দোকান থেকে এসে বললেন, এক গ্লাস জল দাও। বললেন, শরীরটা কেমন করছে।
ব্যস। তাকিয়েও দেখে গেলেন না সুনন্দার দিকে। ভেবেও দেখলেন না এতবড় বাড়িটায় একা সুনন্দা থাকবে কি করে?
কিন্তু সেদিন, সেই আগেকার দিনে সুনন্দার জন্যে ভাবনার অন্ত ছিল না শোভনের। নিজের শোককে চাপা দিয়ে, সুনন্দার সমস্ত অভিযোগে অবিচলিত থেকে সুনন্দার সঙ্গে সঙ্গে থেকেছেন। নীরব সান্ত্বনায় ভরিয়ে রেখেছেন তাকে।
তবু অবিরত একটা অভিযোগের ভাব মনে পোষণ করে এসেছে সুনন্দা টুলুর প্রতি শোভনের যথোপযুক্ত টান ছিল না, তাই ভগবান টুলুকে নিয়ে নিয়েছেন।
বেচারা শোভন হয়তো নীরবই থেকেছে, হয়ত বা কখনও বলেছে, ভগবান নেননি সুনন্দা। নিয়েছে মানুষ।
মানুষের কি সাধ্যি? ভেঙে পড়েছে সুনন্দা যদি ভগবান না বিমুখ হন?
শোভন কোনদিন একথা বলে নি, কিন্তু সুনন্দা, তোমার ভালবাসাটা কি তাহলে একেবারে মূল্যহীন? তোমার ত্রুটিহীন ভালবাসার সাধ্য হল না ঈশ্বরকে প্রসন্ন রাখতে?
তখন যে সুনন্দা শুধু কাঁদে। তখন তো আর সেই আগের সুনন্দা নয়।
কিন্তু যখন আগের ছিল? সেদিন ছুটে ছুটে এসে শোভনকে ঠেলা মেরে সচেতন করে তুলে বলেছিল, কালকের সেই লাল শাটিনটা ফ্রক করে ফেললাম। দেখ–দেখ কী মার্ভেলাস দেখাচ্ছে টুলাকে!
সেই ফ্রক পরে বেড়াতে গিয়েছিল টুলু চাকরের সঙ্গে।
এ বাড়ির আরও সব চেঞ্জার প্রতিবেশীদের বাসার কাছাকাছি নিয়ে বেড়াবার হুকুম দিয়েছিল সুনন্দা।
দেখুক, সবাই দেখুক তার টুলুকে। নজর লাগাকে বিশ্বাস করে না সে।
কিন্তু সেদিন কেউ কি দেখেছিল সেই লাল শাটিনের আবরণে মোড়া গোলগাল পুতুলটিকে?
না, কেউ সাক্ষী দিতে পারে নি, টুলু আর টুলুর চাকরকে দেখেছে।
বাতাস হয়ে উড়ে গেল চাকরটা? মন্ত্রবলে অদৃশ্য হয়ে গেল?
.
ছেলে হারানোর ঘটনা পৃথিবীতে নতুন নয়। কত রকম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই এ ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু নতুন নয় বলে কি মাতৃহৃদয়ের হাহাকার কিছু কম হয়?
