আজ আর হল না। আত্মগোপন করতে। আজি লোকটা গটগটিয়ে বেরিয়ে গেল।
০৬. উনি অন্য ধাতুর
বরুণ আন্দাজে বলেছিল, উনি অন্য ধাতুর। কথাটা ঠিক। অন্য ধাতুরই। নইলে যে লোকটা ওকে অত যাচ্ছেতাই করে গেল, তার জন্যেই ওর মন পোড়ে?
লোকটা যে রাগের চোটে ছাতা মাথায় দিতে ভুলে গেছে, আর ঝিরিঝরি বৃষ্টিটা যেন জোর জোর হয়ে আসছে, এই ভেবেই মন পোড়েনি। উমাশশীর। নিজেও যে ভিজছে, সে কথা মনে থাকে না, ভাঙাবাড়ির ওপারটা পর্যন্ত দেখতে থাকে।
আজ এখনও বেলা আছে, আজ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অন্য দিন তো অনুমানে দেখা। লোকটা যে টার্চ ধরে ধরে যায়, প্রকৃতপক্ষে সেই আলোটাই দেখা। তবু কোনো কোনো দিন, যেদিন জোৎস্নায় ভরা রাত থাকে, সেদিন উমাশশীর স্মরণীয় দিন।
অথচ ওই লোকটাকেই একদিন পুরনো কাপড়ের মতো পরিত্যাগ করে চলে এসেছিল উমাশশী। উমাশশীকে একদিকে টেনেছিল দুরন্ত প্রলোভন, আর একদিকে ঠেলে দিয়েছিল দুরন্ত অভিমান। এই দুই টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে উমাশশীর জীবনের বুনুনিটা ছিঁড়ে-খুঁড়ে জট পাকিয়ে গিয়েছিল।
বৃষ্টিটা জোর হতেই উমাশশীকে ফিরে আসতে হল। এসে দাওয়ায় বসে সেই মেডেলগুলো হাতে তুলে নিল উমাশশী। আর অতখানি অপমানেও যা হয়নি, তাই হল হঠাৎ ৷ হঠাৎ প্রবল বর্ষণে ভেসে গেল তার চোখ গাল বুকের কাপড়।
উমাশশীর বিধাতা উমাশশীকে এত নিষ্ঠুর করে কেন গড়েছিল? কী হত, যদি উমাশশী ওই মেডেলের খবরে আহ্বাদ প্রকাশ করত! উমাশশীর কোন মুখটা আছে যে সেই তিন বছরের মেয়েটার দাবি তুলে, তার যাত্রার আসরে নাচায় ব্যঙ্গোক্তি করল?
উমাশশীর কি সত্যি মেয়ে বলে টান আছে তার ওপর? উমাশশী কি তাকে দেখলে চিনতে পারবে?
বহুবার তো বলেছিল ওই মহৎ মানুষটা, নিয়ে এসে দেখাই, নিয়ে এসে দেখাই। উমাশশীই তো নিষেধ করেছে। নিষেধ করেছে উমাশশী। পাষাণের মতো নিষ্ঠুর বলে। দেখলে নতুন করে মায়ায় জড়াব এটা যে সে ভেবেছিল মনে মনে, ওটা বাজে কথা। পাপের ফল বলে বিতেষ্টা, এটাও বাজে কথা। মনকে চোখ ঠারা! আসলে ভয় ছিল পাছে আবার মেয়েটার দায়িত্ব ঘাড়ে পড়ে। পাছে ও বলে বসে, মেয়ে তো বড়ো হচ্ছে, এবার মায়ের কাছে থাকাই ভালো।
এই, এই ভয়েই উমাশশী লিলি নামের সেই তিন বছরের মেয়েটাকে মা থাকতেও মা নাম ভুলিয়ে রেখেছে!
