অকারণ কৌতূক যেন উপছে পড়ছে নীলাঞ্জনা পিসির চোখ দিয়ে। বললেন, কি দেখছ ওমন করে আমার দিকে তাকিয়ে। ভেবে দেখলাম চোখ যদি হঠাৎ নামিয়ে নিই, ভুল মানে হতে পারে। বললাম তেমনি চোখের পর চোখ রেখে, পিসি তুমি এত সুন্দর না, আগে কোন দিন ভাল করে দেখিনি তোমায়।
নীলাঞ্জনা পিসি নারী। নারীর স্বাভাবিক ধর্ম তার লজ্জা,তাকে তিনি অস্বীকার করবেন কি করে? তাছাড়া কোন নারীকে যদি কোন পুরুষ, সে যে বয়সেরই হোকনা কেন, সুন্দর বলে, তাহলে একটা গোপন অনুভূতি তার হবেই। কিন্তু আমার এ স্তুতিতে মনে হয় তার চিন্তা অন্য খাতে বইতে আরম্ভ করে। বললেন প্রান্তিক, আমার সুন্দরের বয়স আমি পেরিয়ে এসেছি অনেক আগে। হয়তো তুমি আমার মাঝে অন্য কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছো, তাই এত ভালো লেগে গেছে। কি ঠিক কিনা? আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম, না পিসি না। কি না? তুমি যা ভাবছো তা মোটেই নয়। তবে কি সত্যিই তুমি রেহানাকে ভালোবাসনা? না পিসি না। তাহলে তুমি কাকে ভালবাস? আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, তোমাকে পিসি–তোমাকে, শুধু তোমাকে আর কাউকে নয়।
উনি তাকালেন আমার দিকে। আমি মাথা নীচু করলাম, পিসি বোধ হয় এমন একটা উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। উঠে পড়লেন। আমার সঙ্গে আর কোন কথা না বলে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন। তার এই বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় আমি ভীষণ অবাক হয়ে যাই। আমার উত্তরে তিনি আঘাত পেয়েছেন কিনা জানিনা। কিন্তু পিসির ঐ ভাবে চলে যাওয়া আমার একদম ভালো লাগেনি। চেয়ারে সেই ভাবে বসে আছিতো বসেই আছি। চোখে ঘুম নেই। আবোল তাবোল অনেক কথা ভাবতে ভাবতে রাত শেষ হয় এক সময়।
সকালে উঠে পিসি দেখেন যে আমি সেই ভাবে বসে আছি একই জায়গায়। ঘুম জড়ানো চোখে আমার পিছনে এসে দাঁড়ান তিনি। তার পর আমার মাথার চুলে অঙ্গুলি সঞ্চালন করতে করতে বললেন, তুমি কাল রাত থেকে সেই একই ভাবে বসে আছো? ঘুমাও নি কেন? না কোন রাগ নয়, কোন বিদ্বেষও নয়। কোন এক সহমর্মীর আপন করার অনুভূতি যেন। আর তাতেই আমার ভিতরেব ক্ষোভ যেন গলে যেতে লাগলো। কিন্তু আমি নড়ার কোন লক্ষণ দেখালামনা। এবার তিনি আমার মাথাটা ঘুরিয়ে আমার মুখটা তার কবোষ্ণ বুকের পরে রেখে বললেন, আমার উপর রাগ করেছো প্রান্তিক! ছি, এতবড় ছেলের চোখে জল।
আর সত্যি সত্যি আমার দুচোখের জলে তার বুকের আঁচল ভিজে যেতে থাকে। কিন্তু তিনি আমার চোখের জল মোছাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলেন না। তারপর এক সময় বললেন, তুমিতো আমায় ভালোবাস প্রান্তিক, তাই না!–কিন্তু তুমিতো আমায় ভালবাসনা। কে বলেছে?–তাহলে ওভাবে তুমি পালিয়ে গেলে কেন?
