যারা বায়নার টাকা দিয়েছে, দশদিন ধরে এককৗড়ি লোক পুষছে, তারা ছেড়ে কথা কইবে? পালা নামাতেই হয়েছে কুঞ্জকে। চারুহাসিনীকে দিয়েই চালাতে হয়েছে। রব তুলতে হয়েছে লিলিবালার দিদিমার হঠাৎ মরমর অসুখ, তাই চলে যেতে হয়েছে তাকে।।
তা যাক, সারা পালটা এমনিতেই জমজমাট! বিরুণের কলমের গুণেই মুহুর্মুহু হাততালি, আর চারুহাসিনীও একেবারে ফেলনা নয়। চালাচ্ছিল তো এতদিন।
পালা শেষে জাল গুটিয়ে চলেও আসতে হয়েছে বৈকি কুঞ্জকে কোমর তুলে।, বোলার দিদিমার মরণে লিলিবালা সেখানে আটকে পড়েছে বলে কি অধিকারী কুঞ্জ দাস ভেঙে পড়ে মাটিতে পড়ে থাকবে?
তবে হ্যাঁ, দুদুটো ছেলেকে লিলির সঙ্গী হিসেবে পাঠিয়ে অসুবিধে একটু হয়েছে, তারাও তো আটকে পড়েছে। তা কি আর করা যাবে? তেমনি, যে মানুষ পালা লেখা ছাড়া আর কখনও কিছু করে না, সেই মানুষই বুক দিয়ে করল!
ছড়ানো জাল গুটিয়ে আবার কাটোয়ায় এনে ফেলে সবে স্থির হয়ে আমতা লাইনের সেই গ্রামের পথটায় পাড়ি দেবে, হঠাৎ বাঁকুড়া থেকে এক তলব এসে হাজির।
নতুন কি এক পালা করেছেন না কি চোরাকারবারিদের ঠুকে, মেদনীপুরে জয়জয়কার করে। এসেছেন, বায়না করতে এসেছি তার।
কুঞ্জ গভীরভাবে বলে, ওইটি আজ্ঞে করবেন না বাবুমশায়, আর যেটা বলেন রাজী!
হ্যাঁ, বাইরের লোকের সঙ্গে কথা কইতে কুঞ্জ বাবুৰ্মশায় টশায় বলে।
এসেছেন বাঁকুড়ার নামকরা এক ডাক্তার বাড়ি থেকে, ডাক্তারের শালা জন্মাষ্টমী উৎসবে যাত্রাগান দেবেন। লোকটা একটু স্বদেশী স্বদেশী। ছেলেমেয়েরা নাকি চেয়েছিল জলসা হোক, তিনি বলেছেন না, দেশের পুরনো জিনিস হোক।
কথাটা ভালো লাগে কুঞ্জর। কিন্তু ওই পালটা? যেটার সঙ্গে কুঞ্জর জীবনের সব সর্বনাশ জড়িত। ওটা হবে না বাবুমশায়, আর যা বলেন।
বাবুমশায় সন্দেহের গলায় বলেন কেন ওটাতে পুলিশের কোপে-টোপে পড়েছিলেন নাকি?
না না! সে সব ভয় কুঞ্জ অধিকারী করে না। ওটার মানে, অ্যাকটার অ্যাকট্রেস নেই এখন।
নেই কি মশাই? এই কদিন আগেই তো মেদিনীপুরে কাটিয়ে এলেন।
দুতিনজন পালা সেরে দিয়েই দেশে গেছে।
আহা, এখনও তো দুচারদিন রয়েছে। দেশ থেকে আনান।
কুঞ্জ তবু ঘাড় নাড়ে, আসবে না, দেশে অসুখ।
বাবুমশাই কিন্তু নাছোড়বান্দা। এটা তিনি করিয়ে তবে যাবেন। টাকা নিয়ে এসেছেন বায়নার।
কুঞ্জ হতাশ গলায় বলে, আমার অসুবিধেটা বুঝছেন না বাবু, ওটা ছাড়া অন্য কিছু বলুন।
তা হয় না। ওটাই চাই। আপত্তির কোনো অর্থ নেই। দুটো মাত্র কারণ থাকতে পারে আপত্তির, এক আইনের দায়, দুই কম্পিটিশনে নামবার জন্যে নতুন নাটক তুলে রাখছে।
প্রথমটা যখন নয়, তখন দ্বিতীয়টা। কিন্তু ওটা অধিকারীর ভুল ধারণা। তাতে বরং নাম ছড়াবে। যুক্তির শরশয্যা।
হয়তো এই আপত্তিটাই বাবুমশাইকে এমন আগ্রহে উত্তেজিত করেছে। আপত্তি করেছে? নিশ্চয় তাহলে ভিতরে কোনো গৃঢ় কারণ আছে। তবে ওই আপত্তিটা ভাঙবার জন্যে গাইতি শাবল লাগাও।
অনেক কথা অন্তে নিরুপায়ে কুঞ্জ হতাশ গলায় বলে, আচ্ছা বাবু মশায়, আপনি একটা বেলা সময় দিন আমায়, চিন্তা করে বলব। বুঝতেই তো পাচ্ছেন, সাধ্যপক্ষে এত কথা কইতাম না। আমি।
বাবুমশাই বলেন, ঠিক আছে, এখানে আমার ভাইঝির বাড়ি, থাকব আজকের দিনটা। কোথাকার মানুষ কোথায় এসেছি একটা উদ্দেশ্য নিয়ে, বিফল হয়ে ফিরে যাব? আপনার দলবলের আতিথ্যের কোনো ত্রুটি হবে না, দেখবেন।
বাবুমশাই চলে যাবার পর কুঞ্জ ভয়ানক একটা অস্থিরতা অনুভব করে। যা কাম্য, যা প্রাথিত, তাই এসে যাচ্ছে হাতের মুঠোয়, যথার্থ সম্মান। অথচ কুঞ্জ তা নিতে পারছে না। কেন? বাধাটা কোথায়? পালটা অপয়া? ওই মহাকালের খাতা থেকেই কুঞ্জর জীবনের হিসেবের খাতা এলোমেলো হয়ে গেল।
কিন্তু ওই কুসংস্কারটা যদি না মানা যায়? যদি কুঞ্জ ভাবে ওগুলো ঘটতই। সুখ-দুঃখ, বিপদসম্পদ সবই চন্দ্ৰ সূর্যের মতো অমোঘ নিয়মের অধীন, তারা যথাসময়ে আসবেই মানুষের জীবনে, যতটা আলোছায়া ফেলবার তা ফেলবেই। তা হলে? ঠিক তাই।
লিলি লক্ষ্মীছড়ির পালিয়ে যাওয়া কুঞ্জর কপালে ছিল। উমার সঙ্গে অকারণ বিচ্ছিন্নত কুঞ্জর কপালে ছিল। এসব অমোঘ অনিবার্য। কুঞ্জ সেই ব্যাপারটাকে কুসংস্কারে ফেলে অন্য চেহারা দিচ্ছে।
নাঃ, এসব দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া কিছু নয়। কুঞ্জ নেবে বায়না। লিলি মুছে যাচ্ছে চারুহাসিনী তো আছে। নিমাই চুলোয় যাক, বরুণকেই এবার আসরে নামিয়ে ছাড়বে কুঞ্জ।
হঠাৎ একটা নতুন উৎসাহে টগবগিয়ে ওঠে কুঞ্জ। আর সকালে যে সেই লোকটার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করেছে, তার জন্যে লজ্জাবোধ করে। ওকে না হয় বলে দেবে, মনস্থির করে ফেললাম বাবুমশায়! নিলাম বায়না।
বরুণ আপত্তি করবে? সে আপত্তি খণ্ডন করে ছাড়বে কুঞ্জ। বলবে নিজের ভাষা একবার নিজের মুখে বলে দেখেছ? দেখো হে কী উদ্দীপনা পাবে!
ভাবতে ভাবতে নিজেই উদ্দীপনা বোধ করে কুঞ্জ। নতুন শহরের নতুন আসর তার আলোকমালা নিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকে।
কুঞ্জ সেখানে বুকভর্তি মেডেল নিয়ে দীপ্ত মহিমায় না।দীপাঠ করে…শুনুন বাবুসকলরা, এ এক ভেজালদার চোরাকারবারির কাহিনি। কিন্তু এ একের কাহিনি নয়। স* স্রের কাহিনি। মানুষ মারার কারবার খুলে বসেছেন। এরা!..কিন্তু বাবুমশায়, আজও চন্দ্ৰ সূৰ্য উঠছে। তাই এদের হিসেব লেখা হচ্ছে। লেখা হচ্ছে মহাকালের খাতায়। কুঞ্জর শিথিল মন খাড়া হয়ে ওঠে।