সে তুমি বুঝবে না প্রান্তিক। আমার মত অবস্থায় পড়লে হয়তো বুঝতে পারতে। বড় অসহায় মনে হয় পিসির কণ্ঠস্বর। উত্তরে বললাম না তা হয়তো ঠিক বুঝব না, পিসি, তবে খানিকটা অনুমান করতে পারি। কি অনুমান করতে পারো? বললাম, তোমার অসহায়তা, তোমার নিঃসঙ্গতা, তোমার আশা ও কামনার দোদুল্যমানতা। কিন্তু পিসি মিথ্যে দুশ্চিন্তা করে কিছু লাভ হয়কি? তুমি যা ভাবছ তা হয়তো সত্যি নয়, অথচ মিথ্যে ভেবেই তুমি হয়তো তোমারই ক্ষতি করছ। সব কিছুকে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ কর, দেখবে কোথাও কোন অসুবিধা নেই। মনেও শান্তি পাবে।
অবাক হয়ে তাকান নীলাঞ্জনা পিসি আমার দিকে। আমি যে এমন কথা বলতে পারি তা উনি ভাবতেই পারেননি। উনি কাত হয়ে আমার বিছানায় শুয়ে পড়েছিলেন এবার উঠে বসলেন। বললেন, তুমি কাউকে ভালোবাস প্রান্তিক। বললাম হ্যাঁ? কাকে? আমার পরিচিত যারা, সকলকে। আমি তা জানতে চাইনি প্রান্তিক, আমি শুধু জানতে চাইছি এই সকলের মধ্যে আলাদা করে কাউকে ভীষণ আপন করে ভালবাস কি না। হঠাৎ পিসির এ ধরনের প্রশ্নে অবাক হয়ে যাই।
কি বলব। আমার জীবনে তখনো আসেনি ভালোবাসার কোন আলাদা আকাঙ্খ। স্পষ্ট করে ছুঁয়ে যায়নি হৃদয়কে কেউ। বুঝতে পারি অশ্রুকণা বা রেহানা একটু আলাদা দৃষ্টিতে দেখে আমাকে। আলাদা করে কথা বলতে আনন্দ পায়। কিন্তু তাকে ভালোবাসা বলে কিনা জানিনা। অন্তত আমি নিজে ওদের কাউকে আলাদা করে ভাবিনি এখনো। তাই পিসিকে ভড়কে দিতে বললাম, আমার এই ছোট্ট জীবনে একজনকে আমি ভীষণ ভাবে ভালোবাসি পিসি, যদি তাকে ভালোবাসা বলে। কাকে জানতে চান নীলাঞ্জনা। আমি বলে চললাম যেন আমাকে বলার নেশায় পেয়েছে এমনি ভাবে। তার কথা আমি প্রতি মুহূর্তে ভাবি, তার হাসি আমাকে হাসায়, তার কান্না আমাকে কাঁদায়। তার দুশ্চিন্তা আমার কাছে বোঝার মত মনে হয়। তার নিঃসঙ্গতাকে পারলে কানায় কানায় ভরে দিতে ইচ্ছে হয়। তার চপলতায় আমি চঞ্চল হই। তাকে বুঝতে চাই, কিন্তু বুঝতে পারিনা। তাকে ধরতে চাই, যদিও ধরা ছোঁয়ার বাইরে তার অবস্থান। কখনো তাকে মনে হয় বন্ধু, কখনো বা শুভাকাঙ্খী, কখনো বা আপন মনে কথা বলি তার সাথে, সান্ত্বনা দিতে চাই তার সব হারানো ব্যথার জায়গায়, তবু তাকে দূরের বলে মনে হয়। কখনো মনে হয়না, নিজেকে তার যোগ্য বলে। নীলাঞ্জনা পিসি অবাক আর বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকান আমার দিকে। মনে হয় তার মনে কিসের যেন এক ঢেউ খেলে যাচ্ছে। আমার এমন গুছিয়ে কথা বলাতে অবাক হন ভীষণ। জানতে চাইলেন কে সেই ভাগ্যবতী যে তোমার এতটা সময় চুরি