আদুরে খুঁকি লিলি কোনো কোনো দিন আদুরে গলায় বলে, চচ্চড়ি আমি খাব না। ডাল ভাত আমার বিচ্ছিরী লাগে, আমি, শুধু মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাব।
অধিকারী তার জোড়া বেণীর একটাকে টেনে তাকে কাছে নিয়ে এসে বলে, বুঝলাম, খাবে। ডালভাত তোমার রোচে না, তাই শুধু মাছের ঝোল ভাত খাবে। কিন্তু বলতে যাদু, কেন তা খাবে? কিসের দাবিতো? সবাই যা করছে, তুমি তাই করছ! মাঝে মাঝে পার্ট করছ, আর কি? আর কিছু নয়। তবে? ভাবিছ যে অধিকারীর আব্দুরী। আমি, আমার জোর বেশি, কেমন? ভুল! ভুল মাইডিয়ার, একেবারে ভুল! এই প্রোপ্ৰাইটার কুঞ্জ দাসের কাছে একচোখোমি পাবে না, সব সমান! তুমি এখনও পর্যন্ত চুল গুটিয়ে ছেলে সাজছ, তোমার দক্ষিণে কম। যখন চুল এলিয়ে হিরোয়িন সাজবে, তখন দক্ষিণে বাড়বে। ব্যস!
তবে মন ভালো থাকলে আর সময় থাকলে যখন পাকা চুল তুলতে ডাকে লিলিকে, তখন একটু প্রশ্রয় দেয়। চোখ বুজে বুজেই বলে, এবারে পুজোয় কি নিবি বল? আনারসী শাড়ি? ঘুণ্টিদার জুতো? লাল রিবন? আচ্ছা আচ্ছা, হবে।
আবার কোনো সময় গল্পও করে কুঞ্জ লিলির সঙ্গে। কেষ্ট হতভাগা কতবড়ো হতভাগা জনিস? সেদিন নাকি শতরঞ্জির ওপর কোন বাবু ভাইয়ের একখানা মানিব্যাগ পড়ে ছিল, ছোঁড়া নাকি সেটা বিপিন সরকারের কাছে জমা দিয়ে দিয়েছে! দেখ। তবে কতবড়ো মুখু আর হতভাগা! নিয়ে নিতিস, কে দেখত শুনি?
লিলি ঠিকরে উঠে বলে, ভগবান দেখত।
ভগবান! ও বাবা! সে লোকটা আবার দেখতে পায় নাকি? সে তো বোবা কালা অন্ধ রে!
ককখনো না, ভগবান সব দেখো! এই যে তুমি সবাইকে এত কষ্ট দাও, ভগবান নিশ্চয় দেখতে পায়।…আহাদী! আহাদী বলেই এতটা বলতে সাহস পায়।
তা এ রকম সময় কুঞ্জ দাস বিশেষ শাসন করে না। হয়তো শুধু বলে, পায়? দেখতে পায়? তবে তো তোকে কাল উপোস করিয়ে ঘরে বন্ধ করে রেখে দিতে হয়।
লিলি উত্তেজিত গলায় বলে, কেন? কেন শুনি? আমার সঙ্গে কি?
অধিকারী মোলায়েম গলায় বলে, ভগবান তো দেখবে? দেখে আমার কি শাস্তি করে, সেটাই দেখতে চাই।
লিলি রেগে বলে, শাস্তি কি আর এ জন্মে হয়? পরের জন্মে হবে শাস্তি।
পরের জন্মে? অধিকারী হা হা করে হেসে উঠে বলে, তবে নির্ভয় রইলাম। পরের জন্মে তো গরু গাধা ঘোড়া ছাগল এই রকমই একটা কিছু হবই, মনিবে পিটুনি দিয়ে দিয়ে খাঁটিয়ে নেবে, এ তো পড়েই আছে।
লিলি গভীরভাবে বলে, ভালো কাজ করলে আসছে জন্মে। বামুন হতে পারতে তুমি।
বামুন? ওরে সর্বনাশী। কুঞ্জ দাস কনে হাত দেয়, তা হলে তো কাজের ছায়া মাড়ানো বন্ধ করতে হয়।
বামুনের ওপর তোমার অ্যান্তো রাগ কেন বল তো? অধিকারীর পাকা চুল তোলার শেষে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে, লিলি আদুরে গলায় বলে, সবাই বলে তুমি নাকি বামুন বেছে বেছে দলে নাও, আর তাদের ওপর অত্যাচার কর!