পিসি আস্তে আস্তে বললেন, আমার কথা শুনতে তোমার ভালোলাগবে?–তোমার সব কথা আমার ভালোলাগে, মনে হয় সর্বক্ষণ কেবল তুমি আমার সাথেই কথা বল। সঙ্গে সঙ্গে পিসি আমার কথা শেষ না হতেই বললেন, তাই ভয় হয় প্রান্তিক, আর আজ কেন পালিয়ে গেছি এখনি হয়তো তা বুঝতে পারবেনা, কিন্তু জীবনেব অভিজ্ঞতা যখন আর একটু বাড়বে তখন বুঝতে পারবে, আমার পালিয়ে না গিয়ে উপায় ছিল না। এত বিষণ্ণ আর অবসন্ন লাগছে পিসিকে যে তার জন্য ভীষণ দুঃখ হয় আমার।
উত্তরে বললাম, সে আমি জানি পিসি। জান?–হ্যাঁ জানি। এরপরেও জানতে চাও তোমাকে ভালবাসি কিনা। হ্যাঁ আমি তোমার মুখ থেকেই শুনতে চাই। পিসি তার বুক থেকে আমার মাথাটি তুলে দিয়ে বললেন, ছেলে মানুষি করো না। সব প্রশ্নের উত্তর সোজাসুজি দেওয়া যায় না। তার চেয়ে আজ কলেজে গিয়ে রেহানাকে বলবে, আমি তাকে একবার দেখতে চাই।–কেন? বাঃ তোমার বন্ধুরা কেমন আমি দেখব না, দেখতে ইচ্ছে হতে পারে না?–রেহানাতো আমার একমাত্র বন্ধু নয়। জানি। –তাহলে? তাহলেও ওর যদি আমাদের এখানে আসতে কোন অসুবিধা না হয় তাহলে একবার আসতে বলবে। একথা বলে আমাকে ছেড়ে দিয়ে ফিরে যাচ্ছেন দেখে আমি আবারও ডাকলাম, পিসি। কি? আমি কিন্তু আমার উত্তর পাইনি। পিসি এগিয়ে এলেন। আমার পাশে। তারপর আস্তে আস্তে আমার মুখটা তুলে নিলেন ধীরে ধীরে তার মুখের কাছে। তারপর কাঁপা কাঁপা ওষ্ঠাধরে একটা চুম্বন একে দিয়ে দ্রুত পালিয়ে গেলেন। কিন্তু কই আমার মধ্যে তো কোন শিহরণ জাগল না। বুঝতে পারিনি আমি, পিসির কাছে আমি এটাই চেয়েছিলাম কিনা। আমার চাওয়ার বিনিময়ে তিনি যা দিলেন তা আমার ভালবাসার প্রতিদান না তার স্নেহ উপহার তাও বুঝতে পারলাম না। বিনিময়ের জন্য অপেক্ষা করেননি তিনি, পালিয়ে গেছেন। অপেক্ষা করলে, আমি কি করতাম তা আমি নিজেই জানিনা। আমার শিরায় শিরায় যে কম্পন শিহরণ জাগার কথা –কোথায় সেই শিহরণ! আমার বিশ বছরের যৌবনে নারীর প্রথম যৌবন স্পর্শ। হোকনা সে যৌবন আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। হোকনা পিসি আমার গুরুজন। তবু নারীতো। যে নারীর যৌবন আজো তার দেহের কানায় কানায় জোয়ারের জলে উচ্ছলিত। এক অলস মধ্যাহ্নে তাই আমার মনে হয়, এমনি করেই হারিয়ে যাই আমরা–আমাদের যৌবন . বিক্রি হয়ে যায় ফেরি ঘাটে। তাই কি? পিসির ভালবাসাকে কি আমি ফেরিঘাটের সঙ্গে তুলনা করতে পারি? না পারিনা। অপ্রাপ্তি যে প্রাপ্তির থেকেও অনেক মূল্যবান।
০২. পিতৃত্বের দাবী
পরিমলবাবু তার কাছে পিতৃত্বের দাবী করেন, কিন্তু তা দেওয়ার ক্ষমতা নেই পিসির। তাই বলে কোন দত্তক নিয়ে তিনি যেমন তার মাতৃত্বের স্বাদ মেটাতে চাননা তেমনি ঐ একই উপায়ে তিনি পরিমলবাবুকে পিতৃত্ব দেওয়ারও ঘোর বিরোধী। তিনি চান, পরিমল বাবু আবার বিয়ে করুক। আর সেই নবাগতার সন্তান মেটাক তার পিতৃত্বের আকাঙ্খা।