সীমা কি ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলও?
হয় তো হাসল! হয়তো বা কৃতজ্ঞতার হাসি সেটুকু।
হয়তো বা তৈরি করা!
ভিতরে ঢুকতেও কি মুখে হাসি রাখতে পারবে সীমা? নীচের তলার ঝি চাকরদের সামনে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে পারবে অকুণ্ঠিত দৃঢ় পদক্ষেপে?
তারপর?
সিঁড়ি দিয়ে উঠে?
প্রথম কার সামনে পড়বে?
সে কথা জানে না সীমা। দোতলায় হলে বারান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কি সবাই? না আপন আপন ঘরে নিথর হয়ে বসে আছে?…সিঁড়ির মাঝখানে উঠে পা এত ভারী হয়ে আসছে কেন?
ঝি চাকরগুলোর হতভম্ব দৃষ্টির ভারে?
তবু আশ্বর্য হচ্ছে বৈ কি সীমা। কেউ বাধা দিচ্ছে না তাকে, কেউ কিছু বলছে না।
সীমার অকুণ্ঠিত দৃঢ় পদক্ষেপই কি মূক করে দিয়েছে ওদের?
নইলে এই জালিয়াৎ মেয়েটার স্বরূপ তো উদ্ঘাটিত হয়ে গেছে সকলের কাছেই!
আচ্ছা চোর জোচ্চোর জালিয়াৎ এদের জন্যেও কি ঈশ্বরের কৃপা থাকে? নইলে কারুর মুখোমুখি পড়ল না কেন সীমা? ভারী পর্দা ফেলা নিথর ঘরগুলোর একটা ঘরে নিঃশব্দে ঢুকতে পেল কি করে?
কে? কে? কে?
সুনন্দা চমকে বিছানায় উঠে বসল। দিন দুপুরে কি সে ভূত দেখেছে?
–টুলু!
সুনন্দার অজ্ঞাতসারেই বুঝি কাঁপা কাঁপা গলায় এই নামটা উচ্চারিত হয়।
সীমা এ ভুল ভেঙে দেয় না। সীমা প্রতিবাদ করে ওঠে না, না, আমি সীমা!
সীমা শুধু কাছে এগিয়ে আসে। আস্তে বলে–আমার অসাধ্য কাজ নেই দেখতে পাচ্ছেন তো?
সুনন্দা ব্যাকুল ভাবে বলে–ভাল করে দেখতে পাচ্ছি না! সামনের জানলাটা খুলে দাও তো!
সীমা এগিয়ে গিয়ে রোগীর ঘরের মৃদু অন্ধকারের ছায়া ঠেলে সরিয়ে দেয়, বন্ধ জানলাটা : ঠেলে খুলে দিয়ে।
হঠাৎ মূক হয়ে গেল সুনন্দা।
যেন গলার স্বর বন্ধ হয়ে গেল। একটু আগেই যে কথা বলেছে সে, ভুলে গেল সে কথা। তাকিয়ে রইল শুধু সামনের মানুষটার দিকে।
এখন সীমার কণ্ঠই প্রথমে কাজ করল।
–টাকাটা রাখুন!
টাকা! কিসের টাকা?
সুনন্দা এবার চমকে ওঠে।
–যেটা আপনার দাদা আমার বাবাকে দিয়ে এসেছিলেন।
সুনন্দা এবার আত্মস্থ হয়।
শান্ত ভাবে বলে–ফিরিয়ে নেবার জন্যে কি কেউ দেয়?
–কিন্তু সব দেওয়াই কি নেওয়া যায়?
সুনন্দা নিঃশ্বাস ফেলে বলে–নেবার ইচ্ছে না থাকে বিলিয়ে দিক তোমার বাবা, আমি যা দিয়েছি তা ফেরৎ নিতে পারি না।
সীমার মুখে একটা সূক্ষ্ম হাসি ফুটে ওঠে।
সীমা ব্লাউজের মধ্যে লুকনো টাকার বাণ্ডিলটা বার করে সুনন্দার বিছানার উপর নামিয়ে রেখে বলে, সব সময় কি একথা বলা যায়? কত রকম অবস্থা আসে, দেওয়া জিনিসও ফেরৎ নিতে হয়। সেই ভেবেই নিন–
কী বললি? কী বললি বেইমান নেমকহারাম!
