ওকে সময়ে বিয়ে দিয়ে সংসারী করার ইচ্ছেটা আমার ছিল। যেই স্বার্থের গন্ধ পেয়েছি সেই ছল উড়ে গেছে।
হঠাৎ একটা অসমসাহসিক প্রতিজ্ঞা করে বসে কুঞ্জ দাস। হ্যাঁ, দুএকদিন পরেই লিলিকে নিয়ে তার মায়ের কাছে যাবে কুঞ্জ, কিন্তু এক লিলিকে নিয়ে নয়, জোড়ো নিয়ে। দেখিয়ে দেবে উমাকে সবটাই তার ছিল ছিল না।—বরুণের কাছে হাতজোড় করে বলবে, এই বিয়েটা না হলে একটা লোক আত্মঘাতী হবে। এ তোমাকে করতেই হবে।
কুঞ্জ যখন পৌঁছল, তখন সকালের সূর্য মধ্যাহ্ন আকাশে। কুঞ্জ বসে পড়ে বলল, এক গেলাস জল!
জল দিল বাসমতী। দুচক্ষে যাকে দেখতে পারে না কুঞ্জ।
জলটা তক্ষুনি চৌ-ৰ্চো করে খেয়ে না নিয়ে ভুরু কুঁচকে বলল, লিলি কোথায়?
বাসমতী খনখনে গলায় বলে উঠল, সেই সকালে উঠে কোথায় কি কালীঠাকুর আছে, সেখানে নাকি নরবলি হত, তাই দেখতে গেছে।
কুঞ্জ আঁৎকে ওঠে, একলা?
একলা কেন? বাসমতীর গলা আরও খনখনায়, পেরাণের বন্ধু নিমাইদা গেছেন সঙ্গে—
থামো, চুপ করো। কুঞ্জ ওর বিরক্ত চিত্তের ভাবটা এটা প্রচণ্ড ধমকের মধ্যে দিয়ে কিছুটা লাঘব করে নিয়ে বলে, এলে আগে আমার কাছে আসতে বলবে।
তারপর কুঞ্জ ও-বাড়ি চলে যায়। যে বাড়িতে বরুণ আছে।
যারা ভবানী অপেরাকে এনেছিল তাদের মেয়াদ মিটে গেছে, তবে পাশের পাড়ায় আর একটা বায়না জুটেছে বলে কুঞ্জর দলকে এরা থাকতে দিয়েছে। কিছু লোককে কাছারি বাড়িতে, কিছু লোককে বসতবাড়ির বৈঠকখানায়। সেই কাছারি বাড়ির দোতলাতে বিরুণের স্থিতি। কুঞ্জ সেখানে গিয়ে বসে।
বরুণ হাতের কাজ রেখে বলে, মিস্টার দাস এসে গেছেন? কতক্ষণ? সুন্নানটান হয়নি এখনও?
কুঞ্জ অগ্রাহ্যুভরে বলে, নাঃ! মরুকগে স্নান। দুটো কথা শোনার সময় হবে তোমার, বরুণ?
বরুণ একটু চমকায়।
কুঞ্জ কখনো বরুণ বলে ডাকে না।
তবু বরুণ সে প্রশ্ন তুলল না। শুধু বলল, কী আশ্চর্য, সময়ের অভাব কি? বলুন।
বরুণ, কুঞ্জ আবেগের গলায় বলে, আমার ওই মেয়েটাকে তোমায় নিতে হবে বরুণ!
এবার বরুণ চমকায়।
আর প্রায় রুক্ষ গলায় বলে ওঠে, কী বলছেন?
হ্যাঁ, জানি তুমি চমকে উঠবে, কুঞ্জ ওর হাতটা চেপে ধরে বলে, তবু তোমাকে এটি করতেই হবে। নচেৎ একটা মানুষ আত্মঘাতী হবে।
বরুণ অবাক দৃষ্টিতে তাকায়।…লোকটা কি অসময়ে নেশা-টেশা করে এল নাকি! আস্তে বলে, আমি আপনার কথার মানে ঠিক বুঝতে পারছি না।
কুঞ্জ জেদের গলায় বলে, মানে পরে বুঝো, তুমি আগে কথা দাও।
তাই কখনও সম্ভব, মিস্টার দাস-আপনিই বলুন?
