মানুষই। বাঘ ভালুক নয়। কামড়ে দেবে না।
উমাশশী তথাপি টলেনি। বরং হেসে উঠে বলেছিল, বিশ্বাস কি? তাছাড়া পাড়াপড়শি তো বাঘ ভালুকের কাছাকাছি। সকালবেলা ছাতা জুতো দেখলে—
কুঞ্জ নিজস্ব ভঙ্গিতে চড়ে উঠেছিল, কেন, এ কথা বলা যায় না দেশের লোক খোঁজ নিতে এসেছিল, বৃষ্টিতে আটকা পড়ে—
উমাশশী আরও হেসে উঠেছিল। হেসে হেসে বলেছিল, জিগ্যেস করলে বলা যায়। জিগ্যেস না করলে? গায়ে পড়ে বলা যায় না তো?
ঠিক আছে, যাচ্ছি। বলে চলে গিয়েছিল অধিকারী কুঞ্জ দাস। কিন্তু ঠিক আছে, যাচ্ছি ভিন্ন কবে আর আচ্ছা, চললাম— অথবা আচ্ছা, আসি বলে কুঞ্জ? কুঞ্জর বিদায় নেবার ভঙ্গিটাই তো রাগ-রাগি! বিদায় যে নিতে হচ্ছে, সেটাই রাগের।
কিন্তু উমাশশী কী করবে? উমাশশী তো নিজেই নিজের সুখের পথে কাঁটা বিছিয়ে রেখেছে।
উমাশশী নিজেই নিজের সুখের পথে কাঁটা বিছিয়ে রেখেছে। কিন্তু উমাশশীর মেয়ে? তা সে নাকি বুদ্ধিমান, অন্তত তার পালক পিতা তাই বলত, তা সে বুদ্ধিমান বলেই বোধকরি * সুখের পথ প্রশস্ত করে নিয়েছে।
একটা মাটিকোঠার হোটেলের দোতলার ঘরে লোহার চেয়ারে বসে পা দোলাতে দোলাতে উমাশশীর মেয়ে বলে, পোপাইটারের জন্যে একটু মন কেমন করছে বটে, তিন তিনটে মানুষ কেটে পড়ায় অসুবিধেতে পড়বে ও। তবে খুব চালাকি হল একখানা!
নিমাই বলে, সনার যা পার্ট, ও তো রাস্তা থেকে লোক ধরে এনে আসরে ছেড়ে দিলেও হয়। আমারটা ব্রজরাজ দেবে অখন যা হোক করে চালিয়ে, আর তোর? সে বিষয়ে নিশ্চিন্দে থাকিস, তোকে আর আসরে যেতে হত না। চারুহাসিনীর জ্বর ছেড়েছে, ওর হকের ধন মদনমোহন—ও ছাড়াত ভেবেছিস?…জোর করে ছাড়ালে ও তোর গায়ের ছাল ছাড়িয়ে নিত! তোর ভাগ্যে ওই একটি রজনীই।
উমাশশীর মেয়েকে শাড়ি পরে মোহিনী দেখায়। উমাশশীর মেয়ের এক মুখ পান খাওয়া পানের রসটা ঠোঁটের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে, আর সে অতীতের এক উমাশশীর মতো ঠোঁট উল্টে বলে, ইস, তাই বৈকি। দেখো সাহসরো রজুনী হবে! তুমি একবার খোলো দল।
ওইভাবে ঠোঁট উল্টে বলত উমাশশী, আমার কপালে অশেষ দুঃখু আছে? ইস! কেন? দেখো পরে। বলত বুড়ি পিসশাশুড়িকে। যে নাকি বৌয়ের বেচাল দেখে গাল-মন্দ করতে বসত।
উমাশশীর মেয়ে সেই ভঙ্গিতে বলে, ইস, তাই বৈকি। তুমি আগে দল খোলো।
জ্ঞানাবধি দল দেখে আসছে, আর সেই বিরাট দলবল আর তাদের সাজ-সরঞ্জাম, বাক্স বিছানা নিয়ে নিতান্ত অনায়াসে আনাগোনা করতে দেখেছে। দল গড়া যে চারটিখানি কথা নয়, নিমাইয়ের বাবারও যে সে সাধ্য নেই, সে জ্ঞান হয় না লিলির।
লিলি সাজানো আসরে নিজেকে কল্পনা করে, আর বলে, দলটা গড়ে ফেল, জোগাড় যন্তর করো। দেরি কিসের?
