ও বলল, একটু দাঁড়াও প্রান্তিক। আমি ওর কথা শুনে দাঁড়ালেও তার শাড়ীর আঁচলটা গলায় জড়িয়ে আমায় প্রণাম করল। আমি ওকে তুলে বুকের মাঝে টেনে নিয়ে বললাম, আর কোন অভিমান নেইতো কণা? আছে। এখনো অভিমান। হ্যাঁ, আমার এ অভিমান কোন দিন যাবে না প্রান্তিক। আজ যা তুমি আমায় দিলে বিনিময়ে তোমায় কি দেব বল? বললাম যা তুমি দেবে তাই নেবো দুহাত ভরে। যদি কোন শূন্যতা থাকে, পূর্ণ করে নেবো তোমার সে দানে। তাহলে কথা দাও, জীবনে কোন দিন কোন ভাবে তুমি সেলিনাকে অবহেলা করবেনা, ও তোমার স্ত্রী। স্ত্রীর প্রাপ্য মর্যাদা থেকে তুমি ওকে কোনদিন বঞ্চিত করবে না। হতভাগীকে আদর করতে করতে কোন দিন তোমার কণার মুখটি ভেসে উঠবে না। বল প্রান্তিক কথা দাও। বললাম, এ বড় কঠিন শাস্তি কণা। ও বলল, আমার সিঁথির রক্ত থেকেও কঠিন? বেশ কথা দিলাম। স্ত্রীর মর্যাদা থেকে কোন দিন তাকে বঞ্চিত করব না। আরেকটা কথা, যতই আমাকে দেখতে ইচ্ছে করুক, সেলিনাকে না নিয়ে কোনদিন তুমি আসবে না আমার কাছে। আমি প্রায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললাম, কণা! জানিগো কষ্ট হবে তোমার। কিন্তু তোমার নিঃসঙ্গতায় আমার যে কি কষ্ট হয় তাকি একবারও বুঝবেনা। বেশ তাই হবে। রাগ করলে? না। শোন প্রান্তিক, সেলিনা তোমাকে পেয়েছে তার তীব্র চাওয়ার মধ্যে দিয়ে। আমি তোমাকে পেয়েছি ত্যাগের মধ্যে দিয়ে। সে তোমার স্ত্রী হয়েও প্রতি মুহূর্তে তোমাকে হারাবার ভয় নিয়ে বেঁচে থাকবে। আমি জানব তুমি আমার কখনো হারাবার নয়। তুমি আমার মনোরাজ্যের অধীশ্বর। আর আমি? তোমার মানসী প্রেমিকা। আমাকে ভুলে যাওয়ার যেমন তোমার কোন উপায় নেই, তেমনি আমার ও উপায় নেই নতুন পথ খুঁজে নেওয়ার। তারপর বলল ওই দেখ পূব আকাশ লাল হয়ে উঠেছে, এখনি আলোর ঝরণা ধারায় ভেসে যাবে সমস্ত বনভুমি। আমার সিঁথির মত লাল ওই সূর্যকে সাক্ষী রেখে তুমি আমায় অন্তত একবারের মত তোমার বুকে টেনে নাও। আমি ওকে নিজের বুকের ওপরে টেনে নিয়ে বললাম কণা। আমি তোমারি শুধু তোমারি। ও বলল, নাগো, তোমার যে মনটা কেউ দেখতে পায় না, সকলের অগোচরে একা পথ চলে সেই মনটা শুধু আমার, আর জাগতিক সুখ-দুঃখ মান-অভিমান ভরা যে জীবন সে শুধু সেলিনার। এবার আমায় ছাড়। সাতটায় সত্যভূষণ গাড়ী নিয়ে আসবে। তার আগে প্রস্তুত হতে হবে। আর তাকে বলতে হবে, আমাদের যাওয়ার ঠিকানা একটু বদলে নিয়েছি আমরা। মানে? প্রান্তিক আমাদের পথের শেষ প্রতীমবাবু ও সেলিনার গতরাতের ঠিকানা নয়। আমরা যাব তপতীদির কাছে। আমি বললম কণা। হ্যাঁ প্রান্তিক। রেহানাকে বলতে চাই, সকলের ভাল করতে গিয়ে তুমিতো কারো ভাল করতে পারলে না। হেরে গেলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে। এখনো সময় আছে, এস আমার সাথে। এস রেহানা আমরা পূর্ণতা ভাগ করে নিই আধা আধি করে। সেলিনাকে মুক্তি দাও। ওকে বাঁচার অধিকার দাও। আমার কণ্ঠে উচ্চারিত হল কণা, তোমার তুলনা শুধু তুমিই।
