ডাইনিং টেবিলে পিসেমশাই পরিমল বাবু আসেননি। পিসি আর আমি অনেকক্ষণ তার জন্য অপেক্ষা করে করে শেষ পর্যন্ত নিজেরা টিফিন খেয়ে উঠে পড়েছি। একবার মনে হয়েছিল আজকের সব ঘটনা খুলে বলি পিসিকে। কিন্তু কেন যেন বলতে পারলামনা। হয়তো লজ্জায় বা ভয়েও হতে পারে।
নিজের টেবিলে পড়তে বসেছি। শুনতে পাচ্ছি পিসেমশাই বলছেন, শেষ পর্যন্ত তুমি কি ঠিক করলে? কিসের? বা সব ভুলে গেলে? তোমাকে তো কয়েকদিন ধরে বলছি। বেশী দেরি করলে সব ভুল হয়ে যাবে। বুঝলাম দেরি করলে ভুল হয়ে যাবে। কিন্তু ব্যপারটি কি? পিসেমশাই বললেন একটা বাচ্চাকে দত্তক নেওয়ার। কিছুক্ষণ চুপচাপ উভয়ে, তারপর ধীরে ধীরে পিসি বললেন, আমার মত নেই। দত্তক যাকেই নাওনা কেন তাতে তোমার রক্তের অধিকার থাকবেনা, আর যেখানে তোমার রক্তের অধিকার থাকছেনা, তাকে আমার পক্ষে মেনে নেওয়া কষ্টকর। তাহলে তুমি কি চাও? আমি যা চাইব তাই তুমি করবে? চেষ্টা করব। তাহলে তুমি আরেকবার বিয়ে কর। নীলু, তোমাকে বার বার বলেছি এ অসম্ভব। কেন তুমি বোঝনা কেন? বুঝি যে না, তা নয়। কিন্তু আমি তোমায় ভালবাসি পরিমল। আমি যে তোমায় পিতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করছি, তারজন্য আমার মনের যে অবস্থা তা তুমি বোঝনা। তুমি কি আমায় একটুও বিশ্বাস করতে পারছনা? এটা বিশ্বাসের প্রশ্ন নয় নীলু। বাস্তবতার প্রশ্ন। তারপর বললেন আমি না হয় মেনেই নিলাম, তুমি সব কিছু মেনে নেবে। কোন প্রতিবাদ করবে না। কিন্তু যে আসবে সে যদি তোমাকে মেনে না নেয়? তাতেও আমার দুঃখ থাকবেনা, যদি সে তোমাকে অন্তত ভালবাসে। কিন্তু তার ভালবাসার খেসারত দিতে গিয়ে যদি তোমাকে হারাতে হয়? তাতেও আমার কোন দুঃখ থাকবে না। আমি হাসিমুখে তোমার জীবন থেকে সরে যাবো। পরিমল বাবু বললেন জীবনটাকি এত সহজ ভাবে চলে নীলু? আর তা ছাড়া তুমি তোমার নিজের কথা ভাবছো। আমার কথা এক দম : ভাবছো না। আমার মন যদি তোমাকে হারানো সহ্য করতে না পারে। আগে আগে এসব কথা ভাবছ কেন? আমি যদি তাকে আমার ছোট বোনের মত ভালবাসি, সে কেন আমাকে অস্বীকার করবে? আর যদি করেও সেদিনকার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন ভাবে চিন্তা ভাবনা করব। তুমি না করোনা লক্ষ্মীটি। এ যেন এক নতুন আবিস্কার আমার কাছে। মনে হয় পিসি যেন আত্মত্যাগে এক মহীয়সী নারী।
