তপতী ও অশ্রুকণা ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে বলল, তা হলে মিথ্যে মেখলা খুলে ফেলেছিস বল। তারপর বলল, তোর চলার পথে বাধা সৃষ্টি করতে চাইনে। কিন্তু রেহানা একবার আমার দিকে তাকা। আমাকে তোর কিছুই বলার নেই? আছে অঞ। অনেক কথাই বলার আছে। কিন্তু যে কথা বলব, সে তো ওর কথা। বরং আমার হয়ে ওই তোকে বলবে। তবু তার মুখ দিয়ে যে কিছু শুনতে চাই। ও বলল, সেদিন যখন সকলের অগোচরে পথে নেমেছিলাম, মনে একটাই ইচ্ছে ছিল ডালিমদের ষড়যন্ত্রে যেন শেষ না হয়ে যায় ফুলের মত দুটো জীবন। একজনের মধ্যে তীব্র আগুন, আরেকজনের দ্যোদূল্যমানতা, আমায় সংকল্পে অটল করে। মনে মনে ভাবি, তুলনাহীন এই ভালবাসাকে আমি ব্যর্থ করে দিতে পারি না। যারা ব্যর্থ করে দিতে চায় একবার তাদের মানবিকতার কাছে আবেদন জানাবো। যদি শোনে ভাল, না হলে নিজেই শাস্তি দেব। তবু কিছুতেই সেলিনার প্রেমকে ব্যর্থ হতে দেব না। আর তাই নিজের পরিচয়কে গোপন করে গিয়েছিলাম ডালিমের কাছে। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে পড়ে গেল প্রান্তিকের মুখ। তার কথা। হৃদয় জয় করতে হয় ভালবাসা দিয়ে। মুহূর্তে নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ডালিমকে বললাম, তোমাকে আমিই পথ দেখাবো ডালিম। ও সাতদিন সময় নিয়েছিল। কিন্তু বুঝতে পারিনি, জীবনের অঙ্ক সহজ ভাবে মেলে না। একদিকে প্রান্তিক তার আচরণের মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছে নতুন পথ, আর ডালিমের মৃত্যু আমাকে দিয়েছে সত্যের সন্ধান। যে সত্যের সন্ধান আমি পেয়েছি প্রান্তিকের কাছ থেকে। আমি জানি সে সত্যের সন্ধান, এতদিনে তুইও পেয়ে গেছিস তাই নতুন করে তোকে কিছু বলার নেই অশ্রু। নিশ্চয়ই তোদের গাড়ী প্রস্তুত। অশ্রু বলল, হ্যাঁ, প্রস্তুত। তা হলে ওঠা যাক। তপতী এতক্ষণ কোন কথা না বলে এক পাশে দাঁড়িয়েছিল। রেহানা আস্তে আস্তে তার কাছে এসে তার দুটো হাত ধরে বলল, তোমার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই তপতীদি। তাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তোমায় ছোট করতে চাইনে। শুধু একবার অনুমতি দাও আমার শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে। রেহানা। চোখ দুটো ওর ছল ছল করছে। রেহানা বলল, নতুন করে আর কোন কিছু বলার নেই তপতীদি। আমি আবার আসব তোমার কাছে, বার বার আসব। তোমার চোখ দিয়ে দেখব আমি নীল আকাশ সবুজ প্রান্তর আর জ্যোছনার প্লাবন। এতদিনের মিথ্যাচারকে অভিমানের আড়ালে চাপা দিয়ে আমায় তুমি দূরে সরিয়ে দিওনা তপতীদি। অশ্রু বা সেলিনাকে যা দিতে পারব না, সেই কষ্টের বোঝা তোমার পায়ে নামিয়ে রেখে আমি আমার শ্রদ্ধা জানালাম। কোনো অজুহাতে তা ফিরিয়ে দিওনা। বলে সত্যি সত্যি রেহানা তপতীর পায়ে হাত রাখতে যেতেই তপতী তাকে দুহাতে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বলল, তোমার দেওয়া কষ্ট আমার বুকের মধ্যে নিয়ে তোমায় আমি ঋণমুক্ত করলাম রেহানা। আমার দরজা চিরদিন তোমার জন্য ভোলা রইল। আমার চোখ দিয়ে এই বিরাট পৃথিবীকে তুমি আর কতটুকু দেখতে পাবে। বরং আমিই দেখব তোমার চোখ দিয়ে এই পৃথিবীকে, এইটুকু দাবীর অধিকার তুমি আমায় দাও ভাই। তাই দিলাম তপতীদি। এবার অশ্রুকে তাড়া দিয়ে বলল, চল তা হলে, ওরা এসে গেলে হয়তো আবার পথরোধ করে দাঁড়াবে। এবারও যাওয়া হবে না।
