আমি চুপচাপ বসে আছি দেখে রেহানা বলল, তুমি কি কথা বলবেনা বলে ঠিক করেছ নাকি? চমকে উঠে তাকালাম ওর দিকে। না ঠিক তা নয় আসলে আমি একটা কথা ভাবছিলাম। কি? আমি জানতে চাইলাম তুমি কি রোজ কলেজে যা যা ঘটে সব বাড়ীতে এসে বল?–কেন? না, এমনিই জিজ্ঞেসা করছি। –তবু? মানে মাসিমার তো আমাকে চেনার কথা নয়। তাই ভাবলাম, তুমি না বললে জানবেন কি করে।
ও তাই বল, খিল খিল করে হেসে উঠলো রেহানা আর আমি স্পষ্ট সোজাসুজি তাকলাম ওর দিকে। ওকি লজ্জা পেল? কি জানি। বলল অমন করে তাকিয়ে আছো কেন? নারীর স্বাভাবিক লজ্জায় খানিকটা যেন নুয়ে আসে রেহানা।
লাল রোদ্দুর ফিকে হয়ে ধূসর আঁধার নামার অপেক্ষায়। রেহানার আফরোজ বেগম, তাঁর ঘর থেকে চিৎকার করে বলেছন সেলিনাতো এখনো ফিরলনা, একবার দেখবি রাস্তার মোড়ে গিয়ে? রেহানা বলল কি যে তুমি ব্যস্ত হও রোজ রোজ, ও কবে আর এত সকালে ফেরে? না ফিরলে চিন্তা হয় না। এত চিন্তা করার কি আছে? তোমার মেয়েতো একাই কেবল ফেরেনা তা নয়, ওদের ক্লাসের অনেকেই ফেরেনা।–কেন ফেরেনা কেন? আফরোজ বেগমের কণ্ঠে উদবিগ্নতার ছোঁয়া।–ফিরবে কি করে মা। ওরা ক্লাস শেষ হলে এক জায়গায় পড়তে যায় তাইতো দেরি হয়। ৭টার মধ্যে না ফিরলে আমি যাব যেখানে ওরা পড়ে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল–কই কি যেন বলছিলে? না কিছু না, বলে চায়ের কাপটা মুখে তুলে নিলাম। আলদা প্লেটের খাবারগুলোও একটু একটু করে খেয়ে নিলাম। তারপর বললাম, আজ তাহলে উঠি রেহানা। আচ্ছা বলে উঠে দাঁড়ায় রেহানা। তারপর বলে, তুমি তো এই পথেই হেঁটে গিয়ে বাস ধর তাইনা?–হ্যাঁ? তাহলে তো যে কোনদিন আসতে পারো? হ্যাঁ তা পারি। তাহলে কাল আসবে বল? চেষ্টা করব। ও আর কিছু বললনা। আমিও বেরিয়ে আসি ওদের বাড়ী থেকে।
অনেক কথাই ওকে জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারলামনা কোন কথাই বলতে। পরের দিন থেকে পারত পক্ষে, ওই রাস্তাটি এড়িয়ে চলেছি। এটা কি ভিতরের কোন ভয়, না আশঙ্কা। তা না হলে ওদের বাড়ীর পাশ দিয়ে কম দূরত্বের সোজা পথ ছেড়ে বেশী দূরত্বের ঘুরপথে বাস স্টজে যাবো কেন? রেহানা বুঝতে পারলেও আমাকে কোন প্রশ্ন করে অস্বস্তিতে ফেলতে চায়নি হয়তো। আজ আবার অন্যমনস্ক ভাবে এই রাস্তায় এসে পড়েছি। সব বাড়ীর আলো জ্বলে উঠেছে। একটু আগে সন্ধ্যার অন্ধকার গম্ভীর হয়ে নেমে এসেছে পৃথিবীতে।
রেহানার ঘরে আলো জ্বলছে। রাস্তার দিকে পিছন ফিরে সামনের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কি যেন বলছে আর হাসছে। এ সময় ওদের বাড়ী গেলে কিছু মনে করবে নাতো! তবু বেল দিলাম। আমাকে বোধ হয় সামনে বসা মেয়েটি আগেই দেখেছে কারণ তা না হলে বেল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলতো না। মেয়েটি কোন কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! নীরবে বোধহয় জানতে চাইছে আমি