ছেলেবেলার আধো উচ্চারণটাই রয়ে গেছে জিভে। তবু লিলি প্রায় বাপের চোখেই দেখে কুঞ্জকে। তাই কুঞ্জ যখন স্টেশনে যাবার জন্যে প্রস্তুত হতে থাকে, লিলি গিয়ে আদুরে গলায় বলে, আমায় নিয়ে যাওয়া হয় না একবারও। এ্যাঁ। আমি যেন মানুষ নই! লিলিকে তখন শিশুর মতো দেখতে লাগে। কুঞ্জ তাই নিশ্চিন্ত।
নিশ্চিন্ত কুঞ্জ বলে, মানুষ আবার কিরে? মানুষ কাকে বলে? বাছুরকে কি গরু বলে? ব্যাঙাচিকে ব্যাং? বলি ডাবকে কি নারকেল বলে? এচিড়কে কাঁঠাল? মানুষ হবার বয়েস হবে, তবে তো মানুষ হবি?…তা, এখন আমি বেরোচ্ছি—নিমাইদের সঙ্গে ঝগড়া বাধাবি না, বুঝলি? আর নববালার সঙ্গে সঙ্গে থাকিবি।
লিলি মাথা নেড়ে ঝঙ্কার দেয়, তোমার আদরের নিমাই যা ঝগড়াকুটে! ওই তো ঝগড়া বাধায়। আমাকে তুই বলে, আহ্রদী বলে। আমরা রাগ হয় না?
কুঞ্জ মৃদু হাসির সঙ্গে বলে, ভালো তো কোনোটাই নয়। সনা, জগা, সব কটাই তো পাজীর পাঝাড়া।
লিলি একগাল হাসির সঙ্গে বলে, যা বলেছ! ছোটোলোক এক একটা!
কুঞ্জর এ সময় মেজাজ শরীফ। স্টেশনে যাবার সময় কুঞ্জকে বাসমতী নববালার সঙ্গেও হেসে কথা কইতে দেখা যায়। লিলির সঙ্গে কইবে সে আর আশ্চর্য কি! হেসে উঠে বলে, তা একটা ভদরলোক তো আছে। ভদরের মতোন ভাদর, তার কাছে বসে থাকলেই পারিস। তোকে আর তাহলে জ্বালাতে আসবে না। ওরা।
লিলি মুখ ঘুরিয়ে বলে, সে ভদ্রলোকটা আবার কে গো, পোপাইটার?
কেন, বরুণ? যাকে বলে ভদ্দর!
লিলি ঠোঁট ওল্টায়। বরুণ? লেখকবাবু? সে যা দেমাকী! কথাই কয় না। আমার সঙ্গে!
কুঞ্জ সহসা কৌতূহলী হয়, কথাই কয় না তোর সঙ্গে?
মোটে না। লিলি ঝঙ্কার দেয়, কী লিখছে একটু দেখতে গেলে এ্যাইসা খিচোয়! বলে, পালা, পালা বলছি। কাজের সময় গোলমাল করতে আসসনি।–তোমার দলের কেউ ভালো নয়।।
কুঞ্জ বলে, তুই তো ভালো, তাহলেই হল। বলে ওর হাতে দু-একটা টাকা গুঁজে দিয়ে হাসিহাসি ভাবটাকে চাপা দিতে দিতে বেরিয়ে যায়।
যাক এখন দশ-বারো ঘণ্টার জন্যে নিশ্চিন্দি—এঘরে এসে পা ছড়িয়ে বসে লিলি। চোখ মুখের ভঙ্গি করে হাতের টাকা নাচাতে নাচাতে বলে, এই দেখো, নিমাইদা!
নিমাই ব্যাজার মুখে বলে, দেখে কি করব? বেল পাকলে কাকের কি? রাজা ধন বিলোচ্ছেন কোথায়? না অন্তঃপুরে। কুড়োচ্ছেন কে? রাজকন্যে। এই তো?
লিলি টাকা নিয়ে লোফালুফি করতে করতে বলে, আমি তো রেল ভাড়া জমাচ্ছি।
রেল ভাড়ার দরকার কি? নিমাই বলে, এবার তো নাটক দেখাতে কলকাতায় যাওয়াই হচ্ছে। নাটকের লড়াই হবে, কারটা ফাস্ট হয়! যেমন হয়। গেলে তো দলবল সবাই যাব।।…আর কলকাতার শহরে একবার হারিয়ে গেলে খুঁজে বার করে কার সাধ্য!
