সব তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল তপতীর। সিঁথি লাল, অথচ হাতে কোন এয়োতির চিহ্ন নেই। প্রান্তিকের সঙ্গে এসেছে একেবারে আটপৌরে একটা শাড়ী পরে। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল ওর সিঁথির দিকে, বলল, বিজয়িনী তোমাকে দেখছিলাম অশ্রুদি। ও সব কথা প্রকাশ না করে বলল, নীল রক্তে আমার জন্ম তপতীদি, মৃত্যুর আগে নীল রক্ত কখনো হারতে জানেনা। দুঃখের অনুভূতি ময় কণ্ঠে তপতী বলল, হবে হয়তো। সে যাকগে তোমাদের সঙ্গে আর কেউ এসেছে? হাসতে হাসতে অশ্রু বলল, আমার একা এই যাত্রা পথটাকেও কি তুমি কারো সঙ্গে ভাগ করে নিতে বলছ? তপতী বলল, সারা জীবনইতো একা পথ চলার অঙ্গীকার নিয়েছে, চললে না হয় এই সামান্য পথটুকু ভাগাভাগি করে? ও বলল সে আমার দ্বারা হবে না তপতীদি। তারপর ওর সাদা সিঁথির দিকে তাকিয়ে বলল, বরং তুমি যদি বল, আমি তোমার জন্য পথ ছেড়ে দিয়ে অন্য পথে চলে যাবো, হাটবে নাকি ওর সঙ্গে একা দীর্ঘ পথ? তপতী বলল ঠাট্টা করছ? কেন ঠাট্টা করব। কোন কিছুকে গ্রহণ করার অপেক্ষা সহ্য হয়, কিন্তু ছাড়ার অপেক্ষা একদম সহ্য হয়না। তারপর বলল হাসিমুখে ওকে তোমার হাতে তুলে দিয়ে চলে যাব, বুকে বিন্দুমাত্র ব্যথা বাজবেনা, কণ্ঠ কাঁপবেনা একটুকুও। মৃদু হেসে ও বলল ভেবে দেখব, আমার নৌকায় জায়গা আছে কি না। বরং একটুখানি বোস, সকালে নিশ্চয়ই খাওয়া হয় নি, আগে কফি নিয়ে আসি। অশ্রুকণা বলল, তার আগে চলনা ওই রুকসানা নামের মেয়েটিকে দেখে আসি।
ও বলল, ভালই করেছ। আজ না হলে দেখা হতো না। আমার মনেও একটা ক্ষোভ থেকে যেত। উদ্বিগ্ন হয়ে অশ্রুকণা বলল, কেন? ওর আজ ছুটি হয়ে গেছে। ছুটির পরে ও কোথায় যাবে? এখানে থেকে প্রায় ৫০ কিমি দুরে এক আদিবাসী গ্রামে। ওদের মধ্যেই কাজ করেন উনি। ওদের কোন ঠিকানা আছে? নিশ্চয়ই আছে। দিতে পারবে আমায়? দেব। তার আগে আমি কফি আনছি খেয়ে চল রুকসানাকে দেখে আসবে। তাই তোক বলে চুপ করে গেল অশ্রুকণা।
বাঁকুড়া আদিবাসী উন্নয়ন সমাজের পক্ষ থেকে, ওকে এখানে ভর্তি করা হয়েছে। কাল ওদের ওখান থেকে কেউ আসবে বলে জানিয়েছে। এই বেলা চল রুকসানা সত্যি রেহানা কিনা পরখ করে দেখা যাক।
কফিটা খেয়ে বললাম চল তা হলে। তপতী, আমি ও অশ্রুকণা। কেবিনের দরজাটা বাইরে থেকে ভেজানো। তপতী জেনে নিয়েছে ভিতরে কেউ আছে কি না, যদিও এটা ভিজিটিং আওয়ার নয়। তপতী বলল, প্রান্তিক তুমি যাও। আমরা বাইরে অপেক্ষা করছি। তাই হোক, বলে আমি ভেজানো দরজায় টোকা মারলাম। ভিতর থেকে মেয়েলী কণ্ঠস্বর ভেসে এল, খোলা আছে। দরজাটা একটু খানি ফাঁক করে দেখে নিলাম ভিতরের মানুষটাকে। দরজার দিকে পিছন ফিরে দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ওই গ্রীবা দেশ, কোমর থেকে নীচে নামা এক গোছা কালো চুল, তার শাড়ী পরার ভঙ্গিমা, হাত দুটো কেমন করে রাখে সেই স্মৃতি সব কিছু একাকার হয়ে মুহূর্তে আমায় জানিয়ে দিল রুকসানার আসল পরিচয়। তপতী ভুল করে নি, মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছে রেহানা। সুর করে আবৃত্তি করলাম–