কে। বললাম, আমি প্রান্তিক, রেহানা আছে? রেহানাও কখন যেন ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। বলল, কি ব্যাপার প্রান্তিক, তোমার শরীর খারাপ? এমন শুকনো শুকনো লাগছে কেন? কলেজতো অনেকক্ষণ ছুটি হয়ে গেছে, এতক্ষণ কোথায় ছিলে? এসো এসো ভিতরে এসো। এক নাগাড়ে এতগুলো প্রশ্ন করায় আমি খানিকটা বিভ্রান্ত। আমার অবচেতন মনে হয়তো রেহানার কথা বারবার মনে হয়েছে। আবার একথাও ঠিক যে সচেতন ভাবে আমি রেহানার কথা ভেবে ওদের বাড়ী আসিনি। তাই খানিকটা ইতস্তত করে বললাম, না আজ থাক রেহানা, আজ আমি একটা বিশেষ প্রয়োজনে এসেছিলাম তোমার কাছে। বেশতো বলনা কি প্রয়োজন? এত লজ্জা করছ কেন? বলল রেহানা। আমি ইতস্তত করছি দেখে সঙ্গের মেয়েটি বলল,–আপা, আমি থাকলে বোধহয় উনি কিছু বলবেন না। আমি বরং চলে যাচ্ছি। ও হাসতে হাসতে চলে গেল ভিতরের দিকে। রেহানা নিজেই বলল, আমার বোন সেলিনা। তুমি ওর কথায় কিছু মনে করোনা। ও ঐ রকমই। অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে সারদিনই হৈ হুল্লোড় আর আনন্দে মেতে আছে। তারপর বলল বলনা কি বলবে? আসলে আমি আমার ম্যানিব্যাগটা ফেলে এসেছি, তারপর কলেজ থেকে বেরিয়ে এমন একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লাম যে, অনেক দেরি হয়ে গেল। পিসিমা হয়তো ভাবছেন। ও আর কোন প্রশ্ন করল না। জানতেও চাইলনা কিসের ঝামেলা। শুধু বলল, তুমি ভিতরে এসো। আমি সঙ্কোচের সঙ্গে বললাম, এমনিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে, ভিতরে গেলে আরো দেরি হয়ে যাবে। আমি বরং এখানে অপেক্ষা করছি। রেহানা ভিতরে গিয়ে আবার ফিরে এলো, তারপর পাঁচটি টাকা আমার হাতে দিয়ে বলল, আশাকরি এতে হয়ে যাবে। আমি ওকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এলাম। শুনতে পেলাম সেলিনার কথা রেহানাকে বলছে, বেচারা! তারপর বলল তুইকি জানিস আপা, কড়ি দিয়ে কিনলাম এর সতী, দীপুকে কি বলেছিল? কি? তাও জানিসনা। তবে শোন, সতী বলেছিল, আমি জানি তুমি আমার কাছে কিছু চাইবে কিন্তু সে যে টাকা …। রেহানা ধমক দিয়ে বলে ইয়ার্কি করিসনা সেলিনা ওর কানে গেলে ও কি ভাববে বলতো। সেলিনা উত্তরে কি বলেছিল ভাল করে শোনা গেলনা, তাছাড়া ওদের কথা শুনবার সময়ও আমার নেই। এরপর বাড়ীতে যখন পৌঁছালাম, তার অনেক আগেই পিসি এবং পিসেমশাই অফিস থেকে ফিরে এসেছেন। পিসি বললেন, এত দেরি হল যে, কোথায় গিয়েছিলে? আমি আর কি বলব। খিদেতে পেট জ্বলছে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে অপমানের জ্বালা। কোন কথাই বলতে ভাল লাগছেনা, শুনতে তো নয়ই। তবু অন্যের বাড়ী। উত্তরতো একটা দিতেই হবে। বললাম কলেজে ছুটির পরে এক বন্ধুর বাড়ী গিয়েছিলাম, দেরি হয়ে গেছে। পিসি বললেন এতদেরি করবেনা। চিন্তা হয় না? যা তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে খেতে এস।