জানি আমি, কিন্তু বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। নীলাঞ্জনা পিসিকে যতটুকু বুঝেছি বা জেনেছি তাতে মনে হয় তিনি এখন কি চান তা বোধ হয় তিনি নিজেও জানেন না। আর একথা শুধু পিসি কেন, আমরা কেউ কি জানি, আমরা কি চাই? অথচ নীলাঞ্জনা পিসি একদিন ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন পরিমলবাবুকে। সবে কলেজে ঢুকেছেন নীলাঞ্জনা পিসি। আর সেই সময় উঁচু ক্লাসের পরিমলবাবুর নজরে পড়ে যান তিনি। শুনেছি নীলাঞ্জনা পিসির রূপে মুগ্ধ হয়ে আরো অনেক ছেলে তার প্রেমে পড়ার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু পিসি কারো দিকে ফিরেও তাকাননি। বলা চলে পরিমলবাবুই তার জীবনের প্রথম পুরুষ এবং একমাত্র পুরুষ হিসাবে প্রথম দিন থেকে মেনে নিয়ে তার ঘরে এসেছিলেন। সম্ভবতঃ পরিমলবাবু তা জানতেন। তাই নীলাঞ্জনাকে লাভ করা যেমন তার জয়ের একটা অঙ্গ, তেমনি কৃতজ্ঞতাবশত অন্য কোন নারীর কথা এতদিন তিনি মনেও আনেন নি। অবশ্য এসব আমার শোনা কথা, কিছু অনুমান মাত্র।
মিনতি সেনই বোধ হয় তার প্রথম ছন্দপতন। অবশ্য তাও ঠিক আমি ভালো করে জানিনা। পিসিকে নিয়ে তার একাকী আর নিঃসঙ্গ জীবনের কথা ভাবিনি কখনো। সেদিন যা কিছু বলেছিলাম, কথার পর কথা সাজিয়ে তার একটা কাব্যিক রূপ দিয়েছিলাম মাত্র। কিন্তু পিসি যে এমন একটা কিছু করবেন তা কখনো ভাবিনি। হয়তো এটা ভাবার কোন বিষয় নয় বলেই।
আমার উথাল পাতাল চিন্তাকে প্রতিহত করে কে যেন বলল, তুমি এখানে বসে আছো প্রান্তিক আর আমি তোমাকে সব জায়গায় খুঁজে বেড়াচ্ছি। তাকিয়ে দেখি রেহানা। বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকাই ওর দিকে। বেশ কয়েকদিন পরে দেখা রেহানার সাথে। ও কয়েকদিন কলেজে আসেনি। যদিও ওদের বাড়ীতে যাওয়া যেতো কিন্তু ইচ্ছে করেনি। সহজ ভাবে বললাম, খুব দরকার আমাকে? কেন খুঁজছিলে? আমার উত্তরটা ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু কোথায় যেন রেহানার অভিমানে আঘাত লাগে। বলে, দরকার না হলে বুঝি তোমাকে খোঁজা যায় না। তারপর বলল, না প্রান্তিক তোমার সাথে আমার কোন দরকার নেই। একথা বলেই ও সামনের দিকে পা বাড়ায়।
আর, ও চলে যাচ্ছে দেখে, আমি ওকে পিছু ডেকে বললাম একি রেহানা, তুমি চলে যাচ্ছ যে! বিশ্বাস কর আমি কোন কিছু মনে করে একথা বলিনি। তবু চলে যাচ্ছে। দেখে বললাম, আরে শোন শোন! কিন্তু কে কার কথা শোনে, ও দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে . চলেছে। একবার মনে হল দৌড়ে গিয়ে ধরি ওকে। তারপর কি ভেবে যেন থেমে গেলাম। রেহানা যেমন এসেছিল, তেমনি ভাবেই চলে গেল। আমি শুধু তাকিয়ে রইলাম ওর চলে যাওয়ার পথের দিকে।
