ও নীরবে সব শুনলো, তারপর শান্তভাবে বলল, এত কথা জেনে আমার কি লাভ? তাছাড়া আপনারা কে? কেন আমাকে এত কথা শোনাচ্ছেন! কেন আমাকে রেহানা বলে ভুল করছেন। আমিতো বলেছি আমি রেহানা নই, আমি রুকসানা। অশ্রুকণা আর থাকতে পারল না বলল তুই রেহানা নোস? না–না–না! অশ্রুর চোখের ইঙ্গিতে আমি ও তপতী বেরিয়ে এলাম, অশ্রুকণা বলল, তুই যে রেহানা নোস তার কোন প্রমান আছে তোর কাছে? ও বলল, আমি যে রেহানা তার কি কোন প্রমান আছে? অশ্রুকণা চকিতে তার শাড়ীর আঁচলটা সরিয়ে দিয়ে উন্মুক্ত পিঠে হাত দিয়ে বলল, এই সেই জরুল, এই যে তার নীচে যে আঘাতের দাগ, যা শয়তানদের অত্যাচারে এখনো জাজ্বল্যমান, এসব কি রেহানার প্রমান নয়? আরো প্রমান চাস? না–না চাইনে বলে দু হাতে চোখ ঢেকে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। অশ্রুকণা তাকে কোন রকমের সান্ত্বনা না দিয়ে নীরবে বেরিয়ে এসে আমাকে বলল, তুমি যাও প্রান্তিক। ওকে রাজী করাও, ওকে আমার ওখানে নিয়ে যাব।
তপতী ও অশ্রুকশা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল, আমি ভিতরে গিয়ে ওর পাশে বসে, পরম মমতায় ওর চুল গুলোকে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে ওর উন্মুক্ত পিঠে হাত রাখলাম। ও আরো জোরে শব্দহীন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ওর শরীরের ওঠানামায় ওর কান্নার গভীরতা অনুভব করতে পারছি। বুঝতে পারছি কান্না ওর ভীষণ দরকার। আর ওর কামার স্পর্শ যেন, ছোঁয়াচে রোগের মত আমাকে বার বার ছুঁয়ে যাচ্ছে? খানিক পরে ডাকলাম, রেহানা? ও আস্তে আস্তে উঠে বসল। নিজের শাড়ির আঁচলে মুছে নিল চোখের জল। তারপর বলল, ওই নামে আমায় ডেকোনা প্রান্তিক। রেহানার মৃত্যু হয়ে গেছে। আর সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেছে রেহানার জন্মান্তর। আমি রুকসানা। বললাম, মিনতি সেনকে দেখতে ইচ্ছে : করে না? না। নীলাঞ্জনা পিসিকে? না। তোমার মা আফরোজ বেগমকে। বলেছিতো না-না-না। কাউকে দেখতে ইচ্ছে করে না। তবে মিথ্যে বলবনা প্রান্তিক, ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে একজনকে। কে? ও বলল, তোমার বাবা, গ্রামের সেই শান্তসৌম্য মানুষটিকে, যিনি আমাকে মেয়ে হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। তাকে কথা দিয়েছিলাম, মেয়ে বলে ডেকেছেন, পরে অস্বীকার করবেন নাতো! একবার শুধু একবার তাকে দেখতে ইচ্ছে করে। তারপর আবার চলে যাব আমার নিজের কর্মক্ষেত্র আদিবাসীদের মধ্যে। খুব ভাল কথা। জীবনের কর্ম যজ্ঞ সবার জন্যেতো এক নয়। তুমি যে এই ক্ষুদ্র সংসারের জন্যে নও, তা সেদিনই জানতে পেরেছিলাম, যেদিন তুমি তোমার ভালবাসাকে রূপান্তরিত করে প্রেমিককে বানিয়েছিলে গুরু। কেন আমাকে এমন করে মাটি থেকে ছিন্ন করে ছুঁড়ে দিলে ধরা ছোঁয়ার বাইরে? হয়তো বৃহতের আহ্বান শুনেছো তুমি, তাই ক্ষুদ্রকে বিসর্জন দিতে তোমার বুকটা কাপল না একবারও। এত নির্মম আর নিষ্ঠুর যে, অতীতের যা কিছু সব ভুলে যেতে চাইছো, ভুলে যেতে চাইছে প্রান্তিকের ভালবাসা পর্যন্ত।
