বাঁকুড়ার পালটা একবার সেরে আসতে পারলে হয়। কিন্তু পালা তো সহজে মেটে না। বাঁকুড়া থেকে আবার পুরুলিয়া ডাক আসে। হাততালির স্রোতে কুঞ্জ নামের মানুষটার ভিতরের সত্তটা যেন ভেসে ভেসে দূরে সরে যায়। পুরো একটা লরি ভাড়া নিয়ে ভবানী অপেরা পার্টি বাঁকুড়া থেকে পুরুলিয়ায় রওনা হয়।
এর ফাঁকে কুঞ্জর কাটোয়ায় বাড়িতে সনাতন নামের সেই পালিয়ে যাওয়া ছেলেটা ঝোড়ো কাকের মূর্তি নিয়ে এসে আরও দুটো পালানো মানুষের কীর্তি কাহিনিতে রং চড়িয়ে চড়িয়ে গল্প করে। পুরনো করে ফেলে, এখন মনের সুখে খাচ্ছে আর ঘুমোচ্ছে।
আর খামে মোড়া একটা চিঠি এসে কুঞ্জর ঘরের চৌকির ওপর পড়ে আছে। পিয়ন ফেলে দিয়ে গেছে জানিলা দিয়ে।
চিঠিটার মধ্যে শুধু একটাই লাইন, নাম সম্বোধনহীন।
মতলবিটা কী? না খাইয়ে মারতে চাও বুঝি?
পুরুলিয়া থেকে ফিরে এল ভবানী অপেরা পার্টি নতুন মেডেল নিয়ে।
একটা ভেজালদার তার নিজ পরিবারের সকলের মৃত্যুর কারণ হওয়ায় যেমন লোকে বেশ হয়েছে বলেছে, তেমন কেঁদেছে, শিউরেছে। এবং নাট্যকার আর পরিচালকের দরদ আর দুঃসাহসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছে লোকে।
ভরা মন নিয়ে এসে ঢুকল কুঞ্জ, আর এসেই দেখল। সনাতন। দেখেই চড়াৎ করে পায়ের রক্ত মাথায় উঠল তার! বলল, তুই এখানে? আবার তুই মুখ দেখাতে এসেছিস? বলে পায়ের জুতো খুলে মারতে উঠে থেমে গেল।
মুখ দেখানো শব্দটাই হঠাৎ মনের মধ্যে আলোড়ন তুলল। জুতো ফেলে বলল, আর দুটো কই?
তারা আসেনি ঘাড় গুঁজে উত্তর দেয় সনাতন।
তারা আসেনি? শুধু তুমি? কেন তোমারই বা আসবার দরকার কি ছিল? কোথায় তারা?
জানি না।
জানিস না? মিথ্যেবাদী হারামজাদা! একসঙ্গে ভাগলি, আর-
আমি ভাগিনি, ওরাই আমায় বলে. সনাতন বোঝে এই মত্ততায় ছাড়া কথাগুলো বলা যাবে। না। তাই সনাতন তড়বড় করে বলে ওঠে, যা কষ্ট দিয়েছে আমায়! খেতে দেয়নি।–তাড়িয়ে দিয়েছে।
খেতে দেয়নি? খেতে? নবাব খাঞ্জা খাঁ আবার খেতে চান! বলি ওরাই বা কোথা থেকে খেতে দেবে শুনি? ৰ
সনাতন এখন রাজসাক্ষী। সনাতনকে এখন নিজের দিক বাঁচিয়ে কথা বলতে হবে। তাই সনাতনের বলতে বাধে না, কর্তার ঘর থেকে টাকা চুরি করে পালিয়েছে লিলি। আর সে টাকা শেষ হতে লিলি রোজগার ধরেছে। না করে উপায় কি! খেতে তো হবে।
রোজগার!…কুঞ্জর অসতর্ক কণ্ঠ বিস্ময়ের চাবুকে আহত হয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলে, কিসের রোজগার?
সনাতন ঘাড়টা হোঁট করে। আর হঠাৎ তার সেই হোঁট হওয়া ঘাড়ের ওপর খটখট করে এসে পড়ে একটা ভারী জুতোর পাটি। বলবি আর? বলবি আর?
