মুখের প্রায় সমস্ত চামড়াটা পোড়া কেঁকড়ানো, কালো জামড়ো পড়া।.তার মাঝখানে মাঝখানে সত্যিকার রঙের এক এক চিলতে আভাস যেন আরও ভয়াবহ বীভর্ৎসতার সৃষ্টি করেছে।
যে সত্যিটা পরীর তুলনাবাহী ছিল। আর যার অহঙ্কারে সেদিন ওই মুখরা মেয়েটা সদৰ্পে বলেছিল, বাহবাও ছিল বৈ কি। ছিল রূপের বাহবা।
কুঞ্জ ভাবতে পারত এ উমাশশী নয়, আর কেউ। ভাবতে পারত, উমাশশী মরে গেছে, এটা তার প্রেতাত্মা। কিন্তু কুঞ্জকে সেই ভাবনার শান্তিটুকুও দিল না। ওই শয্যাবিলীন নারী।
শক্তি নেই। তবু মুখর হাসি হেসে বলে উঠল, ভেবেছিলাম জ্যান্ত থাকতে এই পোড়ামুখটা আর দেখাব না, একেবারে মরা মুখই দেখবে। হল না। দেখে ফেললে।
উমাশশী নয়, বলে আর স্বস্তি পাওয়া যায় না। কুঞ্জ মেজেয় পাতা বিছানার ধারে মাটিতে বসে পড়ে হাহাকারের গলায় বলে, এ কী?
উমাশশী হাসে। ভারী বিকৃত দেখায় মুখটা। ক্ষীণকণ্ঠে বলে, কোনটা? বিছানায় পড়ে থাকা, না পোড়া মুখটা?
দুই! দুইই উমা। এ কী করে হল?
উমা কষ্টে বলে, এত দেরিতে এলে, বলবার সময় আর কই? তা বলে ভেবো না, না খেতে পেয়ে মরছি। সে অহঙ্কার তুমি করতে পারতে না। এখনও অনেক টাকা আছে। গয়লা-বৌ আমার অনেক করছে, বলেছি তাকেই দিয়ে যাব।.চিঠিটা? ছলনা। দুষ্টুমি! তোমার টনক নড়াবার চেষ্টা। অসুখই। জ্বর রক্ত অতিসার। একেবারে শেষ করে ফেলল।
কুঞ্জ আর্ত চিৎকার করে, ডাক্তার দেখেনি? ওষুধ পড়েনি?
পড়েছিল। আবার হাসে উমা, গয়লা-বৌয়ের টোটকা। তার পর থেকেই চরমে উঠল আর কি। তোমার চিঠি আমি পাইনি। উমা— কুঞ্জ হাহাকার করে ওঠে, বাইরে বাইরে ঘুরছিলাম। এক কাল পালা নিয়ে–
পাওনি বুঝেছিলাম।
কুঞ্জ হাউ হাউ করে কেঁদে বলে, বুঝেছিলো? এখনও এত বিশ্বাস করেছিলে আমার ওপর?
কি যে বল!
উমা আরও আস্তে বলে, যেদিন বেলেঘাটার বস্তিতে এসে দাঁড়ালে সেই দিনই—না তারও আগে বোধ হয়। নইলে চিঠি দিয়ে ডাকতে পেরেছিলাম কি করে?…আর এখনও তা পারলাম কি করে?
উমা, আমি যাই! ডাক্তগণ ডেকে আনি—
আঃ, থামো! পোড়া মুখটা যখন দেখেই ফেললে, তখন তোমার মুখটা দেখতে দাও দুদণ্ড।
আমার মুখটাও পোড়া, উমা! অহঙ্কার করে বলে গিয়েছিলাম তোমার মেয়েকে তোমার কাছে দিয়ে যাব! অহঙ্কার রইল না। ফিরে গিয়ে দেখলাম সেই ঘাগরা পরা মেয়েটা— কুঞ্জ একটু থেমে বলে, দলের একটা ছোঁড়ার সঙ্গে পালিয়েছে।
পালিয়েছে! এ্যাঁ! পালিয়েছে! উমা হঠাৎ ভাঙা গলায় উচ্চ হাসি হেসে বলে ওঠে, বাঃ বাঃ।। মায়ের উপর্যুক্ত মেয়ে হয়েছে তাহলে! দেখলে রক্তের গুণ? দূর দূরান্তরে রেখে একবারও চোখে না। দেখিয়ে, তবু কেমন গুণটি ফলালাম?
