আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখলাম মিনতি সেনের ভাসাভাসা দুটি চোখকে। বললেন খুব ভালো করেছে। আমি একদিন অন্তর একদিন ওদের বাড়ীতে গেছি। কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করেছি তোমার কলেজ বন্ধুরা কেমন? এতদিন কলেজ যাচ্ছনা, অথচ কেউ তো তোমাকে দেখতে এলনা। আমাদের সময়ে আমরা এত অবাধ মেলামেশা করতে পারতাম না ঠিকই কিন্তু কেউ আমরা হঠাৎ অনুপস্থিতি হয়ে গেলে কেউ না কেউ ঠিকানা খুঁজে খুঁজে উপস্থিত হয়ে যেতাম। তারপর ওকে জিজ্ঞাসা করলাম প্রান্তিককে সংবাদ দেব?
অনুতপা বারণ করেছিল, তাই আর তোমাদের সংবাদ দেওয়া হয়নি। এবার তো আমার বাড়ী চেনা হয়ে গেছে মাঝে মাঝে এস কিন্তু। এটা ওটা কথা বলতে বলতে মিনতি সেন আমাদের জন্য খাবার তৈরি করলেন, কফি দিলেন, অনেক অনুরোধে মিষ্টিও খেতে হল। যতক্ষণ ওবাড়ীতে ছিলাম মিনতি সেন বেশীক্ষণ অশ্রুকণার সঙ্গেই কথা বললেন আমার সঙ্গে সামান্য ২/১ টি কথা ছাড়া প্রায় এড়িয়েই চললেন। জানিনা কেন মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, তবে পরে ভেবেছি, মিনতি সেনের এই ব্যবহারের পিছনে একটা কারণ ছিল, এবং তা যথেষ্ট যুক্তি গ্রাহ্য।
পথে বেরিয়ে এসে অশ্রুকণা বলল, তোমার পিসি এত সুন্দর যে আমার কি মনে হয় জান?–কি? আমি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাই ওর দিকে। ও বলে, আমি যদি ছেলে হতাম, নির্ঘাৎ ওর প্রেমে পড়ে যেতাম। আমি হাসতে হাসতে বললাম, ভাগ্যিস মিনতি সেন আমার পিসি, কিন্তু তা না হয়ে যদি মিনতি সেন আমার কাকু হতেন তবে নির্ঘাৎ কপালে দুঃখ ছিল। ধ্যাৎ বলে চোখে যে কটাক্ষ হেনে তাকালো আমার দিকে, তাতেই আমার অবস্থা কাহিল। আমি আর কোন কথা বলতে পারলামনা। বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের নর্থের বাস আর আসছে না। আস্তে আস্তে রাত বাড়ছে। বাড়ীর লোকেরা নিশ্চয়ই চিন্তা করছে। অশ্রুকণা বলল, না বাস আর আজ আসবে না, চল বরং ট্রেনেই ফিরে যাই। অগত্যা আমরা আবার হাঁটতে হাঁটতে রেল স্টেশনের দিকে এগিয়ে চললাম। অশ্রুকণা বলল, আমার কি মনে হচ্ছে যান?–কি? যদি আমাদের এই পথ চলা আর শেষ না হতো। আমি হেসে উঠলাম। হাসলে যে! না ভাবছি তোমার এই স্বপ্নের খেয়া কোথায় গিয়ে শেষ হবে। ওকে দেখে খুব চিন্তিত মনে হল, তাই জানতে চাইলাম, তোমার কি হয়েছে বলতো কণা? ও আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে গুন গুন করে গেয়ে উঠলো আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ, গানটা ভারি সুন্দর, বাধা দিতে পারলামনা। অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এমন জনারণ্যের মাঝে যে এমন গাইতে পারে, না জানি সুর তার হৃদয়ের কোন উৎস থেকে উৎসারিত হয়। কিন্তু পথ যে সামান্য। আর সামান্য পথ বলেই হয়তো পথ শেষ না হওয়ার এই আকুলতা। প্লাটফরমে ঢুকতেই শিয়ালদহ গামী ট্রেন এসে দাঁড়ালো। টিকিট কাটার কোন অবকাশই হয় না। বিনা টিকেটেই ট্রেনে উঠে পড়ি।
বাড়ীতে যখন ফিরেছি তখন রাত ১০টা বাজে। নীলাঞ্জনা পিসি এঘর ওঘর করছেন। আমাকে দেখে আশ্বস্ত হলেন ঠিকই, কিন্তু ক্ষেপে গেলেন তার থেকে বেশী। বললেন এমন ইচ্ছেমত যদি চলতে চাও তাহলে যেখানে খুশী যেতে পারো। প্রান্তিক আমার এখানে তোমার থাকার দরকার নেই। ভেবে দেখেছে কিছু একটা হয়ে গেলে গ্রামের বাড়ীতে কি জবাব দেব?
