আমাকে আপনারা ভুল বুঝবেন না। বাবা মাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। জানি আমাকেও ফিরিয়ে দেবেন তবু যদি জানতে পারতাম, আমার অপরাধ কোথায়? হয়তো বলবেন এ মিলন ঈশ্বর চাননি। ঘটনার গতি হয়তো তাতে বিশ্বাসের আলপনা আঁকতেও পারে। কিন্তু এক্সিডেন্টতো এক্সিডেন্টই। এটাও জানিনা তিনি কেন এমন চরম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আমি কোন অজুহাত খাড়া করছিনা, যদি সব কিছুকে সরিয়ে দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারেন, আমাকে জানাবেন। আমি অপেক্ষা করব, ইশ্বর আপনাকে শান্তি দিন। কল্যাণাকাঙ্খী প্রতীম।
মনে মনে ভাবলাম, এতবড় মনের মানুষকে আমি খারাপ ভাববো কি করে? বললাম, আপনি উত্তর দিয়ে ছিলেন? না দেওয়া হয়নি। কেন দিলেন না? মায়ের কথা মনে করে। হয়তো ঠিক কথাই বলেছেন মিনতি সেন। যার জন্য তার মা মৃত্যু বরণ করলেন, তাকে কি করে জীবনসাথ হিসাবে বেছে নেবেন তিনি? তবু জিজ্ঞাসা করতাম প্রতীমবাবু কি পরে কোথাও বিয়ে করেছেন? জানিনা। তিনি এখন কোথায় আছেন? তাও জানিনা। বললাম, ওনার কোন অফিস ঠিকানাই আপনি জানেননা? কি করবে? কিছুই করব না পিসি, শুধু চোখের দেখা দেখে আসব। একটা জীবন তো ধ্বংস হয়ে গেল, আরেকটা জীবনও ধ্বংস হয়ে গেল কি না।
মিনতি সেন মৃদু হেসে বললেন কি দরকার প্রান্তিক? আমার পক্ষে যা মেনে নেওয়া সম্ভব হবে না, সেখানে আরেকজনের দুঃখ বাড়িয়ে লাভ কি? লাভ কিছু নয় পিসি, কিন্তু একথা তো সত্য, জীবনে কোনদিন আপনি তাকে ভুলতে পারবেন না। আমি আপনাকে জোর করব না, শুধু ঠিকানাটা দিন। মিনতি সেন বেশ কয়েক বছর আগের অফিস ঠিকানাটা আমার হাতে এনে দিলেন। আমি উঠে পড়লাম। জানতে চাইলেন, আমি আবার কবে আসব। খুব তাড়াতাড়ি আসব, জানিনা কেন সব সময় আপনার কথা মনে পড়ে! আমি বেরিয়ে এলাম।
রেহানার সঙ্গে কলেজে কয়েকবারই দেখা হয়েছে, কিন্তু আমাকে এড়িয়ে গেছে প্রতি মুহূর্তে। আজ রবিবার। পিসিকে বললাম আমি একটু বেরোব পিসি। কোথায়? আমাদের এক কলেজ বন্ধুর জন্মদিন ওদের বাড়ী যাব। তোমাকে লো; না বলে নি, তাইতো জেদ হয়েছে আমি যাব। পিসী আর কথা না বাড়িয়ে আমাকে ২০ টাকা দিয়ে বললেন, জন্মদিনের গ্রীটিং কার্ড আর একটি ফুলের তোড়া নিয়ে যেও।
তোমার জন্মদিনে আমার শুভেচ্ছা লেখা গ্রীটিং কার্ড আর বিভিন্ন রংয়ের ফুলের সমাহারে সাজানো ফুলের তোড়া নিয়ে আমি যখন ওদের বাড়ী উপস্থিত হয়েছি তখনো দুপুর হয়নি। সেলিনা আমাকে ঘরে ডেকে নিল। তার ওর মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, সেদিন উনি আসেননি মা আজ কিন্তু এসেছেন। রেহানার জন্মদিনে, কিছু খাওয়াবেনা? ওর মাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম আমি।
একটু পরে সেলিনা রেহানাকে ডেকে নিয়ে আসে এ ঘরে। আমি আমার ঝোলা থেকে প্রথমে ফুলের তোড়াটা তার হাতে দিতেই ও প্রায় ছিটকে গিয়ে বলে এটাকি? আমি বললাম, আগে গ্রহণ কর তারপর বলছি। ও আমার হাত থেকে ফুলের তোড়াটি নেওয়ার পর আমি গ্রীটিংস কার্ডটা মেলে দিলাম ফুলের তোড়ার উপরে। তাতে এক পলক চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, কে তোমাকে বলল আজ আমার জন্মদিন? আমি হাসতে হাসতে বললাম অত অধৈর্য হয়ো না রেহানা? কে আবার বলবে? তোমার চোখ বলছে, তোমার চেহারা বলছে, সর্বোপরি তোমার এ্যাডমিশান রেজিষ্টার তাকে তুমি অস্বীকার করবে কি করে?