আমি এ স্বপ্নেও ভাবিনি— কুঞ্জ কেঁচার খুঁট তুলে চোখ মোছে, কত ভালো পাত্তর ঠিক করেছিলাম। তার জন্যে।
স্বপ্নেও ধারণা করনি? কেন গো? ওর মা-বাপের পরিচয়টা বুঝি ভুলে গিয়েছিলে?
কুঞ্জ উত্তর খুঁজে না পেয়ে বারে বারে চোখটা মুছে নিয়ে বলে, মুখের এ অবস্থা হল কি করে?
ওমা, এখনও তুমি মুখের কথা ভাবিছ? ভাবলাম ভুলে গেলে! কিছু না। আমার সেই ভালোবাসার লোকের ভালোবাসার চিহ্ন। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে হেসে ফেলার পুরস্কার।
অ্যাসিড্!
হ্যাঁ, শুনলাম আমাকে শিক্ষা দিতে হাতের কাছে রাখা ছিল। বস্তির কাকে দিয়ে আনিয়ে—
থাক, উমা, কথা বোলো না, কষ্ট হচ্ছে। আমি ডাক্তার আনি।
আনো তবে। তোমার আবার আক্ষেপ থেকে যাবে বিনি চিকিচ্ছেয় মলো—
না, আক্ষেপ থাকেনি কুঞ্জর। করেছিল চিকিৎসা। কলকাতা থেকে ডাক্তার নিয়ে গিয়েছিল। তার নির্দেশে কলকাতায় এনে ভালো হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছিল। কিন্তু বাঁচল না। উমাশশী। তবে কুঞ্জ তার প্রতিশ্রুতিও রাখল।
সেই আধাপোড়া মুখটার মুখাগ্নি করল। করল শ্ৰাদ্ধ শান্তি। আর মোটা-বুদ্ধি গ্রাম্য লোকেরা যা করে তাই করল, সেই উপলক্ষে লোকজনও খাওয়াল বিস্তর।
কর্তার পরিবার ছিল এখনও, এই দেখে তাজব হয়ে গেল সবাই। আর কর্তার সেই হঠাৎ চলে যাওয়াটার হদিশও পেল। ছিল গিন্নি রুগ্নটুগ্র।
সব মিটে গেলে জীবনযুদ্ধে পরাজিতের চেহারা নিয়ে কুঞ্জ লিলিবালার অনেক খোঁজ করল, কিন্তু এই শহর কলকাতার রাক্ষসী ক্ষুধার জঠরে কোন অতলে তলিয়ে গেছে এক ফোঁটা লিলিবালা, কে কার পাত্তা দেবে? নিমাই নামের যে অপদাৰ্থ ছেলেটাকে ভর করে অবোধ দুঃসাহসী লিলিবালা ওই রাক্ষসীর গহ্বরে ঝাঁপ দিয়েছিল, সে ছেলেটা হয়তো পালিয়েছে প্ৰাণ বাঁচিয়ে।
আর লিলিবালা প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টায় পথ ভুল করে ধীরে ধীরে নেমে গেছে মৃত্যুর অন্ধকারে।
তবু সাহস করে ভবানী অপেরা পার্টির দরজায় এসে দাঁড়াতে পারেনি। যেখানে জীবন ছিল, আশ্বাস ছিল, আশ্রয় ছিল।
কোথায় কি থাকে সেটা টের, পায় না বলেই না মানুষের এত ভুল পথে ঘুরে মরা!
জ্বলন্ত নাটক নিয়ে রাজবাড়ির যাত্রা প্রতিযোগিতায় আর যোগ দেওয়া হল না কুঞ্জর, কবে যেন হয়ে গেছে সে সব। বায়না করাতে এসেও ফিরে যাচ্ছে লোকে, প্রোপ্ৰাইটারকে পাচ্ছে না।
প্রোপ্ৰাইটার তখন লিলিবালার মৃত্যু সংবাদ খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওটা পেলেই যেন বঁচে সে। নিশ্চিন্ত হয়ে কাজকর্মকরতে পারে।
সেই বাঁচাটা হল না কুঞ্জর। সে খবরটা না পেয়েই ফিরে এল একদিন কাটোয়ায়। দলের অবস্থা তখন শোচনীয়। কেউ কেউ ছেড়ে গিয়ে অন্য কাজে যোগ দিয়েছে। মাইনে পাচ্ছিল না ঠিকমতো, করবে কি? আর যারা কুঞ্জর নিতান্ত পুষ্যি, তারা পড়ে আছে আর অধিকারীকে দুবেলা গাল পাড়ছে। কারণ খাওয়াদাওয়া খারাপ হচ্ছে।