মুগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ভাবি এমন করে কি রেহানা হাসতে পারে? পারেকি এমন করে ভালোলাগার রক্তে দোলা দিতে। আমি বললাম, তোমার মতো অবস্থা হলে আমিও তাই ভাবতাম। কিন্তু আসল কথা তা নয় সেলিনা। তবে আসল কথাটা কি? আমি বললাম থাক ওসব কথা, তোমার পড়াশুনা কেমন হচ্ছে বলো? ও অধৈৰ্য্য হয়ে বলল, দূর প্রান্তিক ভাই, এই পড়াশুনা ছাড়া কি আমরা আর কোন কথা বলতে পারিনা। আমি বললাম, আচ্ছা তুমিই বল আমি শুনি। আমি বলব? শুনতে ভালো লাগবে আপনার। এমন কি বলবে যা আমার ভালো লাগবে না? তারপর অবশ্য বললাম তুমিই বল তোমার কথা শুনতে আমার ভালোই লাগবে। বললাম আমি।
ও বড় বড় চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে। তারপর নীচু হয়ে খেতে খেতে বলল, জানেন, কাল মা কতকিছু রান্না করেছিলো, আমার জন্মদিন উপলক্ষে। এক সময় মা জানতে চাইলেন, কাউকে বলবি। আমি মাকে বললাম, কোনদিনতো কাউকে বলা হয়, আজ আবার কাকে বলব। জানেন প্রান্তিক ভাই, আমাদের তো কোনভাই নেই, আর সেই যে একদিন আপনি গিয়ে মাকে কি মায়ায় বেঁধেছেন। তাই হয়তো বললেন, রেহানা, ছেলেটা শুনেছি পিসিব কাছে থাকে, মা তো নেই। অবশ্য আমি ওর মা নই, তবু একবার কলেজ থেকে ফেরার পথে ধরে নিয়ে আসিস তো। কেন যে এই পোড়া মনটা তার কথা ভাবে কে জানে। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম মার দুটো চোখ ছলছল করছে। রেহানা মাকে বলল, এই তোমার দোষ মা। সবাইকে আপন করে নেওয়া। তারপর বলল তুমি আসতে বলছো, কিন্তু যদি ও না আসে। যদি আমাদের বিধর্মী ভেবে যে কোন অজুহাতে এড়িয়ে চলে। আমার কিন্তু রেহানার এই অজুহাতটা একদমই ভাল লাগেনি। বলল সেলিনা।
মা আর কোন কথা বলেন না। কিন্তু মায়ের জন্য আমার মনটা এমন করে উঠলো যে, মনে হল মা শুধু একা কাঁদছেন না আমিও কাঁদছি। আমি রেহানাকে বললাম, আপা, তোমার সাথে কি দেখা হবে না প্রান্তিক ভাইয়ের। ও চিরদিনই একটু কম কথা বলে। মেপে কথা বলে। আমার মতো উচ্ছল নয়। আমার মতো আনন্দ বা দুঃখ অবলীলায় প্রকাশ করতে পারে না। তাই অনেকে ওকে দাম্ভিক বলে, আবার উন্নাসিক বলে। আসলে ওর মনটা শিশুর মত এল। বাবা ওকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন, কিন্তু বছর খানেক আগে এক বাস দুর্ঘটনায় বাবার মৃত্যু হয়। আমরা হঠাৎ বড় অসহায় হয়ে পড়ি। ডালিম নামে একটি ছেলে, প্রেসিডেন্সিতে আপার থেকে সিনিয়র ক্লাসে পড়তেন। তিনিই সংবাদটি নিয়ে আসেন। তারপর, ধীরে ধীরে একদিন সব শোকের যেমন অবসান হয়, আমাদের ও হয়েছিল! ডালিম ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক ধীরে ধীরে গাঢ়তর হয়েছিল, রেহানা মনে হয় আস্তে আস্তে ওকে ভালবেসেও ফেলে। কিন্তু বড় চাপাতো। তাই তার ভালোবাসার কোন প্রকাশ ছিল না। আমাদের দুই বোনের সামনে একদিন মা বলেছিলেন, রেহানা ওকে কি তোর