তারপর খাওয়া শেষ করে বললাম এবার তা হলে উঠি। এই তো এলে। বেশী রাত হলে পিসি চিন্তা করবেন। তুমি যে বলেছিলে তোমার পিসি আমায় খুঁজছিলেন, কই তিনি তো ফোন করলেন না। হয়তো সময় পাননি, হয়তো বা যে জন্য খুঁজে ছিলেন তা মিটে গেছে। হবে হয়তো। তারপর একটু থেমে বললেন নীলাঞ্জনা তোমার কেমন পিসি। আমারই মত কি? হঠাৎ এ প্রশ্নের কারণ কি, আমার মন সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে।
কঠিন, অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন। এর উত্তর আমি কিভাবে দেব। তিনি যদি সহজ ভাবে জানতে চাইতেন নীলাঞ্জনা আমার কেমন পিসি, উত্তর দেওয়া সহজ হতো। হয়তো সত্যি কথাই বলতাম, গ্রাম সম্পর্কে পিসি। কিন্তু ঐ যে আমার মতো কি। প্রশ্নটা জুড়ে দিয়ে আমার সবকিছু কেমন এলো মেলো করে দিলেন। কোন উত্তরই দেওয়া হয়না। চুপ করে আছি দেখে বললেন, বললে নাতো। আর এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই বললাম আমাদের গ্রামের মেয়ে। গ্রাম সম্পর্কে আমার পিসি হয়। তবে আমি বিশ্বাস করি, সত্যি কারে দায়িত্ব নেওয়ার যার অধিকার আছে, রক্ত দিয়ে তার বিচার করা যায় না। এই যে বলতে গেলে আপনি তো আমার কেউ নন। অথচ কেন যে আপনার কথা মনে হয় সব সময় বুঝতে পারিনা। সম্পর্ক দিয়ে কি এর বিচার করা যায়? তবে যদি আপনি আমায় অস্বীকার করতেন এড়িয়ে চলতেন, তখন হয়তো মনে হতো আপনিতো আমার কেউ না।
ওঘর থেকে কে যেন বললেন, কার সঙ্গে কথা বলছিস মিনতি? পিসির বাবার কণ্ঠস্বর। বললেন, প্রান্তিক এসেছে। ওই যে কয়েক দিন আগে এসেছিল, তুমি উঠোনা আমি ওকে তোমার কাছে নিয়ে আসছি। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাবা চোখে কম দেখেন, আর সব সময় ভাবেন আমার কি হবে?
মিনতি পিসি কেন এসব কথা বললেন জানিনা, আমি গিয়ে ওনাকে প্রণাম করে বললাম কেমন আছেন? অবাক হলেন যেন বৃদ্ধ ভদ্রলোক। কিন্তু কোন রকম প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করে বললেন, মিনতি ওকে খেতে দিয়েছিস? তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, তোমার নামতো প্রান্তিক? মিনতি বলছিল। তা তুমি কি করছ? আমি বিজ্ঞান নিয়ে অর্নাসে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছি। খুব ভালো খুব ভালো, বৃদ্ধ তারিফ করলেন আমাকে। তারপর বললেন, যাও মিনতির সঙ্গে কথা বল, আমার মতো বুড়োর সঙ্গে তোমার আর কতক্ষণ ভালোলাগবে। বললাম, আমার কিন্তু আপনাকে ভালোই লাগছে। তারপর ওনার বিছানার একেবারে কাছে এসে বললাম, আপনার মাথাটা একটু উঁচু করুনতো দাদু, আমি বালিশটা দেওয়ালের সঙ্গে ঠেশ দিয়ে দিচ্ছি, আপনি বসুন। কি সব সময় শুয়ে থাকেন।