বলে বুঝি? কুঞ্জ এবার গলা ছেড়ে হাসে। বলেছে তোর কাছে? বামুন ব্যাটাগুলো আচ্ছা! ধূর্ত তো! ধরে ফলেছে সব!
ওদিকে নিমাই, জগবন্ধু, সনাতন, বিপিন, ব্ৰজ, সবাই চোখ টেপাটেপি করে, কর্তার মেজাজ খুব শরিফ দেখছি! পুষ্যপুত্তর বুঝি পাকাচুল তুলতে গেছে?
এখনও খুঁকি করে রেখে দিয়েছে। ব্যাপার কি বল দিকি? ইচ্ছে করলেই তো একটা মেন পার্ট দিতে পারে?
দেবে না। মতলব আছে। ভেতরে ভেতরে।
কী মতলব বল দিকি?
ব্ৰজ সবজান্তার ভঙ্গিতে বলে, বিয়ে দেবে। কন্যে দানের পুণ্য কুড়োবে! এখন খুকি। সেজে, বেড়াচ্ছে, নয়তো নাটকে বালক সাজছে, লোকের চোখে পড়ছে না। শাড়ি পরে নাটকে অবতরণ করলেই তো হয়ে গেল! সবাই চিনে ফেলবে। বিয়ের বারোটা বেজে যাবে।
বিয়ে দেবো? নিমাই হি হি করে হাসে, দেবে তো আমার সঙ্গেই দিক না বাবা? দিব্যি সুন্দরী, ঢং ঢাংও জানে খুব।
তুই তো বামুন?
বামুন! হঠাৎ নিমাই বলে, বিষ হারিয়ে টোড়া। দেয় তো লুফে নিই।
দেবে না। সনাতন, বিচারকের রায়ের মতো অমোঘ ভঙ্গিতে বলে, তুই বামুন বলেই দেবে। না।
আচ্ছা, কেন বল দিকি? বামুনের ওপর ওর এত জাতক্ৰোধ কেন?
জনিসনে বুঝি?? বিপিন ওরই মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ, আর বিপিন সবচেয়ে পুরনো। তাই বিপিন জ্ঞান দেয় ওদের, ওরপরিবার যে ওঁদের দেশের এক বড়লোক বামুনের ছেলের সঙ্গে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল। বলিনি তোদের এ কথা?
হ্যাঁ হাঁ, বলেছিলে বটে একদিন। কিন্তু সেটা কি সত্যি?
অসত্যির কী আছে? জগতের কোথাও কারুর বিয়ে-করা বৌ পরী-পুরুষের সঙ্গে কুলের বার হয় না?
তা বলছি না! তবে—
বিপিন বলে, আমাদের পাশের গায়ের লোক তো! ওর বিত্তান্ত আমিই বেশি জানি। বৌ পালিয়ে গেল, বছর পাঁচেকের একটা মা-মরা ভাগ্নে ছিল সেটা মরে গেল। ও তাই ঘটিবাটি তুলে গ্রাম ছেড়ে একটা যাত্রার দলে ঢুকল। মাধব অধিকারীর যাত্রার নাম শুনেছিস? না, নামকরা খুব নয়, তবে ছিল তখন। সেইখানে ওর হাতেখড়ি। তা ও নাকি নিজে একখানা পালা লিখে নিয়ে গিয়েছিল—নারী না নাগিনী?। বলেছিল, সেইটা আসরে নামাতে। অধিকারী বলত, দেখব দেখব, দেখতে গা করত না। একদিন বলল, দেখেছি, অখাদ্য! ব্যস হঠাৎ আমাদের কর্তা চটেমটে খুব বাচসা লাগিয়ে দিল, রাগের মাথায় খাতাটা ছিনিয়ে নিয়ে কুচিকুচি করে ছিঁড়ে, অধিকারীর মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে এসে নিজে দল খোলবার তাল করে বেড়াতে লাগল। তারপর তো এই দেখছিস?
তা পালা তো আর লেখে না কই নিজে?
না! বোধহয় বুঝেছে অখাদ্যই হয়েছিল।
নিমাই মিটি-মিটি হেসে বলে, নারী না নাগিনী? নিজের সেই লক্ষ্মীছাড়া বেঁটার কাহিনি নয় তো?