তথাপি কুঞ্জ দাস ভয়ে ভীত হয় না।
কুঞ্জ দাস আবার চোঙের পিছনে মুখ রাখে, আর চোঙের মুখে খানখনে গলায় বলে চলে, চার্জ আপনি আমার নামে একটা কেন, একশোটা আনতে পারেন। বাবুমশায়, আপনিই যখন ইনচার্জ, চার্জের ভঁড়ারটাই তো আপনকার হাতে। কিন্তু তাহলেও আবার একখানা প্রশ্ন রাখতে হয়। বাবুমশায়। প্রশ্নখানা হচ্ছে, অধম কুঞ্জ দাসকে চার্জে ফেলার আগে এ প্রমাণটা দিতে পারবেন কি সমগগ্রে পুলিশ বিভাগে কোথাও ঘুষ নেওয়া নেই, চোর বদমাসদের সাহায্য করা নেই, গাঁটকােটা, পকেটমারদের সহায়তা করা নেই?…জবাবটা স্যর দিতেই হবে।.তারপর আমি আছি, আপনি আছেন, আর আপনার চার্জ আছে।
দারোগাবাবুর মাথার মধ্যে সমুদ্র-রোল। দারোগাবাবুর কানের মধ্যে হাসির কল-কল্লোল। এই ভণিতা, এই বাকচাতুরী, এর সঙ্গে লড়তে পারবেন। তিনি? পারতেন, শুধু দুজনে মুখোমুখি হলে, মাথার ঘিলু বার করে দিতেন অধিকারীর। কিন্তু এখানে সহস্ৰ লোক। আর অন্তরলোকে অনুভব করতে পারেন, সেই সহস্রের ঊনসহস্রই অধিকারীর পক্ষে।
কিন্তু তাই বলে তো চুপ করে থাকা চলে না? দারোগাবাবু তাই যথাসম্ভব গলা চড়িয়ে বলে ওঠেন, এক-আধটা বেচাল লোক সর্বত্রই থাকে অধিকারী, কাজেই তামা-তুলসী নিয়ে শপথ করতে পারিনে। তথাপি আমি নিশ্চয়ই আপত্তি তুলব, এভাবে যাত্ৰা-থিয়েটারের মধ্যে সেই একজনকে টেনে এনে ইয়ে করা। কথা জোগায় না বলেই ইয়ে দিয়ে সারেন দারোগাবাবু। তারপর চেঁচিয়ে বলেন, থানায় তোমায় যেতেই হবে।
হিজ মাস্টারস ভয়েস-এর চোঙ। আবার খনখনিয়ে ওঠে, সে তো বুঝতেই পারছি। সার! আপনকার যখন হুকুম। তবে এটাই বুঝছি না। স্যার, আমার এই নাটকে এই যে একটা অতি কুচরিত্র মেয়েছেলের পার্ট রয়েছে, যে নাকি নিজের স্বামীকে বিষ প্রয়োগের চেষ্টা করছে, কই তাকে দেখে তো। এখানের এই শত শত মা-লক্ষ্মীদের মধ্যে কেউ আপনার মতো ক্ষেপে উঠলেন না? কই বলে উঠলেন না তো—যেহেতু ও মেয়েছেলে, সেই হেতু আমাদের গায়ে অপমানের কালি এসে লেগেছে! তবে সাধ্যমতো বলি-বলবেন কেন? ওনারা—আমাদের সতীসাধ্বী মা-জননীরা জানেন, নাটক-নবেলের কাজই এই! মন্দকে চোখে ধরিয়ে দেওয়া। পাপকে উচ্ছেদের চেষ্টা করা! ওনারা ওই বদ মেয়েছেলেটাকে মোটেই স্ব-জাতি বলে মনে করছেন না। তাই ওনারা নীরবে নাট্যদৃশ্য দেখছেন! তা সে যাক—এখন বলুন বাবুমশায়, নাটক বন্ধ করে এই দণ্ডে আপনকার সঙ্গে থানায় যেতে হবে, না নাটকটা আজ্ঞে শেষ করে যাব? তবে পালিয়ে আমি যাব না। বলুন, এখন আপনার কী আদেশ?
