হতে পারে। বিপিন বলে, আমারও সে সন্দেহ ছিল। তবে বলিনি কোনোদিন কিছু। কি জানি মুখে মুখে ছড়িয়ে যদি দুর্বাশার কানে যায়। আমি যে ওর ইতিহাস জানি, ওর পাশের গায়ের লোক, কিছুই বলিনি কোনোদিন। বললে কোপে পড়ে যাব। কিনা কে জানে। …এই আজ হঠাৎ তোদের কাছে বলে ফেললাম, দেখিস যেন পাঁচ কান না হয়।
ওরা সবাই একযোগে হেসে ওঠে। বলে, পাঁচ কান? সে তো হয়েই বসে আছে। নিমাই, জগবন্ধু, সনাতন, ব্ৰজ আর বিপিনদা তুমি নিজে, পাঁচ দুগুণে দশ কান!
আরে বাবা, অধিকারীর কানে না গেলেই হল— বিপিন বলে, রাগলে দুর্বাসা—
এই রকম আলোচনার ক্ষেত্রে হঠাৎ লিলি এসে দাঁড়ায়। বেল্ট বাধা কোমরে একটা হাত দিয়ে মহারানীর ভঙ্গিতে বলে, কী হচ্ছে কি তোমাদের? কাজকর্ম নেই?
বিপিন বিরক্ত গলায় বলে, আছে কি নেই তাতে তোর দরকার কিরে ছুড়ি? তুই নিজের চরকায় তেল দিগে না।
আমার চরকা? লিলি হি হি করে হাসে। আমার চরকায় তো তেল দিয়ে এলাম এতক্ষণ ধরে? একশো তিনটে পাকা চুল তুলেছি।
আর, তুললি না কেন? মাথা বেল করে দিগে না? বিপিন রেগে রেগে বলে।
লিলি কিন্তু রাগে না। সে ঘাগরা ঘুরিয়ে একটা পাক খেয়ে বলে, বলে দেব প্রোপ্ৰাইটারকে।
দিগে যা, লাগানি-ভাঙানী-খোসামুদী!
লিলি এবার রেগে ওঠে। বলে, দেখ বিপিনদা, ভালো হবে না বলছি! তোমরা এখানে আড্ডা দিচ্ছ, তোমাদের হাসিতে প্রোপ্ৰাইটার মশাইয়ের ঘরের ছাত ফাটছে। তাই আমাকে বলে দিল, যা তো লিলি, দেখে আয় তো বাছাধনেদের এত ফুর্তি কিসের? কাজকর্ম নেই? উচ্চ হাসির বান ডাকিয়েছেন একেবারে!
ব্ৰজ এই পুষ্যপুত্তুরটিকে একেবারে দেখতে পারে না। তাই রুক্ষগলায় বলে, কেন? তোর প্রোপ্ৰাইটারের অধীনে যারা আছে, তাদের কি হাসতেও মানা?
তা আমি কি জানি? লিলি তার একটা গোড়ালির উপর দেহের সব ভারটা চাপিয়ে আবার এক পাক ঘুরে নিয়ে বলে, জানি না বাবা! প্রোপ্ৰাইটার আমায় পাঠাল তোমাদের শাসন করতে, তাই এলাম।
নিমাই চড়া গলায় বলে, তা হয়েছে তো শাসন করা? এবার যা আমাদের নামে লাগাতে-ভাঙাতে।
ভালো হবে না বলছি, নিমাইদা! লিলি নিতাইয়ের লম্বা লম্বা চুলের মুঠিটা একবার ধরে নাড়া। দিয়ে বলে, সব সময় তুমি আমার সঙ্গে লাগতে এসো না।
ব্রজ একটা ছ্যাবলা মার্ক হাসি হেসে বলে, নিমাইবাবুর তো সেই তাল। সব সময় যাতে তোর সঙ্গে লেগে থাকতে পারে, সেই আশায়-
বালিকা লিলি চেঁচিয়ে ওঠে, কেন? কেন সব সময় আমার সঙ্গে লাগতে আসবে? বলে দিচ্ছি। গিয়ে—
লিলি চলে গেলে এরা বলে, খুকিপনা আর গেল না!
যাবে কোথা থেকে? কৰ্তামশাইয়ের পুষ্যিপুত্তুর যে!
