রাতে পিসি জানতে চাইলেন আমি মিনতি সেনের বাড়ী চিনি কিনা বা তার ঠিকানা জানি কি না? বললাম বাড়ী চিনিনা, তবে ঠিকানা জোগাড় করে দিতে পারি। কিভাবে? আমাদের এক সহপাঠি ওদের ওদিকে থাকে আর মিনতি সেনকেও চেনে। কি নাম? অনুতপা। একদিন নিয়ে আসবে ওকে? পিসি যেন একটা ফয়সালা চান এ ঘটনার।
পরের দিন কলেজে গিয়ে জানলাম, অনুতপা কলেজে আসেনি। কিন্তু অনুতপাকে আমি খুঁজছি এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে অনেক আজে বাজে আলোচনা আরম্ভ হয়ে গেল। এরই মাঝে অশ্রুকণা এগিয়ে এসে বলল তুমি ওকে খুঁজছিলে কেন?
আলোচনা এমন একটা বিশ্রী আর কদৰ্য্যরূপ নিয়েছে যে, আমার কারো কথা শুনতে ভালো লাগছিল না। বললাম, প্রয়োজন আছে তাই। আমার কণ্ঠে উম্মা প্রকট হয়ে ওঠে। অশ্রুকণা কিন্তু রাগল না। বলল তোমার এই গেঁয়ো গোঁয়ারতুমি আমার একদম ভালো লাগে না প্রান্তিক। আমি বিশ্বাস করি অনুতপাকে তোমার সত্যি কোন দরকার আছে। আমাকে বলা যায় না কি দরকার। সত্যিকারের সহমর্মীর মতো জানতে চায় অশ্রুকণা।
না, এর মধ্যে তো কোন কৌতূহল নেই, নেই কোন কুটিলতা। বললাম, ওকে একবার আমার পিসির প্রয়োজন তাই। এবার অবাক চোখে তাকালো অশ্রুকণা। বলল, কে? মিনতি সেন? আমি বেফাঁস বলে ফেললাম, তুমি ওকে চেন নাকি? বা তুমিই তো সেদিন পরিচয় করিয়ে দিলে উনি তোমার পিসিমা, অনুতপাদের ওদিকেই তো থাকে না। অনুতপা কয়েকদিন ধরেই কলেজে আসছে না। জ্বর হয়েছে। যাবে নাকি? আমি যাচ্ছি ওকে দেখতে।
কি যেন ছিল অশ্রুকণার এই আবেদনে। আমি না করতে পারলাম না।
ওদের ওখানে যখন পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। অনুতপা বোধ হয় ভাবতেই পারেনি আমরা ওদের ওখানে যেতে পারি। ওর জ্বর কমেছে। কাল স্নান করেছে। শরীর বেশ কাহিল, খুবই ক্লান্ত লাগছিল ওকে দেখে। ওর বাবা অফিস থেকে ফেরেননি। দাদা কেন্দ্রীয় সরকারে চাকরি নিয়ে বাইরে থাকেন। বাড়ীতে শুধু ওর মা আছেন। আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় অনুতপা। বলে আমার যে কি ভাল লাগছে তোমরা এসেছো বলে। কদিন বাড়ীতে থেকে একেবারে হাঁফিয়ে উঠেছি। মনে মনে শুধু ভেবেছি তোমরা কেউ এলে ভাল লাগতো। তোমাদের কাউকে যে সংবাদ দেব সে উপায়ও নেই। তা তোমরা জানলে কি করে? অশ্রুকণা বলে আজই সংবাদ পেলাম। প্রশান্ত বলেছে। প্রশান্ত? নামটা অশ্রুকণার মুখে শুনে অবাক হয় অনুতপা। প্রশান্তকে তো চেনার কথা নয় অশ্রুকণার। তবু সেটা আচরণে প্রকাশ না করে বললো, ওর সঙ্গে তোমার দেখা হল কোথায়? কি একটা কাজে আজ কলেজে গিয়েছিলো। হঠাৎ মনে হল তোর সংবাদ ও জানতে পারে। তাই জিজ্ঞাসা করাতে বললো, তোর বেশ কয়েকদিন ধরে জ্বর।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অনুতপা বলে, অথচ দেখ, আমার বেশ কয়েকদিন ধরে জ্বর এ সংবাদ রাখে অথচ একবার আসতে পারেনা। এরা সব এই রকমই। অনুতপার মা আমাদের জন্য মিষ্টি নিয়ে আসেন। বলেন, তোমরা কলেজ থেকে আসছ এই মিষ্টিটা খেয়ে নাও। আমি তোমাদের জন্য খাবার করছি। আমরা না না করে উঠলাম। কিন্তু উনি তখন আর ওখানে নেই।