ও বলল, তুমি চুপকর প্রান্তিক! আমি বললাম কেন চুপ করব? অসহায় আদিবাসীদের কল্যাণে নিয়োজিত প্রাণের যদি অধিকার থাকে, তার অতীতকে কাঁদাবার তবে আমার কেন অধিকার থাকবেনা, আঘাতে আঘাতে তোমাকে সেই অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার। তা আর হয়না প্রান্তিক। আমি যে নিবেদিত আদিবাসীদের মঙ্গল কামনায়। সেখান থেকে আমাকে আর ফিরে আসতে বলো না। বললাম, বেশ ডাকব না, কিন্তু যে সেলিনার জন্য তুমি এত করলে একবার দেখবেনা, বধূরূপে তাকে কেমন লাগছে। উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার দুটি চোখ। বলল এসেছে তোমার সাথে? এসেছে, তবে এই হাসপাতালে নয়। কোথায়? অশ্রুর ওখানে। তারপর বললাম, চলনা রেহানা, আর একবার আমরা সবাই সবাইকে চিনে নিই। ও বলল তা আর হয় না প্রান্তিক। জীবনে যা পেয়েছি তা আর নতুন করে পেতে চাইনে। তারপর ধীরে ধীরে বলল, তুমি সেলিনাকে গ্রহণ করেছে এ যে আমার কি আনন্দ তা তোমাকে বোঝাবার নয়। আমি বললাম, তোমার আনন্দটাই সব নয় রেহানা। তোমার স্মৃতি তাকে কি করম বিকারগ্রস্থ করে দিয়েছে, কি চেয়েছিলে আর কি হয়েছে সেই অভিশাপকে দেখবেনা? ও আতঙ্কিত হয়ে বলল, কি বলছ প্রান্তিক! আমি যা বলছি তাইতো তোমাকে নিজের চোখে দেখে আসতে বলছি। তুমি ভাবতে পারবেনা, রেহানা হওয়ার জন্য। সেলিনার সেই অক্লান্ত প্রয়াস। সে নিজের জীবন থেকে সেলিনা নামাটাই মুছে দিতে চায়। তার আবদার তাকে রেহানা নামে ডাকতে হবে। সেই দুরন্ত ছটফটে মেয়েটির কি করুন মৃত্যু তা না দেখলে তোমার পথ চলা যে শেষ হবে না। কি যেন ভাবতে লাগল ও, তারপর। বলল, সেলিনাকে তোমার বাবা মেনে নিয়েছেন? হ্যাঁ, মেনে নিয়েছেন। তোমার পিসি এবং মিনতি সেন মানে আমার মা? হ্যাঁ নিয়েছেন। আর আমার জন্মদায়িনী মা আফরোজ বেগম। আমার চোখ ছল ছল করে উঠলো। বললাম তুমি বোধ হয় তোমার মায়ের সর্বশেষ সংবাদ এ জান না। কেন কি হয়েছে? অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো ওর বুক। আমি ধীরে ধীরে বললাম, চোখ বোজার আগে, উনি আমার হাতে সেলিনাকে দিয়ে বললেন, ও যদি স্বেচ্ছায় তোমাকে ও তোমার পিসিকে ছেড়ে না যায়, তাহলে ওর সব দায়িত্ব আমি তোমাকে দিয়ে গেলাম প্রান্তিক। আমাকে ফিরিয়ে দিও না। সেলিনা এবং আমি আতঙ্কিত হয়ে বলতে চাইলাম, এ হয় না। মৃদু হেসে আফরোজ বেগম বললেন অনেক ভুল করেছি। আর করতে চাই না। না প্রান্তিক তোমার জীবনে রেহানার যে স্থান, সেখানে ওকে দিয়ে যাচ্ছিনা, ওর ভাল মন্দের দায়িত্ব শুধু তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি। মা নেই? বলে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল