড়ার লোকেরা এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে সাহায্য করতে

–হ্যাঁ পাড়ার লোক কত মহৎ!

হবে মহৎ!

যতীন সেন কুটিল হাসি হেসে বলে,–গার্জেনহীন বাড়িতে রূপসী তরুণী থাকলে পাড়ার লোক মহৎ হয়। তোমার বড়মেয়ের তো রূপের বালাই নেই, এটা তো সুন্দরী।

কথাটা অবশ্য সুন্দরী মেয়ের মার খুব ভাল লাগে না। বিরক্ত গলায় বলে জানি না, যা বোঝো কর।

কিন্তু বুঝে সুঝে তো কিছু করছে না যতীন সেন, অবুঝ গোঁয়ারের মতই করতে ছুটছে। সর্বনেশে কাজটা।

.

এবাড়িতে তখন বসেছে সেই উৎসবের আসর। বাড়িটা গমগম করছে লোকে, ঝকঝক করছে আলোয়, মুছিত হচ্ছে সঙ্গীতের সুরে।….ভিতর থেকে ভেসে আসছে লোভনীয় খাদ্যের সুঘ্রাণ। যা নিমন্ত্রিতের ক্ষুধা আর আগ্রহ বাড়াচ্ছে।….মরীয়া যতীন সেন সেইখানে এসে দাঁড়াল কুৎসিত এক ছন্দ পতনের মত।

কেমন করে যেন গেটে দাঁড়ান দ্বাররক্ষীর চোখ এড়িয়ে কাদের পিছনে পিছনে এসে ঢুকে পড়েছে একেবারে ভিতরের হ-এ।

উদ্ভ্রান্ত চোখ উদ্ভ্রান্ত ভাব।

হয়ত এই উদভ্রান্ত ভাবটা এতটা হত না, যদি না ঘরে ঢুকে দেখত মুক্তামালার মধ্যমণি হীরক খণ্ডের মত আসরের ঠিক মাঝখানটিতে সীমা বসে আছে বেশে ভূষায় ঝকমকে হয়ে।

ওই রাজদুলালীটি এই হতভাগ্য যতীন সেনেরই মেয়ে! যাকে না কি যতীন সেনই কৌশল করে ওইখানে পৌঁছে দিয়েছে।

আর অকৃতজ্ঞ পাজী মেয়ে কি না সেই বাপকে আর পুঁছছে না?

ওকে ফাঁসিয়ে নিজে ফঁসবে যতীন সেন।

আর তবে কিসের বাধা?

চড়া কুৎসিত গলায় অতএব চেঁচিয়ে ওঠে যতীন সেন–এই যে কন্যে আমার! মহারাণীর বাড়ির পুষ্যি হয়ে খুব লঞ্চপানি দেখাচ্ছিস যে দেখছি! হতভাগা বাপ মা ভাই বোন খেতে পাচ্ছে কি পাচ্ছে না, তার খোঁজও করছিস না। একটা দিন মাত্তর মস্ত গাড়ি হাঁকিয়ে গিয়ে মুষ্টিভিক্ষে দিয়ে এলি, তারপর? পেট কি একদিন খেয়ে চুপ করে থাকবে?

এক ঘর লোক স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। এ দৃশ্যের অর্থ দুর্বোধ্য। কয়েকটা মুহূর্ত স্তব্ধতা, তারপরই বিরাট একটা রোল ওঠে–পাগল! পাগল! গোলমালে একটা পাগল ঢুকে পড়েছে। গেটে কেউ নেই না কি? দাড়োয়ান কি করছে?

কেউ ধরতে যায়, কেউ মারতে যায়, একজন ঘাড়ে হাত দেয়।

–বেরিয়ে যা! বেরিয়ে যা ব্যাটা!

কী মুশকিল! এই আহ্বাদের মাঝখানে হঠাৎ পাগলটা এসে

ওদের কথা শেষ হতে পায় না।

ভীড় সরিয়ে এগিয়ে আসে বসন ভূষণে উজ্জ্বল এক মেয়ে।

আজকের উৎসবের যে মধ্যমণি!

এসে দাঁড়ায় পাগলবেশী লোকটার কাছে! সকলের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে স্থিরগলায় বলে–পাগল নয়।

-পাগল নয়?

–না পাগল নয়।

–কে তবে? জানো তুমি, কে ও?

আমার বাবা!

–তোমার বাবা!

–হ্যাঁ আমার বাবা!

ভীড় পাতলা হয়ে যায়, এদিক ওদিকে সরে যায় সবাই। যারা উঠে দাঁড়িয়েছিল, বসে পড়ে।

সুনন্দা এগিয়ে আসে।

সুনন্দা বুঝতে পারে এতদিন কেন ওর সেই–বাবা সুনন্দার সঙ্গে দেখা করেনি। আসল কথা দেখা করতে দেওয়া হয়নি। ক্ষ্যাপা ক্ষ্যাপা মতন আর কি!

কিন্তু সুনন্দার স্নেহ সবাইয়ের জন্যে।

তাই সুনন্দা কোমল স্বরে বলে-ও, তোমার সেই পালক বাবা?

–না, আমার নিজের বাবা! সত্যিকার বাবা, যার ঘরে জন্মেছি, যার অন্ন খেয়ে বড় হয়েছি।

সীমার কণ্ঠে দৃঢ়তা। সীমার চোখে বেপরোয়া দুঃসাহসিক সংকল্পের ছাপ!

উদ্দালক এখন এই ভয়াবহ মুহূর্তে কী করতে পারে?

উদ্দালক কি এগিয়ে গিয়ে বলবে–এই টুলু কী হচ্ছে? বুঝলাম ওঁর প্রতি তোর কৃতজ্ঞতা আছে, তাই বলে ওঁকে প্লীজ করবার জন্যে এতটা ইয়ে করা উচিত নয়।

নাঃ উদ্দালকের পক্ষে সম্ভব নয়, এখন কোনও কিছু বলা।

উদ্দালক অনুভব করছে এ সময় সীমার কাছে গিয়ে তাকে কথার জালে নিবৃত্ত করতে যাওয়াটা হবে পাগলামী। সে চেষ্টার ফল হবে সীমার সঙ্গে উদ্দালকের নিবিড় আর গভীর সম্বন্ধটুকু ফঁস হয়ে যাওয়া।

তাই উদ্দালক তাকিয়ে থাকে নিরুপায় দর্শকের দৃষ্টিতে।

তাকিয়ে দেখে আরক্তমুখ সুনন্দা রুদ্ধকণ্ঠে বলছে,

-তবে? তবে যে ব্রজনাথ বাবু

–সবে মিথ্যে কথা, সব গল্প! বানানো কাহিনী!

–সব বানানো কাহিনী?

সুনন্দার কপালের শির ফুলে উঠছে, সুনন্দা তাকিয়েও দেখছে না তার নিমন্ত্রিতদের দিকে, সুনন্দা তীব্রস্বরে বলে চলেছে–বানানো কাহিনী? কেন? কেন? কেন?

সীমা অচঞ্চল–কেন, বুঝতে পারছেন না? আপনার অগাধ টাকা, আপনার উত্তরাধিকারিণী সেজে এসে বসলে, সে টাকা আস্তে আস্তে চলে যাবে এই যতীন সেনের হাতে, ওই আপনার পরম হিতৈষী ব্রজবাবু উকিলের হাতে। তাদের সাজানো পুতুল সিন্দুকের চাবি হস্তগত করে ধরে দেবে তাদের কাছে, ধরে দেবে রায় কোম্পানীর মালিকানা।…বুঝতে পারছেন এবার?…ও কি ব্রজবাবু ওপাশ থেকে সরে পড়ছেন কেন চোরের মত? বসে থেকে নাটকের শেষ দৃশ্যটা দেখুন? অভিনয়টা বেশ জমেছে না?

সুনন্দা উন্মাদ গলায় বলে ওঠেন, রঘু গেটে চাবি দে। কেউ যেন বেরিয়ে যেতে পারে না।….ব্রজবাবু বলুন একথা মিথ্যে? বলুন, বলুন আপনি!

ব্রজনাথ মাথা নীচু করেন।

সুনন্দা হয়তো সত্যিই উন্মাদ হয়ে গেছে, তাই সুনন্দার দাদা কাছে এসে যতই বলতে থাকেন–এই নন্দা বোস! মাথা খারাপ করিসনে, ভাল করে বুঝতে চেষ্টা কর ব্যাপারটা

সুনন্দা ততই উত্তেজিত হয়।

যতীন সেনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে-আর আপনি? আপনিও বলবেন একথা সত্যি?

যতীন সেনও সুনন্দার মতই উত্তেজিত উন্মাদ।

–সত্যিই তো! ষোলো আনা সত্যি। কেন সত্যি হবে না? আমি গরীব, আমার অভাব, স্বভাব নষ্ট তো হবেই? আজকাল এ নষ্ট কার না হচ্ছে? মেয়ে দিয়ে সংসারের ডুবো নৌকো কে না টেনে তুলছে? কে না তাকে ভাঙিয়ে খাচ্ছে? যে যেমন পারছে।….আমার সামনে প্রলোভনের ছবি ধরেছেন ওই আপনার উকিলবাবু।

–আপনি থামুন, আপনি থামুন-সুনন্দা এবার সীমার দিকে তাকায়। তারপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে তার হাত ধরে বলে–কিন্তু তোক যে আমি আমার সেই হারানো টুলু বলেই জেনেছি। ওরে টুলু, তুই একবার বল্ একথা মিথ্যে। বল্ এটাই কোনও নতুন ষড়যন্ত্র। আমার বুক ভেঙে দেবার জন্যে কোনও রাক্ষস এই মতলব ভেঁজেছে বসে বসে। তুই সেই জাল ছিঁড়ে দে। বল্ মা, যা বলেছিস মিথ্যে–

–মিথ্যে নয় মা!