তবু সে হাহাকারের ওপর হয়তো স্তর পড়ে নতুন শিশুর আবির্ভাবে। হারিয়ে যাওয়া সন্তানের তুলে রাখা জামা জুতো খেলনা পুতুলগুলি আবার মাটিতে নামে গভীরতর নিশ্বাসের মধ্য দিয়ে। যেসব বস্তু তাকে দিয়ে উঠতে পারা যায় নি, দেওয়া হয়নি, সে বস্তু সংগ্রহ করে এনে একে দিতে পারলেও যেন একটা শান্তি আসে। কথা প্রসঙ্গে একটি নিশ্বাসের সঙ্গে তার নামটুকু উচ্চারণ করা ছাড়া আর বড় কিছু থাকে না। কিন্তু সুনন্দার জীবনে আর নতুন শিশুর আবির্ভাব ঘটল না।
তাই উনিশ বছর ধরে সেই লাল শাটিনের ফ্রকটি সুনন্দার মনের মধ্যে জীবন্ত হয়ে আছে একটি রক্তাক্ত বিদারণ রেখা টেনে রেখে।
ডাক্তার বলেছিল, আর আশা নেই। প্রথম সন্তানের জন্মকালে ভিতরের যন্ত্র বিকল হয়ে গেছে। আশ্চর্য, সেই বিকলযন্ত্র দেহ আর বিকল মনটাকে নিয়ে অনায়াসে বেঁচে রইল সুনন্দা। আর শোভন রায় তাঁর অপরিসীম কর্মক্ষমতা আর অটুট স্বাস্থ্য নিয়েও ফেল করলেন হার্ট।
শোভন বেঁচে থাকতেও ইদানীং কাজ-কারবার বিষয়-সম্পত্তি সবকিছুর দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিলেন শুধু উকিল নয় ম্যানেজার ব্রজনাথকে। শোভন মারা যেতে তো আরোই দায়িত্ব পড়ল। সুনন্দা তো তাকিয়ে দেখা দূরে থাক, কানেও শোনে না। শোনাতে এলে শুনতে চায় না।
প্রথম প্রথম ভারি বিপন্ন বোধ করতেন ব্রজনাথ। বলতেন, আপনি এভাবে আমার সঙ্গে নন কোঅপারেশন করলে আমার কি অবস্থা হয় বলুন তো?
সুনন্দা বলত–ধরে নিন আমিও মারা গেছি!
অদ্ভুত অবস্থায় কেটে গেছে ব্রজনাথের সেই দিনগুলো।
সামান্য একটা সই করাবার দরকার হলেও সুনন্দার কাছে সাতবার আর্জি করতে হত।
দাসী কখনো এসে বলত, মা ঘুমোচ্ছেন। কখনো বলত, ডাকতে পারলাম না, কাঁদছেন। কখনো বলত, দরজায় খিল লাগিয়ে বসে আছেন, একশো ডাকাডাকিতেও খুললেন না।
অবশেষে একদিন ক্ষুব্ধ প্রশ্ন করলেন ব্রজনাথআপনি কি আমাকে অবিশ্বাস করেন মিসেস রায়?
অবিশ্বাস!
তা ছাড়া আর কি বলি বলুন? এক একটি সাইনের জন্যে এত অসুবিধেয় পড়তে হয় মাঝে মাঝে, নিশ্বাস ফেললেন ব্রজনাথ, আপনার দোকানের কর্মচারীরা কী যে ভাবে! যথাসময়ে মাইনে দেওয়াও সম্ভব হয়ে ওঠে না–
লজ্জিত হয়ে উঠেছিল সুনন্দা। মরমে মরে গিয়েছিল।
ছি ছি, নিজের শোককে নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছেকে এত বড় করে তুলে যথেচ্ছাচার করেছে সে। কিন্তু তা করলে চলবে কেন? সত্যিই যখন সে যথাসর্বস্ব মিশনে দান করে দিয়ে সন্ন্যাসিনী হয়ে চলে যাচ্ছে না।
চিরদিন বিলাসে অভ্যস্ত জীবন, কৃচ্ছসাধনের স্বরূপই জানে না ভাল করে। সে দিন থেকে চৈতন্য হল সুনন্দার।
বিনা বাক্যে, বিনা বিলম্বে ব্রজনাথের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে শুরু করল। কিন্তু সে কাজে কর্তব্য পালনই হয়, দিনের শূন্যতা পূর্ণ হয় না।
ক্রমশই অসহনীয় হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গতা।
একদিন ব্রজনাথকে ডেকে পাঠাল সুনন্দা। বলল, আর তো টিকতে পারছি না। ভাবছি আমার এক ভাইপোকে এনে কাছে রাখি।
ব্রজনাথ একটু চিন্তিত হয়ে বলেন, রাখবেন, সে তো খুবই ভাল কথা, কিন্তু একটা বাচ্ছার দায়িত্ব
সুনন্দা একটু হাসল। বাচ্ছা নয়।
বাচ্ছা নয়? তবে?
এঞ্জিনীয়ারিং পড়ছে।
ব্রজনাথের চোখে একটা ধূসর ছায়া পড়ল। কিন্তু কণ্ঠস্বর ছায়ামুক্ত, বরং যেন উৎফুল্ল।