পালাটা কি?
তা জানিনে! কোনটি বাছবে কে জানে। মোট কথা যাওয়া হবে। বরুণবাবু তো আবার পালা লিখছে!
বরুণবাবু! লিলি মুখটা বাঁকায়, যা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে আমায়! দেখলে গা জ্বলে যায়।
নিমাই হাসে, গা জুললে আর কি হবে, কর্তা তো ওকে জামাই করবে ঠিক করেছে।
ঠিক করেছে! লিলি পনেরো বছরের মুখে পঁচিশ বছরের ভঙ্গি করে বলে, ঠিক করলেই হল? আমার দায় পড়েছে।
কর্তা জোর করলে কী করবি?
আহা রে! কী করব যেন জানেন না! চওড়া জরির কোমরবন্ধটার ওপর হাত রেখে ঘাড় বেঁকিয়ে দাঁড়ায় লিলি, এখন আবার ন্যাক সাজছ যে?
গোল ঘর, লাঙল তুলে ধরা। কর্তা বেরিয়েছে, আর ফষ্টিনষ্টি হচ্ছে, কেমন?
খাটো স্কার্ট আর আঁটো জ্যাকেটের মধ্যে থেকে ফোঁস করে ওঠে, তোমার খেয়ে ফষ্টিনষ্টি করছি। তুমি বলবার কে?
ওমা! মেয়ে দেখ! যেন ফণা ধরা ফণিনী! নববালা গমগম করে চলে যায়।
কুঞ্জর অনুপস্থিতিতে দলের চেহারাটা অনেকটা এ রকমই। এখন তবু সবাই নেই, থাকলে দেখবার মতো। তবু মাঝে মাঝে কুঞ্জ অনুপস্থিত হবেই।
কুঞ্জ সেই একটা নামহীন পরিচয়হীন গণ্ডগ্রামে পৌঁছে, তার মাঠের মাঝখান দিয়ে পুকুর ধার দিয়ে সরু একটা পায়ে চলার পথ ধরে গিয়ে উঠবে একখানা জরাজীর্ণ একতলা বাড়ির সামনে। উঠোনের বেড়ার দরজাটার বাঁধন দড়িটা খুলে উঠোনের মাঝখানে এসে দাঁড়াবে।
০৩. জুতোর শব্দ
আজও তেমনি দাঁড়াল। কিন্তু আশ্চর্য বেড়ার দরজার সাড়া, জুতোর শব্দ, এই দুটো ঘটনাতেও সামনের ঘর থেকে কোনো সাড়া এল না। অথচ ঘরের মধ্যে মানুষ নড়ে-চড়ে বেড়াচ্ছে তা টের পাওয়া গেল। দেখা গেল না কাউকে, তবু কুঞ্জ দাস দাওয়ায় উঠে পড়ে পা ঝুলিয়ে বসল। পিঠটা ঘরের দিকে। গলা তুলে বলল, বাড়ি ঘর আলগা রেখে বাড়ির লোক উধাও! চোর ঢুকল বাড়িতে তা হুশ নেই।
কথার উত্তর এল না, শুধু ভিতরের নড়া-চড়াটা যেন আরও স্পষ্ট হল।
কুঞ্জ দাস সেইভাবেই বলল, মনস্থির করে ফেললাম! ওখানেই মেয়ের বিয়ে দেব।
এবার হঠাৎ ঘরের বাতাস অলক্ষ্যে কথা কয়ে উঠল, ওইখানটা আবার কোনখানটা? চাল-চুলো আছে নাকি?
কুঞ্জ এবার গলাটাকে আরও দরাজ করে, যে চালের নীচে আছে সেইটাই তার চাল, যে চুলোয় খাচ্ছে সেইটাই তার চুলো।
আবার শব্দভেদী বাণ, অধিকারীর সব্বস্বর উত্তরাধি-কারী হবে তো ওই কুড়োনো মেয়েটা। যার জাতের ঠিক-
থাক থাক, আর বাহাদুরীতে কােজ নেই জাত-টাত আমি মানি না!
অলক্ষ্য থেকে—তা হঠাৎ মনস্থির করবার হেতু?
করছিলামই! নতুন করে আবার বাজিয়ে নিলাম। রোমান্টিক পালা নিতে বললাম, বলল, —আমার দ্বারা ওসব প্যান-প্যােনানি হবে না।—ব্যস, করে ফেললাম মনস্থির—
ঘর থেকে অবাক গলা ভেসে আসে, এতে কি হল?