কিন্তু অসম্ভবই বা কিসে বরুণ? লিলি দেখতে বলতে গেলে সুন্দরী, আর ধরে নাও আমার নিজেরই মেয়ে। কাজে কাজেই আমরা সর্বস্বই ওর, মানে তোমার হবে। জীবনের আর কোনো চিন্তা থাকবে না, তুমি শুধু নিজমনে লিখবে, সুখে স্বচ্ছন্দে থাকবে।
বরুণ হেসে ফেলে। বলে, সুখে থাকব কি না জানি না, তবে স্বচ্ছন্দে থাকতে পাব তা ঠিক। এখন যেমন রয়েছি। রাস্তায় রাস্তায় না-খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, আপনি—আপনার সেই দয়ার ঋণ শোধ দেবার নয়। কিন্তু একটা কথা জিগ্যেস করি, আপনার সর্বস্ব পণ দিয়ে সুন্দরী মেয়েটিকে হাতে তুলে দেবার মতো এমন কি দামি পাত্র আমি?
দামি! দামি! কোহিনুর হীরে! কুঞ্জ আতিশয্য দেখায়, চিনেছি বলেই বলছি। মেয়েটাকে বড্ড ভালোবাসি বলেই বলছি বরুণ! তা ছাড়া ও একজনার গচ্ছিত ধন, ওর যদি ভালো ব্যবস্থা না করি, ধর্মের কাছে পতিত হতে হবে। আমায়।
কিন্তু আমি যদি বলি— বরুণ দৃঢ় গলায় বলে আমার মতো একটা রাস্তার লোক, যার জািত-জন্মের ঠিক আছে কি নেই, তার হাতে তুলে দেওয়াটাও আপনার এমন কিছু ধর্ম হবে না।
সে আমার ভাবনা।
কুঞ্জ আত্মস্থ গলায় বলে, জাতের পরিচয় কি তার গায়ে লেখা থাকে লেখক? থাকে, তার আচরণে। ওই সনা ব্যাটা তো বামনা। ভট্টচায্যি বামুনের ছেলে। ওর আচরণটা ভাবো? মনে হয়। চাঁড়াল। আর এই আমি? কায়েতের ঘরের ছেলে, কী আচরণ আমার? ওসব জাত-ফগত ছেড়ে দাও।
তা না হয় ছেড়ে দিলাম— বরুণ কঠিন গলায় বলে, কিন্তু জন্ম? সেটা ছাড়তেও আপত্তি নেই আপনার—আমি ভালো পালা লিখতে পারি বলে?
কুঞ্জ এতক্ষণ ওর হাত ধরে রেখেছিল, এবার আস্তে ছেড়ে দেয়। কুঞ্জর মুখে একটা ঝাপসা রহস্যের হাসি ফুটে ওঠে। কুঞ্জর কপালে শুকিয়ে-ওঠা ঘামের চিহ্নগুলো আবার ফুটে ওঠে। কুঞ্জ কেঁচার খুঁট তুলে ঘাম মুছতে মুছতে বলে, তবে—তোমাকে একটা কাহিনি শোনাই লেখক, শোনো। হয়তো তোমার একটা নাটকের প্লট হয়ে যাবে।
বরুণ বাধা দিয়ে বলে, কিন্তু তারও আগে আপনি স্নান আহার করে নিলে হত না?
নাঃ, ওসব আপদ বালাই এখন থাক বরুণ, আমার মনের মধ্যে এখন সমুদুর উথলোচ্ছে। এই গল্পটা আগে শোনাই তোমাকে, তারপর বুঝতে পারবে কেন তোমায় অকস্মাৎ অমন কথাটা বলে ফেললাম!
বরুণ খাতা-পত্ৰ সরিয়ে রেখে বলে, বলুন!
কুঞ্জ তার চেহারার সঙ্গে বেমানান আবেগের গলায় বলে, দেশটার নাম করব না, শুধু বলি। এক দেশে একটা বাঁদরের গলায় একটা মুক্তোর মালা ছিল। মালাটা জুটেছিল বাঁেদরটার ঘরে কিছু পয়সা ছিল বলে। তা হতভাগা বাঁদর বৈ তো নয়? সে ওই রাজার গলার উপর্যুক্ত মুক্তোর মালার মর্ম বুঝত না, তাকে ঘরে ফেলে রেখে পাড়ায় এক সখের থিয়েটারের দল খুলে সেখানেই রাতদিন পড়ে থাকত। কখনও গোফ কমিয়ে মেয়ে সাজত, কখনও গোফ লাগিয়ে ডাকাত সাজিত।
ঘরে ভাত ছিল, তাই পেটের ধান্ধা ছিল না। কিন্তু ওদিকে দরজা-খোলা ঘরে মুক্তোর মালা পড়ে, চোখের দৃষ্টি পড়বে সেটা আশ্চয্যির নয়। বল লেখক, আশ্চয্যি?