তা ওই দলের লোকেরা লিলিকে মুখে যতই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভাব দেখাক, মনে মনে না মেনে পারে না। কারণ অধিকারীর পুয্যি কন্যে। সময় অসময় তাই তোেয়াজও করতে হয় তাকে।
তোয়াজ করে না শুধু বরুণ। ওই ব্ৰজ বিপিনের দল থেকে সে সম্পূর্ণ পৃথক। আর থাকেও সে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে। বরুণ পার্ট প্লে করে না, বরুণ পালা লেখে। বরুণের তাই কুঞ্জ দাসের কাছে বিশেষ খাতির। একমাত্র বরুণকেই কুঞ্জ কখনও উঁচু কথাটি বলে না, কখনও তুমি ছেড়ে তুই করে না।
বরুণের প্রতি কুঞ্জর যেন গুরুপুত্রের ভাব। কারণটা হয়তো ক্ষমতাবানের প্রতি অক্ষমের মুগ্ধতা। যে ক্ষমতা নিজের মধ্যে থাকবার ইচ্ছে কুঞ্জর, সে ক্ষমতা নেই তার। অথচ সেটা বিরুণের কাছে।
কুঞ্জর ভিতরে ভাবের জোয়ার, অথচ সে ভোব প্রকাশের ক্ষমতা নেই তার। বিপিনের কথা যদি সত্যি হয় তো কুঞ্জ অধিকারীর প্রথম এবং শেষ রচনা নারী না নাগিনী?
কিন্তু বরুণের কলম হচ্ছে সাধা কলম। ধরলেই সফল। যাই ধরুক। কুঞ্জ বরুণের এই অপূর্ব শক্তিতে অভিভূত! তাই কুঞ্জ তার ভাব আর ইচ্ছে ব্যক্ত করে, আর অনুরোধ জানায়, লিখে ফেলো লেখক, এটা নিয়ে লিখে ফেলো। খুব জ্বলন্ত ভাষায়। সমাজের এই দুর্নীতি, বজ্জাতি, ওর ওপর দুঘা চাবুক বসানো দরকার। ব্যস শুরু হয়ে যায় লেখা।
কুঞ্জ দেখে সে যা চেয়েছিল ঠিক তাই। অথচ বুঝিয়ে বলতে কতটুকুই বা পেরেছিল সে? শুধু ইচ্ছে প্রকাশ করা! বরুণ যেন মনের ভিতরের কথা টেনে বার করে সুন্দর আর সহজ করে স্বচ্ছন্দে লিখে দেয়। কুঞ্জ আশ্চর্য হয়ে ভাবে, কই আমি তো এত সব গুছিয়ে বলিনি? অথচ যত শুনি ততই মনে হয় ঠিক, ঠিক এইটাই বলতে চাইছিলাম। নিজের মনের কথা লোকে না হয় লিখতে পারে, কিন্তু অপরের? অপরের মনের কথা লেখে কেমন করে? তা ছাড়া বিরুণের ভাষার জোর কতা! বিরুণের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের তীক্ষ্মতা কতা! আগাগোড়া পালাটাই যেন হীরে চুনী পান্না! মুহুর্মুহু হাততালি পড়ে কি আর সাধে? ভবানী অপেরার যাবতীয় মহিমার মূলে বরুণ। সেই বরুণকে পুজ্যি করবে না। ভবানী অপেরার প্রোপ্ৰাইটার? তবে নাটকের নামকরণের ভারটি কুঞ্জর নিজের হাতে। এইটি তার নিজের এলাকা। মনে মনে আর একটি সংকল্প আছে কুঞ্জর, সেটা আজ পর্যন্ত ব্যক্ত করোনি কারও কাছে।
০২. কুঞ্জর মনের কথা
কিন্তু কুঞ্জর কি তাহলে মনের কথা বলবার কেউ নেই? সত্যিই কুঞ্জ নারীসম্পর্ক বর্জিত? তবে কুঞ্জ সুযোগ-সুবিধে পেলেই আমতা লাইনের কোন একটা গণ্ডগ্রামে যায় কেন? তা কুঞ্জ দাসকে জিগ্যেস করবে। কে? আমতা লাইনের ওই গ্রামটায় তোমার কি কাজ? এ কথা জিগ্যেস করতে গেলে তো চাকরি যাবে!