অবৈধ বলে মমতা নেই, এটা কি সত্যি? নিঃসন্তান নারীচিত্ত, প্রথম যে সন্তানকে কোলে পেল, তার উপর থেকে কি মান সরিয়ে নিতে পারে? তাছাড়া—তখন তো উমাশশী অমল মুখুজ্যের আদরে সমাদরে ভাসছে। কুঞ্জ নামের একটা বুনো-মানুষের জন্যে দুদণ্ড মন খারাপ করে বসে থাকবারও সময় নেই তার। তখন তাই সন্তানে ও ডগমগ।
অথচ সেই সন্তানকে সে দায়িত্ব নেবার ভয়ে বিলিয়ে দিয়ে রেখেছে। বিলিয়ে দিয়েছে না হয়। একটা মহান লোকের হাতে, কিন্তু তার পরিবেশটিা যে মহান নয়, তাতো উমাশশীর অজানা ছিল
যাত্রার দলে আছে মেয়ে, ছেলে সেজে পার্ট করছে। দরকার হলে সখী সাজিছে, এসব তো জানতই উমা। যাত্রার অধিকারী নিঃস্বাৰ্থ, তাই কোনোদিন বলেনি, দিন গুণছি কবে ওটা বড়ো হবে।
বললেই বলতে পারত। উমাশশীর কিছু বলবার ছিল না। যাত্রার দলে মানুষ হওয়া মেয়ে লায়েক হয়ে উঠে আসরে নাচবে, এটাই তো স্বাভাবিক। অথচ এই স্বাভাবিক নিয়মটার বিরুদ্ধেই উমা এমন একখানা প্ৰতিবাদের আস্পর্ধা দেখাল, যা এখন ভেবে মরমে মরে যাচ্ছে সে।
এ আস্পর্ধার কারণ কি? না ভালো লোকটা উদার লোকটা একদা ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল, ওকে আমি বিয়ে দিয়ে ঘর-সংসারী করে দেব।
ঘর-সংসার জিনিসটার ওপর কি তবে এত মোহ উমাশশীর যে, সেই আসা ভয়েস্ক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল? এটা তুলসী মন্দিরের মতো পবিত্র ঘর-সংসার পায়ে ঠেলে দিয়ে চলে এসে কি ঘরসংসারের মূল্য টের পেয়েছে উমাশশী?
দাওয়াতেও আর বসা চলল না। বৃষ্টি প্রবল হচ্ছে। উমাশশী ঘরে গিয়ে ততক্ষণে আছড়ে
ও যদি আর না আসে?—ও যদি সত্যিই মনিঅৰ্ডারে টাকা পাঠিয়ে দিয়ে বসে থাকে?
হ্যাঁ, টাকা ও দেবেই তা জানে উমাশশী। উমাশশী কষ্টে পড়তে পারে, এমন কাজ ও করবে: না। কষ্ট দেওয়া কাজটা উমাশশীরই একচেটে।
উমাশশীর আর একটা ভয়ানক বর্ষার রাতের কথা মনে পড়ে আজ।…মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল, বাজ চমকাচ্ছিল।…অধিকারী কুঞ্জ দাস খাওয়া-দাওয়ার পর বলেছিল, যা দেখছি আজ তো আর যাওয়া হল না।
বলে দাওয়ার ভিতরের জলচৌকিটার উপর উঠে বসেছিল। তারপর নিজ মনে বাতাসকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলেছিল, দাওয়ায় একখানা তক্তপোষ-টক্তপোষ পাতিয়ে রাখতে হবে। এ রকম বেঘোরে পড়ে গেলে বসে রাত কাটাতে হবে না।
উমাশশী তখন কোনো কথা বলেনি। তারপর রাত বোধকরি বারোটা, বৃষ্টি একটু ধরেছিল। তখন উমাশশী ঘর থেকে বলে উঠেছিল, এখন তো বিষ্টি কমেছে, এইবেলা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলে হয়।
লোকটা অবাক হয়ে গিয়েছিল তাতে আর সন্দেহ কি? বোধহয় আশা করেনি এমন কথা শুনতে হবে। তাই বিস্ময়ের গলায় বলে উঠেছিল, এখন রওনা দেব?
তাতে কি? উমাশশী অভয় দিয়েছিল, শুধু এই হাঁটাটুকু! রাতভোর তো ইস্টিশনেই পড়ে থাকা হয়।
ঘরের ভিতরকার অভয়বাণী বৃষ্টির ছাঁট খেয়ে বসে থাকা মানুষটার প্রাণে শীতল বারি নিক্ষেপ করেনি। সে বলেছিল, ওঃ। তা যাচ্ছি। তবে এমন রাতে লোকে বেড়ালটা কুকুরটাকেও দূর দূর করে তাড়ায় না। বলে উঠে পড়েছিল।
আশ্চর্য, উমাশশী এত নিষ্ঠুরতার শিক্ষণ কোথায় পেয়েছিল? তাই উমাশশী ছুটে এসে পথ আটকে বলেনি, আমার ঘাট হয়েছে, মাপ করো। উমাশশী সেই ঘর থেকেই বলেছিল, বেড়ালটা। কুকুরটা হলে তাড়ায় না, মানুষ বলেই উল্টো নিয়ম।