সকাল সাতটা। সত্যভূষণের বন্দোবস্তে গাড়ী হর্ণ দিয়ে চলেছে। অশ্রুকণা তার আটপৌরে সাজে বেরিয়ে এসেছে। আর পাঁচটা সাধারণ দিন থেকে আজ যেন আলাদ কোন বৈশিষ্ট্য নেই। তবু পিয়াসী মন চেয়েছিল, অন্তত কাল রাতের পোষাকে চলুক সে আমার সাথে। ব্যতিক্রমের মধ্যে উজ্জ্বল বক্তে রাঙানো লাল সিঁথি। যেন বিজয়িনীর আত্ম প্রকাশ। সত্যভূষণ শুধু একবার ওর দিকে তাকিয়ে চোখ নীচু করে নিলেন। যখন আমাদের গাড়ীটা ওর কোয়ার্টারের পাশ দিয়ে যাচ্ছে কনক এসে দাঁড়ালো সামনে। আমি বললাম, কিছু বলবি কুঁড়ি। বলল না, কি আর বলব, তারপর জানতে চাইল, আবার কবে আসবে প্রান্তিকা। হেসে বললাম আমিতো এখান থেকে এখনো যাইনি। এখানেই তো ফিরে আসবেন প্রতীম কাকু ও সেলিনা। কনক অবাক হয়ে বলল, সেলিনা কে? সেলিনাকে চিনিসনা? তারপর নিজেই বললাম, তোর বৌদি? এবার যেন ওর বিস্ময়ের অবধি নেই। বলল, আর তুমি অদি? গাড়ীটা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। অশ্রু বলল, আমি ওর অতীত ও ভবিষ্যত। কুঁড়ি গাড়ীর সাথে সাথে হাঁটতে হাঁটতে জানতে চাইল আর বর্তমান? শুধু সেলিনার বোন। গাড়ীটা হু হু করে এগিয়ে চলল। কুঁড়ির মনে হয়তো অনেক প্রশ্ন ছিল। কিন্তু কোন প্রশ্নই আর করতে পাবে না। গাড়ীটা তখন তার দৃষ্টির বাইরে।
গাড়ীটা যখন জন পদ ছেড়ে সবুজ ধান ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে, আমি বললাম, যে বিজয়িনীর বেশে তুমি চলেছে আসবার সময় ওই ঔদ্ধত ফিকে হয়ে যাবে নাতো। ও বলল প্রভাত সূর্যের রক্তিমাভা, আবির রাঙা গোধুলিতে পায় তার পূর্ণতা। যে রক্ত মিশে গেছে আমার শিরায় শিরায় জীবন থেকে কেমন করে মুছে যাবে তা। বললাম যে কোন বিষয়ে গর্ব থাকা ভাল, অহংকার ভাল নয়। যে অহংকারে তুমি আমায় অহংকারী করেছে গরবিনী অশ্রুকলার সাধ্য কি তাকে হেলায় হারায়। বললাম যদি ফিরতে হয় সেলিনার দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে কি বলবে। বলব এ আমার অনুরাগের রক্তে লাল, তোমার অহংকার দিয়ে এর বিচার করো না। আর প্রতীম কাকু? ভয় নেই প্রান্তিক, সমস্ত উত্তর যে তার জানা। ভাল, কিন্তু তপতী? দুঃখ পেওনা আমার জোরটুকুকে সে স্বাগত জানাবে। আর রেহানা। আমার পূর্ণতাকে সমান দুভাগে ভাগ করে নিতে চাই ওর সাথে, তারপর বলল আর কথা বাড়িওনা। আমার অনুভূতিটাকে আমার মতন করে উপলব্ধি করতে দাও।
২০. তাই তোক তবে
