অশ্রু, আমি এবং প্রতীম কাকু পাশের ঘরে চলে এলাম। রেহানা বলল, একি পাগলামি করছিস সেলিনা। রেহানার শান্ত সরোবরে প্রান্তিক হয়তো স্নান করতে পারে, ভাসতে পারে না। তুই কি বুঝিসনা যে উদ্দাম ঝড় নিয়ে ওকে তুই উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাস, সেখানেই। ওর মুক্তি, তোরও মুক্তি। কেন মিথ্যে নিজেকে রেহানা বানাতে চাইছিস। প্রান্তিক কেবল মুক্তি পেতে পারে তরঙ্গ বিক্ষুদ্ধ সাগরের ঊর্মিমালায়। ওর সেই মনটাকে বুঝতে না চেয়ে নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস ওকেও কষ্ট দিচ্ছিস। সেলিনা এবার বলল আমার কষ্টটাই কি সব? তুই কি বলতে চাস তোর কষ্ট আমি বুঝি না। তুই জানিসনা, আমার মাঝে ও শুধু তোকে খোঁজে। কেমন করে আমি তাকে বোঝাবো, এভাবে সেলিনার মধ্যে রেহানাকে পাওয়া যায় না। তাই উদাস চোখে অতীত স্মৃতিচারণায় ওর মন যখন ভারি হয়ে ওঠে, সেলিনার উদ্দামতা সে মূহর্তে ও চায় না রেহানা। ও শুধু তোকে খোঁজে। আমি স্ত্রী হয়ে কি ভাবে ওর কষ্ট লাঘব করব তুই আমায় বলে দে। ওকে কাছে টেনে নিয়ে পাশে বসিয়ে বলল। ও তোর ভুল সেলিনা। সে সময় ও তোকেই চায়। সেলিনার উদ্দাম ঝড়ে সে নিজেকে সঁপে দিতে চায়, আর তুই ভুল বুঝে অন্য কিছু হতে চাস বলে ওর কষ্টটা শুধু বাড়িয়ে দিস। রেহানা! হারে সেলিনা ঠিক তাই। আর ভুল করিসনি লক্ষ্মীটি। প্রান্তিকের রক্তের উত্তরাধিকার তোর মধ্যে বড় হচ্ছে। সেই উত্তরাধিকারের একমাত্র দাবীদার হয়ে ওর জীবনটাকে মরুভূমি করে দিসনে। জানি আমার জন্য তোর কষ্ট হয়, তাইতো তুই নিজের বুকে পাথর চাপা দিয়ে একটু একটু করে প্রান্তিকের দিকে এগিয়ে দিয়েছিস আমাকে। আমি কি বুঝি না বলতে চাস? তারপর বলল যেখানে তোর জন্ম, তাদের কাছে তোর ওই সিঁথির সিঁদুর হয়তো খেলার অলংকার মাত্র, কিন্তু এদের কাছে এর যে কি অসীম মূল্য তা হয়তো এতদিনে জেনে গেছিস, তাই কথা দে, কোনদিন ওকে তুই আঘাত দিবিনা। সেলিনা বলল, এত কষ্ট তুই কেমন করে সইবি রেহানা। ভয় নেই সেলিনা, একদিন গুরু হিসাবে যাকে মেনে নিয়েছিলাম, আজো মানি, আমার চলার পথে ওর আর্শীবাদ আমি পেয়ে গেছি, সেলিনা এবার এসেছি তোর কাছ থেকে মুক্তি নিতে। দিবিনা আমায় মুক্তি? সেলিনা কায়ায় ভেঙে পড়ে বলল পারবো না রেহানা, কিছুতেই পারবো না তোর কাছ থেকে ওকে কেড়ে নিতে। তা হলে কি চাস তুই, তোর কাছ থেকে ওকে আমায় কেড়ে নিতে বলছিস? নারে রেহানা, একদিন যেমন বুঝতেও দিইনি, আমার কষ্ট কোথায়, আজও তেমনি করে ওকে তোর জন্য রেখে দিয়ে আমি ফিরে যেতে চাই। পাগল। এইজন্য বুঝি বরমাল্য দিয়ে ওকে গ্রহণ করেছিলি? ওর দেওয়া সিঁদুরে তোর সিঁথি লাল, আজ আর পালাবি কোথায়? তবু আমি পারব না রেহানা। রেহানা বলল, দেখ সেলিনা আর এই ভাবে এতগুলো জীবন নষ্ট করে দিসনা। তারপর বলল, কেন পারবিনা। ভয়টা কোথায়? আমি তোকে অভয় দিচ্ছি রেহানার অশরীরী ছায়া তোকে কোনদিন আর স্পর্শ করবেনা। দুর থেকে আমি তোদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবো। তোর অশ্ৰুদি থাকবে পাশে সদা জাগ্রত প্রহরীর মতো। জীবনে যাতে কোন ভুল না করিস। থাকবেন নীলাঞ্জনা পিসি এবং আমার মা মিনতি সেন। অভিভাবকের মতো আছেন প্রতীম কাকু, আর সবার ওপরে রয়েছে প্রান্তিক, যে তোর যাবতীয় ভয় ও আশঙ্কা কাটিয়ে তোকে আপন করে নেওয়ার জন্য। আর একটা কথা সেলিনা, তুই সেলিন, যে সেলিনার উদ্দাম প্রেমের কাছে ধরা দিয়েছে প্রান্তিক, রেহানার প্রেম সেখানে কোনদিনও পোঁছাবেনা। তাই মিথ্যে আশঙ্কা ত্যাগ করে, তোর দুরন্ত ঝড়ো প্রেমে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যা, এই আমার শেষ অনুরোধ। ভুলে যাসনে তোর রক্তমাংসে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে প্রান্তিকের উত্তরাধিকার। তার কাছে তুই কি কৈফিয়ৎ দিবি?
