কুঞ্জ সন্দেহের গলায় বলে, বাঃ, কেন তা বলবে? লোকে তো নতুনই চায়?
বরুণ হাসে, চায়! নতুনের কাছে চায়!
এ কথা তোমায় কে বলল বলত, নাট্যকার? বয়েস তো তোমরা এই বাছা, লোকচরিত্র এত দেখলে কোথায়?
দেখবার চোখ থাকলে, দেখতে বেশি সময় লাগে না, মিস্টার দাস!
হুঁ। তা বটে! নইলে এতগুলো আমন আগুন-আগুন নাটক লিখলেই বা কি করে? তবু আমার ভারী একটা সাধ হয়েছে, রোমান্টিক একটা লেখো তুমি! আজই শুরু করে দাও।
বরুণ হাসে, ভাবতে হবে না?
ভাবতো? আরে বাবা, রোমান্টিকের আবার ভাবাভাবির কী আছে? দুটো তরুণ তরুণী খাড়া করে, হয় তাদের—ওই তোমার গিয়ে কি বলে—পূর্বরাগ অনুরাগ ঘটিয়ে বিয়ে দিয়ে ছেড়ে দেবে, নয়তো অগ্ৰে মিলন, মধ্যে বিরহ, পরে আবার মিলন, এইভাবে ছক কেটে ফেলো-
বরুণ বলে, তাহলে পৌরাণিক কি ঐতিহাসিক কোনো চরিত্র নিয়ে কাজ করলেও হয়।
কুঞ্জ হাঁ হাঁ করে ওঠে—না না, ওসবে দরকার নেই। ওসব কি আর কেউ বাকি রেখেছে হে? পড়ে আছে পুরাণে ইতিহাসে, আবহমানকাল ধরে যে পারছে ধরছে আর চোরের মার মারছে। না না, তুমি বাপু কাল্পনিক চরিত্রই গড়ো।
বরুণ মৃদু হাসে। তারপর আস্তে বলে, কাল্পনিক চরিত্র মানেই সে আজকালকার জীবন? আজকের জীবনে রোমাস কোথায়, মিস্টার দাস?
কুঞ্জ অধিকারী মিস্টার দাসের মহিমা ভুলে চোখ গোল করে বলে ওঠে, নেই? রোমান্স নেই? তুমি যে তাজব করলে হে লেখক, আমি তো দেখি এটা রোমান্সেরই যুগ। এত রোমান্স যে, ঘরের দেওয়ালে আর আটক খাচ্ছে না, পথেঘাটে, হাটেবাজারে, মাঠেময়দানে রোমান্সের ছড়াছড়ি!
আপনি শহরের ফুটপাথের দোকানগুলো দেখেছেন, মিস্টার দাস?? মুক্তোর মালার ছড়াছড়ি!
কুঞ্জ দাস এক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ওহো হো-হো বলে বরুণের পিঠটা চাপড়ে দেয়। তারপর বলে, খুব উত্তরখানা দিয়েছ বটে…কিন্তু তুমি যাই বলো, আমি নিরুৎসাহ হচ্ছি না। আমার এবার বিশেষ বাসনা—
বরুণ হেসে বলে, তবে তো ভাবতে হয়।
ভাবো,-ভেবে প্লট ঠিক করে ফেল। আবার আসছি আমি, তুমি কতকটা খসড়া করো। তবে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, এই রোমান্টিকের মধ্যেও সমাজচিন্তা থাকবে। প্রেম করলাম বলেই যে বেহেড়া হয়ে প্রেম করব তা নয়।
কেন কে জানে বিরুণের হঠাৎ মেজাজ বদলে যায়। বরুণ হঠাৎ রুক্ষ গলায় বলে, হেড়ু বেহেড় জানি না, মিস্টার দাস, প্রেমের নাটক লেখা আমার দ্বারা হবে না।
কুঞ্জ দাস কি ক্রুদ্ধ হয়? না উৎফুল্ল? বোঝা যায় না। কারণ কুঞ্জ দাসের মুখটা গভীর দেখাচ্ছে, কিন্তু চোখটা যেন আলো-আলো। তা হয়তো বা রাগের আগুন। এবার হয়তো কুঞ্জ তার এতদিনের পুজ্যি লেখককে অসম্মান করে বসবে! কিন্তু চট করে তা করে না বুদ্ধিমান কুঞ্জ দাস। সে শুধু গভীরভাবে বলে, হবে না কেন, সেটা শুনতে পাই না?