রেহানা। আমি ওর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললাম। নিয়তিকে অস্বীকার করবার শক্তি আমাদের কারো নেই। কিন্তু রেহানা, সেলিনাকে সবাই মেনে নিয়েছে কিনা জানতে চেয়েছো, কিন্তু আমি মেনে নিলাম কি না সেতো জানতে চাইলে না। মৃদু হাসল রেহানা, এ সেই হাসি, যে হাসি আমায় একদিন মুগ্ধ করে রাখতো ঘন্টার পর ঘন্টা। তারপর বলল, আমার কোন ইচ্ছেকে তো তুমি কোন দিন অস্বীকার করনি, আজই বা করবে কেন? আমিতো মনে প্রানে চেয়েছিলাম, ওকে তুমি আপন করে নাও। যত কষ্টই হোক তোমার, আমি জানি আমার এ ইচ্ছেকে তুমি অমৰ্য্যাদা করতে পার না। বললাম ভালো কথা। তোমাদের কারো কাছে আমি কোন রক্তমাংসের মানুষ নই। আমার কোন ইচ্ছে অনিচ্ছা থাকতে নেই। আমি একটা জড় পদার্থ মাত্র। আর সেই জড় পদার্থের অধিকার নিয়ে তোমাদের কাড়াকাড়ি। একবার ভাবলেও না রক্তমাংসের মানুষটির নিজস্ব কোন চাওয়া পাওয়া আছে কি না। মনে হল ভীষণ আঘাত পেয়েছে ও। বলল দেখ প্রান্তিক, তোমাকে আমি আমার গুরু হিসাবে মেনে নিয়েছি। একদিন বলেছিলাম ডালিমকে তোমার কথা উঠতে। সবকিছুকে মেনে নেওয়ার শিক্ষা মানুষকে ভালবাসার শিক্ষা, আমি পেয়েছি আমার গুরুর কাছ থেকে। সেই তুমি আজ যদি নতুন নির্দেশ দাও তাও মেনে নেবো অক্ষরে অক্ষরে। অশ্রুকণা আমাকে গুরু দক্ষিণার কথা স্মরণ করিয়ে আমার বিবেককে জাগাতে চেয়েছে। আজ তুমিও বলছো, তোমার কথা নাকি আমি একদমও ভাবিনি। সত্যি কি তাই প্রান্তিক? তুমি কি চেয়েছিলে তোমাকে নিয়ে একটা সঙ্কট তৈরি হোক, আর সেই সঙ্কটের ভিতর দিয়ে আমাদের চরম স্বার্থন্বেষী চেহারাটা কংকালের মতো বেরিয়ে আসুক। আর সেটাই যদি হয় তোমার গুরুদক্ষিণার দাবী, তাহলে বল কি করতে হবে আমায়। প্রচন্ড অভিমানে যেন কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে। বললাম, না রেহানা, তোমাকে আর আমার দেনা পাওনার সাথে মেলাতে চাইনে। তোমার আপন পথে চলার অধিকার দিলাম তোমাকে। যে মহৎ প্রেম তোমাকে আজ জনারণ্যের মাঝে নিয়ে এসেছে তার থেকে তোমাকে বিচ্ছিন্ন করে কেবল আমার করে পেতে চাইনে। শুধু অনুরোধ, তোমার ছায়াটুকু সরিয়ে নাও সেলিনার জীবন থেকে, শুধু ওকে সেলিনা হয়ে বাঁচতে দাও। ও বলল তাই হবে। যাব আমি অশ্রুর ওখানে। দু চোখ ভরে দেখবো তোমাদের। তারপর চলে যাবো। আমিও তো রক্ত মাংসের মানুষ প্রান্তিক। তাইতো নিরাকার আল্লাহ বা প্রানহীন পাষাণ মুর্তির কাছে, আমার মুক্তির আবেদন না জানিয়ে রক্ত মাংসের মানুষের মধ্যেই, নিজের মুক্তি খুঁজে ফিরছি। তাদের ভালবাসার মধ্যে যে আমি তোমার ভালবাসার স্পর্শ পেতে চাই প্রান্তিক। আর স্বপ্ন দেখতে চাই, পথ প্রান্তে ক্লান্ত তোমাদের হয়তো বা কোন দিন বরণ করে নেওয়ার জন্য রেহানা অপেক্ষা করছে। আমি বললাম, তাই যেন হয়। তোমার স্বপ্ন যেন সত্য ও সুন্দরের স্পর্শে চির অমলিন হয়। এবার চল আমাদের সাথে।