আমার সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। রেহানা যে এত অভিমানী তা জানব কি করে? অথচ সত্যি কথাটাও বলতে পারছি না, তাতে হয়তো রেহানাকে ছোট্ট করা হবে। সেলিনা বলল, এত কি ভাবছেন প্রান্তিক ভাই? রেহানার সাথে ভুল বোঝাবুঝি কিছু হয়েছে?
আমি সেলিনাকে যতই দেখছি ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি। ও যে ডালিমকে বলেছে, আমি রেহানা নই আমি সেলিনা। আমাদের দু বোনকে রক্ষা করার জন্য আমি একাই যথেষ্ট। সেলিনার উপর বিশ্বাস যেন আমার বাড়তে থাকে। আমি সেলিনাকে বললাম, তুমিতো যথেষ্ট বুদ্ধিমতি, রেহানাকে তুমি ভালভাবেই জান। তাহলে তার কথায় তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না কেন? হচ্ছেনা কারণ ওটা বিশ্বাস যোগ্য কথা নয় তাই। তাছাড়া আমি ওকে এত জানি যে ওর মুখ দিয়ে আর কোন কথা বের হওয়া সম্ভব নয়। তা ওর চোখ দেখে বুঝতে পারি। কিন্তু আমারই ভুল হয়েছে প্রান্তিক ভাই আপনি যে রেহানার থেকেও এক কাঠি উপরে এ সত্য আমার জানা ছিল না।
তারপর হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে পড়ে বলল চলুন যাওয়া যাক। আমি বললাম, হ্যাঁ তাই চল। আমিও উঠে পড়লাম। ও আমাকে কোন দাম দিতে দিল না। বেশি জোরও করতে পারলামনা। মনটা খারাপ হয়ে গেল। কাল ওর জন্মদিন ছিল। কিন্তু কালকের দিনটা তো আর ফিরে আসবেনা। তাই বললাম, তোমার জন্মদিনটা আমার মনে থাকবে সেলিনা। আগামী জন্মদিনে আমি নিশ্চয়ই যাব। ও হাসতে হাসতে বলল, সত্যি আপনি পাগল আছেন প্রান্তিক ভাই! আগামী জন্মদিন মানেতো আরো এক বছর পরে। ততদিনে দেখবেন সব গোলমাল হয়ে গেছে। তার থেকে চুপি চুপি একটা কথা বলি, কাউকে বলবেন না কিন্তু। কৌতুক ছড়িয়ে পড়েছে তার উজ্জ্বল দুটি চোখে। আমি তখনো কিছু না বলে চুপ করে আছি দেখে ও বলল, আসছে রবিবারের পরের রবিবার রেহানার জন্মদিন। ও কিন্তু ওর জন্মদিনের জন্য কোন আয়োজন মাকে করতে দেবেনা। মা কত সাধ্য সাধনা করেও একটা জন্মদিনের পোষাকও পরাতে পারবেনা তাকে। সেদিন সে উপোস করবে। খাবে তার পরের দিন, যাতে জন্মদিনে কিছু না খেতে হয়। আমি অবাক হয়ে বললাম, এমন কথা তো শুনিনি কখনো। সত্যি অবাক হচ্ছি তোমার কথা শুনে। তুমি সত্যি বলছ তো। সেলিনা বলল, এতক্ষণ কি তবে সব আমি মিথ্যে কথা বলেছি। যাকগে গোপন কথাটি বলে দিলাম। এবার যা ভালো বুঝবেন করবেন। আর একটা কথা, রেহানা খায়না বলে, ও দিন কিন্তু আমাদেরও উপোষ করতে হয়। না হলে দোকান থেকে খাবার কিনে এনে খেতে হয়। তবে বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন কিন্তু রেহানার জন্ম দিন ঘরোয়া ভাবে হলেও ভালো ভাবেই পালন করা হতো। জানতে চাই তবে এখন হয়না কেন? সেলিনা বলল আসলে ওর জন্মদিনেই বাবার এক্সিডেন্টটা হয়, আর তা ওকে এমন ভাবে আঘাত দেয় যে, ঐ দিনটাকে ও প্রানপণে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে। তারপর আমাকে চমকে দিয়ে বললেন একি আপনি আবারও বসে পড়লেন যে। এরপরও বসতে গেলে আমার ক্ষমতায় কুলোবেনা। চলুন বলে হাসতে থাকে সেলিনা। সেলিনার যৌবন যেন উপছে পড়ছে।