–নয়? নয়? মিথ্যে নয়? তবে কোন মুখে মা বলে ডাকছিস শয়তানী? দূর হয়ে যা, দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে।…না দূরই বা হবি কেন? তোকে আমি পুলিশে দেব। তোদের সব কটাকে জেলে পুরবো। মায়া বাড়িয়ে এখন আবার মা বলতে আসছে!….তাই তাই-তাই তোর মা ডাকতে জিভ আড়ষ্ট হয়ে যেত! তাই আমার স্নেহের সমুদ্র দুহাতে ঠেলে সরিয়ে দিতিস, তাই সব সময় তোর চোরের মত ভাব ছিল!….এখন বুঝতে পারছি। সব বুঝতে পারছি–

চিরদিনের শান্ত মানুষটা যেন ক্ষেপে উঠেছে, তাই এমন শক্ত করে চেপে ধরছে সীমার হাত যে, রক্ত জমে উঠছে তার। সীমা হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে। পারে না।

আস্তে বলে, হাতটা ছেড়ে দিন, লাগছে।

ছেড়ে দেব? ছেড়ে দেব তোকে আমি? জেলে দেব না?

.

–পিসিমা!

উঠে আসে উদ্দালক। জোরালো গলায় বলে কী পাগলামি হচ্ছে? বোসা তো শান্ত হয়ে?

শান্ত হয়ে? শান্ত হব আমি?

সুনন্দা বসে পড়ে।

আর এবার হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠেভগবান! কত মহাপাপ করেছিলাম আমি, তাই এমনি করে হরিষে বিষাদ করলে।

.

হল-এ যে যেখানে ছিল, যেন পাথরের পুতুল হয়ে গিয়েছিল, সুনন্দার দাদা বাদে। তিনি উঠে গিয়ে হল-এর শেষপ্রান্তে পৌঁছে ব্রজ উকিলকে প্রশ্ন করছিলেন কটু কঠিন চাপা গলায়। এবার তিনি যতীন সেনের সামনে দাঁড়িয়ে সরাসরি প্রশ্ন করেন কী চান আপনি? টাকা? কত টাকা? হাত পেতে চাইলে পাবেন সে টাকা; বলুন কত চান? হাজার, দুহাজার? পাঁচ হাজার?….আমার এই বোনটিকে দেখছেন? এঁর কাছে যদি আপনি ওই টাকাটা চান, হাসতে হাসতে দিতে পারেন ইনি, একসময় আপনি এঁর হারানো মেয়েকে পালন করেছেন বলে। কিন্তু যদি প্যাঁচ কসে ব্ল্যাকমেল করে টাকা আদায় করতে চান, ফল ভাল হবে না বলে দিচ্ছি।

হ্যাঁ, এই ভাবেই আপাতত শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চেষ্টা করেন সুনন্দার দাদা। সত্যি মিথ্যে পরে বোঝা যাবে, এখন লোকসমাজে মানটা রাখতে হয়।

কিন্তু তোক কি ঘাসের বীচি খায়?

সুনন্দার এই মেয়ে খুঁজে পাওয়ার পর থেকে আত্মীয় মহলে কি সন্দেহের চাষ চলছিল না? সুনন্দার মত দেখতে নয়, নয় শোভনের মত দেখতে; হঠাৎ কোথা থেকে না কোথা থেকে ধাড়ি একটা মেয়ে এসে রাজ্যপাটে বসল, এটা সহ্য করা সোজা না কি?

যতীন সেন আকস্মিক এহেন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না, তাই এদিক ওদিক তাকায়, তারপর মেজাজি গলায় বলে ওঠে–তাই দিন। দিয়ে দিন হাজার পাঁচেক টাকা, চলে যাচ্ছি।

–দেব! আপনি বাইরে চলুন। মনে করেছিলেন এই রকম একটা সীন ক্রিয়েট করলেই সবাই আপনার কথা বিশ্বাস করবে। আর ওই বেচারী মেয়েটা–যে না কি এ যাবকাল আপনার কাছে প্রতিপালিত হয়েছে সে, সাধারণ ভদ্রতা এবং কৃতজ্ঞতার বশে নিশ্চয়ই আপনাকে সমর্থন করবে। সে মতলব আপনার কিছুটা হাসিল হয়েছে; তবে চালাকি দিয়ে চিরদিন ঠকানো যায় না, মনে রাখবেন সেটা। একবার দেব টাকা, কিন্তু আপনি যে বারে বারে এসে মোচড় দেবেন; তা চলবে না। চলুন, চলুন আমার সঙ্গে।

যতীন একবার জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ব্রজনাথের দিকে তাকায়, ভাবে ওই বুড়োই নিশ্চয় আমায় ফাঁদে ফেলবার তাল করছে, নিজে এর ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাবে। নইলে এক কথায় টাকা দিতে রাজী হয়? পরীর গল্প না কি! আর কিছু না, বাইরে বার করে নিয়ে গিয়ে দুঘা রদ্দা দিয়ে ছেড়ে দেবে।…তবে গেট বন্ধ, আর ওই মহিলাটি তো উগ্রচণ্ডী হয়ে রয়েছেন। মেজাজ দেখিয়ে লাভ নেই। টাকা দেবে, এ হতেই পারে না। তবু দেখাই যাক! এক মাঘে তো শীত পালায় না।

তাই ব্রজনাথকে ভস্ম করে ফেলবার ইচ্ছে পরিত্যাগ করে ব্যাজার ভাবে বলে,–টাকা যে কত দেবেন বোঝাই গেছে। বেশ চলুন!

.

-না।

সীমা এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল, যেন এই ঘরভর্তি লোকের কাউকে দেখতে পাচ্ছিল না। শুনতে পাচ্ছিল না কারও কথা! এখন শুনতে পেল। তাই এগিয়ে এসে শান্তদৃঢ় গলায় বলল–না!

সুনন্দা সেই ক্লান্ত কণ্ঠে জোর এনে বলে–সব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। রায় কোম্পানীর বিরাট সম্পত্তি তিলে তিলে গ্রাস করে আশা মিটছিল না ওঁর, তাই জাল পেতে–থেমে যায়, রুদ্ধকণ্ঠ পরিষ্কার করে নিয়ে আবার বলে–এদের যেতে দে দুলু, ওঁকে আটকা।

.

টাকাটার কথা তাহলে ফাঁকা?–মরিয়া যতীন সেন ব্যঙ্গহাসি হেসে কটু প্রশ্ন করে। এবং সমবেত অভ্যাগতরা এইবার হৈ হৈ করে ওঠে–টাকা! আবার টাকার নাম করতে লজ্জা করছে না? অনেক ভাগ্য যে ছাড়া পাচ্ছ, নইলে দশবছর ঘানি ঘোরাতে হত!…আমাদের কিন্তু মনে হচ্ছে মিসেস রায়, ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না। এই জাল মেয়ে আর তার বাবা দুজনেরই রীতিমত শাস্তি পাওয়া দরকার। মেয়েটি তো শিশু নয় যে, না বুঝে কিছু করেছে। এ সব মেয়ে সমাজ ধ্বংসকারী আগুন! কোনও সেন্টিমেন্টের মুখ চেয়ে একে ক্ষমা করা যায় না। ক্ষমা করা উচিত নয়।….

অনেকের কণ্ঠ হতে ঝরে পড়ে কথাগুলো নানা আকারে।

সুনন্দা সকলের দিকে তাকায়।

তারপর ক্লান্ত গলায় বলে জানি। মানছি তোমাদের যুক্তি, তবু জিগ্যেস করি, যদি তোমরা কখনো ভুল করে শালগ্রাম ভেবে একটা পাথর নুড়িকে পূজোর সিংহাসনে বসিয়ে অনেক দিন ধরে পুজো কর, ভুলটা ধরা পড়লে কি সেই নুড়িকে সিংহাসন থেকে টেনে এনে জুতোর তলায় মাড়াতে পারো? বল পারো কি মা? বল? বল?

.

না, বলতে সেদিন পারেনি কেউ–হ্যাঁ পারি মাড়াতে!

বলতে বলতে আরক্ত-মুখ সুনন্দা বাড়ির মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল, খোলা গেট দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল যতীন সেন আর সীমা, বেরিয়ে গিয়েছিল ব্রজ উকিল।…তবে সুনন্দার দাদা কঁচা কাজ করেননি, খবর দিয়ে রেখেছেন পুলিসের ঘরে, পাশের ঘরে গিয়ে ফোনের রিসিভার তুলে।

আসল আসামী জালে পড়লে, ওদের জন্যে ভাবতে হবে না। ঠিক ধরা পড়বে, সীমা–আর সীমার বাপ। এখন সুনন্দা ভয়ানক একটা সেন্টিমেন্টের বশে ছেড়ে দিচ্ছে, দিক। শাস্তি ওদের পেতেই হবে।

৪. সেই শাস্তি

কিন্তু কতটা সেই শাস্তি?

অন্তত সীমার জন্যে কতটা শাস্তি ধার্য করতে পারবে আদালতের আইন আর বিচার?

আবার যতীন সেনের কলোনীর বাড়িতে ফিরে এসে নিঃশব্দে বাসন মাজা, রান্না করা, সাবান কাঁচার চাইতেও বেশি? তাই করছে এখন সীমা, সব কাজ করছে মাকে ছুটি দিয়ে।

বলছে–আমি তো অনেকদিন আরাম খেয়ে এলাম, ভাল ভাল খেয়ে গায়ে জোর করে এলাম, এইবার খাটি।

এ খাটুনির সঙ্গে কর্পোরেশনের স্কুলের সেই চাকরিটাও যোগ হল। বাইরে গিয়েছিল সীমা মাস কতকের জন্যে, তাই বলে চাকরিটা আর ফিরে পাবে না?

না, স্কুলের ওরা জানে না কোথায় গিয়েছিল সীমা। কলোনীর এরা জানে।

পদ্ম রাধা নীলা স্বপ্ন, আর তাদের বাড়ির সকলে। জানে পাড়ার সবাই।

কোন এক বড়লোকের গিন্নী নাকি হঠাৎ কোথায় সীমাকে দেখে ভালবেসে ফেলেছিলেন, তাই বলে কয়ে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন পুষবেন বলে। বিধবা গিন্নী, পুরুষশূন্য বাড়ি, তাই আপত্তি করেনি সীমার মা বাপ। ভেবেছিল থাক, একটা মেয়েই খেয়ে পরে ভালভাবে থাক।

অবিশ্যি এ আশাও ছিল, মেয়েটা চালাকি করে গিন্নীর কাছ থেকে কিছু কিছু হাতিয়ে এনে ভাই বোন মা বাপকে দেবে থোবে। কিন্তু সে আশায় ছাই দিয়েছে মেয়ে।

নিজের মান বজায় রাখতে কিছু চায়নি কিছু নেয়নি। অতএব কিছু দেয়ওনি। সেই যা। একদিন

সে তো এরা সবাই দেখে গেছে, শুনে গেছে, গালে হাত দিয়েছে। ছি ছি করেছে।

তারপর?

