অধিকারী কুঞ্জ দাস হঠাৎ মনস্থির করে ফেলল। গায়ে জামা চড়িয়ে একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগে একখানা কাপড় গেঞ্জি আর যতগুলো পারল টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
সেখানে গিয়ে দেখে এক বিতিকিচ্ছিরি কােণ্ড। একটা সরু গলির মধ্যে পাকা গাঁথুনির এক বস্তি, তারই একটা ঘরের সামনে একটা মড়া পড়ে। জোয়ান বয়সের পুরুষের মড়া। চেহারা প্রায় সুকান্তি। মরে গেলেও বোঝা যাচ্ছে।
কুঞ্জ গিয়ে পড়তেই একটা সোরগোল উঠল।
অনেকগুলো মেয়ে-পুরুষ এক সঙ্গে কথা কয়ে উঠল। ঘরের মধ্যে একটা মেয়ে-গলা ঝঙ্কার দিয়ে উঠল, ভাসুর বুঝি? তা বিপদের সময় অত ভাসুর ভাদ্দরবৌ মানলে চলে?…তারপর কোন ঘর থেকে একটা বয়স্ক বেটাছেলে বেরিয়ে এসে হেঁড়ে গলায় প্রশ্ন করল, আপনিই বুঝি অমলবাবুর দাদা? তা ভাই মরে গেল। তবে এলেন? প্রতিজ্ঞে ছিল বুঝি মরমুখ দেখবেন? তা তেমন প্ৰতিজ্ঞের উপর্যুক্ত লোকই ছিলেন বটে। শ্ৰীযুক্ত অমলবাবু! মরে গেছেন, আর বলতে কিছু চাই না। তবে চটপট ব্যবস্থা করে ফেলুন মশাই।
করতেই হল ব্যবস্থা। কোথাকার এক মফস্বল শহরের কমল মুখুজ্যের ছেলে অমল মুখুজ্যের লিভার পচে মরা দেহটার সদগতি করতে নিয়ে গেল। কুঞ্জবিহারী দাস। মুখাগ্নিও সেই করল, কারণ তখন সে অমল মুখুজ্যের দাদা।
ভাদ্দরবৌ! সামনে বেরোয় না। কিন্তু কথা না বললে চলছে না। দরজার আড়াল থেকে বলে, আর কিছুদিন আগে এ দয়া হলে দেশের লোকটা বিনি চিকিচ্ছেয় মরত না।
কুঞ্জর চারিদিকে দুডজন করে চোখ কান। কুঞ্জ তবু গলা নামিয়ে বলে, বড়ো দুঃখ হচ্ছে, না?
তা একটা মানুষ বেঘোরে মরলে হয় বৈকি দুঃখ।
আমার একটা বাসনা পূর্ণ হয়েছে! কুঞ্জ চাপা নিষ্ঠুর গলায় বলে, মুখে আগুন ধরাবার বাসনাটা পূর্ণ হল।
আরও একটা মুখ তো বাকি— ঘরের ভিতরটা যেন আগ্রহে ব্যাকুল হয়ে কথা কয়ে ওঠে, সেটারও কি এ গতি হবার আশা আছে?
কুঞ্জ গম্ভীর গলায় উত্তর দিয়েছিল, গ্যারান্টি দিতে পারছি না।
তা যাক। মুখে আগুন দেওয়াটা ভাগ্যচক্ৰ। যে জন্যে ডেকেছি, বলি—
বলল সেই কথা, সেই দুঃসাহসিক মেয়ে মানুষটা! বছর তিনেকের একটা মেয়ে আছে তার, সেটার ভার নিতে হবে কুঞ্জকে।
ভার নিতে হবে মানে? মানে কিছুই নয়। নিতেই হবে তাই। সেটাই বক্তব্য ওই আদর্শনার। মেয়েটার বাপ মরেছে নানা রোগে, মা মরবো, মানে মরতে বসেছে যক্ষায়, অতএব পরোক্ষে মেয়েটা ডাস্টবিনে যাবে। কুঞ্জ ভার না নিলে নেবে কে? পথের কুকুর বেড়াল ছানার মতো মরবো?