পছন্দ? আমরা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালাম। রেহানা অন্য ঘরে পালিয়ে বাঁচতে চাইল। আমি বললাম, তুমি কি ডালিম ভাইয়ের সাথে রেহানার বিয়ে দিতে চাও? জানতে চাইলাম তাহলে ওর পড়াশুনার কি হবে? তাছাড়া রেহানা বা তোমার পছন্দেতো সব হবে না। ডালিম ভাইয়েরও একটা নিজস্ব পছন্দ আছে। আছেন তার অভিভাবকেরা। আর তারা যদি রাজি না হন, কেন অপমানিত হতে যাবে। মা বললেন আমি ডালিমের সাথে কথা বলেছি ও রেহানার মত জানতে চেয়েছে তা ছাড়া ও আরো একটা কথা বলেছে যে রেহানা রাজী থাকলে ও অপেক্ষা করবে যতদিন না ও প্রতিষ্ঠিত হয়, ওর শিক্ষা শেষ না হয়।
আমি বললাম, এ তোমার ঠিক হচ্ছে না মা। কি দরকার এই ভাবে জড়িয়ে পড়ার। আমাদের পড়াশুনা করতে দাও। আমরা নিজেরা দাঁড়াতে পারলে তোমার আর কোন চিন্তা থাকবে না। মা বলেছিলেন না থাকবে না ঠিক। কিন্তু আমাদের সমাজে কটা মেয়েকে দাঁড়াতে দেওয়া হয়? আমি মা কে বললাম, সবটাই সমাজের ঘাড়ে চাপিয়ে লাভ নেই মা! আমাদের দাঁড়াবার ইচ্ছেটাও জোরদার নয়। তারপর জোর দিয়ে বললাম না মা, ও চিন্তা তুমি ছেড়ে দাও। মা বললেন ডালিম আসলে কি বলব? বলবে ও এখনো ছেলে মানুষ। ও সময় চাইছে। এত কথা বলার পরে আমার একটা কথা মনে হল, না, আমার মনে হয় এটা বলা ঠিক হয়নি। কারণ মা তো আমার জন্য ডালিমকে পছন্দ করেননি। তিনি পছন্দ করেছেন রেহানার জন্য। আর ওর মনে যদি অন্য কোন ভাবনা থাকে। তাই বলার পরে বেশ অনুশোচনা হয় আমার।
কিন্তু প্রান্তিক ভাই! সেই ডালিম ভাই কি করলেন জানেন? বললাম কি? যে ডালিম ভাই রোজ একবার আসতেন তার দেখা নেই ৩/৪ দিন। পরে একদিন খুঁজে খুঁজে আমার স্কুলে এসে উপস্থিত। গেটে দাঁড়িয়ে আছেন ছুটির অপেক্ষায়। আমি বেরিয়েই দেখি ডালিম ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। বললাম ডালিম ভাই আপনি? কোথাও গিয়েছিলেন বুঝি? উনি বললেন না। তাহলে আমাদের ওখানে যান না কেন? কোন কথা না বলে উনি হাঁটতে লাগলেন। আমিও হাঁটতে লাগলাম ওঁর পিছন পিছন। বললাম জানেন, এ কদিন আমরা। সব সময় আপনার কথা ভেবেছি। ও তাই বুঝি। একেবারে নিরাসক্ত উত্তর। বললাম, কেন বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? হঠাৎ ও পিছন ফিরে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালো। আমি চমকে উঠে বললাম কিছু বলবেন? ও বলল তুমি ভাবতে আমার কথা? বাঃ আমরা কি আমাকে বাদ দিয়ে। ও তেমনি ভাবে বলল আমি স্পষ্ট কবে জানতে চাইছি তোমার কথা। তুমি ভাবতে কিনা? আমি সরল মনে বললাম হ্যাঁ, আমিও ভাবতাম ডালিম ভাই। কতদিন আপনি আসেননা। সত্যি, বলে ও আমার হাতটা চেপে ধরল। আমি অবাক হয়ে বললাম, ছিঃ ডালিম ভাই এসব কি করছেন, হাত ছাড়ন। কণ্ঠে যেন কি ছিল, ও আমার হাত ছেড়ে দিল কিন্তু তার পকেট থেকে একটা ভাজ করা কাগজ আমার হাতে জোর করে গুঁজে দিয়ে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল।