কী হল? কুঞ্জ দাস একটি রহস্যময় হাসি হেসে বলে, বোঝা গেল, সাচ্চা পুরুষ ছেলে। ন্যাকা ভালোবাসাবাসির ধার ধারে না। তবু আরও একটু বাজাব!
ভিতর থেকে এবার একটু স্থির স্বর শোনা যায়। স্থির, ভারী! যে ছেলে ভালোবাসার ধার ধারে না, সেই তাহলে কন্যে সম্প্রদানের পক্ষে সুপাত্ৰ?
আলবত! আর তার কথাবার্তা কী জোরাল! বলে,—বিয়ে বুঝি, ঘর সংসার বুঝি। সেটা হচ্ছে বিজিনেসের মতোন লেন-দেনের ব্যাপার। রোমান্স আবার কি? নেই ওসব এযুগে!
ওঃ! তাহলে আগের যুগে ছিল!
ছিল, সেই রাধাকেষ্টর আমলে ছিল। ব্যস। তারপরে আর না। যা আছে, সবটাই বখামি, আর ন্যাকামি!
ওঃ! ভালো কথা।
আলাপ চলছে। অথচ সেই দূর ভাষণে। একজন দেওয়ালের আড়ালে, আর একজন পিঠ ফিরিয়ে। তবু কথা কাটাকাটিরও কসুর নেই।
একটা গলা বলছে, বিয়ে দেবার আগে মেয়ের ইতিহাসটা বলতে হবে।
আর একটা গলা জোর গলায় জবাব দিচ্ছে, কেন? কী দায় পড়েছে? ওরই বা তিন কুলে কাঁটা গার্জেন আছে?
তবু তো ভদ্দর ঘরের ছেলে!
কুঞ্জ দাসও অভদ্র ঘরের ছেলে নয়!
মেয়েটা তো শুনেছি দাস মশাইয়ের কুড়ানো মেয়ে!
কুড়োনো তো কুড়োনো! অন্নজলের কোনো দাম নেই?
তা বটে! কিন্তু রেলগাড়ির হাতমুখ ধোওয়া হবে, না ধুলো পায়েই বিদায়?
তা সেটা হলেই ভালো হত, নিতান্তই ক্লান্ত, তাই—
অতঃপর এক সময় দেখা যায় কুঞ্জ সেই উঠোনটা পার হয়ে পিছনের এটা দরজা খুলে পুকুরে হাত পা ধুচ্ছে।
এক সময় দেখা যায়, সেই দালানেই একাধারে পাতা আসনে বসে পড়েছে কুঞ্জ, সামনে পরিপাটি করে বাড়া অন্নব্যঞ্জন।
আচ্ছা, লোক তো ত্রিসীমায় নেই, এসব করল কে? ভূতে নাকি?
তা তাই। ভূতই!
কুঞ্জ যখন হাতমুখ ধুয়ে বলল, যাই একবার মিষ্টির দোকানটা ঘুরে আসি, আকাশে তখন ঝিকিমিকি বেলা। অথচ তখন এই ক্ষুদ্রকায় বাড়ির ক্ষুদ্রকায় রান্নাঘরটার মধ্যে দুটো উনুন জ্বলে উঠেছে। শুকনো কাঠ গোছানো ছিল বোধহয়।
মিষ্টি কিনে আরও খানিক এদিক ওদিক ঘুরে কুঞ্জ যখন ফিরল, তখন আসন পাতা, অন্ন প্রস্তুত।
কুঞ্জ আবার পিঠ ফিরিয়ে বসে, আর বলতেই হবে।–ভূতে ভাতের থালা নামিয়ে রেখে যায়।
খাওয়া মেটে, তবু অনেকটা রাত পর্যন্ত এমনি লুকোচুরি খেলা চলে। তারপর একজন বলে, বাড়ি ফিরতে হবে না?
আর একজন বলে, বাড়ি না ঘোড়ার ডিম! সরাইখানা!
তা সেই সেখানেই-
ট্রেন তো সেই ভোরে।
তই আছে চিরকাল।
তার মানে সমস্ত রাত ইস্টিশানের চালার নীচে পড়ে থাকা!
তা মানে তাই দাঁড়ায় বটে।
অগত্যই রাগ-রাগভাবে উঠে পড়ে কুঞ্জ দাস। বলে, আর আসছি না।
ভিতর থেকে ছোট্ট একটু শব্দ, আচ্ছা!
কুঞ্জ গমগমিয়ে বলে, আচ্ছা? হুঁঃ! জানা আছে কিনা আসতেই হবে মুখে কুটো নিয়ো!