অত্যন্ত কঠিন আঘাত সন্দেহ নেই, তবু কিছু বলতে পারলামনা। কারণ আমার বার বার মনে হয়েছে আমাকে আঘাত দেওয়া তার উদ্দেশ্য নয়। আমার জন্য যে তার সীমাহীন দুশ্চিন্তা তাই ফুটে উঠেছে তার দেওয়া আঘাতের মধ্য দিয়ে। আমি চুপ করে তার বকুনিকে মেনে নিলাম।
খাওয়ার টেবিলে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় গিয়েছিলে? আমি বললাম তোমাকে জানতেই হবে? বা আমাকে জানতে হবে না, এত রাত পর্যন্ত তুমি কোথায় কি করে বেড়াচ্ছ? একটা কিছু হয়ে গেলে তো আমাকেই কৈফিয়ত দিতে হবে। আমি সত্যি কথা বলব কিনা ভাবছি, উনি আবার বললেন কি হল, জবাব দিচ্ছনা কেন? আমি বললাম তোমাকে বলব কিনা তাই ভাবছি। এমনকি গোপন কথা যা আমাকে বলা যাবে না। আমি পিসিকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য বললাম, আমি তো বড় হয়েছি পিসি। কিছু গোপনতা তো আমার থাকতেই পারে। পিসি কি বুঝলেন কে জানে। বললেন, লুকিয়ে লুকিয়ে জল খাওয়া হচ্ছে? ওসব চলবেনা আমি স্পষ্ট বলে দিচ্ছি।
নারী মনের কৌতূহল, সব বয়সেই তা একই রকম। ঈশ্বর বোধ হয় এই সীমাহীন কৌতূহল দিয়েই তাদের পাঠিয়েছেন। আস্তে আস্তে আমার বিছানায় এসে বসলেন উনি। আমি নিবিষ্ট মনে বইয়ের পাতায় ডুবে গেলাম। যদিও জানি একটা লাইনও আমার মাথায় ঢুকছেনা। আড়চোখে একবার তাকালাম পিসির দিকে। পিসি সুন্দরী। প্রায় ১০ বছরের বিবাহিত জীবনে শরীরের কোথাও এতটুকু টোল খায়নি। পাশাপাশি মিনতি সেন। কে বেশী সুন্দরী। অশ্রুকণার কথায়, যদি সে ছেলে হতো তাহলে সে মিনতি সেনের প্রেমে পড়ে যেতো। আসলে এই কথা বলে সে কি বোঝাতে চাইছে, সেকি চাইছে আমি যেন মিনতি সেনের সঙ্গে আর না মিশি? কেন যে ছাই মিনতি সেন আমার পিসি এই পরিচয় দিতে গেলাম ওদের কাছে। আমি তো বলতেই পারতাম আমার পিসির বন্ধু বা অন্য কিছু। কিন্তু এখন যা হয়েছে তাতে আর ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না।
পিসি বললেন, বই পড়ছ না পাতার পর পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছো? বললাম পড়ছি তো। ছাই পড়ছে। তার চেয়ে শুয়ে পড়। বললাম ঘুম আসছেনা। কথা লুফে নিয়ে পিসি বললেন সারাদিন এই রকম টোটো করে ঘুরলে কি আর ঘুম আসবে? না আসলে কি করব? শুয়ে শুয়ে ভেড়া গোন দেখবে এক সময় ঠিক ঘুম এসে যাবে। আমি বললাম, তুমি ঘুমাচ্ছনা কেন? আমারও ঘুম আসছেনা।–কেন তোমার ঘুম আসছেনা কেন? তুমিতো আর সারাদিন আমার মতো টোটো করে ঘোরনি। পিসি বললেন আমার যে কেন ঘুম আসছেনা