তারপর আমি ওনার মতামতের অপেক্ষা না করে ওনার মাথাটা নিজের হাতে একটু উঁচু করে বালিশটাকে ঝেড়ে দেওয়ালে ঠেশ দিয়ে ওনাকে সাহায্য করে বসিয়ে দিলাম। তারপর নিজেই বিছানার অগোছালো চাদরটা তুলে নিয়ে, মাথার জট পাকানো চুল গুলোকে আঁচড়িয়ে দিলাম। খোঁচা খোঁচা দাড়ি তা আর চিরুনি দিয়ে ঠিক করা সম্ভব হয়না। গায়ের কোচকানো জামাটা খুলে ফেলে পাউডারের কৌটো থেকে কিছু পাউডার নিয়ে তার সারা গায়ে ছড়িয়ে দিলাম, পাশের আলনা থেকে একটা পরিস্কার জামা তুলে নিয়ে তার গায়ে গলিয়ে দিয়ে বললাম, এমন নোংরা হয়ে থাকেন কেন? দাঁড়িও কাটেননি। দেখবেন কয়েকদিন পরে ওখানে পোকা কিল বিল করছে। কালই নাপিত ডেকে জঙ্গল পরিস্কার করে ফেলবেন। আর রোজ না হলেও আমি পিসিকে বলে যাব, যেন একদিন অন্তর একদিন বিছানার চাদর বদলিয়ে দেন। এমন নোংরা ভাবে কি বাঁচার স্বপ্ন দেখা যায়? পিসি যে কি করে! বৃদ্ধ মন্মথনাথ। সেন। অবাক হয়ে আমার কাজ দেখছিলেন আর মনে মনে কি যেন ভাবছিলেন। কেন যে এই কাজগুলো উপযাচক হয়ে করলাম জানিনা। হয়তো মিনতি সেনের জন্য, উনি আমার বাবা, উনি আমার একমাত্র আপনজন কথাটা আমায় প্রভাবিত করে থাকবে। আপনজনের সিঁড়ি বেয়েই তো আরো আপন জনের কাছে পৌঁছানো সম্ভব। সে যাই হোক এই কাজগুলো করতে আমাকে যেমন কোন জেদ করতে হয়নি। তেমনি বৃদ্ধ মন্মথ সেনও কোনরকম বাধা দেননি। মিনতি সেন অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কে করল তুমি? আমি নীরবে মাথা নাড়লাম এবং মিনতি সেনের হাত থেকে চায়ের প্লেটটা নিয়ে তার হাতে দিয়ে বললাম, দাদু চা খান, কিন্তু আপনার চশমা কোথায়? মিনতি সেন দেরাজ থেকে চশমা জোড়া বের করে আমার হাতে দিলেন। আমি চশমাটা তার চোখে পরিয়ে দিয়ে বললাম দেখুন তো আগে আমাকে কখনো দেখেছেন কী না। কিন্তু আমার এত আগ্রহের কোন জবাব দিলেন না উনি। আমি এরপর দিনের কাগজটা খুঁজে পেতে তার হাতে দিয়ে বললাম, সারাদিন শুয়ে থাকেন কেন? কাগজ, বই, ম্যাগাজিন যা পাবেন তাই পড়বেন। এইবার চা খেতে খেতে কাগজটা পড়ে ফেলুন তো। আমি একটু পরে এসে জিজ্ঞাস করব কি পড়লেন। বলতে হবে কিন্তু। এতক্ষণে হেসে ফেললেন বৃদ্ধ। বললেন পড়া ধরবে তো! বেশ তাই হবে। কিন্তু দাদুভাই পাশ না ফেল তা কিন্তু বলতে হবে তোমায়। এই যে মুহূর্তে আপন জনের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠলো, তাতে মনটা ভীষণ ভাল হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি মিনতি সেনের দৃষ্টি হতে বিস্ময় যেন আর কাটতে চায় না। তার বিস্ময় আমার এই কাজের জন্য না, তার বাবার এই সহজ হয়ে ওটা। বুঝতে পারি না।
এরপর মিনতি সেনের সঙ্গে আবার সেই বাইরে এসে বসলাম আমি। চা খেতে খেতে বললাম, আপনার চা যে ঠান্ডা হয়ে গেল পিসি। এই খাই, বলে চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে এক চুমুক খেয়ে আবার রেখে দিলেন।