তাই তোক তবে। এখান থেকে বাঁকুড়া শহর বেশী পথ নয়। পৌঁছিয়ে গেলাম এক সময়। হাসপাতালে গিয়ে শুনলাম, ওর ডিউটি আজ ইভিনিংএ। কোয়ার্টারে গিয়ে যখন পৌঁছালাম, তখন বেলা প্রায় ১০টা। বেল দিতেই ও বেরিয়ে এসে আমাকে দেখেতো একেবারে অবাক। অশ্রুকণাকে গাড়ীতে বসিয়ে রেখে এসেছি। ও আমার হাত ধরে ভিতরে টেনে নিতে নিতে বলল, তোমাকে আজ সত্যি মনে প্রানে চাইছিলাম। আমি অবাক হয়ে বললাম, এত আনন্দ কেন তপতী। কেন এত আনন্দ জানিনা প্রান্তিক। শুধু মনে মনে ভাবছিলাম আর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছিলাম, তুমি, সেলিনা বা অশ্ৰুদি যে কোন একজন যেন আজ আসো, আমি যেন কিছুই জানিনা এমন নিরীহ ভাবে বললাম, আজ কি তোমার নবজন্ম যে, আমাদের যে কোন একজনকে চাইছিলে। ও গম্ভীর হয়ে বলল, তা বলতে পার। কিন্তু রুকসানা নামের মেয়েটি এই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরে মনে হয়েছিল যদি তোমাদের যে কোন একজন আসতো। আমি তাচ্ছিল্য সহকারে বললাম কোথাকার কে রুকসানা, তার জন্য আমাদের আসার এত অধীর প্রতীক্ষা কেন? নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল জানিনা, শুধু মনে হয়েছিল, ও কিছুতেই রুকসানা হতে পারে না। ও তবে কে? আমার মনে হয় ও রেহানা। কিন্তু হাজার অনুরোধেও ও তা স্বীকার করেনি। আমি বললাম, তা হলে একটা চিঠি দিয়ে জানালেনা কেন? কাকে, তোমাকে? হ্যাঁ আমাকেই লিখতে পারতে। কোন অধিকারে প্রান্তিক? রেহানা তোমার কে? ছিঃ তপতী একথা তুমি বলতে পারলে রেহানা আমার কে? ও বলল, কোনদিন ভাবিনি, রেহানাকে নিয়ে এ ভাবে তোমার সঙ্গে কথা বলা যায়। আজ তা হলে ভাবলে কেন? তোমার আদর্শ, তোমার মহত্ত্ব তোমার সুগভীর প্রেম ও অনুভূতি গোলক ধাঁধায় হারিয়ে গেছে তাই। কি করে বুঝলে? যে দিন শুনলাম, রেহানা নয়, অদিও নয়, তোমার ঘরে তোমার স্ত্রী হয়ে এসেছে সেলিনা, সেদিন থেকে। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম হায় কি বিচিত্র এই মন আর তার ভালবাসার উত্থান পতন। বললাম তুমি কিন্তু একদিন বলেছিলে, রেহানা নয়, সেলিনাই আমাকে বেশী ভালোবাসে। তাতে অস্বীকার করি না আজো। কিন্তু তুমি? তোমার সমস্ত মন জুড়ে কি সেলিনা ছিল, না রেহানা? হয়তো ওরা দুজনেই ছিল একে অপরের পরিপূরক হয়ে, কিন্তু সে কথা থাক তপতী। তোমার বিচারে রেহানার সংবাদ জানার আমার কোন অধিকার যদি নাও থাকে, জানাতে পারতে সেলিনাকে, জানাতে পারতে অশ্রুকণাকেও, ও বলল অশ্ৰুদিকে তো জানিয়েছিলাম, কিন্তু কি জানি, হয়তো তোমার প্রতি অভিমানে তোমার সমস্ত সংশ্রব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছেন। ততক্ষণে চুপি চুপি কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছে অশ্রুকণা, এবার পর্দা ঠেলে এক রাশ অভিমান নিয়ে বলল, সত্যি তপতীদি, এরপর আর ওর সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যায় না। অবাক হয়ে বলল, তুমি অশ্রুদি? আমার চিঠি পেয়েছিলে? আমি পাইনি, তবে ও পেয়েছিল, আর তাইতো সাত সকালে উঠে ও আমাকে এখানে ধরে নিয়ে এসেছে।