হবে না। হবে না। এর আর কেনর কি আছে? বরুণ অবহেলার গলায় বলে—ওসব আমার হাতে আসবে না।
কুঞ্জ এবার একটু ঘনিষ্ঠ হয়, গলা নামিয়ে বলে, ব্যাপার কি বল তো নাট্যকার? কোথাও দোগা টাগা পাওনি তো?
বরুণ আরও অগ্রাহ্যের গলায় বলে, মাপ করবেন, স্যার! আমার কোনো অতীত ইতিহাস আবিষ্কার করতে বসবেন না। আপনাদের ওই লাভ ব্যাপারটাতেই আমার অশ্রদ্ধা! প্ৰেম বলে সত্যিই কিছু আছে নাকি? রাবিশ!
কুঞ্জ আলগা গলায় বলে, একেবারে রাবিশ?
আমার কাছে অন্ততঃ! ওসব শুনলেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। বিয়ে করা, ঘর সংসার কর, আপত্তির কিছু নেই। সেটা হচ্ছে লেনদেনের ব্যাপার। একটা চুক্তিপত্রের ব্যাপার। আমি তোমায় স্বামী সংসার দিলাম, সামাজিক পরিচয় দিলাম, তুমি আমায় স্ত্রী-পুত্র দিলে, রোগে-অসুখে দেখলে, চুকে গেল। তা নয় প্রেম, লাভ, মিলন, বিরহ। জগতে যা নেই, তাই নিয়ে কচকচি। এসব পালা লেখাতে হলে আমায় ছাড়ুন, মিস্টার দাস! বরুণ কলমটা কামড়াতে থাকে।
কুঞ্জ অধিকারী মানী লোক, তবু আশ্চর্য এতবড়ো অপমানেও আহত হয় না। বলে, চণ্টছ কেন নাট্যকার, চটছ কেন? ভাবলাম একটা নতুনত্ব করা যাক। যাকগে, দরকার নেই। ওই যে সেই কালোবাজারীদের নিয়ে কি একটা লিখবে বলছিলে—
বরুণ আত্মস্থ। বলে, আমি বলিনি, আপনি বলেছিলেন—
ও সে একই কথা! সেটাই করো।
কুঞ্জ দাস ওর ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। কিন্তু ব্যাজার মুখে নয়। কুঞ্জ দাসের মুখে বরং যেন একটা আশার দীপ্তি।
এই রকম মুখ দেখালেই কুঞ্জকে আমতা লাইনের সেই গ্রামের পথটায় হাঁটতে দেখা যায়। যখন যে নাটকটা নামায়, সেটায় হইচই পড়লে, নতুন মেডেল পেলে, বাবুদের দুকথা শোনাতে পারলে— কুঞ্জ ট্রেনের টিকিট কাটে। কুঞ্জ এক-আধবেলার জন্যে হাওয়া হয়ে যায়। আর কুঞ্জ হাওয়া হলেই দলসুদ্ধ সকলের পোয়া-বারো।
মায় কোমরে বেল্ট আঁটা লিলির পর্যন্ত। লিলি সেদিন খুকির খোলস ছেড়ে তরুণী হয়ে ওঠে। ফ্রকের ওপরেই যাত্রার সাজের একটা শাড়ি জড়ায়। আর নিমাইয়ের কাছে গিয়ে তার গা ঘেঁষে বলে, প্রোপ্ৰাইটার নেই বলে, খুব ভোজ লাগানো হচ্ছে, না?
নিমাই মুচকি হেসে বলে, তা হবে না কেন? তুইও তো সুযোগ পেয়ে হিরোইন সেজে বসে আছিস!..কী বলব লিলি, শাড়িতে আর ওই ঘাগীরাতে যেন আকাশ-পাতাল তফাত দেখায় তোকে।
লিলি তার সেই অবোধ শিশু চক্ষে এমন একটি কটাক্ষ করে, যা দেখতে পেলে রাগে কুঞ্জ। অধিকারীর বুক ধড়ফড় করে উঠত। আর হয়তো মেয়েটাকে ধরে চাবুক পেটাতে যেত।
কুঞ্জ তার পুষ্যি কন্যেকে খাটো ফ্রক আর আঁটো জ্যাকেট পরিয়ে খুকি করে রেখে নিশ্চিন্ত আছে। তবে কুঞ্জ মেয়েটাকে বাবা বলতে শেখায়নি, অদ্ভূত ওই ডাকটাতেই অভ্যস্ত লিলি : পোপাইটার।