ঢোক গিলেছিলেন ব্রজনাথ, তারপর আরও শান্তস্বরে বলেছিলেন সেও আতঙ্কিত হবে। …এটাই ভাল হবে যে একটা দিন সময় পাবেন আপনি, মনকে প্রস্তুত করতে। কাল আসবে সে আমার সঙ্গে।
তখন সুনন্দা ব্যাকুল হয়েছিল, উদ্ভ্রান্তের মত বলেছিল–না না, আজই আনুন তাকে।
ব্রজনাথ তা আনেন নি। ব্রজনাথ বুঝিয়েছিলেন তাতে সুনন্দার ক্ষতিই হবে। কারণ সে যদি এত আবেগ এত ব্যাকুলতা দেখে ভয় পায়, হয়তো সহজে কাছে আসতে পারবে না।
একটা দিন সময় নিয়েছিলেন ব্রজনাথ, আজ এনেছেন সীমাকে।
তার পালয়িত্রী মা যে নাম দিয়েছিল তাকে সেই নামেই এসে দাঁড়িয়েছে সে। কিন্তু সুনন্দার দেওয়া, ওর নিজের মা-র দেওয়া যে একটা নাম ছিল, সেটা কি মুছে গেছে? একেবারে ভুলে গেছে সুনন্দা?
না। সুনন্দার অস্থিমজ্জায় দেহের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে মিশে আছে সে নাম। সেই নাম বহাল হবে আজ থেকে সীমার।
সেই নামেই প্রথম ডাকল সুনন্দা।
যখন তার থরথর করা বুক একটু স্থির হল, যখন তার কথা বলবার সহজ স্বর ফিরে এল, তখন সোফা থেকে উঠে ওর কাছে এসে দাঁড়িয়ে দুটি হাত ওর দুকাঁধে রেখে বলল, তুই আমার কাছে আসতে ভয় পাচ্ছিস? তুই যে আমার টুলু। আমার টুলা।
ব্রজনাথ উদ্বেলিত হয়ে উঠছেন, ব্রজনাথ চেয়ারে স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছেন না। ব্রজনাথ উঠে দাঁড়ালেন। গলা থেকে কেমন একটা শব্দ উঠল।
যেন এই মুহূর্তটাকে একটা নাট্যমুহূর্তে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে ভিতরটা নিসপিস করছে ব্রজনাথের। ব্রজনাথ কি সীমাকে ঠেলে পাঠিয়ে দেবেন সুনন্দার বাহুবন্ধনের মধ্যে?
দিতে হল না। প্রাকৃতিক নিয়মেই গড়ে উঠল নাট্যমুহূর্ত। সীমা সুনন্দার বুকে এলিয়ে পড়ল।
সুনন্দা সীমাকে সেই বুকের মধ্যে মিলিয়ে নিতে চাইল। বুঝি বা পিষে ফেলতে চাইল। –টুলু! টুলা! আমার টুলটুল! মা বল, মা বলে ডাক একবার।
মা!
বড় রকমের একটা স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল ব্রজনাথের রুদ্ধশ্বাস বুক থেকে।
ব্রজনাথ আশঙ্কায় কণ্টকিত ছিলেন এতক্ষণ। ভাবছিলেন মিলনের প্রথম লগ্নটা যদি ব্যর্থ হয়, পরম প্রাপ্তির অনুভূতিটা যদি দেখা না দেয়, গান কি ঠিক সুরে বাজবে?
ব্রজনাথ এ সংসারের আত্মীয় নন। ব্রজনাথ উকিল মাত্র।
কিন্তু ব্রজনাথ কি আত্মীয়ের বেশি নয়?
