বরুণ মাথা নাড়ে।
হঠাৎ কুঞ্জ সন্দিগ্ধ গলায় বলে, গল্পটা তুমি ধরতে পারছ তো, লেখক?
বরুণ ওর দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে বলে, পারছি।
হ্যাঁ, কি বলছিলাম? সেই চোরের দৃষ্টি, না? তা সেই চোরের দৃষ্টি পড়ার পর যা হয় তাই হল।
মুক্তোর মালা হাওয়া হয়ে গেল! বুঝলে নাট্যকার? বাঁেদরটা ঘরে এসে দেখে ঘর খালি। তখন বুঝলে, তখন সেই শূন্য ঘর দেখে বাঁদরটা টের পেল তার কী ছিল! তখন বুঝল। কিন্তু তখন আর উপায় কি? হতভাগাটা তখন—
কুঞ্জর গলাটা বসে আসে। আর সেই বসা গলায় সে এক হতভাগা বাউণ্ডুলের কাহিনি বলে চলে, যা পালাকার বিরুণের বুঝতে অসুবিধে হয় না।—অসুবিধে হয় না, সে শুধু বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে শুনে চলে একটা অবোধ প্রেম-কাহিনি! যে প্রেমিক জানে না সে ভালোবাসছে। যে শুধু ভেবে এসেছে, না করলে চলবে কেন, মানুষ বৈ তো জানোয়ার নয়। সে!
আশ্চর্য, অধিকারী কুঞ্জ দাস, রািগচটা রূঢ়ভাষী নিতান্ত গ্রাম্য চেহারার এই লোকটা, সে এমন কবিত্বের ভাষা পেল কোথায়? জীবনভোর যাত্ৰা-গান করে আর দেখে? নাকি এই ঘর-ছাড়া বরুণটা তার এই উন্নতি সাধন করেছে?
ভাবের সন্ধান দিয়েছে, তাই ভাষা এসেছে তার পিছু পিছু! সেই ভাষা আসছে কুঞ্জ অধিকারীর জিভো, চোরটা আবার আর এক বঁদের। বুঝি বাঁেদরও নয়, ভালুক। তাই মুক্তোর মালাটা নিয়ে গলায় না। পরে তাকে ছিঁড়ে ছড়িয়ে ফেলে মাড়িয়ে নিজে মিরাল। তারপর-
০৫. বেলা বেড়ে উঠেছে
বেলা বেড়ে উঠেছে। ও-বাড়ি থেকে বিপিন ব্রজ সনাতন অনেকে এই কাছারি বাড়িতে এসে উঁকি দিয়ে গেছে, দু-দুবার ডাকের পর তাদের মুখের ওপর ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে কুঞ্জ। বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বরুণকে বলেছিল, তোমার চান আহার হয়েছে তো?
বরুণ মৃদু হোসেছে। কুঞ্জ সেই হাসিটার অর্থ খুঁজতে বসেনি। কুঞ্জ তার কাহিনির হারিয়ে যাওয়া সূত্র খুঁজতে অতীত হাতড়েছে।
বন্ধ দরজার মধ্যে সেই মৃদু কণ্ঠের কথন, বরুণের চোখে খুলে দিয়েছে একটা বন্ধ দরজার কপাট। সেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বরুণ আস্তে বলেছে, সেই মেয়ে! আপনি তাকে? আশ্চর্য!
কুঞ্জ স্নান হেসে বলে ভাবলে তাই মনে হয় বটে, কিন্তু আরও তলিয়ে ভেবে দেখলে জগতে কিছুই আশ্চর্য নেই, লেখক! সবাই তো মনের ওপর নির্ভর। সেই মনটা দিয়ে তোমাকে আমি পরম বন্ধু ভাবতে পারি, পরম শত্ৰুও ভাবতে পারি। সেদিন যখন সেই অকস্মাৎ গিয়ে পড়ে আমাদের গ্রামের সেরা বড়োলোক কমল মুখুজ্যের ছেলে অমল মুখুজ্যের মড়াটাকে একটা বস্তির উঠোনে বঁশের খাঁটিয়ায় পড়ে থাকতে দেখলাম, হঠাৎ যেন চোখের সামনে থেকে একটা পর্দাঁ খুলে গেল। দেখলাম জগৎ সংসারের এই লীলাটার যেন কোনো মানেই নেই। যেন একটা হাসির ঘটনা। তোমরা যেমন হাসির নাটক লেখো, বিধাতাপুরুষ তেমনি একখানা বড়োসড়ো হাসির নাটক লিখে রেখেছেন। পার্টগুলো প্লে করছি আমরা।…মরে গেলাম, ফুরিয়ে গেল—ব্যস।.ওই মেয়েটাকে যদি আমার শত্রুর মেয়ে না ভেবে আমারই মেয়ে ভাবি? হলটা কি? কিছু না। অনেক ল্যাঠা মিটে গেল। বরং! আর উমা? তাকে তো মরবে বলেই হাসপাতালে দিয়ে এসেছিলাম। যখন দেখলাম ফিরে এল, তখন আহাদে দিশেহারা হয়ে—
কুঞ্জ চুপ করে একটু।
বরুণ সেই অবসরে মৃদু হেসে বলে, দিশেহারা হয়ে ভাবলেন ছড়ানো মুক্তোগুলো দিয়ে আবার মালা গাঁথি?