তারপর যা স্বাভাবিক তাই হয়েছে।

শখ মিটে গেছে গিন্নীর। কি বুঝি একটু রাগ হয়েছিল, একবস্ত্রে বিদেয় দিয়েছে।

দেবেই তো। কথাতেই তো আছে বড়র পীরিতি বালির বাঁধ, ক্ষণে হাতে দড়ি, ক্ষণেক চাঁদ! শখ হয়েছিল হাতে চাঁদ দিয়েছিল। এখন যে হাতে দড়ি না দিয়ে শুধু বিদেয় দিয়েছে এই ঢের বলতে হবে।

ঘুচে গেল রাজকন্যেগিরি!

নাও এখন হাভাতে যতীন সেনের ঘরে এসে মোটা চালের ভাত রাঁধো, আর রাস্তার কলে গিয়ে কানা-ভাঙা চটা-ওঠা কলাই-করা বাসন মাজো!

.

–অহঙ্কারের ফল ফলে বুঝলি দিদি!

বলেছিল সীমার পিঠোপিঠি বোনটা! যেদিন ফিরে এসেছিল সীমা বাপের হাত ধরে।

সেদিন মরিয়া যতীনের তেজ করে বেরিয়ে যাবার পর থেকে দুর্গানাম জপ করছিল বসে বসে যতীনের বৌ। আর ভাবছিল, হে ভগবান ওর যেন পথে থেকে মতি ফেরে। যেন গিয়ে রাগারাগি করে সত্যি সব প্রকাশ করে না দেয়।

কিন্তু ভগবান যথারীতি তার কথা শুনলেন না।

মেয়ে নিয়ে ফিরে এল যতীন রাগে ফুলতে ফুলতে। লক্ষ্মীছাড়া মেয়েটা কিনা গায়ের গহনাগুলো পর্যন্ত খুলে খুলে ফেলে দিয়ে এল!

একটা গিন্নীমত কে যেন বলে উঠেছিল, থাক থাক গায়ের গহনাগুলো আর ফেরৎ দিচ্ছ কেন বাছা! যে মানুষ দিয়েছে ওসব, সে কখনই দেওয়া জিনিস ফেরৎ নেবে না। ও তুমি যেমন পরে আছ থাকো।

পাজী মেয়ে সে কথা না শুনে গলা থেকে হাত থেকে কান থেকে খুলে খুলে তার সামনেই ফেলে দিয়ে চলে এল! কেন, থাকলে তো সেগুলো ভাঙিয়েও কিছুদিন চলতো! মেয়ে তো নয় শত্রু! পরম শত্রু!

সীমার মা দেখল দামী একখানা শাড়ী পরে এসে দাঁড়াল মেয়ে ন্যাড়া হাতে ন্যাড়া গলায়। এসেই বলে উঠল–মা ছেঁড়া খোঁড়া নেই একখানা কিছু তোমার? দাও না, পরে লজ্জা নিবারণ করি।

–শাড়ী! আমার ভেঁড়া শাড়ী পরে লজ্জা নিবারণ করবি তুই?

ডুকরে কেঁদে উঠল সীমার মা।

–ওই হতভাগা সর্বনেশে বুঝি সব ফাস করে ফিরিয়ে নিয়ে এল তোকে? ওরে একী লক্ষ্মীছাড়া বুদ্ধি হল ওর? তবু তো একটা পেটও অন্যত্র ভরছিল। আবার সেই বুড়ীর কুলতলায় এসে জুটল। এখন কিনা মেয়ে আমার পুরনো ছেঁড়া ন্যাকড়া পরে লজ্জা নিবারণ করবে!

সীমা ততক্ষণে ঘরে ঢুকে পরনের সেই ক্রেপ বেনারসীর শাড়ীটা ছেড়ে সত্যিই মায়ের দরুন শতজীর্ণ একখানা শাড়ী পরে এসে দাওয়ায় দাঁড়িয়েছিল। মায়ের কথার শেষাংশে অদ্ভুত একটা তিক্ত করুণ হাসি হেসে বলে ওঠে–আশ্চর্য! আস্ত এতবড় একখানা মেয়ে বেচে কিছুই পাওনি তোমরা? উকিল বুড়ো এতই ঠকিয়েছিল তোমাদের?

যতীন সেন তীব্র স্বরে বলে–ঠকাবে না কেন? বিশ্বসুদ্ধ লোকই ঠকাবে। ভগবান যাকে ঠকিয়েছে, তাকে আবার জেতাবে কে? তুমি মেয়ে হয়ে ঠকালে না বাপকে? এই যদি তুমি এতদিনে একবারও মনে ভাবতে তাইতো বাবা আমায় পাঠিয়েছে কেন, তাহলে আজকের এই কেলেঙ্কারিটা ঘটতো?…ঘটতো না। এখন পাঁচজনের সামনে উদারতা দেখিয়ে ছেড়ে দিল, সত্যি ছাড়বে ভেবেছিস? এই যদি না বাপ বেটিকে সাতটি বছর শ্রীঘর বাস করতে হয় তো কি বলেছি। মানুষ জাল করা অমনি নয়!

সীমা দাওয়ার ধারে পা ঝুলিয়ে বসেছিল, সেই অনেক দিন আগের মত খুঁটিতে মাথা ঠেকিয়ে। এখন মাথাটা সোজা করে বলে–তাই বা মন্দ কি বাবা? দুদুটো লোকের সাত সাতটা বছরের মত অন্নচিন্তা ঘুচবে। আমাদের সদাশয় গভর্মেন্ট হয়তো বা দয়ার পরকাষ্ঠা দেখিয়ে তোমার নাবালক ছেলে মেয়েদের এবং অসহায় স্ত্রীর জন্যে কিছু মাসোহারারও ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। সব দিক দিয়েই লাভ!

ভালই হল! সীমার মা তেতো হাকুচ গলায় বলে লাভের মধ্যে এই হল, দুদিন বড় মানুষের ভাত খেয়ে এসে আরও চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শিখল মেয়ে। এখন ওই বাক্যি বুলি শোনো বসে বসে। এত মেয়ে মানুষের মরণ হয়, আমার কেন মরণ হয় না তাই ভাবি।

সীমার পিঠোপিঠি বোনটা বলে উঠেছিল–হবে কেন? ভগবানের দয়া হাড়ে হাড়ে টের পাবে কে তাহলে? এখনো কত বাকী!

বড় মানুষের ভাত না খেয়েও বাক্যি বুলিতে যে সেও কিছু কম যায় না, সে কথা মনে পড়ে না তার মার।

.

এই।

এই হল প্রথম দিনের অভ্যর্থনার নমুনা। তারপর গেছে কয়েকটা দিন। কাটা হয়ে থেকেছে যতীন সেন কখন পুলিস আসে। তারপর ক্রমশ ভয়টা ঝাপসা হয়ে গেছে।….চলছে দিন।

সীমাকে কলোনীর সকলের কাছে জনে জনে বলতে হয়েছে তার যাওয়া আসার ইতিহাস। কিন্তু ওর কথা বিশ্বাস করবে কে? ও যদি বলে নিজের ইচ্ছেয় চলে এসেছে সে, আর ভাল লাগছিল না বলে, সেটা কি বিশ্বাসযোগ্য কথা?

তবু সবাই এখনো দেখা হলেই সকৌতূহলে প্রশ্ন করে–আচ্ছা তারা আর খোঁজ খবর করেনি?…আশ্চয্যি বাবা! একটা মায়া মমতাও তো পড়ে মানুষের? একটা জীব জন্তু পুষলেও পড়ে। বড়লোকদের প্রাণই আলাদা!

বলছে। বলে বড় সুখ পাচ্ছে।

সীমা নির্বিকার!

সীমা কলতলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে কল খালি হওয়ার অপেক্ষায়। এ যেন কোন এক পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে সীমা তিলে তিলে। মা কাড়াকাড়ি করে বাসন নিয়ে, সাবান সেদ্ধ কাপড় নিয়ে, সীমা ছাড়ে না। চিরদিনের জেদী মেয়ে সীমা!

মা বলে–মরবি নাকি খেটে খেটে?

মেয়ে হেসে উঠে বলে–পাগল হয়েছ? এক্ষুণি মরব মানে?

***

–আমি জানতাম।

উচ্চারণ করেছিল উদ্দালক যেন নির্লিপ্ত নির্মমের মত।

জানতাম! অনেকদিন থেকেই জানতাম! সব বলেছিল আমায় সীমা। পুলিসে দিতে হলে আমাকেই আগে দিতে হবে।

উদ্দালকের মা রুদ্ধ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করেছিলেন–তুই জেনেছিলি? তবু প্রকাশ করিসনি?

–নাঃ!

–কেন? কেন এমন অন্যায় হতে দিয়েছিলি দুলু? বিষগাছের শেকড় আরও গম্ভীর হতে দিয়েছিলি কেন?

–পারিনি, বলতে পারিনি মা! হতভাগা মেয়েটা প্রতিদিন বলেছে প্রকাশ করে দেবে, বিদায় নেছে! আমিই ঠেকিয়ে রেখেছিলাম।

–কিন্তু আমি তো এর অর্থ বুঝতে পারছি না দুলু? কী উদ্দেশ্য ছিল তোর? রাস্তার একটা লোক এসে তোর পিসিকে ওই রকম সর্বনেশে ঠকানো ঠকাচ্ছিল, আর তুই তাতে সাহায্য করছিলি?

–পিসির জন্যেই।

–পিসির জন্যেই?

উদ্দালকের মা উদ্দালকের মুখের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়েছিলেন– শুনছ কথা? পিসির জন্যেই পিসিকে ঠকাতে সাহায্য করছিল ও। তার মানে, একটা মাটির ঢেলা নিয়েই যদি শালগ্রাম ভেবে মত্ত থাকে তো থাকুক, এই তত?

