বরুণ আস্তে বলে, তা বটে!
তবে? তবেই বোঝো? কুঞ্জ আবার সাগ্রহে ওর হাত চেপে ধরে বলে, খুকি। সেজে বেড়ায়, তাই খুঁকিপনা করে। আর সর্বদার সঙ্গী তো ওই অকাল কুম্মাণ্ডগুলো? তোমার হাতে পড়লে দেখো! ভোল বদলে যাবে। মাতৃগুণ বলেও তো একটা জিনিস আছে লেখক?
বরুণ চুপ করে থাকে।
কুঞ্জ বলে, তাহলে কথা দিলে?
দিলাম।
কুঞ্জর এতক্ষণের উত্তেজনা সহসা স্থির হয়ে যায়। কুঞ্জ জামার হাতটা চোখে ঘসে ঘসে চোখের জল মোছে।
তারপর কুঞ্জ মনে মনে ছক কেটে ফেলে। ধাড়াবাড়ির বায়না হচ্ছে সামনের পূর্ণিমায়, হাতে এখনও চার-পাঁচটা দিন। এরমধ্যেই শুভ কাজটা সেরে ফেলে উমার কাছে নিয়ে যেতে হবে। আর এই বরুণকে দিয়ে হাতজোড় করিয়ে আর একটা শোর জন্যে অনুমতি চাইয়ে নিতে হবে। বায়না করেছে, অগ্রিম টাকা দিয়েছে, দশদিন ধরে এতগুলো লোককে পুষছে, না করলে মহা অধৰ্ম।…
তাছাড়া বড়োলোকের মেজাজ, হয়তো লিলির বদলে চারুকে দেখলে পুলিশ কেস করতে আসবে। জামাই গিয়ে ধরলে না করতে পারবে না।
ভেঙে পড়া কুঞ্জ একটা মানুষের আশ্বাসবাক্যে আবার যেন চাঙ্গা হয়ে ওঠে। অবোধ হৃদয়টা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে বসে, জামাই দেখে বিগলিত হয়েছে উমা, পুরনো জেদ বিসর্জন দিয়েছে। মুখ দেখাতেই হাসছে, কথা কইছে, তাদের খাওয়াচ্ছে, আর. হঠাৎ আহাদ করে বলে উঠেছে— জামাইয়ের লেখা পালা, মেয়ের অ্যাক্টো, তবে চল দেখেই আসা যাক।
কিন্তু কি জানি, কেমন দেখতে হয়েছে এখন সেই মুখ! এই দীর্ঘদিনে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে আসতে অবগুণ্ঠনে ঢাকা মানুষটার শুধু হাতের একটুখানি দেখেছে কুঞ্জ। মুখ দেখেনি। জানে না বয়সের ছাপ কতটা পড়েছে তাতে।.
লিলি হকচাকিয়ে যাবে। ভাববো মা আছে আমার, জন্মে জানতাম না সেকথা, হঠাৎ এই পরীর মতো মা! হঠাৎ পরী শব্দটাই মনে আসে কুঞ্জর, দেবী নয়। অথচ সেটাই হলে ভালো হত।. হয়তো কুঞ্জর এই বিশেষণটা পূর্বস্মৃতির উপর নির্ভরশীল।
কুঞ্জ তাই ভাবে—ওই পরীর মতো মাকে দেখে আহ্লাদে হয়তো মূৰ্ছা যাবে ছুড়ি।…
আর কুঞ্জ এই ভেবে মুছাহত হয়, আলোকোজজুল আসরে সামনে এসে বসেছে নায়িকার মা। তার গৌরব কতা! কিন্তু ওর বেশভূষাটা কেমন?
সধবার মতো তো? না কি বিধবার মতো? অমল মুখুজ্যে মরেছে বলে কি লোক দেখিয়ে বিধবা সাজতে হয়েছিল বামুন বৌকে, সর্বাঙ্গে চাদর মুড়ি দিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিল, এসেছিল, রেলগাড়িতে ট্যাক্সিতে সবই একরকম। কে জানে, সে এখনও সিঁদুর পরে কিনা, শাখা পরে কিনা।
আচ্ছা, যদি ওই অমলটার কথা মুছে ফেলে থাকে ও, যদি নিজের পুরনো জীবনের সাজেই অবিচল থাকে?