কুঞ্জ ওর দিকে তাকায়। আস্তে বলে, তা ঠিক নয়, লেখক! অতটা আশা করিনি, শুধু ভেবেছিলাম—না, কিছুই বোধহয় ভাবিনি। শুধু একটা নেশার অভ্যেসের মতো করে চলেছিলাম। তা কাল তো ভালোই করে এলাম। এখন শুধু ভাবছি তার কাছে মুখ দেখাবার একমাত্র পথ হচ্ছে—
আগেই কথা হয়ে গেছে। তাই থেমে যায় কুঞ্জ। তারপর বলে, জানি না সে সময় মিলবে কি না। হয়তো আত্মঘাতীই হয়ে বসবে—
বরুণ মাথা নেড়ে বলে, না, তা মনে হয় না। যে রকম শুনলাম, সে ধাতুর মেয়ে নয় বলেই মনে হয় তাকে ৷
হয়তো তাই হবে। তবে টাকা আর নেবে কি না সন্দেহ! টাকার খোঁটাটা মোক্ষম দিয়ে এসেছি কি না!
তাও বলা যায় না, হয়তো নেবেন।
কুঞ্জ ব্যগ্রভাবে বলে, নেবে? তুমি কি করে জানিছ বলত?
এমন অনুমান! আপনার প্রকৃতি ওঁর জানা। যেমন আমরা একটা বই পড়ে তার সবটা বুঝে ফেলি, প্রায় তেমনি। উনি জানেন আপনার মুখের কথা যাই হোক, ভেতরের ভাবটা কি।
কুঞ্জ গম্ভীর গলায় বলে, এবার বুঝতে পারছি বরুণ, কেন তোমায় সুপােত্র বলে ভাবছি? পালা লেখো বলে নয়। মানুষ বলে। চোখ কান আন্দাজ অনুভব সমেত আস্ত একটা মানুষ বলে। আমার অনুরোধ রাখবে না বরুণ?
বরুণ মাথা নীচু করে বলে, দেখুন, জীবনের ছক কেটেছিলাম অন্য রকম, সে ছক হচ্ছে কোনোখানে স্থিতু হব না, স্নেহের বন্ধনে বাঁধা পড়ব না, ভেসে ভেসে বেড়াব। কিন্তু অজান্তে কখন যে আপনার কাছে বাধা পড়ে বসে আছি! শেকড় গজিয়ে গেছে, টেরই পাইনি। এখন হঠাৎ টের পাচ্ছি। কিন্তু লিলি তো আপনার সত্যি মেয়ে নয়? তার মধ্যে অন্য প্রকৃতি, অন্য স্বভাব।
কুঞ্জ বোঝে বিরুণের বাধাটা কোথায়। কিন্তু কুঞ্জ তার সেই একান্ত স্নেহপাত্রীটিকে বোঝে না। তাই কুঞ্জ সাস্ত্ৰনার গলায় বলে, তা আমি স্বীকার করছি লেখক, মেয়েটা হালকা স্বভাবের। বয়স পেরায় পনেরো ষোলো হল, তবু জ্ঞান বুদ্ধি হয়নি। তবে হবে। আমি বলছি হবে। ভেতরে বস্তু মাত্ৰ না থাকলে দুটো দিনের রিহার্সালে আমন প্লেখানা করতে পারত না। তোমার লেখা ভাষার মানে বুঝেছে ও, বলছি আমি তোমায়। মানে না বুঝলে—