রাস্তায় এসে সেলিনাকে বললাম, আমার একটা কাজ আছে। একটু দেরি হবে, তুমি বরং চলে যাও। সামান্য হেসে বললাম, তোমার গোপন কথাটা আমার মনে থাকবে, আর তোমার কথাও মনে থাকবে। আসি বাই বাই।
ও চলে গেল। আসলে আজতো আমার কোন কাজ নেই। কিন্তু এমন একটা সুন্দর আর জোরালো মনের সঙ্গে পথ চলতে বড়ই তৃপ্তি লাগছিল। ও চলে গেলে আমি তাই আরো খানিকটা এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে কখন যে কি কারনে শিয়ালদা স্টেশনে চলে এসেছি বুঝতে পারছি না।
আবারও সেই মিনতি সেন। বুঝতে পারিনা, কেন মিনতি সেনের মুখটা বার বার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর কেনইবা মিনতি সেন বার বার টানে আমায়, কি যে দুর্নিবার আকর্ষণ মিনতি সেন আমার কাছে তার কোন ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। তাইতো নিজের অজান্তেই সাউথ গামী ট্রেনে উঠে পড়ি আর নেমেও পড়ি ঢাকুরিয়া স্টেশনে। আর সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে মিনতি সেনের বাড়ী।
স্ট্রীট লাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছে বাইরে একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন মিনতি সেন। আটপৌরে পোক। চুল এলায়িত। তার মানে হয় অফিসে যাননি, না হলে অফিস থেকে ফিরে এসেছেন অনেক আগে। বেল দিতেই, উপর থেকে বললেন খোলা অছে। চলে এস, তার মানে আমাকে এর মাঝে কখন যেন দেখে নিয়েছেন এক ফাঁকে।
সিঁড়ির দরজাটা ভেজানো ছিল। আবার তেমনি ভেজিয়ে দিয়ে আমি উপরে চলে এলাম। আমাকে দেখে যে উনি অখুশী হন নি তা তার চোখমুখ দেখে বুঝতে পারি। বললেন, কোথায় এসেছিলে অনুতপাদের বাড়ীতে? ওকে নিয়ে এলেনা কেন? বললাম, না পিসি আমি সোজাসুজি আপনার এখানে চলে এসেছি। ভীষণ আনন্দিত হলেন মিনতি সেন। মুখে বললেন, শুধু আমার কথা মনে করে আমার কাছে এসেছে, কি যে ভালো লাগছে, বল কি খাবে?
আমি বললাম, বাড়ীতে যা আছে, আপনি কিন্তু দোকানে যেতে পারবেন না। তাই হবে। উনি উঠে গিয়ে ফ্রিজ থেকে মিষ্টি এবং টুকি টাকি আরো কিছু নিয়ে এলেন।
মিনতি সেনদের এই রাস্তা মুখী বারান্দাটা বেশ বড়। কয়েকটা চেয়ার পাতা আছে এবং একটি টি টেবিল। উনি আমার হাতে খাবরের প্লেটটা তুলে দিয়ে বললেন, আচ্ছা প্রান্তিক তুমি আমায় পিসি বলে ডাক কেন বলত। আমি বললাম, ঠিক কোন কিছু ভেবে বলিনা, তবে আপনার যদি আপত্তি থাকে, তবে যা বলে ডাকতে বলবেন, তাই বলেই ডাকব। উনি হেসে ফেললেন, বললেন, তোমার মনটা এত সরল। তোমাদের মতন ছেলে মেয়েরা আছে বলেই এখনো পৃথিবীটাকে ভাললাগে। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললেন, ওই যে সেদিন তোমার সঙ্গে যে মেয়েটা এসেছিল, কি যেন নাম .. হ্যাঁ মনে পড়েছে অশ্রুকণা। তোমরা এক সাথে পড়? বললাম হ্যাঁ। মেয়েটি খুব ভালো তাইনা? আমি সন্দেহতুর হয়ে বললাম কেন বলুন তো। না এমনি, ওকে আমার ভীষণ আপনার মনে হয়েছিল। সেদিন জলযোগে তো ওর সঙ্গেই দেখা হয়ে ছিল তাই না প্রান্তিক? আমি সম্মতি সুচক ঘাড় নাড়ি।