তা মরুক না। কুঞ্জর কী লোকসান তাতে? আমন কত মরছে জগতে।
হ্যাঁ, সেই জবাবই দিয়েছিল কুঞ্জ। চোটপাট বলেছিল, বেড়াল কুকুরের মতো সে অপেক্ষাই বা কিসের? শানে আছাড় দিলেই তো চুকে যায়।
তো, তা হলে তাই দিয়ে যেতে হবে— অন্তরালবর্তিনী বলেছিল, সেটাও একটা উপকার করে যাওয়া হবে। ওর মায়ের তো সেটুকু ক্ষমতাও নেই গায়ে।
হুঁ! তারপর? সেই জননীটির শেষ গতি কি হবে?
তার গতি? একটু হাসি শোনা গিয়েছিল, যক্ষ্মা হাসপাতালের মুদ্দফরাশ নেই!
তা ভালো! উঁচু দরের গতির ব্যবস্থা হয়ে আছে তাহলে! তা হাসপাতালের ব্যবস্থাটা হয়েছে?
হবে! বাড়িওলাই নিজের গরজে টেনে ফেলে দিয়ে আসবে। যাক মেয়েটাকে আছড়ে দেওয়ার কাজটা সেরে যাওয়া হয় যেন।
পাশের ঘরে এধারে ওধারে অনেকগুলো কান ভাসুর ভাদরবৌয়ের আলাপ শোনার আশায় উদগ্র হয়েছিল। তারা মুখ বাঁকিয়ে বলল, ঘোমটার ভেতর খ্যামটা নাচ!
আরও অনেক কিছুই বলল তারা। এবং অপেক্ষা করতে লাগল, লোকটা বিদেয় হলে আচ্ছা! করে একবার শুনিয়ে ছাড়বে বামুন বৌকে।—বলি এতই যদি কথার বান, মুখ দেখাদেখিতেই যত দোষ? আরও বলবে—ভেতরে ভেতরে এতবড়ো একটি ব্যামো পুষে রেখে এতগুলো লোককে মজাচ্ছ তুমি?
কিন্তু শুনিয়ে দেবার আসাটা আর মিটাল না। তাদের।
লোকটা চলে গেল না।
গেল একেবারে বামুনবৌকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে, আর তার বাচ্চ মেয়েটাকে নতুন জামাজুতো পরিয়ে সঙ্গে নিয়ে।
হাসপাতালের খরচের দায়িত্ব তো অগত্যা কুঞ্জ দাসকেই নিতে হবে। আর রুগীটা যখন মরবেই তখন তার মা-মরা মেয়েটারও যাবজীবনের দায়িত্ব নিয়ে নিতেই হবে। উপায় কি? মানুষ বৈ তো জন্তু জানোয়ার নয় কুঞ্জ?
কিন্তু আশ্চৰ্য্য, রুগীটা মরল না। অখাদ্যের প্রাণ যমের্য অরুচি বলেই হয়তো মরল না, সারল। অতএব হাসপাতালের জায়গা জুড়ে আর থাকা চলল না।
অনেক ঘাটের জল খেয়ে অনেক অবস্থা পার হয়ে, অবশেষে আমতা লাইনের একটা গণ্ডগ্রামের এই আশ্রয়। সাড়ে সাতশো টাকা দিয়ে কেনা হল এই মলাট-ছেড়া বইয়ের মতো বালি-খসা বাড়িটা। আর বাড়িটা নিজের ট্যাকের কড়ি খসিয়ে কিনেছে বলেই হয়তো কুঞ্জ দাসের এটার ওপর এত টান!
বছরের পর বছর করে অনেকগুলো বছরই তো পার হল, টানটা বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে না। বোধকরি মুখ না দেখানোর প্রতিজ্ঞাটা বজায় আছে বলে, রংটাও অ-বিবৰ্ণ, উজ্জ্বল।
আগে কখনও কখনও বলত কুঞ্জ, মেয়েটাকে ইচ্ছে করলেই বেড়াতে আনতে পারি।
ঘরের দেওয়াল বলেছে, থাক!
লোকসান কি?
আছে। মিছিমিছি একটা অবোধ শিশুর মনে কৌতূহল জাগিয়ে দেওয়া। পাঁচটা প্রশ্ন তার মনে। তোলা।
কত বড়োটা হল, দেখবার সাধও হতে পারে, তাই ভেবেই বলা।
নাঃ, সে সাধ নেই।
তা, নেই সে সাধ নিশ্চয়। সাধ থাকলে ওই ধৃষ্ট নির্লজ্জ মেয়েমানুষটা নির্ঘাত নিজে থেকেই বলত, কত বড়োটি হল দেখতে সাধ হয়! তা পারত ও বলতে, ওর অসাধ্য যখন নেই।