সুনন্দার সেই তুলনাটাই সুনন্দার ভাজ ব্যবহার করেন।

সুনন্দার দাদা ছেলের মুখের দিকে তাকান। তার অন্যদিকে ফেরানো মুখের দিকে।

কী দেখেন তিনি ছেলের মুখে?

তাই এমন অদ্ভুত কথাটা বলে বসেন?

বলেন–তা সেটাও একটা কারণ বৈ কি! ওর অতখানি আনন্দ আর বিশ্বাসের ওপর হাতুড়ি বসাতে বেধেছিল হয়তো।….কিন্তু দুলু, শুধুই কি পিসির জন্যে? আর কারও জন্যে নয়?

চমকে মুখ তোলে উদ্দালক।

বাপের দিকে তাকায়। বাপের সেই স্থির নির্নিমেষ দৃষ্টি সহ্য করতে পারে না, আবার চোখ নামায়।

তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে মায়ের মুখ, তীব্র হয়ে ওঠে দৃষ্টি!

তারপর সহসাই বলে ওঠেন–তা বটে। জানাই যখন হয়ে গেছল পিসির মেয়ে নয়, বাধা কি আর?

উদ্দালক কি আবার চমকে ওঠে?

না কি উদ্দালক মায়ের দিকে অমন অপলকে তাকায় শুধু শুধুই? কয়েকটা সেকেণ্ড!

মায়ের চোখের দিকে বরং তাকানো যায়, যায় না বাপের চোখের দিকে।

.

যায় না বলেই হয়তো পিসির রোগশয্যার পাশে আত্মগোপন করেছে সে আজ কদিন। সদা সন্ত্রস্ত ভঙ্গীতে রোগীর ঘরে থাকলে, কে তাকে প্রশ্নে জর্জরিত করতে আসবে?

হ্যাঁ, সেদিন থেকে একেবারে শয্যা নিয়েছে সুনন্দা। রক্তচাপ, দুর্বলতা, বুক ধড়ফড়, অরুচি, অক্ষুধা, ইত্যাদি বহুবিধ অসুখে শুয়ে পড়েছে সে।

বুক ভেঙে যাওয়া বলে চলতি একটা কথা আছে না? অর্থ কি তার? সুনন্দার কাছে কি সে তার অর্থ নিয়ে এসে হাজির হয়েছে?

সুনন্দার ঘরের সঙ্গেই লাগোয়া ঘরখানা ছিল সীমার, সে ঘরের দরজা আজ কদিন বন্ধ রাখা আছে।

দরজা হাট করা ঘরের শূন্যতাটা বড় বেশি স্পষ্ট আর প্রকট হয়ে ওঠে। সুনন্দা হাহাকার করে বলেছে সে কথা। সেই বন্ধ দরকার দিকে তাকিয়ে উদ্দালক মনে মনে অদ্ভুত একটা ক্ষুব্ধ হাসি হাসল।…বেশ মজার নিয়ম আমাদের সমাজের! শ্রদ্ধা ভক্তি স্নেহ ভালবাসা সবাই আসন পাবে, সবাই মর্যাদা পাবে, তাই নিয়ে যত বাড়াবাড়ি আতিশয্যই কর না কেন, নিন্দনীয় হবে না, কিন্তু প্রেম?

খবরদার! খবরদার! নাম কোরো না–নাম কোরো না। সে কখনোই ওই হৃদয় বৃত্তিদের কাছে বৃত্তি পাবে না। প্রেম অপাঙক্তেয়, প্রেম নিন্দনীয়, প্রেম লজ্জাকর!

অতএব এ বাড়িতে সবচেয়ে সহজ আর সাধারণরূপে থাকতে হবে উদ্দালককে। উদ্দালকের পক্ষে সম্ভব নয় একবার ওই বন্ধ কপাটটার ওধারে গিয়ে বসে! দেখে কোথায় কি জিনিস কেমন করে ছড়িয়ে রেখে চলে গেছে সীমা।

সীমা যখন সাজগোজ করে নীচের তলায় নেমে গিয়েছিল, তখন তো ভাবেনি, আর সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠবে না সে।…ভাবেনি। ভাবেনি, যেসব প্রসাধন বস্তুগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে গেছে, জীবনে আর কোনদিন সেগুলোয় হাত দেবে না।

সকালবেলাও একসঙ্গে খেয়েছিল সবাই। সুনন্দার আদরের টুলুর ভাত খাবার রূপোর সেই থালাটা বাসনের আলমারির এক পাশে পড়ে আছে বোধহয় ধূলোপড়া হয়ে।…

সীমার আলনায় যে শাড়ীগুলো ঝুলছে, সেগুলো রাখার সময় কি সীমা স্বপ্নেও ভেবেছিল, অনন্তকাল ধরে ঝুলেই থাকবে ওইগুলো? যেখানে যেমন রেখে গেল সে, সেখানে তাই থাকবে চিরকাল? আর সব কিছুর ওপর দরজাটা বন্ধ করে দেওয়া হবে?

সুনন্দা কেঁদে কেঁদে শয্যা নিয়েছে, সেটা দুঃখবহ, উদ্দালকের চোখটা ভিজে এলে তা হাস্যকর।

আর একবার ভাবল উদ্দালক। অদ্ভুত সমাজ আমাদের! জগতের মধ্যে যে বস্তু সবচেয়ে পবিত্র, সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে শুভ্র, সেই বস্তুই লজ্জার। একান্ত লজ্জার।

উদ্দালকের শরীরে লজ্জার বালাই ছিল না, এখন উদ্দালককে লজ্জা শিখতে হয়েছে।

নইলে সমাজে নিন্দনীয় হতে হবে উদ্দালককে। লোকে বলবে বেহায়া! বলবে অসভ্য!

আর উদ্দালকের মা বাপ উদ্দালকের দিকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন

কিন্তু উদ্দালক তো শিশু নয়?

সে কি একবার সীমার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারে না? বলতে পারে না, সমস্ত সংসার তোমায় ত্যাগ করে করুক, আমি আছি তোমার পাশে!

বলতে পারে না–সীমা, তোমার জালের জাল ভেদ করে সত্য মূর্তিতে এসে দাঁড়াও সকলের সামনে, সেদিনের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে দাও আমায়!

পারত হয়তো।

কিন্তু বাদ সেধেছে সুনন্দা। প্রতি মুহূর্তে যায় যায় অবস্থা ঘটিয়ে! সারাক্ষণ বাড়িতে আটকে রেখেছে!

তবে সন্ধান সে জানে সীমার। জানে কোন্ কলোনীতে থাকে যতীন সেন।

ইচ্ছে করলেই যেতে পারে। কিন্তু এখন সে ইচ্ছে করছে না উদ্দালকের।

মা বাবা ফিরে যান, তারপর দেখা যাবে।

তাছাড়া সীমা একটু স্থির হোক, একটু শান্ত হোক!

নিজেকে তাই কদিন আটকে রেখেছে উদ্দালক এই রোগশয্যার পাশে! আর অবিরত মনে মনে মহলা দিচ্ছে সেই কথাটির, যে কথাটি প্রথমেই গিয়ে দাঁড়িয়ে বলবে সীমাকে।

সীমা, অনেক তো হল, এবার চলো!

সীমা কি উত্তর দেবে সেটাও মনে মনে আন্দাজ করে। অভিমানী সীমা অবশ্যই কঠিন মুখে। বলবে, কোথায় যাব?

তার উত্তরে উদ্দালক বলবে, আমার কাছে, আমার ঘরে।

হ্যাঁ, এই কথাটিই ভেবে ঠিক করে রেখেছে উদ্দালক।

আর সেই ঘরটিও ঠিক করছে মনে মনে।

মা বাবার চলে যাবার আগের দিন সব কথা খুলে তাদের কাছে বলবে উদ্দালক। নিজের সব। তারপর প্রশ্ন করবে, এখন বল, এই জালিয়াত মেয়েকে ঘরে নেবে কি না! যদি না পারো, যদি তোমাদের মন ঘৃণায় বিদ্বেষে কঠিন হয়ে ওঠে, জোর করব না তোমাদের ওপর, কিন্তু আমাকে ছেড়ে দিতে হবে মা! উপায় নেই আমার। আমি আমার হৃদয়ের কাছে বদ্ধ, বিবেকের কাছে বদ্ধ।

.

উদ্দালকের মা-বাপও কিছু ভাবছিলেন বৈকি। ছেলের দিকে তীক্ষ্ণ লক্ষ্য রেখে অনেক কিছুই ভাবছেন তারা। সেই ভাবনার শেষে একদিন বোনের কাছে এসে বসলেন সুনন্দার দাদা। সস্নেহ কণ্ঠে বললেন–আজ কেমন আছিস রে নন্দা?

সুনন্দা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে–ভালই!

–বলছিস তো ভাল, দেখাতে তো পারছিস না তা? আমার তো এদিকে ছুটি ফুরিয়ে এল, ভাবছি তোকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাই।

–আমাকে? সুনন্দা চমকে উঠে বলে–আমি কোথায় যাব?

–কেন আমাদের কাছে? বাপের বাড়ি যায় না মেয়েরা?

–এখন থাক দাদা!

–কেন এখন থাকবে কেন? এখনই তো দরকার! আমরা চলে যাব, দুলুরও কলেজ খুলে যাবে, আর তুই বসে বসে সেই মেয়েটাকে ভাববি! এই তো!

–দাদা! চমকে ওঠে সুনন্দা।

তীব্রস্বরে বলে–কোন মেয়েটার কথা ভাবব আমি?

দাদা মৃদু হেসে বলেন–যে মেয়েটার জন্যে শয্যা নিয়েছিস! দেহপাত করছিস! তোর ঠাকুর ঘরটাকে পর্যন্ত ভুলে গেছিস।

–কক্ষনো না!

সুনন্দা উত্তেজিত হয়ে উঠে বসে রুদ্ধ কণ্ঠে বলে–কক্ষনো না। কক্ষনো আমি কারুর কথা ভাবছি না! কেন, অসুখ হয় না মানুষের?

–আহা রেগে উঠছিস কেন? শুয়ে পড়, শুয়ে পড়। অসুখ তো হয়ই মানুষের, তবে তার একটা কারণও থাকে।

–সেই পাজী মেয়েটা আমার অসুখের কারণ?