সেলিনা বলল, কিন্তু সে আসবে কী না তারতো কোন নিশ্চয়তা নেই। বিস্মিত হয়ে, রেহানা বলল কেন? সেলিনা সেদিনের সব ঘটনা খুলে বললে, রেহানা বলল, প্রান্তিক হয়ে, রেহানা বলল কেন? সেলিনা সেদিনের সব ঘটনা খুলে বললে, রেহানা বলল, প্রান্তিক আমায় সব কথা বললেও ও প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছে। হয়তো আমায় আঘাত দিতে চায়নি। কিন্তু সেলিনা সেদিন যাইই ঘটুক না কেন, সে সব ঘটেছে রেহানার অশরিরী উপস্থিতিতে। ও আঘাত হোর ও তোর সন্তানের কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। সে আসবেই, তাই তাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য নিজেদের মানসিক ভাবে প্রস্তুত কর। সব শেষে আশীর্বাদ চেয়ে নে প্রান্তিকের বাবা ও মায়ের কাছ থেকে, কারণ ওর রক্তধারাতো তাদেরই থেকে বয়ে আসছে। সেলিনা শুধু দেখছে অবাক হয়ে তার দিদি রেহানাকে। এর পর রেহানা ডাকল, অশ্রু তোরা একবার এ ঘরে আসবি? আমরা সবাই এঘরে এলে, আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, প্রান্তিক, মনের সম বিধা কাটিয়ে সেলিনাকে তুমি একান্ত করে নাও। ওর অভিমানকে গভীর মমতায় মুছিয়ে দিয়ে রেহানাকে নিষ্কলুষ কর। তোমার জীবনে রেহানাব ছায়াও যাতে না পড়ে সেই আর্শীবাদ তুমি আমায় কর প্রান্তিক। ও এই প্রথম তার মাথা নামিয়ে দিলো আমার পায়ের কাছে। বললাম তাই হবে রেহানা। এবার রেহানা এগিয়ে এসে প্রতীমবাবুকে বললেন, যে আদর্শ ও ভালবাসার অতুল ঐশ্বর্য নিয়ে আপনি এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন আমাকে তার শরিক করে নেবেন কাকু? বুঝতে পারছি প্রতীম বাবুর বুকের মধ্যে যেন কি হচ্ছে। বললেন, রেহানা মা, তোমাকে পথ দেখাবার সাধ্য কোথায় আমার? শুধু তোমার চলার পথকে আরো সুগম করার অঙ্গীকার করতে পারি মাত্র। তা হলে তাই করুন। কি করতে হবে মা। শুধু আপনার ড্রাইভার আকবরকে বলুন আমাকে যেন আমার কর্মক্ষেত্রে একটু পৌঁছিয়ে দেয়। ওরা আমার পথ চেয়ে আছে। সেলিনা, আমি ও অকণা একসঙ্গে বলে উঠলাম রেহানা! প্রতীমবাবু বললেন, কেন বাধা দিচ্ছো! ওকে যেতে দাও। অশ্রুকণা বলল, আমাকে কিছু বলবিনা রেহানা? হ্যাঁ বলব। আমার মা মিনতি সেনকে আমার কথা বলিস, কাজ যখন শেষ হবে, যাবো তার কাছে ফিরে, ততদিন যেন আমার জন্য অপেক্ষা করেন।