একদিন এই ফাঁকা পথ দিয়ে
এসেছিনু তব দ্বারে।
মুগ্ধ নয়নে দেখেছি তোমা
গোপন অন্ধকারে।
ও তড়িতে ফিরে বলল কে আপনি? আমি হেসে ফেলে বললাম—
চিনবে আমায় কেমন করে
হারিয়ে গেছে মন
সে মন আমি ফিরিয়ে দেব
এই করেছি পণ।
ও রেগে বলল, আপনি বেরিয়ে যান। এ ভাবে আপনাকে কে প্রবেশাধিকার দিয়েছে? একথা বলেই সিস্টার সিস্টাব করে ডেকে উঠলো। একটা কেলেংকারী হয়ে যেতে পারে ভেবে তপতী এগিয়ে এল। বলল, কি হয়েছে বলুন। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, একে কে এখানে পাঠিয়েছে, তাছাড়া এটাতো ভিজিটিং আওয়ারও নয়। আমি হতবাক হয়ে ভাবছি, তবে কি আমার ভুল? অশ্রুকণা কিন্তু নিশ্চিত হয়ে এগিয়ে এসে বলল, রেহানা চিনতে পারছিসনা আমায়? তাকিয়ে দেখ আমি অশ্রুকণা, আর কাকে তুই বেরিয়ে যেতে বলছিস? প্রান্তিককে? যে তোর স্বপ্নকে পূরণ করেছে, তোর ত্যাগকে মহিমান্বিত করেছে, সেলিনাকে গ্রহণ করেছে ও জীবন সঙ্গিনী হিসাবে। একদিনতো এই জন্যই কাউকে না জানিয়ে বিবেকের সঙ্গে যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়ে হারিয়ে যেতে চেয়েছিলি। চেয়েছিলি ডালিম যেন তোর একান্ত আদরের সেলিনার কোন ক্ষতি না করে, আর সেই আদরের ধনকে চেয়েছিলি, তোর একান্ত আপন ও গোপন প্রান্তিকের হাতে তুলে দিতে। তুই কেন বিশ্বাস করতে পারলিনা, যে তোর ভালবাসার আবদারকে ও ফিরিয়ে দিতে পারে না। একদিনতো তোরই জন্য আমিও ওর জীবন থেকে সরে যেতে চেয়েছিলাম, পেরেছি কি? তুইও চেয়েছিলি সেলিনার জন্য ওর জীবন থেকে সরে যেতে। কিন্তু পারিসনি তাইতো এই মিথ্যে পরিচয়। আসলে তুই, আমি, আমরা পরাজিত। কিন্তু সব পরাজয় পরাজয় নয়। বাবা মা তার শিশু সন্তানের কাছে বার বার হারার অভিনয় করেন, কখনো বা সত্যি হেরে যান, সে হারার মধ্যে কোনও অগৌরব নেই। হয়তো ডালিমকে পথ দেখাতে চেয়ে তুই তার মঙ্গলই করেছি, কিন্তু নিজেকে এভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে কিসের সন্ধান পাবি তুই? তুই মিনতি পিসিকে বলেছি তাকে একবার মা বলে ডাকতে তোর ভীষণ ইচ্ছে। জানিস কি, তোর সেই ঋণের বোঝা নিজের কাঁধে নিয়ে প্রান্তিক মিনতি সেনের ছেলে হয়ে তোরই ঋণ শোধ করে চলেছে। কি করে ভুলে গেলি তাকে, কি করে ভুলে গেলি, প্রান্তিকের গ্রামে গিয়ে তার বাবাকে বাবা বলে ডেকে তোর সেই আবদার। মেয়ে বলে মেনেছেন ভবিষ্যতে অস্বীকার করবেন না তো? কিন্তু তোর জীবনে এসবের কোন মূল্য নেই। তোর কাছে তোর নিজের অভিমানটাই বড়। বারবার চিঠিতে লিখে গেছিস তোকে যেন না খোঁজা হয়, নিজেই আবার তুই আসবি। এত করেও তোর পরীক্ষা নেওয়া শেষ হলনা রেহানা? জানিস্ তুই সেলিনার কি ক্ষতি করেছিস? ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল রেহানা অশ্রুকণার চোখের দিকে। অশ্রুকণা বলে চলেছে, বুঝতে পারবিনা রেহানা নিজের অজান্তে কতবড় ক্ষতি করেছিস ওর, তোর এই পালিয়ে বেড়ানোতে, তুই না ভাল করেছিস প্রান্তিকের না ভাল করলি সেলিনার। ছিঃ এই কি তোর ভালবাসা? ডালিমকে বলেছিস প্রান্তিক তোর গুরু, আর এই তোর গুরুদক্ষিণা?