হেডস্যার নিশীথরঞ্জন সরকার এর আর কি উত্তর দেবেন। তবু তার মনে হয় নীলাঞ্জনার এ এক হঠকারি সিদ্ধান্ত। ও কোন ভাবেই ঠিক করছেনা। তাই আর ও প্রসঙ্গ না বাড়িয়ে আমার প্রসঙ্গে বললেন, তা হলে তোমাদের এখানে প্রান্তিককে রাখা বোধহয় ঠিক হবে না! কেন স্যার? তোমাদের মানসিক এই অবস্থার মধ্যে ও একটা বোঝা হয়ে উঠবে। নীলাঞ্জনা পিসি বলল, আপনি ঠিক বলছেন না স্যার। প্রান্তিক আপনার স্কুলের কৃতী ছাত্র এটা যেমন ঠিক, তেমনি ওতো আমারও গ্রামের ছেলে, সম্পর্কে আমার ভাইপো। হয় তো এই কলকাতা শহরে এ সম্পর্কের কোন মূল্য নেই। কিন্তু এতদিনেও গ্রামের বন্ধন যখন কাটাতে পারিনি তখন এ সত্যকে অস্বীকার করব কি করে? না স্যার ওর কোন অসুবিধাই হবেনা। আমি পরিমলকে বলেছি ও হাসি মুখে মেনে নিয়েছে। ওর আসার সময় হয়ে গেছে, আপনি আরেকটু অপেক্ষা করুন। হেডস্যার বললেন, কিন্তু নীলু। আমার যে সময় নেই একদমও। আমাকে উঠতেই হবে। নীলাঞ্জনা আর কি করবে? হেডস্যার যাওয়ার আগে বললেন, তোমরা আমাকে নিশ্চিন্ত করলে। আশীর্বাদ করে হেডস্যার চলে গেলেন। আমি রয়ে গেলাম। তা আমিও এখানে আছি বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে পিসি ও পিশেমশাইর মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিংএর কোন অভাব আছে বলে আমার কখনো মনে হয়নি। বলতে গেলে ওনারা আমাকে ওদের পরিবারের একজন হিসাবে হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন। ওবাড়ীতে আমাকে কোন কড়া অনুশাসনেও রাখা হয়নি বরং বাস ভাড়া এবং সামান্য টিফিনের পয়সা আমাকে নিয়মিত দিতে কোনদিন ভুল করেন না। আমার সারাদিন যা ব্যয় হয় তারপর বাকী পয়সা ওনাদের ফিরিয়ে দিই। ওরা ফিরিয়ে নিতে চান না। তবু আমি তা ফিরিয়ে দিই। সুতরাং আমার কাছে অতিরিক্ত ব্যয় করার মত পয়সা থাকে না।
আজ ওরা ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেছেন। আমায় পয়সা দিতে সম্ভবত ভুলে গেছেন। সুতরাং কোন টিফিনই খাওয়া হয়নি। তারপর আসার সময় যেমন হেঁটে এসেছি, যেতেও হবে হেঁটে, পথ অনেকটা। তাই একটু তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলছিলাম। অসম্ভব ক্লান্তি নিয়ে পুকুরের ঘাটে বেদীর ওপরে বসে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই।
অন্ধকার নেমে এসেছে। বাইরের পৃথিবীকে, তা আরো ঘন কালো যবনিকায় ঢেকে দিয়েছে, উপরন্তু সন্ধার অন্ধকারে ২/১টি মশার কামড়ও টের পাচ্ছি। ঘুম ভেঙে যায়। এ পথ নির্জন। পুকুরের জলে ভাল করে চোখমুখ ধুয়ে, হাঁটতে আরম্ভ করি। কিন্তু পা চলতে চাইছেনা। অথচ এতটা পথতে হাঁটতেই হবে। সামনের ঐ বাড়ীতে হয়তো রেহানা থাকে। রেহানা রহমান। সারা কলেজের সহপাঠীদের মধ্যে ওর সঙ্গেই আমার ২/১টি কথা হয়। আসলে কলেজে আমরা একই ক্লাসে পড়ি। আমাকে কিছু নোট দিয়ে ও সাহায্য করেছিল, দূর্ভাগ্য সে খাতাটিই আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
ওর সঙ্গে কলেজ করিডোরে যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল, আমি ক্লাসরুম খুঁজছিলাম। ইতস্ততঃ করছি দেখে ও আমায় জিজ্ঞাসা করেছিল আপনি তো প্রান্তিক রায়? আমি হ্যাঁ বলাতে, ও বলেছিল, আমাকে চিনতে পারছেন না তাইনা? তারপর নিজেই নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিল, আমি রেহানা রহমান। যেদিন কলেজে ভর্তি হন সেদিন আপনাকে দেখেছিলাম। ভর্তির ফর্ম থেকে আপনার নামটাও জেনে নিই, সেই সময়। কিছু মনে করবেন না, সহপাঠীদের সঙ্গে আমি কিন্তু বেশীক্ষণ আপনি করে কথা বলতে পারিনা। তুমি বললে আপত্তি করবেন না তো! সরল আর সহজ স্বীকারোক্তি, ভীষণ ভালই লেগেছিল কারণ তাতে কোন অহংকার নেই। তাই আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। আমাদের গ্রামের স্কুলেও গুটি কয়েক ছাত্র-ছাত্রী ওদের সম্প্রদায় ভুক্ত ছিল। ছেলেরা আমাদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করলেও মেয়েরা একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলতো। হয়তো কোন ধর্মীয় সঙ্কোচ তাদের এভাবে চলতে বাধ্য করতো। কিন্তু রেহানার সাবলীলতায় সে ভুল যেন ভেঙে গেল আমার। বললাম না আপত্তি কিছু নেই। ও বলল, কিন্তু একটা শর্ত আছে, আমাকেও কিন্তু আপনি বলা চলবেনা। বললাম, চেষ্টা করব। ও প্রতি উত্তরে মৃদু হাসল শুধু। একেবারে প্রথমেই যে তাকে তুমি বলতে পেরেছিলাম তা কিন্তু নয়। তবে ধীরে ধীরে একদিন সেই জড়তা ভেঙে গিয়েছিল এবং রেহানাকে তুমি বলতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। তবে তার সঙ্গে কথাবার্তা হতো কালে ভদ্রে এবং খুব সামান্য। মনে মনে ভাবতাম রেহানাও তো শহরের মেয়ে, তবুও ওদের সঙ্গে কত পার্থক্য। মনে পড়ে সপ্তাহ দুয়েক আগে এই পথেই ফিরছিলাম। রেহানা একটা বাড়ীর বারান্দা থেকে আমাকে ডাকলো। এই যে প্রান্তিক! আমি তাকিয়ে দেখি একটা বাড়ীর বারান্দা থেকে রেহানা ডাকছে। খুব হাসিখুশী, গোধূলির রক্তিমাভায় ভীষণ সুন্দর লাগছিল ওকে। আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম, ও বারান্দা থেকে নেমে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, এটা আমাদের বাড়ী, চলনা! কিন্তু! কিন্তু কি? তারপর কি মনে হতে হেসে ফেলল, ও আমি তোমাদের স্বধর্মের লোক নই বলে তোমার সঙ্কোচ হচ্ছে? না ঠিক তা নয়। তবে অত ইতস্তত করছ কেন? চলনা ভিতরে। বলে হাত ধরে প্রায় জোর করে টেনে নিয়ে গেল। আমার কোন প্রতিবাদই সে শুনল না।
বাড়ীতে ওর একটা আলাদা পড়ার ঘর আছে। বাইরে থেকে ঠিক বোঝা যায় না। কিন্তু ঘরগুলো ভীষণ ছিমছাম এবং সুন্দর ভাবে সাজানো। ও আমাকে ওর পড়ার ঘরে বসিয়ে রেখে ভিতরে চলে গেল। একটু পরে এক ভদ্রমহিলা এসে দাঁড়ালেন আমার সামনে। বললেন আমি রেহানার! ও বলছিল তুমি নাকি ভিতরে আসতে চাও নি। কিন্তু কেন? কিসের সঙ্কোচ? আমি আর কি বলব। আমি উঠে ওঁনাকে প্রণাম করলাম, কোন বাধা দিলেন না। ওনার প্রশ্নের উত্তরে বললাম ঠিক তা নয়, আসলে আমার খুব তাড়া আছে। কেন? জানতে চাইলেন ভদ্রমহিলা। আমি বললাম আপনি হয়তো জানেন না। আমি গ্রামের সম্পর্কে এক পিসিমার কাছে থাকি, বলেছিলেন একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে তাই আর কি? ভদ্রমহিলা পাশের একটা চেয়ারে বসে বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন বোসনা। আমি বসলাম। ভদ্রমহিলা বলে চললেন, তোমার কথা শুনেছি রেহানার কাছে। তুমি তোমার এক আত্মীয়ার বাড়ীতে থাক তাও বলেছে আমায়। প্রায় দিনই তোমার কথা বলে। আমার কথা? অবাক হয়ে বলি, কিন্তু ওর সঙ্গেতো কলেজে আমার কোন কথাই হয় না বলতে গেলে। আমার কথা বোজ কি করে বলবে? ভদ্রমহিলা বললেন ও সেই কথাই বলে, যে তোমার সঙ্গে রোজ দেখা হয় অথচ তুমি ওকে এড়িয়ে চল, কোন কথাই বলতে চাওনা। আমি ওকে বলেছিলাম, একদিন ছেলেটাকে নিয়ে আয়না আমাদের বাড়ীতে। ভদ্রমহিলার কথা শুনতে শুনতে আমার বিস্ময় যেন আর কাটেনা। আমাদের কথা বলার মাঝে রেহানা একটা প্লেটে কিছু খাবার এবং চা নিয়ে ঘরে ঢুকলো। কিন্তু আমি যে কেন ওর দিকে সোজাসুজি তাকাতে পারছি না কে জানে? ভদ্রমহিলা বললেন, তোমরা কথা বল, আমি দেখি সেলিনা এখনো আসছেনা কেন? সেলিনা, রেহানার ছোট বোন, আগামীবার উচ্চমাধ্যমিক দেবে।