ধপ করে শুয়ে পড়ে সুনন্দা-কক্ষনো না।

দাদা মৃদু হেসে বলেন,–মনকে চোখ ঠেরে লাভ কি বল তো নন্দা? মেয়েটাকে যে তুই বড্ড ভালবেসে ফেলেছিলি সেটা তো আর মিথ্যে নয়?

–আমি বোকা, আমি মুখ, আমি আহাম্মক তাই, তাকে

কথা শেষ করতে পারে না সুনন্দা, বালিশে মুখ গুঁজে শোয়।

দাদা ওকে শান্ত হতে একটু সময় দিয়ে তারপর আস্তে বলেন–মুখ আহাম্মক বোকা আমরা সবাই নন্দা! নিজেকেও আমি কম ধিক্কার দিচ্ছি না। যখন শুনলাম মেয়ে ফিরে পেয়েছিস তুই, তখন অত সহজে সেটা বিশ্বাস না করে সন্দেহ করা উচিত ছিল আমার। আসা উচিত ছিল ছুটি নিয়ে। সে দোষের বিচার করতে হবে বৈ কি। কিন্তু সে তো আলাদা কথা। আসল কথা–তোকে তো বাঁচাতে হবে? তাই ভাবছি কলকাতার এই লোকসমাজ থেকে কিছুদিন সরে পড়া দরকার তোকে নিয়ে। সেই সঙ্গে মেয়েটাকেও নিয়ে যাই।

মেয়েটাকে? মেয়েটাকে নিয়ে যাবে তুমি?

সুনন্দা ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলে, আমাকে কি পাগল পেয়ে ঠাট্টা করছ দাদা?

–ছিঃ নন্দা একথা বলছিস কেন? তোর মনের ভেতরটা কি দেখতে পাচ্ছি না আমি?

–দাদা! সুনন্দা ডুকরে কেঁদে উঠে বলে–আর তাকে কোন্ সুবাদে আনতে যাব?

–আহা সে যা হয় একটা সুবাদ তৈরি করে নেওয়া যাবে। মোট কথা, তোর একটু চেঞ্জের দরকার হয়েছে, আর সেই মেয়েটা কাছে না থাকলে তোর কাছে স্বর্গও মিথ্যে!

–দাদা, দাদা গো! সেই পাষাণীকে চেন না তুমি! সে যে কতবড় নিষ্ঠুর, কতবড় কসাই, সে কথা আমি জানি রুদ্ধকণ্ঠে জোর এনে কথা শেষ করে সুনন্দা–আমি মরে গেছি শুনলেও সে দেখতে আসবে না।

দাদা হেসে ফেলে বলেন–মরে গেলে আর মড়াটা দেখতে এসে কী করবে? জ্যান্ত থাকতেই যাতে আসে সেই চেষ্টা দেখি!

সুনন্দা বালিশে মাথা ঘষতে ঘষতে বলে–পারবে না দাদা, পারবে না। মান রাখবে না তোমার। ফিরিয়ে দেবে, আসবে না। বলবে, তোমার বাড়ি যাব কেন? আর সেই পাজী বাপটা নিশ্চয় তাকে আসতে দেবে না! শুধু শুধু তুমি

কথা আর শেষ করতে পারে না সুনন্দা, আরও কেঁদে ওঠে।

আর ভাবতে থাকে, দাদা ছেলেমানুষ! দাদা সরল! দাদা চিরদিন মফস্বলে কাটিয়ে, কলকাতা শহর আর সেই শহরের মানুষরা যে কী বস্তু তা জানে না! তাই দাদা ভাবছে আমার মন ভাল রাখতে আবার তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে আসবে। অসম্ভব! অসম্ভব! আমি তো জেনেছি সে মেয়েকে।

সুনন্দার বৌদিও বলেছিল–অসম্ভব! হতেই পারে না, অসম্ভব।

কিন্তু সুনন্দার দাদা–নিজ সঙ্কল্পে অটল। সুনন্দাকে একবার নিজের কাছে নিয়ে যাবেন তিনি। আর তার ঔষধার্থে সেই সীমাকে। হয়তো–অনেক প্রতিকূলতার সঙ্গে যুঝতে হবে, তা হোক! কঠিন কাজেই তো রোম্যান্স!

তবে সে রোম্যান্সে সাহায্য নিতে হবে ছেলের। উদ্দালকের!

.

টাকা! টাকা দেখাতে এসেছিল।

ছেঁড়া চটের থলিতে আনা অকিঞ্চিৎকর বাজারটা নামিয়ে দিয়ে যতীন বিকৃত গলায় বলে–কী লম্বাই চওড়াই! কী চান? টাকা? কত টাকা? হাজার? দুহাজার? পাঁচ হাজার? চলুন দিয়ে দিচ্ছি।…দিচ্ছেন টাকা! কি আর বলব, ভগবান মেরেছে, নইলে একটি ঘুষিতে ওই সব বড়মানুষদের লম্বাই চওড়াই ঘুচিয়ে দিতাম।

এই টাকার কথা বহুবার শুনিয়েছে যতীন, তার স্ত্রী কন্যা সকলেরই জানা। স্ত্রী কখনো চুপ করে থাকে, কখনো বলে–জেলে দেয়নি এই ঢের, আবার টাকা দেবে!

সীমা সবসময়ই চুপ করে থাকে।

আজ হঠাৎ সীমা কথা কয়ে ওঠে।

বলে–তুমি যদি ওদের কনডিশান মানতে, দিতই নিশ্চয় টাকা। তা না হলে দেবে কেন?

কনডিশান? কনডিশান আবার কি ছিল?

ক্রুদ্ধ গলা যতীনের। অশান্ত অস্থির যতীন সেন!

সীমা শান্ত! সীমা সেই শান্ত গলায় বলে–যিনি টাকার কথা বলেছিলেন, তিনি পাঁচজনের সামনে দেখাতে চাইছিলেন, তুমি ব্ল্যাকমেল করে টাকা চাইতে এসেছ! তুমি সেটাই স্বীকার করে নিলে দিতেন টাকা।

যতীন গর্জন করে বলে ওঠে–তা সেটা তো স্বীকার করে নিতামই। যাচ্ছিলাম তো তাই বলতে, এই তুমি! তুমি আমার ধর্মের ধ্বজা মেয়ে বলতে দিলে তা? কেন তুমি বলতে পারলে না, ওই আমার পালক পিতা, লোকটার মাথার একটু দোষ আছে! সেইটুকু বললেই মিটে যেত! তা নয় ধর্মিষ্ঠি হলেন মেয়ে। একঘর লোকের সামনে কবুল করে বসলেন–ওগো ওই আমার নিজের বাবা! আমার জন্মদাতা পিতা! বাঁধলেন পুণ্যের ছালা সত্যবাদী যুধিষ্ঠির!

যতীন-গিন্নী এতক্ষণ নীরবে দাওয়ায় চারটি লাল লাল চাল ঢেলে তার কাকর বাছছিল, এবার মুখ তুলে নিশ্বাস ফেলে বলে–সে কথা আমিও অনেকবার বলি। তুমি মাথা পাগল মানুষ, না হয় অভাবের জ্বালায় ক্ষেপে উঠে একটা নিবুদ্ধিতা করে বসেছিলে, সীমা ইচ্ছা করলেই একটু বুদ্ধি খাঁটিয়ে একটু সামলে নিতে পারত! বলতে পারত-বরাবরই ওঁর একটু মাথার দোষ! তাতে সাপও মরত, লাঠিও ভাঙত না। যুধিষ্ঠির হয়ে তো ভারি লাভ হল! সেই মাগীকেও তো যা নয় তাই অপদস্থে পড়তে হল! অতটা না করলে, পাঁচজনের সামনে হেয় না হলে, নির্ঘাত ওই সীমাকে আবার টানতো, হয়তো মাসোহারা দিত! তা সব দিক থেকে সবই ঘুচল!

একথা সত্যি, সীমা ইচ্ছে করলেই এদের দুঃখু ঘোচাতে পারত, কিন্তু সে ইচ্ছে করেনি সীমা। কোন সময় নাতা এতই যদি ধর্মজ্ঞান, তবে আর গিয়েছিল কেন ঢং করে? জাল করছি অন্যায় করছি, এ তো জেনেই গিয়েছিল।

সীমা মৃদু হেসে বলে–তা সত্যি মা! জেনে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার বাইরে তো আর কিছু জানতাম না। মানুষ বলতে শুধু তোমাদেরই দেখেছি আজীবন, অন্য আর এক রকমের মানুষ দেখলাম গিয়ে। দেখলাম সেই মানুষের সংস্পর্শে এসে সাপ ব্যাং-ও বদলে যেতে পারে।

–তাই বদলালে!

যতীন সেন ব্যঙ্গতিক্ত স্বরে বলে–চোরের মেয়ে সাধু হলে! অথচ অতটা সাধু না হলে, হাজার দুহাজার ঘরে আসতই সেদিন!

সীমা হঠাৎ হেসে ফেলে বলে–সে আপসোস যে তোমার আর যাচ্ছে না বাবা? মনে কর স্বপ্ন দেখেছ একটা। যেমন ছিলাম আমি তোমার ঘরে, বরাবর তেমনই আছি!

মনে করব!

যতীন সেন ক্ষুব্ধ রুক্ষ গলায় বলে-করতাম মনে, যদি পেটে দুটো ভাত পড়ত ঠিক সময়ে।

–তা তুমি তো কিছু করতেই চাও না বাবা! বললাম কর্পোরেশনে একটা কাজ রয়েছে

কাজ! সেই রাস্তায় রাস্তায় ডি ডি টি ছড়িয়ে বেড়ানোর কাজ? সেই কাজ তো? বাপকে ওই চাকরি করতে বলতে লজ্জা করল না তোর?

-কেন? লজ্জা করবে কেন বাবা? তবু তো সৎপথ। সর্বদা ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতে হবে না, ওই পুলিস এল বলে–

কথা শেষ হবার আগেই সীমার ছোট ভাই অরুণ হঠাৎ বাইরে থেকে ছুটতে ছুটতে এসে চাপা গলায় বলে বাবা পুলিস!

