কী করবে তখন সীমা?
.
সুনন্দা ধরা পড়ল ফ্রিজিডেয়ারের সামনে!
সীমা উপরে উঠে আসার ক্ষণকাল পরেই–বলাই বাহুল্য নীচের তলার দাসী চাকরগুলো উঠে এসেছিল, এবং উঁকিঝুঁকি মারছিল, তারপর হেড় ঝি মানদা উদ্দালকের মায়ের কাছে গিয়ে এই রসালো খবরটা পরিবেশন করেছিল। তিনি শুনেই উদগ্র কৌতূহলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়ে থতমত খেয়ে দাঁড়ালেন।
সুনন্দা ফ্রিজিডেয়ার খুলে একটা বড় প্লেট নিয়ে খাবার সাজাচ্ছে। যা পাচ্ছে সামনে, সব নিচ্ছে।
থতমত খাওয়ার পর শিউরে উঠলেন মহিলাটি।–ঠাকুরঝি তুমি উঠে এসেছ, ব্যাপার কি?
সুনন্দা চোখের ইশারায় কাতর মিনতি জানায় চুপ করবার জন্যে। আর পশ্চাদবর্তিনী মানদাকে কঠোর স্বরে বলে ওঠে–এখানে গুলতানি করছিস কেন? যা নীচে যা! কারুর থাকবার দরকার নেই ওপরে! রাধা কি করছিস ওখানে? যা, যা চলে যা!
উদ্দালকের মা ঠাণ্ডা গলায় বলেন–আমিও কি নেমে যাব ঠাকুরঝি?
কী আশ্চর্য! কী বলছ বৌদি! আমি–মানে, শুধু মানে মেয়েটা লজ্জা পাবে তাই, দোহাই তোমায় পরে সব বলব
-তা আমার হাতেই দাও না হয় ওটা? সব সুদ্ধ পড়ে যাবে শেষটা
না না না,–সুনন্দা চাপা ব্যাকুল কণ্ঠে বলে কিছু হবে না আমার, আর কিছু হবে না। শুধু একবারটি ও আমার হাতে খাক।
তাকিয়ে দেখে না তার বৌদি কোন্ অবস্থায় দাঁড়িয়ে পড়েছেন।
সেই যথেচ্ছ খাবারের রাশি এনে নামিয়ে দেয় সুনন্দা সীমার সামনে। ধপ করে বসে পড়ে বলে–সব খেতে হবে তোকে আমার সামনে বসে বসে।
.
কিন্তু এই ঘরের দরজায় ঝুলে থাকা পর্দাটার ওপারে তখন সমুদ্র কল্লোল। কারও মতে, সেই মেয়েটা চুপি চুপি এসে মায়াকান্না কেঁদে সুনন্দার কাছ থেকে বাগিয়ে ফেলেছে টাকার গাদা, তার ওপর আবার চব্যচোষ্য খেতে বসেছে। নোটগুলোকে অবশ্য জানলার বাইরে থেকে দশটাকারই ভেবেছে তারা। কিন্তু তাই কি কম?
অন্যদলের মতে, চুপিসাড়ে এসেছিল চুরির মতলবে। কোথায় চাবি, কোথায় আলমারি, সন্ধান তো নিয়ে গেছে সব কিছুর। তা নিয়ে-টিয়ে হঠাৎ ধরা পড়ে গেছে। নিদ্রাভিভূতা সুনন্দার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেছে। অতএব আর কি করবে কান্না ছাড়া? খাবারের থালার সামনে বসে তাই কেঁদেই চলেছে। তা সুনন্দাও চালাকি করেছে, খাবার খাওয়ানোর ছুতো করে আটকে ফেলেছে একটু, এখন দাদাবাবু কি মামাবাবু কেউ একজন এলে হয়।
.
সমুদ্র কল্লোল, কিন্তু চাপা।
আমাদের যদি বলে, তোদের চোখের সামনে দিয়ে উঠে গেল ধরলি না? আমরা বলব আমাদের কী দোষ, ওই বাহাদুর মুখপোড়া ঢুকতে দিয়েছে কেন….আমরা বলব আমরা চোক্ষেও দেখিনি।….কিন্তু আশ্চয্যি, আমাদের চোখে যেন ধুলোপড়া দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল।….