আর এ বলে, বিয়েটারই বা দেরি কিসের, নিজেরা নিজেরাই তো করে নিতে হবে। জগাদা বলেছিল। সব ব্যবস্থা করে দেবে। সে তো বেইমানী করল, এলই না। সনাদাটা। তবু মায়ায় পড়ে এসেছে, তা সে তো বোকার ধাড়ি। কার পিত্যেশ?
নিমাই বলে, হবে হবে! সুবিধে হোক—
লিলিবালা ঝঙ্কার দেয়, হবে হবে? আমি মলে? বিয়ে কোথায় তার ঠিক নেই স্বামীসন্ত্রী সেজে বসে আছি, আর যা খুশি করে চলেছ তুমি। এ-সব আমার ভালো লাগছে না।
কিন্তু ভালো কি নিমাইয়ের লাগছে? ওই খুশিটা ছাড়া? প্রোপ্রাইটারের বাক্স থেকে লিলি যে টাকাটা সরিয়ে এনেছিল, সে টাকা তো ফুরিয়ে এল। লিলির গায়ের গহনাগুলো তো গিলটিব, নিজের আঙুলে একটা আংটি পর্যন্ত নেই, উপায়টা কি?
লিলিকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিল নেহাত লোভের বশে। তা ছাড়া অধিকারীকে জব্দ করবার মনোভাবও একটু ছিল। যা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে নিমাইকে!
সেদিন অমন খপ করে বলে বসল, দেখলি? দেখলি লিলির অ্যাক্টো? ওর পায়ের নখের যুগ্য ক্ষ্যামতাও নেই তোদের! অথচ এই সাত বছর ধরে ঘষটাচ্ছিস!
নাও দেখো, যার পায়ের নখের যুগ্যিও ক্ষ্যামতা নেই, তাকে পায়ে বেঁধে নিয়ে চলে আসবার ক্ষ্যামতা আছে কি না নিমাইয়ের।
এত তাড়াতাড়ি হয়তো চলে আসত না নিমাই, সেদিনের অপমানটাও কাজ করেছে। তাছাড়া ভেবেছিল অজানা অচেনা জায়গা থেকে সরে পড়াই সুবিধে। কেউ বলে দেবে না, আরে তাদের তো দেখলাম পেয়ারাতলার বাসে উঠতে।..চলে এসেছে। খরচ চালাতে হাড়ে দুৰ্ব্বো গজাচ্ছে।
এদিকে সনাতন আর উচিত।মতো হোটেল খরচা পাচ্ছে না। অতএব সনাতন দুবেলা শাসাচ্ছে, চলে যাব। বলে দেব গিয়ে অধিকারীকে ৷
লিলিবালা বলে, বলে দিলে তো প্রেথম ফাঁসি তোমার! তুমিও সমান পাপে পাপী। জেরার সময় আমি বলব, তুমিই আমায় ফুসলে এনেছ, নিমাইদা তোমার সঙ্গী মাত্তর। মায়ার প্রাণ তাই এসেছে।
বলবি একথা? সনাতন বলে, মুখে বাধবে না?
বাধবে কেন? তুমি কি কম শয়তান? সেদিন ঝগড়ার মুখে বলনি ওকে, লিলির দায় আমি পোহাতে যাব কেন? তুই কি আমায় ওর ভাগ দিবি? তবে? শয়তান আবার কাকে বলে?…
খাটো স্কার্ট আর আঁটো জ্যাকেটের মধ্যে বন্দী থেকেও লিলি জগৎ-সংসারের কোনো কথা শিখতে বাকি রাখেনি, তাই নববালা বাসমতীদের ভাষার সঙ্গে লিলির ভাষার বিশেষ কোনো তারতম্য নেই।
তবে লিলি জানে নিমাই তার বিয়ে করা স্বামী, শুধু অনুষ্ঠানটা বাকি।-বাকিটা কেবলমাত্র নিমাইয়ের আলস্যের জন্যে হচ্ছে না।
কিন্তু নিমাই? সেও কি তাই জানে?
আহা, কুঞ্জ অধিকারীর কি হল? ভবানী অপেরার প্রোপ্রাইটার মিস্টার দাসের? সে কি আজও পাথর হয়ে বসে আছে? নাঃ, তা বসে থাকলে কি চলে? পৃথিবী বড়ো কঠিন জায়গা। বাস্তব বড়ো নির্মম!