সনাতন ছুটি দেয়। আর কুঞ্জ জুতোটা হাত থেকে ফেলে ঘরে ঢোকে। ঢুকেই স্তব্ধ হয়ে যায় কুঞ্জ। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে চৌকির ওপরকার জিনিসটার দিকে।
তারপর জুতোর হাতটা ধুয়ে এসে, আস্তে খামটা খোলে। পড়ে—মতলবিটা কি? না খাইয়ে মারতে চাও বুঝি?—আবার পড়ে।—আবার পড়ে। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দুদিক থেকে জুতো দুপাটি কুড়িয়ে নিয়ে পায়ে দিয়ে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
আবার আমতা লাইনের সেই গণ্ডগ্রামটার সেই পায়ে চলা সরু পথের উপর দুপাটি ভারী ভারী জুতোর ছাপ পড়ে…ভারী জুতো আর আধময়লা ধুতি শার্ট পরা একটা লোককে আবার সেই বেড়ার দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকতে দেখা যায়।
ভিতরের দৃশ্যটি যথাযথ। সেই উঠানে তুলসী ঝাড়, এখানে ওখানে গাঁদা টগর জবা, দাওয়ায় উঠতে তিনটে সিঁড়ি। কোনো কিছুর ওদিক ওদিক নেই। তবু যেন বুকটা কেঁপে ওঠে কুঞ্জর।
তবু কুঞ্জ অধিকারীর মনে হয় যেন বাড়িটা শ্মশান শ্মশান। যেন এখুনি কোনোখান থেকে প্ৰেতাত্মারা কথা কয়ে উঠবে।
কী হয়েছে? কেউই তো থাকে না কোনো দিন, তবে আজ এমন কেন? সত্যিই তো তাহলে—
কিন্তু আজও কুঞ্জ দাওয়ায় দাঁড়িয়ে কেন? কুঞ্জর যে সংকল্প ছিল এবার আর ভয় নয়। এবার নিজের দাবিতে সবলে। ঘরে প্রবেশ করবে। এবার বলবে, জগতে কতই দেখলাম। কত ভুলের কারবার ঠিক-এর বাজারে চলে যাচ্ছে, কত গলি ঘুজি রাজরাস্তায় এসে মিশেছে। তবে দৈবাতের একটা ভুল শুধরে নিতে বাধা কোথায়?…ভুল তুমিও করেছ, আমিও করেছি, ব্যস শোধ-বোধ। আবার জীবনের পথে—।
কিন্তু সে সব কথা হারিয়ে গিয়ে আবার শুধু ভয় কেন? কেন আজও দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আছে বোকার মতো? কতকাল ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে ও? অনন্তকাল?
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাল কুঞ্জ। দেখতে পেল, উঠোনের দড়িতে একটা কথা শাড়ি সেমিজ শুকোচ্ছে, দেখল দাওয়ার ধারে মাজা ঘটিতে জল। তার মানে বাড়িতে জ্যান্ত মানুষ আছে। আর সে নিত্য কাজ করছে। কোথায় তবে গেল সে? পড়াশীর বাড়ি? পুকুরে জল আনতে? কতক্ষণের জন্যে?
ভরা রোদুরের বিকেল, চারিদিক আলোয় খ খ করছে, শূন্য বাড়ির মাঝখানে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে গলাটা শুকিয়ে আসে কুঞ্জর। আর নিজেই হঠাৎ সে প্রেতাত্মার গলায় কথা বলে ওঠে, একটু জল পাওয়া যাবে? খাবার জল?
কাকে বলে ওঠে, জানে না। কিন্তু তার এই অবোধ প্রশ্নের উত্তর এসে যায় হঠাৎ! ঘরের মধ্যে থেকে একটা ক্ষীণ রোগীকণ্ঠ উত্তেজিত গলায় বলে ওঠে, কে? কে? জল চাইল কে? সদ্য ঘুম ভাঙার গলা? না? জ্বরে আচ্ছন্নর গলা।
কুঞ্জর বিহ্বল চেতনা যেন ঝাঁকুনি খেয়ে হঠাৎ সজাগ হয়ে ওঠে। কুঞ্জর সেই সাহসী সংকল্প দৃঢ় হয়ে দাওয়া থেকে ঘরে এনে ফেলে কুঞ্জকে। অতএব কুঞ্জর ঘরে ঢোকা হয়।—হয়।—কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই অস্ফুট একটা আর্তনাদ করে পিছিয়ে আসতে হয় কুঞ্জকে। বুঝিবা চোখটাও বুজে। বিছানায় যে পড়ে আছে, সে কে!