যে জটিলতার জালে আমি ক্রমান্বয়ে জড়িয়ে পড়ছি নিজেরই ভুলে, তা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পাচ্ছিনা। অথচ আমার একথা যে কাউকে বলার নয়। আর এদিকে সাতদিন কেন ১০ দিন হয়ে গেছে পরিমলবাবু ফেরেননি। আজ তার চিঠি এসেছে, তার আরো মাস খানেক দেরি হবে। কোম্পানীর একটা বিরাট প্রজেক্ট-এ তাকে আটকে পড়তে হয়েছে, তাই নীলাঞ্জনা যেন সাবধানে থাকে। আমার পড়াশোনার যাতে কোন বিঘ্ন না ঘটে সেদিকে অবশ্য বিশেষ নজর দিতে বলেছেন। চিঠিটা পোষ্টকার্ডের। ডাক বাক্সে দেখে পিসিকে না জানিয়ে পড়ে ফেলেছি। অথচ অন্যের চিঠি যে পড়া উচিৎ নয় বুঝেও কৌতূহল দমন করতে না পেরে পড়ে ফেলি চিঠিটা। পিসিকে না জানিয়ে। কিন্তু আমার যা অবাক আর বিস্ময়ের ব্যাপার তা হচ্ছে পরিমলবাবুর এ কেমন চিঠি? প্রথম কথা স্বামী লিখছেন স্ত্রীকে চিঠি, তাও পোষ্টকার্ডে, দ্বিতীয়ত স্বামী স্ত্রীর চিঠির মধ্যে থাকবেনা এমন কিছু যা মনকে ছুঁয়ে যায়। এ আবার হয় নাকি, তৃতীয়ত ব্যক্তিগত চিঠিতে আর ব্যবসায়িক চিঠি নয় যে তাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা শব্দও ব্যয় করা যাবে না। চতুর্থত একবারও জানতে চাইবেন না স্বামী যে তার স্ত্রী কেমন আছেন? বা তিনি নিজেইবা কেমন আছেন? এ চিঠিতেও পরিমলবাবু একবারের জন্যও পিসি কেমন আছে জানতে চাননি। শুধুমাত্র একটা সংবাদ যে তার ফিরতে আরো মাস খানেক দেরি হবে। তা হতেই পারে। কিন্তু তাই বলে স্বামীর চিঠিতে ধরা পড়বেনা স্ত্রীর জন্য কোন উদ্বিগ্নতা। চিঠিটা পড়ার পর ডাক বাক্সে আবারও তেমনি ভাবে রেখে এসেছি আমি। রাতে বাড়ী ফেরার পরে হয়তো সে চিঠি দেখবেন পিসি। পড়ে তিনি কি ভাববেন? কি ভাবে নেবেন জানিনা। হঠাৎই মনটা খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় পিসির সঙ্গে পরিমল বাবুর দুরত্বটা অনেকটাই বেড়ে গেছে।
কয়েকদিন ধরে আমার কিছুই ভালো লাগছেনা। পিসির কাছে কেন যেন স্বাভাবিক হতে পারছি না। খারাপ জেনেও অকারণ এড়িয়ে চলছিলাম। কেন এড়িয়ে চলছি তারও কোন উত্তর জানা নেই।
পরের দিন আবারও পিসি জিজ্ঞেসা করেছিলেন, রেহানাকে বলেছিলে আমার কথা? দায় সারা উত্তর দিয়েছিলাম, কলেজে আসেনি। পিসি আর কথা বাড়াননি।
এদিকে রেহানা ঐ ভাবে চলে যাওয়ার পরে অনেক ভেবেছি, কেন তার এই অভিমান। পরের ক্লাসটা অফ। তিনটে থেকে ক্লাস আছে ডি এন বি এর। একবার মনে হল যাব না ক্লাসে, তারপর অবশ্য ভেবে দেখলাম ক্লাসটা ফাঁকি দেওয়া ঠিক হবে না। রেহানার সাথে দেখা হওয়াটাও ভীষণ দরকার। এভাবে সবাই আমাকে ভুল বুঝবে তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।