–অ্যাঁ। তার মানে? পুলিস কি?

–পুলিসই তো! নইলে জিগ্যেস করবে কেন,–খোকা জানো তুমি এখানে যতীন্দ্রনাথ সেন বলে এক ভদ্রলোক কোথায় থাকেন?

–পুলিসের পোশাক?

না তা নয়, এমনি। কিন্তু পুলিস নইলে তোমায় খুঁজবে কেন? অবলীলাক্রমেই কথাটা বলে ছেলেটা।

পুলিস ব্যতীত আর যেন কেউ তার বাবাকে ডাকবে না, ডাকতে পারে না, এই তার ধারণা।

সীমা বিরক্ত স্বরে বলে-পুলিস ছাড়া আর কেউ ডাকতে পারে না? অসভ্য ছেলে!

সীমার মা বিরক্ত কণ্ঠে বলেন–তা ওকে বলে কি হবে? কর্তা পুরুষ নিজেই রাতদিন পুলিসের ভূত দেখছেন, ওরা তাই শুনছে তো?

সীমা আরও বিরক্ত গলায় বলে–ভূতই তো হয়েছি মা আমরা! নতুন ভূত আর কি দেখব? যা অরুণ, বলগে যা, দেখিয়ে দিচ্ছি–

–এই সীমা খবরদার!

যতীন বলে–যেতে হবে না কারুর। ঘুরে মরুক সে! আমার হুকুম, কেউ যাবে না।

সীমা চুপ করে যায়।

বাবার এই হুকুমের ওপর আর কি বলা চলে? আর বলার দরকারই বা কি?

সীমা ভাবে, অচেনা একজন ভদ্রলোক যদি যতীন সেন নামক লোকটার সন্ধান জানতেই চেয়ে থাকে, সীমার কি?

সীমার বুকটা কেঁপে উঠেছিল বলেই তো আর কপার কোনও কারণ ঘটেনি!

অতএব সীমা চুপ করে যাবে। চুপ করে থাকবে। চুপ করিয়েই রেখেছে নিজেকে।

ভিতরটা যখন উত্তাল হয়ে ওঠে, অকারণ খানিকটা কাজ করতে বসে। মোটা রূঢ় কাজ। হয়তো কয়লা ভাঙা, হয়তো সাবান কাঁচা, হয়তো বা উঠোনের মাটি খুঁড়ে গাছ লাগানো।

.

জবর দখল কলোনীতে এই সুখটুকু আছে। মাটির উঠোন! মা বসুমতীর স্পর্শ! গরীবের কাছে এ স্পর্শটুকু পরম মূল্যবান। গরীবের নিত্য আহার্যের তালিকায় যারা আসর জমায়, সেই লাউ কুমড়ো পুঁই শিম, ঢ্যাঁড়স, উচ্ছে, ইত্যাদি আনাজের রাজ্যের সেই সিডিউল কাস্টেরা সহজেই ওই সামান্য, মাটির স্নেহেই জন্মলাভ করতে পারে, বাড়বাড়ন্ত ফসলে মাটির ঋণ শোধ করতে পারে।

মন উত্তাল হয়ে উঠলেই সীমা উঠোনের ওই গাছগুলোর পরিচর্যা করে। ঘোট ভাইটা একদিন বলেছিল–দিদি এত গাছ করিস, রজনীগন্ধা গাছ করবি? আমার একটা বন্ধু বলেছে নিস তো দেব।

সেদিন সীমা হেসে উঠেছিল।

বলেছিল, রজনীগন্ধা? আরে দূর! ওর ডাঁটায় কি চচ্চড়ি রাঁধা যায়?

ছোট ভাই সতেজে বলেছিল, সব জিনিসই কি খেতে হবে? দেখতে ভাল নয় রজনীগন্ধা?

সীমা ওর রাগে হেসেছিল। বলেছিল, দেখতে ভাল জিনিস গরীবের জন্যে নয় রে! গরীবের সব জিনিসই খেতে হয়! সব সব!

.

সে যাক, আপাতত বাইরে কোথাও কেউ একজন যতীন সেন নামক ভদ্রলোকের ঠিকানা খুঁজে বেড়াচ্ছে এবং যতীন সেনের হুকুম হয়েছে কেউ তাকে সে ঠিকানা দেখিয়ে দেবে না।

তা হুকুম আর কার উপর হয়েছে?

মাত্র যতীন সেনের নিজের এক্তারের লোকগুলোর ওপরই তো? কিন্তু কলোনীতে কি আর কোনও লোক নেই? তারা জানে না যতীন সেন কোন্ কুঁড়েটায় থাকে?

অতএব সেই একজন একটু পরেই এই কুঁড়ের উঠোনে এসে দাঁড়ান।

–কে? না বলে কয়ে ভদ্রলোকের বাড়িতে-বলে তেড়ে এগিয়ে এসেই থতমত খেয়ে যায় যতীন সেন।

ভদ্রলোক হাত তুলে নমষ্কার করে হাস্যবদনে বলেন, কী মশাই, কী রাগ আপনার? সেই চলে এলেন আর গেলেন না? আমি এদিকে টাকাটা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

টাকা।

টাকা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে লোকটা?

ইয়ার্কি নাকি? এ আবার একটা নতুন চাল। আর কিছু নয়, ভুলিয়ে বাসা থেকে বার করে নিয়ে পুলিসের হাতে ধরে দেবে! কথায় ভেজাতে এসেছে।

অতএব যতীন সেন ভেজে না, তীব্রস্বরে বলে, দেখুন আমি গরীব, আমি হতভাগা, আমার সঙ্গে ঠাট্টা মস্করা করতে আসবার দরকার আপনার নেই। যেতে পারেন।

ভদ্রলোক পকেট থেকে একগোছা একশো টাকার নোট বার করে এগিয়ে ধরে হেসে বলেন, কী আশ্চর্য, ঠাট্টা করব কেন? কথা হয়েছিল সেদিন—

যতীন সেন সেই মোহময় বস্তুটার দিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে থাকে। কথা বলে না। ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে এগিয়ে ধরে বলেন, নিন।

যতীন আস্তে হাত বাড়ায়।

যতীনের মুখে কথা নেই।

যতীনের স্ত্রী বেড়ার ধার থেকে অনবরত যে ইশারা করছে ভদ্রলোককে যত্ন করে বসাবার জন্যে, সে দিকে দৃষ্টিই নেই যতীনের।

টাকাগুলো সত্যি, না জাল! না কি নম্বরী নোট গছিয়ে দিয়ে ফাঁদ পাতবার ফন্দি! হাত থেকে পড়ে যায় টাকাটা।

নাঃ আপনার দেখছি টাকাকড়ির দরকার নেই। কিন্তু আমি যে সত্যবদ্ধ হয়ে আছি, না নিলে অশান্তিতে মরব।

টাকাটা তুলে নিয়ে এদিক ওদিক তাকান তিনি।–কই আর কেউ আছেন না কি?

যতীন এবার নেয়।

গম্ভীর গলায় বলে,–আপনাকে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

ভদ্রলোক হেসে উঠে বলেন–না পারবেন কেন সেটাই বলুন? কবে কখন আপনার সঙ্গে কি কি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। সেদিন আপনি চটেমটে বেরিয়ে এলেন। টাকাটা নিয়ে এলেন না। অথচ ঠিকানা জানা নেই। খুঁজে খুঁজে কোন মতে

কিন্তু এত আপনি করবেন কেন? সেটাই তো সন্দেহ। নম্বরী নোট গছিয়ে দিয়ে পুলিসে ধরিয়ে দেবেন কিনা কে বলতে পারে?

ভদ্রলোক তবুও হাসেন? যেন খুব একটা মজা দেখছেন

। বলেন, আপনাকে পুলিসে দেবার জন্যে এতসব করতে যাবার তো কথা নয়। বিনা কষ্টেই তো দেওয়া যেত, সেদিন তক্ষুনি। কাজেই বুঝতে পারছেন ওতে আমাদের দরকার নেই। আমাদের যা দরকার সেটাই জানাতে এসেছি।…আমি কলকাতার মানুষ নয়, বাইরের মানুষ, সেই কোন্ দূর দূরান্তরে থাকি। ছুটিতে এসেছিলাম, চলে যাচ্ছি। যাবার সময় আপনার মেয়েটিকে নিয়ে যেতে চাই!

দপ্ করে জ্বলে ওঠে যতীনতার মানে? নিয়ে যেতে চান মানে? কী ভেবেছেন কি?

-নাঃ মশাই ভারি রগচটা আপনি। কথা কয়ে সুখ নেই।…মা লক্ষ্মী, তুমি শোন তো, এস এদিকে।

সীমার হাতে মাটি খোঁড়বার খুরপি, সীমার হাতে কাপড়ে ধুলো মাটি। ভদ্রলোককে দেখে নিথর হয়ে দাঁড়িয়েছিল বেড়ার গা ঘেঁষে। ডাক শুনে শুধু একবার যেন কেঁপে উঠল, কিন্তু নড়ল না।

ভদ্রলোক অতএব নিজেই এগিয়ে যান। বলেন–শোনো! তোমার বাবার কাছে একটা প্রস্তাব করছিলাম, আমি দেরাদুনে ফিরে যাচ্ছি কদিন পরে, যাবার সময় তোমাকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছি, তা তোমার রগচটা বাবা তো মারতেই উঠলেন আমায়, তুমি কি বল?

সীমা নির্নিমেষ দৃষ্টিতে একবার ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে–আমরা গরীব, অভাবে পড়ে অন্যায় করেছি, তার জন্যে যে শাস্তি ন্যায্য তাই দিন। পুলিসেই দিন আমাকে আর আমার বাবাকে। এছাড়া শান্তি পাচ্ছি না আমি।

ভদ্রলোক এবার আস্তে বলেন–শাস্তি তো তোমার হয়ে গেছে মা! এখনো হচ্ছে, হয়েই চলেছে। আর কত শাস্তি চাও?

–আরও অনেক অনেক। সত্যিকার শাস্তি।

ভদ্রলোক আবার হাসেন।

হেসে হেসে বলেন–সত্যিকার শাস্তিই দেওয়া হবে তোমায়। সেই উদ্দেশ্যেই আসা, একেবারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের অর্ডার দিতে এসেছি।

-কী বললেন? সীমা যেন শিউরে ওঠে।

ভদ্রলোক কিন্তু আত্মস্থ–ওই তো বললাম, আমার বাড়িতে যেতে হবে, চিরকালের জন্যে

-না না না!