আমাদের গাড়ীটা ছেড়ে দিল। তপতী তাকিয়ে আছে যতক্ষণ দেখা যায়। যখন আমরা অশ্রুদের ওখানে পৌঁছালাম তখন দুপুরের সূর্য বেশ খানিকটা হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। আমরা না যাওয়াতে সেলিনা ও প্রতীমবাবু ফিরে এসেছেন বেশ খানিকটা আগে। কিন্তু সব কিছু বন্ধ থাকাতে সীতা শুধু ফাঁকা বারান্দায় বসে পাহারা দিচ্ছে শূন্য খাঁ খাঁ বাড়ীটা। সেলিনা জিজ্ঞাসা করল অশ্ৰুদি কোথায়? তাতো জানিনা বৌদিমনি। আপনারা বসুন, আমি সতভূষণ বাবুকে ডেকে আনছি। প্রতীম বাবু বললেন, দরকার নেই, তুমি এখানেই থাক, আমরা ওর ওখানে যাচ্ছি। অশ্রু এলে আমাদের সংবাদ দিও। তাই হবে বলে ও ঘাড় নাড়ল। আমরা এসে যখন শুনলাম, তখন অশ্রুকে বললাম তুমি রেহনাকে নিয়ে ঘরে যাও, আমি দেখছি।
সবে কফির কাপে ঠোঁট দুইয়েছেন আমি দ্রুত ঘরে প্রবেশ করতেই কনক বলল, দাদা তুমি? এত তাড়াতাড়ি চলে এলে? আমি ওর কোন কথার উত্তর না দিয়ে সেলিনাকে বললাম, সেলিনা, রেহানা এসেছে। যুগপত বিস্মিত হয়ে প্রতীমবাবু বললেন কে রেহানা? হ্যাঁ, কাকু। তাহলে চল আর দেরি নয়। সংবাদটা শুনে সেলিনা যেন নীরব হয়ে গেল। কফির কাপটাকে ও আর ঠোঁটের কাছে আনতেই পারলনা। থরথর করে কাঁপছে ও। কনক এসে ওকে ধরে বলল, বৌদি তোমার কি শরীর খারাপ কবছে? প্রতীমবাবু বললেন, কি হলো মা! তারপর ওকে দুহাতে তুলে বললেন, এস তোমাকে শুইয়ে দিই। ও বলল, না কাকু, দরকার নেই চল।
কনক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আমার দিকে, কত যেন প্রশ্ন আছে ওর। প্রতীমবাবু সেলিনাকে নিয়ে এগুতেই কনক বলল দাদা, রেহানা কে? বললাম ওর দিদি, কিন্তু বোন, এখন আর কিছু জানতে চাসনে পরে আসব।
চলে এলাম, কতদিন পরে মুখোমুখি রেহানা ও সেলিনা। দুজনেই দুজনার দিকে তাকিয়ে আছে ভাষাহীন অপলক চোখে। তারপর এক সময় বেহানা বলল, কি রে আমাকে চিনতে পারছিস না। ও কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে আছে দেখে বলল, কি অপূর্ব লাগছে তোকে। আয়না আমার কাছে। তবুও স্থানুর মত দাঁড়িয়ে আছে দেখে বলল, এত অভিমান! সেলিনা এবার তাকালো অশ্রুকণার দিকে! তার রক্তিম সিঁথি তাকে কি কোন নতুন সংকেত দিতে চাইছে। কিন্তু নিজেকে যথা সম্ভব সংযত রেখে বলল, কাকু, এই রেহানা, যার ভালবাসার স্রোতে আমি ভেসে ভেসে এসেছি প্রান্তিকের কাছে। এবার যার জিনিষ তার হাতে তুলে দিয়ে আমিও ছুটি চাই কাকু! প্রতীমবাবু অবাক হয়ে দেখছেন রেহানার স্নিগ্ধ রূপ, যা জোছনার মিগ্ধতাকেও হার মানায়। রেহানা কাছে এসে প্রণাম করে বলল, ওকে বুঝিয়ে বলুন কাকু ওর কাছ থেকে আমি কিছু নিতে আসিনি, দিতে এসেছি সর্বস্ব উজাড় করে নিজেকে রিক্ত করে ঋণমুক্ত হতে। প্রতীমবাবু বললেন, আমি জানি মা। তুমি ওকে ভুল বুঝোনা। তুমি ভাবতেও পারবেনা, কি প্রাণান্তকর প্রয়াসে, ও প্রান্তিকের কাছে শুধু রেহানা হতে চেয়েছে। যাতে প্রান্তিকের জীবনে তোমার জন্য কোন শূন্যতা না থাকে। তোমরা কথা বল। আমরা পাশের ঘরে আছি।