হুঁ তারপর দেখিস, খুকিটি হঠাৎ কোনোদিন কার সঙ্গে ভোগে পড়ে। সেই জ্যোচ্ছেনাবালার কথা মনে আছে তো? সে তো আর কর্তার পুষ্যিকন্যা ছিল না। কর্তা তাকে খাইয়ে পরিয়ে বড়োটি করেছিল অলক্ষ্যে ভোগে লাগাবে বলে, ব্যস চোদ্দ না পার হতেই নীল পাখি পালক গজিয়ে ফুড়ুৎ!
এই জগবন্ধু, ওকথা বলছিস কেন? কৰ্তার আর যাই দোষ থাক, ও দোষ নেই।
নেই, তোকে বলেছে। জ্যোচ্ছেনাকে কী রকম আগলাত মনে নেই? কারুর সঙ্গে একটু হেসে কথা কয়েছে কি মার-মার কাঁটু-কটু! ওটি কি শুধু শুধু হয় বাবা! স্বাৰ্থ চিন্তা থাকলেই তবে হয়।
ওটা কর্তার স্বভাব! মেয়েছেলেকে একচুল বিশ্বাস করে না! ছেদও করে না। নববালা, বাসমতী, এদের কী রকম তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে দেখেছিস তো? নেহাত কারে পড়ে দলে রাখতে হয় তাই, নচেৎ সেই আদ্যিকালের মতোন ব্যাটাছেলেগুলোকে গোঁফ কামিয়ে মেয়ে সাজাতে পারলেই বোধহয় বাচিত ও।
তা কথাটা ওদের মিথ্যে নয়, অধিকারীর মনোভাবটা প্রায় সেই রকমই। বলেও যখন তখন— দলের মধ্যে পাঁচটা মেয়েছেলে পোষা কি কম ঝকমারি? একশোটা ব্যাটাছেলের যা না ঝঞাট, একটা মেয়েছেলের জন্যে তা ঝঞাট। কী করব, কালের গতিকে না রাখলেই নয়। এখন যে সব বায়োস্কোপদেখা চোখ হয়েছে বাবু বিবিদের! গোঁফ কামানো মুখ নিয়ে শাড়ি পরা দেখলেই হাসির হররা উঠে যাবে।
দেখতে পারে না কুঞ্জ। একটা মেয়েকেও দেখতে পারে না। কাজেই তার সম্পর্কে স্বভাব দোষের কথাটা নেহাতই গায়ের জ্বালা থেকে উদ্ভূত।
জ্যোৎস্না নামের মেয়েটাকে যে আগলে বেড়াত, সে শুধু সন্দেহ বাতিকে, আর শাসনেচ্ছ হয়ে। তবু রক্ষা করতে পারল না জ্যোৎস্নাকে, সে একটা তবলচীর সঙ্গে পলাল।
কুঞ্জ দাস যখন টের পেল, তখন কিন্তু লাফালাফিও করল না, মার-মারও করল না। শুধু বলল, যে যার উপর্যুক্ত কাজই করেছে। কাঁঠালে মাছি কি আর কঁঠালী চাপায় বলতে যাবে? পচা কাঁঠালেই বসেছে।
তবু আবারও মেয়ে নিতে হয়েছে প্রোপ্রাইটার মিস্টার দাসকে। এখনকার নায়িকা হচ্ছে চারুহাসিনী। নববালা আর বাসমতী গিন্নিদের পার্ট প্লে করে। তাদের নিতে কারো মাখা ব্যথা নেই, শুধু কুঞ্জ দাসের আছে কড়া শাসন। খাও দাও কাজ করো, ব্যস! আড্ডা, গল্প, ভালোবাসাবাসি, এসব চাও তো কেটে পড়ে।
শুধু এই আদূরী মেয়েটা? লিলি! তার প্রতি যে অধিকারীর কী ভাব বোঝা শক্ত। কখনও মনে হয় বেজায় প্রশ্রয় দিচ্ছে, কখনও মনে হয়, নাঃ ওসব কিছু নেই, সকলের প্রতিই সমান অপক্ষপাত অধিকারীর।
তবে লিলির জীবনটা একটু অদ্ভুত বইকি! সে জানে না কখন তাকে মাথায় তোলা হবে, আবার কখন তাকে পায়ে ছেঁচা হবে। হয়তো সেই জন্যেই লিলি বালিকা থাকাটাকেই নিরাপদ মনে করে। তাতে মান অপমানের প্রশ্নটা কম থাকে। কখনও দলের মেয়েদের সঙ্গে হি হি করে, ছাচি পান চেয়ে খায়, ঝাল ঘুগনী এনে দেবার জন্যে বায়না করে, কখনও অধিকারীর তরফ হয়ে পাকাচোখা বুলিতে শাসন করে।