সুনন্দার স্বামী শোভন রায় কি চিরদিন তার এই হিতৈষী বন্ধুটিকে বড় ভাইয়ের শ্রদ্ধা সম্মান দিয়ে আসেন নি? অবশ্য ব্রজনাথ খুব বেশি গায়ে-পড়া কোনদিনই নয়। শোভনলাল যতই ঘনিষ্ঠতার বন্ধনে বাঁধতে চেষ্টা করুন, ব্রজনাথ সাধ্যমত সম্পর্কের দূরত্ব বজায় রেখে এসেছেন। অন্তত শোভনলালের অন্তঃপুরে ঢুকে দাদার পোেস্টটা কায়েমী করে ফেলবার ঝোঁক তার কোনদিনই দেখা যায় নি।
সে ঝোঁক থাকলে হয়তো অবস্থা অন্যরকম হত।
কিন্তু ব্রজনাথ অবস্থাকে স্বাভাবিক সৌজন্যের রীতিতেই চালু রেখেছেন। শোভনলালের মৃত্যুর পর থেকে সুনন্দার সঙ্গে প্রায়ই দেখা করতে হয়, কিন্তু বাইরের দিকের বসবার ঘরে ছাড়া বসেন না কোনদিন।
মিসেস রায় ছাড়া সম্বোধন করেন না কখনো।
তবু হৃদয়ের আবেগ মাঝে মাঝে প্রকাশ হয়ে পড়ে। শ্রদ্ধার আবেগ, স্নেহের আবেগ, সুনন্দার ভাগ্যহত জীবনের জন্য করুণার আবেগ।
হ্যাঁ, ভাগ্যহত বৈ কি। প্রভূত ঐশ্বর্যের মাঝখানে বসেও সুনন্দা হতভাগিনী। কে কবে শুনেছে, কটা দিনের জন্যে বিদেশে বেড়াতে গিয়ে কেউ একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে আসে?
মৃত্যু নয়। চোর!
চোরে চুরি করে নিল সুনন্দার বুকের মাণিকটুকুকে। উনিশ বছর আগের তরুণী সুনন্দা, নতুন মা হয়েছে। সেই মাতৃত্বের গৌরবে আর পুলকে সর্বদা ছল ছল করছে।
টুলু যা কিছু করে, তারই এক আবেগময় ব্যাখ্যা করতে ছুটে আসে শোভনের কাছে। বলে, কী ছাইয়ের কাজ আর কাজ। বেড়াতে এসেছ তাও কাজ। দেখ তো এসে টুলু কেমন করে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে।
শোভন বলত–তুমি এত বেশি দেখছ যে আমার আর না দেখলেও চলবে।
ইস, তাই বৈকি! ছিঁড়ে দেব তোমার দোকানের হিসাবের খাতা।
তাহলে তোমার টুলুর রূপোর দোলনা-খাটের অর্ডারটা ক্যানসেল করা হোক?
হেসে হেসে বলত শোভন বাতিল করা হোক জাপানী পেরাম্বুলেটারের বায়না?
ভাল হবে না বলছি ওসব কথা বললে। ঠিক আছে। থাক তুমি তোমার সাধের ফার্নিচারের দোকান নিয়ে, আমার রইল টুলু।
ভারি অস্থির ছিল সুনন্দা। ভারি চঞ্চল।
আবার এক সময় ছুটে আসত, দেখ তো দেখ তো এই নতুন জামাটা পরে টুলাকে কেমন দেখাচ্ছে? উঃ বাবা, পথের শত্রু ফিরে চায় টুলুর দিকে, আর তুমি বাপ হয়ে একবার তাকিয়েও দেখ না।
শোভন বলত, পথের শত্রু নই বলেই তো তাকাই না। বেশি দেখলে নজর লাগে জান না? নজরে নজরে ক্ষয়ে যায়।
যায়! যত সব সেকেলে কুসংস্কার! ওই সব আবোল তাবোল বলে সাফাই গাওয়া হচ্ছে। ঠিক আছে, আমি আমার ধনকে নিয়ে বনকে যাব
শোভন হেসে ফেলত, বনে যাবার বাড়তি একটা টিকিট তাহলে আমার জন্যে কিনো। তুমি যেমন তোমার টুলুকে এক মিনিট না দেখলে অজ্ঞান হও, আমি যে তেমনি
বক্তব্যটা অবশ্য আর কথা দিয়ে শেষ করে না শোভন।
সুনন্দা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, আহা, কী তুলনার ছিরি হল?
ছিরি না হোক, সত্যভাষণ হল। বলত শোভন।
কিন্তু সে সত্য কি শেষ অবধি রাখতে পারলেন প্রৌঢ় শোভন রায়? পারলেন না, অনায়াসে ছেড়ে চলে গেলেন সুনন্দাকে। গেলেন বিনা নোটিসে।