সুনন্দা ডাক্তারের নিষেধ ভুলে বিছানা থেকে নেমে পড়ে একটা হাত বাড়িয়ে সীমার ডান হাতটা চেপে ধরে রুদ্ধ কণ্ঠে বলে–তা তুই বলতে পারিস, তোর মুখে সবই শোভা পায়। দেওয়া জিনিস ফিরিয়ে নিতে যদি পারতাম, তা হলে আমার এই হাল হত না আজ! ফিরিয়ে নিতে পারছি না, সেই ঘেন্নায় মানুষের সমাজে মুখ দেখাতে পারছি না তা জানিস? জানবি না, বুঝবি না, অন্য মাটি দিয়ে গড়া যে তুই!
হাতটা আস্তে ছাড়িয়ে নেয় সীমা।
মৃদু স্বরে বলে–আমি যাই।
-যাবি? এক্ষুনি যাবি? নিষ্ঠুর পাজী মেয়ে! সেদিন সেই যজ্ঞি বাড়ি থেকে না খেয়ে চলে গেলি
হঠাৎ হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে সুনন্দা,–আজ আবার অমনি মুখে চলে যেতে চাস? মানুষের প্রাণ বলে কি কিছু নেই তোর ভেতর?
হঠাৎ মাটিতে বসে পড়ে সীমা।
বলে–তবে দিন কী খেতে দেবেন দিন।
.
সীমা জানে না সুনন্দার শারীরিক অবস্থা কতটা খারাপ, জানে না সুনন্দার বিছানা থেকে ওঠা বারণ, তাই বলে দিন তবে কী খেতে দেবেন দিন।
আর সুনন্দা যখন শাড়ির আঁচল লুটিয়ে টলতে টলতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, তখনো বুঝতে পারে না এটা তার এতদিন পরে প্রথম ওঠা!
সীমা ভাবে ওটা আবেগের প্রতিক্রিয়া।
তাই সীমা নিষ্পলক নেত্রে তাকিয়ে থাকে পাশের দিকের ওই বন্ধ কপাটটার দিকে। সীমা একদা ওই ঘরে বাস করে গেছে। তখন দরজাটা খোলা থাকত। শুধু দরজায় একটা পর্দা ঝুলত। সেটা কখনো স্থির হয়ে পড়ে থাকত দুঘরের মধ্যে ব্যবধান রচনা করে, কখনো বাতাসে উড়ে এঘর ওঘর এক করে দিত।
এখন কপাট পড়ে গেছে।
আর কোনদিন ব্যবধান ঘুচবে না।
ঘুচবে না, ঘোচা সম্ভব নয়, কিন্তু সুনন্দা কেঁদে ওঠে কেন? সে কি কেবলমাত্র সুনন্দার মায়ার মন বলে, আর একটা অভাগা মেয়ে উৎসব আয়োজনের মাঝখান থেকে কিছু খেয়ে যায়নি বলে? একটা পোষা বিড়াল কুকুর তার মুখের খাবার ফেলে চলে গেলে মায়ার মন মানুষের যেমন হয় তেমনি?
.
বন্ধ দরজার ওপিঠে কি এখনো সীমার স্মৃতির কোন অবশিষ্ট আছে? সে ঘরে কি কেউ কোনদিন একবার গিয়ে দাঁড়ায় না? অসতর্কে একটা নিশ্বাস ফেলে না?
সুনন্দার ভাই সীমাকে তার বাপের কাছ থেকে টাকা দিয়ে কিনতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সুনন্দার ভাইপো? নিজে গিয়ে দাঁড়াবার সাহস সংগ্রহ করতে পারে নি বলেই কি এই পথ ধরতে গেছে সে? অভিভাবকদের কৃপার পথ!
সুনন্দা খাবার নিয়ে আসার আগেই কি পালাবে সীমা? আরও একবার প্রমাণিত করবে কত বড় ইতর, অকৃতজ্ঞ, আর হৃদয়হীন সে?
কিন্তু সেই হৃদয়হীনতা প্রমাণিত করবারই বা পথ কোথায় এখন? সুনন্দার খাটের উপর যে পড়ে আছে পাঁচ হাজার টাকার নোটর বাণ্ডিল! সুনন্দার কান্নায় বিচলিত না হলেই হত, পালালেই হত। কে জানে, এখন যে লোকটা বাড়ি নেই, সে লোকটা হঠাৎ এসে পড়বে কিনা।