বাসমতী আর নববালা স্টেশনের ধারে পানের দোকান দিয়েছে। পানের সঙ্গে না কি পানীয়ও রাখছে তফাতে, অতএব তাদের জন্যে ভাবনা নেই। তাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।
কুঞ্জ আসতেই ব্ৰজ বিপিন জগবন্ধু ছেকে ধরল, ভবানী অপেরা কি উঠে যাবে?
কুঞ্জ তক্ষুনি রোদুরে তেন্তে পুড়ে এসেছে, তবু সমীহ করল না। যে মনিব অধস্তন সম্পর্কে উদাসীন, তাকে কে সমীহ করে? রোদুরে তেন্তে পুড়ে এসেছে কুঞ্জ, তবু তেতে উঠল না। শান্ত গলায় বলল, বোস বোস, বল দিকি তোরা কি চাস?
আমরা?
ওরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। ওদের ভূমিকা এখানে কি!
কুঞ্জ বলল, বল? বল কী চাস? থাকবে, না উঠে যাবে?
ওরা একত্রে বলে উঠল, থাকবে, থাকবে।
থাকবে না তো তারা কোথায় যাবে?
বেশ, তবে থাকবে।.ভবানী অপেরা থাকবে, তোরা থাকবি। নতুন করে জীকিয়ে তুলি আর একবার, অনেকদিন অবহেলা করা হয়ে গেছে।
বরুণ এ দলে নেই, বরুণের কাছে যেতে হয়। লেখক, কি লিখলে এর মধ্যে?
কিচ্ছু না।
সে কি তবে এতদিন সময় পেলে?
মন লাগেনি। আর ভালো লাগছে না। আমায় এবার আপনি ছেড়ে দিন।
ছেড়ে দেব? তোমায়? কুঞ্জ হেসে ওঠে, তোমায় ছাড়ব তো থাকবে কি আমার?
সবই থাকবে। বরুণ নির্লিপ্ত গলায় বলে, চলেই যেতাম! নেহাত আপনার সঙ্গে দেখা না করে যেতে পারা গেল না। তাই—
কুঞ্জ বলে, এই তো হল দেখা, কই যাও?
বরুণ হেসে ফেলে বলে, আপনি অনুমতি করলেই যেতে পারি।
ও, অনুমতির অপেক্ষা? অনুমতি না দিলে তো যাওয়া বন্ধ? ঠিক আছে, দিলাম না অনুমতি, এবার কি করবে করা?
করবার আর থাকছে না কিছু। কিন্তু বাস্তবিকই আমাকে আর আটকাবেন না। রাস্তার লোক আবার রাস্তাতেই ফিরে যাই।
হবে না। নাট্যকার, ওসব হবে না। কুঞ্জ আগের মতো উদাত্ত গলায় বলে, ভবানী অপেরা পার্টিকে আবার নতুন করে জাঁকিয়ে তুলতে হবে। সম্বল সহায়হীন হয়ে পারব কি করে?
বরুণ নির্নিমেষ চোখে একবার ওই অতি উৎসাহী মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে কলে, আর পারবেন বলে মনে হচ্ছে না।
কুঞ্জ ঈষৎ মলিন হয়ে যায়। বলে, পারব না বলছ?
বলছি না। মনে হচ্ছে, সেটাই বলছি।
কিন্তু আমি বলছি বরুণ, পারব! কেউ পাশে থাকলেই সব পারা যায়। একটা ভালোবাসার লোক কাছে আছে, এটুকু জানতে পারলেই মনে বল আসে ভাই।…হাঁ, ভাই-ই বলব। এবার থেকে। কুঞ্জ একটু হাসে, বরাবর ইচ্ছে হত, মুখে এসে পড়ত, কিন্তু সামলে নিতাম। কেন জানো??
বরুণ অবাক হয়ে তাকায়।
এই নির্দোষ সম্বোধনটা মুখে এসে পড়লেও সামলে নেবার কারণ আবিষ্কার করতে পারে না সে।
কুঞ্জ আর একটু হাসে, জামাই করব বলে।…বুঝলে? রেলগাড়িতে দেখে পর্যন্তই ওই বাসনা। দেখ মুখুমি? মাথা নেই মাথা ব্যথা! মেয়ে নেই জামাই!…বল, লিলি কি আমার মেয়ে? অথচ তাকে মেয়ে সাজিয়ে জামাই ঠিক করতে বসলাম! মুখুমির ফল ফলল তো? ওর বাপ আমার মুখে জুতো মেরে গেল।…
কুঞ্জ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বলে, তবে আক্ষেপটা রয়ে গেল এই, মেয়েটা আমায় মায়ামমতাহীন নিষ্ঠুর ভেবে গেল। মানে ভেতরটা তো ধরতে দিতাম না। ভাবতাম কে কখন সন্দেহ করে বসবে। হয়তো খুঁজে বার করতে চেষ্টা করবে। কার গর্ভের মেয়ে।
বরুণ ওই বেদনাহত মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে বলে, সনাতন কোনো খবর করতে পারল না??
নাঃ! যে হারিয়ে যায়, সে নিজে না ধরা দিলে কার সাধ্য খুঁজে পায় রে ভাই! ভেবেছিলাম কষ্টে পড়লে ভুল বুঝবে। এসে দাঁড়াবে।।…কিন্তু এখন বুঝছি ভুল ভেবেছিলাম, দাঁড়াবে কেন? শুধু তো সে তার বাপেরই মেয়ে নয়, মায়েরও মেয়ে যে! আমার মধ্যে কি আছে না আছে টের তো পায়নি, আসবে কি জন্যে?
বরুণ বলে, ও নিয়ে আর মন খারাপ করবেন না, মিস্টার দাস! ধরে নিন—সে যেখানে আছে ভালো আছে, সুখে আছে।
তাই, তাই ভাবছি ভাই এখন। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ওর মরণ খবরটা পেয়ে একেবারে নিশ্চিন্দি হয়ে বসি। হল না। তবে ওটাই ভাবিব, ভালো আছে সুখে আছে…তবে আর তোমার অপেরা পার্টি জাঁকিয়ে তুলতে বাধা কি ভাই?
বরুণের হাতটা চেপে ধরে অধিকারী কুঞ্জ দাস।
বরুণ সে হাত ছাড়িয়ে নেয় না।
নরম গলায় বলে, না, বাধা আর কি। তুলুন জাঁকিয়ে।
কুঞ্জ দাস সেই ধরা হাতটায় একটা নিবিড় চাপ দিয়ে বলে, তা হলে এবার আর ছাড়ছি না ভায়া, এবার একটা রোমান্টিক কাহিনি লিখতেই হবে।…আর চাবুক নয়, দুঃশাসন নয়, মহাকালের খাতা নয়, শুধু ভালোবাসার কথা। স্নেহ প্রেম মায়া মমতা ভালোবাসা।…মহাকালের খাতায় কার কি জমা খরচ লেখা হচ্ছে, আমরা কি তার হিসেব রাখতে যাবার অধিকারী? তবু শুধু শুধু বড়াই কেন? ও খাতায় হাত দেবার আস্পর্ধা করতে গেলে কোন ফাঁকে নিজের জমার ঘরেই শূন্য বসে যাবে কিনা কে জানে।