কেন? কে আসতে দিব্যি দিয়েছে?
কে দিব্যি দিয়েছে? ওঃ, খুব বোলচাল শেখা হয়েছে। কিছুদিন কলকাতায় বাস করে এই উন্নতিটি হয়েছে।
যাত্রার দল খুলেও সে উন্নতি কম হয়নি।
হুঁ! চোটপাটটি ঠিক আছে। যাক বিদেয় হওয়া যাক! বলে অধিকারী কুঞ্জ দাস গেজে থেকে এক গোছা নোট বার করে সামনের ওই ঘরটার দরজার কাছে নামিয়ে রেখে গলা তুলে বলে, কাগজের টুকরো কখানা তুলে রাখা হোক। ইঁদুরে না কাটে।
এবার ঘর নিঃশব্দ।
কুঞ্জ গলাটা একবার ঝেড়ে নিয়ে বলে, বাগদী মেয়েটা এসে কাজকর্ম ঠিকমতো করে দিয়ে যায়?
যায়।
কুঞ্জ ছাতাটা দাওয়ার পাশ থেকে উঠিয়ে নিয়ে উঠোনে নামে, জুতোটা পায়ে দেয়, বেড়ার দরজাটা খুলে বেরোয়, বাইরে থেকে আবার সেটা আটকে দেয়, তারপর সেই পায়ে চলা পথটা ধরে আস্তে আস্তে এগোতে থাকে পকেট থেকে টর্চ বার করে আলো ফেলতে ফেলতে।
সারারাত এখন স্টেশনের সেই করোগেটের চালাটার নীচে পড়ে থাকতে হবে, রাত্রি শেষে ট্রেন। অভিজাত স্টেশন নয় যে, ওয়েটিং রুম থাকবে।
তবু মরতে মরতে এখানে আসতে হয় কুঞ্জ দাসকে। মাঝে মাঝেই আসতে হয়। ওই কাগজের টুকরোগুলোর পরমায়ূর কাল আন্দাজ করে করে তো আসতেই হয়। অকারণেও হয়! হঠাৎ মন ভালো হবার যোগ এলে, নাটক জমলে, মেডেল পেলে। এই পায়ে চলা পথটা যেন প্রবল আকর্ষণে টানতে থাকে কুঞ্জকে।
কিন্তু কেন? কিসের দায়ে বাঁধা কুঞ্জ?
তা সে কথা যদি বলতে হয় তো অনেকগুলো বছর আগে পিছিয়ে যেতে হয়। মন দিয়ে শুনতে হয় একটা কুলত্যাগিনী মেয়ের নির্লজ্জ খৃষ্টতার ইতিহাস। সংসারে আর কোথাও কেউ এতখানি ধৃষ্টতা দেখিয়েছে কিনা সন্দেহ।
তবে কুঞ্জ দাসকে দেখতে হয়েছে। কুলত্যাগিনী ওই মেয়েটার দুঃসাহসিক আবদার রাখতেও হয়েছে তাকে।
কুঞ্জ যখন একটা জ্বালার মন আর তার দলবল নিয়ে যেখানে সেখানে চাবুক বসিয়ে বেড়াচ্ছে, তখন একদিন কুঞ্জ একখানা চিঠি পেল। হাতের লেখা দেখে প্রথমে ছিঁড়ে ফেলতে গেল। তারপর আস্তে আস্তে শুধু খামের মুখটা ছিঁড়ল।
দেখল কটা মাত্র লাইন। সম্বোধনবিহীন—
…নির্লজ্জতার সীমা নেই। তা হোক, নির্লজের আর লজ্জা কি? মরতে বসেছি। একবার এসে দাঁড়াতেই হবে। নিচে ঠিকানা দিলাম।
কলকাতার পুব অঞ্চলে একটা গলি-পথের ঠিকানা।
চিঠিখানা নিয়ে সেদিন কুঞ্জ। সারারাত পায়চারি করল, তারপর সকালে একটা কাগজে লিখল, এখনও মুখ দেখাতে সাহস? খামে ভরল, উচিত।মতো স্ট্যাম্প মেরে ফেলে দিল। তারপর মনের জোর করে নাটকের মহিলা দেখতে বসল।
কিন্তু নির্লজ্জতা আর ধৃষ্টতার চরম পরাকাষ্ঠীর নমুনা নিয়ে আবার একছত্র চিঠি এল, তেত্রিশ কোটি দেবতার দিব্যি মুখ দেখাব না। তবু না এলেই নয়।।