ভদ্রলোক মৃদু হাস্যে বলেন–আমায় না হয় না বলে ফিলোচ্ছ, সবাইকে পারবে?

–আমায় মাপ করুন, আমায় ক্ষমা করুন–বলে সীমা ছুটে পালিয়ে যায়, আর সীমার বাপ।

যতীন সেন এই দুর্বোধ্য নাটকের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।

তবে বেশিক্ষণ থাকে না, হাতের মধ্যে এসে পড়েছে রাজার ঐশ্বর্য! নগদ পাঁচ হাজার টাকা –একসঙ্গে কবে দেখেছে যতীন সেন? ব্রজনাথ উকিলের কাছে মেয়ে জমা দিয়েও তো নয়।

এই টাকা দিয়ে সে একটা দোকান দেবে, ধীরে ধীরে ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে।…মেয়ের সাহায্যে ভবিষ্যৎ গড়ে তোেলা তো আর হল না।

এ টাকা এখুনি লুকিয়ে ফেলতে হবে।

পাওনাদাররা টের পেলে এক মুঠোও বাকি থাকতে দেবে না, রাক্ষস সংসারের নাগালের মধ্যে এলেও খাবল দিতে আসবে। টাকা বড় ভয়ানক জিনিস। ওর ব্যাপারে মা বাপ ভাই বন্ধু স্ত্রী পুত্র পরিবার কাউকে বিশ্বাস করতে নেই।

কিন্তু কোথায় সেই লুকনো জায়গা?

যতীন সেনের বাড়ি কি তিন মহল? ব্যাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ আছে যতীন সেনের?

গচ্ছিত রাখতে পারে এমন কোনো প্রতিষ্ঠাপন্ন বড়লোক আত্মীয়ের লোহার সিন্ধুক আছে? নিজের দেহের সঙ্গে কতক্ষণ রাখা যায়? চানও তো করতে হবে তাকে?

.

লোহার গেটটার সামনে এসে দাঁড়াল সীমা।

এ বাড়ির লোহার গেটের সামনে গাড়ি থেকে নেমে ভিন্ন কখনো দাঁড়িয়েছে সীমা? দাঁড়ায়নি!

গেট থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠেছে, আবার গাড়ি থেকে নেমে গেটে ঢুকেছে।

শেষ বেরিয়ে গিয়েছিল পায়ে হেঁটে, আজ আবার পায়ে হেঁটেই ঢুকল।

গেটের কাছে এসে দাঁড়াল।

আশ্চর্য! আশ্চর্য!

দারোয়ান শোভাবাহাদুর ঠিক আগের মতই সসম্ভ্রমে অভিবাদন জানিয়ে সরে দাঁড়াল, গেট খুলে দিল।

সীমা কি ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলও?

হয় তো হাসল! হয়তো বা কৃতজ্ঞতার হাসি সেটুকু।

হয়তো বা তৈরি করা!

ভিতরে ঢুকতেও কি মুখে হাসি রাখতে পারবে সীমা? নীচের তলার ঝি চাকরদের সামনে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে পারবে অকুণ্ঠিত দৃঢ় পদক্ষেপে?

তারপর?

সিঁড়ি দিয়ে উঠে?

প্রথম কার সামনে পড়বে?

সে কথা জানে না সীমা। দোতলায় হলে বারান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কি সবাই? না আপন আপন ঘরে নিথর হয়ে বসে আছে?…সিঁড়ির মাঝখানে উঠে পা এত ভারী হয়ে আসছে কেন?

ঝি চাকরগুলোর হতভম্ব দৃষ্টির ভারে?

তবু আশ্বর্য হচ্ছে বৈ কি সীমা। কেউ বাধা দিচ্ছে না তাকে, কেউ কিছু বলছে না।

সীমার অকুণ্ঠিত দৃঢ় পদক্ষেপই কি মূক করে দিয়েছে ওদের?

নইলে এই জালিয়াৎ মেয়েটার স্বরূপ তো উদ্ঘাটিত হয়ে গেছে সকলের কাছেই!

আচ্ছা চোর জোচ্চোর জালিয়াৎ এদের জন্যেও কি ঈশ্বরের কৃপা থাকে? নইলে কারুর মুখোমুখি পড়ল না কেন সীমা? ভারী পর্দা ফেলা নিথর ঘরগুলোর একটা ঘরে নিঃশব্দে ঢুকতে পেল কি করে?

কে? কে? কে?

সুনন্দা চমকে বিছানায় উঠে বসল। দিন দুপুরে কি সে ভূত দেখেছে?

–টুলু!

সুনন্দার অজ্ঞাতসারেই বুঝি কাঁপা কাঁপা গলায় এই নামটা উচ্চারিত হয়।

সীমা এ ভুল ভেঙে দেয় না। সীমা প্রতিবাদ করে ওঠে না, না, আমি সীমা!

সীমা শুধু কাছে এগিয়ে আসে। আস্তে বলে–আমার অসাধ্য কাজ নেই দেখতে পাচ্ছেন তো?

সুনন্দা ব্যাকুল ভাবে বলে–ভাল করে দেখতে পাচ্ছি না! সামনের জানলাটা খুলে দাও তো!

সীমা এগিয়ে গিয়ে রোগীর ঘরের মৃদু অন্ধকারের ছায়া ঠেলে সরিয়ে দেয়, বন্ধ জানলাটা : ঠেলে খুলে দিয়ে।

হঠাৎ মূক হয়ে গেল সুনন্দা।

যেন গলার স্বর বন্ধ হয়ে গেল। একটু আগেই যে কথা বলেছে সে, ভুলে গেল সে কথা। তাকিয়ে রইল শুধু সামনের মানুষটার দিকে।

এখন সীমার কণ্ঠই প্রথমে কাজ করল।

–টাকাটা রাখুন!

টাকা! কিসের টাকা?

সুনন্দা এবার চমকে ওঠে।

–যেটা আপনার দাদা আমার বাবাকে দিয়ে এসেছিলেন।

সুনন্দা এবার আত্মস্থ হয়।

শান্ত ভাবে বলে–ফিরিয়ে নেবার জন্যে কি কেউ দেয়?

–কিন্তু সব দেওয়াই কি নেওয়া যায়?

সুনন্দা নিঃশ্বাস ফেলে বলে–নেবার ইচ্ছে না থাকে বিলিয়ে দিক তোমার বাবা, আমি যা দিয়েছি তা ফেরৎ নিতে পারি না।

সীমার মুখে একটা সূক্ষ্ম হাসি ফুটে ওঠে।

সীমা ব্লাউজের মধ্যে লুকনো টাকার বাণ্ডিলটা বার করে সুনন্দার বিছানার উপর নামিয়ে রেখে বলে, সব সময় কি একথা বলা যায়? কত রকম অবস্থা আসে, দেওয়া জিনিসও ফেরৎ নিতে হয়। সেই ভেবেই নিন–

কী বললি? কী বললি বেইমান নেমকহারাম!

সুনন্দা ডাক্তারের নিষেধ ভুলে বিছানা থেকে নেমে পড়ে একটা হাত বাড়িয়ে সীমার ডান হাতটা চেপে ধরে রুদ্ধ কণ্ঠে বলে–তা তুই বলতে পারিস, তোর মুখে সবই শোভা পায়। দেওয়া জিনিস ফিরিয়ে নিতে যদি পারতাম, তা হলে আমার এই হাল হত না আজ! ফিরিয়ে নিতে পারছি না, সেই ঘেন্নায় মানুষের সমাজে মুখ দেখাতে পারছি না তা জানিস? জানবি না, বুঝবি না, অন্য মাটি দিয়ে গড়া যে তুই!

হাতটা আস্তে ছাড়িয়ে নেয় সীমা।

মৃদু স্বরে বলে–আমি যাই।

-যাবি? এক্ষুনি যাবি? নিষ্ঠুর পাজী মেয়ে! সেদিন সেই যজ্ঞি বাড়ি থেকে না খেয়ে চলে গেলি

হঠাৎ হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে সুনন্দা,–আজ আবার অমনি মুখে চলে যেতে চাস? মানুষের প্রাণ বলে কি কিছু নেই তোর ভেতর?

হঠাৎ মাটিতে বসে পড়ে সীমা।

বলে–তবে দিন কী খেতে দেবেন দিন।

.

সীমা জানে না সুনন্দার শারীরিক অবস্থা কতটা খারাপ, জানে না সুনন্দার বিছানা থেকে ওঠা বারণ, তাই বলে দিন তবে কী খেতে দেবেন দিন।

আর সুনন্দা যখন শাড়ির আঁচল লুটিয়ে টলতে টলতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, তখনো বুঝতে পারে না এটা তার এতদিন পরে প্রথম ওঠা!

সীমা ভাবে ওটা আবেগের প্রতিক্রিয়া।

তাই সীমা নিষ্পলক নেত্রে তাকিয়ে থাকে পাশের দিকের ওই বন্ধ কপাটটার দিকে। সীমা একদা ওই ঘরে বাস করে গেছে। তখন দরজাটা খোলা থাকত। শুধু দরজায় একটা পর্দা ঝুলত। সেটা কখনো স্থির হয়ে পড়ে থাকত দুঘরের মধ্যে ব্যবধান রচনা করে, কখনো বাতাসে উড়ে এঘর ওঘর এক করে দিত।

এখন কপাট পড়ে গেছে।

আর কোনদিন ব্যবধান ঘুচবে না।

ঘুচবে না, ঘোচা সম্ভব নয়, কিন্তু সুনন্দা কেঁদে ওঠে কেন? সে কি কেবলমাত্র সুনন্দার মায়ার মন বলে, আর একটা অভাগা মেয়ে উৎসব আয়োজনের মাঝখান থেকে কিছু খেয়ে যায়নি বলে? একটা পোষা বিড়াল কুকুর তার মুখের খাবার ফেলে চলে গেলে মায়ার মন মানুষের যেমন হয় তেমনি?

.