করে নিয়েছে। তোমার জীবন থেকে। কণ্ঠে কি হতাশা না কৌতূহল? আমার ভীষণ মজা লাগছে পিসির এই অসম কৌতূহলের জন্যে। তাকিয়ে দেখি তার বুকের ওঠা নামা। চোখের পরে চোখ রেখে বললাম, সত্যি তোমাকে জানতে হবে পিসি? অভিমানী কণ্ঠে বললেন, যদি বিশ্বাস করতে না পার নাইবা বললে। আমি চুপ করে আছি দেখে বললেন, তার মানে আমাকে তোমার বিশ্বাস হয় না। তা তুমি আমায় বিশ্বাস না করলেও আমি জানি কে তোমার শুধু মনটাই নয় জীবনটাই ধরে নাড়া দিয়েছে। আমার কৌতূহল আরো বেড়ে যায়। বলি বলতো কে? পিসি হাসতে হাসতে বলল রেহানা। এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। রেহানা বা অশ্রুকণার নাম পিসি শুনে থাকতে পারেন, তাই বলে তাদের মধ্যে রেহানা আমার জীবনে জড়িয়ে আছে, এমন কোন ঘটনা ঘটেছে বলেতো মনে করতে পারছি না। আমি বললাম এ তোমার অলীক কল্পনা পিসি। তাছাড়া রেহানা নামের মেয়েটিকে তুমি দেখওনি। তার কোন কথা তোমার সাথে কোন দিন বলেছি বলেও তো মনে হয়না। আমার মুখের কথা লুফে নিয়ে পিসি বললেন, সেই জন্যইতো আমার মনে হয়–রেহানা আছে তোমার জীবনব্যাপী। আর এমন নিবিড় তোমাদের সম্পর্ক যে, গোপনতার সেই মধুরতা তুমি কাউকে প্রকাশ করতে চাওনা। না হলে তুমি তোমার কলেজের কত ছেলে বন্ধু মেয়ে বন্ধুর কথা বল, কিন্তু কোনদিনই রেহানার নাম ভুলেও উচ্চারণ করো না, কিন্তু কেন? সেকি তোমার একান্ত একার বলে? হাসতে থাকেন নীলাঞ্জনা পিসি ভাসা ভাসা চোখ দুটি কৌতূকে উজ্জ্বল।
আমি হাতড়িয়ে দেখি কথাটা হয়তো সত্যি। আসলে রেহানার সাথে আমার সম্পর্ক কেমন জানিনে। কথাও বেশী হয় না নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া। বললাম, বেশ তোমার কথাই সত্যি, আমি তার কথা তোমাকে বলিনা, অবশ্যি বলার কিছু নেই বলেই বলিনা, কিন্তু তুমি তার নাম জানলে কি করে। হাসছেন পিসি। এই সঘন রাতের আলো আধারিতে পিসি যেন মায়া লোকের অঙ্গরির মত। হাসলে এত সুন্দর দেখায় পিসিকে। নিকষকালো ঘণ এলায়িত চুল, দুই ভূর মাঝে সবুজ টিপ, দেহের কোন অংশেই নেই বাহুল্য মেদ, সঙ্গে সুউন্নত পীন পয়োধর, এক নেশা জাগানো আকর্ষণ যেন, অথচ কেবল ভালোলাগা ছাড়া সে আকর্ষণের অন্য কোন ভূমিকা নেই।
হঠাৎ মনে পড়ে যায় মিনতি সেনের কথা, মিনতি সেন সম্পর্কে নীলাঞ্জনা পিসি যা ভাবেন তা সত্যি কিনা জানিনা। অন্তত আজ পর্যন্ত মিনতি সেনের কোন আচরণে এমন কিছু ধরা পড়েনি, যাতে অন্য কিছু ভাবা যায়, শুধু এক অপরাহ্নে পরিমল বাবুর সাথে তার অকারণ আগমন ছাড়া। যদিও প্রশ্নটা থেকেই যায়, শূন্য বাড়ী জেনেও তিনি কেন এসেছিলেন পরিমলবাবুর সাথে?