তাহলে তো আবার লিলির মায়ের সঙ্গে সঙ্গেই লিলির বাপকেও ডেকে আনতে হয়। কুঞ্জ কি তবে এবার সেই পোস্টটা পাকাঁপাকি দখল করবে? তা করতে তো হবেই কুঞ্জকে। কন্যা সম্প্রদান করতে হবে না?
কিন্তু বিয়েটা এত তাড়াতাড়ি কোথায়—কুঞ্জর চিন্তায় বাধা পড়ল। কারণ কুঞ্জর এই বন্ধ দরজায় জোরে জোরে ঘা পড়ল। নিশ্চয় খেতে ডাকছে।
কুঞ্জ এতক্ষণে অনুভব করে খিদেয় পেটটা জ্বালা করছে। কুঞ্জ তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে দেয়।
কিন্তু কুঞ্জকে কি ওরা খেতেই ডাকতে এসেছিল? অনেক বেলা হয়ে গেছে বলে বিচলিত হয়ে ওর বকুনির ভয় ত্যাগ করে? পাগল? এত ভালো কে বাসছে কুঞ্জকে? ব্ৰজ?? বিপিন? নববালা?
ওরা দরজায় ধাক্কা দিয়ে কুঞ্জকে উপহার দিতে এসেছে একমুঠো জ্বলন্ত আগুন। যে আগুনে কুঞ্জর ওই দিবাস্বপ্নটি পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। সেই আগুনটা একটা খবর। কিন্তু আগুন তো খবরেরই হয়।
ওরা বলতে এসেছে, বহুক্ষণ অপেক্ষা করে করে এবার অধিকারীকে না জানিয়ে পারছে না, লিলি, নিমাই আর সনাতন সেই ভোর সকালে কালী মন্দির দেখতে যাব বলে বেরিয়েছে, এখনও দেখা নেই। এরা অধীর হয়ে ঘর বার করতে করতে হঠাৎ সন্দেহের বশে ওদের ঘর দেখতে গিয়েছিল, দেখেছে তিনজনেরই জামাকাপড় জিনিসপত্র, সুটকেস, গামছা আর্শি চিরুণী—সবই নিশ্চিহ্ন।
তার মানে পালিয়েছে। অথচ আশ্চর্য, কেউ এটা স্বপ্নেও সন্দেহ করেনি। আরও আশ্চর্য জিনিসপত্রগুলো পাচার করল কি করে? নিশ্চয় রাতারাতি কোথাও সরিয়ে রেখেছিল!
কুঞ্জ যদি শুধু শুনত ওরা সেই ভোরবেলা কোথায় না কোথায় গিয়ে এখনও ফেরেনি, তাহলে কুঞ্জ পাগল হয়ে ছুটোছুটি করত। কিন্তু এরা শুধু সেই খবরটাই দেয়নি, এই জিনিসপত্রের খবরও দিয়েছে। কুঞ্জ তাই পাথরের মুখচোখ নিয়ে বসে আছে।
কিন্তু যে লোকটাকে দেখা যাচ্ছে, সে-ই শুধু পাথর হয়ে যেতে পারে? আর অরণ্যবাসের অন্তরালে যে মানুষটা নিজেকে আরও আড়াল করে রেখে দেয় দেওয়ালের আড়ালে, অবগুণ্ঠনের আড়ালে? সে? না কি নতুন করে পাথর হবার আর অবকাশ নেই তার? পাথর দিয়েই বুক বাঁধা তার? না হলে অতবড়ো অপমানের পরও তো ছুটে গিয়ে পুকুরে ঝাপ দিল না সে? এমন কি মাথাও ঠুকলি না, কেঁদেও ভাসাল না!
সে শুধু বেড়ার ঝাপটা বন্ধ হবার শব্দ পাবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে উঠোনে নেমে পড়ে ঝাপ খুলে বেরিয়ে একটা গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। দেখল বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝিরিয়ে, তবু ছাতাটা হাতে নিয়েই চলেছে লোকটা। দেখতে পেল চলেছে, তারপর একটা ভাঙা বাড়ির আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর আবার অনেক দূরে দেখা গেল।
দ্রুতদৃপ্ত ভঙ্গি! যে ভঙ্গি বহুকাল দেখেনি। উমাশশী। ইদানীং যে ভঙ্গিটা দেখতে পায় এই গাছের আড়াল থেকে, সে ভঙ্গি শিথিল অনিচ্ছা-মন্থর। যায় যায়। আর ফিরে ফিরে তাকায়। উমাশশীকে তাই আত্মগোপন করে থাকতে হয়।