বন্ধ দরজার ওপিঠে কি এখনো সীমার স্মৃতির কোন অবশিষ্ট আছে? সে ঘরে কি কেউ কোনদিন একবার গিয়ে দাঁড়ায় না? অসতর্কে একটা নিশ্বাস ফেলে না?

সুনন্দার ভাই সীমাকে তার বাপের কাছ থেকে টাকা দিয়ে কিনতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সুনন্দার ভাইপো? নিজে গিয়ে দাঁড়াবার সাহস সংগ্রহ করতে পারে নি বলেই কি এই পথ ধরতে গেছে সে? অভিভাবকদের কৃপার পথ!

সুনন্দা খাবার নিয়ে আসার আগেই কি পালাবে সীমা? আরও একবার প্রমাণিত করবে কত বড় ইতর, অকৃতজ্ঞ, আর হৃদয়হীন সে?

কিন্তু সেই হৃদয়হীনতা প্রমাণিত করবারই বা পথ কোথায় এখন? সুনন্দার খাটের উপর যে পড়ে আছে পাঁচ হাজার টাকার নোটর বাণ্ডিল! সুনন্দার কান্নায় বিচলিত না হলেই হত, পালালেই হত। কে জানে, এখন যে লোকটা বাড়ি নেই, সে লোকটা হঠাৎ এসে পড়বে কিনা।

কী করবে তখন সীমা?

.

সুনন্দা ধরা পড়ল ফ্রিজিডেয়ারের সামনে!

সীমা উপরে উঠে আসার ক্ষণকাল পরেই–বলাই বাহুল্য নীচের তলার দাসী চাকরগুলো উঠে এসেছিল, এবং উঁকিঝুঁকি মারছিল, তারপর হেড় ঝি মানদা উদ্দালকের মায়ের কাছে গিয়ে এই রসালো খবরটা পরিবেশন করেছিল। তিনি শুনেই উদগ্র কৌতূহলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়ে থতমত খেয়ে দাঁড়ালেন।

সুনন্দা ফ্রিজিডেয়ার খুলে একটা বড় প্লেট নিয়ে খাবার সাজাচ্ছে। যা পাচ্ছে সামনে, সব নিচ্ছে।

থতমত খাওয়ার পর শিউরে উঠলেন মহিলাটি।–ঠাকুরঝি তুমি উঠে এসেছ, ব্যাপার কি?

সুনন্দা চোখের ইশারায় কাতর মিনতি জানায় চুপ করবার জন্যে। আর পশ্চাদবর্তিনী মানদাকে কঠোর স্বরে বলে ওঠে–এখানে গুলতানি করছিস কেন? যা নীচে যা! কারুর থাকবার দরকার নেই ওপরে! রাধা কি করছিস ওখানে? যা, যা চলে যা!

উদ্দালকের মা ঠাণ্ডা গলায় বলেন–আমিও কি নেমে যাব ঠাকুরঝি?

কী আশ্চর্য! কী বলছ বৌদি! আমি–মানে, শুধু মানে মেয়েটা লজ্জা পাবে তাই, দোহাই তোমায় পরে সব বলব

-তা আমার হাতেই দাও না হয় ওটা? সব সুদ্ধ পড়ে যাবে শেষটা

না না না,–সুনন্দা চাপা ব্যাকুল কণ্ঠে বলে কিছু হবে না আমার, আর কিছু হবে না। শুধু একবারটি ও আমার হাতে খাক।

তাকিয়ে দেখে না তার বৌদি কোন্ অবস্থায় দাঁড়িয়ে পড়েছেন।

সেই যথেচ্ছ খাবারের রাশি এনে নামিয়ে দেয় সুনন্দা সীমার সামনে। ধপ করে বসে পড়ে বলে–সব খেতে হবে তোকে আমার সামনে বসে বসে।

.

কিন্তু এই ঘরের দরজায় ঝুলে থাকা পর্দাটার ওপারে তখন সমুদ্র কল্লোল। কারও মতে, সেই মেয়েটা চুপি চুপি এসে মায়াকান্না কেঁদে সুনন্দার কাছ থেকে বাগিয়ে ফেলেছে টাকার গাদা, তার ওপর আবার চব্যচোষ্য খেতে বসেছে। নোটগুলোকে অবশ্য জানলার বাইরে থেকে দশটাকারই ভেবেছে তারা। কিন্তু তাই কি কম?

অন্যদলের মতে, চুপিসাড়ে এসেছিল চুরির মতলবে। কোথায় চাবি, কোথায় আলমারি, সন্ধান তো নিয়ে গেছে সব কিছুর। তা নিয়ে-টিয়ে হঠাৎ ধরা পড়ে গেছে। নিদ্রাভিভূতা সুনন্দার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেছে। অতএব আর কি করবে কান্না ছাড়া? খাবারের থালার সামনে বসে তাই কেঁদেই চলেছে। তা সুনন্দাও চালাকি করেছে, খাবার খাওয়ানোর ছুতো করে আটকে ফেলেছে একটু, এখন দাদাবাবু কি মামাবাবু কেউ একজন এলে হয়।

.

সমুদ্র কল্লোল, কিন্তু চাপা।

আমাদের যদি বলে, তোদের চোখের সামনে দিয়ে উঠে গেল ধরলি না? আমরা বলব আমাদের কী দোষ, ওই বাহাদুর মুখপোড়া ঢুকতে দিয়েছে কেন….আমরা বলব আমরা চোক্ষেও দেখিনি।….কিন্তু আশ্চয্যি, আমাদের চোখে যেন ধুলোপড়া দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল।….

মামীমাও নেমে এসেছেন, যোগ দিয়েছেন তাদের সঙ্গে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছেন, কখন এল, প্রথম কে দেখল….ইত্যাদি। এই দৃশ্যের মাঝখানে নাটকের নায়কের প্রবেশ!

–কী ব্যাপার? হঠাৎ এমন গোলটেবিল বৈঠকের কারণ? মা, মন্ত্রণালয়টা তো তেমন সুবিধেজনক জায়গায় হয়নি। চল চল ওপরে চল, সোফায় বসে আরাম করে ঘটনার বিবরণ শুনি।

উদ্দালকের মা ঝিয়েদের সঙ্গে আলাপমগ্ন অবস্থায় ছেলের চোখে পড়ে যাওয়ায় বিশেষ বিরক্তি বোধ করলেও, চেপে গিয়ে বলেন–ঘটনা আবার কি?

–আহা একটা কিছু নিশ্চয়! পিসিমার শরীর ঠিক আছে তো?

–শরীর ঠিকই আছে, মাথাটাই যা বেঠিক হয়ে গেছে–বলে উঠে যান ভদ্রমহিলা।

পিছু পিছু উদ্দালকও। কিছু যেন একটা অনুমান করছে সে।

না, অনুমান ভুল নয়।

সুনন্দার পাশেই বসে পড়ে বলে ওঠে উদ্দালক–যা ভেবেছি বর্ণে বর্ণে সত্য।

কী অনুমান, কী সত্যিসুনন্দা ব্যাকুলভাবে বলে–তুই আবার এখন এলি কেন? একেই তো মেয়েটা এককণাও মুখে তুলতে পারছে না! তুই যা বাপু!

–তবে যাই।

–কিন্তু কি যেন অনুমান করছিলি বললি?

–অনুমান করতে করতে আসছিলাম, ঠিক এমনি একটা দৃশ্য দেখতে পাব গিয়ে। কারণ এইমাত্র জবরদখল কলোনীর যতীনবাবুর ওখান থেকে আসছি কিনা?

-কোথা থেকে? কোথা থেকে আসছেন?–সীমা চোখের জল সমেত চোখটাই তুলে চমকে প্রশ্ন করে–কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?

–ওই তো বললাম। গিয়ে দেখলাম কন্যাহারা পিতা বুক চাপড়ে কাঁদছেন, এবং হারানো কন্যার প্রতি অভিশাপের স্রোত বহাচ্ছেন।

-কি বলছিস দুলু? খুলে বল।

আর খুলে বলা! যতীনবাবুর অকৃতজ্ঞ কন্যা নাকি বাবার সদ্য-লব্ধ কয়েক হাজার টাকা চুরি করে উধাও হয়ে গেছে, তাই স্নেহময় পিতা তার উদ্দেশে কিছু স্নেহবাণী বর্ষণ করছেন, এ হেন সময় আমি সেখানে গিয়ে উপস্থিত।….উঃ অনেক কষ্টে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছি, আর একটু হলেই ইট খেয়ে এই অমূল্য প্রাণটি বিনষ্ট হত!..কিন্তু পিসিমা, সংসারের সব খাবারগুলোই কি ওই অপাত্রের পাত্রে ঢালতে হয়? আমিও তো রয়েছি একটা সুপাত্র–

সুনন্দার মুখটা সহসা একটা নতুন আলোয় ভরে ওঠে। সুনন্দা সেই আলোভরা মুখে বলে– তোর মতন সুপাত্রের জন্যে অন্য জিনিস রেখেছি।…কিন্তু টুলু, শুধু জালিয়াতি নয়, চুরিতেও ওস্তাদ তুই! বাবার বাক্স থেকে টাকা চুরি করে নিয়ে এসেছিস আরও আপনার লোকেদের দিবি বলে?

–মা!

উঁহু মা নয়, আর মা নয়। মায়ার জালে আর নয়, এখন পিসিমা! শুধু পিসিমা!

সীমার চোখের জল কি শুকিয়ে গেছে?

সীমার গলায় জোর এল কি করে?

–তুমি কিন্তু আমায় টুলু বলছ মা!

–বলব, বেশ করব! আমার খুশি আমি টুলু বলব তোকে। দুলু আর একবার তোকে যেতে হবে সেখানে, চল আমিও যাব। চোরাই টাকাটা ফেরৎ দিয়ে বলিগে সেই হতভাগাটাকে, মেয়েকে আর তুমি পাচ্ছ না!

–তুমি যাবে?

–যাবই তো।

–খুনের দায়ে ফাঁসিতে লটকাতে চাও আমায়?

–ফাঁসিতে নয়, ফাঁসে। যে ফাঁস নিজে বসে বসে বানিয়ে রেখেছিস! আর আমার কিচ্ছু হবে না রে দুলু! চল্ ওঠ!

Exit mobile version