অশ্রুকণা বলল, আমরা যদি আগে জানতে পারতাম অবশ্যিই আসতাম। যাকগে সে কথা। এ কদিনে কি কেউ আসেনি? অনুতপা বলে, একবোরে কেউ আসেনি বলা ঠিক হবে না, প্রান্তিকের পিসি মিনতি সেন এসেছেন একদিন অন্তর একদিন। অফিস থেকে ফেরার পথে যেদিনই এসেছেন, ফল ইত্যাদি নিয়ে এসেছেন। বসতেন বেশ কিছুক্ষণ। অনেক গল্প করে আবার ফিরে যেতেন। আমি অবাক হয়ে তাকাই অনুতপার দিকে। অশ্রুকণা বলে, কি এত গল্প করেন উনি? তার কলেজ জীবনের কথা। সেদিন ছেলেরা কি ভাবে ওনাদের পিছনে লাগতেন এইসব আর কি? তোদের বাড়ীর কাছে থাকেন বুঝি! এইতো মোড়টা ঘুরলে ২৫/২ নং বাড়ীতে। মিনতি পিসি যে এত ভালো, পরিচয় না হলে বুঝতেই পারতাম না। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, সত্যি প্রান্তিক তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ তোমার পিসির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। উনি শেষ কবে এসেছিলেন, জিজ্ঞাসা করে অশ্রুকণা। এই তো কালকেই এসেছিলেন। তার মানে আজ আর আসবেনা। তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, চল না প্রান্তিক আমরা তোমার পিসির ওখান থেকে ঘুরে আসি। আমি বললাম আজ থাক কশা, বাড়ীতে চিন্তা করবে। মনে মনে হিসাব মিলিয়ে নিয়েছি পরিমলবাবুর সঙ্গে মিনতি সেন যাননি। অনুতপা বলল, সে কি কথা প্রান্তিক, আমাদের এখানে এসে না গেলে উনি জানতে পারলে দুঃখ পাবেন। হয়তো মনে মনে আমাকেই দায়ী করবেন যে আমিই তোমাকে যেতে দিইনি।
অগত্যা যেতে হয়। সত্যি খুব কাছেই মিনতি সেনদের বাড়ী। ছোট্ট বাড়ী। কিন্তু বেশ সাজানো গুছানো। আমরা বেল দিতেই এক বুড়ো মতো ভদ্রলোক বেরিয়ে আসেন। জানিনা ভদ্রলোক মিনতি সেনের কে হন। কিন্তু ঠিক পিছনে পিছনে মিনতি সেন আমাকে দেখতে পেয়েই ভদ্রলোককে বললেন, বাবা, তুমি আবার উঠে এলে কেন? আমি তো আছি, যাও তুমি ভিতরে যাও। তারপরে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন–প্রান্তিক ভালো আছো। তো? পাশে অশ্রুকণাকে দেখে বললেন, তুমিও ভালো আছো তো অশ্রু? ও এগিয়ে গিয়ে মিনতি সেনকে প্রণাম করতে গেলে মিনতি সেন বাধা দিয়ে বললেন, এসব কি করছ? বা গুরুজনদের প্রণাম করব না?
আমরা ভিতরে গিয়ে বসলাম। মিনতি সেনকে জিজ্ঞাসা করলাম কাল অফিসে যাননি? না কেন বলো তো। এমনি? এমনি এমনি তো কিছু হয় না প্রান্তিক? তারপর বললেন কাল কি আমাকে খুঁজতে আমার অফিসে গিয়েছিলে? না তবে নীলাঞ্জনা পিসি আপনাকে কাল অফিসে ফোন করেছিলেন। কেন? তাতো জানিনা। খুব দরকার বুঝি? তারপর অবশ্য বললেন, আমাকে তো আগে কখনো ফোন করেনি। ঠিক আছে আমি কাল অফিসে যাব। যদি খুব দরকার থাকে আমাকে ফোন করতে বলল। তারপর অশ্রুকণার দিকে ফিরে জানতে চাইলেন তোমরা আমার কাছে এসেছে না অন্য কোথাও গিয়েছিলে? অশ্রুকণা বলল, আসলে কদিন ধরে অনুতপা কলেজে যাচ্ছেনা তো, তাই প্রান্তিককে বললাম, তোমার পিসি তো ঐ দিকেই থাকেন, চলনা, অনুতপাকেও দেখা হবে, আবার তোমার পিসির বাড়ী থেকেও ঘুরে আসা যাবে।