রেহানা আমার কথার কোন প্রতি উত্তর না দিয়ে নিয়ে চলে গেল। আমি ওকে বাধা দিতে গেলে সেলিনা ইশারায় না করল। তারপর বলল, আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন প্রান্তিক ভাই। তারপর তার মাকে বলল, তোমরা না হয় উপোস করবে, কিন্তু প্রান্তিক ভাইকে কিছু খাওয়াবে না। আফরোজ বেগম বললেন এই যাই।
উনি চলে গেলে, সেলিনা বলল আপনি রেহানার ঘরে যান। আজ আপনার অগ্নি পরীক্ষা। মানে? মানে আবার কি, যার জন্মদিনে শুভেচ্ছার উপহার নিয়ে এসেছেন, সেকি উপোষ করে থাকবে নাকি! কিন্তু সেলিনা, কোন অধিকারে আমি তার ব্রত ভাঙব? যদি পারবেন না, তবে দম্ভ করে এলেন কেন? তারপর আরো কাছে এসে চুপিচুপি বলল, ভালোবাসার অধিকারে সব করা যায় প্রান্তিক ভাই! সেই অধিকারে আপনি তার ব্রত ভাঙবেন। কিন্তু একজনের ভালোবাসার অধিকারই কি সব। আরেক জনের দরকার নেই? সেলিনা বলল এইটুকু যদি না বুঝতে পারেন ভালোবাসার কথা বলবেন না জীবনে কখনো। বড় অদ্ভুত মেয়ে এই সেলিনা। বয়সে ছোট হলে হবে কি। জ্ঞানে বুদ্ধিতে আর অনুভূতিতে সবাইকে যেন টেক্কা দেয়। সেলিনা ওর মায়ের কাছে চলে গেলে, আমার পক্ষে আর কতক্ষণ একা একা এ ঘরে বসে থাকা সম্ভব? আমি আস্তে আস্তে যে ঘরে রেহানা আছে সে ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। একটা আকাশী রং-এর পর্দা ঝুলছে দরজায়। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে রেহানা বলল, চলে এস। আমি ভিতরে গিয়ে দেখি, একাকী বসে আছে, পাশে ফুলের তোড়া এবং তার উপর গ্রীটিংস কার্ড আমি নিজেই ওটা তুলে নিয়ে সামনের ড্রেসিং টেবিলের একপাশে যে টিপয় আছে তাতে সাজিয়ে রাখলাম। আর নীচে গ্রীটিংস কার্ডটা খুলে রাখলাম। খাট থেকে তাকালেই দেখা যায়। ও আমার দিকে তাকিয়ে অকারণ একটু হাসল। বললাম হাসলে যে। না, ভাবছিলাম, তুমি এত ভীরু কেন? বুঝলামনা। বুঝে কাজ নেই। ঐ গ্রীটিংস কার্ডটা নিয়ে এস। কেন? আরে আনইনা। আমি নিয়ে এলাম। তারপর খাটের লাগোয়া পড়ার টেবিলের দেরাজ থেকে সবুজ কালির কলমটা বের করে বললো, লেখ। আমি অবাক হয়ে বললাম কি লিখব? বারে! কাকে তুমি জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছ তার নাম লিখবে? আর কে দিচ্ছে? সে জায়গাটাও কি ফাঁকা থাকবে নাকি? আমি পেনটা নিলাম ওর হাত থেকে তারপর সুন্দর করে লিখলাম রেহানাকে আর শেষে লিখলাম প্রান্তিক। কেন। যেন মনে হল আনন্দে ওর চোখ দুটি চক করছে। তারপর নিজেই উঠে গিয়ে এমন সুন্দর করে ফুলের তোড়াটার নীচে রাখল যেন তা আরো সুন্দর ভাবে প্রতিভাত হয়। তারপর আবার নিজের বিছানায় এসে বসল।