এই পালাদারদের যদি আসল বাস বলে কিছু থাকে তো কুঞ্জর আসল বাস কাটোয়ায়। সম্প্রতি এদিক ওদিক ঘুরে এসে, কিছুদিন আবার কাটোয়ায় স্থিতু হয়েছে কুঞ্জ। আর নতুন একটা নাটক লেখা চলেছে।
কোণের দিকের একখানা ঘরে কুঞ্জতে আর বিরুণেতে চলছে। নিভৃত পরামর্শ। হাতের কাছে কোনো বায়না নেই বলে ব্রজ আর বিপিন ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছে। বাসমতী গেছে তার গুরুপীঠ নবদ্বীপে। জগবন্ধুর এই কাটোয়াতেই বোনের বাড়ি, তাই এখানে যখন থাকা হয়, জগবন্ধু বোনের বাড়িতেই থাকে, খায়। কাজেই দল এখন হালকা, কাজকর্ম কম।
নিমাইয়ের হাতে কিছু টাকা ধরে দিয়েছে কুঞ্জ, বলেছে, তোতে আর সনাতনেতে পােলা করে দোকান বাজার করবি, নববালা রাঁধবে, ব্যস! কোনো যেন গণ্ডগোল শুনি না, দুবেলা যেন ঠিক সময়ে খাবার পাওয়া যায়। এই হচ্ছে আমার সাফ কথা। বেতিক্রম হলে কুরুক্ষেত্তর করব।
অতএব ঠিক মতো কাজ চলে। কারণ কুরুক্ষেত্তর করবার ক্ষমতা যে কুঞ্জর আছে, সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। যারা পড়ে আছে, তাদের তিন কুলে কেউ নেই বলেই তো পড়ে আছে।.তারা তো সন্ত্রস্ত থাকবেই।
তবে কুঞ্জ এবার মনের সুরটি বদলেছে। গলা নামিয়ে বরুণকে নির্দেশ দিচ্ছে, চাবুক-টাবুক। তো ঢের হল নাট্যকার, এবার একটা রোমান্টিক পালা লেখো দিকি।
রোমান্টিক! কুঞ্জর অভিলাষ! ভূতের মুখে রামনাম!
বরুণ অবাক হয়ে বলে, রোমান্টিক? হঠাৎ এ খেয়াল যে, মিস্টার দাস?
এই—এই আর একটি গুণের জন্যেও বরুণ কুঞ্জর প্রিয়পাত্ৰ। মিস্টার দাস ছাড়া কখনও আর কিছু বলে না বরুণ।
মিস্টার দাস। অতএব হৃষ্টচিত্তে বলেন, মাঝে মাঝে নতুনত্বের দরকার, বুঝলে? ভেবে ভেবে এটাই এখন ঠিক করেছি। আমি। ভবানী অপেরা মানেই জ্বলন্ত আগুন, এটাও ঠিক নয়, একটি ফুটন্ত গোলাপ দেবার ক্ষমতাও যে ভবানী অপেরা রাখে, সেটা দেখানো দরকার।
বরুণ স্বল্পভাষী, বরুণ স্বল্প হাসি-ও। সেই স্বল্প হাসিটুকু হেসে বরুণ বলে, কিন্তু আমার তো মনে হয় না সেটা দেখে লোকে খুশি হবে!
হবে না? বল কি নাট্যকার? তোমার লেখা নাটক, তাও যদি আবার রোমান্টিক হয়, লোকে তো লুফে নেবে।
আমার ওপর এত আস্থা রাখবেন না—বরুণ বলে, লোকের ধর্ম যে কী তা বোঝা বড়ো শক্ত, মিস্টার দাস। লোক-চরিত্র স্বয়ং ভগবানেরও অজানা। ওযে কিসে। রুষ্ট, কিসে তুষ্ট! তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, কেউ যদি একটা কিছু বিশেষ জিনিস দিতে পারল আর লোকের ভালো লেগে গেল। তো লোকে তার কাছে কেবল সেইটাই চাইবে। যে লোক কমিক করছে, তাকে চিরদিনই ওই কমিকের ভাড়ামিই চালিয়ে যেতে হবে। একটা গভীর জিনিস কি সিরিয়াস জিনিস, কেউ নেবে। না তার কাছে। তেমনি আপনার এই ভবানী অপেরার কাছে লোকে অবিরত ওই চাবুকই চাইবে, মধুর কিছু দিতে যান, হয়তো ফোলিওর হতে হবে! লোকে বলবে, দুর—ভবানী অপেরা আর আগের মতো নেই।