কেটে যায় আরো বেশ কিছু দিন। একদিন পরিমলবাবু তাঁর এক অফিস সহকর্মীকে নিয়ে বাড়ীতে আসেন। সেদিন আমার কলেজ যাওয়া হয়নি। শরীরটা ভালো ছিল না। পিসি অফিস থেকে ফেরেননি। পরিমলবাবু বললেন, তুমি আজ কলেজে যাওনি প্রান্তিক। না, শরীরটা ভালো নেই। ও ঠিক আছে। তারপর সঙ্গের ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, আমার অফিস সহকর্মী, মিনতি সেন, আর এর নাম প্রান্তিক, নীলাঞ্জনার ভাইপো, আমাদের এখানে থেকে পড়াশুনা করে, খুব ভালো ছেলে। মিনতি সেন তাকালেন আমার দিকে। কি ভাবলেন, তা তিনিই জানেন। পরিমলবাবু বললেন, চল ভিতরের ঘরে গিয়ে বসি। মিনতি সেন মৃদু আপত্তি জানিয়ে বলেন, এখানেই বসিনা। তারপর জানতে চাইলেন তা তোমার গিন্নি কখন আসবেন? সাতটা নাগাদ। সাতটা নাগাদ! সে তো অনেক দেরি। না, এতক্ষণ দেরি করা সম্ভব হবে না। আমি বরং আরেক দিন আসব। আমি বুঝতে পারছি না এসময় পরিমলবাবু মিনতি সেনকে নিয়ে বাড়ীতে এলেন কেন? এসময় তো কারো বাড়ীতে থাকার কথা নয়। পরিমলবাবু বললেন, আমার যে তোমার সাথে কিছু কথা আছে মিনতি? প্রান্তিক এখানে বসে পড়াশোনা করছে। ওর পড়াশোনার ডিস্টার্ব হবে, তার থেকে চল ভিতরে গিয়ে বসা যাক। প্রান্তিক এখানে পড়াশোনা করছে এ ব্যপারটা বুঝতে পেরে মিনতি আর কোন রকম দ্বিধা না করে পরিমলবাবুর পিছু পিছু ভিতরের ঘরের দিকে পা বাড়ান।
আমার মনে হলো আমার কলেজে না যাওয়াটা বোধ হয় পিসেমশাই ভাবতে পারেননি। সুতরাং যে কোন অজুহাতে বেরিয়ে পড়াই উচিৎ। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়? সকালে পিসি, কলেজে যাওয়ার খরচ দিয়ে গেছেন। সিনেমায় যাওয়া যেতে পারে। যদিও বলে কোথাও যাওয়াটা পিসির পছন্দ নয়। তবু বেরিয়ে পড়ি আমি। যাওয়ার আগে পিসেমশাইকে বলে যাই, আমি একটু বেরুচ্ছি। কোথায়? আমার এক বন্ধু কিছু কলেজ নোট দেবে বলেছিলো, ওখানেই যাব। কখন ফিরবে? তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। ভিতর থেকে মিনতি সেন বেরিয়ে এসে বললেন, আপনি কোনদিকে যাবেন? বললাম, কলেজ স্ট্রীটের দিকে। একটু দাঁড়ান আমিও যাব। তারপর পরিমলবাবুকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আজ আমি আসি পরিমল। তোমার বাড়ীতে চিনেই গেলাম, এরপর একদিন একলাই চলে আসব।
বুঝতে পারছি এই ফাঁকা ঘরে অস্বস্থি বোধ করছেন মিনতি সেন। তবু বললাম, আপনি একটু অপেক্ষা করে যাননা। পিসির সঙ্গে দেখা করে যান। উনি বললেন, সে আরেকদিন হবে ভাই। আপনি একটু দাঁড়ান, উনি ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন আমার সাথে, পরিমলবাবুর কোন অনুরোধকে গুরুত্ব না দিয়েই।
রাস্তায় এসে বললেন, আপনি কলেজ স্ট্রীট কোথায় যাবেন? আমি তাঁকে বাধা দিয়ে বললাম। আমাকে তুমিই বলবেন। বেশ তাই হবে। ওখানে তুমি কোথায় যাবে? হিন্দু হোষ্টেলে যাব। বেশ যেও, আপাতত চলল না সামনের ওই রেস্টুরেন্টটায়, বেশ খিদে পেয়েছে। আমি ইতস্তত করছি দেখে উনি বললেন লজ্জা করছে? না ঠিক তা নয়? তাহলে? বেশ চলুন।