তমালী বলে ওঠে দেখ দেখ, আমাদের কিছুতেই ও বন্ধু বলে মানবেনা। ক্লাশের বন্ধুদের কেমন আপনি করে বলছে দেখ। মুক্তি বললো, ওকে ঐ পুকুরের জলে ডোবানো দরকার, যদি তাতে ওর নতুন জন্ম হয়। তমালী বলে নারে, তাতে আবার শ্রীরাধিকার মান হতে পারে। ওকে নিয়ে ডোবার অধিকারতো তার। তার চেয়ে ছেড়ে দে, আমরা শ্রীরাধিকাকে বলি। এই যে ভাই অশ্রুকণা তোমার কানু অপেক্ষা করছে ঐ পুকুর পাড়ে কৃষ্ণচূড়ার নীচে। আবারও খিল খিল করে হেসে ওঠে একসাথে। তারপর হাসতে হাসতে দল বেঁধে চলে যায় ওরা। মনে মনে ভাবি কি রকম ফাজিল মেয়ে সব। লজ্জা সরমও নেই।
কিন্তু আমি এখন কি করব। ওটুকু সময়ের মধ্যে যা যা করার সবই করেছে ওরা। টানাটানিতে জামার একটা অংশ ছিঁড়ে গেছে। সেলাই না করে ওটা পরে আর কলেজে আসা যাবেনা। বইগুলো যে কোথায় কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কে জানে? খুঁজে দেখতে হবে। টানা হ্যাঁচড়ায় হাতের কবজিতে ব্যাথা এখনো টনটন করছে। যে ভাবে চুল ধরে টানাটানি করেছে, তাতে মাথা নাড়াতেই কষ্ট হচ্ছে। কি অপরাধ আমার? কলেজে আসি, আবার ফিরে যাই আপন মনে। অন্যান্য ছেলে মেয়েরা যখন আড্ডা মারে, আমি তাতে যোগ দিইনা। ডালে লাগেনা তাই। কিন্তু এটাও তো সত্য, ওরাতো কোনদিন ডাকেনি আমাকে। হা একদিন বলেছিল বটে, কলেজের প্রায় ১০/১২টি ছেলেমেয়ে একসঙ্গে কলেজ ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছিল, আমার ভীষণ খিদে পেয়েছিল তাই পকেটের পয়সা গুনে নিয়ে সামান্য কিছু খাওয়ার জন্য ক্যান্টিনে ঢুকেছিলাম। ক্যান্টিনের বিশুদা, পুরো নাম জানিনা ঐ নামে সবাই ডাকে–আমাকে বলল কি খাবে প্রান্তিক?–আমি বললাম, ৫০ পয়সা আছে তাতে যা হয় দাও। আমি বিশুদাকে দিতে বলে, পিছনের একটা ফাঁকা সিট দেখে এগিয়ে চলেছি। কলেজ বন্ধুদের
মধ্যে একজন, নাম মনে হয় বিমল, আমাকে বলল, আরে প্রান্তিকবাবু যে এসো এসো, আজ তোমার ঘাড় ভেঙে আমাদের চা খাওয়া হবে। বলেই তমালী শিপ্রাদের বলল, একটু সরে বসতো তোরা, প্রান্তিকবাবুকে বসতে দে। আমি বললাম, না ভাই আপনারা আরাম করে বসুন। আমি পিছনের সিটে বসব। তমালী ফোড়ন কেটে ওঠে কেন ভাই আমাদের সঙ্গে বসলে কি আপনার জাত যাবে? শিপ্রা বলল, না ভাই আপনাকে খাওয়াতে হবে না, আমরাই খাওয়াব। বসুন না, আমাদের সঙ্গে বসে এক কাপ চা না হয় খেলেনই। আমি বললাম, আমি চা খাইনা। একথা বলেই ওদের কথার আর কোন উত্তর না দিয়ে পিছনে গিয়ে বসলাম। বিশুদা একটু পরেই ২ খানা হাতে করা রুটি এবং খানিকটা ছোলার ডাল দিয়ে গেল। আমি কোন ভাবে খেয়ে উঠে পড়লাম। শুনতে পাচ্ছি তখনো আমাকে নিয়ে ওরা হাসাহাসি করছে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু উপায়ই বা কি।