মামীমাও নেমে এসেছেন, যোগ দিয়েছেন তাদের সঙ্গে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছেন, কখন এল, প্রথম কে দেখল….ইত্যাদি। এই দৃশ্যের মাঝখানে নাটকের নায়কের প্রবেশ!
–কী ব্যাপার? হঠাৎ এমন গোলটেবিল বৈঠকের কারণ? মা, মন্ত্রণালয়টা তো তেমন সুবিধেজনক জায়গায় হয়নি। চল চল ওপরে চল, সোফায় বসে আরাম করে ঘটনার বিবরণ শুনি।
উদ্দালকের মা ঝিয়েদের সঙ্গে আলাপমগ্ন অবস্থায় ছেলের চোখে পড়ে যাওয়ায় বিশেষ বিরক্তি বোধ করলেও, চেপে গিয়ে বলেন–ঘটনা আবার কি?
–আহা একটা কিছু নিশ্চয়! পিসিমার শরীর ঠিক আছে তো?
–শরীর ঠিকই আছে, মাথাটাই যা বেঠিক হয়ে গেছে–বলে উঠে যান ভদ্রমহিলা।
পিছু পিছু উদ্দালকও। কিছু যেন একটা অনুমান করছে সে।
না, অনুমান ভুল নয়।
সুনন্দার পাশেই বসে পড়ে বলে ওঠে উদ্দালক–যা ভেবেছি বর্ণে বর্ণে সত্য।
কী অনুমান, কী সত্যিসুনন্দা ব্যাকুলভাবে বলে–তুই আবার এখন এলি কেন? একেই তো মেয়েটা এককণাও মুখে তুলতে পারছে না! তুই যা বাপু!
–তবে যাই।
–কিন্তু কি যেন অনুমান করছিলি বললি?
–অনুমান করতে করতে আসছিলাম, ঠিক এমনি একটা দৃশ্য দেখতে পাব গিয়ে। কারণ এইমাত্র জবরদখল কলোনীর যতীনবাবুর ওখান থেকে আসছি কিনা?
-কোথা থেকে? কোথা থেকে আসছেন?–সীমা চোখের জল সমেত চোখটাই তুলে চমকে প্রশ্ন করে–কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?
–ওই তো বললাম। গিয়ে দেখলাম কন্যাহারা পিতা বুক চাপড়ে কাঁদছেন, এবং হারানো কন্যার প্রতি অভিশাপের স্রোত বহাচ্ছেন।
-কি বলছিস দুলু? খুলে বল।
আর খুলে বলা! যতীনবাবুর অকৃতজ্ঞ কন্যা নাকি বাবার সদ্য-লব্ধ কয়েক হাজার টাকা চুরি করে উধাও হয়ে গেছে, তাই স্নেহময় পিতা তার উদ্দেশে কিছু স্নেহবাণী বর্ষণ করছেন, এ হেন সময় আমি সেখানে গিয়ে উপস্থিত।….উঃ অনেক কষ্টে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছি, আর একটু হলেই ইট খেয়ে এই অমূল্য প্রাণটি বিনষ্ট হত!..কিন্তু পিসিমা, সংসারের সব খাবারগুলোই কি ওই অপাত্রের পাত্রে ঢালতে হয়? আমিও তো রয়েছি একটা সুপাত্র–
সুনন্দার মুখটা সহসা একটা নতুন আলোয় ভরে ওঠে। সুনন্দা সেই আলোভরা মুখে বলে– তোর মতন সুপাত্রের জন্যে অন্য জিনিস রেখেছি।…কিন্তু টুলু, শুধু জালিয়াতি নয়, চুরিতেও ওস্তাদ তুই! বাবার বাক্স থেকে টাকা চুরি করে নিয়ে এসেছিস আরও আপনার লোকেদের দিবি বলে?
–মা!
উঁহু মা নয়, আর মা নয়। মায়ার জালে আর নয়, এখন পিসিমা! শুধু পিসিমা!
সীমার চোখের জল কি শুকিয়ে গেছে?
সীমার গলায় জোর এল কি করে?
–তুমি কিন্তু আমায় টুলু বলছ মা!