দৰ্শককুল এতক্ষণ যাত্রাপালার বদলে তর্জর লড়াইয়ের আস্বাদ অনুভব করে চুপ করে ছিল। এবার তুমুল হট্টগোল ওঠে, নাটক হোক! পালা চলুক।
দারোগাবাবু এই উন্মত্ত গণদেবতার দিকে তাকান, তারপর আচ্ছা ঠিক আছে— বলে গট গট করে বেরিয়ে যান।
তুমুল হর্ষোচ্ছাসের মধ্যে আবার ভাঙা-পালা জোড়া লাগে। দর্শকরা হাততালি দিয়ে দিয়ে হাতে ব্যথা ধরিয়ে ফেলে।
বলাবাহুল্য পরে দারোগাবাবু তাকে দেখে নেবার চেষ্টাই আর করেননি।
এই। এই বুকের পটা আর বাকচাতুরীর জোরেই কুঞ্জ দাস দলের লোকগুলোকে মুঠোয় পুরে রেখেছে। নচেৎ—জগতের যত শাসন-শোষণ-নিপীড়ন-এর দৃশ্য তুলে তুলে সমাজের চৈতন্য করিয়ে দিতে আসে বলেই যে কুঞ্জ নিজে ওই দোষগুলির বাইরে, তা নয়। দলের লোকদের উপর কুঞ্জর ব্যবহার দারোগার বাবা-সদৃশ। তবে মারধর করে না সে।—কাউকেই না।
ওই লিলিটা তো সেই তিন চার বছর বয়েস থেকে অধিকারীর কবলে, বলুক দিকি মার কোনোদিন খেয়েছে? অধিকারীর শাসননীতি অন্য ধরনের। সে হাতে মারে না, ভাতে মারে। খেতে না দেওয়া হচ্ছে তার প্রধান শাসন। তাছাড়া—খাটানো। সেও এক রকম শাসন। যে যেদিন অপরাধী সাব্যস্ত হয়, তার ওপর দলের সমস্ত লোকের রান্নার ভার পড়ে, কাঠ কাটা, জল তোলা, বাসন মাজার ভার পড়ে। বামুনের ছেলে হলেও রেয়াত নেই।
ব্ৰাহ্মণত্বের গৌরবে কেউ প্রতিবাদ তুললে, কি গোজ হয়ে থাকলে, অধিকারী তার মিষ্টমধুর বচন ঝাড়ে।—
বামুনের ছেলে? অর্থ্যা, কী বললি? বামুনের ছেলে? ওরে বাপধন, সেই দৈব ঘটনাটা এখনও মনে রেখেছিস? ভুলে যা বাপ ভুলে যা! মনে রাখলে শুধু যন্তান্না। ওরে তুই যে একদা বামুনের ঘরে। জন্মেছিলি, সেটা সেরেফ দৈবাতের ঘটনা। মানুষের পেটে কখনও কখনও যেমন তোপয়ে জীব জন্মায়, একটা মাথা দুটা ধড়, আজব প্রাণী জন্মায়, তেমনি!… বামুনের ছেলে! বাসন মাজব না— শুনে হাসিতে যে পেট গুলিয়ে উঠছে রে! বলি-জাত তোর এখনও আছে? বামুনের ছেলের যা যা কত্ত্যব্য করিসি সব? ত্ৰিসন্ধে গায়ত্রী? স্বপাক হব্বিষ্যি? বল? বল বাপা!
আশ্চর্য! তথাপি রাগ করে চলে যাওয়ার ঘটনা প্রোপ্ৰাইটার কুঞ্জ দাসের দলে বিরল ঘটনা! ওই বাক্য সুধা পানের পর অপরাধী ব্রাহ্মণ তার ব্রাহ্মণত্ব বিসর্জন দিয়ে অধিকারীর নির্দেশিত কাজই করে। টিকেও যায়।
তবে শান্তিস্বরূপ দৈবাৎ ভাত বন্ধ করলেও এমনিতে কুঞ্জর এখানে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা দস্তুর মতো ভালো! আর সে খাওয়ায় পক্ষপাতিত্ব নেই। অধিকারী নিজে যা খায়, শতরঞ্জি গুটোবার চাকর কেষ্ট বাগদীও তাই খায়।
ওই যে লিলি, যাকে না কি সবাই ব্যঙ্গ করে বলে থাকে, অধিকারীর পুষ্যপুত্তুর, তারও ওই একই বরাদ্দ। ভালো আয়োজন হল তো ভালো, আর সুবিধে অসুবিধেয় আয়োজন খারাপ হলে খারাপ।