কুঞ্জ বরুণের কাছে আর্জি পেশ করতে যায়। ওই ভেজালদারের এক বন্ধু আছে, যে তার হিতৈষী যে সত্যব্রতী। তার মুখে অনেক উপদেশ বাণী আছে। সে পার্টটা নিমাই করে। নিমাইয়ের উচ্চারণ ভালো। গেলবারে ব্রজকে দিয়ে চালাতে হয়েছে। কিন্তু ব্ৰজর উচ্চারণ অস্পষ্ট। অমন চরিত্রটা, অমন ডায়লগ, ওই দোষে যেন ঝুলে পড়ল।—বরুণ যদি নিজে ওতে নামে, মারকাটারি হবে।
তা বরুণ বুঝি সত্যিই ওই মুখ কুঞ্জ দাসের কাছে সেই অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা পড়ে গেছে। যে বন্ধন স্বাধীন চিত্তের স্বাধীনতাটুকু হরণ করে নেয়। নইলে কুঞ্জর অনুরোধ রাখতে রাজী হয় বরুণ?
বলে, কিন্তু একদিনের জন্যে।
ঠিক আছে, তাই সই।
কুঞ্জ আবার নবীন বয়সের উদ্যম পায় যেন? কুঞ্জ চারুহাসিনীকে গিয়ে অবহিত করে। তারপ বাঁকুড়ার ডাক্তারবাবুর শালাকে জানায়, মনস্থির করেই ফেললাম। বাবু।
এই উত্তেজনার মাথায় পরদিনই বেরিয়ে পড়ল স্টেশনের উদ্দেশ্যে। গিয়ে পড়ে বলতে তে৷ হবে, বড়োমুখ করে বলেছিলাম মেয়েকে দিয়ে যাব। মুখ থাকল না। মেয়ে সেই মুখে চুনকালি দিয়ে চলে গেছে!
দেওয়ালের ওপর থেকে নিশ্চয়ই ব্যঙ্গ হাসি উঠবে। মেয়ে আসরে নেচে মেডেল লোঠার খবর থেকেই যে এ খবরটাও পাওয়া গিয়েছিল, সেই উল্লেখ থাকবে সে হাসিতে। থাককু, তবু বলতে তো হবে। জানাতে তো হবে মুখে কুটো দিয়ে, তোমার গচ্ছিত ধন আমি রক্ষে করতে পারিনি!
কদিন ধরেই মনে মনে চালাচ্ছিল এ মহলা, কিন্তু ভয়ানক একটা ভয় যেন গ্ৰাস করে ফেলছিল। কুঞ্জকে। কুঞ্জ পেরে উঠছিল না।
নিজে পথ করে কাঠগড়ায় উঠতে কে যায়? নিজে দড়ি টেনে গলায় ফাঁসি কে লাগায়? কিন্তু আজি হঠাৎ উৎসাহের বেঁকে বল সংগ্রহ করে ফেলল। চলল মহলা করতে করতে। উমাকেও বলতে হবে, যা হবার তা হবেই। তাকে রোধ করা যায় না।
কিন্তু কুঞ্জর গ্ৰহ নক্ষত্র বোধহয় এখন প্রতিকুল, তাই কুঞ্জর আত মহলা বিফলে গেল। কুঞ্জ একটুর জন্যে ট্রেন ফেল করল। আজ আর সুবিধের ট্রেন নেই। অথচ আর সময়ও নেই। কাল বাদ পরশু বাঁকুড়ায় যাবার ব্যবস্থা।
এই দলবল, এই পাহাড় প্রমাণ সাজসরঞ্জাম! এসব গুছিয়ে নিয়ে যাওয়া সোজা নয়। ছেলে ছোকরাদের মধ্যে তো ছোট নেই। বিপিন থেকে শুরু করে সকলেই প্ৰায় বয়স্ক। তাদের আবার ধমক দেবার জো নেই। তোয়াজ করে করে নিয়ে যাওয়া। দুটো দিন হাতে রাখতেই হবে। ট্রেনের টাইম আছে, ট্রেনের ধকল আছে।
এ যাত্রায় আর হল না। ঘুরে এসে হবে। যাঁহা বাহান্ন তাহা পয়ষট্টি! ভাবছেই তো ঝগড়া করে চলে এসেছি, তাই যাচ্ছি না, আরও দুদিন ভাবুক!