তখনো সন্ধ্যে হয়নি। একটা খাতা খুঁজেই পাওয়া গেলনা। ওতে আমার বেশ কিছু জরুরী নোটস্ ছিল। এত খারাপ লাগছে যে, বাড়ী ফিরতেও আর ইচ্ছে করছেনা। চুপচাপ বসে আছি শান বাধানো পুকুর ঘাটের বেদীতে। ভাবছি সন্ধ্যার আঁধার নেমে এলে আস্তে আস্তে চলে যাব।
এরইমধ্যে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন। একা একা পথ চলতে ভয় হয়। গ্রামের স্কুলে যখন পড়তাম হেডমাষ্টাব, মশাই ভীষণ ভালবাসতেন। আমি মোটামুটি লেখা পড়ায় খুব একটা খারাপ ছিলাম না বলে গ্রামের সকলে আমাকে ভালবাসতেন।
তখন ১১ ক্লাসে উচ্চমাধ্যমিক ছিল। টেষ্টে ভাল নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে হেডস্যার বললেন; তাঁর এক ছাত্রী থাকে কলকাতায়। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করে। ওদের কোন সন্তান নেই। তোমার কথা বলেছি ওদের। তুমি কলকাতার কলেজে গিয়ে ভর্তি হও। ওরাই সব ব্যবস্থা করে দেবে, তোমার কোন আপত্তি নেই তো। হেডস্যারের ছাত্রী মানে গ্রামের সম্পর্কে আমাদের নীলাঞ্জনা পিসি, মাঝে মাঝে গ্রামের উৎসবে আসেন গ্রামের বাড়ীতে। মাঝে মাঝে ডেকে কথাও বলেন। কিন্তু তবু যেন মনে হয় কত দূরের মানুষ। কেন্দ্রীয় সরকারের একজন জুনিয়ার একাউন্টস অফিসার নীলাঞ্জনা পিসি, পিসির বর পরিমলদাও ভাল চাকরি করেন। তবে প্রাইভেট ফার্ম। ওদের একটাই দুঃখ, কোন সন্তান। হয়নি। আমার বয়সটা ঠিক ওদের সন্তানের বয়সের মতো নয়।
কলকাতায় হেডস্যারই আমাকে নিয়ে এসেছিলেন নীলাঞ্জনা পিসির কাছে। আসার কথা ব্যক্ত করে নীলাঞ্জনা পিসিকে বললেন যে, তোমার যদি কোন অসুবিধা হয়, তাহলে বল। পিসি বললেন, আমাদেরতো কোন অসুবিধা নেই, বরং ও থাকলে আমাদের কিছু সুরাহাই হবে।
সারাদিনের ক্লান্তির পরে আমরা যখন ফিরি, জীবনের সবকিছু একঘেয়েমি বলে মনে হয়। ও থাকলে অন্তত কিছুটা হলেও একঘেয়েমির ছন্দপতন হতে পারে। উত্তরে হেডস্যার বললেন একটা কথা বলব নীলু?–বলুন। আজকাল তো চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক উন্নত, তোমরা চেষ্টা করছনা কেন? চেষ্টা করা হয়েছে স্যার, কিন্তু ঈশ্বর যা চায়নি তা কি জোর করে পাওয়া যায়? তারপর বললেন তা হলে অরফ্যান হোম থেকে তো দত্তক নিতে পার? না স্যার, দত্তকের কথা ভাবিনি কখনো। আরো দু-এক জন যে বলেনি তা নয়, কিন্তু বিষয়টি আমাদের বিবেচনার মধ্যে নেই স্যার। আর তাছাড়া দোষ যখন আমার, তখন পরিমলকে আমি কেন আমার ভাগ্যের সঙ্গে জড়াব। বুঝতে পারলাম না তুমি কি বলতে চাইছো? নীলাঞ্জনা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, তারপর ধীরে ধীরে বলে যে, আমি ওকে আবার বিয়ে করতে বলেছি। অবাক হয়ে হেডস্যার বলেন, সেকি কথা নীলু! তুমি এর পরিনাম জানো? জানি স্যার। একদিন হয়তো ওর ঘরে আমার আর জায়গা হবে না। কিন্তু ওতো সুখী হবে, পূর্ণ হবে ওর পিতৃত্ব।