০৭. কুঞ্জ আজ বাইরে গেছে
কুঞ্জ আজ বাইরে গেছে। কালকের আগে আসবে না। নববালা আর বাসমতী রান্নাঘরে বসে বিড়ি টানছিল, আর সুখ দুঃখের কথা কইছিল।
আবার হট্ হট্ করে ছোটো এক দেশে।—অরুচি ধরে গেছে বাবা!—এর থেকে এসব ছেড়ে-ছুঁড়ে ইস্টিশানে পানের দোকান দিলে হয়। তা থেকে খুব পেট চলবে। অথচ খাটুনি নেই।
আর এই দস্যি কাজে? হাড় পিষে যায়! শুধু তো পার্ট করা নয়, এই রাবণের গুষ্টির ভাত রাঁধা!
গল্প যখন উদ্দাম, হঠাৎ বুকের ভেতর ধড়ফড়িয়ে উঠল। এ কী, অধিকারীর গলা না? চলে গিয়েছিল যে? ওরা তো ধরে নিয়েছিল মাঝে মাঝে যেমন একদিনের জন্যে ড়ুব মারে কর্তা, তেমনি গেছে।
এই নিয়ে কত জল্পনা-কল্পনা করে তারা। কোথায় যায় অধিকারী? এদিকে তো খাজা-গোয়ার, ওর যে কোথাও কোনোখানে ভাবের লোক আছে, তা তো মনে হয় না। তবে আছে কে? বলে না। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে। আসেও ঠিক নিয়ম মাফিক।
জল্পনান্তে ওরা ধরে নিয়েছিল নিশ্চয় কোনো দেবস্থানে যায়। অনেকের আবার ওতে লজ্জা আছে। তাই চেপে যায় কথাটা। ঠাকুর দেবতা করে, লুকিয়ে।
আজও তাই গিয়েছে জানে, হঠাৎ কর্তার গলার স্বর। কাকে যেন বলছে, নাঃ বেরোলাম না, ফিরেই এলাম। শরীরটা তেমন ইয়ে ঠেকাল না।
হাতের বিড়ি ফেলে দিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল ওরা। বাসমতী বলে উঠল, শরীর বুঝি খারাপ?
শত্রুর শরীর খারাপ হোক। বলে চলে যায় কুঞ্জ।
কুঞ্জর কানে একটা সুর এসে বাজে। কে কোথায় কী সুর বাজাচ্ছে কে জানে। কুঞ্জর বিস্বাদ মনটা হঠাৎ একটা আনন্দের আস্বাদে ভরে যায়। কুঞ্জ ভাবছিল, এ পৃথিবীতে বুঝি ভালো জিনিস বলে কিছু নেই। কিন্তু তা তো নয়। আছে ভালো জিনিস আছে। সুর আছে।
সুর আছে, এটা যেন কুঞ্জ প্রায় ভুলেই যেতে বসেছিল। সুর হারানো প্ৰাণ নিয়ে কেবল ভেসে এসেছে, জগতে শুধু বেসুরো অ-সুর আছে। আর কুঞ্জর হাতে চাবুক আছে। অথচ এখনও সুর আছে, গান আছে!
কুঞ্জ তার ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে ভাবে, তার পৃথিবীকে কি আবার সুরে ভরে তোলা যায় না? হয়তো ঠিক এই ভাষায় ভাবতে পারে না মুখ কুঞ্জ, তবে ভাবটা এই।
জীবনের রাজপথে চলতে চলতে, তার অনেক গলি ঘুজিও চোখে পড়ে বৈকি। দেখা যায় সেখানেও লোকে দিব্যি বাস করছে বড়ো রাস্তার ধারের মানুষদের মতোই। কতসময় কত বিয়ে না। হওয়া স্বাম স্ত্রীকে ঠিক স্বামী-স্ত্রীর মতোই সংসার করতে দেখল কুঞ্জ, দেখল কত বিধবাকে সহজভাবে একটা আত্মীয়পুরুষের ঘর করতে। অথচ তাদের মধ্যে কোনোখানে অস্বচ্ছন্দতা নেই।
কুঞ্জই বা কেন তবে একটা দৈবাৎ উল্টোপাল্টা হয়ে যাওয়া ঘটনাকে সোজা করে নিতে পারল না? কেন চিরদিন দেওয়ালের বাইরে রইল? এটা কি কুঞ্জরই ত্রুটি নয়? কুঞ্জ যদি দাবি খোটাত? কুঞ্জ যদি ভয়ে না মরত? কিন্তু কুঞ্জ ভয় পায়। কুঞ্জ ঠিক করল এবার, কুঞ্জ নির্ভয় হবে। কুঞ্জ দাবির বলে দেওয়াল ভাঙবে। দেখবে না কেমন মুখ দেখায় সে।